#আমার_হায়াতি
পর্ব : ৩৮
লেখিকা : #Nahar_Adrita
মা হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অলৌকিক ক্ষমতা। গর্ভবতী নারী তার শরীরে ভবিষ্যৎকে ধারণ করে, তার হাসি যেন নতুন জীবনের প্রথম সুর। একজন মা বুকের ভেতর বহন করেন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ধন, কারণ গর্ভবতী নারী শুধু একজন নারী নন, তিনি আগামী প্রজন্মের আলো। মায়ের গর্ভই হলো প্রথম বিদ্যালয়, প্রথম আশ্রয় আর জীবনের প্রথম নিরাপত্তা।
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে আরো একটি মাস, একসপ্তাহের মাঝের যেকোনো দিন হায়াতের বেবির আগমন ঘটবে। আলিয়া বেগমের সাথে অনেকবার যাওয়ার চেষ্টা করেছে হায়াত,কিন্তু আদিব তাকে যেতে দেয় নি, এমনকি বাড়ির কেউই রাজি হয় নি।
এদিকে মিনহাজা পালিয়ে গিয়েছে সতেরো দিন হবে। বাড়ির সকলে অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তাকে পায় নি, কিছুদিন পর অচেনা নাম্বার থেকে মিস্টার রাকিব চৌধুরীর ফোনে মেসেজ আসে – আমাকে খুজে লাভ নেই, বড় বাবা, আব্বু তোমরা টেনশন করো না, আমি যেখানে আছি ভালো আছি।
ব্যাস সকলের আর বুঝতে বাকি রইলো না , মিনহাজা নিজের ইচ্ছেতেই অন্য একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। সকলের মাঝে মিনহাজাকে নিয়ে রাগ অভিমান থাকলেও, হায়াতের এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে আছে কখন তার ডেলেভারি হবে আর এই রাজের সন্তান গুলো থেকে মুক্তি পাবে সেই চিন্তায়।
আজ রবিবার………
হায়াত বেলকনিতে বসে বসে আনমনে ফোন স্ক্রল করছে, এমন সময় তার কাছে এলো আরাবি, আরাবিকে এক পলক দেখে পুনরায় ফোনের স্ক্রিনে তাকালো হায়াত, আরাবি কিছু না বলে হায়াতের পাশে বসলো,এ আর নতুন না,, হায়াতের এমন ব্যাবহার পুরো একটা মাস ধরে মেনে নিয়েছে বাড়ির সকলে।
আরাবি মুচকি হেসে হায়াতের মাথায় হাত দিলো,
— হায়ু পাখি এতো টেনশন করছিস কেনো ? দেখবি বেবিরা সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবে দুনিয়ার আলো দেখবে।
আরাবির কথায় হায়াত এক পলক তাকালো হায়াত, মনে মনে ভাবতে লাগলো – ওদের নিয়ে আবার চিন্তা …. হাহ্ ওগুলো তো আমার গর্ভের কলঙ্ক, ওদের নিয়ে আবার চিন্তা করতে যাবো কেনো।
হায়াত আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। আরাবিও গুন গুন করতে করতে রুম থেকে বের হলো।
দশ মিনিট পরই আদিব রুমে প্রবেশ করলো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলতে লাগলো, এমন সময় হায়াত বের হলো, আদিব কিছু না বলেই বেলকনিতে গিয়ে দড়িতে শার্ট ছড়িয়ে দিলো।
রুমে এসে হায়াতের পাশে দাড়ালো,হায়াত মাথা নিচু করে ওড়নার একপাশ আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগলো। আদিব হায়াতের কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
— ঔষধ খেয়েছ ?
— হু….!!
আদিব আর কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পরলো। হায়াত ডিভানে বসে মুভি দেখতে লাগলো, হঠাৎ করেই পেটে কেমন যেনো চাপ অনুভব করলো। চোখ বন্ধ করে পেটে হাত দিতেই খানিকটা আঁতকে উঠল, বেবিরা নড়াচড়া করছে না।
দাঁতে দাঁত চেপে আদিবকে জুড়ে এক চিৎকার দিয়ে ডেকে ওঠলো,
— আদি ! আমার বেবিরা নড়াচড়া করছে না, আহ্ আব্ আমার ব্যাথা করছে।
আদিব তাড়াহুড়ো করে বিছানায় থেকে এক লাফে নেমে পরলো,
— কি হয়েছে পাখি, ব্যাথা করছে ?
— আমার কষ্ট হচ্ছে, আব্ আমি………………..হায়াত আর কিছু বলতে পারলো না,তার আগেই জ্ঞান হারালো।
আদিব হায়াতকে তার বুকে চেপে ধরলো, আর এক মূহুর্ত দেরি না করে সকলকে ডাকতে লাগলো,সকলে তাড়াতাড়ি করে রুমে আসলো। আদিব আর আসিফ দু’জনে মিলে হায়াতকে কোলে তুলে নিল, এতো ভারি শরীর আদিবের একা উঠানো রিস্ক, যদি বাচ্চাদের কিছু হয়ে যায়।
সন্ধ্যার নিস্তব্ধ ছয়টায়, হায়াতকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এলো আদিবরা। করিডরে টানটান উত্তেজনা, নার্সরা ছুটে এসে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো তড়িঘড়ি করে। রাকিব চৌধুরী থরথর হাতে ছেলেকে ধরে ওয়েটিং চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। আসিফ, নুপুর আর আরাবি উদ্বিগ্ন চোখে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো—সবার মুখেই নিস্তব্ধ প্রার্থনা।
সময় যেন থমকে গেলো, দীর্ঘ তিন ঘন্টা ছিলো একেকটা দিনের সমান হয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই নীরবতার বুক চিরে ভেসে এলো নবজাতকের কান্না। সবার চোখে জল এসে গেলো আনন্দে,নুপুর আর আরাবি খুশিতে প্রায় চিৎকার করে উঠলো। আদিব তড়িঘড়ি করে O.T রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, বুকের ভেতর কেমন অজানা কাঁপুনি।
ঠিক তখনই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো দু’জন নার্স, দু’হাতে সাদা তোয়ালের ভাঁজে নরম প্রাণদুটি। একজন নার্স আদিবকে দেখে হেসে বললো,
— কংগ্রাচুলেশনস, মিস্টার চৌধুরী। আপনার ঘরে এসেছে এক পুত্র আর এক কন্যা।
শুনে আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়লো চারপাশে। আরাবি আর নুপুর উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠলো, মিসেস অরোরা এগিয়ে এসে চোখ ভিজিয়ে আদিবকে বাবুদের কোলে নিতে ইঙ্গিত করলেন।
কিন্তু আদিবের চোখে তখনো অদ্ভুত উৎকণ্ঠা, তার ঠোঁট কেঁপে উঠলো উদ্বেগে। নবজাতকের কান্না, চারপাশের আনন্দ—সবকিছু ছাপিয়ে সে কেবল এক প্রশ্নই উচ্চারণ করলো স্তব্ধ কণ্ঠে,,
— আমার স্ত্রী… হায়াত কেমন আছে ?
ঠিক তখনি ডক্টর বের হয়ে আসলো,,
— আপনার স্ত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ আছে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
এবার যেনো আদিবের দেহে প্রাণ আসলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফুঁকে মেয়েকে কোলে নিয়ে কানের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে আজান দিতে লাগলো। মেয়ে বেবির দিকে তাকাতেই মিসেস সুফিয়া মুচকি হেসে বললো,
— আরেহ্ মেয়ে বাবুটা তো দেখতে একদম আদিবের মতো হয়েছে।
মিসেস অরোরাও হেসে বললেন,
— ছেলে বাচ্চাটা তো হায়াতের মতো হয়েছে।
এরপর আদিব ছেলে বাচ্চার কানেও আজান দিলো। দুজনকে একসাথে কোলে নিয়ে কিছু পিক তুলে নিল। আসিফ আর আরাবিও বাবুদের কোলে নিলো। আরাবি টেডি স্মাইল দিয়ে বললো,
— দেখেছেন আসিফ, আমি বলেছিলাম না আমাদের বেবি গার্ল হবে।
আসিফ একটু ভাব নিয়ে বললো,
— কেনো ছেলেও তো হয়েছে।
নুপুর এসে আসিফ আর আরাবির ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আরে ঝগড়া করে সময় নষ্ট করছো কেনো, এখন তো কুটু পাখিদের নামও রাখতে হবে।
একটুপরই দরজা খুলে স্ট্রেজে করে হায়াতকে নিয়ে বের হলো। আদিব সহ সকলে হায়াতের পেছন পেছন যেতে লাগলো। হায়াতের জ্ঞান আরও পরে আসবে। চারতলার একটা ১২০ নাম্বার কেবিনে নিয়ে শুয়ে দিলো, সাথে স্যালাইন চলছে।
বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সবাই পাশের ছোট্ট বিছানায় শুইয়ে দিল। আদিব হায়াতের পাশে বসলো কপালে অনেকগুলো চুমু একে দিলো। পরম আবেশে ক্যানোলা লাগানো হাতে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিলো। মিন মিন করে বললো – আমার জান, আমি জানি তো, তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে, মা হওয়া এতটাও সহজ নও, থাক এখন আর কোনো টেনশন নেই। এই বলে হায়াতের ঠোঁটে আলতো করে পরশ একে দিলো। সকলে মিটি মিটি হাসছে। আদিব কিছু কাজপর জন্য বাইরে গেলো।
প্রায় চার ঘন্টা পর হায়াতের জ্ঞান ফিরে আসলো। আলতো করে তাকাতেই দেখলো সে হসপিটালে। হাত একটু নড়াচড়া লাগতেই স্যালাইনে টান পরলো। মিসেস অরোরা আর সুফিয়া ছুটে আসলো, হায়াত দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— আব্ আম্মু পানি খাবো।
একজন নার্সের সাথে কথা বলে মিসেস অরোরা হায়াতকে একটা ছোট্ট বোতলের মোখা করে পানি খাইয়ে দিলো। আরাবি এসে বাবুদের হায়াতের পাশে শুইয়ে দিতেই, হায়াত মুখ কুঁচকে ফেললো।
— আমার আদি……আব্ আদি কোথায়।
এই বলেই হায়াত হাতের স্যালাইন এক টানে খুলে ফেললো। চিৎকার করে কান্না করতেই হায়াত অসম্ভব ব্যথা অনুভব করলো পেটে। নুপুর ছুটে গিয়ে নার্সকে ডাকলো, তৎক্ষনাৎ আদিব এসে হায়াতকে আলতো করে বুকে টেনে নিলো। হায়াত অর্ধেক জ্ঞান হারালো,
— আমি…. বাড়ি যাবো, আদি আমি আপনার সাথে থাকবো,আব্ আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
কথা বলতে বলতেই হায়াত পুরোপুরি জ্ঞান হারালো। নার্স আবারো সব ঠিকঠাক করে দিলো। আদিব হায়াতের পাশ থেকে সড়ে বেবিদের কোলে নিলো৷
………………..
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে আজ ঊনিশ দিন। হায়াত আর বেবিদের নিয়ে বাসায় এসেছে সকলে। বাসায় আসার পর বেবিদের একবারও কোলে নেয় নি হায়াত, মিসেস আলিয়া আর লামিয়াও এসেছে একটু আগে। হায়াত আদিবের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
হায়াতের এই বিষয়টা সবাই তাচ্ছিল্যের স্বরে নিলেও আদিব ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। হায়াত বেবি বলতেই পাগল, সেখানে তার নিজের সন্তানদের কোলে নিচ্ছে না ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না সে।
বেবিদের আকিকার অনুষ্ঠান করে নামকরণ করা হয়েছে। রাকিব চৌধুরী আর আদিবের চাচা দুজন মিলে ছেলে বাবুর নাম রেখেছে ( আদ্রিয়ান মাহাব চৌধুরী) আর আরাবি, নুপুর,লামিয়া মিলে মেয়ে বেবির নাম রেখেছে ( আভিরা জাবিন চৌধুরী)। আদিব শখ করে তার প্রিন্সেসের নাম রেখেছে হুমাইরা।
দুপুর বারোটা বিশ। হায়াত বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে, আর বাচ্চারা দোলনায় শুয়ে আছে। একটু পরই মাহাব কান্না করতে লাগলো। হায়াত মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে ভাবলো, ওরা তো আমাদের বেবি না, তাহলে ওদের কান্না কেনো থামাতে যাবো আমি। যত্তসব নাটক বাজ ছেলে মেয়ে।
প্রায় বিশ মিনিট ধরে মাহাব কাঁদছে । হায়াতের মনে তবুও কোনো মায়া দয়া হয় নি। আদিব অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে রুমে আসলো,মুহূর্তের মাঝেই রাগে গা শিরশির করে ওঠলো হায়াতকে এভাবে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখে।
চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ দমন করে মাহাবকে কোলে নিলো আদিব। হায়াতের সামনে গিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
— হারাম’জাদি তুই দেখছিস না বেবি কান্না করছে, ওকে কোলে নিচ্ছিস না কেন ?
হায়াত ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বললো,
— ওদেরকে অন্য রুমে দিয়ে আসুন তো, এমন কান্না করে কেনো, অসহ্য লাগে আমার।
হায়াতের কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিব হায়াতের গালে ঠাটিয়ে এক চড় মারলো। হায়াতের যেনো নিমিষেই মাথা ঘুরে গেলো।
— আমাকে মারলেন…!!
হায়াতের গাল চেপে ধরলো, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— তুই বেবি হওয়ার পর থেকেই এমন নাটক করছিস। ওদের ঠিক মতো খাওয়াচ্ছিস না, আর কোলেও নিচ্ছিস না, আমার সন্তানদের অবহেলা করার তুই কে।
হায়াতের গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো,
— আহ্ লাগছে ওমমম ছাড়ুন, ওগুলো রাজের সন্তান, আব্ আমাদের না। তাহলে কেন ওদের আমি আদর করতে যাবো।
হায়াতের কথা শুনে আদিব হতবাক হয়ে গেলো। বাবুকে দোলনায় শুয়ে দিয়ে হায়াতের পাশে এসে দাড়ালো।
— লাথি খাওয়ার আগে বাজে কথা বলা বন্ধ কর। ওরা আমাদের সন্তান গাধা, তোর লজ্জা করে না মুখ দিয়ে এসব কি বলছিস।
— আমি সত্যি বলছি ওরা রাজের সন্তান,আব্ আমাকে
নেশা করিয়ে আব্ আমার সু…………..
হায়াত আর কিছু বলতে পারলো না ডুকরে কেঁদে উঠে। আদিবকে তার লাজুকপাখিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা ছবি বের করে হায়াতের সামনে ধরলো,
— দেখো জান সেই রাতে আমি তোমার পাশে ছিলাম, ডেট দেখো প্লিজ।
আদিবের কথায় হায়াত ফোন হাতে নিলো, প্রথমে একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিলেও একটু পর লজ্জায় লাল হয়ে গেলো,
— আপনি এসব পিক তুলে রেখেছেন কেনো ? লজ্জা লাগে না আপনার।
আদিব হায়াতের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ পুড়ে নিল, হাত আপনাআপনিই সাড়া শরীর জুড়ে চলতে লাগলো, হাস্কি স্বরে বললো,
— আমি সব পিক রেখে দিই লক করে, আর এই পিক গুলো যদি না রাখতাম তুমি কোনো দিনই বুঝতে পারতে না ওরা আমাদের সন্তান।
হায়াত আদিবের বুক থেকে মাথা সড়িয়ে ছুটে গিয়ে বাবুদের বুকে জড়িয়ে ধরলো, নিমিষেই কান্নায় ভেঙে পরলো।
আদিব মুচকি হেসে তিন মা মেয়ে আর ছেলের কান্ড দেখতে লাগলো।
#চলবে