#তোমার_বুকেও_আকাশ_জমুক – ২
আমার আগেই মা এসে বসে আছে ওদের বারান্দায়। আমি বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। আমাদের কথা হয়ে গেল চোখেচোখে! ওরা ঘরে ডাকেনি মাকে? আমার কৌতুহল পাত্তা না দিয়ে শাড়ির আঁচলটাকে পেতে ধরল মা। বিনয়ে গদগদ হয়ে বলল,
–ছোটো থেকেই তো আমাদের বাড়িতে নাজুর যাওয়া-আসা আছে। আমার খুব পছন্দ ওকে। আর ছেলে-মেয়ের মধ্যে ভাব-ভালোবাসাও আছে। আপনার মেয়েটাকে আমারে দেন, ভাইসাহেব। আমি নিজের মেয়ে করে রাখব ওরে!
মায়ের পাশে মেঝেতে অনেকগুলো মিষ্টির দোকানের প্যাকেট ফেলে রাখা। খালি হাতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেনি সে। মায়ের আত্মসম্মানবোধ সর্বজনবিদিত, আজকে আবার জানলাম!
নাজনীনের বাবা চেয়ার টেনে বসলেন। মায়ের মুখের উপরে পা নাচাতে নাচাতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–ঢাকায় থাকো শুনেছিলাম। ওখানে করোটা কী? চুরি-বাটপারি না তো?
অপমানটুকু গিলে নিলাম। নাজনীনের জন্য সব করা যায়! নতমুখে বললাম,
–আমার সবকিছুই তো আপনারা জানেন। ভালো ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনা শেষ করেই চাকরি পেয়ে গেছি। সরকারি চাকরি না হলেও সুযোগ-সুবিধা ভালো। মাসের এক তারিখে স্যালারি হয়ে যায়।
নাজনীনের আব্বা মুচকি হাসলেন,
–এক তারিখে বেতন পাইলে সুবিধাটা কী? টাকা ঘরে ঢুকলে কি তা দেও? সেই টাকার ডিমে বাচ্চা ফুডে?
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। বাঁকা কথার সিধা উত্তর খুঁজে পাই না।
মা বলল,
–জমি-জিরাত যা আছে, সবই তো ওর। আমাদের তো ভাই নাই। বাপের জমি বোনেরা কেউ নেয় নাই। আমার অবস্থা খারাপ দেখে মায়া করছে। অনেকদিন তো যান নাই ওদিকে, সেই বাড়ি আর নাই। বাড়ির ছাদ হয়েছে। আরও হবে আল্লাহ দিলে!
লোকটা মায়ের কথা যেন শুনতেও পেলেন না। আমাকেই বললেন,
–বেতন কত পাও?
আমি ইতস্তত করে বললাম,
–ত্রিশ হাজার!
–এই টাকায় ঢাকা শহরে পানি গরম হয়?
আমাকে করা প্রশ্নের উত্তরে মা বলল,
–গ্রাম থেকে পাঠাব ভাইসাহেব। আমার টাকা সবই তো আবিদের। নাজুর কোনোকিছুর অভাব হবে না!
ভদ্রলোক মুখ বাঁকালেন,
–থোও তো তোমার টাকার হিসাব!
মায়ের মুখ কাচুমাচু। আমার বুক জ্বলে। মা তার সবচেয়ে দামি শাড়িটা পরে এসেছে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে কিনে দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে ভিখারিনীর মতো। দামি শাড়ির জমিন তার মুখের মতোই মলিন।।
নাজনীনের আব্বা জোরে হাঁক দিলেন,
–নাজু, আমার মা নাজু কই? একটু এদিকে আসো তো?
আড়ালেই ছিল ও। মৃদু পায়ে এগিয়ে আসে। ওর বাবার পাশে দাঁড়ায়। আমার দিকে তাকাতে পারে না। আমিও উঠানে দাঁড়িয়ে ওর কামিজের কোণা দেখি। চোখ তুলে দেখতে পারি না। অপরাধীর মতো কোমরের কাছে হাতভাঁজ করে রাখি।
নাজনীনের আব্বা বলেন,
–নাসিরুদ্দিন গার্মেন্টসে লটের ব্যবসা করে। থাকে যে ফ্ল্যাটে সেটা চব্বিশশো স্কয়ার ফিট। বাসা ঘুরে দেখতে গিয়ে আমার হাঁটুর ব্যথা বাড়ছে। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা গেল! ওর এই একটাই ছেলে। ছেলে আবার অনেক ব্রিলিয়ান্ট। এলেবেলে পাশ দিয়ে ভালো ছাত্র না। বিএ, এমএ তো এখন ঘরে ঘরে সবাইই! নিয়াজ আসলেও ভালো ছাত্র। বিসিএস সুপারিশ পেয়ে গেছে। লম্বা-চওড়া ছেলে, চোখে লেগে থাকে। রাজপুত্রের মতো দেখতে।
বলতে বলতে নাজনীনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–হাতদুটো মেলে দেখা তো মা!
নাজনীনের হাতে ভারী দুটো সোনার বালা গলানো।
ওর বাবা বললেন,
–আমার মেয়েকে দেখেই ছেলের মায়ের খুব পছন্দ হয়ে গেছে। নিজের হাতের বালা দুইটা খুলে ওকে পরিয়ে রেখে গিয়েছেন। আংটিটা আবার হীরার দিয়েছে!
নাজনীনের অনামিকাজুড়ে ঝিকমিক করতে থাকা আংটিটা এখন শোনার পরে নজরে এলো আমার! যত শোনা যায়, হীরা অতও চকচক করে না আসলে! নাজনীনকে সেই কথা বলেছিলাম। এর চেয়ে জিরকন, মোয়েসানাইট পাথর বেশি সুন্দর। সাধ্যের মধ্যে জিরকনের আংটি দেবো কথা দিয়েছিলাম নাজনীনকে।
মায়ের গলা শুনলাম। আঁচলের তলায় লুকোনো ব্যাগ থেকে একটা পোটলা বের করল। আমি চিনি এটাকে। বিয়ের সময় আমার বাবা এগুলো দিয়েছিল মাকে। বাবাকে যেমন ঘৃণা করে মা, এগুলোতেও মায়ের অরুচি ছিল।
আজকে মায়ের মুখে কোনো বিতৃষ্ণার ছাপ দেখতে পেলাম না। তেলতেলে হাসি দিয়ে বলল,
–আমিও খালি হাতে আসিনি, ভাইসাহেব। আরও বেশি নিয়ে এসেছি।
একটা একটা করে গয়না খুলে মেঝেতে সাজাতে লাগল মা। গলার চওড়া হার, কানের ঝুমকো, হাতের চুড়ি, মাথার টিকলি।
মায়ের মুখে অহংকারী হাসি,
–আমার আবিদের বউয়েরই তো সব! পাকা কথা দিয়ে এখনই এর আসল মালিককে দিয়ে যাব!
–থোও তো ওসব গয়নাগাটি! জামাইখেদানো বেটির পোলার সাথে তালুকদারের মেয়ের বিয়ে! লোক হাসাইও না! জাত-পাত বলে তো আছে কিছু!
নিতান্ত দায়ে পড়ে অধ:স্তন কর্মচারীর সাথে কথা বলছেন এমন একটা ভাব লোকটার বলার ভঙ্গিতে। অবহেলায় বললেন,
–তবুও মেয়ে যদি চাইত, আমি বিবেচনা করতাম।
আমার চোখদুটো আশায় চকচক উঠল। কিন্তু লোকটা গম্ভীর গলায় বললেন,
–নাজনীন একবারও বিয়েতে আপত্তি করে নাই। হাসি-খুশি, সেজেগুজে সামনে গেছে। নিয়াজের সাথে মোবাইলে কথা বলতেও দেখেছি। মেয়ের মুখে আমি খুশির রঙ দেখেছি। তোমাদের চোখে কী হয়েছে কে জানে? শুনেছি, হাত পোড়াতে শখ হলে লোকে চাঁদ ধরতে চায়। সে তোমরা পুড়ে মরো আমি ফিরেও চাইব না। কিন্তু আমার গায়ে মিছেমিছি কালি লাগাতে গেলে তিনপুরুষ কাদায় চুবাই রাখব!
মা আদর করে নাজনীনকে ডাকলেন,
–ও নাজু, আয় মা। আন্টি আদর করি না তোকে কত? আমার কাছে এসে বস?
নাজনীন অচল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। নড়ল না। মায়ের কথার উত্তর দিলো না।
আমি বললাম,
–নাজনীন, ভয় কোরো না। কোনো ভয় নাই। আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। আমি পারভেজ ভাইকে বলে রেখেছি। তার শালা আমাদের থানায় পোস্টেড। এস আই। তুমি চলো আমার সাথে!
নাজনীনের বাবার মুখে স্মিত হাসি। আদুরে গলায় বললেন,
–বলো মা, তোমার যা পছন্দ, যাকে পছন্দ আমি না করব না। এই যে কথা দিলাম সবাইকে স্বাক্ষী রেখে, তুমি যদি এই পোলার সংসার করতে চাও আমি না করব না।
আমি চিৎকার করে বললাম,
–নাজনীন, বলো। প্লিজ বলো?
ওর বাবা বললেন,
–নিয়াজ আর এই ছেলে আকাশ আর পাতাল। অনেক খুঁজে তোমার যোগ্য পাত্রের সন্ধান এনেছি আমি। তবুও আমি আমার মর্জি তোমার উপর চাপিয়ে দেবো না। তুমি স্বাধীন। কিন্তু এই হাঙ্গামা আজকেই শেষ করতে হবে। দ্বিতীয়বার এইসব উটকো জঞ্জাল আমি বাড়ির সীমানায় দেখতে চাই না। তুমি বলো, এই ছেলে যা বলছে সেটা ঠিক?
–না আব্বা! আমি ওনাকে চিনি না। রুপাদের বাড়িতে কয়েকবার দেখেছি শুধু। টুকটাক কথা হয়েছে, এর বেশি না!
ভদ্রলোকের মুখে চওড়া হাসি। সিনা টানটান করে বললেন,
–আমি জানতাম। তালুকদারের মেয়ের এত নিচু রুচি হবে না।
আমি মরিয়া গলায় বললাম,
–নাজনীন, আমার মা আসছে। মায়ের অনেক বড়ো অপমান হবে। তুমি আজকে ভয়কে জয় করো! তোমার আব্বাকে ভয় কোরো না। উনি কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।
আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে নম্র, শান্ত নাজনীন খেঁকিয়ে উঠল,
–কীসের ভয় ভয় লাগিয়ে রেখেছেন? আমার আব্বাকে কেন ভয় পাব আমি? আমি তো আপনাকে ভয় পাচ্ছি। আমার বিয়েটা ভাঙতে চার হাত পা দিয়ে লেগে রয়েছেন কেন?
মা বলল,
–ও নাজু, এমন করে না, মা। তোমার আব্বাও সমঝোতায় এসে গেছেন। এখন মুখ ফুটে পছন্দের কথাটা বলো। আজকেই নিয়ে যাব তোমারে আমরা। ফুলের বিছানায় বসায়ে রাখব তোমারে। কোনো অভিযোগ করার জায়গা দেবো না। আবিদ যদি ত্যক্ত করে, আমাকে বিচার দিবা। আমি ওকে শাসন করব।
নাজনীনের আব্বা ইশারা করলেন ওকে। ও ঘরের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
নাজনীনের মা বললেন,
–দেখো বাবা, আমি বুঝতে পারছি তোমাদের ব্যাপারটা। কিন্তু মেয়েটা তো আমাদেরই। আমাকে ও নিজে বলেছে, তোমাদের সামনেই আসবে না। তুমি যেমন করতেছ, ও যদি তেমন করত আমরা তো তোমাকেই খুঁজতাম! জোর করে তো মেয়ে বিয়ে দেওয়া যায় না। এই বিয়েটাতে ও অনেক খুশি। তোমরা ওর খুশিতে ভেজাল কইরো না!
আমি চিৎকার করে নাজনীনকে ডাকলাম,
–নাজ? ও নাজনীন?
ওপাশ থেকে অমার্জিত উত্তর আসলো,
–কী?
তারপর সব চুপচাপ।
নাজনীনের বাবা হুঙ্কার ছাড়লেন,
–অনেকক্ষণ সহ্য করেছি। মার খাওয়ার আগে কেটে পড়!
আমি হাতজোড় করে বললাম,
–একটাবার আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দেন, প্লিজ! মা-ও এগিয়ে এলো,
–ভাইসাহেব, পোলা-মাইয়া দুটোরে মিটমাট করে নিতে দেন। ওদের জীবন, ওদের ভবিষ্যৎ!
নাজনীনের আব্বা মায়ের আনা মিষ্টির প্যাকেটগুলো ছুঁড়ে দিলেন আমাদের দিকে। মায়ের শাড়ি-চুল মিষ্টির রসে মাখামাখি। মাথার কাপড় খুলে অবিন্যস্ত চুল ছড়িয়ে পড়েছে মাকে বেআব্রু করে!
লোকটা বললেন,
–ডিভোর্সি মেয়েমানুষ, বাপের বাড়ি হুমাইন্যা থাকে, ড্যাং ড্যাং করে চলে এসেছে তালুকদার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে!
আমি অসহায় মিনতি করে নাজনীনকে ডাকলাম,
–নাজ? আসো একবার? বাইরে আসো, প্লিজ? মাকে এমন অপমান কোরো না!
মায়ের চোখ জ্বলছে। বলল,
–কাঁদিস না, বাপধন। অপমানের জবাব দে?
আমাকে তেলে জলে আদরে মানুষ করেছে মা। প্রতিশোধ কীভাবে নিতে হয় আমি শিখিনি। মা-ই উপায় বের করল। একটু আগে প্রত্যাখ্যাত আঁচলটাকে গুঁটিয়ে নিয়ে খালার সামনে পেতে দিলো,
–তোর মেয়েটাও তো তালুকদার বংশেরই মেয়ে! রুপাকে দিয়ে দে আমাকে!
চলবে…
আফসানা আশা