এক চিলতে প্রেম পর্ব-১৬+১৭

0
6

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৬
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

সকালের রোদ জানলার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে। দূর দিগন্তে সূর্য ঘুম জড়ানো চোখ মেলে ধীরে ধীরে আলো ছড়াচ্ছে। বাতাসে শিশিরের গন্ধ, ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকা জলের
ফোঁটাগুলো আলো পেয়ে হিরের মতো ঝিকমিক করছে। পাখিরা ডানা মেলে ডাকছে। ঘুম ভাঙলো সাঁঝের। বিছানায় শুয়ে থেকেই কিছুক্ষণ চারপাশ দেখে মিষ্টি হাসলো সাঁঝ।
চুপচাপ উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলটার দিকে তাকাল। গলার চেইনটা খুলে আলতো করে রাখলো সেখানে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। ভাজাভাজি আর মশলার গন্ধে ভরে গেছে পুরো ঘর। সাঁঝ থেমে গিয়ে এক ঝলক তাকাল। চোখে পড়লো, আরশান রান্না করছে। এপ্রোন গায়ে, মনোযোগ দিয়ে সবজি কাটছে, কখনো হাঁড়িতে মশলা নেড়ে দিচ্ছে। রান্নাঘরের আলোয় আরশানের অবয়বটা অন্যরকম লাগছিল। মজবুত কাঁধ, ত্রু কুঁচকে মন দিয়ে কাজ করছে।কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না। সাঁঝের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। ওর আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আরশান তো রান্নায় পারেই, তাই তাকে আর কিছু করতে হবে না। সাঁঝ এগিয়ে গেল ভেতরে। কিচেনের দরজার ফ্রেমে ভর দিয়ে হালকা গলায় বলল,

“আপনি তো ভালো রান্না করতে পারেন। কী বানাচ্ছেন?”

কথাটা বলেই সাঁঝ একপাশ থেকে উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখতে চাইল। চোখে কৌতূহল ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু আরশান কোনো উত্তর দিল না। যেনো কিছু শুনতেই পায়নি। হাতের কাজটা চালিয়ে যেতে লাগলো আগের মতোই। চোখ-মুখে বিরক্তির ছাপ। সাঁঝ একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ কুঁচকালো। মনে হলো, ইচ্ছে করেই উত্তর দিল না। আবার বলল,

“আচ্ছা, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”

আরশানের চোখের ত্রু একসাথে জোড়া হলো। থামলো না সে, কিন্তু হাতের ভেতরে চাপ বেড়ে গেল। মশলা মেশানোর শব্দট আগের চেয়ে জোরে হচ্ছিল। কাল রাত থেকেই মেয়েটা একের পর এক প্রশ্ন করছে করেই যাচ্ছে। ছোটখাটো কিছু হলেও ইচ্ছে করেই তাকে বিরক্ত করছে। কোনো কথা না বলে, আরশান রান্না শেষ করে খাবারগুলো গরম গরম প্লেটে সাজালো। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, একেবারে নির্লিপ্ত। তারপর ধীরে ধীরে টেবিলে খাবারগুলো রাখলো। প্লেট সাজালো, পানির গ্লাস রাখল। দু’জনেই নীরবে টেবিলে বসল।
সাঁঝ খেতে খেতেই একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। কখনো খাবারের প্রশংসা করছে, কখনো আরশানকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। কিন্তু আরশান চুপচাপ। নিঃশব্দে খাচ্ছে। প্রতিবারই চামচ চালানোর শব্দটা সাঁঝের বকবকানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিরক্তির ঢেউ তুলছিল ওর মনে। তবুও সহ্য করছিল। খাওয়া শেষ হতেই আরশান প্লেটগুলো তুলে নিয়ে কিচেনের দিকে হাঁটা দিল। সাঁঝও চুপ রইলো না।

“আপনি কথা বলছেন না কেন?”

আরশান এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল সাঁঝের দিকে। সেই তীক্ষ্ণ চোখে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট। কিন্তু সাঁঝ কিচ্ছু তোয়াক্কা করছে না। মিষ্টি মুখে আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। আরশান এবার আর কোনো কথা না বলে সোজা এগিয়ে গেল। সাঁঝ অবাক হয়ে পিছিয়ে দাঁড়াতে গিয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তেই ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল দরজার দিকে।
সাঁঝ হতবাক। হঠাৎ এই লোক কী করছে! বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল তার।
আরশান দরজার সামনে এসে এক ঝটকায় সেটি খুলে দিল।

“আউট।”

আরশান একটুও দেরি করল না। দরজাটা ধপ করে বন্ধ করে দিল।
সাঁঝ দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল।এভাবে কি সত্যিই তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো? মুখটা ভার হয়ে এলো অনিচ্ছায়, হাঁটা ধরলো। তবে যাই হোক যে কাজটার জন্য করতে এসেছে, সেটা তো সে করেছে। শুধু আরশান জানলেই হয়।

নির্ভাণ মেহুলদের বাড়ি থেকে ফিরছিল। রাস্তার মোড়ে এসে সে হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো। চোখে আরশানের বাড়ি থেকে সাঁঝ বেরিয়ে আসছে। মেয়েটার মুখে একরাশ খুশি। সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে। নির্ভাণের চোখ বড় হয়ে গেল।
মুহূর্তেই মাথার ভেতরে একঝাঁক সন্দেহ জমা হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই, হুড়মুড়িয়ে করে এগিয়ে গেল । কলিং বেল বাজতেই আরশান বিরক্ত হয়ে গুছিয়ে নিলো নিজের শ্বাস। ভেবেছিলো, আবার হয়তো সাঁঝ ফেরত এসেছ। নির্ভাণ কে দেখে আরশান ত্রু কুঁচকালো। গম্ভীর গলায় বলল, “তুই এখানে?”

“শা’লা, ভিতরে ভিতরে কাজ সেরে ফেলিস অথচ আমাদের বলিস না।”

আরশান এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো, তারপর গম্ভীর চোখে তাকালো।
“কী বলবো তোদের?”

নির্ভাণ ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,

“বাহ্! এখন আবার পল্টি মারছিস? সোজা করে বল। ভোরবেলায় মেয়ে এলো, থাকলো, আর বেরোলও… তুই কিছু বলবি না?”

আরশানের মুখ গাঢ় হয়ে উঠলো। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “দেখ নির্ভাণ, ফালতু কথা বলবি না।”

“আমি কি মিথ্যে বলছি? চোখ দিয়ে দেখেছি। এলিশা কে দেখলাম তোর বাড়ি থেকে বেরোতে।”

আরশান এবার চোখ সরু করে তাকালো তার দিকে। “হ্যা, তো?”

“তো মানে? তুই নিজে মুখে স্বীকার করেছিস। তোর বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, আর তুই বলছিস, তো?”

“গত রাতে এসেছিলো। কী জানি বিপদে পরেছে বলল। আমি শুধু থাকতে দিয়েছি। ব্যাস।”

“তোরা একসাথে থেকেছিস।”

“স্টুপিড! যা খুশি বলিস না। আমরা আলাদা রুমে ঘুমিয়েছি।”

তখন নির্ভাণের হঠাৎ মনে পড়লো গতকাল রাতে সাঁঝ তাকে ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল আরশানের ব্যাপারে।তাই আরশানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আরে শোন, তোকে একটা কথা বলি।”

“বল।”

কিন্তু কথা মুখ থেকে বের হবার আগেই পেছন থেকে দৌড়ে আসা পায়ের শব্দ ভেসে এলো।

“ভাইয়া!”

হাঁপাতে হাঁপাতে নির্ভাণের ছোট বোন মিতুল এসে দাঁড়ালো। মুখ লাল, কপালে ঘাম।
“ভাইয়া, আম্মু তোমাকে ডাকছে।”

নির্ভাণ চোখ গোল করে তাকালো।
“আম্মু কেন ডাকবে?”

“কারণ আম্মু জেনে গেছে তুমি যে গত রাত ঘরে ফিরোনি। আর এখন ভীষণ রেগে আছে।”

নির্ভাণের মুখ শুকিয়ে গেল। মাথার ভেতর বাজ পড়ার মতো শব্দ হলো। সে একবার আরশানের দিকে তাকাল, একবার মিতুলের দিকে।
“ওরে সর্বনাশ! আমি যাই। পরে কথা হবে।”

বলে একেবারে দৌড় লাগিয়ে দিল বাড়ির দিকে। আজকে ওর রেহাই নেই।

অন্যেদিকে, সাঁঝ ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। চোখ দু’টো সাবধানে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে সে দেখলো, আপাদত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যেনো পুরো বাড়িটাই তার জন্য ফাঁকা হয়ে আছে। সেই সুযোগে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পায়ের শব্দ যতটা সম্ভব চাপা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। অবশেষে নিজের রুমে পৌঁছে দরজা আস্তে করে ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল সাঁঝ। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হালকা বাতাসে পর্দা উড়ছিল। সাঁঝ ধীরে ধীরে বিছানার পাশে গিয়ে বসলো। মনে হচ্ছিল তার বুকের ভেতরে একটা ছোট্ট ঢাক বাজছে।
আস্তে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করতেই বুকের ভেতরের সেই কাঁপুনি আরও তীব্র হলো। এখন শুধু অপেক্ষা,আরশান ভাই কবে চেইনটা খুঁজে পাবে। সাঁঝের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। বুকের ভেতরে যেনো প্রজাপতি ডানা ঝাপটালো। ভাবতেই গাল দু’টো লাল হয়ে উঠলো। চাদর টেনে গাল ঢেকে ফেললো।

আরশান রেডি হয়ে সোজা অফিসে চলে গিয়েছিল। অফিসে সারাদিন গেমিং প্রজেক্টের কাজ। প্রেজেন্টেশন, কোড, নতুন ডিজাইন সবকিছুর চাপ মাথায়। কাগজের ফাইল, একের পর এক মিটিং মাথা ভার হয়ে আসছিল।
বেশ রাতের দিকে ক্লান্ত শরীরে অফিস থেকে বের হলো। গাড়ি চালিয়ে ফিরলো বাড়িতে। চারপাশ নিস্তব্ধ।তখন হালকা বাতাস বইছে।
শরীরটা ভারী লাগছিল। জুতো খুলে করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ ডান পাশের রুমের সামনে এসে থেমে গেল। যেখানে সাঁঝ ঘুমিয়েছিল। কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো। কী ভেবে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রুম অন্ধকার। শুধু জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো বিছানার একপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিছানার চাদর ভাঁজ হয়ে আছে। আরশান তাকিয়ে থাকলো চারপাশ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ কী মনে করে আবার ফিরে তাকালো। পায়ের শব্দ থেমে গেল। চোখ পড়লো বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ওপর। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে নিলো টেবিলে থেকে একটা চেইন।

চোখ বড় হয়ে গেল আরশানের। আঙুলে ধরা চেইনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। মুহূর্তেই বুক ধক করে উঠলো। এটা তো… এটা তো ওর।বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপন শুরু হলো। হাত শক্ত করে ধরে ফেললো সেটা। তাঁর মানে..

” সাঁঝ! ওহ শীট…”

আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলো না।তাড়াহুড়ো করে বাইরে বের হয়ে এলো। মাথার ভেতর শুধু ঘুরছে,সাঁঝ… সাঁঝ…। এমন সময় হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বাজলো। হাত কাঁপতে কাঁপতে ফোনটা বের করলো। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠলো নির্ভাণ। ধীর কণ্ঠ এলো,

“নির্ভাণ, আমার চড়ুই বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে। বড় হয়ে গেছে নির্ভাণ ।”

নির্ভাণ হেসে ফেললো। “আমি যেটা ভাবছি সেটা নাতো…? এলিশাই তোর বেবি বউ । ঠিক না?”

“ঠিক বলেছিস। এলিশাই আমার সাঁঝ।আমি যাচ্ছি ওর কাছে।”

ফোন কেটে দিল সে। দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে নিচে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। গাড়ির স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে আরশানের চোখে ভাসছিল শুধু সাঁঝের মুখ।
বুকের ভেতর ঝড় উঠছে। সাঁঝ কে একটাবার দেখার জন্য। কিছুক্ষন পর গাড়ি এসে থামলো সাঁঝদের বাড়ির সামনে। কিন্তু গেইট তো লাগানো। আরশান হাতে ঘড়ি দেখলো। রাত ১১টা পেরিয়ে গেছে। এখন ঢোকা ঠিক হবে না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। স্টিয়ারিং-এ মাথা ঠেকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আরশান।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। আজ রাতটা অপেক্ষাতেই কাটুক। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার আসবে সাঁঝের কাছে।

আরশানের গাড়ির আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে ওপরে কাঁচের দরজা খুললো ধীরে ধীরে। সাঁঝ বেরিয়ে এলো ব্যালকনিতে। চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই। সারাদিন অস্থির ছিল, ভাবছিল একবার অন্তত আরশান ভাইয়াকে দেখবে। অথচ… আজ সারাদিন কেটে গেল, একবারও দেখা হলো না।
হালকা রাতের বাতাস চুল এলোমেলো করে দিলো। চারপাশ নীরব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁটে ফিসফিস করলো, “আরশান ভাইয়া… কী চেইনটা পাইনি?”

চোখের কোণে চিকচিক করছে আর্দ্রতা। মনটা অদ্ভুত কেমন করছে। যাকে সে খুঁজছে, যার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করেছে, সে তো এলই না।চুপচাপ ঠাণ্ডা রেলিঙে হাত রেখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সাঁঝ।

চলবে…..

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_১৭ 🤍
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

আকাশে রোদের ঝিলিক ছড়িয়ে আছে, সোনালি আঁচল মেলে দিয়েছে প্রকৃতি। সকালের মিষ্টি প্রহর, বাগানের বাতাসে হালকা সুগন্ধ, ফুলের পাপড়ি দোল খাচ্ছে বাতাসে।
সাঁঝ হাতে জলের কাঁচের জগ নিয়ে বাগানের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। কাঠের গোল টেবিলটা রোদে চকচক করছে। টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারগুলোয় ইতিমধ্যে বসে আছে সামির আর হেলেনা, দু’জনেই কথা বলছে। সাঁঝ টেবিলটায় পানি রেখে ধীরে ধীরে নিজের জন্য একটা চেয়ার টেনে বসল। কপালের কয়েকটা গোছা মুখের সামনে নেমে এলো। তখন টুকটুক শব্দে নুটি দৌড়ে এসে পড়লো সাঁঝের পায়ের কাছে। নুটি সাঁঝকে দেখেই খুশিতে লাফাতে লাগলো। সাঁঝ হেসে উঠলো। নিচু হয়ে নুটি কে হাতে তুলে আদর করলো, ওর ছোট্ট বাদামি শরীরটায় আলতো হাত বোলালো। নুটি খুশিতে কিচিরমিচির ডাক ছাড়লো, লেজ নেড়ে ওর গলায় মুখ ঘষলো। সাঁঝ ব্যাগ থেকে ছোট্ট দানার মতো কিছু খাবার বের করে নুটির সামনে রাখলো। নুটি সঙ্গে সঙ্গে খাবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো, আর সাঁঝ অবাক হয়ে তার চঞ্চল খাওয়া দেখলো।

হালকা বাতাসে বাগানের ফুলগুলো মাথা দোলাচ্ছে। সাঁঝ তখনো নুটিকে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত। তখন পায়ের শব্দ ভেসে আসতেই সাঁঝ কপাল কুঁচকে সামনের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল। আরশান।
চমকে উঠলো সাঁঝ। এখানে কিভাবে? তারমানে চেইনটা পেয়েছে। কিন্তু..এই মুহূর্তে ওকে এখানে আসতে হলো নাকি? আল্লাহ! যদি কিছু বলে ফেলে? সবাই যদি জেনে যায়। এখানে তো সামির ভাইয়া আর হেলেনা মামীও আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল সাঁঝের। বুকের ভেতর যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সাঁঝ তড়িঘড়ি ইশারায় বললো,” কিছু বলবেন না। এখন কিছু বলবেন না, প্লিজ।” মুখের দিকে তাকিয়েই ইশারায় আরশানকে সতর্ক করলো।

আরশান ভুরু কুঁচকালো। সাঁঝ কে এমন করতে দেখে ভেতরে একরাশ প্রশ্ন জমে উঠছে মনে।
সাঁঝ এমন করছে কেন? চুপ থাকতে বলছে কেন? নাকি কিছু লুকোচ্ছে? বুঝতে পারলো না আরশান। এদিকে হেলেনা বেগম আরশানকে দেখে চমকে উঠলেন,মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

“আরে,শান! তুমি?”

আরশান ভদ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল,”হ্যালো, আন্টি।”

হেলেনা স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন,
“এখানে বসো বাবা। হঠাৎ এলে যে কিছু হয়েছে?”

আরশান বসার আগে এক ঝলক সাঁঝের দিকে তাকালো। সাঁঝের বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। তারপর ধীরে বলল, “এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখে করে যাই।”

সাঁঝ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ভিতরের চাপ’টা কিছুটা হলেও হালকা হলো। ভালো হয়েছে, আরশান ভাইয়া কিছু বলেনি। নাহলে যে কী হতো। ভাবতেই সাঁঝের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। হেলেনা হাসিমুখে বললেন,

“ভালো করেছো, বাবা। এখানে বসো। আমি আসছি।”

বলেই তিনি চেয়ার থেকে উঠে ভেতরের দিকে চলে গেলেন। সাঁঝ-ও ভেতরে গেল। বুকের ভেতর তখনও ধুকপুক করছে। মনে হলো চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেছে। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসতেই চোখে ভেসে উঠলো আরশানের সেই গম্ভীর দৃষ্টি। নাহ,
কিছু একটা করতে হবে। হাত কাঁপতে কাঁপতে টেবিল থেকে একটা কাগজ টেনে নিলো। অজান্তেই চোখে পানি জমে উঠলো, কিন্তু জোর করে আটকালো। চিরকুটে কিছু শব্দ লিখে ফেললো তাড়াহুড়োয়। আগে লিখে আসলে ভালো হতো। কিন্তু কে জানতো আরশান ভাই এভাবে হঠাৎ এত সকালে এসে পড়বে।
চিরকুট ভাঁজ করে আঁকড়ে ধরলো হাতের মুঠোয়। হাসলো সাঁঝ। এত অপেক্ষার পর দেখা। দ্রুত তো নিচে নামলো । সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় ও বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসছে। একবার চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো, বাগানে বসে আছে আরশান। পাশে সামির বসা। উফফ সামির ভাইয়ার উপস্থিতি এখন দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিরক্ত হলো সাঁঝ। সামনে এগিয়ে গেল । বাগানের ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, কিন্তু তার ভেতরের অস্থিরতা সেই সৌরভ টেরই পেতে দিল না। আরশানের কাছে গিয়ে থমকালো। সরাসরি হাতে দেওয়ার সাহস হলো না, সামিরের চোখে ধরা পড়ার ভয় আছে।অতএব, সাঁঝ একটু ঝুঁকে আস্তে করে চিরকুটটা আরশানের ধারে ফেলে দিলো। আরশানের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝালো।

আরশান এক মুহূর্তও দেরি করলো না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে চিরকুটটা লুকিয়ে নিলো। সে জানে না,সাঁঝ কেন এত লুকোচুরি করছে। তবে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তখন হেলেনা নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে এলেন। পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সাঁঝ একপাশে দাঁড়ালো।আরশান ভদ্রতার সঙ্গে নাস্তা নিলো, দু-চারটা সাধারণ কথোপকথন হলো।কিন্তু সেই সময়টাতে দু’জনের চোখে চোখ বারবার লুকিয়ে মিললো। প্রতিবারই বুক কেঁপে উঠলো সাঁঝের। কিছুক্ষণ পর আরশান উঠে দাঁড়ালো। বিদায় নেওয়ার ভঙ্গিতে সবাইকে সালাম করলো। বাগান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার থেমে পিছনে তাকালো। সাঁঝ ও তাকিয়ে পড়লো তার দিকে।চোখে চোখ পড়তেই দু’জনের নিঃশব্দ ভাষা মিলে গেল। অগণিত না বলা কথা, অজস্র প্রশ্ন আর এত বছর অপেক্ষা এক ঝলক দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো।
তারপরই ধীরে ধীরে দরজার আড়ালে মিলিয়ে গেল আরশান। সাঁঝ দাঁড়িয়ে রইলো, হাতের তালু ঘামে ভিজে গেছে। বুকের ভেতর চাপা কাঁপন এখনো থামেনি। ভিতরে চলে যায় সাঁঝ।

সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। প্রতিটি ধাপ অদ্ভুত এক অস্বস্তি, আবার আনন্দের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে । বুকের ভেতর কেমন অচেনা কাঁপুনি তৈরি হচ্ছিল। নিজের রুমে ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল নিঃশ্বাস ফেলার জন্য। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতরটা আগুনে জ্বলছে, অথচ ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসি খেলে যাচ্ছে।
আশ্চর্য! সে তো আগে কখনো এরকম অনুভব করেনি। এ কেমন লজ্জা? কেন এমন অকারণ কাঁপুনি? কেন এত অস্থিরতা? মুহূর্তের মধ্যে আরশানের চোখ তার সামনে ভেসে উঠলো। সেই গভীর চাহনি…এক অদ্ভুত টান যা সাঁঝের মনকে একসাথে বন্দি করে ফেলেছিল।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নিজের মুখের লালচে আভা চোখে পড়লো। তারপর চুলের কিছু গোছা কাঁধের ওপর পড়তেই হাত দিয়ে সরাল। সাঁঝ নিজের বুকের ওপর হাত রেখে গভীর নিঃশ্বাস নিল। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতরটা কেউ শক্ত করে বাঁধা দড়ির মতো টেনে ধরেছে। আজ বিকেলে দেখা হবে। এই একটা চিন্তাই যে মাথা ভরিয়ে রেখেছে। আঙুলে অজান্তেই চুল পাকাতে লাগলো। কি পরে যাবে সে? আরশান তাকাবে তার দিকে… সেই চিন্তায়ই গালে হালকা লজ্জার লালচে আভা ফুটে উঠলো। সাঁঝ দ্রুত কাবাড খুলে দিলো। কাপড়চোপড়ের রঙিন স্তূপ একের পর এক টেনে বের করতে লাগলো। একেকটা জামা আয়নার সামনে তুলে ধরে দেখছে, আবার অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে ফেলে দিচ্ছে পাশে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। চুল খোলা থাকলে ভালো লাগবে নাকি বাঁধলে? ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস দিলে কেমন লাগবে?
ভাবতে ভাবতে নিজেই একবার হেসে উঠলো।

সেই মুহূর্তেই দরজা ঠেলেই ভেতরে ঢুকলেন সোফি । সাঁঝের রুমের অগোছালো অবস্থা দেখে হকচকিয়ে থেমে গেলেন।

“এসব কী করছিস,এলি!”

সাঁঝ অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত বলল,

“কিছু না মা… এমনি। বাইরে যাবো।”

সোফি মেয়ের চোখ-মুখে চাপা উচ্ছ্বাস দেখে মৃদু হেসে মাথা নেড়ে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ হতেই সাঁঝ আবার জামার দিকে মন দিল। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।

আরশান চুপচাপ বসে আছে। হাতে সাঁঝের দেওয়া চিরকুট। তাতে কয়েকটা মাত্র লাইন লেখা, কিন্তু সেই অল্প কথার ভেতরে অদ্ভুত লাগছে। চোখদুটো বারবার সেই অক্ষরের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই কয়েকটা শব্দই তাকে সারাদিন অস্থির করে রেখেছে। কেন এমন করছে সাঁঝ? কী এমন বিষয় আছে,যে এভাবে লুকোচুরি করছে ?

এদিকে বিকেল আস্তে আস্তে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। পাখিরা দল বেঁধে বাসায় ফিরছে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু সেদিকে সাঁঝের কোনো হুস নেই। সাঁঝ এতোক্ষণ ভাবতে ভাবতে কাবাড ঘেঁটে, কী পরে যাবে সেই হিসেবেই ব্যস্ত ছিল। কখন যে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে, সে নিজেও জানে না। অচেতনভাবে গভীর ঘুম গ্রাস করে নেয়। ঘুমে মুখটা শান্ত। অথচ বাইরে সময় থেমে নেই। শহরের পার্কে আরশান বসে আছে। চারপাশে আলো জ্বলে উঠছে একে একে, পথবাতির হলুদ আভা ছড়িয়ে পড়ছে।

পার্কে কিছু বাচ্চারা এখনও খেলা করছে, কেউবা হাঁটছে, কেউ আবার বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু আরশানের চোখে এসবের কিছুই ধরা দিচ্ছে না। তার দৃষ্টি বারবার পথের দিকে। সে হাত ঘড়ি তুলল। কাঁটা ছয়টার ওপরে গিয়েছে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমে উঠল। কিন্তু এখন সন্ধ্যা নামছে, আর সাঁঝের কোনো দেখা নেই। অপেক্ষার মিনিটগুলো যেন ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরা ঘড়ির কাঁটা তাকে তাড়া করছে, প্রতিটি টিকটিক শব্দে বিরক্তি আর উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আরশান বেঞ্চে বসে অস্থিরভাবে চারদিকে তাকায়। ব্যাকুল হয়ে প্রতিটি মুহূর্ত গুনছে।
প্রতিবারই মনে হয় হয়তো এই বুঝি সাঁঝ এসে দাঁড়াবে সামনে। কিন্তু না, কেবলই অপরিচিত মুখ। আশেপাশের আলো আরও গাঢ় হচ্ছে। সন্ধ্যার হাওয়া হালকা ঠান্ডা হয়ে বয়ে যাচ্ছে, পাতা দুলছে মৃদু শব্দ তুলে। অথচ আরশানের ভেতরটা আরও অশান্ত হয়ে উঠছে।

আকাশের গাঢ় নীলের ভেতর কমলা রঙের রেখা শেষ বিদায় জানাচ্ছে দিনের। তখন সাঁঝ হঠাৎ ঘুম ঘুম চোখে নিচে নামলো। বসার ঘরে সোফি বসে ছিলেন। সাঁঝ কে দেখে হালকা অবাক হয়ে বললেন,

“তুই না কোথায় যাবি বললি?”

কথাটা শুনেই সাঁঝ চমকে উঠলো। এক ঝটকায় সব মনে পড়লো। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। হায় আল্লাহ! আমি তো ভুলেই গেছি। তাড়াতাড়ি দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো। কাঁটা তখন রাত ৮টার ঘরে দাঁড়িয়ে। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে ছুটে গেল রুমে। এলোমেলো হয়ে থাকা ড্রেসগুলো থেকে তাড়াহুড়ো করে একটা বেছে নিল, আয়নায় দাঁড়িয়ে ঝটপট চুল আঁচড়ালো। ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস মেখে নিলো। তারপর দ্রুত দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে গেল সাঁঝ।
শহরের রাস্তায় লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে একে একে। আরশান স্টিয়ারিংয়ে হাত শক্ত করে ধরে আছে। বহুক্ষণ অপেক্ষা করছিল। একের পর এক মিনিট কেটে যাচ্ছিল, অথচ কোনো খোঁজ নেই সাঁঝের। তার ধৈর্য ভেঙে যাচ্ছিল। শেষমেশ সে বিরক্তি নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। এদিকে সাঁঝও বের হয়েছে গাড়ি নিয়ে। বুকের ভেতর কেমন ঢেউ খেলছে। তখন রাস্তার দু’প্রান্ত থেকে দু’টি গাড়ি এগিয়ে আসছে। একটায় আরশান আর অন্যটায় সাঁঝ। এক নির্জন মোড়ে, দু’টি গাড়ি পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। আরশানের চোখে প্রথমেই ধরা পড়লো সাঁঝ। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চুলগুলো একটু এলোমেলো। কাছে আসতেই মুহূর্তের জন্য দু’জনের চোখাচোখি হলো । নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। গাড়ি থামিয়েই স্থির হয়ে গেল । সাঁঝ দরজা খুলে দ্রুত নেমে গেল গাড়ি থেকে। একটানা দৌড়ে এলো আরশানের দিকে। তার চোখে জল চিকচিক করছে, কণ্ঠরোধ হয়ে আছে। ঠোঁট কাঁপছে, কিছু বলতে চাইছে কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। আরশানও গাড়ি থেকে নেমে এলো। সাঁঝ কাছে আসতেই একটা তীব্র শব্দ চারপাশের নিরবতা ভেঙে দিল।

সাঁঝের গাল লাল হয়ে উঠলো। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,চোখ দুটো ভিজে উঠলো। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আরশানের দিকে।

আরশান দাঁড়িয়ে আছে অবিচল।

“এতক্ষণ নাটক করছিলি? কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।”

কথাগুলো কেটে গেল সাঁঝের বুকের ভেতরে। সে কিছু বলতে চাইলেও গলা শুকিয়ে গেল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আরশান আর তাকাল না, গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল চেইনটা আনার জন্য। সাঁঝ মনে করছে, আরশান চলে যাচ্ছে। তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বুকের ভেতর কেমন শূন্য হয়ে গেল। চোখে অঝোর জল জমে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ওকে রেখে চলে যাচ্ছে? সাঁঝ এক কান্ড করে বসলো। রাগ সামলাতে না পেরে
নিজের পায়ে উঁচু হিল ঝুঁকে হিল খুলে ফেলল। কাঁপতে থাকা আঙুলে জুতোটা শক্ত করে ধরে হিলটা ছুঁড়ে দিলো সরাসরি আরশানের দিকে।
সোজা গিয়ে লাগলো আরশানের পিঠে।
চমকে দাঁড়িয়ে গেল আরশান। কয়েক সেকেন্ড থেমে থাকলো নিঃশব্দে। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো পিছনে। সাঁঝ আর দাঁড়ালো না। চোখের জল মুছতে মুছতে দ্রুত গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো।

আরশান ঝুঁকে পড়ে হিলটা হাতে নিল। মৃদু গলায় বলল, “আশ্চর্য… তুই তো একেবারে সিঁড্রেলার মতো হিল ফেলে যাচ্ছিস। বে’য়াদব! কোথায় পালাচ্ছিস?”

কথাগুলো বাতাসে ভেসে গেল, কিন্তু সাঁঝ আর শুনলো না। ততক্ষণে সে গাড়িতে উঠে পড়েছে। চাকা ঘুরতেই ধুলো উড়লো রাস্তায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সাঁঝের গাড়ি মিলিয়ে গেল শহরের আলো-আঁধারির ভিড়ে। আরশান হাসলো, “আমার থেকে কোথায় পালাবি?”

সে রাতে দু’জনেরই চোখে ঘুম এলো না।দু’জনেই আলাদা ঘরে, আলাদা বিছানায়, অথচ একই অস্থিরতায় ভুগছিল। তাদের রাতের আকাশে একই চাঁদ উঠেছিল, আর সেই চাঁদের আলোয় দু’জনের হৃদয়ের দূরত্ব আরও কাছে টেনে আনছিল।নিদ্রাহীন রাতের প্রতিটি মুহূর্তে কেবল একে অপরেরই ছায়া ভাসছে চোখের সামনে।

পরদিন।
লাইব্রেরির বইয়ের তাকগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। সাঁঝ এক কোণে বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। চারপাশে অন্য ছাত্রছাত্রীরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় ধুলো ভেসে উঠছে। ক্লাস শেষ হয়েছে অনেক আগেই। অথচ সাঁঝ বাড়ি যায়নি। মনটা অস্থির লাগছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মেহুলও আসেনি আজ। একা হয়ে বসে থাকতে থাকতে বুকটা ভারী হয়ে উঠল। শেষমেশ উঠে দাঁড়াল সে। গেট দিয়ে বেরোতেই চোখে পড়ল। আরশান গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শার্ট পরা, উপরের দু’টো বোতাম খোলা। হালকা বাতাসে চুল উড়ছে। সাঁঝের বুকটা হুহু করে উঠল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। এখন আসছে? আবার কষ্ট দিতে, রাতভর ঘুম না হতে দিয়ে, আজ এসে দাঁড়িয়ে আছে। হুঁহ,আমি যাবো না। চোখ নামিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করল। ভান করল যেনো আরশানকে দেখেইনি।
কিন্তু আরশান থেমে থাকল না। পা বাড়িয়ে সাঁঝের দিকে এগিয়ে এল।কাছে আসতেই ঠাণ্ডা গলায় বলল, “গাড়িতে উঠ।”

“Who are you?”

আরশানের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। সে এক-পা এগিয়ে এসে গাঢ় কণ্ঠে বলল,

“Your husband, baby wifeey.”

সাঁঝ এবার ঘুরে তাকাল।
“আমি তো আপনাকে চিনি না।”

আরশান ভ্রু উঁচু করল।

“বাহ্, এক রাতেই মেমোরি লস।”

“এখান থেকে চলে যান।”

“আমাকে রাগস না,সাঁঝ। গাড়িতে উঠ।”

সাঁঝ অভিমানী চোখ তাকাল।

“আমি যাবো না।”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য চারপাশটা থমথমে হয়ে গেল। তখন এরিক তাঁর গাড়ির দিকে যাচ্ছিল। ওদের দেখে বিদ্রুপ ভরা হাসি হেসে উঠল।
“দেখ দেখ, ড্রামা চলছে এখানে।”

আরশানের দৃষ্টি মুহূর্তেই এরিকের দিকে ঘুরে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। এরিক তাচ্ছিল্যভরে আবার বলল,”শালার এখানে আসে ভাব নিতে। হিরো সাজবি নাকি?”

আরশানের বুক ওঠানামা করছে রাগে। মুহূর্তের মধ্যেই সে সামনে এগিয়ে গেল। এক ঝটকায় তার মুষ্টিবদ্ধ হাত গিয়ে পড়ল এরিকের নাকে।
প্রচণ্ড আঘাতে এরিক পেছনে হোঁচট খেল। মুহূর্তেই নাক ফেটে লাল র’ক্ত ঝরতে শুরু করল। চারপাশে যারা ছিল তারা স্তব্ধ হয়ে গেল। সাঁঝ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে।
এরিক যন্ত্রণায় গর্জে উঠল, “তুই।”
আরশানের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে, কিন্তু ঠিক তখনই ওর সঙ্গে থাকা কয়েকজন ছেলে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল। “শান্ত হ! এখন না।”
“চল, আগে এখান থেকে যাই।”

তারা কোনো মতে তাকে টেনে হিঁচড়ে দূরে সরাতে লাগল। র’ক্তে ভিজে যাওয়া নাক মুছতে মুছতে শেষবারের মতো এরিক তাকাল আরশানের দিকে। চোখে একরাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এরিক চলে যেতেই চারপাশে হালকা ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। সাঁঝ কিছু একটা বলবে ভেবেছিল, কিন্তু তার আগেই আরশান ঝট করে এগিয়ে এলো। তাকে দুই হাতে তুলে নিলো কোলে। সাঁঝ চমকে উঠল,

“এই! আপনি কি করছেন?আমাকে নামান।”

কিন্তু আরশানের মুখের গম্ভীরতা একটুও বদলালো না। নীরবে এগিয়ে গিয়ে সোজা গাড়ির দরজা খুলে তাকে ভেতরে বসিয়ে দিল।
আরশান নিজেও বসে পড়লো ড্রাইবিং সিটে। গাড়ি ধীরে ধীরে রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। সাঁঝ ছটফট করছে সিটে বসে। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে বিরক্তিতে।

“আমি কিন্তু নেমে যাবো।”

আরশান এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকাল, ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “যা।”

সাঁঝ একদম হতভম্ব হয়ে গেল। সে দরজার হাতলে হাত রাখতেই টের পেলো। আরশান তার কব্জি শক্ত করে ধরে আছে। একহাতে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে, আর অন্য হাতে শক্ত করে চেপে রেখেছে তার হাত।

“আপনাকে কী এমনিতেই আরশোলা বলি।জুতা মারলেও উড়ে এসে পড়েন।”

“বড় হয়ে দেখছি সাহস বেড়েছে। রিমুট দিয়ে ছোট করে ফেলবো, বে’য়াদব।”

সাঁঝ ঠোঁট ফোঁলাল । ঝুঁকে পড়ে আরশানের হাতে দাঁত বসিয়ে দিল। আরশান সামান্যও টলেনি। মুখে কোনো ভাঁজ পড়ল না। একটাও শব্দ বের হলো না। শুধু দৃঢ়ভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। সাঁঝ থমকে গেল। ব্যথা কী কিছুই পেল না নাকি? তার মনে অদ্ভুত প্রশ্ন জাগল। সে চোখ ছোট করে আবার ঝুঁকে এলো। এবার আরও জোরে কামড় দিল। দাঁতের চাপ এতটাই তীব্র যে, সাধারণ মানুষ হলে চিৎকার করে উঠত। সাঁঝ অবাক হয়ে তাকাল। আরশান টু শব্দ করেনি।
গাড়ি এসে ধীরে ধীরে থামলো আরশানের বাড়ির সামনে। চারদিক তখন নীরবতায় আচ্ছন্ন। আকাশের বুকজুড়ে জমে উঠেছে কালো মেঘ। চাপা অশনি-বার্তা ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশে। হালকা বাতাস বইছে, তবে সেই বাতাসের ভেতরে অস্বস্তির চাপা ভার ছড়িয়ে আছে। গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালো আরশান। সাঁঝও গাড়ি থেকে নামলো। নামার পরই দু’হাত দিয়ে লোহার গেইট ধরে দাঁড়িয়ে রইলো, যেনো আর কোনোদিকে যাবে না। তাকিয়ে বলল,

“বললাম তো আমি যাবো না। কেন এত জোর করছেন? বিরক্ত করছেন কেন? আপনার নামে কেস করবো ইভটিজিং-এর। বুঝেছেন?”

“আশ্চর্য! আমি কখন তোকে ইভটিজিং করলাম?”

সাঁঝ রাগে-অভিমানে ফুঁসে উঠলো।

“এই যে এখন আমার সাথে জোর করছেন, এটা কি ইভটিজিং না?”

আরশানের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটলো।

“আমার তো অধিকার আছে। চাইলে এখনও অনেক কিছু করতে পারি।”

সাঁঝ চোখ ছোট করে তাকালো,”অসভ্য লোক।”

আরশান এগিয়ে এসে থেমে দাঁড়ালো তার সামনে। “ভিতরে, চল।”

“যাবো না। ” সাঁঝ গেইট আঁকড়ে ধরলো আরও শক্ত করে।

“আচ্ছা, তোর হিলটা নিয়ে যা। তুই ফেলে রেখে গেছিস। এটার জন্যই আমার বাড়ির ভেতর এখন ঘূর্ণিঝড় বইছে। আমি আর আটকাবো না তোকে। তাড়াতাড়ি কর। দেখ, বৃষ্টি হবে।”

সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে, ভেজা চোখে তাকালো। বিরক্তি আর অভিমান মিলেমিশে ভেতরে ঝড় তুলছে । “ফেলে দিন। আমি চাই না। আমার দরকার নেই।”

আরশান মাথা নেড়ে ধীরে বলল,
“আমি পারবো না ফেলে দিতে। তুই যা, নিয়ে যা। এটা তোর।”

দৈবাৎ, মুহূর্তেই আকাশ ফেটে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। মেঘের বজ্রধ্বনি আর ঝড়ো বাতাস দু’জনকেই কাঁপিয়ে দিল। বৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠলো, তবু কেউ নড়লো না। বৃষ্টির ফোঁটা তাদের দু’জনকে ভিজিয়ে দিলো । আরশান সাঁঝের হাত ধরলো। সাঁঝ মুহূর্তের জন্য হতবাক। তার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে এল বৃষ্টির পানিতে আর অশ্রুজলে মিশে। সে হাত ছাড়িয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠলো। টানাটানির ভেতরেই তার চোখ ভিজে উঠলো। টলমল চোখে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো, বুকের ভেতরে জমে থাকা অভিমান একসাথে ফেটে পড়লো। চেহারায় ভাঙা কাঁচের মতো তীক্ষ্ণ ব্যথা উঠলো।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

“আপনি তো আমাকে মনে রাখেননি… ভুলের খাতায় ঠেলে দিয়েছেন। ছোট্ট সাঁঝকে ভুলে গেছেন। অথচ আমি পারিনি। আপনি মুক্ত হয়ে গেছেন, কিন্তু আমি বন্দি হয়ে রয়ে গেছি আপনার অনুপস্থিতির গোলকধাঁধায়। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে,প্রতিটি কথায় আপনার অনুরণন। অথচ আপনার কাছে আমি কেবল এক ভুলে যাওয়া অধ্যায়। এখন আফসোস হচ্ছে, কেন আপনাকে আমার স্মৃতির ভেতর এতো যত্নে বাঁচিয়ে রাখলাম?”

সাঁঝের কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে উঠল,

“আপনি ভেবেছেন আমি নেই। সাঁঝ নেই, ম..রে গেছে…..”

আরশান ধমকে উঠল,

“সাঁঝঝ….”

মুহূর্তের ভেতর আরশান এগিয়ে এসে সাঁঝকে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলো।

“আমার দিকটা দেখলি না । প্রতিদিন তোর অনুপস্থিতি আমার বুকটা জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে। তোকে এক ঝলক দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে ছটফট করেছে বারবার। দিন যত গড়িয়েছে, তোর জন্য আমার তৃষ্ণা তত বেড়েছে তোকে এক পলক দেখার জন্য। আমি তোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কী করে ভুলবো তোকে। এই শেরহাম আরশান এখনো আগলে রেখেছে তাঁর ছোট্ট সাঁঝ কে। ভুলে যায়নি, উহু.. এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যায়নি তাঁর বেবি বউ’কে।”

বৃষ্টি তখনও অঝোর ধারা বইছে ঝুমঝুম করে। সাঁঝের চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু বৃষ্টির জলে মিশে গেল। আরশানের বুকের ভেতর মাথা গুঁজে হাত কাঁপতে কাঁপতে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো সাঁঝ। বুকের ভেতর জমে থাকা সব ব্যথা ওই আলিঙ্গনে গলে বেরিয়ে আসছিলো। কিছুক্ষণ পর সাঁঝ হেঁচকি তুলে ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা… আপনার কী গার্লফ্রেন্ড আছে?”

“নাহ। তবে একটা বেবি বউ আছে।”

বাতাসের সাথে ভেসে এলো তার সেই কথা। সাঁঝ প্রথমে বিস্মিত, লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠল। তারপর খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

চলবে…..