এক চিলতে প্রেম পর্ব-১২+১৩

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১২
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

কানাডার আকাশটা নীলচে অন্ধকারে ঢাকা, চারপাশে কোমলতার আলো ছড়িয়ে আছে। হালকা বাতাসে গাছের ডাল দুলছে, মাঝে মাঝে দূরে কোনো গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। চারপাশ শান্ত, শুধু পাখির মৃদু ডাক আর বাতাসের শব্দ শোনা যায়। দূরের ম্যাপল গাছের পাতাগুলো নড়ছে।
সাঁঝ দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। ঠান্ডা হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে। হঠাৎ সামনের রাস্তায় একটা গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল। গাড়িটা ধীরে ধীরে এবার বাড়ির গেটের সামনে এসে থামল। সাঁঝ হাসলো।

“এসে গেছে।”

ভেতর থেকে শুয়ে থাকা মিরাব শুনলো। সে আধোঘুমন্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
“তুই জানলি কী করে?”

সাঁঝ দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকাল, তারপর হেসে বলল, “ম্যাজিক!”

মিরাব হেসে উড়িয়ে দিলো। তখনই তার ফোনে টুং শব্দ হলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠল জাইরানের মেসেজ। মেসেজ খুলতেই চোখের কোণে হাসি খেলে গেল। খুব সাধারণ একটা লাইন, তবু হৃদয়কে নড়বড়ে করে দেওয়ার মতো।
“আমি নিচে এসে গেছি।”

মিরাবের বুক কেমন দুলে উঠলো। সে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে পড়ল, তাড়াহুড়া করে একটা শাল কাঁধে জড়িয়ে নিলো। আয়নায় নিজের চেহারা একবার দেখে নিলো, তারপর ছুটে গেল নিচে। সাঁঝ ও পিছু পিছু গেল। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল জাইরান। তার সাদা টিউলিপ ফুল। কানাডার বসন্তে টিউলিপের গন্ধই আলাদা।
গেটের কাছে পৌঁছতেই দেখা গেল। জাইরান দাঁড়িয়ে আছে। মিরাব এগিয়ে গিয়ে নরম স্বরে বলল,”ফুল।”

“কেন তোমার পছন্দ হয়নি?”

“পছন্দ হয়েছে তো।”

মিরাব ফুল হাতে নিল। সাঁঝ তখন নিচে এসে টমকে ডেকে আনলো। সামিরের কুকুর’টা, ছোট্ট চঞ্চল সাদা-বাদামি রঙের। টমের গলায় সবসময় একটা লাল দড়ি বাঁধা থাকে।

সাঁঝ বলল, “যা টম, ওদের একটু ডিসটার্ব করে আয়। ”

টম যেনো সাঁঝের কথা বুঝতে পারলো। খুশিতে লাফিয়ে গেটের দিকে দৌড়ে গেল। সাঁঝ এবার নিজের নুটি’র দিকে তাকালো। নুটি ছোট্ট খাঁচায় বসে বাদাম চিবুচ্ছিল। সাঁঝ হাসি মুখে ফিসফিস করে বলল,

“তুইও যা নুটি, আজ একটু মজা হবে।”

নুটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে লাফ দিলো। সাঁঝ পেছনে সরে লুকিয়ে পড়লো একপাশে, ঠোঁট চেপে হাসি চাপতে লাগলো। টম দৌড়ে জাইরানের পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো।
জাইরান প্রথমে চমকে উঠলো, তারপর কুকুর’টাকে দেখে মাথা নেড়ে হেসে ফেললো।

“তোমাদের কুকুর’টা মনে হয় আমাকে খুব একটা পছন্দ করছে না।”

মিরাব অপ্রস্তুত হয়ে গেল। “না না, আসলে… ও একটু বেশিই এক্সসাইটেড।”

এমন সময় নুটি হুট করে মিরাবের কাঁধের ওপর লাফ দিলো। মিরাব ভয়ে চিৎকার করে উঠলো,

“আআহ! নুটি।”

সাঁঝ লুকানো জায়গা থেকে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তার হাসির শব্দ চাপা থাকলেও দুজনের কানে গেলো। জাইরান মাথা উঁচু করে তাকালো।

“লুকিয়ে লাভ নেই, এলিশা। এদিকে আসো।”

সাঁঝ দূরের ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো, হাতে নুটিকে ধরে আছে। মুখে তার আগের মতোই দুষ্টু হাসি।

“আচ্ছা আচ্ছা… ধরা তো পড়লামই। কিন্তু কালকের ট্রিটের কথা ভুলবে না, ভাইয়া। আপনার পকেট কিন্তু হালকা হবেই।”

জাইরান হাসলো। “আমার পকেট খালি করা এত সহজ না।”

“কালকেই বুঝবেন।”

“তুমি একেবারে ছোট্ট ঝড়।”

“ঠিক ধরেছেন।”

মিরাব বিরক্তি ভরা স্বরে বলল,”আর একটুও যদি বাড়াবাড়ি করিস… কালকে কোনো ট্রিট নেই।”

“উফ! বিশ্বাসঘাতকতা। নিজের বোনই আমাকে সাপোর্ট করলো না।”

জাইরান হালকা হেসে মিরাবের দিকে তাকাল। “চিন্তা করো না, কালকের ট্রিট আমি সামলে নেব।”

“হ্যা, আপনাকেই তো সামলে নিতে হবে।”

সাঁঝের কথায় দু’জনেই হাসলো।

————–

সাঁঝ আজ সাদা ড্রেসটা পরেছে। হালকা নরম কাপড়, হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা। গলার কাছে সুতোর কাজ, আর হাতার কিনারায় ছোট ছোট মুক্তোর মতো বোতাম ঝুলে আছে। স্ট্রেট চুলগুলো পিঠ ছুঁই ছুঁই । একপাশে ওড়নাটা হালকা করে গুঁজে দিল, আয়নায় শেষবারের মতো দেখে নিলো। মুখে অতিরিক্ত সাজসজ্জা নেই। মেহুলও সাজগোজ সেরে বের হলো। তার গায়ের ওপর গোলাপি ড্রেস পড়েছে। ফ্লোরাল কাজ করা শাড়ির মতো লম্বা ড্রেসটা তার চঞ্চল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে গেছে।
মিরাবও প্রস্তুত। গোল্ডেন কালারের ড্রেস পরেছে। গোল্ডেন ড্রেসের সাথে সিল্কের ওড়না।

তিন’জনই একসাথে বের হলো। গেটের বাইরে ভর দুপুরের আলো ঝলমল করছে। হালকা বাতাস বইছে, তাতে ওড়না দোল খাচ্ছে।
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জাইরান আর নির্ভাণ, আরশান। সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাঁঝ প্রথমে তাদের চোখ এড়িয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকালো। কিন্তু পরক্ষণেই তার দৃষ্টি গিয়ে আটকালো এক জায়গায়। সামনের গাড়ির হুডের ওপর বসে আছে ছেলেটা। ফর্সা মুখ কিছুটা লাল হয়ে আছে। পরনে জিন্স শার্ট । সামনের দুটো বোতাম খোলা আর সেই ফাঁকে অলসভাবে ঝুলছে একটা কালো সানগ্লাস। তার হাতের আঙুলগুলো ব্যস্ত মোবাইলের স্ক্রিনে, যেন চারপাশের কোনো কিছুই তার চোখে পড়ছে না। সামনের চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ে এসে কপালে পড়ছে, আর সে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে সেগুলো সরাচ্ছে।

সাঁঝ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। মুখটা খুব চেনা লাগছে । কিছুক্ষণ তাকিয়েই তার মনে পড়লো। বাসের সেই বিরক্তিকর ছেলেটা।
তার ভ্রু কুঁচকে উঠলো সাথে সাথে।
আবার এই লোক! মনে মনে বিরক্তি উগরে দিল সাঁঝ। দুনিয়ায় এত ছেলে থাকতে কেন এই ছেলেটাকেই জাইরানের বন্ধু হতে হলো। সেদিন বাসে ওর আচরণে যে বিরক্তি জমেছিল, আজ আবার নতুন করে সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এখন তো ওদের বার বার দেখা হবে।

নির্ভাণ গাড়ি থেকে নামতেই চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। বসন্তের বিকেল, হালকা হাওয়ায় গাছের ডালপালা দুলছে। ভেতর থেকে তখন একে একে তিনটা মেয়ে বেরিয়ে আসছে।
প্রথমেই চোখ আটকাল সামনের গোলাপি ড্রেস পরা মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চলাফেরায় মিষ্টি চঞ্চলতা। নির্ভাণ হালকা হাসলো, বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা টান অনুভব করলো। নিজের অজান্তেই ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এলো,
“দিল নিকাল গেয়েয়া।”

আরশান ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তা কাকে দেখে মনে ঘণ্টা বেজে উঠলো,হুঁ?”

নির্ভাণ চোখ না সরিয়েই মাথা সামনের দিকে ইশারা করলো। “তুই একবার তাকিয়ে দেখ।”

আরশান অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা তুললো। তবে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সাদা ড্রেস পরা মেয়েটার ওপর। কিন্তু মেয়েটার মুখটা দেখেই আরশানের চোখ কুঁচকে গেল। এটা তো সেই বাসের মেয়েটা। কিছুদিন আগের বিরক্তিকর ঘটনার স্মৃতি ভেসে উঠলো।আজ আবার হঠাৎ করে সামনে। আরশান বিরক্তিতে ঠোঁট চেপে ধরলো।
“কি আজব ব্যাপার! দুনিয়া তো ছোট না?”

ওরা আসতেই জাইরান,নির্ভাণ আর আরশানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার শালীদের সাবধানে নিয়ে যাবি।”

নির্ভাণ সঙ্গে সঙ্গেই ঠোঁটে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিল,”চিন্তা করিস না। সুন্দর মত ড্রেনে ফেলে আসবো।”

মেহুল থমকে গিয়ে ভ্রু উঁচু করল। “আপনাদেরও চিন্তা নেই। একটা হাড্ডি ও আস্ত থাকবে না।”

চোখেমুখে খুনসুটির হাসি দেখে মুহূর্তেই চারপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। নির্ভাণ মজা করে বুকে হাত দিয়ে বলল,

“হায় আল্লাহ, শালীদের থেকে বাঁচতে আমাদের নাকি সিকিউরিটি দরকার।”

সাঁঝ মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। ওর হাসি পেল না। বরং বিরক্তিতে চোখ ঘুরাল। আরশানের মুখে ও কোনো অভিব্যক্তি নেই। দু’জনেরই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে আছে। কিন্তু সেটা কেউ কাউকে দেখাতে চায় না।

জাইরান আর মিরাব আলাদা এক গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট হতেই সাঁঝ, মেহুল, নির্ভাণ আর আরশান অন্য গাড়ির দিকে এগোল।
নির্ভাণ আর আরশান সামনে বসল। পিছনের সিটে সাঁঝ আর মেহুল। গাড়ি কানাডার রাস্তায় ছুটছে। চারপাশে ছিমছাম সবুজ ঘাসে মোড়া লন, কোথাও কোথাও ফুলে ভরা গাছ। হালকা বাতাস জানালা দিয়ে ভেতরে আসছিল।
পিছন থেকে মেহুল বলল,

“ভাইয়া, সামনে একটা স্কুল আছে। একটু থামবেন।”

আরশান স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ব্রেক চাপল। গাড়ি স্কুলের সামনে থেমে গেল। সামনের মাঠে কিছু বাচ্চা ছুটোছুটি করছে, কেউ বল খেলছে, কেউ বই হাতে বসে আছে। মেহুল দরজা খুলে নামল। গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পর নির্ভাণ সিটে হেলান দিয়ে বলল,

“আমি আসছি।”

আরশান ভ্রু কুঁচকালো,”তুই আবার কোথায় যাবি?”

“আমার ১ নাম্বার পেয়েছে।”

কথা শেষ করেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দৌড় দিল। সাঁঝ এতক্ষণ পর্যন্ত গম্ভীর মুখে বসেছিল, কিন্তু নির্ভাণের কথাটা শুনে হঠাৎ মুখ টিপে হেসে ফেলল। কিছুক্ষন পর আরশান এক ঝলক তাকাল সামনের আয়নার দিকে। কাচের প্রতিফলনে ভেসে উঠল সাঁঝের দৃষ্টি। আর ঠিক সেই সময়েই সাঁঝও তাকিয়েছিল ওদিকে। কিন্তু সেই নীরব স্পর্শ টিকল না বেশিক্ষণ। পরক্ষণেই দু’জনে অস্বস্তি লুকোতে চোখ সরিয়ে নিল।
আরশান সামনে রাস্তার দিকে তাকাল, আর সাঁঝ জানালার বাইরে তাকিয়ে পড়ল, যেনো কিছুই হয়নি। এরমধ্যে স্কুলের গেটের ভেতর থেকে প্রথমে দেখা গেল মেহুল ফিরছে। সাঁঝ এতক্ষণে যে অস্বস্তির ভেতরে ছিল, সেটা হালকা হয়ে গেল।
মনে হচ্ছিল, গাড়ির ভেতরে ওর আরশানের সঙ্গে সেই অদ্ভুত চোখাচোখির পর পরিবেশটা ভারী হয়ে গিয়েছিল। মেহুল ফিরে আসাতে সেটা কেটে গেল। কিছুক্ষণ পর নির্ভাণও গাড়িতে এসে বসল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।

চলবে……

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৩
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

ক্লাসের ঘণ্টা বাজতেই সবাই ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করল। করিডোর ভরে উঠলো হইচই আর কথাবার্তায়। সাঁঝ ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে মেহুলের সঙ্গে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে সাঁঝের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। করিডোরের একপাশে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এরিক। তার মাথায় এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা, ক’দিন আগের সেই মার খাওয়ার দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু সাঁঝের অবাক লাগে। এই লোকটার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই, বরং চোখ দুটো আরও ভয়ঙ্কর, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। এরিক একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সাঁঝের দিকে। সাঁঝ একটু গা শিরশির করে উঠলো, কিন্তু সে চোখ সরিয়ে নিলো। এই ছেলেটাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে। মনে মনে ভাবলো সাঁঝ। তার বুকের ভেতর হালকা অস্বস্তি জমলেও মুখে প্রকাশ করল না।

তারা দু’জন করিডোরের ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগোচ্ছে। তখন হঠাৎই পেছন থেকে কেউ ধাক্কা দেয়। সাঁঝ ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই মেহুল হাত বাড়িয়ে তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল।
সাঁঝ দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। পিছনে দাঁড়িয়ে এরিক, মুখে ঘৃণ্য হাসি।

সাঁঝের রাগ উঠল। ঠোঁট কামড়ে থমকে না থেকে সে সরাসরি বলে ফেলল,

“শা’লার কাউয়া, তুই দেখে চলতে পারিস না নাকি?”

বাংলা ভাষা এরিক বোঝে না, তবে তার চোখমুখ দেখে বোঝা গেল যে কথাটা নিশ্চয় ভালো কিছু নয়। কপাল কুঁচকে এক পা এগিয়ে এসে নিচু স্বরে দাঁত চেপে বলল,

“তোকে আমি পরে দেখে নেবো। এমন শিক্ষা দেবো তুই নড়তেই পারবি না।”

সাঁঝের মেরুদণ্ডে হালকা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। চোখে অদ্ভুত এক ঝিলিক। হুমকি দিয়ে আনন্দ পাচ্ছে। করিডোরের হইচইয়ের মাঝেও মুহূর্তটায় সাঁঝ আর এরিকের মধ্যে অস্বস্তিকর টানটান অবস্থা তৈরি হলো।মেহুল সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে সাঁঝকে আড়াল করল, তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

“এলি, চল। এখানে দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই। এ পাগলটা মার খেয়েও শিক্ষা পায়নি। উল্টো আরও উগ্র হয়ে গেছে।”

সাঁঝ কিছু না বলে ব্যাগটা শক্ত করে ধরে মেহুলের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।

———

স্কুলের গেটের বাইরে হালকা ভিড়। ছুটির ঘন্টা বাজতেই ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ে বের হতে শুরু করেছে। কারও হাতে বইয়ের ব্যাগ, কারও হাতে টিফিন বক্স, আবার কেউ মা-বাবার হাত ধরে খিলখিল করে হাসছে। গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভাণ আর আরশান। সেদিন মেহুল যেই স্কুলে গিয়েছিল, সে আজ ইচ্ছে করেই আরশানকে নিয়ে এসেছিল এখানে। এখানে মেহুল তাঁর ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিল। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষার পর ভিড়ের মাঝ থেকে দেখা গেল মেহুলের ছোট ভাই কে। গোলগাল মুখ, চোখে দুষ্টু ঝিলিক, ব্যাগ কাঁধে ঝুলছে। সাথে সাথেই চেনা লাগল।

“ওই যে! এ তো মেহুলের ছোট ভাই।”

নির্ভাণ দ্রুত এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে। গিয়েই হেসে বলল, “হাই শালাবাবু।”

ছেলেটা হাঁটা থামিয়ে তাকাল নির্ভাণর দিকে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।
নির্ভাণের মনে হচ্ছিল, ওর ছোট ভাই নিশ্চয়ই মিষ্টি মিষ্টি কিছু উত্তর দেবে, কিন্তু প্রত্যাশার উল্টো হলো। ছেলেটা মুখটা বাঁকা করে, ঠোঁট কুঁচকে বলল, “রাবিশ।”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য ও একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এত ছোট একটা ছেলে তাকে রাবিশ বলছে।

“কি বললি?” নির্ভাণের ভ্রু কুঁচকে গেল, চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল ওর দিকে।

ছেলেটা একটুও ভয় পেল না। নির্বিকার মুখে ব্যাগটা সামলে আবার হাঁটা শুরু করল, যেনো কিছুই হয়নি। ওদের দেখে আরশান হাসলো।

“তোকে মনে হয় পছন্দ হয়নি।”

একটু পর ছেলেটা নির্ভাণের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎই হাত উঠিয়ে মিডল ফিঙ্গার দেখালো। কোনো কথা না বলেই দৌড়ে চলে গেল ভিড়ের মধ্যে। নির্ভাণ একেবারে স্থির হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,

“দেখেছিস এই বিচ্চু কত পাজি। দুষ্টুমিতে পুরো গডফাদার।”

“চল, এখানে দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই। পরে জেনে নিবি।”

নির্ভাণ গভীর নিঃশ্বাস ফেলল।
“হ্যাঁ, পরে জেনে নিবি ঠিকই। তবে এখন মনে হচ্ছে , মেহুলের ভাই মানে একেবারে ছোটখাটো ভিলেন হবে।”

——–

ট্রামটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। ভিড়ে গাদাগাদি অবস্থা, চারপাশে শপিং ব্যাগ হাতে লোকজনের কোলাহল। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের আলো ফিল্টার হয়ে ভেতরে ঢুকছে। ঘণ্টার শব্দ বাজছে, মাঝে মাঝে হালকা দুলুনি দিচ্ছে ট্রামটা। সামনের দিকে পাশাপাশি বসে আছে আরশান, সাঁঝ, নির্ভাণ আর মেহুল। প্রত্যেকের হাতে শপিং ব্যাগ। ওরা সবাই শহরের মলে ঢুঁ মেরে ফিরছে। জাইরান আর মিরাবকে ইচ্ছে করেই অন্য বগিতে পাঠানো হয়েছিল, যাতে ওরা একটু একসাথে সময় কাটাতে পারে। কিন্তু এদিকে বসে থাকা আরশান মোটেও স্বস্তিতে নেই। জায়গা এতটাই কম যে, চেপে বসা ছাড়া আর উপায় নেই। তার লম্বা দেহ গুটিয়ে বসার চেষ্টা করছে, কিন্তু যতই সরতে চায়, পাশে বসা মেয়েটির গায়ের সাথে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঠেকে যাচ্ছে। সাঁঝ প্রথমে কিছু বলল না। চোখ তুলে দেখল, লোকটা একদম ওর গা ঘেঁষে বসে আছে। মুখটা লাল হয়ে গেল রাগে আর অস্বস্তিতে। শেষমেশ ওর ধৈর্য ভাঙল।

“আপনার কী সরম করছে না? এভাবে লেগে বসেছেন কেন? দূরে যান।”

আরশান ভুরু কুঁচকালো, ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর দিল, “তুমি ভাবছো আমি খুব মজা পাচ্ছি নাকি? আমার কোনো ইচ্ছা নেই তোমার সাথে চিপকে বসার।”

তার কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট। সাঁঝ এক ঝলক তাকিয়ে আবার দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল জানালার দিকে। ওর বুক ধড়ফড় করছে। চারপাশে লোকজন থাকলেও মনে হচ্ছে সবাই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ট্রামটা ধাক্কা খেয়ে থামল। ঘণ্টা বাজল। সবাই নামতে শুরু করল। মেহুল উঠে দাঁড়াল, শপিং ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। পিছনে সাঁঝও ধীরে ধীরে উঠল নামার জন্য। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই বিপত্তি ঘটল। সাঁঝ উঠে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় ধস করে আবার বসে গেল সিটে। কারণ আরশান অজান্তে বসেছিল তার লম্বা ওড়নার ওপর। চারপাশের কয়েকজন যাত্রী অবাক হয়ে তাকাল। সাঁঝের মুখ মুহূর্তেই লাল হয়ে গেল, মনে হল মাটি ফুঁড়ে যদি ভেতরে চলে যেতে পারত।

সে অসহায়ের মতো নিজের ওড়না টানতে লাগল। আরশান বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল। অস্বস্তিও তার চোখেমুখে স্পষ্ট।
কিছু বলবে কিনা বুঝতে পারছিল না। ঠোঁট নড়ল, কিন্তু শব্দ বের হল না। সে কোনো কথা না বলেই নেমে গেল ট্রাম থেকে। নির্ভনও তার পিছু পিছু গেল। এদিকে মেহুল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেসে কুটি কুটি।

“আরেকটু হলেই তুই উনার কোলে বসে পরতি।”

“মেহুল!”

—-

মিরাব আর জাইরানের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। চারদিকে আলোয় সাজানো, ফুলের মালার গন্ধে পরিবেশ আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। সবাই বিদায়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বিদায় জানাতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব চারপাশে ভিড় করছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরশান আর নির্ভন। দুজনেই নিঃশব্দে চারপাশ দেখছে। ওদের পাশে সাঁঝ আর মেহুল। সবার চোখেই আনন্দ আর আবেগের ছাপ।

নির্ভাণ তখন নরম গলায় বলল, “তোমাদের আজকে অনেক প্রিটি লাগছে।”

আরশান মুখ ঘুরিয়ে নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলল,”চুন্নি লাগছে।”

কথাটা এত আস্তে বলল যে মনে হলো, শুধু বাতাসই শুনল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁঝ শুনে ফেলল। চোখের কোণে দুষ্টু ঝিলিক খেলে গেল, তবে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। মনে মনে ঠিক করে নিল,পরে মজা বুঝিয়ে দেব।
এদিকে,জাইরান আর মিরাব, গাড়িতে উঠেছে। বিদায়ের সময়ের আবেগঘন মুহূর্ত চলছে।
এই সুযোগেই সাঁঝ নিজের ছোট্ট পরিকল্পনা কার্যকর করল। তার হাই হিলের ধারালো অংশটা দিয়ে আরশানের পায়ের ওপর বেশ জোরে চাপ দিল। ব্যথায় মুখ কুঁচকে গেল আরশানের। সে তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে রাগে চোখ বড় করে সাঁঝের দিকে তাকাল।

“দেখে চলতে পারো না নাকি ?”

কিন্তু সাঁঝ একটুও বিচলিত হলো না। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,”আমি ইচ্ছে করেই দিয়েছি।”

আরশান মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “ইচ্ছে করে ?”

সাঁঝ এবার হাত গুটিয়ে বুকের কাছে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে উত্তর দিল,

“ভেবে দেখুন তো, আপনি কী দোষ করেছেন।”

আরশান ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ মনে মনে খোঁজাখুঁজি করল। তেমন কিছু তো ওর মনে পড়ছে না।

“আমি তো এমন কিছু করিনি…”

মুখে সেটা প্রকাশ করতেই সাঁঝ মুচকি হেসে ধীরে ধীরে পিছন ফিরল।

“আসলে নিজের দোষ কেউ দেখে না।”

কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে সাঁঝ ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেল। এখন মনটা হালকা হল। এদিকে
আরশান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখনও সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আসলে কী এমন করে ফেলল সে?

চারপাশে মানুষের ভিড়। শব্দ কোলাহলে জায়গাটা ভরে আছে। মেহুল ছোট ছোট পা ফেলে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে। চোখে একরাশ দুশ্চিন্তা। গলায় উৎকণ্ঠার চাপা সুর,

“নিকো! নিকো কোথায় গেলি?”

মেহুলের কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট। ওর ছোট ভাইটা কোথায় উধাও হয়ে গেছে। মানুষের ভিড়ের মধ্যে ছোট্ট ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। অন্যদিকে নির্ভাণ ও মেহুলকে খুঁজছে।
নির্ভন ঠিক সামনে তাকিয়ে হাঁটছিল, তাই খেয়াল করেনি, পায়ের কাছেই নিচে মাটিতে কেউ বসে আছে। ছোট্ট নিকো মাটিতে বসে গম্ভীর হয়ে জুতোর ফিতা বেঁধে চলেছে। ওর ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো বারবার ফিতাটা সোজা করছে, আবার গিঁট দিতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছে। তখনই নির্ভাণের পা সামান্য ছুঁয়ে গেল নিকোর গায়ে। নিকো কেঁপে উঠে মাথা উঁচু করে বলল,

“রাবিশ! দেখে চলতে পারিস না নাকি?”

নির্ভাণ চমকে নিচে তাকাল। খানিকটা অবিশ্বাস আর অবাক দৃষ্টিতে দেখল।

“আরে, এ তো মেহুলের ছোট ভাই। শালাবাবু দেখছি এখানে বসে আছে… তাহলে বোন কোথায়?”

নিকো কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে তেজ দেখিয়ে উত্তর দিল, “আমার বোনকে দিয়ে কী করবি?”

নির্ভাণ স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন দাপুটে জবাব আশা করেনি এতটুকু ছেলের কাছ থেকে। কপালটা কুঁচকে উঠল,”শা’লা, এইটুকু ছেলে… তেজটা কম কিছু না।”

ঠিক তখনই দূর থেকে শোনা গেল এক চেনা ডাক। “নিকো।”

মেহুল দৌঁড়ে আসছে, শ্বাস হাঁপিয়ে উঠেছে। ভাইকে সামনে দেখে বুক ভরে উঠল। নিকো সুযোগ বুঝে মাটিতে বসেই হঠাৎ মিথ্যা কান্না শুরু করে দিল। চোখ মুছে নাক সিঁটকাচ্ছে, যেনো ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। মেহুল কাছে এসে হুড়মুড় করে ভাইকে জড়িয়ে ধরল।

“কী হয়েছে? কান্না করছিস কেন?”

নিকো তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,
“আপু, এই লোকটা আমাকে মেরেছে।”

মেহুল চোখ বড় বড় করে তাকাল নির্ভাণের দিকে।

“আপনি? এতটুকু ছেলের ওপর হাত তুলেছেন?”

নির্ভাণ এক পা এগিয়ে এসে,”মেহুল, বিশ্বাস করো… আমি ওকে ছুঁইনি। মারার প্রশ্নই ওঠে না।”

মেহুল কিছু না বলে নির্ভাণের চোখে চোখ রেখেই শক্ত স্বরে বলল, “চল।”

নিকো কান্নার ভান করতে করতে বোনের হাত ধরে এগোল, কিন্তু হাঁটার ফাঁকে হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে নির্ভনের দিকে তাকাল। ছোট্ট মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠল। নির্ভাণ তখনও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

চলবে……..