মেঘের খামে পর্ব-৬+৭

0
4

#মেঘের_খামে
পর্ব ৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

পরেরদিন মহুয়া ভার্সিটি যেয়েই তিসানের খোঁজ করে। সত্যিই খোঁজ করার সাথে সাথেই তার ঠিকানা পেয়ে যায়। যেয়ে দেখে একটি খালি ক্লাসরুমে তিসান তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল।

হাই বেঞ্চে শুয়ে ছিলো। মোবাইল চালাচ্ছিল। মহুয়া নক করে দরজায়, “আসতে পারি?”
তিসান মেয়েলি কন্ঠ শুনে প্রথমে মুখ থেকে মোবাইল সরিয়ে তাকায় তারপর মহুয়াকে দেখে লাফ উঠে উঠে বসে, “অফকোর্স পার্টনার। আসো”
“পার্টনার?” মহুয়া ভেতরে ঢুকে প্রশ্ন করে।
“তুমি জাহানের জ্বালাই তো আমার সাথে দেখা করতে এসেছ। পার্টনারশিপ করতে। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়, রিমেম্বার?”
মহুয়া লাফ দিয়ে বসে তার সামনের বেঞ্চে। পা ঝুলিয়ে বলে, “ব্রো আমার কোনো শত্রু তো নেই। তাই হয়তো বন্ধু হতে পাড়লাম না।”
তিসানের পাশের ছেলে একটা, যার নাম মুহিব। সে রেগে বলে, “তাইলে এখানে কি মুড়ি খাইতে আইসেন?”
মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “দেন বানিয়ে। ঝাল কম, চানাচুর বেশি।”
“মানে? আমাকে কি মুড়িওয়ালা মনে হয়?”
“তো না হলে মুখ খুললেন কেন?”
ছেলেটা রেগে এগোতে গেলে মহুয়া তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সে কর্কশ গলায় বলল, “এভাবে দেখছেন কোন দু:খে? আপনার বন্ধু ভিডিও দেখে আমার কাছে এসেছিল, আপনি দেখেন নি? আমি কিন্তু চোখের সামনে শুধু অ*স্ত্র উঠাতে পারি না, চোখের ভেতরও ঢুকাতে পারি। চোখ নামান। ফারদার এমন চোখে তাকালে চোখ উঠিয়ে ওই চোখ দিয়েই মারবেল মারবেল খেলব।”
একটা সামান্য মেয়ে তার অপনাম করল এই কথা মুহিবের সহ্য হলো না। সে এবার আরও তেজে এগোতেই দেখে মহুয়া আসলে তার পকেট থেকে একটি ছু*রি বের করে আঙুলে মাঝে ঘোরাচ্ছে। তারপর এক আঘা*তে ছুরিটার কোণা সে বেঞ্চে গেঁথে দিলো।
বাঘের মতো গর্জন করা ছেলেটা ভিজে বিড়াল বলে গেল। সে চুপসে গিয়ে এক পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসল।

তিসান এতক্ষণ চুপ করে সব দেখছিলো। সে দেখতে চাচ্ছিল আসলেই কি মহুয়া জাহানকে টক্কর দেওয়ার সাহস রাখে না’কি শেষ ঘটনাটা নেহাৎ ভাগ্য।

অবশেষে সে শব্দ করে হেসে উঠে। মহুয়ার ভাবসাব তার ভীষণ ভালো লেগেছে। সে এবার তার ফোনটা পাশে রেখে মহুয়ার সাথে কথা বলার প্রস্তুতি নেয়। তার সাথে কথা বলে অন্তত তার সময় অপচয় হবে না।
“তো জাহানের সাথে শত্রুতা না থাকলে আমাকে খোঁজার কারণ। প্রথম দেখায় মন কেড়ে নিয়েছি না’কি?”
মহুয়া হেসে উওর দেয়, “নিজেকে এতটাও প্রাধান্য দেবার প্রয়োজন নেই। আমি এসেছি এখানে জাহানের ব্যাপারে জানতে।”
“আমার কাছে?” কপাল কুঁচকে তাকায় তিসান।
“দেখো ওই লোক আমাকে একবার ফাঁকি দিয়ে জিতে গেছে। আমার হেরে যাওয়া পছন্দ না। আর ওই লোকের কাছে তো একটুও না। ওর সঙ্গীদের সাথে ভালো খাতির হয়েছে আমার। তবে ঝামেলাটা হচ্ছে ওরা জাহানের বিশ্বাসী। জাহানের কথার বিরুদ্ধে তো আর তারা যাবে না, যতই হোক আমার ভাই ব্রাদার। এখন বন্ধু বাদে তো শত্রুই তোমার সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তো সোজা এলাম তোমার কাছে। জাহানের দুর্বলতা আমার জানা প্রয়োজন।”
“বলো কি জানতে চাও?”
“জাহানকে কীভাবে জব্দ করা যায়?”
“সেটা জানলে তো এতদিনে করতামই।”
“আচ্ছা বলো তো জাহান না’কি অলোয়েজ ফার্স্ট হয়। আসলেই টেলেন্টেড না’কি ফ্যামিলি পাওয়ার? ফ্যামিলি পাওয়ার হলে ফুল ক্যাম্পাসের সামনে এক্সপোজ করে দিব। ইজ্জতের ছ্যালাপ্যালা হয়ে যাবে।”
“সরি টু সে আসলেই টেলেন্টেড। বৃত্তি থেকে শুরু করে এস এস সি, এইচএসসিতেও গোল্ডেন এ প্লাস। সংবাদপত্রেও ওর ছবি এসেছিল।”
“ড্যাম। আচ্ছা যাই হোক। আরও উপায় আছে, মেয়েবাজ না’কি বলো তো। তাইলে একটা স্কেন্ডাল ফাঁস করে দিব।”
“মেয়েদের পাত্তা দেয় না।”
“তাহলে কি ছেলেদের প্রতি ইন্টারেস্টেড না’কি?”
“ছেলেদেরও পাত্তা দেয় না।”
মহুয়ার মনে পড়ে জাহান সেদিন কীভাবে হলে তার কাছে যাওয়ায় অস্বস্তিকর বোধ করে চলে গিয়েছিল সেখান থেকে। সে এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়ে তিসানকে জিজ্ঞেস করে বসে, “তাহলে কেবল বলো ওই হনুমান প্লাস্টিক সার্জারি করেছে?”
“না তো।”
” একটা ছেলে পড়াশোনা, খেলাধুলা, চরিত্র, চেহেরা সব এক নাম্বার হয় কীভাবে? কোনো খারাপ অভ্যাস নাই? ওইটা কি আসলে মানুষ? মানুষ ভেসে এলিয়েন না তো?”
মহুয়ার গভীর ভাবান্তর দেখে তিসানের হাসি পেয়ে গেল। মেয়েটার চিন্তা দূর করতে সে বলল,
“সিগারেট খায়।”
“তাইলে কি ওই সিগারেট আমি ওর চুলের বাহারে লাগিয়ে টাক্কু করে দিব। না, তার চুলগুলো সুন্দর। আমার কেবল তার চুলগুলোই ভাল্লাগে। প্রাক্টিকাল কিছু বলো। আমি তোমার আশায় সারারাত নিজের মস্তিষ্কের উপর প্রেশার না দিয়ে শান্তি মতো ঘুমিয়েছি।”
“কিছুই তো নেই। খারাপ কিছু পাচ্ছি না।”

মহুয়া ভাবান্তর দৃষ্টিতে তাকায় তিসানের দিকে। সে হাঁটুতে তার কণুই রেখে গালে হাত রাখে। জিগ্যেস করল, “সে এত ভালো হলে তোমাদের শত্রুতার কারণ কী?”
প্রশ্নে চমকায় তুরণ। সে চোখ নামিয়ে নেয়। বিষয়টি নিয়ে ভাবতেই তার রাগে হাতের মুঠো বন্দী হয়ে যায়। সে নিজেকে শান্ত করতে গভীর নিশ্বাস ফেলে। তাকায় মহুয়ার দিকে, “তোমার তা না জানলেও চলবে। এবার যেতে পারো।”
“লজ্জা টজ্জা বলতে কিছু আছে না’কি? আমি এখানে এত কষ্ট করে তোমাকে খুঁজতে এসেছি। জানো কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে এসেছি? আম্মুর গরম গরম ইয়ামি ইয়ামি পরোটা না খেয়ে এসেছি। আর এমনি মেহমানদারি না করে পাঠিয়ে দিলে? ছি:! আমার গরম পরোটার অভিশাপ দিলাম তোমার বউ অনেক বাজে পরোটা বানাবে।” বলে সে ভেংচি কেটে তার জিনিসপত্র নিয়ে দৌড়ে ছুঁ মন্তর হয়ে গেল।

তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল তিসান। তার মেজাজ খারাপটা হাওয়া হয়ে গেল। সে উচ্চ স্বরে হেসে উঠল, “মেয়েটা আজলেই একটা জিনিস। ঠিক বলেছি না মুহিব?”
“ভাই মজা নিয়েন না।”
“শালা মজা নিব না? তোদের দিয়ে একটা কাজও তো হয় না। উল্টো কাজ বিগড়ে দিতে এগিয়ে থাকিস। গতকাল তোরা ডাক না দিলে আমি সে মোহিনীকে হারাতাম না, নামটাও জিজ্ঞেস করতে পারি নি। আর তোরা এখনো মেয়েটার খোঁজ করতে পারিস নি। জয় থাকলে এতক্ষণে…..” বলতে বলতে থেমে যায় তিসান। তার সামনে আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। সে বেঞ্চে শুয়ে একটি হাত মাথার নিচে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকায়, “সারারাত ঘুমুতে পারি নি আমি। ওই মেয়ের চেহেরাটা শুধু আমার চোখের সামনে ভাসছে।”
“ভাই এমন কী আছে ওই মেয়ের মধ্যে? আপনার জন্য মেয়ের অভাব আছে? দিনে নাহয় দশটা প্রেমের প্রস্তাব পান। একটা বাছাই করলেই তো হয়।”
“তুই বুঝবি না। এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে আমার দৃষ্টি আটকে গেছে। অন্য মেয়েদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। এই মেয়ের সৌন্দর্যে ডুবে গেছি। এই মেয়েকে আমি আরও দেখতে চাই। তাকে দেখে আমার মন ভরে নি।”
“ভাই আপনি দুই দেখায় প্রেমে পড়ে গেলেন না’কি?”
“সে কথা বাদ দে। শায়ানের সাথে কথা হয়েছে? কবে আসবে?”
“শায়ন ভাই তো বলল এই সাপ্তাহেই আসবো। ভাই বলসে এসেই সবাইকে পার্টি দিবো।”
“কী উপলক্ষে?”
“ওইটা তো শায়ান ভাই ই জানে।”
.
.
মহুয়া ক্লাসের বাহিরে কাওকে না দেখে ভাবে প্রফেসর এসে পড়েছে। তাই সে জলদি করে ঢুকে ক্লাসরুম। সে ঢুকতেই হঠাৎ করে সকলে মোড়া কাগজ তার উপর ছুঁড়তে থাকে। মহুয়া বুঝে উঠার আগেই যখন তার উপর কাগজের বর্ষণ হতে থাকে। সে পিছনে ফিরে দেখে জাহান একটি চেয়ারে পা’য়ের উপর পা তুলে বসে আছে। সে হাত উঠাতেই সবাই থেমে যায়। অবশ্যই এইটা জাহানের কান্ড। সে রেগেমেগে লাল হয়ে গেছে। সে মুখ ফুলিয়ে তাকায় জোহানের দিকে। একতো সে সকালে খেয়ে আসে নি, মানে এখন তার মাথা কাজ করবে না। এর উপর সকাল সকাল এত ঝামেলা।

জাহান পা নামিয়ে তার নীল শার্টের হাতাটা উপরে উঠাতে উঠাতে তার দিকে এগিয়ে আসলো। তারপর বলল, “তো মিস জেরিন মহুয়া আপনার পরাজয়ের সময় শুরুই হয়ে গেল। এখন আর আপনার বিজয়ী হবার চান্স নেই। এই খেলা তো তুমি শুরু করেছিলে। শেষটা আমার দ্বারাই হবে। আর শেষে পরাজিত হবে তুমি। তুমি তিন, আমি দুই। আর কেবল দুইবার।”
মহুয়া রাগে ফুলছিল। গাড়ি যেমন পেট্রোল ছাড়া অচল তার মস্তিষ্কও খাবার ছাড়া অচল। তার মাথায় কিছু আসছিল না বলে তার রাগ বাড়লো। সে মেঝেতে দেখতে পায় মুড়ানো কাগজগুলো কয়েকটা উঠিয়ে ছুঁড়ে মারতেই জাহান সাথে সাথে ঝুঁকে যায়। কাগজগুলো যেয়ে লাগে প্রফেসরের মাথায়।

মহুয়া চোখ বন্ধ করে তার মাথায় হাত রাখে। সাথে সাথে হুংকার গর্জে উঠে, “এই মেয়ে…এই ফাজিল মেয়ে কি করছ তুমি?”
মহুয়া আমতা-আমতা করে বলে, “স্যার আপনার উপর ভুলে যেয়ে লেগেছে। আমি তো জাহানকে মারতে চেয়েছিলাম।”
“হোয়াট? হোয়াই? ও তোমার সিনিয়র হয় ভুলে গেছো? কত্তো বড় বেয়াদব!”
তখনই জাহান সরল মুখে তাকায় স্যারের দিকে, “স্যার বলেন না মেয়েটা আমার পিছনে পড়ে আছে সে কবে থেকে লেগে আছে। বুঝতে পারছি না আমি ওর কি ক্ষতি করলাম।”

মহুয়া তো আকাশ থেকে পড়ে। যার মুখে সারাটাক্ষন এটাটিউড ঝরে, যার ভারী কন্ঠে মানুষের আত্নাও কেঁপে উঠে, সে এমন চিকন সুরে কথা বলছে? সে কি ঘুমে? নিজেকে একটা চিমটি কেটে নিজেই চিৎকার করে উঠে সে। তারপর হাতে ডলে বলে, “বেশি জোরে দিয়ে দিসি।”
সে দেখে প্রফেসর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জাহান আগুনে ঘি ঢেলে আরও বলে, “স্যার দেখেন এই কাগজগুলো ও ফেলে ময়লা করেছে। স্যার বলেন এখানে যারা কাজ করে তারা কি মানুষ না? তাদের কাজ বাড়ানো কী উচিত?”
প্রফেসর তার কথায় সায় দিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুমি কত ভালো জাহান। সবাই যদি তোমার মতো হতো…”
“স্যার বিশ্বাস করবেন না এই হনুমান চেঁকামেঁকা কথা। মুখের উপর মিথ্যা কথা বলে। ”
মোহও দাঁড়ায়। মহুয়ার পক্ষ নিয়ে বলে, “মহুয়া সত্যি বলছে স্যার। জাহানের কথায় সবাই কাগজ মুড়িয়ে….”
“চুপ একদম চুপ।” প্রফেসর বকা দেয় তাকে, “আমি কি জাহানকে আজ থেকে চিনি। আরও তিনবছর আগে থেকে চিনি। ওর মতো ভালো ছেলে হয় না।”
কথাটা শুনে মহুয়ার মাথা ঘুরিয়ে গেল। এত বড় মিথ্যা ধারণা কেউ কীভাবে রাখে?

জাহান ক্লাসের সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের কী আমি বলেছি কাগজ ছুঁড়তে?”
সবাই একত্রে “না” করে উঠে।
মহুয়ার মন চাইছিল জাহানের সাথে এই সকল মিথ্যাবাদীর মুখে এই কাগজ ভরে খাইতে দিতে।
প্রফেসর এবার মহুয়াকে বলে, “তোমার গার্জিয়ানকে আগামীকালই নিয়ে আসবা।”
“ঠিকাছে।”

তার এমন বেখেয়ালিপণা দেখে প্রফেসর বুঝল গার্জিয়ান আনলে কিছুই হবে না। তাই সে আরও রাগান্বিত স্বরে বলল, “না, দরকার নেই। তোমাকে এই শাস্তিতে হবে না। তুমি রবিবারের মধ্যে ফার্স্ট চাপ্টারের সব ম্যাথ তিনবার করে করে আসবে।”

“স্যার!” সে এত্তো জোরে প্রফেসরকে ডাক দিলো যে সে ঘাবড়ে কেঁপে উঠে। মহুয়া বলে, “আপনি এই জাহানের সাথে মিলে আমাকে মার্ডা*র করার প্লান করেছেন তাই না?”
“এই মেয়ে এসব কী বলছ তুমি?”
“ঠিকই তো বলছি। যে বই দেখলে আমার মাথা ঘুরায় সে বইয়ের ফার্স্ট চাপ্টারের সব ম্যাথ করব? তাও তিনবার? স্যার আপনি কী কোনো দাওয়াত পাচ্ছেন না? তাই আমার চল্লিশা খেতে ইচ্ছে করল আপনার?”

ক্লাসের সবাই হেসে দিলো এই কথায়। প্রফেসর এক বকায় সবাইকে থামিয়ে বলল, “সাট আপ। আর মিস মহুয়া আপনাকে যা বলেছি তা না করলে ব্যাপারটা আমি অফিসে জানাতে বাধ্য হব। তখন আপনাকে এই ভার্সিটি থেকে নিষ্কাশিত করা হলে আমাকে বলতে আসবেন না। আর আপনি আর আপনার বান্ধবী মিথ্যা বলার অপরাধে এই সব ময়লা পরিষ্কার করবেন। আমার ক্লাস শেষ হতে হতে যেন এসব পরিষ্কার হয়ে যায়।” বলে সে ভেতরে ঢুকে।
সে জাহানকে দেখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে। আঙুল দিয়ে তিন দেখিয়ে এক চোখ টিপ মেরে সে বেরিয়ে যায়। মনে মনে জাহানের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে মহুয়া। যেসব গালি শুনে তার বিরক্ত লাগে সেসব গালিও দেয়। এই অপমানের পরিণতি ভালো হবে না।

ক্লাস শেষে মোহ ও মহুয়া বসে। লজ্জায় মোহ আর থাকতে পাড়ছে না। সে মহুয়াকে নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। মহুয়া রেগেমেগে বলে, “তোর লজ্জা পাবার কী আছে? ওই মিথ্যুকগুলোর লজ্জা পাওয়া দরকার। শালা একেকটা মিথ্যুক!”
“ক্লাসে স্যার পড়ার সময় কীভাবে হাসছিলো দেখিস নি?”
“সবগুলো থেকে প্রতিশোধ নিব। ময়লা করসে ওরা আর
শাস্তি আমাদের? আর তুই আমাকে বলবি না যে ওই জাহানের বাচ্চা এসব প্লান করেছে।”
“কীভাবে বলব আমার ফোন নিয়ে রাখছে উঠতেও দেয় নি বেঞ্চ থেকে। তুই হুদাই ক্লাসে না এসে কোথায় গেলি? আর তোর কি দরকার ছিলো কাগজ ফিরে মারার?”
“আমি কী জানতাম না’কি ওইটা ওই কাওয়ার বাসায় না পইরা স্যারের চান্দিতে যাইয়া লাগব? ক্যান্টিনে চল। খিদায় আমার মাথা গরম হয়ে গেছে।”
“ঠিকাছে চল। এরপর বাসায় যাব। আমি আর ক্লাসে যাব না।”
“হো যাইয়া আবার ওই লেখা শুরু করতে হইব। ইতিমধ্যেই আমাকে পাবনায় ট্যান্সফার করতে হলে দেখতে আসিস।”
মোহ হেসে বলে, “তোর করা লাগবে না কিছু। আমি অর্ধেক করে দিব নে। আর মৃণাকে কল দিয়ে বললে ও আরও খুশি হয়ে করে দিবে।”
মহুয়া কথাটা শুনে একগাল হেসে তার গালে চুমু চায়, এজন্যই তো তোদের এত ভালোবাসি।”

তারা ক্যান্টিন থেকে খেয়ে মহুয়া মোহকে রিক্সাতে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও রিক্সা নেয়। উঠতে গেলেই জয় এলো তার কাছে, “কেমন আছো মহুয়া? নিজের ব্রাদারকে তো ভুলেই গেলে।”
“কচুর ব্রাদার তুমি? তোমার জাহান ভাই আমাকে সক্কাল সক্কাল যে বাঁশটা দিলো সে ব্যাপারে তো জানালে না।”
“আমি তো নিজেই জানতাম না। জাহান ভাই কিছু বলে নি। ভার্সিটি এসে জানতে পারি এসব কাহিনি।”
মহুয়া তার রাগ জলে ভাসিয়ে দেয়। সে বলে, “তাহলে কী চাই?”
“ক্যারামবোর্ড এনেছি। সবাই ওখানে। খেলবা? জাহান ভাই রবিবারের প্লানও বলেছে। ওটাও বলব নে।”
“তো তোমার জাহান ভাই জানলে তোমাদের জ্যান্ত রাখবে?”
“আরে জানবে না। তুমি না বললে জানবে কী করে? তুমি তো এখন আমাদের বোন তাই না? আসো।”
মহুয়ার তার কথা ঠিক বিশ্বাস হয় না। তবুও সে জানে তারা তার সাথে খারাপ কিছু অন্তত করবে না। ভর্তি হবার পর সে খোঁজ নিয়েছিল এক বড় আপুর কাছ থেকে। জাহানের আসার পর এই ক্যাম্পাসে ইভটিজিং হওয়ার ঘটনা প্রায় শুন্যই হয়ে গেছে। একবার দুই ছেলে তার ক্লাসমেটকে বাজেভাবে স্পর্শ করছিল জাহান মুহূর্ত না ব্যয় করে সে ছেলে দু’টোকে ক্যাম্পাসের মাঝে এনে মারধর শুরু করে। লোকটা যতই ফাজিল হোক এদিক থেকে ভালো আছে। তাইতো সে নির্ভয়ে তাদের সাথে যেতে পাড়ছে। তাও সে নিজের ব্যাগে দেখে নেয় আত্নরক্ষার জিনিসপত্র আছে না’কি?

সে দেখতে দেখতে জয় হলরুমের দরজা খুলে দেয়। মহুয়াও ঢুকে পড়ে। ভেতরে কাওকে না দেখে সে বলে, “ব্রাদার এখানে তো কেউ…”
হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দে সে পিছনে ঘুরে। দরজা বন্ধ দেখে সে আতকে উঠে। সে নিজের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে যেয়ে দরজা ধাপড়ায়, “ব্রাদার এটা মজার বিষয় না। দরজা খুলো।”
তখনই জাহানের কন্ঠ শুনতে পায় সে, “এই’যে মিস মহুয়া, আপনার কি মনে হয় ইয়াজভান জাহান এত সহজে পরাজিত হয়ে যাবে? তাও পিচ্চি একটা মেয়ের কাছে? নো ওয়ে। তুমি তিন, আমি তিন। এইবার আমার বিজয়ের পালা। জাহান কোনো খেলাই হারে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি হার স্বীকার করছ এখানেই থাকো।”
মহুয়াও বড় গলা করে বলে, “তোমার কী মনে হয় আমার তোর কাছে আকুতি করা লাগবে? জ্বি না। আমার ফোন আছে না? আমি এখুনি…. ”
“এই রুমে নেটওয়ার্ক নেই বুদ্ধিমতী কন্যা। তুমি আমাকে অনুরোধ না করা পর্যন্ত বের হতে পাড়বে না।”

মহুয়া তার ফোন দেখলো আসলে কোনো নেটওয়ার্ক আসছে না। সে আশেপাশে তাকাল এই হল রুমটা বিশাল বড়। দোতলা জুড়ে। তাই সব জানালা অনেক উপরে৷ তার নাগালের বাহিরে। তবুও সে হার মানবে না। তার জেদ সবার উপরে। হার মানবে সে? তাও এই হনুমান থেকে? এই কাওয়ার বাসা বাঁধানো লোক থেকে? এই ফাজিল থেকে? অসম্ভব। সে উঁচু স্বরে বলল, “আমার এখানে কিছু হলে তোমার ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে বসবো তাও তোমার থেকে অনুরোধ করবো না। হনুমান একটা। মনে রেখো আমি বের হলে তোমার সিগারেট দিয়ে তোমার কাওয়ার বাসার মতো চুলগুলো জ্বলিয়ে দিব। ফালতু একটা।” বলে সে বসে পড়ে। তার মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই তো কি হয়েছে? সে এই সুযোগে তার ডাউনলোড থাকা মুভিগুলো দেখে শেষ করবে।

জাহানের মহুয়ার এই বেখেয়ালিপণা দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে দুইজনের দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলে, “যতক্ষণ না পর্যন্ত এই মেয়ে আকুতি বিনুতি করবে ততক্ষণ ভুলেও দরজা খুলবি না। আজ ওকে একটা উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। আর কোথাও যাবি না। তোদেরও বলে দিচ্ছি, ভুলেও ভেতরে যাবি না। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাবি।” বলে সে রাগে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। তার পিছনে যায় অন্যসবাই।

দিন ঘড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। নীলচে আকাশ কালো আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। সাথে আঁধার নেমে আসে সে বিশাল কক্ষে। মহুয়ার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে আসায় তার সেদিকে ধ্যান যায় সবে। তখনও মৃদু আলো আসছিল জানালা দিয়ে। মহুয়া উঠে লাইটের সুইচ খোঁজার চেষ্টা করে। সে লাইটের সুইচ পাচ্ছিল না। আলো বিলীন হতে থাকে। আঁধার আরও ঘাড় হয়। এই মুহূর্তে তার বুকের ভেতরটা ধকপক করতে থাকে। সে মাথা ঘুরাতে শুরু করে। তার চোখের সামনে ভাসতে শুরু করে কিছু ঝাপসা দৃশ্য। যা মনে করতেই তার নিশ্বাস আটকে আসে। মুহূর্তে সে নিশ্বাস ঘন হয়ে থাকে। তার হৃদপিণ্ডটা ভারী হয়ে যায়। সে এত হিমশীতল আবহাওয়াতেও ঘামতে শুরু করে। সে দৌড়ে যেয়ে দরজায় ধাক্কাতে শুরু করে, “জাহান…জাহান প্লিজ আমাকে এখান থেকে বের করো। আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না প্লিজ বের করো এখান থেকে। আমার অনেক খারাপ লাগছে। ভয় করছে। আমি অনুরোধ করছি প্লিজ খুলে দেও।”
বাহির থেকে কোনো উওর আসে না। কোনো শব্দ নেই। সে আরও জোরে ধাক্কাতে শুরু করে। অনুরোধ করে। কত আকুতি করে। কোনো উওর আসে না। জাহান কী এতটা হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষ? তার এত আকুতি তার কানে যাচ্ছে না?

তার চোখের সামনে ভেসে উঠা ঝাপসা দৃশ্যগুলো স্পষ্ট হতে থাকলো তার কাছে। সে দেখল একটি ছোট মেয়ে দৌড়াচ্ছে। তার পরনে কালচে গোলাপি রঙের বারবি গাউন। তার পিছনে দৌড়াচ্ছে চারটি পুরুষ। মেয়েটির পা থেকে র*ক্ত বের হচ্ছে। মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে র*ক্তের ধারা। হাত, পা ছিঁলে গেছে। সব মনে পড়তেই আতঙ্কে মহুয়া বসে দুইহাত কানে রেখে চিৎকার করে উঠে।

চলবে…

#মেঘের_খামে
পর্ব ৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মোহ আজ জলদি বাসায় আসায় একটি বই নিয়ে বসলো। গল্পের বই পড়া তার পছন্দের কাজের মধ্যে একটি। আজ সে একটি ইংরেজি বই নিয়ে বসেছে। বইটি তার কাছে খুব মজার লাগছিল। তাই সে উঠলো না বিছানা থেকে। এরমধ্যে মা খাবার রেখে গিয়েছিলো। তাও খায় নি। কাপড়ও পালটায় নি বাসায় এসে। তার সব ধ্যান বই’য়ে। তার সে গভীর ধ্যান ভাঙে ফোনের শব্দে।

মোহ দেখে মহুয়ার মা কল দিয়েছে, “আসসালামু আলাইকুম মিষ্টু আন্টি, কেমন আছো?”
“আমি তো ভালো আছি মামণি। কিন্তু চিন্তায় আছি। তোমার বান্ধবী কোথায় বলোতো। কল ধরছে না। ফোনও বন্ধ। তোমরা তো তিনটা চারটার মধ্যে বাসায় এসে পড়ো। আর দেরি হলেও তো জানাও।”
“মহু বাসায় যায় নি?”
“ও তোমার সাথে নেই?” তার চিন্তিত কন্ঠ শুনে মোহেরও চিন্তা হতে শুরু করে। সে ঘাবড়ে তার বই পাশে রেখে। ওড়না নিতে নিতে বলে, “সম্ভবত মৃণার সাথে আন্টি। আমি দেখছি। চিন্তা করবেন না।”
মোহ ফোন রেখে দ্রুত তার বোনের রুমে যায়। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এই সময় তার মা তাকে একা বের হতে দিবে না। তাই মিতাকে জোর করে বের করে রুম থেকে।

অন্যদিকে মহুয়াকে ফোন দিতেই থাকে। ফোন বন্ধ। মৃণাকে কল করে জানতে পারে মহুয়ার সাথে তার কথাই হয় নি। তার এখন ভয় হতে থাকে। তারই দোষ, মহুয়া রিক্সা উঠার পর তার আসা উচিত ছিলো। এমনিতেই ভার্সিটিতে আজকাল তার সাথে কম কাহিনি হয় না। সে মস্তিষ্ক খাটিয়ে অনুমান করে মহুয়া ভার্সিটিতে থাকতে পাড়ে। সেখানে না পেলে সে মুরাদকে সব জানাবে। তারপর তার সাথে যেয়ে খুঁজবে। প্রয়োজনে পুলিশের কাছে যাবে।

সে তার বোন মিতাকে নিয়ে বের হতেই দেখে ড্রইংরুমে তার মা’য়ের সাথে আরিশ ভাই বসা। তারা কথা বলছে। তাদের দেখতেই সে তার দৃষ্টি মোহের দিকেই আটকে রাখল। আরিশ তাদের আত্নীয়। তার বড় খালুর ভাইয়ের ছেলে। তাকে আরও আগের থেকে পছন্দ করে। বিগত চার বছরে প্রতি মাসে দু’বার করে আসবে তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তার বাবার সাথে বসবে। তার বাবার আরিশকে পছন্দ কিন্তু বয়সের ব্যবধানের জন্য এগোতে পাড়ে না। এছাড়া বড় মেয়েকে রেখে কীভাবে বিয়ে দিবে ছোট মেয়েকে?

তাকে দেখে মিতা ও মোহ দু’জনেই সালাম দেয়। তারপর মোহ তার মা’কে বলে, “মা আমি আপুর সাথে একটু বাহিরে যাচ্ছি।”
“এত সন্ধ্যায়? কোথায়?”
“ভার্সিটিতে একটু কাজ আছে। একটা ফাইল নিতে হতো। ভুলে এসেছি। রবিবারই জমা দেওয়া লাগবে। এখনই যাওয়া প্রয়োজন। আপুকে নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করো না।”
“মহু বা মৃণা থেকে নিয়ে নিস।”
“মৃণা তো ক’দিন ক্লাসে আসে না। আমার আর মহুর দু’জনেরই নেওয়া লাগবে। আমরা তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি বলে পাই নি।”
“এখন গেলে পাবি?”
“পাব।”
“আচ্ছা তাহলে যা। তাড়াতাড়ি আসিস।”
আরিশ সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ায়, “আমি গাড়ি এনেছি। তোমাদের সাথে যাব?”
“প্রয়োজন নেই। আপনার কষ্ট হবে। আমরা রিক্সা দিয়ে যেয়ে আসতে পাড়ব।”
“আংকেল আসতে তো সময় আছে। তোমাদের কাজ সেরে আস্তে পাড়ব।”
মোহের মা’ও তাকে সায় দিলে, “হ্যাঁ এটা ভালো হবে। আমারও চিন্তা হবে না।”
মোহ আর কথা বাড়াল না। একতো মিথ্যা বলে তার খারাপ লাগছে। এর উপর আর মিথ্যা বলা উচিত হবে না।

আরিশ খুব করে চাইছিল মোহ গাড়িতে তার পাশে বসুক কিছু সে বসল পিছনে। পরে মিতা তার পাশে বসে। তবে আরিশ এইটুকু পাওয়া সময়ও তো অপচয় করতে চায় না। সে বারবার লুকিং গ্লাসে তাকায়। তার পিছনে বসা তার প্রিয় অপরূপা সুন্দরীর দর্শন যে তার সহজে হয় না। বারবার তাকানোর পর একসময় মোহও লুকিং গ্লাসে তার দিকে তাকায়। সাথে সাথেই যেন আরিশের হৃদ স্পন্দন থেমে যায়।

মোহ আমতা-আমতা করে বলে, “ভাইয়া আসলে আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো।”
আরিশ বলে, “যা বলার বলো তাও ভাইয়া বলো না প্লিজ।”
মিতা মুখ টিপে হাসে, “নাহলে তো আংকেল বলতে হবে।”
আরিশ চোখ ছোট করে তাকায় মিতার দিকে। সাথে সাথে মিতা বলে, “মানে আপনি তো ওর থেকে প্রায় দশ বছরের বড়। ভাইয়া ডাকাই উচিত, সম্মানের জন্য আরকি।”

মোহ তাদের একথার তোয়াক্কা না করে বলে, “আসলে ভার্সিটিতে আমি ফাইল আনতে যাচ্ছি না। আমার বেস্টফ্রেন্ড বাসায় যাই নি। আর ভার্সিটির একজনের সঙ্গে ওর একটু ঝামেলা চলছে। তাই আমার মনে হয় কিছু একটা হয়েছে। যদিও আমি এতদিন এসব মজা ভেবেছি কিন্তু… বুঝতে পাড়ছি না।”
আরিশ তার চিন্তিত মুখ দেখে নিজেও বিচলিত হয়ে পড়ে, “ডোন্ট ওয়ারি কিছু হবে না। ইনশাআল্লাহ যেয়ে ওকে পেয়ে যাব। আর যে ঝামেলা করছে তার তথ্য দিও তার ব্যবস্থা আমি করব। তোমাদের ভার্সিটির একটা টিচার আমার পরিচিত।”
“করতে পাড়বেন না। তার পরিবার অনেক পাওয়ারফুল।”
“যতই পাওয়ারফুল হোক, আমি তাকে দেখে নিব।”
“ইভান এয়ারলাইনের মালিকের একমাত্র ছেলে ইয়াজভান জাহান।”
কথাটা শুনতেই আরিশ ব্রেক কষে। বিস্ময় নিয়ে তাকায় মোহের দিকে। মোহকে ইম্প্রেস করার চক্করে না বুঝে কী বলে ফেললে! সে আমতা-আমতা করে বলে, “ভার্সিটির পড়ুয়া ছেলে তো। বয়সে তো ছোটই, হয়তো মজাই করছিল!”
মোহ তার এই চিন্তিত ভাবভঙ্গি দেখে হেসে দেয়, “গাড়ি চালান আরিশ ভাইয়া, আপনাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

মোহ ভার্সিটির সামনে আসতেই সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞেস করে, “ভার্সিটিতে কি এখনো কেউ আছে?”
“জাহান বাবারা আছে। ওরা আটটা নয়টায় যায়।”
“কোথায় আছে জানেন? উনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“সব ক্লাসের দরজা তো বন্ধ করে দিলাম। ক্যান্টিনেই তাছে তাহলে। ”
মোহ দৌড়ে যায় সেদিকে। মিতা আর আরিশও যায় তার পিছনে।

মোহ ক্যান্টিনে তাদের পায়। জাহান তার বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। সে একটি টিবিলের উপর বসে চেয়ারে পা রেখে সিগারেট খাচ্ছিল। তার সাথে অনেকেই। সারা ক্যান্টিন যেন সিগারেটের গন্ধে ম ম করতে থাকল। মোহের বমি এসে পড়ল। তবুও নিজেকে সামলে সে জাহানের কাছে যায়।
“ভাইয়া মহু কোথায় আছে জানেন? প্লিজ সত্যি বলেন।”
জাহান তার দিকে তাকায়। তার এমন চিন্তিত অবস্থা দেখে খানিকটা বিরক্তির সুরে উওর দেয়, “তোমার বান্ধবী চিলে আছে তোমার এত চিন্তা করার দরকার নেই।”
“মানে আপনি জানেন ও কোথায়? প্লিজ ভাইয়া বলেন।”
“বললাম তো ও নিজে মজায় আছে। তোমার চিন্তার প্রয়োজন নেই। তার তো নিজেরই চিন্তা নেই। শুধু বলেছিলাম আমার থেকে অনুরোধ করলে ছেড়ে দিব। কিন্তু না, সে হারবেই না। রুমে বন্ধ করে রেখেছি কিন্তু সে উলটো মোবাইলে মুভি দেখছে। গান শুনছে। তাও হার মানবে না। তোমার বান্ধবী নিজের এতটুকু শরীরে এত জেদ রাখে কীভাবে?”
“কী বলছেন আপনি? আপনি ওকে রুমে বন্ধ করেছেন?” মোহের এমন চিন্তিত অবস্থা দেখে কপাল কুঁচকে নেয় জাহান, “ওভার রিয়্যাক্ট করো না তো। তোমার বান্ধবীর এতটুকু সময়ে কিছু হবে না।”
“আপনি কীভাবে জানেন কিছু হবে না?”
“বাহিরে লোক বসিয়ে এসেছি। বলেছি ওর খেয়াল রাখতে। কোনো সমস্যা হলে বললেই খুলে দিতাম। তোমার বান্ধবীর কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলেই তো….”
মোহ তার কথা কেটে উঁচু স্বরে বলে, “আপনি কী জানেন ওর ব্যাপারে? নিজের রুম বাদে অন্য কোথাও বন্ধ রুমে, একা, অন্ধকারে ওর প্যানিক এট্যাক আসে। ভার্সিটিতে শুধু এই ক্যান্টিনের লাইট জ্বালানো। মানে বাকি সব লাইট অফফ। অন্ধকার ওকে ছোটবেলার দুর্ঘটনার কথা বারবার মনে করায়। ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ওর শরীর কাঁপে, অজ্ঞানও হয়ে যায়। আমি আপনার সামনে হাত জোড় করছি প্লিজ এখন এসব ফালতু খেলাটা বন্ধ করুন। এতদিন মজার ছলে ছিলো কিছু বলিনি। এখন এসব অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে….”
তার কথা শেষ হবার আগেই জাহান তার সিগারেট ফেলে দৌড়ে যায় একদিকে। মোহসহ সবাই তার পিছনে যায়। জাহান যেয়ে দেখে মিন্টু ও রনি যাদের সে এখানে রেখে গিয়েছিল কেউ নেই।
“শীট” বলে সে দ্রুত পকেটে চাবি খুঁজতে থাকে। তালা খোলার সময় মোহও এসে পড়ে।
“মহু এই রুমে?” মোহ প্রশ্ন করে।
জাহান অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।
মোহ দরজা ধাক্কায়, “মহু…মহু তুই ঠিক আছিস? ঠিক আছিস তুই?”

মহুয়া সে বিশাল রুমের এক কোণে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসেছিল। থরথরে কাঁপছিল সে। তার নিশ্বাস আটকে আসছিল। অতীতের স্মৃতিগুলো তাকে ভীষণভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ তার আত্না দেহ থেকে টেনে নিচ্ছে। ভয়ে সে হাত পা গুটিয়ে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ মোহের কন্ঠ শুনে যেন তার আটকে থাকে নিশ্বাস ফিরে আসে। সে মুখ তুলে আশার ভঙ্গিতে দরজার দিকে তাকায়। উঠে দাঁড়াতেই পড়ে যায়। তাও পাশের এক চেয়ার ধরে উঠে দাঁড়ায়। সে আরেকটু এগোতেই স্পষ্ট মোহের কন্ঠ শুনে। মুহূর্তে যেন তার দেহে সকল শক্তি ফেরত পায়। এক দৌড় দেয় দরজার দিকে। কাছে আসতেই দরজাটা খুলে যায়। অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তি দেখতেই ঝাপিয়ে ঝাপটে ধরে সে। অবশ্য তার বুঝতে মুহূর্তখানিকও লাগে না যে ছায়ামূর্তিটা মোহ না। সে হতভম্বের মতো তাকে ছেড়ে উপরে তাকাতেই বাহিরের লাইট জ্বলে উঠে। সে দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়ানো অপ্রিয় ব্যক্তিটি। ইয়াজভান জাহান। তাকে দেখতেই তার ভেতরের রাগ উপচে পড়ে। মাথায় রক্ত উঠে যায়। খানিকক্ষণ আগের তার কষ্ট, আতঙ্কের কথা মনে পড়ে এক দুই না ভেবে সে সজোরে এক চড় মেরে বসে জাহানের গালে।

সে দেখল জাহানের চোখ দুটো খানিকটা বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সে চোখে ক্রোধ দেখতে পায় না সে। তার কিছু সঙ্গী তার দিকে এগিয়ে কিছু বলতে নিলেই জাহান হাতের উঠিয়ে ইশারায় তাদের থামায়। কিন্তু তার চোখ নড়ে না মহুয়া থেকে।

মহুয়াও রাগে, ক্ষোভে তার দিকে তাকিয়েই থাকে। তার ঠোঁট, চোখের পাঁপড়ি, হাত পা সব কাঁপছে। রাগে। তার ইচ্ছা করছে জাহানকে এই মুহূর্তে একটা উচিত শিক্ষা দিতে। কিন্তু সে আর শক্তি পাচ্ছে না। এমন সময় মোহ যখন এসে তার হাত ধরে তখন তার দৃষ্টি সরে জাহান থেকে। সে বলে, “তোর ব্যাগ নিয়েছি। এখন বাসায় চল।”
মহুয়া কিছু বলে না। কেবল মাথা নাড়ায়। তারপর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় জাহানের দিকে। যেন দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম করে দিবে। কিছু না বলেই মোহের হাত ধরে সেখান থেকে চলে যায়।

গাড়িতেও কেউ তেমন কিছু বলে না। মহুয়া এখনো মোহকে ধরে আছে। আর মোহ তাকে শান্ত করতে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। ইতিমধ্যে সে মহুয়ার মা’কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আজ মহুয়া তার বাসায় থাকবে। এমন অবস্থা সে মহুয়াকে একা তো আর ছাড়তে পারে না। যখন সে মহুয়াকে শান্ত করতে ব্যস্ত কোথা থেকে হঠাৎ করে মোহের বোন মিতা বলে উঠে, “যাই বলিস না কেন জাহান ছেলেটা কিন্তু দেখতে ভয়ানক হ্যান্ডসাম। উফফ কি লাগছিল। একদম সিনেমার নায়কদের মতো। তাদের থেকেও সুন্দর। কিন্তু আফসোস আমার থেকে ছোট হবে তাই না মোহ?”
তার এই কথা শুনে গাড়িতে থাকা তিনজোড়া চোখ তার দিকে আটকে যায়। তিনজোড়া চোখেই বিরক্তি। সে সাথে সাথে আমতা-আমতা করে বলে, “সরি…সরি… তোমাদের কান্নাকাটি কন্টিনিউ করো।”
.
.
শুক্রবার মৃণা সব ঘটনা জেনে যায় মহুয়ার বাসায়। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সে। বাসায় যেয়ে মহুয়াকে স্বাভাবিক দেখে তার জান আসে। সে বিদায় নিয়ে যেতে নিলে মহুয়ার মা ডাক দেয় তাকে।
“কী’রে কোথায় যাচ্ছিস?” মহুয়ার মা তাকে আটকালেন।
“আন্টি চলে যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“এলি তো একঘন্টাও হলো না। কোথাও যাবি না তুই। তোকে দেখে চিংড়ি নামিয়েছি। তোর পছন্দের মালাই চিংড়ি করব।”
“আল্লাহ আন্টি কেন কষ্ট করতে গেলে? এই আমরা আসলেই তুমি রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পরো বলে আসতে ইচ্ছা করে না। তোমার কত কষ্ট হয়।”
“ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করলে কষ্ট হয় না’কি আবার? তোদের জন্য রান্না করলে আমার ভালো লাগে।”
মৃণা মিষ্টি হাসে, “আমি আবার আসবো আন্টি। আজ যাই। সত্যি কোথাও যেতে হবে।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। জলদি আসবি কিন্তু।”

দরজা থেকে বের হয়ে জুতো পরতে পরতে এগোতেই তার সাথে কারো ধাক্কা লাগে বেখেয়ালিপণায়। সাথে সাথে সে পিছিয়ে যায়। মাথা তুলে দেখে মুরাদকে। মুরাদ পাঞ্জাবি পরে আছে। বোধহয় জুম্মার নামাজে গিয়েছিল। সে খেয়াল করে আজ কাকতালীয়ভাবে তাদের পোশাকের রঙ মিলে গেছে। মুরাদের সাথে দেখা হওয়ার ভয়েই জলদি যেতে চাচ্ছিল সে। কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয়, ওখানে সন্ধ্যা হয়। তার ভাগ্যটাই খারাপ। নাহলে বের হবার আগ মুহূর্তে এই লোকের মুখামুখি হওয়া লাগে? এই মানুষটাকে তার ভীষণ ভয় করে। অকারণেই বকে তাকে। সে মুরাদের তাকিয়ে থাকা দেখে বকা খাওয়ার আগেই বলে,
“সরি ভা…” বলতে বলতে সে থেমে যায়। তারপর এক ঢোক গিলে বলে, “সরি না দেখে হাঁটছিলাম। আসি।”
বলে যেতে নিলেই ডাক পায় সে,
“এই ময়ণা শুন…”
মৃণা ফিরে তাকায়, “ময়না না-তো মৃণা ভাইয়া…না না ভাইয়া না…সরি ভাইয়া…সরি ভাইয়া না…” এমন আজগুবি কথাবার্তা বলে নিজেই ঠোঁটে কামড় দেয়।

মুরাদ হেসে উঠে, “তোর এই কঠিন নাম আমার মুখে আসে না বাপু। তোকে যা ডাকি তাই ডাকব। বুঝেছিস?”
মৃণা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে। কিন্তু তার মুরাদের ময়না ডাকটা পছন্দের না। ময়না তাকে তার মা ডাকতো। এই ব্যাপারটা মুরাদ জানে না। চারবছর পূর্বে থেকে আচমকায় মুরাদ তাকে ময়না ডাকতে শুরু করে। মৃণা ডাকতে না’কি তার কষ্ট হয়। যে লোক এত কৌশলে এনিয়ে বিনিয়ে নিজের তৈরি করা ছোট ব্যবসাটা এত বড় করেছে তার একটা নাম ডাকতে কষ্ট হয়? তবে সে নিজেই মাঝেমধ্যে তাকে মৃণা বলেই ডাকে। আবার হঠাৎ মৃণা থেকে সে ময়না হয়ে যায়। তবুও সে মুরাদকে কিছু বলে না। কারণ সে মহুয়ার ভাই। আর এই পরিবারের সকলে তাকে ভীষণ আদর করে। কেবল মুরাদ ছাড়া, সে শুধু বকে।

“কী হলো? কানে কি কথা যায় না?” এই আবারও তার বকা খেল মৃণা। সে চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। মুরাদ বলে, “এই দিন দুপুরে এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?”
“একটু বাহিরে যাচ্ছি।”
“খেয়ে যাবি আয়।”
“না, আসলে দেরি হয়ে আছে। সে অপেক্ষা করছে।”
কথাটা শুনে মুরাদের মুখে কালো মেঘ নেমে আসে। সে কপাল কুঁচকে তাকায় মৃণার দিকে, “কে? তোর এক্স-বয়ফ্রেন্ড? তার নতুন গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে তোর সাথে দেখা করার কারণ কী?”
মৃণা উওর দেয় না। মাথা নিচু করে নেয়।
মুরাদ আফসোসের সুরে বলে, “যা, আমার কি?” বলে সে যেতে নিয়ে আবার ফিরে তাকায়, বলে, “তবে একটা কথা শুন মৃণা, কাওকে ভালোবাসা খারাপ কিছু না। কিন্তু সে ভালোবাসার বিনিময়ে নিজের আত্নসম্মান বিসর্জন দিতে হলে সে ভালোবাসা মূল্যহীন হয়। অন্তত একটু আত্নসম্মান রাখ। নিজের কাছে নিজেকে এতটাও ছোট করিস না।” বলে সে ভেতরে চলে যায়। আর একবার ফিরেও তাকায় না।

এদিকে তার কটুবাক্যতে যে মৃণা থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে তা আর খেয়ালও করে না। মৃণার ধ্যান ভাঙে তার ফোনের শব্দে। সে দেখে তন্ময় কল দিয়েছে। সে ফোনটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিসিভ করে,
“হ্যালো….”
“আমি বের হয়েছি। তুমি দ্রুত আসো।”
মৃণার গলা ধরে আসছিল। সে বেশ করে বলতে চাইল, “আমি আসব না। তোমার এক্স-গার্লফ্রেন্ডের সাথে কীসের দেখা? তোমার বর্তমান গার্লফ্রেন্ড কি তা জানে? আমি আর নিজের আত্নসম্মান বিসর্জন দিতে পাড়ব না।”
কিন্তু সে কথাগুলো বলতে পাড়ে না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আসছি।”
সে বেরিয়ে যায়। মুরাদ ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল। তাকে যেতে দেখে তার বুক চিরে বের হওয়া আফসোসের দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল বাতাসে।

মৃণা রিক্সায় উঠে টিস্যু দিয়ে তার লিপ্সটিক আর কাজল মুছে ফেলে। কপালে পরা টিপ খুলে রাখে। মহুয়ার বাসা থেকে কাছেই রেস্টুরেন্টটি। তার যেতে দশ মিনিটও লাগে না। সে দেখে তন্ময় বসে আছে। তাকে দেখে দাঁড়িয়েছে।
“কেমন আছো?”
“ভালো।” উদাসীনভাবে উওর দেয় মৃণা। যা তন্ময়ের ভালো লাগে না। মৃণা তার সাথে কথা বলার সময় কখনো উদাসীনতা নিয়ে কথা বলে না। আজ কী হলো? হঠাৎ তার বুকের ভেতর সুক্ষ্ম ব্যাথা উঠল। তবুও সে হেসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, “খাবার অর্ডার দেই?”
“তোমার জন্য দেও। আমি মহুয়ার বাসা থেকে এসেছি তো। খেয়ে এসেছি। পানি খাব শুধু।”

তন্ময় কথা বাড়ায় না। মৃণা প্রায়ই এমন করে। তার ধারণা মৃণার বাহিরের এধরণের খাবার পছন্দ না। কিন্তু তারও কিছু করার নেই। আজকাল মানুষ তাকে চিনছে। যদি মৃণাকে তার সাথে কেউ দেখে নেয় তাহলে নানান খবর বের হবে। সে খাবার অর্ডার দিয়ে বলে,
“কেমন আছো?”
আবারও একই প্রশ্ন শুনে মৃণা তার দিকে চাইল। আবারও ছোট করে উওর দিলো, “ভালো।”
“তোমার মন খারাপ মৃণা? কিছু হয়েছে?”
“এমনি ভালো লাগছে না।”
“কেন? শরীর খারাপ? ডাক্তারের কাছে যাবে?” চিন্তিত ভাব আছে তার সুরে।
“না। শরীর ভালো আছে। তোমার খবর বলো কাজ কেমন চলছে?”
“ভালোই। এইততো একটা নতুন এলবাম রেকর্ড করবো।”
“গুড।”

এবার তন্ময় আসলেই আতঙ্কিত হয়। পূর্বে তার এলব্যামের কথা শুনতেই মৃণা উৎসুক হয়ে যেত। খুশিতে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতো। সে সবার আগে এলবামে গান শোনার বায়না ধরতো। আর আজ তাকে এত অন্যরকম লাগছে কেন।
“তুমি সত্যিই ঠিক আছো মৃণা?” তন্ময়ের প্রশ্নের উওর না দিয়ে মৃণা তাকে পালটা প্রশ্ন করে, “আমরা যে দেখা করছি বুশরা আপু কি জানে?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে চমকে উঠে তন্ময়। সে আমতা-আমতা করে বলে, “এখানের জানানোর কি আছে? আমি কার সাথে দেখা করলাম, না করলাম, ও এসবে এত মাথা ঘামায় না।”
“ওহ, তো আপু এখন দেশে এসে কি কাজ করছে?”
“তুমি বারবার ওর কথা জিজ্ঞেস করছ কেন মৃণা?”

কেন যেন মৃণার অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। সে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, “আমার ভালো লাগছে না। আমি আজকের মতো চলে যাই।”
সে যেতে নিলে তন্ময় তার হাত ধরে নেয়।
“তোমার হঠাৎ কি হলো মৃণা। গতকাল রাতেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলে।”
“আমার মনে হয় আমাদের প্রয়োজন ছাড়া দেখা করা উচিত হবে না। তুমি বুশরা আপুর সাথে সম্পর্কে আছো। সে ব্যাপারটা জানলে কষ্ট পাবে।”
“ওর চিন্তা আমি করব। তোমার না করলেও হবে। তুমি যাস্ট আমার সাথে স্বাভাবিক থাকো।”
“তুমিই বলেছিলে না বুশরা আপু আমাদের দেখলে ভুল বুঝবে। ঠিক বলেছিলে। আমি কারো সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে চাই না। আমার মনে হচ্ছে তোমার সাথে দেখা করে আমি কেবল বুশরা আপুর সাথেই না, নিজের সম্মানের সাথেও বেঈমানী করছি। আই থিংক আমাদের এত দেখা বা ফোনে কথা বলা উ….” উচিত না বলার পূর্বেই তন্ময় বলে উঠে, “তুমি কি আমাকে শাস্তি দিতে চাচ্ছো? তুমি জানো তোমার সাথে কথা না বললে বা তোমাকে না দেখলে আমার অস্থির লাগে। তোমার কন্ঠ না শুনলে ঘুম হয় না। ঔষধ খেতে হয় ঘুমের। তুমি কি আমাকে শাস্তি দিতে চাও তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য?”
মৃণা ডানেবামে মাথা নাড়া।

তন্ময় তার হাত ধরে রেখেই চেয়ারে বসায়। তার সামনে বসে বলে, “তুমিও আমাকে ছাড়া থাকতে পাড়বে না। তা তুমি জানো মৃণা। তাহলে এমন কথা কেন বলছ?”
মৃণা কোনো উওর দেয় না। সে জানে তন্ময় ঠিক বলছে। কিন্তু তার এসব আর ভালো লাগছে না। তার তন্ময়কে বলতে ইচ্ছা করছে হয়তো তাকে কাছে টেনে রাখুক নাহলে দূরে সরিয়ে দিক। এভাবে মাঝখানে ঝুলে থাকতে সে চায় না। তার কষ্ট হয়। কিন্তু সে বলে না। প্রতিবার তন্ময়ের সাথে কথা বলার পর তার কান্না পায়, আশ্চর্যজনকভাবে আজ তার কান্না পাচ্ছে না।
.
.
রবিবার তিন বান্ধবীই ভার্সিটিতে আসে। গেইট থেকে ক্লাসে একসাথে এসে বসতে মহুয়া খেয়াল করল সবাই তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। সে মোহ ও মৃণাকে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আমি কি রূপ বদলে এলিয়েন হয়ে গেছি?”
“কী আবল-তাবল বকছিস?” মোহ বলে।
“তাইলে সবাই এভাবে তাকিয়ে কথা বলছে কেন?”
“এতে নতুন কী? ভার্সিটিতে আসার শুরু থেকেই তো এমন হচ্ছে। এতদিনে অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা।”
“হ্যাঁ, ওই চেঁকামেঁকার কৃপায়। ”
“তুই ওদিন যেভাবে থাপ্পড় দিয়েছিলি আল্লাহ জানে এখন সে কি করে।”
“শুধু থাপ্পড়? তাকে পেলে আমি মেরে মুড়ে ভর্তা বানায় দিব।”

এমন সময় জুঁই নামক একটি ক্লাসমেট মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়, “বৃহস্পতিবারটা কেমন কাটল তোমার?”
“মানে?” মহুয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“মানে বুঝো না? এতটা বোকাও তুমি না। শুনলাম বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ভার্সিটিতে তুমি ছিলে। কি করেছ, না করেছ কে জানে? সাথে কয়টা ছেলে ছিলো?”

শেষ কথাটা শুনতেই মানে বুঝে নেয় মহুয়া। তার মাথায় রক্ত উঠে যায় কথাটা শুনে। সে উঠেই মেয়েটাকে কষিয়ে মারতে যাবে আর মেয়েটা হাত ধরে নেয়। তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “কাহিনি ঘটাতে লজ্জা নেই, শুনতে লজ্জা হচ্ছে?”
মহু তার পা’য়ে জোরে লাথি মা*রতেই সে ব্যাথায় তার হাত ছেড়ে দেয়, বুঝে উঠার আগেই মহুয়া মেয়েটার চুল ধরে জিজ্ঞেস করে, “এসব গুজব কে ছড়িয়েছে বল। জীবনের রক্ষা চাইলে তাৎক্ষণিক বল।”

মেয়েটা ব্যাথায় আঁতকে উঠে। তবুও মহুয়া তাকে ছাড়ে না। সে উল্টো একটা কষিয়ে থাপ্পড় মারে। মেয়েটা ব্যাথায় মিনিমিনিয়ে বলে, “সবাই জানে একথা। আমি কেবল একা না।”

মহুয়া বুঝতে পারে এই মেয়েকে দিয়ে কিছু হবে না। তাই সে ভেবে নেয় এইখানে তার সময় নষ্ট করলে চলবে না। গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভেবে সে মেয়েটাকে ছেড়ে দ্রুত গতিতে বেড়িয়ে যেতে নেয়। তখনই জুঁই নামক মেয়েটা বলে, “আমি জাহান ভাইকে বিচার দিব তোমার নামে। তার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড আমি। দেখো সে তোমার কি করে।”
“আমি তার কাছেই যাচ্ছি। যত দ্রুত সম্ভব বিচার পৌঁছে দে।”
মোহ মৃণাকে বলে, “তুই এখানেই থাক। আমি আসছি।” বলে সে-ও দ্রুত মহুয়ার পিছনে যায়।

মহুয়া রেগেমেগে ক্যাম্পাসের বিল্ডিং থেকে বের হয়েই দেখতে পায় জাহান ও তার দলকে। তারা পার্কিং স্পটে আড্ডা দিচ্ছে ও সিগারেট খাচ্ছে। মহুয়া তেড়ে আসে তার দিকে। তার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে জাহানকে মেরে তার হাড্ডি ভেঙে দিতে। কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ঘুষি মারল তার গাড়িতে। যদিও এতে জাহানের গাড়িতে কিছুই হলো না। উলটো সে নিজেই ব্যাথা পেল তার হাতে। সে ঠোঁট কামড়ে তার ব্যাথা গিলল। এই লোকের সামনে তো নিজের দুর্বলতা কখনোই দেখাবে না। মনে মনে ব্যাথায় কেঁদেকুটে গাড়ির গুষ্টি উদ্ধার করলেও সামনে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় জাহানের দিকে,
“সেদিন আমার জান বের করে প্রাণ ভরে নি তোমার? সেদিন তো তোমাকে অনুরোধ করলামই। বললাম এসব বন্ধ করতে। আজ আবার কি গুজব ছড়াচ্ছো?”
“কী হয়েছে সিস্টার?” জয় তার এমন রাগ দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে। মহুয়া তার দিকে আঙুল তুলে বলে, “এই সিস্টার সুস্টার মারালে ঘুষি দিয়া নাক ফাটায় দিমু। শালা মীরজাফর। শালা ভন্ড।”
তার হুমকি শুনে জয় ভয়ে চুপ করে যায়।

মহুয়া আবার জাহানকে বলে, “আমি তো ভাবতাম তুমি মেয়েদের সম্মান করো। এই একটা ভালোদিক ভাবতাম তোমার। আজ ওটাও ভুল প্রমাণিত হলো। তোমার সাহস কি করে হয় আমার চরিত্র নিয়ে গুজব ছড়ানোর। সেদিন আমাকে রুমে আটকে তালা লাগালে তুমি আর আমার নামে গুজব ছড়াচ্ছো?”
“কিসের গুজব?” জাহানের কপাল সংকুচিত হয়।
“এহ এখন কিছু জানে না।”
“আমি এসব ফালতু কাজ করি না। আমার নিজেরও বোন আছে। আমি অন্যকারো বোনের সম্মান নষ্ট করব কেন?”
মোহও কথার ধরণ ধরতে পারে সে মহুয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কানে বলে, “দোস্ত আমার তো মনে হয় সত্যি বলছে। সেদিনও না’কি সে দুইজনকে রেখে গিয়েছিল যেন তোর সমস্যা হলে জানায়। তোকে পাহারা দেয় যেন কেউ ঢুকতে না পারে। এমন করবে বলে মনে হয় না।”

মহুয়ার রাগ এবার ফুঁস করে একটুখানি কমে । সে টিমটিম করে তাকায় তার থেকে আধাহাত লম্বা মানুষটার দিকে। সে প্রথমে আমতা-আমতা করলেও কিছু সেকেন্ড পর আবার বড় গলায় বলে, “গুজব এই লোক না ছড়ালেও, তো গুজব তো ছড়ায়সে এর জন্যই।”
“কি গুজব?”
“তোমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকে জিজ্ঞেস করো।”
“কে?”
“জুঁই। তোমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড।”
“কি বলেছে?”
“আপনার বন্ধুমহল থেকে কথাটা এসেছে আপনি জানেন না? এটাও মানতে হবে? আচ্ছা তাহলে শুনুন, বলেছে আমি বৃহস্পতিবার বেরাত পর্যন্ত ভার্সিটিতে ছিলাম। কার সাথে ছিলাম না’কি, কয়টা ছেলের সাথে ছিলাম জানতে চাইছে। আজকে তোমার জন্য জীবনে প্রথম আমার চরিত্র নিয়ে কেউ কথা বলেছে।”

জাহানের দৃষ্টি শীতল। সে সিগারেটের ধোঁয়া এক বড় নিশ্বাসে ভরতেই তার কপালের রগটা ফরফর করে উঠে। সে সিগারেটটা হাত দিয়েই পিষে নিভিয়ে মোহের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মেয়েটা কোন ক্লাসের?”
“আ…আমাদের ক্লাসেরই।”

জাহান এক মুহূর্ত দেরি না করে মহুয়ার হাত ধরে তাকে সাথে নিয়ে যেতে থাকে। মহুয়া তো হতভম্ব। হঠাৎ এই লোক তার হাত ধরল কেন?
“এই ছাড়ুন…আমার হাত ছাড়ুন বলছি।”
জাহান তার হাত ছাড়ে না। সে বাম হাতে বড় নখগুলো দিয়ে তার হাত খামচে দেয়। চামড়া উঠে যায়, র*ক্ত বের হয়। তবুও জাহান হাত ছাড়ে না।

সিঁড়ি করে উঠে যায় মহুয়ার ক্লাসরুমে। যেতেই প্রথমে জিজ্ঞেস করে, “জুঁই কে এখানে?”
সবাই তাকে দেখে দেখে এমনভাবে উৎসুক হয়ে যায় যেন কোনো তারকা এসেছে। হৈচৈ করতে শুরু করে। চরম পরিমাণে বিরক্তি ভার করে জাহানের। সে প্রায় গর্জন করে উঠে, “জুঁই কে এখানে?”
সাথে সাথে সকলে চুপ হয়ে যায়। একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে। মহুয়া নিজেও ভয়ে কেঁপে উঠে। বিড়বিড় করে বলে, “এই হনুমানের মাথায় আবার কোন ভূত চাপলো!”

একটি ছেলে এবার জুঁইকে ঠেলে এগিয়ে দেয়। জুঁইয়ের প্রথমে ভয় না লাগলেও গর্জনে সে আতঙ্কে কেঁপে উঠে। যেন বাঘের গুহায় পা রেখেছে। সে বিড়বিড় করে বলে, “আসলে জা…জা…”
জাহান শান্ত সুরে তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড?”
জুঁইয়ের চোখের ভয় মুহূর্তে উড়ে যায়। সে ভাবে জাহান তার জন্যই এসেছে। মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বাহবা দেবার জন্য।

সে উৎসুক কন্ঠে বলে, “হ্যাঁ আমি আরাফাতের গার্লফ্রেন্ড।
আপনার সাথে কথা বলার কত ইচ্ছা ছিল আমার।”
“বলো তো কে এই মেয়ের বিরুদ্ধে কথা ছড়িয়েছে? এত ভালো কাজের জন্য বাহবা দিতাম।”
জুঁই তো খুশিতে সাত আসমানে। তার এতদিনের ক্রাশ আজ তার সাথে এত মিষ্টি করে কথা বলছে?

আরাফাতের সাথে সে সম্পর্কে জড়ায়ই তো জাহানের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু ওই অকর্মা কোনো কাজের না। তাই তার নিজেরই পদ্ধতি বের করতে হয়েছে, “আমিই করেছি। আরাফাত বৃহস্পতিবার আমাকে বলেছিল এই বেয়াদব মেয়েটার কথা। আমি জানতাম আপনি খুশি হয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসবেন।” সে আবার ঠোঁট উল্টে বিচারের ভঙ্গিতে বলে, “জানেন জাহান ও আমাকে মেরেছে। বিচার করেন ওর।”

জাহান মহুয়ার হাত ছেড়ে জুঁইয়ের দিকে এক’পা এগিয়ে আসে। তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে জিজ্ঞেস করে, “জানো আরাফাত কোথায়?”
জুঁই মাথা নাড়ায়। সে জানে না, “দুইদিন ধরে কথা হয় না। বৃহস্পতিবার রাতে কথা হয়েছিলো।”
জাহান জুঁইয়ের দিকে এগিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “সেদিন শেষ কথা হয়েছিল কেন জানো? কারণ সে এখন হাত পায়ে পট্টি বেঁধে বসে আছে। কারণ ও আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা অমান্য করেছে। ওর কারণে আমার পছন্দের একটা মানুষ কেঁদেছে, আতঙ্কিত হয়েছে। আর তুমি তার বিরুদ্ধে এত বড় কথা তুললে? তোমার কী দশা হওয়া উচিত?” জাহানের দৃষ্টি শীতল, কিন্তু ভয়ানক। মনে হচ্ছে দৃষ্টি দিয়ে পুড়ে ছাঁই করে দিবে সামনে থাকা ছায়ামূর্তিকে।

জাহান উঁচু স্বরে আদেশের সুরে বলে, “জয় আমি এই মেয়েকে এই ভার্সিটিতে আর দেখতে চাই না।”
“আ…আচ্ছা ভাই। যা বলবেন।”
জাহান আবার জুঁইয়ের দিকে তাকাল, “তোমার বাঁচার পথ খুলে দিলাম। এবার বলো শাস্তি কি দেওয়া উচিত?”
জুঁই সাথে সাথে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, “মাফ করে দিন জাহান ভাই। আমি আর এমন করব না। এবারের মতো মাফ করে দন।” সে কেঁদে উঠে।
“মাফ চাওয়ার সঠিক জায়গা এটা না।”
জুঁই সাথে সাথে মহুয়ার কাছে গেল ক্ষমা চাইতে। মহুয়া তো হতভম্ব। কী হচ্ছে এসব? জুঁইয়ের এভাবে ক্ষমা চাওয়া দেখে তার নিজেরই লজ্জা লাগে। সে বলে,”হয়েছে হয়েছে। আর এসব করা লাগবে না। মাফ করে দিয়েছি।”
বলে সে জাহানের দিকে তাকায়। লোকটা তার জন্য এসব করল? কেন? তার জানামতে জাহান তাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। তবে হয়তো লোকটা তার ভাবনার মতো খারাপ না।

তার তাকিয়ে থাকতে দেখে জাহান তার দিকে চোখ টিপ মারে। মহুয়া তো বোকা বনে যায়। কী হলো? এক চমক শেষে আরেক চমক অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ জাহান ঘোষণার ভঙ্গিতে বলে, “আজকের পর থেকে এমন গুজব ছড়ানোর পরিণাম ভয়ংকর হবে। বিশেষ করে কেউ যদি জেরিন মহুয়ার বিরুদ্ধে একটা কথা বলে তার মানে সে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। আর আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পরিণাম সকলে নিশ্চয়ই জানো।”

মহুয়া হা হয়ে তাকিয়ে রয় জাহানের কথা শুনে। সে খানিকটা বাঁ দিকে ঝুঁকে মোহকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “দোস্ত ওদিনের কথা আমার খেয়াল নেই বোধহয়। আমি কি এর গালের জায়গায় মাথায় মেরে দিয়েছি? ছেলেটার মাথার তার ছিঁড়ে গেছে রে আমার এক চড়ে।”
মোহও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলো জাহানের কথা শুনে। সে মাথা নাড়িয়ে সাঁই দেয়, “তোর এক চড়ে তার মাথা গেছে রে দোস্ত। তোর চড় এত সাংঘাতিক জানতাম না তো।”

তারা দেখে জাহান মহুয়ার সামনে এসে তাকায়। প্রথমে কোনো কথা বলে না। গভীর দৃষ্টিতে ছুঁয়ে সে তার সামনে দাঁড়ানো মানবীকে।
মহুয়া প্রথমে অবাক হয়। তার চক্ষু বের হতে চাইছে কোটর থেকে। এই লোকের মাথা আসলে গেছে। ভেবে নিজেকে বকতে থাকে মহুয়া। তার জন্য একটা ছেলের মাথা নষ্ট হয়ে গেল? এরপর ভয় হয় তার। তার বাবা তো অনেক ক্ষমতাশীল। সে যদি জানে তার এক থাপ্পড়ে ছেলে পড়ে গেছে পাগলে কাতারে, এখন তার কি অবস্থা হবে?

মহুয়ার এমন গভীর ভাবনা দেখে জাহান বাঁকা হাসে। আচমকা তার হাত ধরে বলে, “আমি ইয়াজভান জাহান এই জীবনে প্রথম তোমার কাছে পরাজয় স্বীকার করলাম, মাই লাভ।” বলে সে মহুয়া হাত তুলে তার আঙুলে একটি চুমু খেল।
“হেঁ….” মহুয়ার এবার সত্যি সত্যি মাথা ঘুরান দিলো। মাথার উপর যেন মাছিরা ভনভন করছে। এই লোকের মাথা আসলে গেছে। পুরাই গেছে।

মহুয়া দ্রুত তার হাত সরিয়ে মোহকে ধরে কান্নাকান্না ভাব নিয়ে বলে, “দোস্ত এবার আমি শিউর আমার থাপ্পড়ে এই ছেলের মাথা গেছে। এবার আমার কী হবে দোস্ত? এর বাপ তো আমার জীবন শেষ কইরা দিব। একটা থাপ্পড়ের জন্য আমার জে*লে যাইতে হইব। একটা বিয়াও করলাম না। জামাই আর বাচ্চার চেহেরাটাও দেখলাম না। আমার কী হইব দোস্ত?”

জাহান এবার ফিক করে হেসে দেয়। জয় তার পাশে এসে দাঁড়ায়, “ভাই আপনি সত্যি ঠিক আছেন? মাথা কি ব্যাথা করছে আপনার?”
জাহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মহুয়ার দিকে, “জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের জন্য হার্টবিট স্কিপ হয়েছে মাথা ঠিক থাকে কীভাবে?”

চলবে….