ভীনদেশী তারা পর্ব-০৮

0
5

#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(৮)

বাস উহান শহরে ঢুকলো প্রায় রাত ১০টার পর। চোখ খুলে দেখি, শহরের রাস্তাগুলো ঝলমল করছে আলোর ছটায়। উঁচু উঁচু বিল্ডিং, ব্যস্ত রোড, গাড়ির আলোয় ঝলসে উঠছে পুরো শহর। বাস থামলে জিয়ান আর আমি নামলাম। ট্যাক্সি ধরে বাসার সামনে চলে গেলাম।

জিয়ান জড়িয়ে ধরলো আমাকে। কপালে একটা চুমু খেলো। বলল, “তুমি যাও।”

“তুমি এতদূর এলে, বাসায় এসে একটু ফ্রেশ হয়ে গেলে হয়না? রাতটা থেকে গেলেও তো পারতে। হোস্টেল তো কাছেই।”

জিয়ান হালকা হেসে মাথা নেড়ে বললো,
“প্রমিস করেছিলাম তোমায় একা ছাড়বো না। তোমায় সেফলি বাসায় পৌঁছে দিয়েছি, এখন আমার নিশ্চিন্ত লাগছে। আমার রাতের বাস আছে, ওইটা ধরব।”

তার হাত ধরে বললাম,
“আমাকে অনেক মিস করবে, তাই না?”

জিয়ান মুচকি হেসে শক্ত করলো হাতের বাঁধন। নাকে নাক ঘষে বলল,
“আলরেডি মিস করা শুরু করে দিয়েছি, আমার মেঘমালা।”

“খুব মিস করব। তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু। এখন যাও। তুমি রুমে ঢুকলে আমি চলে যাব।”

বেশিক্ষণ আমি থাকলে জিয়ান-এর বাস চলে যাবে। তাই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে হাত ইশারা করলাম জিয়ানকে। জিয়ান এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, “চলে যাও। বাস চলে যাবে।” সে ফ্লাই কিস করলো। আমিও করলাম। বুকের ভেতর টনটন করে উঠলো। মনে হচ্ছিল জিয়ানকে বুকের ভেতর চেপে রেখে দেই।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম জিয়ানের যাওয়ার পথে। সে চোখের আড়ালে চলে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি মুছলাম। বারান্দার ওপাশে নিস্তব্ধ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম কতক্ষণ। প্রায় আধঘণ্টা একাকী কাটিয়ে রুমে ঢুকলাম। মারিয়া আপা আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন।

“কি করলাম, কেমন দেখলাম, সবাই কেমন, জিয়ান কেমন ব্যবহার করেছে?” এসব হাবিজাবি সব জিজ্ঞেস করলেন মারিয়া আপা। আমি এক এক করে সব বললাম।

মারিয়া আপা তো অবাক হয়ে বললেন,
“এত সুন্দর জায়গা! আমার তো এখনই যেতে মন চাইছে।”

“জিয়ান আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে মারিয়া আপা।”

মারিয়া আপা ঘুরে বসলেন, “কি বলো নীহারিকা? ও তো খ্রিস্টান।”

স্মিত হাসলাম, “সে বলেছে মুসলিম হয়েই বিয়ে করবে।”

“ও আল্লাহ! অবিশ্বাস্য। এত ভালোবাসে তোমায়। তার পরিবার কি মেনে নেবে?”

“সে বলেছে, উহানেই রাখবে আমাকে, সেও থাকবে।”

“আর তোমার পরিবার?”

“মায়ের সাথে কথা বলব। মাকে বলব সব। দেখি কি বলেন। রাজি হলেও বিয়ে করব, না হলেও করব। এটা ফাইনাল।”

মারিয়া আপু খুশি হয়ে বললেন, “জিয়ান ভালো ছেলে। যদি বিয়ে করো আমায় সাক্ষী হিসাবে নিতে পারো।”

“থ্যাঙ্ক ইউ মারিয়া আপা।”

“জার্নি করেছো। খেয়ে শুয়ে পড়ো।”

“সারা রাস্তা ঘুমিয়েছি। খেয়েছি ও অনেক। আর কিছু লাগবে না আমার। আজ সারারাত জিয়ান জার্নি করবে। আমি সঙ্গ দেবো। সারারাত ফোনে কথা বলব।”

মারিয়া আপা মৃদু হেসে পড়তে বসলেন।

মারিয়া আপাকে যত সহজে বলেছি, মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলব তত সহজে বলতে পারিনি। বলতে গেলেই গলা কেঁপে উঠে। তারপর ভাবলাম এখনও সময় আছে। যখন বিয়ে করব তখন না হয় বলব।

জিয়ানের সাথে রোজ কথা হতো আমার। মাঝেমধ্যে তার মা-বোনও কথা বলতো। শিয়াং তো ডাইরেক্ট আমার ফোনে কল দিয়ে কথা বলতো। জিয়ান ফিরে আসে ক্যাম্পাসে। আমাদের রোজ দেখা হয়। লেকের পারে গোধূলি সময় কাটাই আমরা। হাজার রকম কথাবার্তা হয় আমাদের মধ্যে। মায়া আর ভালোবাসা এতটাই বেড়েছে যে, দুজন দুজনকে ছাড়া আর কিছুই বুঝি না। ভার্সিটির প্রায় সবার মুখে মুখে আমাদের প্রেম কাহিনী।

মাস দুয়েক পরে একদিন হুট করে শিয়াং এসে হাজির। আমি আর জিয়ান সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে রাস্তায় হাঁটছিলাম, তখনই শিয়াং কল করে বলে, সে এসেছে। আমরা তাকে রিসিভ করি। তার মা অনেক রকম নিজের হাতে তৈরি খাবার পাঠিয়েছেন আমার আর জিয়ানের জন্য। আমাকে হেসে সে বলল,
“তোমার কথা মনে পড়ছিল, দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল তাই চলে এলাম।”

আমি হাসলাম। জিয়ান চোয়াল শক্ত করে তাকাচ্ছিল শিয়াং-এর দিকে। শিয়াং জিয়ানের তাকানোটা তুচ্ছ করে বলল,
“জেলাসি হচ্ছে নাকি? তোমার বউ আমি নেবো না ভাইয়া। রিল্যাক্স থাকো। পুরো ক্যাম্পাস কিন্তু আমাকে ঘুরে দেখাবে নীহারিকা। ভাইয়া তুমি সাথে থাকলে থাকতে পারো, বাধা নেই।”

জিয়ান হেসে শিয়াং-এর মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “পাগলা একটা।”

শিয়াং এক সপ্তাহ থাকলো উহানে। সে ক্যাম্পাসে ওঠেনি, তাদের আত্মীয়ের বাসা আছে উহানে, সেখানে থেকেছে। দিনের বেলা আমাদের ক্লাস শেষে লেকের ধারে, পাহাড়ের চূড়ায়, পার্কে একসাথে ঘুরেছে।

ফার্স্ট ইয়ার শেষ হয়ে সেকেন্ড ইয়ার শেষ হয় আমার। ততদিনে চুটিয়ে প্রেম চলেছে আমাদের। মাঝে গিয়েছে আরও একটা শীত। এই শীতকাল জিয়ান একা গ্রামে গিয়ে কাটিয়েছে। ওর বাবা বাড়ি ছিলেন, তাই আমাকে নিয়ে যায়নি। তার বাবা এসব পছন্দ করেন না।

ভার্সিটি ছুটির দিন ছিল। বাসায় অলস দুপুর কাটিয়েছি। বিকেলের দিকে জিয়ান কল করে ডেকে আমায় বলল,
“মেঘমালা, তাড়াতাড়ি লেকের ধারে আসো।”

“হঠাৎ কেন?”

“আরে বসন্তকাল চলছে, আজকের দিনটা অনেক সুন্দর আর আকর্ষণীয়। না আসলে মিস করবে বসন্তের সৌন্দর্য। বসন্তের সৌন্দর্য আর তোমাকে একসাথে দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।”

রেডি হয়ে চলে গেলাম লেকের ধারে। আজ জোড়ায় জোড়ায় কাপল বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে, হাঁটছে। বসন্তের চারপাশই রঙিন। সত্যিই আজকের দিনটা অনেক সুন্দর। চারদিকে চেরি ব্লসম গাছগুলোতে সাদা আর গোলাপি ফুল ফুটে আছে। বাতাস বইলে পাপড়ি উড়ে এসে চুলে, কাঁধে লেগে যাচ্ছে। বাতাস বইছে জোরে, বাতাসের সাথে যখন পাতাগুলো নিচে নামে, তখন মনে হয় ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে।

জিয়ান আমার হাত ধরে হাসতে হাসতে বলল,
“দেখেছো? এটাই হলো উহানের বসন্ত। সারা শহরকে গোলাপি আর সাদার কার্পেটে মুড়ে ফেলে।”

আমি অভিমানী সুরে বললাম, “কে সুন্দর আমি নাকি তোমার বসন্ত?”

“শুধু বসন্ত কেন? এই পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের কাছে তুমিই বেশি আকর্ষণীয় আমার চোখে।”

“উফ! কি যে বলো!”

আজ আর আমরা বসিনি। ধীরে ধীরে লেকের ধারে হাঁটছিলাম আর গল্প করছিলাম। লেকের পানিতে সূর্যের সোনালি আলো ঝিকমিক করছিল, যেন হাজারটা হীরের কণা ছড়িয়ে আছে।

হঠাৎ জিয়ান লাফ দিয়ে গাছ থেকে একটি ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে এনে বলল,
“মেঘমালা, চোখ বন্ধ করো।”

আমি চোখ বন্ধ করতেই, সে মজা করে পাপড়িটা আমার নাকে লাগিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই হাঁচি উঠে গেল।

“আহ্ জিয়ান!” – বলতে না বলতেই আমি আবার হাঁচি দিলাম।

সে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল,
“দেখো তো! হাঁচি দিতে দিতে তোমার নাক লাল হয়ে গেছে – একদম গোলাপি চেরি ব্লসমের মতো।”

আমি চোখ গরম করে বললাম,
“দাঁড়াও, তোমাকে এখনই শিখিয়ে দিচ্ছি মজা করা মানে কী।”

বলেই তার দিকে ছুট দিলাম। জিয়ান দৌড়ে পালাল, আর আমি পেছন থেকে ধাওয়া করলাম। দুজনেই ফুলে ভরা পথে বাচ্চাদের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে হেসে উঠলাম।

হঠাৎ জিয়ান থেমে গিয়ে আমার হাত শক্ত করে ধরল। দম নিতে নিতে বলল,
“এসো, একসাথে দৌড়াই। যেন স্মৃতি হয়ে থাকে—এক বসন্তে আমরা গোলাপি ফুলের কার্পেটে বাচ্চাদের মতো দৌড়েছিলাম। বুড়ো হলে নাতি-নাতনিদের সাথে গল্প করতে পারব।”

হেসে বললাম, “শুধু বসন্ত নয়, বসন্ত-শীত-গ্রীষ্ম, সব ঋতুতে তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আমি চাই সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকুক।”

তারপর আমরা একটা নদীর ধারে বসলাম। নদীর পানি থেকে মৃদু কুয়াশার মতো ধোঁয়া উঠছিল। চুপচাপ তার কাঁধে মাথা রাখলাম। নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। বেশিরভাগ কাপল চলে গেলো নদীর ধারে থেকে। আকাশ আলো করে উঠলো চাঁদ। চাঁদের আলোয় চকচক করছিল নদীর পানি। নদীর ধারে বেশি অন্ধকার হওয়ার আগে উঠে চলে আসলাম আমরা।

চাঁদের আলোয় নদীর ধারে হাঁটাহাঁটি শেষে জিয়ান আমার হাত ধরে বলল,
“চলো, ফুড স্টলে যাই।”

আমরা হেঁটে গেলাম রাস্তার ধারের ফুড স্টলে। সেখানে অনেক স্টল। জমজমাট লোকে। লণ্ঠনের লাল আলোয় দোকানটা ঝলমল করছিল। চারপাশে মানুষজন বসে আছে, গরম গরম চা আর নানা রকম নুডলস খাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে ঝাল-মসলার ঘ্রাণ।

জিয়ান আমার সামনে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা জুঁই ফুলের চা এগিয়ে দিলো। কাপের ভেতর থেকে সাদা ফুল ভেসে উঠছিল।

চা খাওয়া শেষে খেলাম হট ড্রাই নুডলস, যেটা উহানের বিখ্যাত খাবার। ট্যাক্সিতে উঠতে দিলো না জিয়ান। বলল, “হেঁটে হেঁটে বাসায় যাওয়া যাক। রাতের এই অপার সৌন্দর্যও উপভোগ করা যাবে, আর কথাও বলব।”

হাতে হাত ধরে ল্যাম্পপোস্টের নিচে হাঁটছি। জিয়ান বলল, “নীহারিকা, একটা কথা বলবো?”

“হ্যাঁ, বলো না।”

জিয়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার থেকে দূরে থাকতে আর ভালো লাগছে না আমার। আমি তোমাকে কাছে পেতে চাই, একান্ত কাছে। তোমাকে স্ত্রী রূপে পেতে চাই। চলো না বিয়ে করে ফেলি। আর তার সইছে না।”

মিটিমিটি হাসলাম আমি। আমারও আর দূরে থাকতে ভালো লাগে না। জিয়ানকে কাছে পেতে মন চায়। আদর করতে ইচ্ছে করে। জিয়ানকে বললাম, “মায়ের সাথে আজ সত্যি কথা বলব। আর দ্রুতই বিয়ে করব। একসাথে থাকব দুজন। এক রুমে, এক বেডে।”

“রুম-বেড এসব বলো না মেঘমালা, অসভ্য হয়ে উঠবে ভেতরের জিয়ান।”

“উফ, কি যে বলো!”

জিয়ান থেমে আরও কাছে এসে ধূসর আলোয় ফিসফিস করে বলল, “ওই দিনের মতো একটা লিপ কিস করোনা।”

আমি লাজুক চোখে এক পদক্ষেপ পিছু সরলাম। বললাম, “ওটা শুধু বৃষ্টির দিনের জন্য প্রযোজ্য , সবসময় নয়।”

প্রতিক্রিয়ায় জিয়ানের অসহায়ের মতো মিটিমিটি হাসি আমার কাছে বরাবরের মতো মধুর লাগলো। জিয়ান আলতো করে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে দিলো। অচেনা এক উষ্ণতায় মিটিমিট করতে লাগল আমার শরীর।

আমি শান্ত গলায় বললাম,
“আমি যাই। সোজা হোস্টেলে যাবে। অযথা আর থাকবে না এখানে-সেখানে।”

সে মৃদু হেসে মাথা নুইয়ে বলল,
“আপনি যেমন বলবেন ম্যাডাম।”

ভেতর খুশিতে ভরে উঠলো আমার। হাসতে হাসতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।

চলমান…!