#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_৬
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
আজ ২৫ জানুয়ারি।
সামনে ডাইনিং টেবিলটার দিকে তাকিয়ে আছে আরশান। যেখানে সাঁঝ আর অর্ণব একসঙ্গে বসে মিষ্টি খাচ্ছে। সাঁঝের মুখে একরাশ নিষ্পাপ হাসি, ছোট্ট হাতটা তুলে তুলে মিষ্টির টুকরো মুখে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে অর্ণবের প্লেট থেকেও এক চিমটি তুলে নিচ্ছে।
কিন্তু আরশানের বুকের ভেতর যেনো কিছু একটা চেপে বসে আছে। গলায় আটকে থাকা অদৃশ্য একটা দমবন্ধ অনুভূতি তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
তার মন যেনো এখন একটা ভারী, অজানা ভবিষ্যৎতের ভার বইছে। কিছুক্ষণ আগেই তো সবকিছু বদলে গেছে। কিছু কথাবার্তা, আর সামাজিক কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বদলে গেছে জীবনের রূপরেখা। নামের পাশে একটি সম্পর্ক বসেছে। কিন্তু এই সম্পর্কটার ভার কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। যেমনটা হওয়ার কথা নয়, ঠিক তেমনই কিছু।
সাঁঝ এখনো অনেক ছোট। এখনো এই জগতের ভালো-মন্দ, সম্পর্কের জটিলতা, মানুষের ভালোবাসা আর দায়িত্বের পার্থক্য কিছুই জানে না সে। কিন্তু সময় বদলাবে। একদিন সাঁঝ বড় হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তাভাবনা পাল্টাবে, চোখ খুলে যাবে এক নতুন বাস্তবতায়। তখন? তখন কী সে এই সম্পর্ক মেনে নেবে? সে কী ভাববে তখন?
এই যে তার হঠাৎ একদিন তার জীবনসঙ্গী হয়ে উঠল। এই সত্য সে কীভাবে গ্রহণ করবে? যদি একদিন সে এই সম্পর্ককে ভুল বলে মনে করে? যদি ভাবে, ওর জীবন থেকে বিকল্পগুলো কেড়ে নেয়া হয়েছে? আরশানের মস্তিষ্কে একের পর এক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসে। সে নিজের কপাল টিপে ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। সাঁঝের নিষ্পাপ মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারবার। মেয়েটা এখনো জানেই না যে, তার জীবনের পথচলা আরশানকে সঙ্গে নিয়েই হবে। এই সম্পর্কটা যদি কোনোদিন বোঝার বয়সে গিয়ে সাঁঝের মনে ক্ষভ জাগিয়ে তোলে?
আরশান জানে না তখন সে কী উত্তর দেবে?
এই দায়িত্ব, সবকিছু মিলিয়ে একটা অদ্ভুত বোঝা তার কাঁধে চেপে বসেছে। আরেকটা ভয়ও তাকে তাড়া করে বেড়ায় এই বিয়েটা ভবিষ্যৎতে কি কোনো বড় বিপদের রূপ নেবে না তো? যদি এই সম্পর্ক ভেঙে যায়? যদি সাঁঝ কষ্ট পায়? যদি এই সম্পর্কটা তাকে ভেতরে ভেতরে গিলতে থাকে একদিন? আরশান জানে না। কেউ জানে না। ভবিষ্যৎ তো কারো হাতের মুঠোয় থাকে না। তবে সে জানে, এই মুহূর্তে, তার হৃদয়ের গভীরে একটা কথা ক্রমাগত প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছে সে সাঁঝকে কষ্ট দিতে চায় না। কখনো না।
সে চায়, এই ছোট্ট মেয়েটার জীবনে কোনো প্রশ্ন না থাকুক, কোনো ক্ষত না থাকুক, কোনো অপূর্ণতা না থাকুক। তবুও একটা জিনিস সে জানে, খুব ভালো করেই জানে। সে সাঁঝকে আগলে রাখবে। যতক্ষণ তার শ্বাস আছে, যতদিন সে বেঁচে থাকবে, সে এই মেয়েটার পৃথিবীকে নিরাপদ রাখবে। আর দায়িত্ব? সেটা তো চাইলেই পালন করা যায়।
ভবিষ্যৎ কী নিয়ে আসবে, সেটা সে জানে না। তবে একটাই দোয়া সাঁঝের মুখে সবসময় এই হাসিটুকু লেগে থাকুক ।
——–
বিকেলের নরম রোদটা বারান্দা পেরিয়ে ড্রইংরুমের মেঝেতে ঢেলে দিয়েছে সোনালি আলো। অর্ণব নতুন পাওয়া সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নায় নিজের চেহারা দেখছিল। হাতে ঝকঝকে হ্যান্ড ওয়াচ। চোখে-মুখে একরাশ খুশির ঝিলিক।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ, হাত দুটো কোমরে, চোখে কৌতূহল মাখানো বিস্ময়।
অর্ণব সানগ্লাস খুলে দেখাল,
“দেখ, এইটা ভাইয়া আমাকে দিয়েছে।”তারপর হাতের ঘড়িটা নেড়ে বলল,”আর এই ঘড়িটাও।”
সাঁঝের ঠোঁট এক মুহূর্তে ফুলে উঠল। মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। কই, তাকে তো কিছু দেয়নি আরশান ভাইয়া। একটা কিছুও না। বুকের ভেতর হালকা অভিমান জমে উঠল।ঠোঁট বাঁকা হয়ে গেল অভিমানী ভঙ্গিতে।
“তোমাকে দিয়েছে, আমাকে তো দেয়নি…”
অর্ণবের দিকে আর কিছু না বলে সে ঘুরে দাঁড়াল। পায়ের ছোট্ট পায়েল টুংটাং শব্দ করতে করতে দৌড়ে গেল সোজা সিঁড়ি বেয়ে
ওপরতলায় আরশানের রুমের দিকে।
রুমের দরজায় এসে দেখল, ভেতরে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কিছু টাইপ করছে আরশান। চোখে গম্ভীর ভাব, ঠোঁটের কোণে হালকা কুঁচকানো রেখা। সাঁঝ ধপ করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল।
“ভাইয়া।”
আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
“তোকে বলেছি না, নক করে ঢুকবি?”
সাঁঝ মুখটা গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে করে পিছিয়ে গিয়ে দরজাটা টেনে দিল।
দরজায় এবার ঠকঠক করে নক করল।
“আসবো?”
“আয়।”
সাঁঝ এবার ধীরে ধীরে ভেতরে এল, কিন্তু অভিমানী চোখে সরাসরি তাকাল আরশানের দিকে।
“অর্ণব ভাইয়া কে কতকিছু দিয়েছো, আমাকে দিলে না কেন?”
আরশান হাতের আঙুল থামিয়ে তাকাল সাঁঝের দিকে। ছোট্ট মেয়েটার মুখটায় অভিমানের ছাপ আরও গভীর হয়ে আছে। ছোট্ট মুখটা আরো ছোট হয়ে গেছে যেনো বৃষ্টিভেজা মেঘলা আকাশ। আরশান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে ল্যাপটপ বন্ধ করে চেয়ারের পেছনে হেলান দিল। মনে মনে ভাবল, সাঁঝকে কী দেবে? আরশান উঠে গিয়ে কাবাড খুলল। ভেতরে ছোট্ট একটা কালো বাক্স রাখা। বাক্সটা খুলে বের করল একটা চেইন,এটাতে ওর নাম লেখা। মৌসুমী বেগম পছন্দ করে বানিয়েছিলেন, আরশানের জন্য।
আরশান নিজের হাতে চেইনটা সাঁঝের গলায় পরিয়ে দিল।
“এবার খুশি?”
সাঁঝ গলার দিকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। ঠোঁটে একচিলতে হাসি, আর চোখে একফোঁটা আনন্দ।
“এটা অর্ণব ভাইয়া কে দেখিয়ে আসি।”
বলেই খটখট পায়ে ছুটে গেল দরজার দিকে।আরশান ধীরে পা টেনে টেবিলের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। ঘরের হালকা আলোয় তার মুখে ছায়া খেলা করছে,চিন্তাগুলোও আলো-অন্ধকারের মতোই দোদুল্যমান। চোখে এক অদ্ভুত ভাব অপেক্ষা আর অনিচ্ছার মিশ্রণ। মাত্র দুই দিন পর তার কানাডার ফ্লাইট, অথচ মনটা এখনো বাড়ির চারপাশেই বাঁধা পড়ে আছে।
———-
পরদিন।
আরশান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কপাল কুঁচকে তাকালো। ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে দেখে তার চোখ ঠান্ডা হয়ে গেল। রুনা বেগম সোফায় তাঁর মা’র সাথে বসে আছে। রুনা হাতের ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখলেন, তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন,
“সাঁঝ আর কতদিন থাকবে এখানে? আমি ওকে নিতে এসেছি।”
মৌসুমী বেগম একটু গলা খাঁকারি দিলেন, আরশান বিয়ের ব্যাপারে বলতে মানা করেছে। তিনি কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই আরশান এগিয়ে এসে সোফার সামনে দাঁড়াল। তাঁর ভ্রু কুঁচকে আছে, চোখে কঠোর দৃষ্টি।
“সাঁঝ যাবে না। এখন থেকে এখানেই থাকবে।”
রুনা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”কেন থাকবে? ও আমাদের পরিবারের মেয়ে, আমাদের বাড়িতেই থাকবে।”
“আপনার বাড়ি আর বাড়ি নয়, ওর কাছে একেবারে দুঃস্বপ্ন।”
“ওহ! এখন তুমি বোঝাবে ওর জন্য কী ভালো? আমি ওর চাচী, আমি জানি ওর জন্য কী ঠিক।”
“তাহলে ওকে সারাদিন কাজ করিয়ে, খাবার পর্যন্ত ঠিকমতো না দিয়ে রাখতেন না।”
“তোমাকে এসব কথা কে শিখিয়েছে? মৌসুমী, তোমার ছেলেকে তো বেশ ভালোভাবে কথা বলতে শিখিয়েছো।”
মৌসুমী বেগম এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “শিখিয়েছি তো সত্য কথা বলতে। আর এটাই সত্যি সাঁঝ তোমার কাছে নিরাপদ নয়।”
“আমাকে অভিযোগ করছোঁ?”
“অভিযোগ নয়, সত্যি। ওর পিটে যে দাগ এগুলো তো তোমারই দেওয়া আঘাত। কী ভরসায় সাঁঝ কে তোমার সাথে পাঠাবো বলো ?এত কিছু দেখে আমি তো শুধু চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারব না।”
“তোমার এসব নাটক আমার সামনে চলবে না, মৌসুমী।”
আরশান এগিয়ে বলল,”নাটক নয়, এটা সাঁঝের জীবন। আর আমি ওর জীবনে আপনার মতো মানুষের দুঃস্বপ্ন ঢুকতে দেব না।”
“আমি চাই না সাঁঝের খারাপ হোক। আমি ওকে মানুষ করতে চাই। ”
“মানুষ করতে চান? নাকি ওকে আপনার বাড়ির কাজে লাগাতে চান? কোনটা?
রুনার রাগে গলা কাঁপছে, “তুমি বড় হয়েছো বলে ভাবছো আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলার অধিকার পেয়েছো?”
“আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করছি না। আমি শুধু বলছি সাঁঝ এখানেই থাকবে।”
রুনা এবার হাসল, “দেখি, কতদিন আটকে রাখতে পারো।”
“যতদিন আমার নিঃশ্বাস আছে, ততদিন।”
রুনা মৌসুমী বেগমের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোমার ছেলেকে খারাপ করে দিচ্ছো, মৌসুমী।”
“আমি চিনি আমার ছেলেকে তোমার এতো ভাবতে হবে না।”
“এই কথাগুলো আমি মনে রাখবো।”
“আপনি মনে রাখুন, কিন্তু সাঁঝের মুখে আবার কখনো চোখ তুলে কথা বলবেন না।” আরশান বলল।
“তুমি অনেক বড় বড় কথা বলছো, আরশান।
সাঁঝ আমাদের বাড়িতেই থাকবে। কয়েকদিন পর আমি আবার আসবো।”
রুনা এবার তীক্ষ্ণ চোখে আরশানের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকল, তারপর গুটিকয়েক পদক্ষেপ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে……