মেঘের খামে পর্ব-৮+৯

0
4

#মেঘের_খামে
পর্ব ৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জাহান এবার ফিক করে হেসে দেয়। জয় তার পাশে এসে দাঁড়ায়, “ভাই আপনি সত্যি ঠিক আছেন? মাথা কি ব্যাথা করছে আপনার?”
জাহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মহুয়ার দিকে, “জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের জন্য হার্টবিট স্কিপ হয়েছে মাথা ঠিক থাকে কীভাবে?”

জয় কতক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জাহানের দিকে। সে জাহানকে চিনে আজ পাঁচ বছর। কলেজ জীবন থেকে সে জাহানকে চিনে। তার একবছরের সিনিয়র। তার জন্যই জয়ের এই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। জাহানের ব্যক্তিটা অন্যরকম। ভিন্ন। তার এটাটিউড সবাইকে মুগ্ধ করে। তাকেও করেছে। সে সবসময়ই জাহানের মতো হতে চায়। জাহানকে সকলে সম্মান করে, ভয় পায়, তাকে পছন্দ করে। মেয়েরা পাগলপ্রায় তার জন্য। অথচ সে কারও দিকে চোখ ফিরিয়েও তাকায় না। তার আশেপাশে সকলে এমনকি সে নিজেও দু’দিন পর পর প্রেমে পড়ে। সৌন্দর্যের প্রেমী কে না হয়? অথচ সে একদিন দেখেছিল। একটা পার্টিতে জাহানকে দেশের বিখ্যাত সুপারমডেল প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সেই সুন্দরী। তাকে দেখে চোখ ফেরানো দায়। অথচ জাহান তাকে দু’পয়সার পাত্তা দেয় নি। অথচ তার মনে ধরেছে এই সাধারণ মেয়েটি? লম্বা পাঁচফুট দুই অথবা তিন হবে বড়জোড়, গোলগাল চেহেরা, ফোলা গাল, চুল ছড়ায় পিঠ পর্যন্তই, চেহেরাটায় মিষ্টি ভাব হলেও আহামরি বলা যায় না। চোখজোড়াও হরিণের মতো টানা নয়। ছোট সরু চোখ। সে বুঝল না জাহান কেন পছন্দ করল মহুয়াকে। সে জাহানের দিকে তাকাল। দেখল জাহান মুচকি হাসছে মহুয়ার কান্ড দেখে। তার চোখে মায়াভরা।

সাথে হাসি ফুটে উঠে জয়ের মুখেও। জাহানের খুশিটাই তো মূখ্য। সে বিশস্ত হেসে উঁচু স্বরে বলে, “মহল এত শান্ত কীভাবে আমরা ভাবি পেয়ে গেছি।”
সকলে সম্ভবত তার মতোই ভাবনাতে ডুবে ছিলো। হঠাৎ তার কথায় সকলে আবার চেঁচামেচি শুরু করে।

মহুয়া তার নাটকীয় কান্না ছেড়ে সবার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। এ কী নতুন কাহিনি শুরু হলো? সে তো থাপ্পড় মারল কেবল জাহানকে সকলের মাথার তার ছিঁড়ল কীভাবে?

সে তাকাল জাহানের দিকে। ছেলেটা যেভাবে তার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে এতেই তার ভয় হলো। সে দৌড়ে এসে প্রথমে তার ব্যাগ নেয়। তারপর একহাতে ধরে মৃণাকে দৌড়ে এসেই মোহের আরেকহাত ধরে পালায় সে।
মোহ চিৎকার করে উঠে, “আরে আমার ব্যাগ…”
“রাখ তোর ব্যাগ। এখানে থাকলে হয়তো থানায় যাওয়া লাগবে, নাহয় পাগলখানায়।”
তার কথা শুনে এবার জাহান শব্দ করে হেসেই ফেলে।

কিছুটা সময় দৌড়ে নিজেই হাঁপিয়ে গেল মহুয়া। সে ব্যাগ থেকে পানি বের করে ঢকঢক করে এক বোতল শেষ করে দেয়। তারপর হাঁপিয়ে ওঠে বলে, “ভাই ওই ছেলের মাথা পুরা গেছে। আমি একটা ছেলের মাথা নষ্ট করে দিলাম আমার এত জোর আছে শরীরে? আমি তো সুপারওম্যান হতে পারুম দেখতাছি।” নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে এসব বেখেয়ালিপণা বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসে। কান্নামাখা সুরে বলে, “দোস্ত ওই ছেলের বাপে আমার নামে কেস করব।”

মোহ বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, “ঢঙ করিস না তো। আমার তো সিরিয়াসই মনে হলো। তোকে পছন্দ করে।”
“বোইন তোরও কি মাথা গেছে? ওই পোলা কি আজগুবি কথা বলছিলো আর তোর মনে হলো আমারে পছন্দ করে?”
মৃণাও মোহের সাথে তাল মিলিয়ে বলে, “আমারও তাই মনে হলো।”
মহুয়ার কান্নার সুর আরও জোর হয় সে কপালে হাত রেখে বলে, “আমি চড় মারলাম ওই জাহানের বাচ্চারে আর তোগোও ইফেক্ট পড়ল? এটা কি ছোঁয়াচে…না না ছোঁয়াচে না মনে হয় দেখলেও এই রোগ হয়। ওই বদের হাড্ডি আমার দিকে যেমনে তাকিয়ে ছিলো তাতে আমিও পাগল হয়ে যামু।”
“হওয়ার আবার কী আছে? তুই তো পাগলই। এতদিন জানতি না?”
মোহের কথায় মহুয়া কান্নার ঢঙ বন্ধ করে তার দিকে তাকায়। মৃণাও ফিক করে হেসে দেয়।
মহুয়া মুখ ফুলিয়ে রাগ, অভিমান করে বলে, “তোদের লজ্জা লাগছে না। আমি কেস খাইলে তোরা যে নিজের দুলাভাই, ভাগ্না, ভাগ্নির চেহেরা দেখতে পাড়বি না তোরা বুঝতে পাড়তাসোস না?”

“সে চিন্তা তোমার না করলেও চলবে।” ভারী কন্ঠে মহুয়া চোখ বন্ধ করে নেয়। সে জানে এই কন্ঠটা জাহানের। আজ উনিশ বছরের জীবনে এত ভারী কন্ঠ জাহানেরই শুনেছে। সে পিছনে তাকাতেই দেখে জাহান আসছে তার চেলাপেলাদের নিয়ে। সে বলে, “যদি মন তুমিতেই আটকায় তাহলে ওদের দুলাভাই দেখার কার্যক্রম সম্পূর্ণ হলো।”
মহুয়া চিন্তিত হলো। সে পায়ের পাতা একটু উঁচু করে জাহানের মুখের এদিক-ওদিক দেখছিল। যদিও পা’য়ের পাতা উঁচু করা সত্ত্বেও জাহানের মুখোমুখি হতে পারে নি নি। তাই বিরক্ত হয়ে জাহানের কাঁধে হাত রেখে বলে, “নিচে নামো তো। জিরাফের মতো এত লম্বা কেন তুমি?”
তার কাঁধে হাত রেখে তাকে হাল্কা ঝুঁকিয়ে এবার ভালো করে তাকে পর্যবেক্ষণ করল। তার চোয়ালে হাত ছুঁইয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো।

এদিকে যে জাহানের অবস্থা ব্যাকুল, সেদিকে তার খেয়াল নেই। প্রথমে জাহান তাকে এতটা কাছাকাছি থেকে দেখে দৃষ্টি সরাতে পারে না। তার মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে। মহুয়ার মুখে চিন্তা ও বিরক্তির ছাপ। জাহানের মনে পড়ল সেরাতের কথা যখন মহুয়া জাহানকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর ছেড়ে দিয়ে এক চড় বসিয়েছিল তার গালে। ব্যাপারটা তার ইগোতে লাগার কথা। কিন্তু সে যখন ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তখন জাহানের বুকের ভেতর কী যেন হলো! তার হৃদপিণ্ডটা থেমে গেল। তার স্পষ্ট মনে আছে সে মিষ্টি চেহেরাটা। মহুয়ার চোখ ছিলো ছলছল, তার ফর্সা গাল ও নাক লালচে হয়ে গিয়েছিল, ঠোঁটদুটো ফুলে গিয়েছিল। মুখে আঁকা ছিলো রাগ, আতঙ্ক, ভয়। সে চেহেরাটা জাহানের মুখস্থ হয়ে গেছে। হবারই কথা সে চেহেরাটা যেন প্রতিমুহূর্তে তার চোখে ভাসে।

মহুয়া হঠাৎ তার মুখ ছুঁতেই জাহানের ঠোঁটের মুচকি হাসি উড়ে গেল। তার থেমে থাকা হৃদস্পন্দন বেগতিক গতিতে ছুটতে লাগল। তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদুৎ বয়ে গেল। সে এক ঢোক গিলল। এবার যেন সে সত্যিই অসুস্থ হয়ে যাবে।

মহুয়া তার মুখ ঘুরিয়ে দেখেশুনে বলে, “না মুখে তো দাগ দেখছি না। দাগ হয় নাই বলেই কি সোজা ব্রেইনে ইফেক্ট পড়েছে?”
জাহানের তার কথা শুনে ঘোর কাটে। সে এবার সোজা হয়ে বিস্মিত স্বরে বলে, “আর ইউ সিরিয়াস? এই তুমি আমার অনুভূতি নিয়ে কমেডি করছো?”
“আমি কখন কমেডি করলাম?”
“ঠিক। তুমি নিজেই একটা কমেডি।”
“এক মিনিট এটা কি অপমান ছিলো না প্রশংসা তা আগে ক্লিয়ার করো। আমার ওই হিসাবে রিয়্যাক্ট করতে হবে।”
জাহান বড় একটা নিশ্বাস ফেলল। শেষমেশ এই জোকারকেই তার মনে ধরল!
“ষ্টুপিড!” জাহান বলল ককর্শ গলায়।

“এইত্তো।”মহুয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে, ” যাক এখনো তাহলে সম্পূর্ণভাবে পাগল হন নি। মাথায় এখনো আধ-একটু ঠিক আছে। যাক মজা করছো ঠিক আছে। এত ফালতু মজা আর করবে না। কেস খাওয়ার ভয়ে আমার কলিজার পানি শুকায় গেছে।”
“মজা কী করলাম?”
“যে তুমি আমাকে পছন্দ করো।”
জাহান বাঁকা হেসে তার দিকে এক পা এগিয়ে আসে। দু’হাত দুই পকেটে রেখে ঝুঁকে তার মুখোমুখি হয়। মহুয়ার সে মায়া ডুবো চোখ দুটোয় চোখ রাখে। সম্মোহনী কন্ঠে বলে, “নো লাভ, ইট’স নট আ জোক। আমি সত্যি তোমার উপর ইন্টারেস্টেড। যে মেয়ে জাহানের হার্টবিট স্কিপ করাতে পারে তার উপর ইন্টারেস্ট আসাটা স্বাভাবিক নয় কি?”
জাহান এগিয়ে আসায় মহুয়া মাথা পিছিয়ে নেয়। জাহানের কথায় সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার তাকানো থাকা দেখে জাহান মুচকি হাসে, “বাই এনি চান্স যদি তোমার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট থেকে যায়….তাহলে নিজেকে জাহানের নামে লিখতে প্রস্তুত থাকো।”

মহুয়া ভ্রু কপালে তুলে নেয়। তারপর ভ্রু নাচিয়ে কিছু একটা ভাবে। কোনো প্রশ্নের উওর খুঁজে, পেয়েও যায়। তারপর মুখে বিরক্তি ভাব নিয়ে বলে, “এই পাগল আমাকে কি ছাগল মনে হয়? আমি বুঝি না বুঝসো? আমি কোনো ছাগলটাগল না। সবই বুঝি বুঝছো?”
“কি বুঝছ?”
“যা বুঝছি আমি বুঝছি। তোমাকে কেন বুঝাব আমি কি বুঝছি যা তুমি বুঝাতে চাও না আমাকে।” বলে সে ভেংচি কেটে চলে যায়।
মোহ ও মৃণাও যায় তার পিছনে।

জয় জাহানকে জিজ্ঞেস করে, “ভাই ভাবি কি বুঝলো আর কি বুঝালো তাই তো বুঝলাম না।”
“ওই জানে। আচ্ছা জয় বলতো, জীবনে প্রথম পরাজয়ে আমার রাগ লাগছে না, খুশি হচ্ছে। কেন?”
“আপনি প্রেমে পড়েছেন তাই।”
“এক নজরে প্রেম হয় না’কি? কাউকে না জেনে ভালোবাসা যায়? আগে তো ওকে দেখলে আমার হৃদস্পন্দন এমন বেহায়াপনা করতো না। এখন কেন হচ্ছে?”
“কি জানি?”

মহুয়ার পিছনে তার বান্ধবীরা আছে দ্রুত। মোহ তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে জ্ঞানীগুরু আমাদেরও বলেন আপনি এমন কী বুঝেছেন?”
মহুয়া খুবই গম্ভীর ভাব নিয়ে তাকায় মোহের দিকে, “শুন তাহলে। আমি নিশ্চিত, হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর যে ওই জাহান হনুমান আমার সাথে প্রেমের নাটক করছে।”
“এমন কেন মনে হচ্ছে তোর?”
“বুঝিস না কিছু? যে পোলা দুইদিন আগ পর্যন্ত আমার জীবন ত্যানাত্যানা করতে উঠেপড়ে লেগেছিল সে হঠাৎ আমার প্রেমে পড়বে? আরে সে প্রথমে আমাকে প্রেমে ফালাবে তারপর আমার হার্টব্রেক করবে। এইজন্যই বলি তোদের ড্রামা দেখতে। আমার মতো ভরে ভরে ড্রামা দেখলে আজও তোরাও জ্ঞানী গুরু হতি।”
মোহ মুখ বানিয়ে বলে, “তুই গুরু না, গরু। বুঝলি? আস্তো এক গরু। এরপর থেকে তোর মুখে ড্রামার নাম শুনলে আইস্ক্রিমে শুকনা মরিচ মিলায়া খাওয়ায় দিব।”
“শুনে তো মজাই লাগতেছে। কম্বিনেশনটা আগে ভাবি নাই। আজই যেয়ে ট্রাই করব। কোন ফ্লেভারের সাথে মজা লাগবে দোস্ত।”
“ভাই মাফ কর। তোরে আর কিছু বলতেছি না। এই মৃণা চল তো। এই পাগলের সাথে আর থাকব না। ওই আমার প্রিয় আইস্ক্রিমের ইজ্জত রাখবে না আজ শিউর।”
মোহ মৃণার হাত ধরে নিয়ে গেল। মহুয়া তাদের পিছনে যেতে যেতে বলল, “ভাই আমি ড্যাম সিরিয়াস। বল না। আমার এখন খেতে মন চাচ্ছে। ক্রেভিং হচ্ছে।”
.
.
মোহ বাসায় গিয়ে দেখে মেহমান এসেছেন ঘটকের সাথে। তার বড় বোন মিতার বিয়ের কথা চলছে। ছেলের মা এসে তাকে পছন্দ করেছিল। আজ পরিবার নিয়ে এসেছে। এখনো মিতা বের হয় নি। দরজা দিয়ে ঢুকে সালাম না দিয়েও যেতে পাড়ে না। তাই সালাম দিতেই বাবা, মা, ছেলে তিনজনই তাকায় তার দিকে। সর্বপ্রথম চোখ সরায় ছেলেটা। সাথে সাথে মিতা আপুর জন্য তার ছেলেটাকে ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে যখন পাত্রপক্ষ আসে মিতাকে ছেড়ে ছেলেরা তার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে। অসহ্যকর পরিস্থিতি! অথচ ছেলেটা তার দিকে আরেকবার ফিরেও তাকায় নি। পাত্র নিশ্চিত ভদ্রলোক।

অথচ পাত্রের মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সে চাহনি দেখে অস্বস্তিবোধ করল। তার মনে কু ডাকছে। এখন কিছু একটা হবে, আর তার এর আগে পালাতে হবে। বলল, “আমি মিতা আপিকে দেখে আসি একটু।”
তখনই মহিলাটি থামায় তাকে, “দাঁড়াও দাঁড়াও মামণি।” বলে তিনিই উঠে দাঁড়ালেন। তার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর তার হাত দু’টো নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি মামণি?”
“মোহ।”
“বাহ কী সুন্দর নাম! একদম তোমার মতো। নামটা ঠিক যেন তোমার জন্যই তৈরি।”
মোহ মিথ্যে হাসে। এই মহিলার কথা সুবিধার ঠেকছে না।
“বয়স অনুযায়ী তোমাকে ছোট মনে হয়। মিতার মতো তোমারও পড়াশোনা শেষ?” মহিলাটি প্রশ্ন করে।
“জ্বি না। আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম।”
মহিলাটির মুখের হাসি নিভে গেল, “তোমার বয়স কত?”
“সবে উনিশে পড়ল আন্টি।”
এবার তো পুরোই নিভে গেল। মোহের হাত ছেড়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে নিজের চশমার ফ্রেম করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি মিতার সাত বছরের ছোট?”
“জ্বি।”
“আচ্ছা মামণি যাও। ভার্সিটি থেকে এসেছ। নিশ্চয়ই ক্লান্ত তুমি। আরাম করো।”

সেদিনই মিতার বিয়ে ঠিক হলো। দুই সাপ্তাহ বাদেই বিয়ে। মোহ তো খুশিতে নেচে উঠলো। তার বোনের বিয়ে। সে নাচবে, ভালো ভালো খাবে, আর অনেকগুলো শপিং করবে। ভেবেই তার আনন্দ পাচ্ছে। আনন্দে সে কল করে মহুয়া ও মৃণাকে সব জানায়।
.
.
“ভাই এটা ভার্সিটি না নাটকের মঞ্চ আমি বুঝে পাই না। কচুর ভার্সিটি। প্রতিদিন কোনো না কোনো নাটক হইবই।” দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে মহুয়া। তার সামনে তিসান একগোছা লাল-সাদা গোলাপ নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার বামপাশের হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে জাহান। তার সরু দৃষ্টি তার দিকে আটকে আছে। সাথে তার সকল চেলা-পেলারা চোখ মারবেলের মতো বের করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভার্সিটিতে ঢুকতেই এমন কর্মকাণ্ড ঘটবে সে ভাবে নি। জানলে আজ আসতোই না।

তিসান তাকে কাব্যিক ভাষায় বলে, “মহুয়া, তোমার প্রেমের রোদ্দুরে আমি হারিয়ে যেতে চাই। তুমি একবার হ্যাঁ বলো কেবল, আমি সম্পূর্ণ পৃথিবী তোমার নামে লিখে দিতে চাই।”
“পুরো পৃথিবীটার দাম জানেন? লিখে দিবেন কেমনে? এটার কি আইন আছে? আচ্ছা আমার নামে পৃথিবী লিখে দিলে কি আপনারা অন্যগ্রহে থাকবেন? আমার নামে পৃথিবী লেখা হলে তো সর্বপ্রথম এই ভার্সিটির সব’কটাকে লাত্থি মেরে ব্লাকহোলে পাঠিয়ে দিতাম।”

মৃণা পাশ থেকে তাকে ফিসফিসিয়ে বলে, “মহু এটা তো কাব্য রটে বলছে। তোকে ইম্প্রেস করার জন্য। তুই এভাবে বলিস না, মানুষটা কষ্ট পাবে। হয়তো সত্যি তোকে পছন্দ করে।”
“মহারাণী গাঁধি সাহেবা চুপ করেন একটু। নাইলে সবার আগে তোকে ব্লাকহোলে পাঠায় দিমু।”
“মহু নাসা বোধহয় এখনো রকেট দিয়েই কাওকে ব্লাকহোলে পাঠাতে পাড়ে নি। তুই লাথি মেরে কীভাবে পাঠাবি?”
আড়চোখে মহুয়া তাকায় মৃণার দিকে। তার চোখে বিরক্তি, রাগ। সাথে সাথে মৃণা চুপ করে এক’পা পিছিয়ে যায়।

“তিসান ইহসান এর আগে কাউকে এভাবে প্রাপোজ করে নি। বিলিভ মি।” তিসান নরম দৃষ্টিতে তাকায় মহুয়ার দিকে।

জাহান দূর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলো। আর সিগারেট টানছিল। তিসানের এই কথা শুনে সে বিরক্তি নিয়ে বলল, “ব্লাডি লায়ার।”
তার চোখে মুখে কেবল বিরক্ত। কোনো রাগ নেয়, ক্ষোভ নেই, ভয় নেই। যা দেখে জয় অবাক হয়। সে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আপনি এত শান্ত কীভাবে? তিসান ভাই আমাদের ভাবিকে প্রাপোজ করছে আর আপনি এত আরামে গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছেন?”
“নাটক দেখছিস, নাটক দেখ। এত চিন্তার কিছু নেই। তিসান কেবল আমার উপর ক্ষোভ বের করার জন্য ওকে প্রাপোজ করেছে।”
“যদি ভাবি হ্যাঁ বলে দেয়?”
“বললে বলুক।”
“কি কন ভাই? ভাবি অন্যকাওকে হ্যাঁ বলব আর আপনি দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া সিগারেট টানবেন?”
সে বাঁকা হেসে তাকায় জয়ের দিকে, “শুন জয়, মহুয়া হ্যাঁ বলুক বা না এতে কিছু আসে যায় না। যদি আমি একবার ওকে আমার করে চাই তাহলে ওর সাধ্য নেই আমার ভালোবাসাকে এড়ানোর। ওকে জাহানের জান হতেই হবে। একবার জাহানের ভালোবাসার ছোঁয়া পেলে অন্যকোনো ভালোবাসার বাতাসে সে নিশ্বাসটুকু নিতে পাড়বে না।”
“যা বলেছেন ভাই। কিন্তু ভাই তাহলে আপনি এগোচ্ছেন না কেন?”
“সময়। সঠিক সিদ্ধান্তর জন্য সঠিক সময় প্রয়োজন।”

মহুয়া তিসানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে। তারপর মাথায় কিছু গোলকধাঁধা পাঁকায়। হঠাৎ তার হাত থেকে ফুল নিয়ে বলে উঠে, “অফকোর্স তোমার মতো হ্যান্ডসামকে আমি মানা করতে পারি?”
তারপর তিসানকে হাত ধরে উঠায়।

অন্যদিকে জয় আতঙ্কিত স্বরে বলে, “ভাই… ভাই ভাবি তো হ্যাঁ বলে দিলো।”
জাহান হাসলো, “এবার ও সোজা আমার দিকে তাকাবে।”
সত্যিই মহুয়া তাকায় তার দিকে। জাহান বাঁকা হেসে বাম চোখ টিপ মারে তাকে দেখে। সাথে সাথে মহুয়া মুখ ফুলিয়ে নেয়। বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকায়।

জয় জিজ্ঞেস করে অবাক হয়ে, “ভাই হইতেছে কি?”
“এই মেয়েটা বোকা কিন্তু এতটাও নয়। ও জানে তিসান আমার থেকে শত্রুতা বের করার জন্য ওকে প্রাপোজ করছে।”
“আর ভাবি বুঝেও মেনে নিলো?”
“আমাকে দূরে রাখতে।”
“আপনি কি তাহলে দূরে সরে যাবেন ভাই?”
এবার এবার তাকায় জয়ের দিকে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি নিয়ে বলল, “তোর কী মনে হয় যে ইয়াজভান জাহানের হারা সবচেয়ে অপছন্দ সে জাহান নিজ ইচ্ছায় একটি মেয়ের কাছে হেরে গেল। তাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে? কখনো না। হোক তা নিজের জানের শত্রুর জন্য, নাহয় প্রাণের বন্ধুর জন্য।”

মহুয়া জাহানের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে ইতস্ততবোধ করে। সে ভেবেছিল জাহান দৃশ্যটা দেখার পর তার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে দেখবে তার পরিকল্পনা ভেস্তে ঢালার পর। কিন্তু এই লোক দেখি হাসছে। আবার চোখও টিপ মারছে। কী চলছে এই লোকের মাথায়?

সে বিরক্ত হয়ে তিসানের হাত থেকে ফুল নিয়ে বলল, “আমি ক্যান্টিনে গেলাম। খিদা লাগছে। ক্যান্টিনে চল তো মৃণা।” সে তিসানের দিকে তাকিয়ে বলে, “পরে দেখা করতে আসব।” বলে সে মৃণার হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে গেল। পথে মৃণার হাতে ফুল দিয়ে বলল, “নে তোর জন্য।”
“তোর ফুল আমাকে দিচ্ছিস কেন?”
“জানিস না আমার ফুল একটুও পছন্দ না।”
“দোস্ত তোর কি সত্যিই ছেলেটাকে পছন্দ?”
“পাগল না’কি? চিনি না জানি না পছন্দ হবে কেমনে?”
“তাহলে হ্যাঁ বললি কেন?” মৃণা বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করে।
তারা ক্যান্টিনে পৌঁছায়। মহুয়া চেয়ার টেনে বসে, “আরে এই চক্করে জাহান ব্যাটার সামনে তো পড়তে হবে না। হনুমান চিঙচিঙ্গা ভাববে রিলেশন আছে তো এখন নাটক করে লাভ নাই। এদিকে তো ব্যাটা জানে না আমি নিজেই তার আগে নাটক শুরু করে দিয়েছি।”
“আর ওই ভাইয়াটা যে তোকে প্রাপোজ করল। সে তো নাটক জানলে কষ্ট পাবে।”
“কচু পাইব। ওই শালা নিজেই জাহান থেকে দুশমনি বের করতে আমার পিছনে লাগছে। আমি কি ফিটার খাওয়া বাচ্চা? কিছু বুঝি না? ওই জাহান আর তিসান নামক আপদগুলোকে দশবার বেঁচে কিনে আনতে পাড়ব।”
“তা তুই পাড়বি।” মৃণাও গভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছেলে আসে খাবারের অর্ডার নিতে। মৃণা একটা রোল অর্ডার দেয়। আর মহুয়া স্যান্ডউইচ, দুইটা সমুচা, সিঙ্গারা, একটা পেস্ট্রি আর এককাপ চা। খাবার আসতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে মহুয়ার। মুখে পানি এসে পড়ে। চা’য়ে চুমুক দিয়ে শান্তি পাবার পর খাবারে কামড় দিতে যাবে আর ক্যান্টিনে হৈচৈ শুরু হলো। সে দেখল জাহান তার দলবল নিয়ে আসছে। মহুয়া বুঝে না এই লোককে সবাই এই মানে কেন? সম্মান করে কেন? তাকে নিয়ে এত হৈ-হুল্লোড়ের কী আছে?

জাহান এসে একটি চেয়ার টেনে বসলো মহুয়ার সামনে। পা’য়ের উপর পা তুলে। তাকে দেখে মহুয়ার চোখেমুখে রাগ ভেসে উঠে,
“এখানে বসেছো কেন? আর চেয়ার কী ফাঁকা নেই?”
জাহান একপাশ দিয়ে পিছনে তাকাল। সাথে সাথে খালি থাকা সকল চেয়ারে তার দলের মানুষরা বসে পড়ল।
জাহান তাকাল তার দিকে। তার ভারী কন্ঠে উওর দিলো, “নেই তো।”

মহুয়া গভীর নিশ্বাস ফেলে। এই ছেলের উপর ধ্যান দিতে গেলে অকারণেই তার খাবারের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে। সে খাবারের দিকে তাকাতেই তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। সে হাত এগিয়ে তার স্যান্ডউইচ নিতে যাবে তখনই জাহান বলে, “এতগুলো তুমি একা খাবে?”
“হ্যাঁ। তো?”
“এগুলো যায় কোথায়? সব তোমার গালে যেয়ে লাগে না’কি?”
“তোমার এত জ্বলছে কেন? খিদে লাগলে নিজে অর্ডার দিয়ে খাও। আমার খাবারে নজর দিবে না।” তারপর মিনমিনে সুরে বলে, “শালা ভন্ড!”

জাহান বাঁকা হাসে, “আমি এসব অখাদ্য খাই না। এসবে পুষ্টির আনাকোণাও নেই জানো তো? না’কি আবার ক্লাস টু তে ভর্তি করানো উচিত তোমাকে?”
“এই তোমার সমস্যা কী বলো তো? আমি বলেছি তোমাকে আমার অখাদ্য খেতে দেখতে আসত? তাও একদম সামনা-সামনি বসেছে। কোন সুখে? বের হও এখান থেকে, নাহলে চা’য়ে তেলাপোকা ব্লেন্ড করে খাইয়ে দিব। হনুমান কিনকিনি কোথাকার।”
নিজের মুখে কথাটা বলে চা’য়ের দিকে তাকিয়ে নিজেরই বমি আসলো। আজ থেকে তার আর চা খাওয়া হবে না। এই জাহান নামক আপদটার জন্য তার শখের চা’য়ের বিসর্জন গেল। একারণে জাহানের প্রতি অসহ্যকর অনুভূতিটা আরও বেড়ে গেল তার।

জাহান বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “তোমাকে দেখার সুখে।”
মহুয়ার বিরক্তি বাড়ল। সে গম্ভীরমুখে বলে, “সবে ব্রান্ড নিউ বয়ফ্রেন্ড বানিয়েছি। দেখো নাই? লজ্জা লাগে না অন্যের গার্লফ্রেন্ডকে এসব বলতে?”
জাহান তার ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি। সে চেয়ারে হেলান থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে। টেবিলে কোণি রেখে শুধায়, “তুমি আমাকে যত দূরে সরাতে চাইবে আমি ততই তোমার প্রতি আমার কৌতুহল বাড়বে। ততই তোমার কাছে আসতে ইচ্ছে করবে।” সে উঠে ধীর গতিতে মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। সাদা রঙের প্যান্টের পকেটে তার এক হাত গুঁজানো। অন্যহাত দিয়ে নিজের সামনে আসা কোঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ে পিছনে নিয়ে তার সামনে ঝুঁকে দাঁড়ায়। হাতটি মহুয়ার কাঁধের পাশ কাটিয়ে চেয়ারে রেখে তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।

এই কান্ডে থতমত খেয়ে যায় মহুয়া। এই ক’দিন আগেও তো সে জাহানের কাছে আসতেই সে অস্বস্তিতে ভুগছিল। ক্লাসের মেয়েদের কাছে শুনেছিল জাহান না’কি কোনো মেয়েকে তার আশেপাশেও ঘেঁষতে দেয় না। সবাই জানে মেয়েদের প্রতি তার হয়তো বিরক্তি কাজ করে নাহয় অস্বস্তি। আজ সে জাহান তার এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বিচলিত না হলেও বিস্মিত ঠিকই হয়।

“ডু ইউ নো লাভ, তোমার এসব কান্ড আমার মনে তোমার জন্য আকর্ষণ বাড়াচ্ছে।”
মহুয়া তার কথায় ভীষণ বিরক্তিবোধ করে। সে পাশে তাকিয়ে টেবিলে থাকা চকোলেট পেস্ট্রিটা হাতে নিয়ে ঠাস করে জাহানের মুখে লাগিয়ে দেয়। রাগে গটগট করতে করতে বলে,
“কী মনে হয় এইসব নাটক আমি বুঝি না? আমাকে সরল সহজ মেয়ে মনে হয়? আমার সাথে এসব ফালতু নাটক করলে চোখ উঠিয়ে মিউজিয়ামে রেখে দিব। মাইন্ড ইট।”

এমন বিস্ময়কর কান্ডে সবাই থমকে যায়। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে এই ঘটনার পরিপেক্ষিতে। এমনকি মৃণাও। সে তো ভয়ে শেষ। মহুয়া এমন এক কান্ড করবে সে ভাবে নি। ইয়াজভান জাহানের নাম ডাক সম্পূর্ণ ভার্সিটিতে শোনা যায়। তার নিসন্দেহে ক্ষমতা আছে প্রচুর। শুনেছে জাহানের না’কি রাগ প্রচুর। তেমনি মহুয়ারও। আগুনে আগুনে সব ভস্ম হয়ে যায়। মৃণা তো মনে মনে আল্লাহর নাম নিতে থাকে। আল্লাহ জানে এরপর কী হবে! সে দ্রুত মহুয়ার কাছে যেয়ে বলে, “মহুয়া এসে পড়।”

মহুয়া নড়ে না। সে আগের মতোই জাহানের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বিরক্তি স্পষ্ট। সাথে সে কৌতুহলী জাহানের পরবর্তী পদক্ষেপ জানার জন্য। এখন সে কী করবে? এই নাটক চালিয়ে যাবে না’কি অপমানের প্রতিশোধ সাথে সাথেই নিবে। কিন্তু জাহানের চোখে সে উওর খুঁজে পাচ্ছে না। কেউ চোখের পলক ফেলছে না, যেন কোনো প্রতিযোগিতা চলছে। মহুয়ার চোখ তার মনের কথা স্পষ্ট করলেও জাহানের চোখ দেখে তার মন পড়ার সাধ্য কারো নেই।

জাহান আচমকা মহুয়ার একদম কাছে আসতেই এই প্রথম মহুয়া ঘাবড়াল। জাহানের সাথে তার নাক ছোঁয়াতেই সে সাথে সাথে পিছিয়ে গেল। সে চোখের পলক ফেলল। প্রতিযোগিতায় হেরে গেল। জাহান বাঁকা হেসে তার গালের ক্রিম একটু হাতে নিয়ে মহুয়ার গালে মেখে দিলো। সাথে সাথে চোখদুটো বড় হয়ে যায় মহুয়ার।

জাহান বলে, “তুমি চার, আমি চার। আজ ইক্যুয়াল হলাম অবশেষে।”
মহুয়া কপাল কুঁচকায়। তার দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসু ভাষা।
জাহান আরও যোগ করে, “সেদিন আমারই জেতার কথা ছিলো কিন্তু তোমার টলটলে নেশা ধরানো চোখদুটো আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। ওদিন জিতেও আমি নিজ ইচ্ছায় তোমার কাছে পরাজিত হয়েছি। ইয়াজভান জাহান এই প্রথম নিজ ইচ্ছায় পরাজিত হলো একটু তো সহানুভূতি রাখো নির্দয়া মেয়ে।”

মহুয়া এবার জাহানের চোখের দিকে তাকাতে পাড়ে না আর। অস্বস্তিতে তার শরীরে ঝিম ধরে গেছে। সে তার কোলের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে ঝুঁকে জাহানের হাতের নিজ দিয়ে বিড়াল ছানার মতো বের হয়ে যায়। মুহূর্ত না কাটিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দ্রুত তার স্যান্ডউইচ আর সমুচা এক হাতে বহুকষ্টে ধরে অন্যহাত দিয়ে মৃণার হাত ধরে তাকায় জাহানের দিকে। ভেংচি কেটে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ে। যাওয়ার আগে জানিয়ে যায়, “এক হনুমানের কিটকিটির কারণে এভাবে খাবার নিয়ে যাচ্ছি। টাকা কালকে পরিশোধ করে দিব।”

জাহান হেসে দেয় তার কান্ডে। হাসতে হাসতে চেয়ারে বসে পড়ে। জয় জলদি করে এসে জাহানের পাশে দাঁড়িয়ে গাল থেকে পেস্ট্রি ক্রিম মুছতে মুছতে বলে, “ভাবি দেখি আপনার পছন্দের আকাশীরঙের শার্টটার বারোটা বাজিয়ে দিলো ভাই।”
“ওর সামনে এখন আমার আর কিছুই পছন্দ হয় না।”

চলবে….

#মেঘের_খামে
পর্ব ৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মহুয়া ও মৃণা যখন ক্লাস করছিল তখন সম্পূর্ণ ক্লাস তাকে ঘিরে ধরে। হঠাৎ এমন হওয়ায় চমকে যায় মহুয়া, ঘাবড়ে যায় মৃণা।
“কি’রে মহুয়া তুই দেখি দুইদিনে ভালো পপুলার হয়ে গেছিস। ভার্সিটির সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে প্রেম প্রকাশ করল। অন্যদিকে আজ আরেক হ্যান্ডসাম, মডেল তোকে প্রাপোজ করল। কেমনে কী?” এক মেয়ে তার পাশে বসে ভাবনাচেতক কন্ঠে বলল।
অন্য মেয়ে বলল, “কী আছে এমন তোর মধ্যে? আমি তো কিছুই দেখতেছি না।”
সামনে দাঁড়ানো এক ছেলে বলল, “বলিস কি’রে? মোহের মতো অপ্সরী না হলেও কিউট আছে আমাদের মহুয়া। মুখ মায়া মায়া।”
আরেক ছেলে তার মাথায় চাটি মারল, “শালা জাহান ভাই তোর কথা শুনলে তোকে মাটির নিচে পুঁ’তে দিবে। জানের ভয় নাই না’কি?ভাবি বল ভাবি।” তাকে মেরে ছেলেটি ভাবনাশীল ভাবে তাকায় মহুয়ার দিকে, “ও ভাবি ভালো কথা কার জন্যে ভাবি ডাকব? জাহান ভাইয়ের জন্য না’কি তিসান ভাইয়ের জন্য? ”

মহুয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাল। বলল, “তোরা সবক’টা যদি এখন এখান থেকে না ভেগেছিল ওদের একজনকেও লাগবে না আমিই তোদের মে’রে রোস্ট করে গলির কুকুরদের খাইয়ে তাদের বদহজম করাব। যা ভাগ এখান থেকে।”
তার ধমক শুনে তারা না গেলেও পরক্ষনেই প্রফেসরকে আসতে দেখে তারা ঠিকই চলে যায়।
তবে মহুয়া একজন মেয়ের হাত ধরে বসিয়ে দেয় তার পাশে, “এই রেডিও তোর সাথে কথা আছে। তোর কাছে তো সবার গসিপিং থাকে। আচ্ছা এই জাহান আর তিসানের মধ্যে কিসের ঝামেলা রে?”
“স্যার দেখলে তিনতলা থেইকা ছুঁইড়া ফালাইব।”
“দেখব না। জলদি বল।”
মেয়েটা স্যারের থেকে লুকিয়ে তাকিয়ে মৃদুস্বরে মহুয়াকে জানাল, “আমি শুনেছি জাহান আর তিসান না’কি বেস্টফ্রেন্ড ছিলো।”
“বলিস কী?”
“ছোটবেলার ফ্রেন্ড। ছোটবেলার চারবন্ধু ছিলো। জাহান, তিসান, শায়ান আর একজন কে তা কেউ জানে না। তো কাহিনি একটু পেঁচালো। আমি সোজা করে বলি, কেউ আগের ঘটনা জানে না। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই শায়ান আর জাহানের ঝামেলা। আগের প্রাণপ্রিয় বন্ধু এখন জানের শত্রু। এরা ভার্সিটিতে অনেক ভেজাল করছে। কারণ কেউ জানে না। আর মজার ব্যাপার হলো, তিসান আগে ছিলো জাহানের সাথে। কিন্তু একবছর আগে আচমকা তিসান ও জাহানের মাঝে ঝামেলা শুরু হয়।”
“ওদের ঝগড়ার কারণও জানিস না?”
“জানব না কেন? বৃষ্টিকে কি এমনি এমনি চলন্ত রেডিও রেডিও বলে? সব তথ্য আছে আমার কাছে?”
“তাহলে এত কাহিনি না করে বলেন মাতাশ্রী, নাহলে আপনার রেডিও ভাংতে দুই মিনিটও লাগবে না।”
“ভয় দেখাস কেন শালী? বলতেছি তো। তিসানের বোন জাহানকে লাইক করতো কিন্তু জাহান রিজেক্ট করে দেয়। এরপর তিসানের বোন না’কি অনেক কান্নাকাটি করে।”
“ছ্যাহ! এই এতটুকু বিষয়ে এত কাহিনি!আমি তো ভাবছি কে কারে মাই*রালাইসে আবার?”
“আরে তিসান না’কি তার বোনরে জানের থেকে বেশি ভালোবাসে।”
“তো? সবাই সবার বোনকে জানের থেকে বেশিই ভালোবাসে। আমার ভাই এত আঁকড়ু, খাড়ুস, সারাক্ষণ বকাবকি করে, আমাকে না বকলে তার খাওন হজম হয় না। কিন্তু আমি জানি আমাকে সে জানের থেকে বেশি ভালোবাসে। তাই বলে আমাকে কেউ রিজেক্ট করলে তার সাথে শত্রুতামি শুরু করবে না’কি? যদিও আমিই ওই পোলার হাড্ডির গুঁড়া করে ছাগলদের খাওয়াব। সে বিষয় আলাদা।”
“জাহান ভাই তোরে পছন্দ করছে ভাই। অন্যকেউ তোকে এক্সেপ্ট করার সাহসও পাবে না।”
“হুড় এই জাহান পাহানের গুষ্টি কিলাই। শালা একটা ভন্ড।”
“এমনে কইস না বোইন। কি হট দেখতে। উফফ তাকে দেখলে আমার নিশ্বাস আটকে যায়। এত হট হওয়ার পরও অন্য মেয়েদের পাত্তা দেয় না। আমি খেয়াল করছি তুই সামনে থাকলে অন্য কারো দিকে তাকায়ও না। জীবনে এর থেকে বেশি আর কী লাগে?”
“চুপ যা তো মাথা নষ্ট করিস না।”
“বোইন সিরিয়াসলি কইতাসি। ভার্সিটিতে উনার মতো হ্যান্ডসাম না থাকলেও হ্যান্ডসাম ছেলে তো আছে। সবগুলো মেয়ে ঘুরায়। দুইদিন পর পর গার্লফ্রেন্ড করে আর ছাড়ে। নাইট ক্লাবিংও করে। ইনফ্যাক্ট তিসানকে যে আজ এক্সেপ্ট করলি তুই জানোস এই কয়বছরে কমপক্ষে দশটা গার্লফ্রেন্ড করছে। ধরে আর ছাড়ে। আর জাহান….”
“জাহানের গুণীবাণী শেষ হলে চুপ কর মা। আমি কারো প্রতি ইন্টারেস্টেড না। না জাহান, না তিসান। আমি তো যাস্ট জাহানকে দূরে রাখার জন্য তিসানকে হ্যাঁ বলেছি।”

মৃণা মহুয়াকে টেনে বলে, “মহুমণি তুই ফাঁসবি দেখে নিস। এসব খেলা বন্ধ কর। চুপচাপ থাক দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”
“চুপ কর তো ভিতুর ডিম। কিচ্ছু হবে না। আর আমি চুপ থাকলে ওই জাহান আমার পিছু ছাড়বে তোর মনে হয়?”
“ছাড়বে না কেন?”
“কারণ ওই আমার মতো জেদি। আমি জানি ও এত সহজে আমার পিছু ছাড়বে না। আচ্ছা শুন তুই ভার্সিটি শেষে বাসায় যাবি। আমার একটু কাজ আছে।”
“সেদিনের কাহিনীর পর আমি তোকে একা ছাড়ব? অসম্ভব।”
“ভিতুর ডিমের মতো ফুঁটিস না-তো। যা বলেছি তা কর।”

ভার্সিটির সব ক্লাস শেষে মহুয়া আসে তিসানের আড্ডাখানায়। দক্ষিণ পাশের খালি রুমটাতেই তার দল আড্ডা দেয়।
“আসতে পারি?”
মেয়েলী কন্ঠে তিসান খানিকটা অবাক হয়ে পিছনে তাকায়, “তুমি?”
অনুমতি পাওয়ার আগেই মহুয়া রুমে প্রবেশ করে। প্রশ্নটা তিসানে মুখ দিয়ে বের হতে না হতেই সে তিসানের সামনের বেঞ্চে এসে বসে, “কেন নিজের নব্য গার্লফ্রেন্ডকে এত জলদি ভুলে গেলে না’কি? একটু আগে তো সবার সামনে হাঁটু গেড়ে প্রাপোজ করলে। আর কী ডায়লগটা না মেরেছিলে….”
তিসান আমতা-আমতা করে হেসে বলে, “আরে না না তোমাকে কীভাবে ভুলব? এমনি এখানে এসেছ বলে অবাক হয়েছি।”
“তো আসব না? আমার নতুন নতুন বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে আসব না? আচ্ছা এসব সাইডে রেখে বলো তো কী দেখে হঠাৎ একদিনে আমাকে পছন্দ হয়ে গেল?”
তিসান আমতা-আমতা করছিল। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছিল না। মহুয়া নিজেই আবার বলল, “অবশ্য আমাকে অপছন্দ করার কোনো কারণও নেই। তোমার চয়েজ ভালো আছে মানতে হবে। এখন বলো তো এত পছন্দের হয়ে লাভটা কী হলো? প্রাপোজ করার পর তো ভুলেই গেলে।”
“না আমি…”
মহুয়া তাকে কথা বলতেই দিলো না, “এই’যে দেখো তুমি প্রাপোজ করার পর আমি ক্যান্টিনে গেলাম। ওখানে জাহান এলো, সবার সামনে আমাকে হুদাই রাগালো, বিরক্ত করলো। তুমি সেখানে থাকলে তো এমন হতো না।”
ভ্রু কুঁচকায় তিসান, “জাহান এসেছিল!”
তারপর সে তাকাই তার সাথীদের দিকে। রাগী দৃষ্টিতে। তারা কি কিছুই খবর রাখে না? এতো অকর্মা কেন? জাহানকে জ্বালানোর জন্য সে ভার্সিটির সবার সামনে মহুয়াকে প্রাপোজ করল। যেখানে মহুয়ার প্রতি তার দুই পয়সার ইন্টারেস্ট নেই। না থাকলেই বা কী? জাহানের তো আছে। এই জীবনে প্রথম জাহান কোনো মেয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে। যে মেয়েকে জাহান চায়, সে মেয়েকে কখনো সে জাহানের হতে দিবে না।

“কোথায় হারালে?” মহুয়া তার মুখের সামনে তুড়ি মেরে জিজ্ঞেস করে।
“নাহ, কোথাও না। ডোন্ট ওয়ারি, আজকের পর থেকে তোমার দায়িত্ব আমার। তোমার ক্লাস শেষে আমাকে জানাবে। আমি তোমার সাথে যাব। আমি সাথে থাকলে জাহান তোমাকে কীভাবে বিরক্ত করতে পারে দেখে দিব।”
মহুয়া মনে মনে হাসে, “শালা ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা বুঝসোস আমাকে ইউজ করে জাহানকে জ্বালাবি? এহ আসছে! মহুয়া কারো খেলনা নয়, যে তোর কথায় চলবে। এবার দেখ আমি তোকে কীভাবে আমার আঙুলের ইশারায় ঘুরাই। এবার তোকে ইউস করে জাহানকে হারাবো আমি। ওর নাটকের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব। শালা ভন্ডামি ছুটাব।”

“তোমার ফোন নাম্বারটা দেও।” তিসানের কথায় ঘোর ভাঙে মহুয়ার। সে প্রশ্ন করে, “কেন?”
“তোমার সাথে যোগাযোগ তাহলে কীভাবে করব?”
“অহ হ্যাঁ তাইতো।”
“ক্যান্টিনে বা অন্যকোথাও যাওয়ার সময় আমাকে মেসেজ দিবে। এই চক্করে আমাদেরও ডেইট হয়ে যাবে কী বলো?”
কথাটায় মুখ বানায় মহুয়া, এক মুহূর্তের জন্য। মনে মনে ভাবে, “শালা ক্যাঙ্গারুর ঠ্যাঙ্গা আইলে আমারে ডেইটে নিতে। ছ্যাহ!”
সামনের ব্যাক্তিটিকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সে হেসে বলে, “কেবল ডেইটে আমার দুই প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কাবাবে হাড্ডি হয়ে থাকবো। ওদের ছাড়া কোথাও যাই না।”
“আই ডোন্ট মাইন্ড।”
“ভেরি গুড। মাইন্ড টাইন্ড করেও লাভ নাই। আমার বান্ধবী দুইটা আমার কলিজার টুকরা বুঝলে। ওদের ছাড়া আমার চলেই না। এখন আমি যাই দেরি হইয়া যাইতেছে।” বলে আরেক লাফ দিয়ে নেমে যায়। যাওয়ার সময় পথে মুহিবকে দেখে তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “ওহ মুড়িওয়ালা ব্রাদারও আছো দেখছি। কী খবর ব্রাদার মুড়ির ব্যবসা কেমন চলছে?”
মুহিব বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে। সোজা হেঁটে আসে তিসানের দিকে, “শায়ান ভাই কল করেছে।”
তিসান হেসে তার থেকে ফোন নেয়। জিজ্ঞেস করে, “আমার পার্টনারের প্রশ্নের উওর দিলি না?”
দূর থেকে মহুয়া লাফিয়ে যেতে যেতে বলে, “তার ঝাল লাগছে বেশি। পেটে মুটুর মুটুর করছে বলে চেহেরার এমন বিকৃতি ঘটেছে। পুরো লেঁজকাটা বান্দরের মতো দেখাচ্ছিলো।”
তিসান শব্দ করে হাসে। মুহিব পিছনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা চলে গেছে তখন ঝাঁজালো গলায় তিসানকে বলে, “হোয়াট দ্যা হেল ভাই। ওই মেয়ে আমার ইনসাল্ট করছে আর আপনি হাসছেন? একটা ব্যবস্থা তো করুন।”
“নিউ নিউ গার্লফ্রেন্ড হয়েছে আর তুই বলছিস ঝগড়া করতে। ছিঃ মুহিব! ছিঃ!এত বাজে চিন্তা তোর?”

“তোর আবার কোন নতুন গার্লফ্রেন্ড হলো? এতদিন কোনো মেয়ের কথা তো বলিস নি।” কলের ওপাড় থেকে প্রশ্ন আসে।
“আজই হলো। এতদিন তো আমিও জানতাম না।”
“কী উল্টাপাল্টা বকছিস?”
“জাহানের মন এই মেয়ের উপর এসেছে। আমার বোনের মন ভেঙে নিজের মনের রক্ষা পাবে? অসম্ভব! এতদিন অনেক উপায়ে ওকে কষ্ট দেবার চেষ্টা করেছি পারি নি। এবার ওর মনকে কেড়ে নেবার পর দেখি কি করতে পারে? আমার আদুরে বোন ওর জন্য এত কষ্ট পচ্ছে আর ও দিব্যি প্রেম করে বেড়াবে?”

ওপাশ থেকে বেশ কিছু মুহূর্ত নিরবতা পালন করে, তারপর অট্টহাসিতে মেতে উঠে ছেলেটা বলে, “ড্যাম ব্রো, ইউ আর এন ইডিয়ট। তুই এত বড় ইডিয়ট আমি তো ভাবতেও পাড়িনি। তুই কতদিন নাটক করতে পাড়বি? জাহানের সাথে তোর এত বছরের বন্ধুত্বে ছিলো। এক বছরে সব ভুলে গেছিস? কিন্তু ও তো ভুলবে না। ওই বাস্টার্ড অনেক চালু জিনিস। ওর পিছু জীবনে ছাড়বে না। তার’চে ভালো আমি আমার আইডিয়া শুন ওই মেয়েকে সোজা….”
তিসানের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, “আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি জানি আমি কি করছি। মহুয়া অনেক ভালো মেয়ে। ওর কোনো ক্ষতি আমি কখনো করব না। ইনফ্যাক্ট আমি কখনো কোনো মেয়ের ক্ষতি করতে পারি না।”
“ব্রো তুই আসলেই একটা ইডিয়ট। তোর দ্বারা কিছু হবে না। যদি ততদিনে তুই কিছু করতে পাড়িস তাহলে ভালো, নাহলে আমি বাকিটা দেখব। আমি শায়ানের হাতে কোনো কেস আসলে তার পরিণাম তুই জানিস। আর সেটা যদি জাহানের হয়। আচ্ছা রাখছি আমার ইউস্কির বরফ গলে যাচ্ছে।”
শায়ান ফোন কাটার পর তিসান চিন্তিত চেহেরায় তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। মহুয়ার কথা বলে কি বড়সড় ভুল করল সে?
.
.
“এই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না বন্ধ কর, নাহলে এক চড়ে ষোলোটা দাঁত ফেলে দিব। তারপর অর্ধেক দাঁত নিয়ে ঘুরে বেড়াইস।” মুরাদ বিরক্তি নিয়ে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বলল। তার সামনে মহুয়া দাঁড়িয়ে কান্না করছে এবং তাদের মা বাবা পাকোড়া খেতে খেতে নাটকের মজা লুফে নিচ্ছে।

মহুয়া নিজের কান্না বজায় রাখে, “আমার আগের ব্রান্ডের স্কুটিই লাগবে। তুমি এত কমদামী স্কুটি কেন এনে দিলে?”
“কমদামী কী রে? টাকা দিয়ে কিনছি না? টাকা কামানো কত কষ্ট জানিস?”
“কম তো টাকা কামাও না। কিপ্টামি করো খালি। কিপ্টুস কোথাকার!”

মুরাদ ল্যাপটপের স্কিন থেকে কপাল ভাঁজ করে তাকায় মহুয়ার দিকে। চোখে এক ফোঁটা পানি নেই অথচ শব্দ এমন করছে যেন কান্নায় ঘর কাঁপিয়ে দিবে। সে বিরক্তির স্বরে বলে, “এটা দিয়ে তোর ভার্সিটির চার বছর আরামসে কাটিয়ে দিতে পারবি। তারপর চাকরিতে ঢুকে নিজের টাকা দিয়ে নিজে কিনিস।”
“এহ চাকরি আবার কে করবে? পড়াশোনা শেষে একদম বিয়ে করে জামাইরে নিয়ে তার দেওয়া স্কুটিতে তাকে পিছনে বসিয়ে ঘুরবো। সে তোমার থেকে কম টাকা কামাইলেও তোমার মতো কিপ্টুস হবে না ভাই দেখে নিও। আমাকে রাণী করে রাখবে।”
“রাণী হয়ে রাখার জন্য রাজমহল লাগে।”
“আমার লাগে না। একরুমের বাসাতেও জামাইয়ের সাথে রাণী হয়ে থাকবো। জামাই আমাকে ভালোবাসবে তাতেই রাণী হয়ে থাকতে পাড়বো। ওই একরুমের বাসাও আমার কাছে রাজমহল।”
“সে এক রুমের বাসা হোক অথবা দালানকোঠার রাজমহল সেটা আগে নিজে তৈরীর যোগ্যতা রাখবি তারপর বিয়ে দিব। নিজের পা’য়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত তোর বিয়ে কিছুতেই হতে দিব না।”
“আমি কী তোমার পা’য়ে দাঁড়ানো না’কি? নিজের পা’য়েই তো দাঁড়ানো।”
“যা তো। বিরক্ত করিস না। কাজ করছি। এর এই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করবি না। কান্নার শব্দে আমার মাথা ব্যাথা করে।”
মহুয়া বিরক্ত হয়ে মেঝেতে লাথি মেরে বলে, “আমার কান্নার শব্দে মাথা ব্যাথা করে না? তোমাকে অভিশাপ দিলাম ভাইয়া তোমার হবু বউ আস্তো এক ছিচকাঁদুনী হবে। দিনরাত চোখ দিয়ে পানি ঝরালেও চোখে ট্যাঙ্কি খালি হবে না। মহুয়ার অভিশাপ ভয়ংকর। বৃথা যায় না।”
“হয়েছে যা যা।”
মহুয়া ভেংচি কেটে চলে যাবার পর তার মা বলে, “আসলে ওর অভিশাপ লাগে রে মুরাদ। তোর কপালে কাঁদুনি বউ পেলে কী করবি?”
“আহা মা, ওর কথায় কান দিও না তো। কাজ করতে দেও।” বলে সে নিজের ল্যাপটপে আবার ধ্যান দেয়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হেসে বিড়বিড় করে বলে, “আমার লক্ষ্মী বোনটা এত মিষ্টি অভিশাপ দিয়ে গেল!”
.
.
আজ সকাল সকাল মহুয়া এসেছে ভার্সিটিতে। নিজের প্রিয় ঘুমের ত্যাগ করে আজ এত সকালে উঠার একমাত্র কারণ জাহানকে পরাজিত করা। সে তিসানে সাথে এসে বসে আছে ক্যান্টিনে। তিসান ফোন স্ক্রল করছে আর মহুয়া আয়েশে খাচ্ছে।
মহুয়া তার স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই’যে মিস্টার বয়ফ্রেন্ড আপনার চরম শত্রু কোথায়? আপনি না বলেছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যে আসবে। আমি চরম লেভেলের বোর হচ্ছি।”
মুহিব তার কথায় বিরক্ত হয়, “তাহলে কি এখন তোমার বোর না হওয়ার জন্য পারফরম্যান্স করতে হবে সবার?”
“ভালো বলেছ তো ব্রাদার। একটা বান্দরনাচ দেখাও তো চটজলদি।”

কথাটা শুনে সবাই শব্দ করে হেসে দেয়। এমনকি তিসানও। মুহিব বিরক্তি নিয়ে বলে, “এই বেয়াদব মেয়ে এখন থেকে যেখানে থাকবে আমি সেখানে থাকব না। একবার শায়ান ভাই আসুক তারপর সে-ই একে সোজা করবে।”বলে সে চলে যায়।

মহুয়ার মন কৌতুহলী হয় সে তিসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” এই শায়ানটা কে? তোমার বন্ধু?”
তিসান মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
“আর জাহানের চরম শত্রু?”
প্রশ্নটা শুনে তিসানের মুখের হাসি উড়ে যায়, “হ্যাঁ।”
“কেন?”
তিসান প্রশ্নটার উওর দিতে চায় না। যে ঘটনার কারণে তাদের চারজনের গভীর বন্ধুত্ব নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে সে ব্যাপারে সে মনেও করতে চায় না। সে কথা ঘোরানোর জন্য বলে, “এখানের চিকেন প্যাটিস ট্রাই করেছ? অনেক মজা। দাঁড়াও তোমার জন্য অর্ডার দেই। অন্যকিছু নিবে সাথে?”

মহুয়া বুঝতে পাড়ে তিসান কৌশলে কথাটা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। সে-ও জোর দিলো না। ততক্ষণে জাহান প্রবেশ করেছে ক্যান্টিনে। ঢুকতেই তাদের দিকে দৃষ্টি পড়ে। তাকে দেখতেই মহুয়া চেয়ার টান দিয়ে তিসানের কাছে যেয়ে বসে। তার হাত ধরে বিড়বিড় করে বলে, “জাহান আসছে।”
তিসানও সচেতন হয়। মহুয়ার হাত শক্ত করে ধরে আদুরে কন্ঠে বলে, “বাবু এতটুকু খেলে হবে আরেকটু বেশি করে খাও।”
তার কথা শুনে মুখ বানায় মহুয়া। বিড়বিড় করে তিসানের কানে বলে, “এই জান বাবু টাবু কাবু লাভু বললে একদম মাথা ফাঁটায় দিব। এসব ন্যাকামি নাটকেও করবে না।”
তিসান জোরপূর্বক হাসে।

এতক্ষণে জাহান তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। চেয়ার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বসে। চেয়ারের হাতলে দুই হাত ভাঁজ করে রেখে চিবুক রাখে মুখের উপর। ধ্যান সহকারে দেখতে থাকে তাদের। তিসান বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে কি দেখছিস?”
“দেখছি নিজের ভাবির কত খেয়াল রাখছিস। একজন ভালো বন্ধু হবার গুণ না থাকলেও আদর্শ দেবর হওয়ার গুণ আছে।”
কথাটা শুনে দুজনেই ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে যায়। জয় শব্দ করে হেসে ওঠে।

তিসান বড় গলায় বলে, “গার্লফ্রেন্ড হয় আমার, গার্লফ্রেন্ড।”
জাহান কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। তাকাল মহুয়ার দিকে, “তোমার না’কি গতকাল সিটি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। আন্ডা পেয়েছ। আমার নাম দেখি তুমি ডুবিয়ে দিবে। যে জাহান জীবনে দ্বিতীয় হয় নি, সেখানে জাহানের জান আন্ডা পেয়েছে। ছিঃ! বাক্যটা শুনতেও তো বেমানান লাগে।”
মহুয়া দেখে আশেপাশের সকলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই লোক সারা ভার্সিটিকে তার রেজাল্ট জানাতে উঠে পড়ে লেগেছে কোন দু:খে?

বিরক্তিতে তার চোখমুখ কুঁচকে গেল। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাহানের দিকে। ফোঁসফোঁস করতে থাকে রাগে, ক্ষোভে।
জাহানের তার এমন চেহেরা দেখে হাসি পায়, “এভাবে তাকায় না মাই লাভ, আমার বুকে তুফান উঠে তো।”
“বুক ছিঁড়ে জ্বলায় শুকনা মরিচ লাগায় দিব।”
“হাউ সুইট।”
তিসান মহুয়ার কথা শুনতেই ভয়ে তার হাত ছেঁড়ে দিলো।
মহুয়ার রাগ বাড়ে। তার ইচ্ছা করে রাগে জাহানের চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়তে। কিন্তু পরক্ষণেই তার এই ভাবনা মাটিচাপা দেয়। এই জাহানের শুধু চুলটাই তো তার ভালো লাগে। এত ঘন কোঁকড়াচুলোর বাহার দেখে তার নিজের মাঝেমধ্যে হিংসা হয়। তার চুল এত সুন্দর হলো না কেন!

তার ধ্যান ভাঙে মৃণার উপস্থিতিতে, “তুই এত সকালে আসবি এটা তো কাল্পনিক ব্যাপার স্যাপার!”
“আর তোর দেরিতে আসা। তোকে না বলেছিলাম পনেরো মিনিট লাগে আসতে।”
“মিস লেট লতিফের জন্য দেরি হয়ে গেল।”
তার কথা মাটিতে পড়ার আগেই মোহ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে মহুয়াকে, “জান মিতা আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।” তারপর ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে,”জানিস আপুর সাথে গতকাল লেহেঙ্গা যে কিনতে গিয়েছিলাম। সাথে আমাকে একটা লেহেঙ্গা আরেকটা শাড়ি কিনে দিয়েছে আব্বু।”
“বুঝতে পাড়ছি না তুই নিজের বোনের বিয়ে নিয়ে খুশি না’কি লেহেঙ্গা নিয়ে।”
“বিয়ে হলেই তো লেহেঙ্গা পড়তে পাড়ব তাই না?”
“বুঝছি আমি। কিন্তু বাবাজীবন তুমি যে একদিনে কতকি মিস করে ফেললা তা কি জানো?”
“কী মিস করলাম আমি?”

তিসান দেখল একটি মেয়ে দৌড়ে এসে মহুয়াকে জড়িয়ে ধরেছে। তার কোমড় অব্দি গাঢ় বাদামী রঙের হাইলাইটেড চুল ছাড়া সে কিছু দেখতে পাড়লো না। তার চেহেরাটা দেখা যাচ্ছিল না। মহুয়াকে ছেড়ে তার সাথে কথা বলার সময়ই তিসান তার চেহেরার ঝলক দেখতে পায়। দেখতেই তার হৃদয় কেঁপে উঠে। দাঁড়িয়ে যায় সাথে
সাথে ভালো করে দেখার জন্য। চেহেরাটা দেখতেই সে চমকে উঠে। যে মেয়েটাকে সে এতদিন খুঁজছিল সে মহুয়ার বান্ধবী? লাইব্রেরীতে মেয়েটাকে সে দেখেছিল। তারপর থেকে চোখ বন্ধ করলেই মেয়েটার মোহনীয় রূপ তার চোখে ভাসে। আজও কি অপরূপা লাগছে তাকে। হলুদ রঙের জামাতে হলুদিয়া পাখি লাগছে যে। জানালা দিয়ে আসা রোদ্দুরে তার ত্বকের রঙ স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করছে। চিকচিক করছে তার খোলা আঁকাবাঁকা কেশ। তিসানের হৃদয়খানি অস্বাভাবিক হয়ে গেল। সূক্ষ্ম ব্যাথা হলো। যে কেউ ধনুক থেকে তীর ছুঁড়ে মেরেছে তার এই হৃদয়ে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়ানো যুবতী রমণীর পাণে।

জোহান তিসানের দৃষ্টি দেখে কপাল কুঁচকে তাকায়। এক মুহূর্তের জন্য রাগে তার চোয়াল শক্ত হলেও সে খেয়াল করে তিসানের দৃষ্টি মহুয়ার দিকে নয়, তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। সাথে সাথে সে বাঁকা হাসে, “নাউ দ্যাটস ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং।”
তার গাবলি চুল আঙুল দিয়ে আঁচড়ে পিছনে নিয়ে মাথায় আসা দুষ্টু বুদ্ধিটা কাজে লাগায়, “হে লাভ, তোমার বান্ধবীকে গতকালের নিউজ দিবে না? নিজের বয়ফ্রেন্ড এর সাথে পরিচয় করাও। গো এহেড।”
তিসান তার দিকে তাকায় অবাক দৃষ্টিতে। মুহূর্তে তার কাশি চলে আসে। সে সামনে থাকা কোল্ড ড্রিংক হাতে নেবার পূর্বেই জোহান গ্লাস তুলে চুমুক নেয়। তার এমন ভাব যেন কোনো নাটকমঞ্চে নাটক দেখছে।

মোহ মহুয়ার হাত ধরে ধীরসুরে বলে, “তুই জাহান ভাইয়ের প্রাপোজাল এক্সেপ্ট করে নিয়েছিস? সেদিনের কাহিনীর পরও?” তারপর সে পিছনে ফিরে তাকায় জাহানের দিকে, “আই মিন রিজেক্ট করার মতোও না। বাট একটু ঘুরাবি তো। অন্তত দুই সাপ্তাহ।”
“আরে এই লেজকাটা হনুমানকে আমি এক্সেপ্ট করব না’কি? এত খারাপও দিন আসছে আমার?”
মোহ কপাল কুঁচকায়,”তাহলে কে?”
মহুয়া তিসানের বাহু টেনে এনে দাঁড় করায় মোহের সামনে, “এ…”
“এ আবার কে? এক মিনিট আপনাকে আমি কোথাও দেখেছি।”
“মনে আছে তোমার? ওইদিন লাইব্রেরিতে…”
মোহ তার কথা কেটে মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু উনার কথা তো আমাদের বলিস নি আগে। কে উনি? আর হঠাৎ একদিনে কীভাবে কি হলো?”
“বলব নে পরে।”
“মহুয়ার বাচ্চা এবার যদি তুই উলটা কোনো কাহিনী ঘটাস আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।”

মহুয়ার মুখ চুপসে যায়। এরপর মোহ যদি জানে সে নাটক করছে জাহানকে পরাজিত করার জন্য তাহলে তার অবস্থা আরও খারাপ করে দিবে। সে আমতা-আমতা করে বলে, “আরে তোর সাথে দেখা হয় নি তো কি? আমাদের তো আগে অনেকবার দেখা হয়েছে। সে প্রথমদিন থেকে। প্রথম দেখায় ভালো লেগে গেছে। লজ্জায় তোকে বলতে পারি না।”
“তোর লজ্জাও আছে। অষ্টম আশ্চর্যের ব্যাপার।” বিস্মিত সুরে বলে মোহ।

জাহান ফিক করে হেসে দেয়। একতো মোহের ভয় এর উপর জাহানের রসিকতার হাসি মহুয়ার গা’য়ে সুঁচের মতো লাগল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “হাসলে এক ঘুষিতে ষোলোটা দাঁত ফেলে দিব। হনুমান ক্যানক্যানা একখানা!”
জাহান তার কথায় ধ্যান না দিয়ে তাকায় তিসানের দিকে, “আরে তুই কিছু বলিস না কেন? কীভাবে প্রাপোজ করেছিলি তা বল।”
তিসান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় জাহানের দিকে।

মহুয়া বলে, “আরে হ্যাঁ তোকে তো বলতে ভুলেই গেছি। তিসান আমাকে অনেক বড় এক গোলাপের বুক-এ দিয়ে প্রাপোজ করেছে। দেখেই আমার মনে পড়ে তোর কথা। তোর আবার গোলাপ অনেক পছন্দ কি-না! তোকে দিতাম কিন্তু তুই তো এলি না। ”
“তোর গোলাপ আমি নিব কেন? জানিস না অন্যের জিনিস নেওয়া আমার পছন্দ না। সে কথা বাদ দে,” সে তাকায় তিসানের দিকে, ” আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো ভাইয়া।”
“ভা…ভাইয়া? মহুয়া আমাকে নাম ধরে ডাকে। তুমিও ডাকতে পারো।”
“একদম না। আমি বড় সবাইকে ভাইয়া/আপু বলেই সম্বোধন করি। ইনফ্যাক্ট সেইম এইজরও।”
মহুয়া তার কথায় হাত ঢুকিয়ে বলে, “আমার ফিউচার দুলুভাইয়ের প্রতি অতি লয়েল কি-না!”

মোহ মুচকি হাসে। তার কথা সম্পূর্ণ করে, “আর মহুয়ার সাথে কিছু থাকলে তো আপনি আমার ভাই-ই হন। তাই না?”
“একদম।” হঠাৎ জাহান ভারী উচ্চস্বরে বলে উঠে, “গার্লফ্রেন্ড হয়, ওর গার্লফ্রেন্ড।”
সকলে জাহানের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। তার হাসি দেখে মহুয়া বিড়বিড় করে বলল, “এই লাঙ্গুর আবার কি নেশাযুক্ত আঙুর খেয়ে এসেছে? এমন বিহেভ করছে কেন?”
এতক্ষণে মৃণার কন্ঠ শোনা গেল, “ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। জলদি চল।”
মহুয়া তিসানের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাই মিস্টার বয়ফ্রেন্ড। কল দিব নে ক্লাস শেষ হলে।” তারপর জাহানের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে মৃণার হাত ধরে চলে যায়।
মোহও জাহানের দিকে তাকায়। তার এমন হাসিহাসি মুখের রহস্য উদ্ভাবনের চেষ্টা করে। পারে না। তারপর তিসানের দিকে তাকিয়ে বিদায় নেয়, “বাই ভাইয়া।”
বলে সে-ও চলে যায়।

“ভাইয়া” ডাক শুনে তিসানের বুকের বাঁ পাশে ব্যাথা বাঁধে। সে এত বড়সড় একটা বাঁশ খাবে ভাবতেও পারে নি। না পাড়ছে সইতে, না পাড়ছে কিছু বলতে। তার হৃদয়ের মোহিনী একমাত্র মেয়ে যাকে দেখার সাথে সাথে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় অথচ নিজ হাতে এত বড় গন্ডগোল তৈরি করে নিলো সে?
ভেবেই রাগে টেবিলে ঘুষি মারে, “শীট!”
তারপর টনক নড়ে তার। আজও নাম জিজ্ঞেস করা হলো না। নাম কী হতে পারে এই অপরূপা সুন্দরীর?

“মোহ। মধুরা মোহ।” জাহানের কথায় ধ্যান ভাঙে তিসানের।
“কী?” কপাল কুঁচকে নেয় তিসান।
“মহুয়ার বান্ধবীর নাম।”
তিসান তার নাম শুনে আরও মুগ্ধ হয়। বিড়বিড়িয়ে বলে, “পার্ফেক্ট। ওর সাথে এই নামটা পার্ফেক্ট যায়। ওর সৌন্দর্যের সাথে মিলে যায়। মধুরা মোহ। তোমার মোহে আমি ডুবে গেছি। এই প্রথম তিসান ইহসান কারো থেকে দৃষ্টি সরাতে অক্ষম হয়েছে। তোমার মধ্যে সে আকর্ষণ আছে। তোমার নামের মধ্যেও।”
আবারও জাহানের কথায় ধ্যান ভাঙে তার।
“শুনেছিস জয় মহুয়ার বান্ধবী কী বলল?”
“কী ভাই?”
“অন্যের জিনিস নেওয়া ওর পছন্দ না।”
“শুনেছি তো ভাই কেন?”
“কিছু না। কিছু মানুষ অন্যের জন্য কুয়া খুদতে যেয়ে নিজের জন্য খাল তৈরি করে নিজেই লাফ দেয়।”

তিসান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে জাহান বাঁকা হাসে। সিগারেট জ্বালায়। তিসান রাগে, ক্ষোভে, বিরক্তিতে নিজেই বেরিয়ে যায়। সত্যিই তো। সে জাহানের মন কষ্ট পেতে দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু তা তো হলোই না। উল্টো সে ফেঁসে গেল। সে নাটক করছে। মহুয়াও তাদের ব্যাপারটা নিয়ে গম্ভীর না। কিন্তু নামের হোক, কিছু দিনের হোক, একটি সম্পর্কের নাম হলো। দু’দিন পর এই নাটক শেষ হবে। কিন্তু মোহ কী জীবনে তার কাছে আসবে? না, তার মোহকে লাগবেই। যে মেয়ের কারণে তার হৃদস্পন্দন থেমেছে তাকে তো লাগবেই।

চলবে…