এক চিলতে প্রেম পর্ব-২৪+২৫

0
5

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২৪
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

কিছুক্ষণ আগেই আরশান বিডি থেকে কানাডায় ফিরেছে। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি শরীর জুড়ে ভর করলেও মন যে স্থির হতে পারছে না। বুকের ভেতর সাঁঝকে দেখার টান যে লেগেই আছে। মন ছটফট করছে তাকে একবার দেখার জন্য। কানাডিয়ান শীতের ঠাণ্ডা বাতাস জানালার কাঁচে জমে থাকা কুয়াশাকে আরও ভারী করে তুলেছে। অথচ তার ভেতরে অস্থির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সাঁঝকে না দেখলে শান্তি নেই। বারবার ফোন হাতে নেয়, আবার নামিয়ে রাখে। নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বোঝানো যায় না। অবশেষে এক পলক দেখা হলো। খুব ছোট্ট সেই দেখা, হাওয়ার ঝাপটা এসে চোখে লাগে আবার মিলিয়ে যায়। অথচ সেই পলকও তাকে শান্ত করতে পারল না। বরং মনে হলো, এই দেখা যথেষ্ট নয়। এ তো শুধু তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দিল। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই করছে। নিস্তব্ধ রাতের ভেতরেও আরশানের অস্থিরতার ঢেউ থামছে না।

—–

মিষ্টি আলো জানালার ফাঁক গলে এসে ঘরে ঢুকেছে। লাজুকভাবে রোদের আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। সাঁঝ বিছানায় শুয়ে এপাশ থেকে ওপাশ হল, তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল। ঘুম জড়ানো চোখে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করতেই থমকে গেল। এ কী! কোথায় সে?
এটা তো তার রুম নয়। সাঁঝ হাতের আঙুল দিয়ে চোখ ডলে চারপাশে তাকালো, ভেবে নিল হয়তো স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু না, চোখ খুলেও দৃশ্য বদলাল না। তার ছোট্ট রুমে এত প্রশস্ত জায়গা নেই। বড় বেড রুম, যেটি তার ছোট্ট রুমের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলাতে পারছে না।

সাদা দেয়ালের গায়ে নিস্তব্ধতার ছায়া, মাথার ওপর বড় ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি ঝুলছে, মোটা ক্রিম কালারের পর্দাগুলো হালকা বাতাসে দুলছে। তার ছোট্ট রুমের সঙ্গে এই বিশাল, সুশোভিত ঘরের কোনো মিলই নেই। এক মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল,এটা তো আরশানের রুম। হ্যাঁ, ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই বড় রুমের প্রতিটি কোণা, আরশানের পছন্দের সেই বিরল মিউজিক কালেকশন। সবকিছুই তো সে দেখেছে। সাঁঝ বিস্মিত হয়ে চারদিকে তাকাল। মাথার ভেতর ঝড় বইতে লাগল। কীভাবে সম্ভব? সে তো নিজ রুমে শুয়েছিল গতরাতে। তবে সে এখানে এলো কিভাবে?

তখন দরজা হালকা শব্দ করে খুলে গেল। সাঁঝের বিস্মিত দৃষ্টি দরজার দিকে ফেরানো মাত্রই ভেতরে প্রবেশ করল আরশান। ঘরজুড়ে তার উপস্থিতি ভারি হয়ে উঠল। চোখে সেই অচেনা টান, ঠোঁটে খেলছে কুটিল হাসি। সাঁঝকে একদৃষ্টিতে দেখে নিয়ে হেসে বলল, “ম্যাডামের ঘুম ভেঙেছে বুঝি?”

কথার সঙ্গে সঙ্গে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার পাশে বসল আরশান। সাঁঝ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, আরশানের ঠোঁটের সেই হাসি যে বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। গত রাতের স্মৃতি ঝড়ের মতো ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। প্রতিটি মুহূর্ত স্পষ্ট হয়ে উঠতেই ভরে উঠল রাগে। টাটা দিয়ে বিদায় নিয়েছে। এখন আবার নাটক করছে।

আরশান হঠাৎ ঝুঁকে সাঁঝকে জট করে টেনে নিল নিজের কোলে। অপ্রস্তুত সাঁঝ ছটফট করে উঠল, বারবার ধাক্কা দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।

“ছাড়ুন! এখন কাছে আসছেন কেন?”

সাঁঝের চোখে-মুখে অভিমান। কিন্তু আরশান নির্লিপ্ত, ঠোঁটে সেই গভীর হাসি। বুকের ভেতরের ঝড়টা প্রকাশ করল না, বরং আরও দৃঢ়ভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখল।
আরশান ধীরে ধীরে তার কানের কাছে ঝুঁকে এলো। শ্বাসের উষ্ণতা সাঁঝের গায়ে লাগতেই কেঁপে উঠলো। মুহূর্তের নীরবতার পর মাদকতাভরা কণ্ঠে বলল,

“সুখের ব্যথা বড্ড পীড়াদায়ক। হৃদয়কে আলোয় ভরিয়ে দিলেও অস্থিরতায় ডুবিয়ে রাখে। এই সুখে শান্তি নেই, আছে কেবল প্রতিক্ষণে তোকে আরও কাছে পাওয়ার অশেষ তৃষ্ণা।”

আরশানের মাদকতাভরা কথা সাঁঝ শুনলো না। মুখে কিছু না বললেও চোখ দুটো টলমল করে উঠলো । চোখে অভিমান জমে আছে, এতদিন তাঁর সাথে একটা কথাও বলেনি, এড়িয়ে গেছে, অথচ আজ হঠাৎ এসে নাটক করছে। সাঁঝের বুক ভরে উঠলো ক্ষোভে। এখন এভাবে মায়া দেখানোর ভান করছে? এতদিন কোথায় ছিল? তখন তো একটা ফোনও দেয়নি।

আরশানের বলিষ্ঠ হাত শক্ত করে জড়িয়ে আছে সাঁঝের কোমরের চারপাশে। সাঁঝ যে অভিমানের পাহাড় জমিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সাঁঝ প্রাণপণে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। সেই হাতের শক্তি সাঁঝের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। এবার সে আরশানের কাঁধে ঝট করে দাঁত বসিয়ে দিলো।
কিছুক্ষণ সে ভাবলো, হয়তো আরশান যন্ত্রনায় ছেড়ে দেবে তাকে। কিন্তু না,আরশান একচুলও নড়লো না। কাঁধে সাঁঝের কামড়ের দাগ ফুটে উঠলেও তার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। চোখে সেই একই দমবন্ধ করা অধিকার।

“ছাড়ুন…. আমাকে ছাড়ুন। আপনি খুব খারাপ।”

আরশান ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলো, “ছাড়ার জন্য তো নিয়ে আসেনি।”

এবার সাঁঝের দ্যান ভাঙলো। হতবাক হয়ে তখন বলল, “এ্যাই আমি এখানে আসলাম কিভাবে? গত রাতে তো আমি আমার রুমেই ঘুমিয়েছিলাম।”

আরশান চুপচাপ তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ঠোঁটের কোণে কুটিল হাসি। “নিয়ে এসেছি।”

সাঁঝের চোখ দু’টো বড় হয়ে গেল।

“নিয়ে এসেছেন মানে কী ? এক মিনিট… আম্মু কিছু বলেনি?”

“কী বলবে?”

সাঁঝ অধর্য্য হয়ে বলল, “বলুন না।”

আরশান এতদিনের সবকিছু বলল। এতদিন যা হয়েছে, সবকিছুই সাঁঝকে জানাল। গতরাতে রাত দুই’টার সময় তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিল। তখন সাঁঝ ঘুমে। এই ঘুমের মাঝেই সাঁঝকে কোলে করে নিয়ে এসেছে। সাঁঝ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আরশানের দিকে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না, ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে। তাও আবার তার নিজের মায়ের সামনে। সাঁঝ চোখ ছোট ছোট করে বলল,

“আপনার একটু-ও লজ্জা করেনি? এভাবে কোলে তুলে নিয়ে এসেছেন? তাও আবার আম্মুর সামনে।”

“আমি কী অন্য কাউকে নিয়ে এসেছি নাকি?”

সাঁঝ মুখটা একটু ঘুরিয়ে হেসে উঠল। তার চোখের কোণে খানিকটা বিস্ময়ও খেলে গেল। আরশান যে এমন করবে, সেটা সে একেবারেই কল্পনা করেনি। পরক্ষণেই উষ্ণ ছুঁয়া পেতেই সাঁঝ কেঁপে উঠলো। আরশান মুখ গুঁজে রয়েছে তাঁর গলায়। অবচেতনেই দু’হাত বাড়িয়ে আরশানের শার্টের কলারে শক্ত করে চেপে ধরল সাঁঝ। তবে একটু পরই ব্যথার ঝাঁকুনি ছড়িয়ে গেল শরীরজুড়ে। সাঁঝ কুঁকড়ে উঠল, দ্রুত আরশানকে ঠেলে সরিয়ে দিল। হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলল,

“আশ্চর্য! আপনাকে কামড় দিয়েছি বলে প্রতিশোধ নিলেন?”

আরশান কোনো প্রতিত্তোর করল না। শুধু এক চিলতে হাসি টেনে সাঁঝকে ধীরে কোলে থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। সাঁঝের চোখে ঝিলিক ধরা আতঙ্কটা খেয়াল করে মজা পেতে লাগল । ঝুঁকে পড়ে এলোমেলো করে দিল মেয়েটার চুল। তারপর নরম গলায় বলল,
“রাতে যে এত আদর করলাম, টের পাসনি।”

এক মুহূর্তেই সাঁঝের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। চোখ বড় বড় হয়ে চেয়ে রইল আরশানের দিকে। মনে করার চেষ্টা করেও কিছুই মনে পড়ছে না ওর। গতরাতে তো ও কিছুই বুঝতে পারেনি। দরজার কাছে গিয়ে আরশান হাত বাড়িয়েও থেমে গেল। পেছন ফিরে তাকাল সাঁঝের দিকে। মেয়েটার অস্থির মুখ দেখে হাসলো।

“ওরে বলদ, ভাবতে ভাবতে দেখি উগান্ডায় চলে যাবি। কিছুই হয়নি।”

সাঁঝ ঠোঁট কামড়ে কটমট করে তাকায়। ভীতি আর বিভ্রান্তি এক নিমেষে গলে গিয়ে রাগে পরিণত হলো। পাশে হাতে বালিশ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল আরশানের দিকে।

“আপনি একেবারেই অসহ্য।”

চলবে…..

#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২৫
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)

কানাডার বসন্তের দিন। গাছের ডালপালায় কোমল সবুজ পাতার সাথে সাদা আর গোলাপি ফুলেরা ঝুলে আছে। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা, চারদিকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কাঠবিড়ালির ছুটোছুটি চোখে পড়ছে। পার্কের সবুজ ঘাসে ছোট ছোট সাদা ডেইজি ফুল মাটির বুকে ছড়িয়ে আছে।

মিরাব আর জাইরান হাত ধরে হাঁটছে পার্কের ভেতরকার পাথরের সরু পথ ধরে। মিরাব কিছু একটা বলছে, জাইরান তা শুনে হেসে উঠছে। হেসে ওঠার সময় তার চোখ সরু হয়ে যাচ্ছে। মিরাবের মুখেও তৃপ্তির শান্ত হাসি। দু’জনের মাঝের বোঝাপড়াটা গভীর। পার্কের একপাশে বড় এক ম্যাপল গাছের ছায়ায় বসে আছে আরশান। ফোন হাতে গেম খেলছে, ঠোঁটে অল্প বিরক্তির রেখা। চারদিকে প্রকৃতির এত সৌন্দর্য, অথচ সে একেবারেই তাতে আগ্রহী নয়। মাঝে মাঝে স্ক্রিনে চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছে, আবার দ্রুত আঙুল চালাচ্ছে।

সাঁঝ কিছুটা দূরে বসে ডেইজি ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছে। সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসেছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে নেমে এসেছে। বসন্তের হাওয়ায় তার ওড়না দুলে উঠছে। সাঁঝ ফুল তুলে হাতে রাখছে যত্ন করে। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। হাতে গোছা ডেইজি ফুল নিয়ে সাঁঝ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আরশানের দিকে। আরশান তখনও ফোনে মগ্ন। সাঁঝ পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, কিছু বলে না। শুধু একটা একটা ফুল তুলে আরশানের মাথার ওপর গুঁজে দেয়।

“কী করছিস?” আরশান ভ্রু কুঁচকে ফোন থেকে মুখ তোলে।

“ডেইজি ক্রাউন বানাচ্ছি, আপনার মাথায়।”

“সাঁঝ, এসব বাচ্চাদের মত করছিস কেন?”

সাঁঝ আবার আরেকটা ফুল নিয়ে মাথায় গুঁজে দেয়। “চুপ করুন,নড়বেন না।”

আরশান মোবাইল স্ক্রিন বন্ধ করে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক হাতে হালকা করে ফুলটা সরিয়ে দেয়, কিন্তু সাঁঝ আবার জোর করে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেয়।

“এমন করবেন না। ছবি তুলবো তো।”

সাঁঝ আবারও ডেইজি ফুলগুলো গুঁজতে শুরু করে। আরশান এক মুহূর্ত স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল, হাসিমাখা ঠোঁট আর নির্ভার হাসি। সবকিছু মিলিয়ে সাঁঝকে এই বসন্ত বিকেলের ভীষণ সুন্দর লাগছে। শেষ করে সাঁঝ হাতে থাকা বাকি ডেইজি ফুলগুলো ঘাসের ওপর রেখে দেয়।
আরশান ফোনটা পাশে রেখে উঠে ফুলগুলোর দিকে হাত বাড়ায়। কয়েকটা ডেইজি তুলে নেয় খুব যত্ন করে। মুখে মনোযোগ, আঙুলের মাঝে ফুলের ডাঁটা বাঁকিয়ে, গেঁথে ছোট্ট একটা আংটির মতো বানিয়ে ফেলে। সাঁঝ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। যে ছেলেটা একটু আগেও শুধু গেম খেলছিল, সে হঠাৎ এত যত্ন করে ফুল দিয়ে কি বানাচ্ছে? হঠাৎ আরশান দাঁড়িয়ে ওঠে দাঁড়ায়। সাঁঝ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় তার দিকে।

“কি করছেন ?”

উত্তর না দিয়ে আরশান হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তার সামনে। সাঁঝের দিকে ফুলটা বাড়িয়ে বলে,

“Every day, my love will still be yours. Will you…. marry me?”

সাঁঝ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপরই হেসে ফেলে। তার হাসি বাতাসে ডেইজি ফুলের মতোই ভেসে ওঠে।

“Sorry… I am married.”

এক মুহূর্ত আরশান স্থির থাকে, তারপর তাঁরও ঠোঁটে নরম হাসি খেলে যায়। সাঁঝ তখন হাত বাড়িয়ে দেয়। তার আঙুলগুলো সাদা ফুলের আংটির জন্য প্রস্তুত । আরশান ধীরে ধীরে আংটিটা তার আঙুলে পরিয়ে দেয়। আঙুলের ওপর ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। আরশান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাঁর চড়ুই বাচ্চাকে।

———

বিকেল বেলার আকাশটা হালকা কমলা আর গোলাপি আলোয় রাঙা। বাইরে গাছের পাতাগুলো ধীরে ধীরে লালচে হয়ে উঠছে। মেহুল বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। কানে হেডফোন, ভ্রু কুঁচকে কখনো হেসে উঠছে, আবার কখনো গম্ভীর মুখ করছে। এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে মেহুলের মায়ের ডাক এলো।

“মেহুল।”

মেহুল সোজা হয়ে বসে বলল, “আসছি।”

বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে এগোল।কিন্তু দরজা খুলতেই চোখ আটকে গেল। সামনে তাঁর মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। বিস্ময় আর আনন্দে চোখ চকচক করে উঠল মেহুলের।
মেহুলের মা এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললেন,
“তুমি যে কাউকে পছন্দ করো, আমাকে আগে বলোনি কেন?”

মেহুল হকচকিয়ে গেল। বিভ্রান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে তারপর সাঁঝের দিকে চাইল।মাথায় ঢুকছে না কথাগুলো। “কী বলছো আম্মু?”

“নির্ভাণের ফ্যামিলি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।”

মেহুল চোখ গোল গোল করে তাকাল। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে! মানে কী?

মেহুলের মা বলল,”এভাবে লুকিয়েছো কেন, বলো তো? আমরা কি মানা করতাম? তুমি যদি আগে বলতেই, তাহলে আমরা এই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতাম না।”

মেহুল এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“আমাকে তো কোনদিন জিজ্ঞেস করোনি, আমি করতে চাই কিনা।”

মেহুলের মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সত্যিই তো মেহুল ঠিকই বলেছে। এতদিন তারা শুধু নিজেদের ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কখনো ভাবেনি তাঁদের মন কী চায়, কোনটায় তাদের ভালো লাগে। মেহুলের মা কিছুক্ষণ চুপ করে তারপর বললেন,
“আমি ড্রইংরুমে যাচ্ছি, রেডি হয়ে আসো।”

মেহুলের মা বের হয়ে যেতেই মেহুল দরজা বন্ধ করে সাঁঝের দিকে তাকায়।

“এসব তুই করেছিস, তাই না?”

“আমি করব কেন? আমি তো শুধু বলেছি, বাকিটা নির্ভাণ ভাইয়া করেছে।”

সাঁঝ এগিয়ে এসে একেবারে সামনে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে মেহুলের গাল টেনে ধরল।
“তুই থাক, আমি আসছি।”

মেহুল কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল, “এখন আবার কই যাবি?”

কিছুক্ষন পরই সাঁঝ আর মিরাব দু’জনেই ফিরে আসে। হাতে বড় বড় শপিংব্যাগ ঝুলছে। দু’ইজনের মুখেই তৎপরতার ছাপ।

“এগুলো কী?”মেহুল তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

সাঁঝ ব্যাগটা খুলে দেখিয়ে দিল। ভিতরে রেশমি শাড়ি, সুন্দর ডিজাইনের ব্লাউজ, কাগজে মোড়ানো ফুলের ব্রুশ, গহনা আরও কত কিছু। সাঁঝ হেসে বলল,

“আজকে তোর বিয়ে, তো রেডি হবি না?”

মেহুল থ হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল দু’জনের দিকে। মাথার ভেতর সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। এ হঠাৎ বিয়ে, এ হঠাৎ সাজ, আর চারপাশের এত আয়োজন। সবকিছুই হঠাৎ অপ্রত্যাশিত। মিরাব সাবধানে শাড়িটা খুলে টেনে আনল। রংটা পিচ-গোলাপি, ধীরে ধীরে ভাঁজ খুলে শাড়িটা মেহুলকে সুন্দর করে পড়িয়ে দেয়।চোখের পলকেই সময় ফুরিয়ে এলো। এই অপ্রত্যাশিত ভাবেই মেহুলের বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে পরিবেশটা মুহূর্তের জন্যে উৎসবের আলোয় ভরে উঠেছিল। কিন্তু আনন্দের সেই সময় মেহুল যখন বিদায়ের সময় এলো, সবার ভিড়ের মাঝেই নিকো মেহুলের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। নিকোর ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে, তার চোখ ভিজে উঠেছে টলটলে জলে। বুক ভরে কান্না আটকে রাখতে পারছে না সে। মুহূর্তেই গলা রুদ্ধ হয়ে কান্নার শব্দ বেরিয়ে এলো।

“না! আমি আপুকে যেতে দেব না।”

মেহুল নিচু হয়ে নিকোকে জড়িয়ে ধরলো, চোখে জল। নিকোর ছোট্ট হাত আরও জোরে জড়িয়ে ধরল মেহুলকে। তার ভেতরের ভয়টা স্পষ্ট, মেহুল চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।
সবাই ওদের দেখছে। সাঁঝ এগিয়ে এলো। নরম কণ্ঠে নিকোর ছোট্ট কাঁধে হাত রাখলো সে। একটু ঝুঁকে তার চোখের দিকে তাকাল।
“নিকো, এভাবে কাঁদিস না তো। মেহুল তো কোথাও পালাচ্ছে না। ও তো কালকেই আবার ফিরে আসবে। তুই কাল সকালে উঠেই ওকে দেখতে পাবি।”

নিকো টলমল চোখে তাকায়,মাথা নেড়ে বললো, “কালকে আসবে? একদম সত্যি?”

“হ্যাঁ , একদম সত্যি। কালকেই আসবে। তুই চাইলে আমি নিজেই তোর সঙ্গে গিয়ে নিয়ে আসবো, ওকে।”

সাঁঝের কথায় নিকোর কাঁপা শরীরটা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। কিন্তু তবুও সে মেহুলের গলা থেকে হাত ছাড়তে চাইলো না। মেহুলও তখন চোখ ভিজে আসা হাসি নিয়ে নিকোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নিকো দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিল। তার ছোট্ট চোখ দুটো এখনো কান্নায় ভেজা। সাঁঝ নিকোকে মেহুলের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরাল। সাঁঝ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“চল, আমরা একসাথে মেহুলকে বিদায় দিই। হাসিমুখে বিদায় দিতে হয়, তাই না?”

নিকো চোখ মুছতে মুছতে সায় দিল।

——–

বিছানার ওপর ছড়ানো রঙিন শাড়িগুলো।পাশে রাখা শপিং ব্যাগগুলো এখনো আধখোলা, তার ভেতর থেকে আরও কয়েকটা ঝলমলে শাড়ি উঁকি দিচ্ছে। সাঁঝ দুই হাত কোমরে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে এমনভাবে, যেনো এগুলো কোনো জটিল সমীকরণ। শাড়ি কিনে তো আনলো, কিন্তু সে তো পড়তেই জানে না। আরশান একপাশে দাঁড়িয়ে শাড়িগুলো খুঁটিয়ে দেখছিল। তারপর একটা শাড়ি তুলে নিল। আরশান সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা পড়।”

“আমি শাড়ি পড়তে পারিনা।”

“কিহ! তুই এখনো শাড়ি পড়তে জানিস না?”

সাঁঝ গলা উঁচু করল, “হ্যাঁ, জানি না। শাড়ি পড়া কি আর সোজা কথা নাকি? ওই এত লম্বা কাপড়, কোথা থেকে জড়িয়ে কোথায় গুঁজতে হয়, সব গুলিয়ে যায়।”

আরশান মাথা নাড়ল, “চেষ্টা করে দেখি।”

সাঁঝ গলা নামিয়ে বিড়বিড় করল, “পাগল, এটা কি কোনো খেলা ?”

কথা শেষ না হতেই আরশান শাড়িটা মেলে ধরল। লম্বা কাপড়টা তার কাঁধ থেকে মাটিতে ঝুলে পড়ল। শাড়িটা এলোমেলোভাবে সাঁঝের গায়ে জড়িয়ে দিল, কোথাও ভাঁজ ঠিক হয়নি, কোথাও আঁচল মাটিতে টেনে বেড়াচ্ছে, কোথাও আবার কোমরে গুঁজে রাখার বদলে ঝুলে আছে যেনো কাপড়ের পাহাড়। সাঁঝ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে হকচকিয়ে গেল।
“এ্যাহ, এ কেমন শাড়ি পরালেন।”

শাড়ির আঁচল প্রায় মাটিতে পড়ে আছে, কোথাও কাপড় বেশি টেনে রাখা, কোথাও আবার একেবারেই আলগা। আরশান সোফায় হেলান দিয়ে বসে, পেটে হাত দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে হাসছে। চোখে পানি চলে এসেছে তার হাসতে হাসতে।

“আরে বাহ! একদম নতুন ফ্যাশন। তুই চাইলে এখনই র‌্যাম্পে উঠতে পারিস।”

“এসব কই থেকে শিখলেন?”

আরশান দম ফাটানো হাসি চাপতে চাপতে বলল, “আমি শিখিনি, তবে তোর জন্যই নতুন এক স্টাইল তৈরি করে দিলাম।”

সাঁঝ গম্ভীর ভঙ্গিতে আঁচলটা টেনে ঠিক করতে গিয়ে আরও গুলিয়ে ফেলল। আঁচলটা মেঝেতে টেনে আসছে, সাঁঝের এই অবস্থা দেখে আরশান আবারও হেসে উঠল।

চলবে……