#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(৭)
ভোরের হালকা আলোয় ঘুম ভাঙল আমার। কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। হালকা হাওয়া বইছে, পাখিরা কিচিরমিচির করছে। আজ ঠান্ডা একটু বেশি পড়েছে। কোটটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এমন সময় আগমন হলো শাওলির। হেসে বলল, “গুড মর্নিং মিস নীহারিকা। আমার সাথে এসো, নাস্তা করবে।”
শাওলির সাথে গিয়ে দেখি খাবার টেবিলে সবাই বসা। জিয়ানের দিকে তাকিয়েই লজ্জার হাসি হাসলাম। কালকের ঘটনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমার লজ্জা একটু বেড়েছে। তার দিকে তাকাতে আমি সংকোচ বোধ করছি। জিয়ানের মা হাত ধরে বসালেন, নাস্তা দিলেন সামনে। চা, ভাপে উঠা পিঠা, নুডলস, সিদ্ধ ডিম আর ফলমূল। খেতে লাগলাম। শিয়াং আর জিয়ান এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে খেতেও পারছিলাম না স্বস্তি নিয়ে। চোখ গরম করে জিয়ানের দিকে তাকাতেই জিয়ান চোখ টিপলো। হেঁচকি উঠে গেল আমার। তাড়াতাড়ি শাওলি পানি এগিয়ে দিলো। জিয়ান অপরাধী চোখে তাকালো আমার দিকে। তারপর শিয়াংকে একটা চিমটি কেটে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? বেচারি খেতে পারছে না।”
শিয়াং মুখ বাকিয়ে চায়না ভাষায় কিসব বলতে বলতে খেতে লাগল। জিয়ানের মা উঠে চলে গেলেন। বললেন, উনার কাজ আছে। আমি এই দেশে আসার পর থেকে একটা জিনিস বেশি চোখে পড়েছে, এখানে কেউ বেকার বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল টিপে না। ছোট-বড়, বয়স্ক, সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। বিষয়টা সত্যিই অনেক ভালো লেগেছে আমার।
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। তারপর জিয়ান আমাকে নিয়ে বের হলো গ্রাম দেখাতে। আসার পর থেকে তাদের বাড়ি থেকে বের হইনি আমি। গ্রামটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। তুষার পুরো পথে ছড়িয়ে আছে। তার উপর দিয়ে আমরা হাঁটছি। পায়ের ছাপে ছাপে সরু রাস্তা হয়ে যাচ্ছে। কয়েক কদম হাঁটতেই শিয়াং আমাদের সাথে যোগ দিলো। জিয়ানকে অভিযোগ স্বরে বলল,
“আমাকে রেখে আসলে কেন ব্রো?”
“আমি কি রাস্তা চিনিনা যে তোকে সাথে নিয়ে আসতে হবে?”
“এটা কিন্তু ভালো না ব্রো। নীহারিকার সাথে আমাকে একদমই মিশতে দাও না। আমি কি নিয়ে নেব নাকি?”
হেসে উঠলাম আমি। শিয়াং বাচ্চাদের মতো কথা বলে, মজা লাগে তার কথা শুনলে।
গ্রামে বাড়িগুলো খুব আকর্ষণীয়। পাহাড় কেটে বাড়ি বানানো। ছিঁড়ি বানানো। কাঠের গেট লাগানো। নারী-পুরুষ অনেকজন চা হাতে যার যার বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। নরম রোদ উঠেছে, রোদ পোহাচ্ছে তারা। জিয়ানকে দেখলেই সবাই হেসে এগিয়ে এসে কথা বলছে। আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলেছে, যদিও একটা কথা বুঝিনি আমি।
যেতে যেতে দেখি কাল রাতের বাঁশঝাড় আর পাইন গাছের ডালগুলোতে ঝুলে থাকা তুষার ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছে, আর সেই পানির ফোঁটা পড়ছে মাটিতে টুপটাপ শব্দ করে।
জিয়ান আমাকে নিয়ে ছোট্ট একটা পাহাড়ের চূড়ায় থামল। পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। নদীর পানি থেকে ধোঁয়াশা বের হচ্ছে। আমি হাত বাড়িয়ে পানি ছিটিয়ে দিলাম মুখে। উফ, কী যে ঠান্ডা! পাহাড়ের চূড়ায় তুষার জমে আছে, সেগুলো থেকে মেঘের মতো ধোঁয়া বের হচ্ছে। জিয়ান বলল,
“জানো নীহারিকা? এই পাহাড়ে বছরের বেশিরভাগ সময় তুষার জমে থাকে। ছোটবেলায় ভাবতাম এই ধোঁয়া উঠা পাহাড় বোধহয় আকাশের দরজা।”
আমি কিছু বলার আগে জোরে হেসে উঠলো শিয়াং। “পাহাড়ে নাকি আকাশের দরজা থাকে!” হাসি থামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল,
“আর কবে আসবে আমাদের গ্রামে নীহারিকা?”
“আসব কিনা জানি না। তবে আসার চেষ্টা করব। জীবনে যদি আর নাও আসা হয়, তাও তোমাদের গ্রাম, তোমাদের বাড়ি আর তোমরা সবাই আমার স্মৃতিতে আমরণ থাকবে।”
“আরও কয়েকটা দিন থাকলে হয় না?”
“আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে কালকে। আমাকে যেতে হবে।”
“আমি তোমার দেশে যেতে চাই। ভাইয়া, তুমিও কি যাবে?”
“অবশ্যই যাব। ওই দেশেই তো আমার শ্বশুরবাড়ি হবে।”
শিয়াং দুষ্টু হেসে বলল,
“কি ভয়ংকর লাভ স্টোরি তোমাদের।”
শিয়াংয়ের কথায় আমি মুচকি হাসলাম। কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরতে লাগলাম। প্রচণ্ড বাতাস বইছে, ঠান্ডায় জমে গেছে হাত। দু’হাত মুঠো করে জিয়ানের হাতে ঢুকিয়ে দিলাম। জিয়ান মৃদু হেসে আঁকড়ে ধরল আমার হাত। একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল আমার সারা শরীর জুড়ে।
দুপুরের খাওয়া শেষে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু না গেলে হবে না আমার। জিয়ান আরও কয়েকদিন থাকবে এখানে। বাসে তুলে দিলে আমি একাই যেতে পারব উহানে। জিয়ান তাও আমার কথা শুনেনি, তার এক কথা— আমাকে একা ছাড়বে না। আমাকে উহানে পৌঁছে দিয়ে সে আবার ফেরত আসবে। আরও এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে তারপর ক্যাম্পাসে ফিরবে। বিকেল হলেই বের হলাম আমরা। বিদায়ের মুহূর্তে ইমোশনাল হয়ে গেলাম আমি। এই দুদিনে সবাই কেমন আপন হয়ে উঠল আমার কাছে। জিয়ানের মা কাতর হয়ে বললেন,
“আবার এসে মা, এই ঘর সবসময় তোমার জন্য খোলা।”
উনার চোখে জল চিকচিক করছিল। আমি এগিয়ে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। আমার কপালে চুমু খেলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শাওলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, আমার হাত ধরে বলল,
“তুমি আবার এসো নীহারিকা। খুব মনে পড়বে তোমায়।”
শিয়াং চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছিল। আমি যখন ওকে বললাম, “চলে যাচ্ছি।”
সে নরম কন্ঠে বলে উঠলো, “আবার এসো প্লিজ। খুব মিস করব তোমায়। বেশি মিস করলে আমি কিন্তু উহানে চলে যাব। আপত্তি আছে?”
আমি মলিন হেসে মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
উপস্থিত আরও অনেকজন ছিল, সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম জিয়ানের সাথে। সবাই দাঁড়িয়ে ছিল। বাচ্চারা হাত নাড়ছে। আমিও হাত নেড়ে তাদের থেকে বিদায় নিলাম। পেছনে ফিরে আর তাকালাম না। ভীষণ ইমোশনাল আমি। দুদিনে ভীনদেশী মানুষগুলোও আমার মনে জায়গা করে নিল। পেছনে তাকালে আমি চোখের পানি আটকাতে পারব না।
হাওয়ায় মাথা থেকে উলের টুপি উড়ে পড়ে গিয়েছিল। জিয়ান সেটা আবার আমার মাথায় তুলে দিতে দিতে বলল,
“তুমি তো আমার পরিবারকে মুগ্ধ করে দিলে। দেখলে, কতটা আপন করে নিল তোমায়।”
“তুমি যেমন ভালো, তোমার পরিবারও অনেক অনেক ভালো।”
আমি শেষবারের মতো দেখতে লাগলাম মাংজিয়া গ্রামকে। বিকেলের হালকা রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। সূর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। পাহাড়ের মাথায় সোনালি আলো ঝিকমিক করছে, যেন তুষারের ওপর সোনার গুঁড়া ছিটানো হয়েছে। গাছের পাতাগুলো শো শো শব্দে নড়ছে, ঠান্ডা বাতাসে গা শিরশির করে উঠছে। পাখিরা দল বেঁধে বাসার দিকে ফিরছে। সাদা সারসগুলো আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার কখনও তুষারাচ্ছাদিত মাঠের ওপরে তারা নামছে।
স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম দ্রুত। জিয়ান আমার লাগেজ নিয়ে নামল। আমাকে হাত ধরে নামালো। কাউন্টারে গিয়ে বসে বাসের অপেক্ষা করতে লাগলাম। জিয়ান খাবারদাবার কিনে আনল অনেক। বাস আসতেই উঠে পড়লাম বাসে। বাস চলতে লাগল। জানালা দিয়ে বাইরে এক পলক চেয়ে জানালা লাগিয়ে দিলাম। কাচে জমে থাকা কুয়াশায় আঙুল বুলিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে মনে হলো, এই গ্রাম চিরদিন আমায় ডাকবে।
জিয়ান শক্ত করে হাত ধরল আমার। আমি তার হাতের মুঠোয় আমার হাত ঢুকিয়ে সিটে হেলিয়ে দিলাম মাথা। জিয়ান আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে, আবার কখনও কপালে, কখনও মাথায় চুমু খাচ্ছে। ভালোবাসার এমন পরশ পেয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, টেরও পাইনি।
চলমান….!