এক চিলতে প্রেম পর্ব-২২+২৩

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২২
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

অন্ধকার আধো-আলোয় দেয়ালের রংও ধূসর দেখাচ্ছে। সাঁঝ বসে আছে। মুখ-ভরা বিরক্তি আর চোখে রাগ। একটু আগেই ওর জ্ঞান ফিরেছে। ঠোঁট শক্ত করে চেপে রেখেছে। চারপাশে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। তার সামনে এরিক নির্লজ্জ ভঙ্গিতে বসে আছে, এক ফোঁটা অনুশোচনা নেই চোখে-মুখে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ওর ব্যাগটা-ও এরিক তার কাছ থেকে নিয়ে রেখেছে। নির্লজ্জ হাসিটা দেখে সাঁঝের গা ঘিনঘিন করে উঠল,”আমাকে এখানে এনেছিস কেন?”

এরিকের হাসিটা আরও চওড়া হলো। সে ধীরে ধীরে সাঁঝের দিকে এগিয়ে এলো। পাশে রাখা চেয়ারে বসে বলল,
“তোর লাভারকে জ্বালানোর জন্য। শা’লার তেজ বেশি, না?” এরিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল। “আমার গায়ে হাত তোলার সাহস দেখিয়েছে। এত সহজে তো তাকে ছাড়তে পারি না।”

“কী করবি?কিছু করার ক্ষমতা কী তোর আছে?”

এরিকের ঠোঁটের কোণের হাসিটা আরও চওড়া হলো।

“ক্ষমতা? শুধু দেখতে থাক কতটুকু ক্ষমতা আমার। আজ থেকে তোর লাভারকে আমি প্রত্যেকটি মুহূর্ত জ্বালাব।”

এরিক তার কথা থামিয়ে একটু হাসলো। “আর তুই কিছু করতে পারবি না, কারণ তুই এখন আমার হাতের পুতুল, আমার জিম্মি। তোর চোখের সামনেই তার পতন হবে, আর তুই শুধু অসহায়ভাবে দেখবি। তুই দেখতে পাবি, তোর ভালোবাসার মানুষটা কীভাবে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

সাঁঝ দাঁত চেপে নিজের ভয়কে আড়াল করে রাখল। এরিকের চোখে যে পাগলামি ভর করেছে, সেটা ও বুঝতে পারছে, কিন্তু তবুও পিছু হটার মেয়ে নয় সাঁঝ। ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়াল । সাঁঝ এগিয়ে গিয়ে হঠাৎই জোরে হাত তুলে এরিকের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিল। এরিকের চোখ মুহূর্তেই লাল হয়ে গেল। রাগে তার বুক ধুকপুক করছে। সে সাঁঝের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সজোরে ধাক্কা দিল।অপ্রস্তুত সাঁঝ পেছনে হোঁচট খেল, তার হাত টেবিলের ধার ঘেঁষে গিয়ে লেগে গেল।

এরিক দাঁত চেপে বলল,”তোর এত সাহস?”

এরিক এগিয়ে আসে সাঁঝের দিকে। সাঁঝ এবার দুই হাত দিয়ে এরিকের চুল মুঠো করে টেনে ধরল। এরিক ব্য’থায় কুঁ’কড়ে উঠল, চোখ ছোট হয়ে এলো যন্ত্রণায়। চেষ্টা করছিল সাঁঝকে ছাড়াতে, কিন্তু সাঁঝ এমনভাবে টেনে ধরেছে।
এরিক দাঁত কড়মড় করে, প্রচণ্ড রাগে সাঁঝকে আবার ধাক্কা দিল। এবার সাঁঝ আরও জোরে পড়ে গেল মেঝেতে। রাগে এরিকের চোখে তখন আর কোনো হুঁশ নেই। তার ভেতরের উন্মাদনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠেছে। হঠাৎই তার চোখে পড়ল পাশে রাখা ভারি ফুলদানিটা। এক মুহূর্তের জন্যও ভেবে দেখল না, হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিল।
সাঁঝ তখন মেঝেতে পড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছিল। ঠিক সেই সময় এরিক ফুলদানিটা সজোরে তার মাথায় আঘাত করল।
সাঁঝের মুখ থেকে তীব্র চিৎকার বেরিয়ে এলো। মুহূর্তেই তার কপাল ফে’টে র’ক্ত ঝরে পড়লো গাল বেয়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
ফুলদানির আঘাতে ভেঙে যাওয়া টুকরো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। র’ক্তের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল সাদা টাইলসের ওপর। সাঁঝ মেঝেতে হেলে পড়ে, তারপরই জ্ঞান হারায়।

ফুলদানির আঘাতে সাঁঝ মেঝেতে লুটিয়ে পড়তেই চারদিকে স্তব্ধতা নেমে এলো। সাদা টাইলসের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালচে র’ক্ত। ফোঁটা ফোঁটা হয়ে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরিক কিছুক্ষণ হাঁপাতে হাঁপাতে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো। তার হাতে এখনও ফুলদানির ভার। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে রাগে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই রাগের জায়গা দখল করলো আতঙ্ক। সে তাকালো মেঝেতে পড়ে থাকা সাঁঝের দিকে। মেয়েটার নিস্তেজ শরীর, র’ক্তমাখা কপাল দেখে হঠাৎই তার বুকটা ধক করে উঠলো। ফুলদানিটা হাত থেকে ফেলে দিলো। কর্কশ শব্দে সেটা মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। দু’পা পিছিয়ে গেলো সে। কয়েক মুহূর্ত আগেও রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলছিলো, কিন্তু এখন সেই রাগের জায়গায় এসেছে শীতল ভয়ের ছায়া। আতঙ্কে সে হাত দুটো কাঁপতে কাঁপতে নিজের শার্টে মুছলো, কিন্তু রক্ত মুছলো না বরং আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

এরিকের বুকের ভেতর ধকধক করছে, শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে। সে এক পা, দুই পা পিছিয়ে গিয়ে দরজার দিকে এগোলো। কাঁপতে কাঁপতে দরজার কপাটে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। আর দরজা খোলার সাথে সাথেই এরিকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরশান। তার চোখ, ঠোঁট শক্ত হয়ে আছে। আরশানের পেছনে কয়েকজন পুলিশ। লোকেশন ট্র্যাক করে তারা এখানে পৌঁছেছে। এরিক এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
আরশান ধীরে ধীরে একবার এরিকের দিকে তাকাল। কিন্তু তারপরই তার দৃষ্টি চলে গেল ভেতরের দিকে। ভেতরে মেঝেতে লুটিয়ে আছে সাঁঝ। চারপাশে লালচে র’ক্তের ছাপ, তার চুল ভিজে গেছে র’ক্তে। নিস্তব্ধ, প্রাণহীন দেহ।
ওই দৃশ্য দেখেই আরশানের বুক কেঁপে উঠল।
“সাঁঝ…” গলা ফেটে বেরোল শব্দটা।

আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। দরজার ফাঁক ঠেলে দ্রুত ভেতরে ঢুকে দৌড়ে গেল সাঁঝের কাছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তার পাশে।
আরশান কাঁপা হাতে সাঁঝের মাথা নিজের কোলে তুলে নিল। চোখে পানি জমে উঠেছে।
“সাঁঝ… কী হয়েছে তোর? দেখ আমি এসেছি, জান…”
আরশান সাঁঝের ঠান্ডা গাল ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল,
“চোখ খোল… প্লিজ… চোখ খোল সাঁঝ… আমার দিকে একবার তাকা। কিছু হবে না তোর। আমি আছি… তোকে কিছু হতে দেবো না।”

পাশে পুলিশ দ্রুত ঘরে ঢুকে এরিককে ধরে ফেলছে, এরিক ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।
কিন্তু আরশান তখন শুধু সাঁঝকেই দেখছে। তার চারপাশে শোরগোল হলেও তার দৃষ্টি আটকে আছে এক জায়গায় সাঁঝের নিস্তব্ধ মুখে।

———

হাসপাতালের সাদা দেওয়ালে ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। সময় তখন রাত একটা ছুঁইছুঁই। চারপাশে কেবল অস্বস্তিকর নীরবতা। হাতপাতালের সামনে বসে আছেন সোফি। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে কান্নায়। ঠোঁট কাঁপছে বারবার। সোফির কাঁধে হাত রেখে বসে আছে মিরাব। সে সোফিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, কিন্তু তার নিজের চোখও ভিজে গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে জাইরান। এক হাতে কপাল চেপে ধরেছে, চোখে উদ্বেগ স্পষ্ট। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই চাপা উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। আরশান ফোনে কথা বলছে। ফোনের ওপারে মৌসুমী বেগম। আরশান কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক জায়গায় সাঁঝ নামটা উচ্চারণ করে ফেলল।
সোফির কানে শব্দটা বাজলো বজ্রাঘাতের মতো। তার ভ্রু কুঁচকে গেল, চোখ বড় হয়ে উঠলো। প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরশানের দিকে। আরশান ফোনের ওপাশের কথোপকথন শেষ করে ধীরে ধীরে মোবাইলটা নামাল। তখনই সোফি দাঁড়িয়ে গেল। এত বছরের ভেতরে জমে থাকা রাগ ভরে উঠলো। ধীর পায়ে হেঁটে সে চলে গেল আরশানের সামনে। সোফি থেমে গিয়ে গলায় চাপা কণ্ঠে বলল, “কী নাম বললে?”

এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না আরশান। বলে ফেলল, “সাঁঝ।”

সোফির চোখ সরু হয়ে এলো। দগদগে রাগে ফুঁসে ওঠা কণ্ঠে বলে উঠল,
“তাহলে… তুমিই মৌসুমী আপার ছেলে।”

আরশান মাথা নাড়লো। সোফির ক্ষোভে ভারী হয়ে উঠলো,

“কেন এসেছো এখানে? আমার মেয়েকে আবার কেড়ে নিতে? এতবছর আমার থেকে আমার মেয়েকে দূরে রেখে সাধ মিটেনি?আবার কেড়ে নিতে এসেছো।”

আরশান এক মুহূর্ত স্থির হয়ে তাকাল সোফির দিকে। চোখে বিস্ময়।

“এসব কী বলছেন? সাঁঝকে কেন আপনার থেকে দূরে রাখবো? উল্টো আপনি-ই তো ওকে রেখে চলে গেছেন। আবার হুট করে নিয়ে আসলেন।”

সোফির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এলো, চোখের মণি বড় হয়ে উঠলো।

“রেখে চলে গেছি মানে? আমি আমার মেয়েকে রেখে চলে যাবো কেন? তোমার মা…আমার মেয়ে কে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। অথচ আমাকে বলেছে আমার মেয়ে…ম’রে গেছে।”

কথা বলে সোফি হঠাৎ কেঁদে ভেঙে পড়ল। তার কাঁধ কাঁপছে, মিরাব ছুটে এসে তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। “শান্ত হও, ফুফি। প্লিজ…”

জাইরান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। আরশান দম দাঁড়িয়ে রইল। মাথার ভেতর হাজারো প্রশ্ন ছটফট করছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বেরোচ্ছে না। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সোফির দিকে। ওর মা এমনটা কেন করবে? মনের ভেতর ঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রশ্নটা। সোফি তখন আবার বলল,

“আমার মেয়ে বেঁচে আছে অথচ আমি জানতে পারিনি। দশটা বছর, পুরো দশটা বছর আমার নারী ছেঁড়া ধন আমার কাছে ছিল না। জন্মের পর আমার মেয়ের মুখ আমি একবারও দেখতে পাইনি। আমার বুকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো তোমরা।”

“মম কেন এসব করবে? আপনার নিশ্চয়ই বুঝার ভুল হয়েছে।”

সোফি হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। চোখের জল ঝরছে, কণ্ঠস্বর তখন তীব্র হয়ে উঠল,

“ভুল? আমি নিজের চোখে দেখেছি এলিকে তোমাদের বাড়িতে। এতবছর ধরে ওকে আটকে রেখেছো, আর আজ এসে বলছো আমি ভুল?আমার মেয়ে আর বেঁচে নেই। অথচ তোমাদের বাড়িতেই সে শ্বাস নিচ্ছিল, আর আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল সেই অধিকার থেকে।”

“হ্যাঁ, সাঁঝ আমাদের কাছে ছিল। রুনা মামীই তো আমাদের বলেছিল, আপনি সাঁঝকে রেখে চলে গেছেন। বলেছিল আপনি আর তাকে নিজের কাছে রাখতে চান না।”

“কোনো মা বলবে তাঁর বাচ্চা সে রাখতে চায় না? আমার মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকবে। আর এখানে আসবে না। চলে যাও। তোমাদের ছায়াও যেন আমার মেয়ের আশেপাশে না আসে।”

​সোফির প্রতিটি কথা তীরের মতো আরশানের হৃদয়ের গভীরে বিঁধছিল। তবুও শান্তভাবে জবাব দিল, “আপনার এই কথাটা রাখতে পারবো না। আমি সাঁঝের কাছ থেকে দূরে যাবো না।”

​”কোন অধিকারে থাকবে?”

​আরশান মৃদু হাসল। তারপর বলল,”অধিকার? ওর সব অধিকার তো আমারই। আমার ওয়াইফের কাছে আমি থাকবো, না তো কে থাকবে।”

​সোফির মুখ নিমিষেই হিম হয়ে গেল।”মানে?”

“আমাদের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে।”

সোফির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আরশানের সোফির দিকে ধীরে ধীরে তাকিয়ে বলে,
“আমি জানি না, এইসব কে করেছে। তবে যেই করুক না কেন। সে জবাবদিহিতা দিবে। এবং এটা সে নিজ থেকেই আপনাকে বলবে। তবে আমার একটা কথা, সত্যি জানার পর সাঁঝকে আমার কাছ থেকে আলাদা করবেন না।”

এবার জাইরান বলল, “আন্টি প্লিজ, এটা আর বাড়াবেন না।”

“ঠিক আছে। তবে এর আগে আমার মেয়ের আশেপাশেও আসবে না।”

আরশান ধীর স্বরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। হাসপাতালের করিডোর ঠান্ডা বাতাসে ভরা। লম্বা বাতির আলো মেঝেতে ছায়া ফেলছে। কৃত্রিম আলোয় হালকা নীরস, সাত-আটজন রোগী-পরিবার পথ ধরেছে। উঁচু স্লেটের দেয়ালগুলোতে রোগীর পোষ্টার। আরশান ধীরে ধীরে করিডোরটা পেরিয়ে বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন জাইরান এগিয়ে আসে আরশানের কাছে। ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। হাসপাতালের করিডোর নিস্তব্ধ। বাইরের বারান্দা দিয়ে শীতল বাতাস ভেতরে ঢুকছে।

সারারাতের ক্লান্তিতে সোফি আর মিরাব অন্য কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জাইরান। চোখে লালচে ক্লান্তি, তবু সতর্কতার কোনো ঘাটতি নেই। পাশের কেবিনের দরজার দিকে মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। কেউ বের হচ্ছে কি না। কেবিনের দরজা আস্তে খুললো আরশান। ভেতরে ঢুকতেই বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে এলো। কেবিনে সাদা চাদরের ওপর শান্তভাবে শুয়ে আছে সাঁঝ। তার কপালে ব্যান্ডেজ পেঁচানো, পাশে স্যালাইনের টিউব নেমে আসছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকই আছে, কিন্তু চোখ এখনো বন্ধ। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে যে, আরশানের মনে হলো সমস্ত রঙ নিঃশেষ হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। ধীর পায়ে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । চোখের সামনে যে মেয়েটা এখনো অচেতন হয়ে শুয়ে আছে।

আরশান আস্তে হাত বাড়িয়ে সাঁঝের গালের উপর রাখলো। গরম হাত ছুঁতেই ঠান্ডা চামড়ায় কাঁপন ধরলো তার নিজের শরীরেই। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু জমে উঠলো। মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
“শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা করবি। আমি তোকে হারাতে দিবো না। আবার তোর কাছে ফিরে আসবো।”

আরশান সামনের দিকে ঝুঁকল। চোখ বন্ধ করে সাঁঝের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। নিস্তব্ধতার ভেতর কেবল তার হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছিলো।
চোখ খুলে আবার সাঁঝের দিকে তাকালো । মেয়েটি অচেতন, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।আরশান আঙুল দিয়ে সাঁঝের আঙুলগুলোকে নিজের মুঠোয় ধরে রাখলো।

চলবে…..

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২৩
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

সকালের চারপাশে উজ্জ্বল রোদ, জানালার ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো এসে পড়েছে হাসপাতালের কেবিনের সাদা দেয়ালে।
সাঁঝ সাদা চাদরে মোড়া বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার পাশেই মিরাব চুপচাপ বসে আছে।গত কয়েক ঘন্টার মধ্যে অনেকেই এসে গেছে। সবাই এসে সাঁঝকে দেখে গেছে।
হেলেনা আর সামির টরেন্টতে গিয়েছিল। সাঁঝের খবর পেয়ে আজকেই এসেছিলো।
কিন্তু যার অপেক্ষায় সাঁঝ প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছে সে-ই আসেনি। চোখ বন্ধ করেও সাঁঝের বুকের ভেতর অস্থিরতা বাড়ছে। আরশান এখনো এলো না কেন? সে কি জানে না আমি জেগে আছি? তার মন কী একবারও আমাকে দেখতে চাইছে না?

কেবিনের নিস্তব্ধতার ভেতরই দরজাটা আস্তে খুলে গেল। সাঁঝ চোখ বন্ধ রেখেছিল, তাই প্রথমে টের পেল না। মিরাব সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকল মেহুল। চোখে-মুখে অস্থিরতা। মেহুল সোজা এগিয়ে এল। সাঁঝের কাছে গিয়ে আর কিছু না ভেবে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

“তুই ঠিক আছিস। জানিস, কত চিন্তায় ছিলাম আমি? এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাইনি।”

“আমি ভালো আছি, মেহুল… শুধু একটু দুর্বল লাগছে।”

মেহুল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হাত রাখল কপালে।
“যদি তোর কিছু হয়ে যেত…ভাবতেই পারছি না।”

সাঁঝ হেসে বলল, “তুই এসে গেছিস, এখন আমি একদম ঠিক আছি।”

মিরাব ওদের দেখে হাসলো। গতকাল রাতের ঘটনা সাঁঝ জানে না। মিরাব পাশে রাখা নিজের ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ফোনটা আনলক করতেই নোটিফিকেশনের ভিড় চোখে পড়ল। একটার পর একটা মেসেজ আরশানের। প্রতিটা মেসেজে আরশানের ব্যাকুলতা, সাঁঝকে এক পলক দেখার। মিরাব ফোনটা হাতে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল। সাঁঝ তখন মেহুলের সঙ্গে কথা বলছে। সেই সুযোগে মিরাব ধীরে ধীরে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো সাঁঝের। মিরাব ছবিগুলো সিলেক্ট করে পাঠিয়ে দিল আরশানকে।

এর মাঝে পুরো তিনদিন কেটে গেল অথচ আরশান আসেনি। সাঁঝের বুকের ভেতর হাহাকার। তিন দিন ধরে অপেক্ষা করেও আরশানের দেখা নেই। হাসপাতাল থেকে রিলিজের দিনটা, সাঁঝের কাছে কোনো আনন্দ নিয়ে আসেনি।সবাই খুশি হয়েছিল, কিন্তু সাঁঝের বুকের ভেতর শূন্যতার কুয়াশা জমে গেল। কেবিন থেকে ছাড়ার পর মনে মনে ভেবেছিল হয়তো এবার আরশান হাজির হবে, অন্তত একবার খোঁজ নেবে। কিন্তু না, সব ভ্রান্তি। ফোন করেছে বারবার, প্রতিবারই বন্ধ। জাইরান বলেছে,আরশান বিজনেস ট্রিপে গিয়েছে। ঠিক আছে, কিন্তু ফোনটা তো ধরতে পারতো। এতটুকু সময় কি সত্যিই নেই? এতই কি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আরশান যে তার এক মুহূর্তও নেই সাঁঝের জন্য? অভিমানে চোখ ভিজে উঠল সাঁঝের।

——–

সকালের কিচেনে গরম দুধের ভাপ উঠছে। চুলার ওপর ছোট কড়াইতে স্যুপের মতো কিছু নরম খাবার দমে দমে ফোটছে। সোফি ভোর থেকে উঠে মেয়ের জন্য যত্ন করে নাস্তা বানাচ্ছে হালকা খিচুড়ি, সাথে ডিম সেদ্ধ আর গরম দুধ। কিচেনে জানালার পাশ দিয়ে আলো ঢুকে সাদা পর্দায় চিকচিক করছে। সেই সময়েই রান্নাঘরের শেলফে রাখা মোবাইলের রিংটোন বাজতে শুরু করতেই সোফি হাত মুছে ফোনটা তুলে নিল। দেখে সোফি কিছুটা অবাক হলো। রুনা বেগম খুব একটা ফোন করেন না। কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কান্না ভেজা কণ্ঠ এলো,
“সোফি… আমাকে মাফ করে দাও…, আমাকে মাফ করে দাও।”

“কী বলছো তুমি আপা? কী হয়েছে? কেন এমন বলছো?”

ওপাশে আবারও হাহাকার কান্না।
“আমি… আমি আর সহ্য করতে পারছি না।আমাকে ক্ষমা করো। আমি খুব বড় অপরাধ করেছি।”

সোফির বুক কেঁপে উঠলো। ঠোঁট নড়লো শুকনো কাঁপুনিতে।
“কোন অপরাধের কথা বলছো তুমি? কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। তুমি কাঁদছো কেন? আমার ভয় লাগছে আপা… তুমি ঠিক আছো তো?”

রুনা বেগমের শ্বাস ভারি হয়ে এলো। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, শুধু ফোঁপানির শব্দ ভেসে আসছে।
“সব আমার দোষ… আমি চাই তুমি আমাকে মাফ করো… মাফ না করলে আমি শান্তি পাব না। আমি খুব বড় অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে।”

“আপা, তুমি এভাবে আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছো। স্পষ্ট করে বলো, কী হয়েছে?”

“আমি সাঁঝকে… তোমার মেয়েকে… তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম।”

সোফি এক মুহূর্তে অচেতন। না, চোখ খুলে আছে, কিন্তু চারপাশ কেমন অস্পষ্ট হয়ে এল। কান্না ভেজা কণ্ঠে যখন রুনা বললো,”আমাকে মাফ করে দাও।”

তখন সোফি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। ফোন আঁকড়ে ধরে সে কেঁপে উঠলো, “কী করে করলে এটা আপা? একবারও কি মন তোমাকে বাধা দেয়নি? আমি তোমাকে মাফ করতে পারবো না। না, পারবো না।”

সোফির গলা ভেঙে কান্না বেরিয়ে এলো।
“তুমি পারলে আপা? আমার বুকের টুকরোকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারলে? আমি প্রতিদিন যে শূন্যতায় পুড়েছি, সেই আগুনের জ্বালাটা তুমি বুঝতে পারোনি? তুমি তো আমার আপনজন ছিলে। অথচ আমাকেই ভেঙে দিলে। আমি তোমাকে মাফ করতে পারবো না… কখনোই না।”

ডুকরে কেঁদে উঠলো সোফি । এতদিন সে ভেবেছে, তার মেয়ে সাঁঝকে কেড়ে নিয়েছে মৌসুমী আপা। বারবার সেই নামটা মনের ভেতর দাগ কেটেছে। প্রতিটি দুঃখের মুহূর্তে মৌসুমী আপাকেই অভিশাপ দিয়েছে সোফি। কিন্তু আজ! আজ বুঝতে পারলো। এতবছরের ভুল বোঝাবুঝি, এতবছরের যন্ত্রণা আর অভিযোগের পেছনে মৌসুমী নয়, লুকিয়ে ছিল রুনা আপা। তার সেই আপনজন, যাকে সে বোনের মতো ভরসা করেছিল। সোফির বুকের ভেতর তখন হাজারো স্মৃতি ছুটে আসতে লাগলো। সাঁঝকে হারানোর রাত, প্রতি রাতের নিস্তব্ধ কান্না, প্রতিটি মুহূর্তের শূন্যতা। সবকিছুর দায় সে চাপিয়েছে মৌসুমীর ঘাড়ে। অথচ আসল সত্য এত বছর ধরে চোখের আড়ালে ছিল।সোফির চোখের পানি ঝরতে ঝরতে বুক ভিজিয়ে দিল।

রুনা এবার ফোন লাগালো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও আরশান।”

রুনা বেগমের সংসারটা কখনোই শান্তি দেখেনি। তাঁর দুটো ছেলে ছিল, কিন্তু স্বামী মালিকের অবহেলার কারণে সংসারে সঠিকভাবে মানুষ হয়ে ওঠেনি। মালিক সারাদিন ঘরে পড়ে থাকতো, কোনো কাজকর্ম করতো না। যখন রাত নামতো, তখন সে নেশার ঘোরে টলতে টলতে বাড়ি ফিরতো। বাবার দেওয়া বিশাল সম্পত্তি তাঁর হাতে এসেছিল, কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবন আর নেশার কারণে সেই সম্পদ একে একে শেষ হয়ে যায়। রুনা বেগম কতবার স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, সংসারের দায়িত্ব নিতে বলেছেন, কিন্তু মালিকের কানেই পৌঁছাতো না।
অন্যদিকে, সাঁঝের বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। তিনি দায়িত্ববান, পরিশ্রমী। বাপের দেওয়া সম্পত্তি সঠিকভাবে রক্ষা করেছিলেন, বরং নিজ যোগ্যতায় আরও অনেক সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে তিনি সফল ছিলেন, আর তাঁর সবচেয়ে বড় শখ ছিল ভ্রমণ। বিদেশ ঘুরে বেড়ানো । প্রায়ই তিনি সোফিকে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে বের হতেন। দু’জনের জীবন ছিল ভালোবাসায় ভরপুর।

সোফির জীবনে নতুন রঙ যোগ হয়েছিল যখন তিনি প্রথমবার মা হতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্য যেনো অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছিল। সাঁঝের জন্ম হয়েছিল ডাক্তারের দেওয়া নির্ধারিত সময়ের আগে। হাসপাতালে সবাই ব্যস্ত, সোফি অপারেশন শেষে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন। এই সুযোগটাই কাজে লাগান রুনা বেগম কূটচালে নামলো। রুনা বেগমের মনে তখন ভয়ঙ্কর লোভ। সাঁঝ যখন ১৮ বছর পূর্ণ করবে, তখন তাঁর নামে লিখে দেওয়া সমস্ত সম্পত্তি সে উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে। আর নিজের দুই ছেলেকে সঠিক ভবিষ্যৎ দিতে তিনি সবসময়ই ভেতরে ভেতরে ছটফট করতেন। সেই ছটফটানি আর সম্পদের লোভ মিলেমিশে তাঁকে ভয়ঙ্কর এক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করলো। সেদিন রাতেই রুনা বেগম লুকিয়ে সাঁঝকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। নার্সকে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে দিলেন।যখন সোফি জ্ঞান ফেরালেন, তখন তাঁকে জানানো হল। এই সংবাদে সোফির দুনিয়া মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। তাঁর চোখের জল থামেনি। একদিকে স্বামীকে নেই। অন্যদিকে, নবজাতক সন্তানকেও হারালেন।

তখন তাঁর পাশে ছিলেন শুধু তাঁর মা, সাঁঝের নানী। এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডি সব মিলে সোফি পাগলপ্রায় হয়ে উঠলো। এই ভাঙাচোরা অবস্থায় তিনি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। বুঝতে পারেন, এই দেশে থাকলে সোফি আরও কষ্ট পাবে, স্মৃতি তাঁকে প্রতিনিয়ত ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন করবে। তাই তিনি সোফিকে নিয়ে কানাডায় চলে যান।
সাঁঝের জন্মের প্রায় এক সপ্তাহ পরে বিষয়টা জানতে পারেন মৌসুমী বেগম।সেই সময়েই রুনা বেগম এগিয়ে এলেন নিজের সাজানো মিথ্যা নিয়ে। সোফি ওর সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চায়নি। সে ফেলে রেখে চলে গেছে। নিজের মতো করে জীবন কাটাতে চায়, সে দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। সে তো কানাডা চলে গেছে! যদি সত্যিই ও সন্তানের জন্য কষ্ট পেতো, তাহলে এভাবে চলে যেতো?
এই কথা শুনে মৌসুমী ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সোফি মা হওয়ার জন্য কতটা আগ্রহী ছিলেন। দিনের পর দিন কেমন আগলে রেখেছিলেন তাঁর অনাগত সন্তানকে। তবুও তখন কে জানতো, এই সব কিছুই মিথ্যা।
.

আজকের ম্লান অন্ধকারের মাঝে আলো ছড়িয়ে আছে পূর্ণচাঁদ । চারদিক রুপোলি আভায় ভরে উঠেছে। সাঁঝ অনেকক্ষণ ধরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেই চাঁদটাকে দেখছিল। বাতাসে হালকা শীতলতা, পাতা ঝিরঝির করে কাঁপছিল, অথচ সাঁঝের বুকের ভেতর কেবলই অস্থিরতা জমে উঠছিল। চাঁদ আকাশ থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু যে মানুষের জন্য তার এতো অপেক্ষা, এতো আকুলতা, সে একবারও তার খোঁজ নেয়নি। একবারও ফোন করে জিজ্ঞেস করেনি। সে কেমন আছে?কী করছে? বুকের ভেতরে জমাট বাঁধা অভিমানটা বারবার চাপা দিতে চাইলেও পারছিল না। ভেবেছিল, আজ অন্তত আরশান একটা ফোন করবে, একবার হলেও খোঁজ নেবে। প্রতিটা মুহূর্তে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে সে। বারবার মনে হচ্ছিল, হয়তো এইমাত্র কল আসবে, হয়তো আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আরশানের নামটা ভেসে উঠবে। কিন্তু সময় যত গড়াল, ততই ভেতরের শূন্যতাটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

ধীরে ধীরে ব্যালকনির ঠান্ডা বাতাসও আর ভালো লাগলো না। বারান্দা থেকে রুমে এল। ঘরটা অন্ধকার, কেবল জানালা দিয়ে আসা আলো-অন্ধকারের খেলায় ঘরটাও যেনো তার মনখারাপের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। সাঁঝ ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শরীরটা ক্লান্ত হলেও চোখে ঘুম নেই, মনে শুধু অভিমান।
সাঁঝ চোখ বন্ধ করল, অশ্রুগুলো চুপিচুপি গড়িয়ে যাচ্ছিল গালের পাশ দিয়ে।
অভিমানের প্রাচীর গড়ে তুলল নিজের ভেতরে।
তখন হঠাৎই ফোন বাজলো। সাঁঝ চোখ শক্ত করে বন্ধ করলো। রাত তখন ১১টা ছুঁইছুঁই।

এই সময় আবার কে ফোন দিলো? তার ভেতরটা আরও বিরক্তিতে গুমরে উঠলো।
মুঠোফোনটা টেবিলের উপর রাখা, আলো ঝলমল করছে রিংটোনের তালে। সাঁঝ একবার তাকাল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। তার মন এখন এমনিতেই ভারী, আরশানের জন্য অপেক্ষা করে ভেতরটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। ভাবল, যেই-ই হোক না কেন, এখন আর কথা বলার মতো মানসিক শক্তি নেই তার। চোখ বন্ধ করেই শুয়ে রইলো। কিন্তু ফোনটা আবারও বেজে উঠল। সাঁঝ এবারও হাত বাড়াল না। যে-ই হোক না কেন, তোলার কোনো ইচ্ছেই নেই তার।
তবে আবার ফোনের রিং বাজতে শুরু করলো।
বিরক্তিকর শব্দটা বারবার কানে বাজতে থাকায় এবার আর সহ্য হলো না। সাঁঝ ফোনটা হাতে তুলে নিলো। স্ক্রিনে নাম দেখারও ধৈর্য হলো না। সরাসরি রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে গভীর, দৃঢ়, পরিচিত কণ্ঠ এলো,
“ব্যালকনিতে আয়।”

সাঁঝ এক মুহূর্তে স্থবির হয়ে গেলো। বুকের ভেতর পুরনো ব্যথা আবার কেঁপে উঠলো। এতদিন কোথায় ছিল সে? এতদিন কেন মনে পড়লো না? হঠাৎ এখন কেন? সাঁঝ চোখ কুঁচকে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, “আমি যাবো না।”

ওপাশে একটুখানি বিরতি। তারপর হালকা হাসি মেশানো কণ্ঠে উত্তর এলো, “আয়… সারপ্রাইজ আছে।”

সাঁঝ দাঁত চেপে ফোনটা নামিয়ে রাখলো। মনটা দোদুল্যমান। যাবে কি যাবে না? এত অভিমান জমে আছে তার ভেতরে। এতদিন কোনো খোঁজ নেই, কোনো খবর নেই। হঠাৎ আজ মাঝরাতে এসে সারপ্রাইজ দেখাতে হবে কেন?
বুকের ভেতর থেকে কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অন্য প্রান্তে রাগ আর অভিমান ঢেউ খেলছে। কেন সে যাবে? এতদিন তো কোনো খবর নেয়নি, হঠাৎ আজ এভাবে ডাকছে কেন?এতদিন যে মানুষটা ফিরে তাকায়নি আবার মনের গভীর থেকে কৌতূহলও জেগে উঠলো। সারপ্রাইজটা কী হতে পারে? দ্বিধায় ভরপুর মন নিয়ে ধীরে ধীরে ব্যালকনির দিকে এগুলো। চাঁদের আলো মেখে চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দূর থেকে গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। ব্যালকনিতে গিয়ে তাকাতেই দেখলো। রাস্তার পাশে আরশানের গাড়ি দাঁড়িয়ে। কিন্তু সাঁঝ পৌঁছাতেই আরশান গাড়িতে উঠে পড়লো। হেডলাইট জ্বলে উঠলো। একবারও পিছনে তাকালো না। সাঁঝ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই ফোনে মেসেজ ভেসে এলো। চোখ ঘুরিয়ে দেখলো আরশান একটা মেসেজ পাঠিয়েছে। শুধু একটা টাটার ইমোজি পাঠিয়েছে।

চলবে…..