ভীনদেশী তারা পর্ব-০৩

0
5

#ভীনদেশী_তারা
শারমিন_প্রিয়া
পর্ব_৩

উহান শহরে বেশ ভালো দিন কাটতে লাগলো আমার। ঝামেলা বাঁধলো শুধু খাওয়াতে। চায়নিজ খাবার খেতে পারি না। ইতিমধ্যে বেশ আশেপাশের জায়গা ও চিনে গিয়েছি। বাংলাদেশি কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ঢাকার। উনার নাম মারিয়া। মারিয়া আপাকে সাথে নিয়ে চাল, মাছ, মাংস, বাংলাদেশি এরকম অনেক খাবার কিনে নিয়ে আসছি। তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। বেশ কতক্ষণ বাংলা বলতে না পারলে কেমন একটা অস্বস্তি লাগে। মারিয়া আপা রুমমেট হিসাবে নিয়ে এসেছি সাথে। উনিও উহানে পড়েন। সিনিয়র আমার। তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেছে। ভীনদেশে নিজের দেশের কাউকে পেলে তার আনন্দ বোঝানোর মতো নয়।

এক দিন কলেজে ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের সেদিনের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হই। শীতল বাতাস বইছে। লাল গোলাপী পাতা ঝরছে। কোথাও আবার সবুজ পাইনের গাছ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লুউজিয়া পাহাড় থেকে ঝর্ণা পড়ছে। ক্যাম্পাসের পাশেই ছোট্ট লেক। আমার ইচ্ছে হলো নিরিবিলি বসে এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার। আমি হেটে হেটে লুউজিয়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ইস্ট লেকের ধারে গেলাম। হালকা কুয়াশার মতো মেঘ জমেছে লেকের ওপরে। পানির ঢেউয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যের কমলা আভা। লেকের ধারে বসার জন্য পাথরের আসন ও আছে। আসনগুলো একেবারে খালি। কোন মানুষ নেই। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু হালকা বাতাসে গাছের পাতার মর্মর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

আমি পাথরের একটা আসনে বসলাম। টুকিটাকি লেখার অভ্যাস আছে আমার। ভাবলাম, এই অপার সৌন্দর্য দেখে দুই লাইন লেখার চেষ্টা করি। ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে ভাবতে লাগলাম। যেই কলম হাতে আঙ্গুল চালাতে লাগলাম তখন খেয়াল করলাম আমার থেকে একটু দূরে আরেকজন বসে আছে। বোধহয় মাত্র এসেছে লোকটা।

তাকিয়ে দেখি একজন ছেলে। ছেলেটা লম্বা, ফর্সা-সাবলীল চেহারা, পরনে কালো ট্রেঞ্চ কোট, চোখে চশমা। কানে হেডফোন লাগানো, তার চোখ লেকের দিকে। ভালো করে দেখে আমি চিনতে পারলাম কিছুটা। উনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের’ই ছাত্র । সবাই চিনে। মেয়েরা তো চোখে হারায় উনাকে। উনার ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ার মতো। বেশি কথাবার্তা বলেন না, কাউকে পাত্তা ও দেননা। মারিয়া আপা এসব বলেছে আমাকে। উনি লেকের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ব্যস্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিতে উনি হেডফোন খুলে মৃদু হাসলেন।

তারপর এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বললেন,
“You like writing?”

সৌজন্যবোধে মৃদু হেসে বললাম,
“Yes, sometimes. It helps me feel at home.”

মুখের মৃদু হাসি বজায় রেখে নিজের নাম বললেন,
“আই’ম জিয়ান। চিনা। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেকেন্ড ইয়ার।”

“I’m Niharika. বাংলাদেশ। সেইম সাবজেক্ট,নিউ।”

আমার নাম শুনে উনি কিছুটা অবাক হয়ে ভাঙা ভাঙা করে দুইবার উচ্চারণ করলেন। তারপর ইংলিশে জিজ্ঞেস করলেন, “এই নামের অর্থ কী?”

“আকাশের তারা, শিশির। মেঘমালা।”

জিয়ান কিছুক্ষণ থেমে আকাশের দিকে তাকালেন।তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
“Stars and dew. আকাশের তারারা পথ দেখায়। আর শিশির প্রকৃতিকে শান্ত করে। আকাশের বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মেঘমালা। মানে তোমার নামের মধ্যে আলোও আছে, আবার কোমলতাও। তোমার চেহারার সাথে একদম মানিয়ে যায়।”

আমি খুশিতে আপ্লুত হলাম। আমার নামের এত সুন্দর ব্যাখ্যা এর আগে কেউ দেয়নি। বললাম, “ধন্যবাদ।”

“তারপর কেমন লাগছে আমার দেশ? মিস নীহারিকা?”

আপনাআপনি হাসি প্রশ্বস্ত হলো আমার। বললাম,
“স্বপ্নের দেশের মতো। এত সুন্দর প্রকৃতি, ক্যাম্পাস, এই পাহাড়, এই লেক। এত সুন্দর সুন্দর গাছ। গাছের পাতা। বাংলাদেশে থাকতে মন খারাপ হয়েছিল, এখানে এসে আর তা নেই। সত্যি অনেক সুন্দর আপনার শহর। আচ্ছা এইসব পাতা এত লাল কেন?”

“এখন তো প্রকৃতিতে শরৎকাল চলে। এই সময় গাছের পাতার রং বদলায়। খানিক দূরে আঙ্গুল দিয়ে একটা গাছ দেখিয়ে বললেন,
“এই গাছটার নাম রেড ম্যাপল। এই গাছের পাতা সবুজ থেকে কমলা হয়, গোলাপি হয়, শেষে কড়া লাল হয়। লাল হয়ে যখন ঝরে পড়ে তখন মনে হবে রাস্তা লাল কার্পেটে মুড়ে গেছে।

একেক ঋতুতে একেক রকম গাছ হয়। বসন্তে অনেক রকমের চেরি ব্লসম গাছ হয়। তখন প্রকৃতি আরও সুন্দর হয়, সাদা ফুলে ভরে যায়। গ্রীষ্মে সবকিছু ঘন সবুজ থাকে। লেকের ধারে ঝুলন্ত ডালাওয়ালা গাছ বাতাসে দুলতে থাকে। তখন চারপাশ প্রাণবন্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লেকের ধারে বসে গান বাজনা করে।

আসলে একেক ঋতুতে প্রকৃতি নতুনভাবে সাজে। তুমি তো আছো এখানে। প্রতি ঋতুতে শহরকে নতুনভাবে চিনবে।”

উনার থেকে এসব বর্ণনা পেয়ে অনেক অজানা বিষয়ও জানলাম। উনি এত কথা বলতে পারেন বা আমার সাথে বলবেন আমি ভাবতেও পারিনি। সত্যি অনেক মিশুক আর ভালো মনের মানুষ উনি।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“I’m leaving now. সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তুমি ও চলে যাও। অন্যদিন দেখা হলে অবশ্যই কথা হবে। তুমি অন্যরকম মেয়ে। ভালো লেগেছে।”

উনি আর দাঁড়াননি। চলে গেলেন। আমি কলম কামড়াতে লাগলাম। লেকের ওপর সূর্যের শেষ আলো মিশে যাচ্ছে, ম্যাপল গাছ থেকে ঝিরিঝিরি গোলাপি পাতা উড়ছে। পাহাড় বেয়ে ঝর্ণা পড়ছে ঝিরিঝিরি শব্দে। আমি উঠলাম। বাসায় যেতে যেতে দেখলাম আকাশে উড়ছে কয়েকটা সাদা সারস।

বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়। এর মধ্যে মারিয়া আপা অনেকবার কল করেছে। বাসায় ফিরলে বকা দিলো,
“নতুন এসেছো। এদিক-সেদিক এখনও যাওয়া ঠিক না। রাত করে ফেরা ও ঠিক না। পথে হারিয়ে গেলে কি করবে।”

আমি হাসলাম,
“তুমি আমার আম্মুর মতো কথা বলছো মারিয়া আপা। আমি পথে হারাব কেন? আর হারিয়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া কষ্টের নয়। আর এটা বাংলাদেশ নয় যে রাত হলে বিপদ হবে।”

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
“লেকের ধারে। কি সুন্দর জায়গা। ইশ! তুমি আগে বলোনি কেন আমাকে। আরও আগে যেতাম।”
“হুম, সত্যিই সুন্দর।”

“আমি প্রায়ই ওখানে যাব। জানো আপা? আগে ভাবতাম চায়নারা শুধু ফর্সা হয়, মায়াবী হয় না। কিন্তু আজ একজনকে ভালো করে দেখে মনে হলো উনার গায়ের রঙে যেমন সাদা, ভেতরটাও এরকম সাদা। উনার মুখস্রীও তেমন মায়াবী। চিকন ঠোঁট। চকচকে দাঁত। হাসলে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। অনেক লম্বা। মানে সবদিক দিয়েই উনি অনেক অনেক অনেক সুন্দর।”

আমার কথা শুনে মারিয়া আপা কেমন একটা করে তাকালেন আমার দিকে। তারপর বললেন,
“লেখাপড়া চাঙ্গা যাবে। কারও প্রেমে টেমে পড়ো না নীহারিকা।”

“আরে প্রেমে পড়ব কেন। দেখতো সুন্দর তাই বলছি। ভালো লাগছে।”

“কে সে?”
“কলেজের সিনিয়র। ওইযে যার কথা বললে, যার জন্য মেয়েরা পাগল। জিয়ান নাম।”

মারিয়া আপা দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ কথা শুনে হা করে বসে পড়েন। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেন,
“এটা সত্যি হবে না। এমন একজন মানুষ তোমার সাথে কথা বলবেন, তাও পরিচিত নয়। নতুন এসেছো তুমি।”
“হা বন্ধ করো আপা। এটাই সত্যি। কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে। কথা ও হয়েছে। আমার নামের সুন্দর ব্যাখ্যা ও দিয়েছেন। আমাকে বলেছেন আমি অন্যরকম মেয়ে। হেসেছেন ও।”

“সত্যি এসব!”
“সত্যি। আমি লেকের ধারে ছিলাম। হঠাৎ উনাকে দেখি। আমাকে দেখতে পেয়ে কথা বলেন। স্বাভাবিক বিষয়। উনি মোটেও দাম্ভিক নয়। মিশুক মানুষ।”

“এত খুশি হয়ে লাভ নেই। ওখানে এমনি কথা বলেছে। কাল কলেজে দেখা হলে দেখবা, তোমাকে চিনবেই না।”
“না চিনলে নাই। ওসব বাধ। আজকে আমি রান্না করব।কি খাবে বলো।”
“আমার তো খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছ। রান্না করতে পারবা ঠিকঠাক? সেদিন কি রান্না করলে লবনের পুরো প্যাকেট দিয়ে দিয়েছ। ডাস্টবিনে ফেলতে হলো।”
“এভাবে বলো না আপা। আম্মা কখনও রান্না করতে দিতেন না। ধীরে ধীরে শিখব।”

মারিয়া আপা হেসে বললেন,
“সমস্যা নেই। আমিই রান্না করব। তুমি গুছিয়ে দাও।”

চলমান….!