তোমার বুকেও আকাশ জমুক – ৪
আমি সকালে বেরিয়ে পড়ি অফিসে। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত করি।
রুপার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
একদিন হাসপাতালে গেলাম নাজনীনের বাবাকে দেখতে। রুপাকে নিয়েই গেলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন না। রুপার ভাগ্যের জন্য আমাকে দায়ী করে বকাবাজি করলেন।
খালুকে ভর্ৎসনা করলেন রুপাকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন বলে। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক আর কোনোদিন জোড়া লাগবে না বলে ধমকে দিলেন।
আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমার মায়ের হয়ে। নাজনীন কাছে এলো না। দূর থেকে ওর চোখের অবিরত জলের ধারা নেমে যেতে দেখলাম। ওর চোখে অসহায় কাতরতা।
রুপা আমার হাতটা শক্ত করে ধরল।
আমার দিশেহারা লাগে। হাতটা ছাড়িয়ে নিই। রিকশায় উঠে রুপার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–তুমি তো কারোর অনুরোধ ফেলতে পারো না। যদি খুব অনুরোধ করে বলি, রুপা, সরে যাও! যাবে?
রুপা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার দিকে তাকায় না। ভাব করে যেন শোনেনি কিছু।
এ বছর জানুয়ারি যেন বেশি শীত নিয়ে এসেছে। আমি ভেতরে ভেতরে জমে যেতে থাকি।
নাজনীনের বাবা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। খালা, খালু গ্রামে ফিরবেন। রুপা আসে কাছে। ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে এসেছে। বলল,
–বাড়ি যাচ্ছি। তুমি গিয়ে নিয়ে এসো।
আমি মৃদু হেসে বললাম,
–আমি নিতে না গেলে আসবে না?
এক ঝলকের জন্য রুপা চোখ নামিয়ে নিলো। তারপর খিলখিল করে হাসলো,
–খালা তোমাকে এমন মার দেবে, তুমি বাপ বাপ করে আমাকে আনতে ছুটবে!
রুপা স্বচ্ছ, চঞ্চল, লুকোনো কিছু নেই ওর মনে! খোলা আকাশের মতো!
আমার বুক ভার লাগে।
ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পরে আমি বুঝতে পারি এই নি:সঙ্গতাটুকু আমার খুব দরকার ছিল। নাজনীনের কাছে প্রতারিত হওয়ার পরে যে বিশাল শূন্যতা নেমে এসেছিল আমার জীবনে, রুপার সরব উপস্থিতি আমাকে সেই মহাশূন্যের ভয়াবহতা টের পেতে দেয়নি। রুপার কারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম বলে দু:খ করার অবসর পাইনি।
এখন আমি সবদিক দিয়ে খালি হয়ে গেলাম। তীব্র যন্ত্রণায় হাহাকার পড়ে গেল আমার পৃথিবীতে!
রুপা মেসেঞ্জারে মেসেজ করল,
–ফ্রিজের দুই তাকে রান্না করা তরকারি রেখে এসেছি। বক্সের গায়ে লেবেল আঁটা আছে। গরম করে খেয়ে নিও। আসছে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হয়ে যাবে তোমার। রান্না করতে যেও না। আমার রান্নাঘর নোংরা করবে না।
আমি রুপাকে উলটো মেসেজ দিই,
–রুপা, মনে করো তুমি থার্ড পার্সন। বলো তো, আমি কি নাজনীনের কাছে দায়বদ্ধ?
তিনটে ডট ওঠে, মিলিয়ে যায়। রুপা উত্তর দেয় না।
আমি অপেক্ষা করি।
অনেকক্ষণ বাদে রুপা লেখে,
–তুমি কি এখনো ওকে চাও?
–অপরাধী লাগে নিজেকে! নাজনীনের জন্য মায়া হয়।
–নাজনীনের বিয়েটা ভেঙে গেছে, ও ভাঙেনি। ও তোমাকে চায়নি, পরিস্থিতিতে পড়ে ফিরে এসেছে।
আমার গিল্টফিলিং কমতে থাকে। মায়ের আক্রোশে নাজনীনের জীবনে দু:খ নেমে এসেছে, কিন্তু সেটার জন্য তো আমি দায়ী নই। রুপাও না।
রুপা লেখে,
–দোষ কাউকে দিতে চাইলে নিয়তিকে দিও, নিজেকে না!
আমার মুক্ত লাগে নিজেকে।
বৃহস্পতিবারকে অনেক দূর মনে হয়! অফিস থেকে ছুটি নেওয়া যায় না। লাঞ্চের পরে কেটে পড়ি। মাঝরাতে খালাবাড়ি গিয়ে হানা দিই। ঘুম থেকে তুলে রুপাকে বিরক্ত করি,
–জার্নি করে ক্লান্ত, ঠান্ডা পানি খাওয়াও!
–খিদে লেগেছে, ভাত দাও তাড়াতাড়ি।
–মাছের কাঁটা বেছে দাও, আমি গলায় ফুঁটিয়ে ফেলব।
–ভাত বেশি খেয়ে ফেলেছি, চা দাও এক কাপ!
রুপা কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়ুটে বউয়ের চেহারা নেয়,
–কী শুরু করেছ?
–তুমি যে আগে করেছ!
রুপা চোখ কপালে তোলে,
–আমি কী করেছি?
–ফেলে চলে এলে কেন?
রুপা তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। অনেকক্ষণ উত্তর দিতে পারে না। দাঁতে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল,
–তোমাকে সময় দিতে চেয়েছিলাম।
–সময়?
আমি বিস্মিত হই,
–কীসের সময়? আমাদের কারোরই কি ভাবনা-চিন্তা করে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে, যে সময় লাগবে?
রুপা ঘরের দেয়ালের সাথে সেঁধিয়ে যায়৷ মুখ নামিয়ে বলে,
–তুমি কেবলই একটা বড়ো আঘাত পেয়েছ। হিলিং প্রসেসে একটু তো সময় লাগেই। সেই সময় কেউ দেয়নি তোমাকে। তার আগেই আমাকে, একটা নতুন সম্পর্ককে তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। একটা সম্পর্ক ভুলে আরেকটা সম্পর্ককে চর্চা করতে খানিকটা স্পেস দরকার হয়, বুকের ভেতর অনেকখানি আকাশ থাকা লাগে। আমি সেই স্পেসটা দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে। আমাদের সম্পর্কে সবকিছু খুব দ্রুত ঘটছিল। তুমি কনফিউজড হচ্ছিলে। আমি চাইছিলাম সময়টা দিতে। চাইছিলাম তোমার বুকে আমার জন্য একটু আকাশ জমুক, যেখানে আমার নামে রোদ্দুর হবে, আমার নামে বর্ষা নামবে!
আমি নতুন করে রুপাকে চিনি। এই রুপার বুকে অনেকখানি আকাশ! সেই আকাশটা শক্ত একটা ঠাঁই। গোলমালে সেটা ভেঙে পড়ে না। ডানাভাঙা পাখিকে ঘর বানিয়ে দেয়!
আমি কাছে ডাকলাম ওকে। বললাম,
–আকাশ তো আমার বুকে, মেঘ কেন তোমার চোখে?
রুপা কাঁদছে। আমি কিছু বললাম না। জমে থাকা মেঘ ঝরে গেলে ঝড় ওঠে না!
শেষ
আফসানা আশা