#এক_চিলতে_প্রেম
#পর্ব_২৬
#লেখা_আইজা_আহমেদ
(কপি করা নিষিদ্ধ)
কিচেনের আলোটা হালকা হলদেটে। সাঁঝ আজকে প্রথমবার রান্না করবে, সেই উত্তেজনা আর নার্ভাসনেস তার চোখে-মুখে। রান্নাঘরের টেবিলে সবজি, মশলা আর কাঁচা খাবার সাজানো। নুটি কিচেনের জানালার কাছে বসে আছে। সাঁঝ দেখে হাসলো, হাতায় গুঁজে চুল বেঁধে নিলো, তারপর বলল, “আরশান…”
আরশান তখন পেঁয়াজ কাটছিলো। হাত থামিয়ে তাকাল, “বলেন ম্যাডাম।”
সাঁঝ হেসে ফেলল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলল, “আরশান ভাইয়া।”
“বলো বনু।”
এক মুহূর্তেই সাঁঝের মুখ শক্ত হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল সে। চুপ করে ছুরি তুলে নিলো টেবিল থেকে। ধীরে ধীরে হেঁটে গেল আরশানের কাছে। আরশান তাকিয়ে আছে, হাসিটা আরো গাঢ় হলো।
সাঁঝ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“কী বললেন? আবার একবার বলেন, শুনি।”
আরশান দুই হাত উঁচু করে বলল,
“কী মুশকিল! তুই বললে দোষ না, আর আমি বললেই দোষ।”
“আর বলবেন না।”
বলেই সাঁঝ রান্নার কাজে মন দিল। কিন্তু ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি লুকিয়ে রাখতে পারল না। অনেক পরিশ্রমের পর অবশেষে সাঁঝ খাবারগুলো নামাল। সব খাবার গুলো সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। চোখে তৃপ্তির ঝিলিক। সাঁঝ নিজের হাতেই টেবিল সাজিয়ে বলল, “খেয়ে দেখুন তো ।”
আরশান চেয়ার টেনে বসল। ভাতের সাথে তরকারি মিশিয়ে প্রথম লোকমা মুখে দিল। এক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মুখ কুঁচকে গেল। লবণ যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, আর তরকারির ঝাল এতটাই বেশি যে চোখে পানি চলে এল।
কিন্তু সাঁঝের উজ্জ্বল চোখদু’টো তখন আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই আরশান তাড়াতাড়ি হাসি চাপিয়ে বলল, “খুব ভালো হয়েছে।”
সাঁঝ খুশিতে হাত চাপড়ে বলল, “সত্যি? আমার আর ভাবলাম ভালো হয়নি।”
এদিকে তার গলা যে জ্বলছে, চোখে পানি এসে গেছে। তারপরও আরশান মাথা নেড়ে বলল,
“একদম পারফেক্ট হয়েছে।”
এই বলে সে ধীরে ধীরে খেতে লাগল। যদিও প্রতিটি লোকমার সাথে তার মুখের অঙ্গ-ভঙ্গি অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে ,তবুও সাঁঝের খুশির জন্য খেলো।
——-
সোফি এবার বিডিতে যাবে। খবরটা শুনেই সাঁঝের মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। সোফি যাচ্ছে অথচ সে যাবে না। এটা সাঁঝ একেবারেই মেনে নিতে পারলো না। আরশান প্রথমে না করে দিয়েছে,আমরা পরে যাবো, এখন নয়। কিন্তু সাঁঝ একগুঁয়ে হয়ে বলল, “না, আমি যাবোই। আপনি না গেলে আমি আম্মুর সাথে চলে যাবো।”
সাঁঝের জেদের জন্য আরশান বাধ্য হয়েই রাজি হলো। অগত্যা ওর সঙ্গেও বিডিতে আসতে হলো। বাড়িতে পৌঁছানোর পর থেকেই সাঁঝ অন্যরকম হয়ে গেছে। সেই কখন থেকে সে মৌসুমী বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কত বছর পর দেখা হলো যে। কথাবার্তা বলে সবাই ঘরে ঢুকে। তখনই সাঁঝের মাথায় টান লাগলো। চমকে উঠে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। অর্ণব ভাইয়া ওর চুল ধরে টান দিচ্ছে। মুখে তার চিরচেনা দুষ্টুমি ভরা হাসি।
অর্ণব বলল, “কাঁদতে কাঁদতে দেখি সাগর বানিয়ে ফেলবি।”
সাঁঝ চোখ মুছতে মুছতে একবার তাকাল অর্ণবের দিকে।
“তোমার রুম আমি সাগর বানিয়ে ফেলবো।এতদিন পর দেখছি, কান্না আসবে না নাকি?”
আরশান এগিয়ে এসে সাঁঝের কান টেনে বলল,
“পরে পকড় পকড় করবি। সারাদিন কিছুই খাসনি। আগে ফ্রেশ হয়ে, কিছু খেয়ে নে।”
সাঁঝ ভেঙছি কেটে উপরে চলে গেল।আরশানও যাবে, ঠিক তখনই অর্ণব তার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতটা সামনে বাড়িয়ে পথ আটকাল। আরশান বুঝে গেল অর্ণব কী চাইছে। হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“পিছনের কালো লাগিজটা তোর।”
——
খাবার টেবিলে বসে আছে সাঁঝ আর আরশান। টেবিলে সাদা টেবিলক্লথ বিছানো, তার ওপর গরম ভাত, মাংস, তরকারির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সোফি আর মৌসুমী বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত। এমন সময় ওপরে থেকে ধপধপ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে অর্ণব। আরশান একপলক তাকিয়েই থেমে থাকে না, ঠোঁটে হাসি খেলে যায়।
“তুই মেয়েদের মতো চুলে জুটি করেছিস কেন?”
অর্ণব একটু থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে চোখ বড় বড় করে তাকায় ভাইয়ের দিকে।
“আশ্চর্য! আমি এসব করতে যাবো কেন?”
“ভালো করে দেখ।”
অর্ণব একটু বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত চালালো মাথার চুলে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সত্যি তো, ওর মাথায় দুই পাশে সুন্দর করে দুই’টা জুটি করা। যেমন স্কুলের ছোট মেয়েরা করে। মুহূর্তেই টেবিল কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল সাঁঝ। অর্ণব চোখ কুঁচকে তাকাল সাঁঝের দিকে।
“এটা তুই করেছিস, তাই না? বেয়াদব মেয়ে, আমার চুলে এসব করেছিস কেন? ভাইয়ার চুলে করতি।”
সাঁঝ তখনো হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে গাল লাল হয়ে গেছে।
“কী করবো, তোমার চুলগুলো দেখলে বেঁধে দিতে ইচ্ছে করে। এমন লম্বা যে, হাত আটকানো যায় না।”
“আমার চুলে হাত দিবি না, নাহলে তোর মাথার একটা চুলও থাকবে না।”
খাওয়া শেষে ওরা গেল বাগানে। সাঁঝ গাছ লাগবে। বাতাসে চারপাশটা একেবারে সতেজ লাগছিল। বাগানে রোদের কোমল আলো ছড়িয়ে আছে। সাঁঝ দু’হাত মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে ছোট্ট চারা রোপণ করছে। কপালের কাছে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। চোখে-মুখে আনন্দ।
অর্ণব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাঁঝের কীর্তি দেখছে।
বাগানের সামনে টেবিলের ল্যাপটপ খুলে বসেছিল আরশান। আঙুলগুলো কীবোর্ডে ছুটছিল, মুখ গম্ভীর। তবে হঠাৎ কান্নার শব্দ আসে। আরশানের হাত কীবোর্ডের ওপর থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে সে মাথা তুলল। দেখতে পেল অর্ণব সাঁঝের হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে। সাঁঝ কাঁদছে হাউমাউ করে। তার ফর্সা মুখটায় লালচে আভা এসে গেছে, কান্নায় ভিজে গাল চকচক করছে। আরশানের বুকটা ধক করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে চেয়ারে থেকে উঠে দাঁড়াল সে। কণ্ঠে উৎকণ্ঠার ঝাঁজ।
“কী হয়েছে? কান্না করছিস কেন?”
অর্ণব দাঁত বের করে বলল, “সুন্দরী মেয়ে পেয়ে, শা’লার বেডা মৌমাছি কামড় দিয়েছে।”
সাঁঝ কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না, কেবল হাতটা উঁচু করে দেখাল। ফর্সা হাত ফুলে লাল টকটকে হয়ে উঠেছে, জায়গাটা জ্বলজ্বল করছে।
আরশানের সাঁঝের হাতটা নিজের হাতে নিল।বিরক্ত দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকাল,
“তুই ওকে পিছনে নিয়ে গেছিস কেন?”
“আমি নিয়ে যাবো কেন? ওই ট্যাং ট্যাং করে গেছে গাছ লাগাতে।”
আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাঁঝের হাতের ফোলা জায়গাটায় আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেখল। সাঁঝ কেঁপে উঠল ব্যথায়।
“তাড়াতাড়ি যা বরফ নিয়ে আয়।”
অর্ণব ছুটে গেল ভেতরে বরফ আনতে।
বিকেলের দিকে সাঁঝ ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিল। মৌমাছির কামড়ে হাতটা এখনও ফোলা আর লালচে, ব্যথা লাগছিল বেশ। আরশান বারবার বরফ লাগিয়ে দিয়েছে, ওষুধ লাগিয়েছে। তবুও সাঁঝ কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছতে মুছতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে, টেরও পায়নি। রাত প্রায় ১১টা ছুঁই ছুঁই। তখন সাঁঝ ঘুম থেকে উঠেছিল।
রাতের খাবার আরশান নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে সাঁঝকে। তিনজন মিলে বসেছে ড্রইং রুমে, সাঁঝ, আরশান আর অর্ণব। কাঁচের টেবিলের উপর কয়েকটা কফির মগ পড়ে আছে, সঙ্গে হালকা খাবার। ঘরটা আধো অন্ধকার করে রাখা হয়েছে, শুধু টিভির আলো। সাঁঝ জেদ করেই বসেছে হরর মুভি দেখবে বলে। সোফায় বসে আছে তারা । মাঝখানে আরশান, ডানপাশে সাঁঝ আর বাঁ-পাশে অর্ণব। সাঁঝ ভয় পেয়ে আরশানের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, অন্যদিকে অর্ণবও আরশানের হাত ধরে রেখেছে। ফলে আরশান মাঝখানে বসে একেবারেই বিরক্ত হয়ে আছে। এক হাতে সাঁঝ, অন্য হাতে অর্ণব। ভয় পাচ্ছে তবুও ওরা মুভি দেখবে।
টিভির পর্দায় তখন ভৌতিক দৃশ্য চলছে। সাঁঝ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে।
আরশান তখন সাঁঝের দিকে তাকায়। সাঁঝও আরশানের দিকে ঘুরে তাকাল। দু’জনের চোখাচোখি হওয়া মাত্রই টিভির আলোয় আরশানের মুখটা এক সেকেন্ডের জন্য কেমন দেখা গেল। আর তাতেই সাঁঝ ভয়ে হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে উঠল।
“আআআ…..”
চিৎকার দিয়ে একলাফে সোফার একদম অন্য প্রান্তে গিয়ে বসে পড়ল সাঁঝ। সাঁঝের চিৎকারে আরশান আর অর্ণব দু’জনেই ভয় পেয়ে একসঙ্গে সরে গেল অন্য পাশে। অর্ণব নিজের বুক চেপে ধরে বলল,
“আরেকটু জোরে চিৎকার দিতি, আমি এখানেই হার্ট অ্যাটাক করে ফেলতাম।”
আরশান গলা উঁচু করে বলল, “এভাবে কেউ চিৎকার দেয়, সাঁঝ।”
“আমি কী করবো? আপনার দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেছি।”
আরশান উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে টিভির রিমোটটা নিয়ে অফ করে দেয়। আগে যে অন্ধকার-আলোর ভাসানী ছিল, তা কেটে গেল।আরশান টিভি অফ করে অর্ণবের দিকে ফিরে বলল, “এখন যা,গিয়ে ঘুমা। আর দেখা লাগবে না।”
অর্ণব উঠে দাঁড়াল, কয়েক পা যেতেই পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। সাঁঝের দিকে তাকিয়ে অর্ণব ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“আমার চুলের যদি বারোটা বাজাস, তাহলে তোকেও আমি তেরোটা বাজিয়ে দিবো।”
সাঁঝও ভেঙছি কেটে বলল, “আমিও তোমাকে চৌদ্দটা বাজিয়ে দিবো।”
ছোট্ট এই স্থানে খুনসুটি আর টক্কর চলছে। তা দেখে আরশান মেকি রাগ দেখিয়ে বলল, “অর্ণব, যা গিয়ে ঘুমা।”
অর্ণব সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। আরশান তাকিয়ে দেখে, সাঁঝ এখনও সোফায় বসে আছে।
“এখনো বসে আছিস কেন?”
সাঁঝ দুই হাত বাড়িয়ে দিল। চোখে একরাশ আকুলতা ভাসছে। মৃদু স্বরে বলল,”কোলে নিন।”
আরশানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। কোনো কথা না বলে সাঁঝকে আলতো করে তুলে নিল বুকের কাছে। মুহূর্তেই সাঁঝের মাথা ঠেকল তার কাঁধে। রুমে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল আরশান। সাদা বিছানার চাদরে ছড়িয়ে পড়ল সাঁঝের চুল। আরশান এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ঝুঁকে এল তার দিকে।
মৃদু, গভীর কণ্ঠে আরশান ফিসফিস করে বলে,
“হৃদয় যদি বন্দী হয় চোখের কারাগারে, তাহলে আমি তোমার ওই চোখেই বন্দি হতে চাই।”
এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠে সাঁঝের হৃদস্পন্দন। আরশানের মুখ থেকে ‘তুমি’ শব্দ শুনে ভেতরে ঢেউয়ের শিহরণ বইছে। চোখে হঠাৎই ভেসে ওঠে শিশির ভেজা ভোরের মতো নরম আলো, আর ঠোঁটের কোণে জমে ওঠে অব্যক্ত বিস্ময়ের হাসি।
চলবে……..
[রিচেক করা হয়নি।]