#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১০
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
[ এলিশা আর সাঁঝ একই। আপনাদের সুবিধার জন্য এলিশা কে সাঁঝ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।]
বাসের ভেতরটা শান্ত। কোথাও মোবাইলের আলো, কেউ’বা হেডফোন কানে দিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। আবার কেউ গভীর ঘুমে হেলান দিয়ে বসে আছে সিটে। জানালার বাইরে ঝাপসা আলোয় ভেসে যাচ্ছে বড় বড় বিল্ডিং আর গাড়ির ভিড়।
সাঁঝ আর আরশান দু’জনেই দাঁড়িয়ে আছে।
তখন হঠাৎই সামনে থেকে ধাক্কা লাগে। ভিড়ের চাপে সাঁঝ পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে সরাসরি গিয়ে পড়ল আরশানের বুকের ওপর। সাঁঝের চুলের ঘ্রানে এক ঝটকায় ভরে উঠল আরশানের নিঃশ্বাস। সাঁঝও চমকে উঠল, নিজের অবস্থাটা বুঝে দ্রুত সরে দাঁড়াল।
আরশানের ভ্রু কুঁচকে গেল। মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ফুটে উঠল। সাঁঝ কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। আরশানের বুকের সাদা শার্টে লালচে দাগ লেগে আছে। কাছে তাকিয়ে বুঝল, ওটা আসলে তার লিপস্টিকের দাগ।
সাঁঝের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। লজ্জা, অস্বস্তি আর অপরাধবোধ মিলে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট রুমাল বের করল।
“স্যরি… আমি… আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
সে কাঁপা হাতে রুমাল দিয়ে শার্টটা মুছতে গেল। কিন্তু মুহূর্তেই আরশানের শক্ত হাত তার কব্জি চেপে ধরল। গলায় বিরক্তি ভরা কণ্ঠ ভেসে এল, “লাগবে না।”
সাঁঝ হকচকিয়ে গেল। তার চোখে আতঙ্কের ছায়া ফুটে উঠল। “বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই ইচ্ছে করে করিনি।”
আরশানের ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। মাথার ভেতর বারবার একটাই কথা বাজছিল। কেন যে আজকে এই বাসে উঠতে এল।
“বললাম না লাগবে না।”
সাঁঝ নিঃশব্দে হাত সরিয়ে নিল। মুখটা লাল হয়ে উঠল লজ্জা আর অস্বস্তিতে। বাস তখনও তার নিয়মিত চলছিল, কিন্তু দু’জনের মাঝের নীরবতা আরও ভারী হয়ে উঠল।
সাঁঝ মাথা নিচু করে রুমালটা আবার ব্যাগে ভাঁজ করে রাখল। বাইরে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু নিজের মনের ভেতরের অস্থিরতা আড়াল করতে পারছিল না।
আরশান তখন ফোন বের করে দ্রুত একটা মেসেজ টাইপ করল। তারপর বিরক্ত মুখে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দিল। উপরের হ্যান্ডেল ধরতে হাত বাড়াল ঠিক তখন বাসটা হঠাৎ একটা বড় ঝাঁকুনি খেল। ভিড়ের চাপে সে ভারসাম্য হারিয়ে তার হাত গিয়ে লাগল সোজা সাঁঝের গালে। ঠাস করে হালকা শব্দ হলো।
সাঁঝ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। চোখ-মুখে বিস্ময় আর অস্বস্তি।
“আ… আপনি আমাকে চড় মারলেন।”
কথাটা শোনার পর চারপাশের যাত্রীরা একসাথে ঘুরে তাকাল। কানে কানে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল আরশানের দিকে। একজন গম্ভীর মুখে বলল, “তুই মেয়েটাকে মারলি কেন? শরীরে এত তেজ ?”
আরেকজনও চোখ রাঙাল,”মেয়েদের উপর হাত তোলা, তাই না? দাঁড়া আজকেই শিক্ষা দিই।”
আরশান হালকা চোখ কুঁচকে তাদের দিকে তাকাল। মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল।
“আমি মারিনি। অ্যাক্সিডেন্টালি হয়ে গেছে।”
কিন্তু তাতে কি? আশেপাশের কয়েকজন আবার হাসাহাসি শুরু করল।
“এখন আবার ভালো ছেলে সাজছে দেখো।পুলিশ ডাকবো নাকি?”
পরিস্থিতি ঘো’লাটে হয়ে উঠছে। মানুষজন ফিসফিস করছে, কেউ আবার মোবাইল তুলে ভিডিও করতে চাইছে। আরশান গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে নিজেকেই দোষ দিল। কেন যে আজ পাবলিক বাসে উঠতে হলো। একটার পর একটা ঝামেলা হচ্ছেই। যদি আগে জানত এমন ঝামেলা হবে, তাহলে হাঁটতেও রাজি ছিল।তারপর ঠান্ডা স্বরে বলল,
“আমার গার্লফ্রেন্ডকে আমি কী করব, কী করব না ওটা তোকে বলে করতে হবে?”
তখন সবাই একসাথে তাকাল সাঁঝের দিকে।
যে ছেলেটা একটু আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে চোখ কুঁচকে বলল, “গার্লফ্রেন্ড?”
আরশান ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তার শার্টের বুকের দিকটা দেখাল। সাদা কাপড়ে স্পষ্ট লিপস্টিকের দাগ। “প্রমাণ চাইলে দেখ।”
সাঁঝ স্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্ময়ে চোখদুটো গোল হয়ে গেল। বলে কী এই লোক?গার্লফ্রেন্ড? ওকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে ফেললো। সে তো জীবনে কোনোদিনও এই লোকটাকে দেখেনি। কী অবলীলায়, কী দৃঢ়তার সাথে লোকটা বলে দিল সে নাকি তার গার্লফ্রেন্ড। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, এই লোকটা কতটা ঠান্ডা মাথায় মুহূর্তে পরিস্থিতি নিজের পক্ষে ঘুরিয়ে দিল। সাঁঝ দাঁত চেপে বলল,
“আপনি মিথ্যা বললেন কেন?”
আরশান এবার সাঁঝের দিকে তাকাল। রাগে মুখটা ফুলে আছে সাঁঝের। সে সামান্য ঝুঁকে এল, এতটাই কাছে যে সাঁঝের কানে গরম নিঃশ্বাস এসে লাগল।
“তোমার জন্য আমি ঝামেলায় পড়ব, সেটা কি আমি বসে বসে দেখব? ভুলে যেও না এটা তোমার জন্যই হয়েছে। তাই চুপচাপ মেনে নাও। নাহলে সোজা এখান থেকে ফেলে দেবো। মাইন্ড ইট।”
সাঁঝ বিড়বিড় করে বলল, “নির্লজ্জ লোক।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সাঁঝ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বুকের ভেতরটা দপদপ করছে। মনে হচ্ছিল, যদি পারত, এখানেই এই মানুষটার মুখে চড় কষাত। তখন বাসটা হালকা ব্রেক কষতেই থামল। মুহূর্তের মধ্যে যাত্রীরা ধাক্কাধাক্কি করে নামতে শুরু করল। সাঁঝ দ্রুত ভিড় ঠেলে নেমে গেল। তার ভ্রু কুঁচকে আছে, চোখে এখনো রাগ জমে আছে। ঠোঁট কামড়ে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজের পথে চলে গেল।
আরশানও নামল, কিন্তু ওর ভঙ্গিতে সেই আগের মতোই নির্বিকার ভাব। সামনের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। একবারও চোখ ঘুরিয়ে দেখল না আশেপাশে কে আছে।
দু’জন দু’দিকে এগিয়ে গেল। সাঁঝ ডানে মোড় নিল, আরশান বাঁ দিকে। পিছনে ফিরে কেউ কাউকে আর দেখল না।
————
আরশান বিরক্ত মুখে অফিসে ঢুকল। জরুরি একটা ফাইলও ঘরে থেকে গিয়েছিল, সেটাই আনতে গিয়ে বাসে উঠতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ বাসের সেই ঘটনাটা তার মেজাজ আরও খারাপ করে দিল। অফিসের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখল, নির্ভাণ আর জাইরান দু’জন আরাম করে বসে আছে। টেবিলে কফি, ল্যাপটপ খোলা। নির্ভাণ আরশানের দিকে চোখ কুঁচকে ওর শার্টের দিকে তাকাল।
“ওহহহ! শা’লা, তুই তলে তলে টেম্পু চালাস অথচ আমাদের কিছু বলিস না?”
আরশান চোখ ঘুরাল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“চুপ কর তো, মাথা খারাপ কোরিস না।”
জাইরান শার্টের বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ” এই দাগটা কী রে শান? ফুলে আছিস কেন? কার সাথে প্রেম করছিস?”
“বল, আমরা কিন্তু তোর পুরনো বন্ধু। লুকোনো প্রেমের গল্প জানার অধিকার আমাদের আছে।”
আরশান কফির কাপে চোখ রাখল। ঠোঁটে এক চিলতে বিরক্তি মেশানো হাসি এঁকে ধীরে বলল,
“যদি প্রেমই করতাম, এতদিনে দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম।”
নির্ভাণ আর জাইরান দুজনেই একসাথে হেসে উঠল।
“মিথ্যে বলিস না, শান। ওই লিপস্টিকের দাগটা কীভাবে এলো তাহলে?”
আরশান ঠোঁট কামড়ে চুপ রইল কিছুক্ষণ। মনে পড়ল বাসের সেই মেয়েটার মুখ। তার চোখের রাগ, ঠোঁটে চাপা প্রতিবাদ। মুহূর্তের জন্য মুখটা ভেসে উঠতেই মাথা আরও গরম হয়ে গেল।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আজব একটা ঝামেলায় পড়েছিলাম, ব্যস।”
জাইরান ভুরু তুলল, ” ঝামেলা মানে? মেয়ে জড়িত?”
আরশান কটমট করে তাকাল ওদের দিকে।
“একটা দাগ দেখেই এত তদন্ত শুরু করছিস কেন?”
আরশান বিরক্ত মুখে চেয়ার টেনে বসল। ল্যাপটপের দিকে চোখ রাখলেও মাথার ভেতর তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে বাসের ঝামেলাটা। শার্টের বুকের কাছের দাগটা আরও অস্থির করে তুলছে। নির্ভাণ আবার পাশ থেকে খোঁচা দিল,
“শান, এত সিরিয়াস কেন?”
আরশান চোখ পাকাল। কফির কাপটা জোরে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল,
“আমাকে একটা শার্ট এনে দে। আমার জন্য হয়তো মিটিংটা দেরি হয়ে যাচ্ছে… তাড়াতাড়ি চল।”
জাইরান চেয়ারে হেলান দিয়ে হেসে উঠল।
“ওরে বাবা! তোর এত তাড়াহুড়া? দাগটা ঢাকতেই নাকি এত চিন্তা?”
আরশান দাঁড়িয়ে গেল, এবার কণ্ঠে ধৈর্যহীনতা স্পষ্ট।
“জাইরান, আমি সিরিয়াস। আমার কেবিন থেকে নতুন একটা শার্ট এনে দে। এই অবস্থায় আমি ক্লায়েন্ট মিটিং-এ যেতে পারব না।”
“এখন বুঝি কেবিন থেকে শার্ট এনে উদ্ধার করতে হবে।”
আরশান গম্ভীর চোখে তাকাল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ যে মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল। জাইরান এবার শান্ত গলায় বলল,
“ঠিক আছে, তোর কেবিনে গিয়ে শার্ট নিয়ে আসছি। কিন্তু শান, সিরিয়াসলি বল তো… ব্যাপারটা আসলে কী?”
“বলেছি তো, একটা ঝামেলা হয়েছে। ব্যস। বাড়তি কিছু না।”
নির্ভাণ তখন বলল, “এ্যাই, তুই ভুলে গেছিস মনে হয়… ওর বেবি বউ আছে তো।”
নির্ভাণের কথা শুনে আরশানের হাত একদম থেমে গেল। তার বুকের ভেতরটা কেমন যেনো হাহাকার করে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোট্ট একটা মুখ। এখন কেমন আছে? চোখ নামিয়ে বড় কাঁচের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইল আরশান। গ্লাসের স্বচ্ছ জলে নিজের মুখের ক্লান্ত প্রতিচ্ছবি দেখল। ঠোঁট নড়ল আস্তে আস্তে,
“ওকে স্পর্শের চাইতে এক নজর দেখার তৃষ্ণাই আমার মন বেশি ব্যাকুল করে তোলে।”
অফিসের ভেতর হঠাৎ নিস্তব্ধতা নেমে এল। নির্ভাণ আর জাইরান দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকাল। আরশানের চোখে সেই গভীর শূন্যতা ওরা নতুন নয়, অনেকবারই দেখেছে।
জাইরান মৃদু গলায় বলল,
“কেন বলতে গেলি। জানিস তো, এটা ভাবতে গেলেই ওর মুড অফ হয়ে থাকে।”
পরিস্থিতি হালকা করতে জাইরান কাঁধে হাত রেখে বলল, ” চল, শান। মিটিংটা শেষ করতে হবে। ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে।”
আরশান ধীরে নিঃশ্বাস ফেলল, “চল।”
———-
সাঁঝ রাস্তা ধরে হাঁটছে। বাস থেকে নামার পর মন খারাপটা কেটে যায়নি, তাই চোখে-মুখে এখনও অস্থিরতা। হঠাৎ সামনের খোলা জায়গায় কয়েকটা ছোট্ট বাচ্চাকে খেলতে দেখে থেমে গেল। বাচ্চারা গোল হয়ে বসে মার্বেল খেলছে, কেউবা আবার লাফঝাঁপ করছে। সাঁঝ হালকা হাসল। কিছুক্ষণ তাদের সাথে সেও খেলা করল। হাসতে হাসতে নিজের অজান্তেই মনটা হালকা হয়ে গেল। সময় কখন কেটে গেল, টেরও পেল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে শুরু করেছে। চারপাশে আলো -আঁধারির খেলা। তখন ফোনটা হাতে নিয়ে অন করতেই দেখল অসংখ্য মিসড কল। আগেই ফোনটা অফ করে রেখেছিল সে। এতগুলো মিসড কল দেখে সাঁঝের বুক ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি আগে ফোন দিল বাড়িতে। ওপাশ থেকে সোফির তীক্ষ্ণ, উৎকণ্ঠিত গলা এলো,
“কোথায় আছিস,এলিশা? সামির তোকে ভার্সিটিতে পাইনি। কোথায় গেলি?”
সাঁঝ হকচকিয়ে গেল। মিথ্যা বলার মতো অবস্থা নেই। হালকা গলায় উত্তর দিল, “আমি আসছি, মা।”
“তাড়াতাড়ি আয়! সামির এখন পুলিশ স্টেশনে।”
“পুলিশ স্টেশনে কেন? ”
“তোকে খুঁজতে গিয়ে তখন একটা ছেলের সাথে ঝগড়া লেগে গেছে। সাথে আবার মিরাবের ফিয়ন্সে জাইরান আর তার বন্ধুরাও আছে।”
সাঁঝে কেঁপে উঠল। “কিহ! এতকিছু ঘটে গেছে এই অল্প সময়ের মধ্যে?”
“তোর কিছু হয়নি তো, মা?”
“না, মা। আমি ঠিকাছি। চিন্তা করো না, আসছি আমি।”
ফোন কেটে সাঁঝ অস্থির হয়ে পড়ল। মাথার ভেতর একের পর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। সামির ভাইয়া পুলিশ স্টেশনে কেন? ভার্সিটিতে কী এমন ঘটল, যে কারণে সেখানে যেতে হলো? আর জাইরান ভাইয়াও কেন সেখানে? অজানা শঙ্কায় বুক ধকধক করতে লাগল সাঁঝের। সে এবার হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল।
চলবে…..
[রি-চেক করা হয়নি।]