মেঘের খামে পর্ব-১০+১১+১২

0
4

#মেঘের_খামে
পর্ব ১০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“নতুন স্কুটি নিয়েছ দেখি। ওই স্কুটি পিংক বলে তার নাম ছিলো পিংকি। এইটা তো দেখি ডার্ক ব্লু। তাহলে কী ডংকি হবে? তোমার স্কুটি তো তোমার সাথে মিল থাকাই লাগে।” জাহানের কথায় পার্কিং স্পটেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে মহুয়া। একারণেই গত একসাপ্তাহ ধরে সে স্কুটি আনে নি। আর আজ আনতেই তার এই হনুমান টিকটিকির সামনে পড়তে হলো।

রাগে মহুয়ার গাল মুখ লাল হয়ে যেতে দেখে জাহান শুধায়, “কিউটের কথা বলছি। তুমি কিউট, তোমার স্কুটি কিউট, ডংকিও কিউট।”
“এই মিস্টার হনুমান ভালো হচ্ছে না কিন্তু। মাথা ফাটায় দিব একদম।”
“ফাঁটানোর সময় বলো। মাথা পেতে নিব।”
তখন জয় কথার মাঝে হাত ঢুকায়, “ভাবি এটা ঠাডা মিথ্যা কথা, জাহান ভাই কারো সামনে মাথা নত করে না। জীবনেও না। যে বাবা তার আদর্শ তার সামনেও করে না।”
মহুয়া বিরক্তির স্বরে বলে, “এই লোকের ব্যাপারে কিছু শুনতে চেয়েছি। আর দেখো জয় ব্রাদার ভাবিটাবি ডাকবা না। মাথা গরম হয়ে যায়। আমার মাথা গরম হলে তোমার মাথা কখন গায়েব হয়ে যাবে টেরও পাবা না।”
বলে হনহনিয়ে চলে যায় সে।

জাহান নিজের বাম হাতের প্রথমা আঙুলের সিলভার রিংটি খুলে দুই আঙুলের মাঝে ধরল। আংটির গোলাকার ফাঁক দিয়ে মহুয়াকে যেতে দেখে বাঁকা হাসে, “তেজ দেখেছিস জয়? জাহানের জানেরই এমন তেজ মানায়। ওর এই তেজ ওর প্রতি আমার আকর্ষণটা বাড়িয়েই তুলছে। জাহান কারও কাছে পরাজিত হয় না। যে মেয়ের কাছে যে পরাজিত হয়েছে সে মেয়ে পুরষ্কার হিসেবে আমার হৃদয়টাই ডিসার্ভ করে তাই না?”
জয়ের উওর না পেয়ে সে তাকায় তার দিকে, “এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
“ভাই শায়ান আজ দেশে আসবে। আজ ফ্লাইট।”

কথাটা শোনামাত্র জাহানের চোখমুখও গম্ভীর হয়ে যায়, “মহুয়ার সাথে আমাদের দুইজন লোক রাখবি। আড়ালে। ও টের পেলে উল্টো কাহিনি ঘটাবে। এতটুকুতেই নিজেকে খুব শক্তিশালী ভাবে। অথচ মানুষ কত ভয়াবহ হতে পারে তার ধারণাও তার নেই।”
“ভাই এখন থেকে লাগাব? তাসিন ভাইও তো….”
তার কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই জাহান বলল, “তাসিন নাটক করতে পারে কিন্তু কারো ক্ষতি কখনো করবে না। শালা শুধু উপরেই যত কঠিন ভাব দেখায় ভেতর দিয়ে নরম, ভিতুর ডিম। ইনফ্যাক্ট শায়ান আসলেও ওর সাথে থাকলে মহুয়া সুরক্ষিত থাকবে। তাসিন আর শায়ান দুইজন আমার ছোটবেলা থেকে চেনা। ওদের শিরায় শিরায় চিনি। কে কতটুকু যেতে পারে তাও জানি।”
.
.
ভার্সিটির ক্যান্টিনের পাশেই একটা লেক ছিলো। সেখানে খোলা জায়গাতে নতুনভাবে ক্যান্টিনের জন্য জায়গা তৈরি করেছে। কয়েকটি বেঞ্চ টেবিলের সাথে রাখা। মহুয়া একটি বেঞ্চে যেয়ে বসে তাসিনের পাশে, “হোয়াটসঅ্যাপ মিস্টার বয়ফ্রেন্ড?”
তাসিন জোরপূর্বক হেসে তাকায় মহুয়ার দিকে। সে একসাপ্তাহ ধরে চেষ্টা করছে মহুয়ার সাথে ব্রেকাপ করার অথবা তাকে সত্যি বলার। কিন্তু মেয়েটা কষ্ট পাবে বলে করতেও পাড়ছে না। এই কয়দিনে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি ও মিশুক। তাকে দেখে তার বোনের কথা মনে পড়ে তার। তাই তাকে কষ্ট দিতেও খারাপ লাগছে।
তিসান আমতা-আমতা করে বলে, “একটা কথা বলার ছিলো তোমাকে।”
“বলে ফেলো। তিনদিন ধরে এই এক কথাই বলে যাচ্ছ। কিন্তু বলার সময় অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে দেও। বলো তো কি হয়েছে?”
তিসান আমতা-আমতা করে। কিন্তু বলতে পাড়ে না আজও। শেষমেশ আবারও কথা ঘুরায়, “কী খাবে বলো?”
“উফফ আপনি কী বলতে চান তা না জানা পর্যন্ত কৌতুহলে আমার পেটে গুড়ুম গুড়ুম করবে। বলে ফেলো তো দেখি।”
“আসলে…না মানে…কীভাবে যে বলব?”
“মুখ দিয়ে বলবেন নাক দিয়ে কি বলা যায় না’কি?”
“বললে তুমি কী আমাকে মাফ করবে মহুয়া?” আহতসুরে প্রশ্ন করল তাসিন।
“হেয়ালি না করে চটজলদি বলে ফেলুন তো।”
“আসলে আমি না… আমি তোমাকে বোনের চোখে দেখি।”

কথাটা শুনে অবাক না হয়েই মুখ বানাল মহুয়া, “গার্লফ্রেন্ড থেকে বোন? কোন পথে চলছো ভাই?”
“আসলে গত সাপ্তাহে আমি যখন জানতে পারি জাহান তোমাকে পছন্দ করে তখন…. ”
“তখন ভাবেন জাহানের সামনে নাটক করলে ও কষ্ট পাবে তাই না?”
“তুমি বুঝে নিয়েছ?” তাসিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
“আমি আবার বড্ড বুদ্ধিমতী কি-না? আমি তো প্রথমদিনই বুঝেছি। কিন্তু আপনার গিলটি ফিল করার প্রয়োজন নেই৷ আমিও নাটকই করছিলাম। কিন্তু জাহানকে কষ্ট দেবার জন্য নয়, উনি কষ্ট পাবেও না। কারণ উনিও তো আমাকে পছন্দ করার নাটক করছিল।”
“কী? আমি নাটক করছিলাম সেটা তুমি জানতে আমিও জানতাম, অর্ভিয়াস। তুমি নাটক করছিলে তোমার জানারই কথা। ওকে। কিন্তু জাহান নাটক করছে মানে? এটা কে জানে? কে বলল তোমায়?”
“কাওকে বলতে হবে কেন? আমি বুঝি না? আমি সব বুঝি। তার সাথে আমার টম এন্ড জেরির সম্পর্ক। একে অপরকে সহ্য করতে পারি না। আর হঠাৎ একদিনে তার প্রেম উতলে পড়ছে? সব নাটক বুঝলেন। আমাকে পরাজিত করার নাটক। কিন্তু আমি চাচ্ছি নাটকটার কন্টিনিউ করতে। তোমার আমার বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের। ওই জাহানকে আমি জিততে দিব না।”

তাসিন হাসল। তার বলতে ইচ্ছা করল, “না, তুমি মোটেও বুদ্ধিমতী না। যে ছেলে মেয়েদেরকে আশেপাশেও ঘেঁষতে দেয় না সে তোমায় চোখে চোখে রাখে, কেবল তোমারই কাছে আসে, কেবল তুমি আশেপাশে থাকলেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি থাকে। সে তোমার সাথে নাটক করছে? তুমি কী জানো ভালোবাসা শব্দটা জাহানের কাছে কতটা পবিত্র? ওর মা নিজের ভালোবাসার জন্য নিজের রাজমহল ছেড়েছে, ওর বাবা তার ভালোবাসার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন রাজমহল গড়েছে কেবল তার রাণীর জন্য। তাদের ভালোবাসার অংশের কাছে প্রেম কোনো খেলা হতে পাড়ে না।”
কিন্তু সে কিছু জানাল না মহুয়াকে। জাহানের ভালোবাসাকে সে সম্মান করলেও সে চায় না জাহান তার ভালোবাসা পাক। যেমন তার বোন পায় নি। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “আমার বোনও তো ওর কাছে এই ভালোবাসা চেয়েছিল। আমার বোনকে ও যে কষ্ট দিয়েছ তার জন্য কখনো ক্ষমা করব না ওকে।”

আচমকা একটা মেয়ে এসে তাসিনের চোখের উপর হাত রাখে। হঠ্যাৎ তার চোখের উপর নরম কিছু টের পেয়ে বিস্মিত হয় তাসিন। সে নরম তুলতুলে তার দুটো ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করে ব্যক্তিটি কে?

টের পায় না। ক’টি মেয়ের নাম মাথায় আসে কিন্তু বলে না। এক নাম ভুল বললে অন্য নাম বলতে হবে। মহুয়া তো মোহের বেস্ট ফ্রেন্ড। এত মেয়ের নাম তার মুখে শুনলে মোহের সাথে তার ভবিষ্যৎ শেষ। এই ভুল সে হতে দিবে না।

“চিনতে পাড়ছি না।” তাসিন সাবধানতা বজায় রেখে বলল।
হাত দুটো’ সরে তার তার চোখ থেকে। তার বাঁ’পাশ থেকে একটি মাথা ঝুঁকে আসে। উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বক, কাঁধ পর্যন্ত চুল, টানা টানা চোখ, বাচ্চামো মুখশ্রী চেহেরার অধিকারী একটি মেয়ে। সে তার পাতলা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমাকে তুমি চিনতে পাড়লে না তাসিন ভাইয়া?”

তাকে দেখে তাসিনের ঠোঁটেও হাসি এঁকে উঠে, “জিনি তুই?” উঠে দাঁড়িয়ে সে একপাশ থেকে জিনিকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, “তোকে হঠাৎ এখানে আশা করিনি।”
“কলেজে আগামীকাল নতুন বর্ষের নবীনবরণ। আমরা সিনিয়ররা দায়িত্ব নিয়েছি। এদিকে এসেছিলাম বান্ধবীরা জাহান ভাইয়ার সাথে দেখা করবে। সব বান্ধবীরা জাহান ভাইয়াকে পেয়ে আমাকে আর চিনে না। এই সুযোগে তোমাকে খুঁজে চলে এলাম।”

এতক্ষণে জিনির দৃষ্টি গেল মহুয়ার উপর। তার কপাল কুঁচকাল। হাসিমাখা মুখে অসন্তুষ্টির ছায়া পড়ল। গভীর স্বরে প্রশ্ন করল, “উনি কে?”
তাসিন উওর দিতে চাইল। কিন্তু কি উওর দিবে ভাবতে পারে না। মহুয়া তার কাছে তার বোনের মতো লাগে কিন্তু সে রিলেশনের নাটকও করেছিল। আবার তাদের মাঝে বন্ধুত্বেরও সম্পর্ক নেই তেমন।

তার চিন্তার মাঝেই মহুয়া হাসিমুখে উওর দিলো, “আমি তাসিনের ফ্রেন্ড। মহুয়া। তুমি?”
উওরটাও যেন জিনিকে সন্তুষ্ট করে নি। তার কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়।
মহুয়া তার এমন চাহনিতে থতমত খেয়ে যায়। মেয়েটাকে সে চিনে না। তাহলে এমনভাবে তাকাচ্ছে কেন?
মহুয়া আবার বলল, “তুমি দেখতে তো অনেক প্রিটি। একদম বারবি ডলের মতো।”
প্রশংসাতেও মেয়েটার মন গলে না। সে তাসিনের বাহু শক্ত করে ধরে বলে, “ভাইয়া তুমি আমাদের সাথে যাবে? চলো না যাই।”

তাসিন দ্বিধাবোধ করল। আলতো করে জিনির হাত তার বাহু থেকে ছাড়িয়ে বলল, “ক্লাস আছে। তুই যা, আরেকদিন দেখা করব।”
জিনি গোমড়া মুখ করে বলল, “বাসায় আসো না একদিন। আমি তোমাকে কফি বানিয়ে খাওয়াব।”
তাসিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আসব নে একদিন।”
“আসবে না তুমি। জাহান ভাইয়ার সাথে নাহয় তোমার ঝামেলা। শাস্তি আমাকে দিচ্ছো কেন?”
কথাটা শুনে তাসিনের মুখে বিরক্তির ভাব দেখা যায়, “তোকে কীভাবে শাস্তি দিচ্ছি আমি বুঝতে পাড়ছি না।”
“বুঝো, তুমি সবই বুঝো। বুঝেও আমাকে কষ্ট দেও। গেলাম আমি।”
জিনি যাবার পূর্বে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে গেল মহুয়ার দিকে।

মহুয়া বুঝে উঠলো না। এক অচেনা মেয়ে তাকে দেখে এমন রাগছে কেন। সে তাকাল তাসিনের দিকে, “ও কি কোনোভাবে জাহানের সাথে রিলেটেড?”
“হ্যাঁ, জাহানের একমাত্র বোন। জিনি। কীভাবে বুঝলে?”
“দু’জনের চোখদুটো একদম সেইম। চোখের নিচটা কেমন কাজলমাখা। কালোমণির টানাটানা চোখ দুটো।”
“বাহ খুব খেয়াল করে দেখেছ জাহানের চোখ। আর বলো তার প্রতি তুমি একবিন্দুও আকর্ষণ ফিল করো না?”
তাসিন বেঞ্চে পুণরায় বসলো।
“আমি সবার চোখে চোখ রেখে কথা বলি। সবার বলতে সবার। এতে আমি কনফিডেন্স পাই। আর ওই লেজকাটা বাঁদরের প্রতি আমার দুইপয়সার ইন্টারেস্ট নেই।”
“আচ্ছা।”

মহুয়া গালে হাত দিয়ে তাকায় তাসিনের দিকে। প্রশ্ন করে, “মেয়েটা আপনাকে পছন্দ করে তাই না?”
“বুঝে গেছ?”
“অন্ধ ব্যক্তিও বুঝে যাবে। তাহলে তুমি জাহানকে ভাঙতে চেয়েছ, ওকে ইউস করেন নি কেন?তোমার কাজ জলদি হয়ে যেত। জাহানের প্রেমে পড়ার অপেক্ষায় ছিলেন কেন?”
“কী বলো? জিনিকে আমি কষ্ট দেবার কথা ভাবতেও পারি না। ছোট থেকে দেখে এসেছি ওকে। আমি জাহানের মতো না’কি? ও তো আমার বোনের কথা চিন্তাও করল না।”
“ওহ… আচ্ছা জিনি তোমাকে কয়বছর ধরে পছন্দ করে?”
“জানি না। তবে তিনবছর আগে কনফেস করেছিল।”
“তুমি রিজেক্ট করে দিয়েছ?”
“অফকোর্স।”
মহুয়া আফসোসের সুরে বলল, “আহারে! কিন্তু কেন?”
“ওকে আমি ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। আমার ছোটবোনের মতো দেখে এসেছি। ওর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস আসে না, আসবেও না।”
“হুম বুঝলাম। পয়েন্ট আছে। আচ্ছা ব্যক্তিগত আরেকটা প্রশ্ন করি?”
“করো।”
“তোমার বোন জাহানকে কয়বছর ধরে পছন্দ করে?”
“এক থেকে দেড়।”
মহুয়া তাচ্ছিল্য হাসে, “সে হিসেবে তো জাহানের আগে থেকে তোমার সাথে শত্রুতা করার কথা ছিলো।”
কথাটা শুনে তাসিন চকিতে তাকায় মহুয়ার দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে।
মহুয়া ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একগাল হেসে বলে, “আমার ক্লাসের সময় হয়েছে। টাটা ব্রোফ্রেন্ড।”

মহুয়া যাবার পরও তাসিন একইরকম তাকিয়ে রইলো। মহুয়ার কথাগুলো ভাবাল তাকে। হঠাৎ তার অন্তঃস্থলে ব্যাথা অনুভব করল।
.
.
আজ মোহ এবং মৃণা কেউ-ই আসে নি। মোহ আসবে না সে জানতো। আগামীকালই তার বোনের বিয়ে। সে আসতে পাড়বে না। সেও আজ রাতে হলুদে যাবে অনুষ্ঠানে। মৃণা একবারে আগামীকাল যাবে। আগামীকাল তাদের বাসায় মেহমান আসার কথা। তাই মেহমানদের সাথে দেখা করেই আসবে। কিন্তু মৃণার আজকে এভাবে না আসার ব্যাপারটা সে বুঝলো না।

তাই সে দেরি করল না। একটা ক্লাস করেই আজ ফাঁকি দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। পার্কিং থেকে নিজের স্কুটি নিতে যেয়ে আবারও দেখা হলো জাহানের সাথে। তারা বসে সিগারেট খাচ্ছিল। বিরক্ত লাগলো মহুয়ার তাদের দেখে। এড়িয়ে যেতে চাইল কিন্তু স্কুটিতে উঠতেই জাহানের ডাক শুনল, “এই ধানিলংকা দাঁড়াও।”
মহুয়া কপাল কুঁচকে তাকাল তার দিকে। জাহান গাড়ির উপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামে, জিজ্ঞেস করে, “ক্লাস না করে এখানে কী?”
“তোমার জানতে হবে কেন?”
“না বললে স্যারের কাছে বিচার যাবে।”
“দিও তাহলে। আমি ভয় পাই না’কি?”
“এইটুকুনি তুমি, এত তেজ আসে কোথা থেকে?”
“দেখো সকালে ক্যান্টিনে যেয়েও খাই নি। মাথা গরম।”
“খাও নি? খাও নি কেন? সকালে না খেয়ে বেরোবে কেন তুমি? শরীরে দুর্বলতা আসবে না? কী খাবে বলো? আমি
আনাচ্ছি।” জাহানের কন্ঠে স্পষ্ট অস্থিরতা।

মহুয়া পিছিয়ে গেল তার থেকে। বিরক্তির স্বরে বলল, “দূরে সরে কথা বলো তো। সিগারেটের গন্ধে আমার বমি আসে। আচ্ছা একটা কথা বলো, তোমরা কি সারাক্ষণ শুধু সিগারেটেই খাও? আমি আজ পর্যন্ত তোমাকে সিগারেট ছাড়া অন্যকিছু খেতে দেখলাম না।” তারপর বিরক্তি নিয়ে বলে, “সিগারেট খেয়ে নিজের শরীর দূষণ করে আবার পরিবেশও। ছ্যাঁহ!”
এইটুকু বলে সে ভেংচি কেটে চলে যায়।

জাহান সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। জয় তার পাশে এসে দাঁড়ায়, “কী ভাবছেন ভাই?”
“ও’কি মাত্র আমাকে কেয়ার করল?”
“কই?”
“দেখ ভেবেছে আমার শরীর দূষণ হবে। মানে আমার স্বাস্থ্য নষ্ট হবে। আমার কত কেয়ার করে।”

পিছন থেকে আবিদ বলল, “ভাই আপনার কেয়ার করে না। ভাবির নিজের খারাপ লাগে বলে কথাটা বলেছে।”
“শুন, এখন আমি ওর উপর কেবল ইন্টারেস্টেড না। আমি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। ওর রাগ, হাসি, দুষ্টুমি, কান্না,কথা সব আমার ভালো লাগছে। আর আমার ভালো লাগার জিনিসকে আমি কত আলগে রাখি তোরা জানিস তাহলে ভালো লাগার মানুষের খারাপ লাগাটা তো আমি সহ্য করতে পাড়ব না।”
“কী বলতে চাচ্ছেন ভাই?”
“আজ থেকে সবার সিগারেট অফফ।”
সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, “কী বলছেন ভাই?”

জাহান এখানেই থামলো না, আরও বলল, “ভার্সিটির আশেপাশের কোনো দোকানে সিগারেটের অস্তিত্ব না থাকে। লাগলে মাসিক টাকা দিয়ে দিবি ওদের। ক্ষতিটা পুষিয়ে দিবি। ভার্সিটিতে আজ থেকে সিগারেট ব্যান। আচ্ছা আমিও আসি তাহলে। কাজ আছে। আজ তো আর আমার লাভকে দেখা হবে না। বরং কাজেই যাই।”
সে বোম্ব মেরে সেখান থেকে রওনা দিলো। সকলে বিস্ময় নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।

আবিদ তাৎক্ষনিক জয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়, “জয় ভাই এ’কি করল? আপনি জাহান ভাইকে বুঝান প্লিজ। আমরা ভাত ছাড়া বাঁচতে পাড়ব সিগারেট ছাড়া না। আমাদের ট্রু লাভকে এভাবে ভাই লাথি মেরে নিভাতে পারে না।”
“ভণিতা বন্ধ কর। ভাই জানলে তোরে লাথি মেরে নিভায় দিবো।”
“তাই বলে রাস্তাঘাটের সিগারেট বন্ধ করে দিবে? সরকারও তো এত নির্দয় হতে পাড়ে নি, জাহান ভাই কেমনে পাড়ল?”
“ভাই যে ড্রোন উড়িয়ে সিগারেট খাওয়া লোকদের ধরে পুলিশ কেস করতে বলে নাই এই ভাগ্য। উনি পাড়লে দেশে সিগারেটের বিরুদ্ধে আইনপাশ করায়।”
“কী যা-তা বলছেন ভাই? ভাবির সিগারেট খারাপ লাগে বলে এমন করবে? ভাইয়ের তো শুধু ভাবিকে ভালো লাগছে তাতেই এমন করবে?”

জয় আড়চোখে তাকাল আবিদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওর মা-বাবা দুইজনের প্রেমের পাগলামোর কথা তো এখনো জানিস না। দুইজনের এক অংশ জাহান ভাই প্রেমের পাগলামো তো দ্বিগুণ হবেই। এই অসম্পূর্ণ প্রেমই তোর পাগলামো মনে হলে সম্পূর্ণ প্রেমে পড়লে যা করতে পারে তার ধারণা আমারও নেই। এখন তো আমি চাই ভাই সম্পূর্ণভাবে তার প্রেমে ডুবে যাক, তার ভালোবাসার গভীরতা দেখতে ইচ্ছা করছে।”
.
.
শায়ানকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাবার কথা ছিলো তিসানের। সে গেল না। এলো অন্যকোথাও।

তিসানের গাড়ি এসে থামে একটি শ্বেত রাজবাড়ীর সামনে। তার গাড়ি দেখেই দরজা খুলে দেয়া হয়। তবে সে সাথে সাথে প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকে না। কিছুক্ষণ স্থির থেকে ভেতরে প্রবেশ করে কালো রঙের মার্সেডিসটি। ভেতরে ঢুকেও আরেকটু চালাতে হয়। একটি রাস্তার ন্যায় করা। দু’পাশে সবুজ ঘাসে ভরা।বাগানের একপাশে বিভিন্ন রঙের ফুলে ভরা তো অন্যপাশে প্যটিও করা। সেখানে এখনো চায়ের কাপ বিদ্যমান।

বাড়ির সামনে গাড়িটি থামিয়ে নামে সে। প্রবেশ করে নিঁখুত কাজ করা প্রবেশপথ দিয়ে। ঘরের ভেতর ঢুকতেই চোখ বুলালো তাসিন। কেবল এক বছর ধরে সে এখানে আসে না। তাতেই এতকিছু বদলে গেছে? অবশ্য বাড়ির মালিকের পরিবর্তন বেশ পছন্দ তাই ক’দিন পর পর বাসার ডেকোরেশন চেঞ্জ করে থাকেন। তাই বিশেষ হবার হলো না তিসান।

হঠাৎ একজন বৃদ্ধলোক প্রবেশ করে কক্ষে। স্যুট পরা।
“তিসান বাবা কেমন আছো তুমি? আমাদের কথা তোমার মনেও পড়ে না বাবা? আসো না কেন? আমি জিনি মামণিকে ডেকেছি। জাহান বাবাও ওর রুমে। মাত্র অফিস থেকে এসেছে। শাওয়ার নিচ্ছিল। তাই ডাকিনি।”
“ভালো করেছেন।”
উনি হলেন মোহফেজ চাচা। ছোট থেকে জাহান ও জিনির খেয়াল রাখার সুবাদে তাকেও ভীষণ আদর করেন। জাহানের বয়স যখন ছয় তখন থেকেই এখানে চাকরি করেন তিনি।

এতক্ষণে জিনি এসে পড়েছে। তিসানকে দেখে তার খুশির সীমা থাকে না। সে চিৎকার করে করে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে যে তিসান এসেছে। বাড়ির সবাই বলতে বাড়িতে কাজ করা হেল্পিং হ্যান্ডদের। এই বিশাল বাড়িতে বাড়ির সদস্যরাই তেমন থাকে না।

জিনি তিসানকে ছাড়লোই না। ছাড়লো কেবল একটা শর্তে সে তিসানের জন্য নিজহাতে পাস্তা রান্না করবে। সে রান্নাঘরে ঢুকতেই সকল হেল্পিং হ্যান্ডরাই তার পিছনে তিরতির করে ঢুকে পড়লো রান্নাঘরে।

ছাড় পেয়ে তিসান গেল জাহানের রুমে। দেখল সে হাতে বাস্কেটবল নিয়ে খেলছে। তার হঠাৎ অস্বস্তি বেড়ে গেল। ডাক দিতে যেয়েও দিলো না।

জাহান তাকাল তার দিকে আড়চোখে। তাকে দেখতেই বাস্কেটবলটা ছুঁড়ে মারল তার দিকে, “শালা বাড়িতে এসেছিস এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিলি, এখন রুমে ঢুকতে অস্বস্তি লাগছে তোর?”
তিসান রুমের ভেতরে ঢুকে। চুপচাপ। কিছু না বলে একপাশের বিনব্যাগে বসে পড়ে। বেশ খানিক্ষণ চুপ থেকে বলে, “রাগে মাথায় গোবর জমে গিয়েছিল। তাই প্রপার্লি ভাবতে পারি নি। তুই তন্নিকে রিজেক্ট করেছিলি ওকে কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য। আর উল্টো আমি তোকেই… ওর কান্না আমার সহ্য হচ্ছিল না।”
“তোর মস্তিষ্কে গোবর তো আগের থেকেই জমা। নতুন কিছু না’কি? কিন্তু ওই গোবরের স্তুপ থেকে একটুখানি গোবর কে পরিষ্কার করল?”

তিসানের ভালো লাগছে জাহানের সাথে সে মুহূর্তে আবার স্বাভাবিক হতে পেড়েছে। সে ভেবেছিল প্রথমে ক্ষমা চাইবে। তারপর আস্তে-ধীরে স্বাভাবিক হবে। কিন্তু জাহানের ব্যবহারে সে সহজেই আগের মতো হতে পাড়ল। মনে মনে জাহানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও মুখে করল না। জাহানের প্রশ্নের উওর দিলো,
“আজ জিনি এসেছিল ভার্সিটিতে। মহুয়া ওকে দেখে প্রশ্ন করল কয়েকটা। ইনডেরেক্টলি বুঝাল। আমি যদি জিনির কথা ভেবে তাকে মানা করি তাহলে তোর দোষ কোথায়? আমিও চাই জিনি কখনো কষ্ট না পাক। তোর বোন মানেই আমার বোন। আমি ওকে ভালো না বাসলে কীভাবে ওকে এক্সেপ্ট করতে পারি? এতে ভবিষ্যতে ওই কষ্ট পাবে।” কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে থামল তাসিন। তাকাল জাহানের দিকে, “আর যেখানে তুই কারো প্রেমেই পড়িস না। ওহ সরি, একজন বাদে।”
“দেখছিস আমার প্রতি কি কেয়ার তোর ভাবির?” জাহান তার বুকে হাত রেখে বলে, “ওর কথা ভাবতেও হার্টবিট ফার্স্ট হয়ে গেল? এই মেয়েটা তো আমার রোগ হয়ে ছাড়বে দেখছি।”

তাসিন স্বশব্দে হেসে উঠে, “তুই তো দেখি প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছিস দিনে দিনে আর ওদিকে তোর হার্টবিট ভাবছে তুই নাটক করছিস।”
জাহানের কপাল কুঁচকায়, “কী নাটক?”
“ও ভাবছে তুই প্রেমে পড়ার নাটক করছিস ওকে পরাজিত করার জন্য। আমাকেও বলছে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের নাটক কন্টিনিউ করতে। ভাই প্রেমে পড়লি তো পড়লি এমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়লি কীভাবে? ওর ভাবনা দেখে আমি শিহরিত হয়ে যাই।”
“তো ইয়াজভান জাহানের জান বলে কথা। ইউনিক তো হবেই। তোদের মতো সুন্দরী দেখেই মন হেরে বসি না।”
“মোহের কথা কীভাবে বুঝেছিলি?”
“কুত্তা তোকে ছোট থেকে চিনি। তোর হাবভাব আমার মুখস্থ। মহুয়ার বান্ধবী আমার ভবিষ্যতের শালিকা হয়, উল্টাপাল্টা করার কথা ভাববিও না, নাহলে আমার পূর্বে আমার জানই তোর জান নিয়ে নিবে।”
“সত্যি বলছি আমি এবার সিরিয়াস। ওকে দেখার পর থেকে আর কিছু আমার মাথায় আসে না, আমার চোখে ভাসে না, আমার মনে পড়ে না। সব জায়গায় শুধু মোহিনী আর তিসানের মোহিনী।”

জাহান কিছু বলে না। তিসানের ভাবসাবে আসলেই তাকে গম্ভীর মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে এখনো নিশ্চিত হতে পারে নি। সে তার আলমিরা খুলে দুইটা হেলমেট বের করে।
“দুইটা বাইক আমাদের অপেক্ষায় কাতর হয়ে গেছে। মরেটরে গেছে না’কি জানি না। চল একটু যেয়ে তাদের হাওয়ার সাথে প্রতিযোগিতা মনে করাই।”
“তুই এই একবছরে বাইক চালাস নি?”
“নিজের সুখের ভাগিদার ছাড়া সুখ কুড়াব কীভাবে?”
তিসান কিছু মুহূর্ত করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে জাহানের।
“সরি দোস্ত। রাগে আমার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ে গেছিল। এর উপর শায়ান আরও তোর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিলো। আমার ভুল হয়ে গেছে দোস্ত মাফ করে দে।”

জাহান তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, “ছিঃ ছিঃ শালা তোর লজ্জা করে না এভাবে জড়িয়ে ধরতে। বয়স এখন বউয়ের জড়িয়ে ধরার, সেখানে তুই জড়িয়ে ধরছিস? একফুট দূরে থাকবি এখন থেকে। আমার বউয়ের সম্পত্তির ভাগিদার আমি কাওকে হতে দিব না।”
তিসান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো জাহানের দিকে, “তুই বিয়ে পর্যন্ত গেসোস গা? একবছর আগ পর্যন্ত তো মেয়ে দেখলেও বিরক্ত হতি। আর কোনো মেয়ে ছুঁলে তো ঝড় উঠায় দিতি।”
“তো আমি হলাম আমার বউয়ের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। অন্যমেয়েরা হাত কেনো দিবে?”
“আচ্ছা বাদ দে, কিন্তু তুই আমাকে সুখের ভাগিদার ভাবছিস এটাতেই আমার মন প্রাণ সব গলে গেছে।” আবারও করুণ দৃষ্টিতে তাকায় তিসান জাহানের দিকে।
“ঠিকই তো বললাম, তোকে না হারালে রেইস করে মজা পাই না।”
সাথে সাথে তিসানের করুণ দৃষ্টি বিরক্তিতে বদলে যায়, “হারামি নির্দয় লোক তুই একটা। একবছর পর এলাম আমাদের বন্ধুত্ব ঠিক করতে আর তুই…. বাদ দে, আজ দেখ আমি তোকে কীভাবে হারাই।”
জাহান হেসে উঠে। যেন তিসান রসিকতা করছে।
“গুড জোক।” জাহান তাকাল তিসানের দিকে। সে রাগে ফুঁসছে।
“আজ তো তোকে আমি হারিয়েই ছাড়ব।”
“দেখি। চল বাঁজি ধরি। আমি জিতলে আমি যা বলব তুই তাই করবি। আর তুই জিতলে তুই যা বলবি তাই করব।”
“ডিল।”
জাহান তিসানের হাতে একটা হেলমেট দিয়ে বাহিরের দিকে এগোয়, “জলদি চল তাহলে। আমার জিতার জন্য তর সইছে না। এমনিতেও তোর ভাবিকে গার্লফ্রেন্ড করার দুঃসাহসের শাস্তিও তো তোর পাওয়া লাগবে। তাই না?”
তিসান দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে এক ঢোক গিলে। সে দেখে জাহান বেরিয়ে গেছে রুম থেকে। সে দৌড়ে যায় তার পিছনে। উচ্চস্বরে বলে, “ভাই সব নাটক ছিলো…”
.
.
রাতে মৃণাকে কল দিয়েও পেল না মহুয়া ও মোহ। মিতার হলুদ হলো। ঘরোয়াভাবেই। কিন্তু দুইজনে নাচে-গানে সারারাত ঘর মাতিয়ে রেখেছিল। পরদিন আবার সকালে উঠল। ঘুম হলো কেবল তিনঘণ্টা। সকাল সকাল দুইজনে মিলে মিতাকে পার্লারে নিয়ে যায়। মোহও সেখানে পার্টি সাজ দিবে। মহুয়া পার্লারে সাজবে না। তার ভারী সাজ পছন্দ না। তাই সে বাসায় এসে পড়ে বারোটা নাগাদ। গোসল করে বের হবে বলে। মা’য়ের হাতে দু’নেলা ভাত খেয়ে নিলো। কল দিলো মৃণাকে। ফোন বন্ধ। তারপর রুমে বসে কিছুক্ষণ কার্টুন দেখে গেল একঘন্টার গোসলের যাত্রায়। বেরিয়ে কল দিলো মৃণাকে। ফোন বন্ধ। কপাল কুঁচকায় তার। বিড়বিড় করে কতগুলো বকা দেয় মৃণাকে। সাথে দুই চারটা গালি ফ্রী। তারপর সাজগোজ করে নিলো। হাল্কা গোলাপি রঙের একটি গোল জামা পরেছে। জামায় মুক্তোর কাজ দেখে মুক্তোর কানেরদুল ও চুলে মুক্তার ক্লিপ পড়ে নিলো। হাতে মুক্তোর সাথে স্টোনের ফুলের একটি রিং। হাল্কা সাজ দিয়েছে সে। কাজল চোখে মাখবে কি-না দ্বিধায় ছিলো। কিন্তু শেষমেশ দিয়ে একটি পার্লের ব্যাগ হাতে নিলো। তারপর বিছানায় বসে আবার কল দিলো মৃণাকে তার ফোন এবার ব্যস্ত। বিরক্তবোধ করে সে। তার মা’কেও কল দিলো উনিও ধরে না। মেহমান এসেছে বলে কী কল ধরবে না? যেন মেহমান নয়, প্রধানমন্ত্রীরা আসছে তাদের বাড়ি। কল ধরার সময় নেই।
.
.
লাল রঙের একটি জরজেটের শাড়ি পরে আছে মৃণা। মাথায় লাল নেটের ওড়না, চোখের নিচে লেপ্টানো কাজল, ঠোঁটে লেপ্টানো লাল লিপ্সটিক, এলোমেলো গহনা। তার চোখের পানি ঝরঝরে পড়ে ফোনের স্কিনে। সে বারবার তন্ময়কে কল দিয়েই যাচ্ছে। সে ধরছে না। আবারও কল দিচ্ছে। এর মধ্যে বাহির থেকে জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দ পাওয়া যায়। তার সৎ মা’য়ের হুমকি শোনা যায় স্পষ্ট। সে কাঁচুমাচু হয়ে আবারও কল দেয় তন্ময়কে। একবার কেটে দেওয়ার পর আবারও দেয়। এবার রিসিভ হয় কল, “কে?”
“হ্যালো…হ্যালো তন্ময়…মৃণা বলছি। শুনো…”
ওপাশ থেকে তন্ময়ের মৃদুস্বর শোনা যায়, “তুমি এসময় কেন কল দিচ্ছো মৃণা? তোমাকে বলেছিলাম না আমি তোমাকে কল দিব। তুমি দিবে না। বিরক্ত করবে না। আমি বুশরার সাথে আছি তোমার কল দেখে কী ভাববে বলো? আমি বাসায় গেলে তোমাকে কল দিব। এর আগে না।”
“আমার কথা তো শুনো। আমার বিয়ে…” কথা শেষ হবার পূর্বেই কল কেটে দেয় তন্ময়। মৃণা নির্বাক দৃষ্টি তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। তারপর হুঁশ আসলে আবারও কল।দেয়। এবার ফোন সুইচ অফফ আসে।

কি করবে বুঝে কুলাতে পারে না মৃণা। তার সৎ মা বলেছিল মেহমান আসবে। তার কেবল রান্না করে মিতার বিয়েতে যাবার কথা ছিলো। সে তৈরিও হয়েছিল কিন্তু তার সৎ মা বিভিন্ন কাজে তাকে ব্যস্ত রাখলো। এর মধ্যেই মেহমানরা আসলো। মৃণা ভদ্রতার খাতিরে তাদের সাথে দেখা করল। এক বৃদ্ধা মহিলা ও দুইজন মধ্যবয়সী লোক।। তাদের সালাম দিয়ে মৃণা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। তারপর সেন্টারে রওনা হবার উদ্দেশ্যে বের হয়। এর মধ্যে তার সৎ মা এলো। তাকে একটা লাল শাড়ি ও ওড়না দিয়ে বলল পরে আসতে। প্রথমে সে ব্যাপারটা বুঝতে পাড়ে নি৷ কিন্তু পড়ে যখন এলাকার পার্লারের একটি মেয়েকে আনা হলো তাকে সাজানোর জন্য তখন সে বুঝল এখানে তাকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। কথায় বুঝে গেল তার বাবার বয়সী সে দু’টোর মধ্যে একটি লোকের সাথে তার বিয়ের কথা চালিয়েছেন তার সৎ মা। তার ফোন নিয়ে গেলেন। রাজি না হলে মারধর করলেন। অত্যাচার করলেন। পালাতে গেলে পায়ে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিলেন। জোর করে তাকে সাজালেন, শাড়ি পরালেন। হাতে ও ফসকা পরা পায়ে আলতাও পরালেন। সে সব সহ্য করল কিন্তু যখন তার বাবাকেও সে লোকদের সাথে খাবার টেবিলে হেসে কথা বলতে দেখল তখন তার আর সহ্য হলো না। তার মনে হলো এই পৃথিবীতে তার থেকেই লাভ কী? কেউ তাকে ভালোবাসে না, কেউ তাকে নিয়ে ভাবে না। তার আপন আব্বাও না। সে ভেবেছিল দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁ*সি দিবে। সাহসও হলো তার। কিন্তু ভাবতেই তার তন্ময়ের কথা মাথায় এলো। সে পার্লারের মেয়েকে বাথরুমে যাবার কথা বলে বের হলো। সাবধানে ঢুকলো তার বাবার ও সৎ মায়ের রুমেতে। সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে ফোন খুঁজতে লাগল। তার ফোন না পেলেও তার সৎ মা’য়ের ফোন পায়। তন্ময়ের নাম্বার তার মুখস্থই ছিলো। সাথে সাথে কল দিলো তাকে। তার ভালোবাসার মানুষ নিশ্চয়ই তাকে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য ছুটে আসবে। অথচ কী হলো? তার ভালোবাসার মানুষটি তাকে এভাবে এড়িয়ে গেল? তাকে বিরক্ত করতে মানা করল?
মেঝেতে একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে ছিলো মৃণা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। বাইরের এত চিৎকার চেঁচামেচি তার কানে ঢুকছে না যেন। তার কান্নাও থেমে গেছে বিস্ময়ে। কিছু সময় কাটলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার অশ্রুর দাগ পড়া গালে আরেক ধারা জল বয়ে গেল।

তার ভালোবাসার মানুষটিও তাকে চায় না? কেউ-ই তাকে চায় না? এই পৃথিবীতে আরেকজন তার ভালোবাসার শূন্য পুস্তক থেকে বাদ পড়ে গেল? ভাবতেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক কষ্টেভরা দীর্ঘশ্বাস। আর কেবল ভালোবাসার দুইজনই তো তার জীবনে বাকি। এই দুইজনের জন্য কী বাঁচবে? ভাবতে লাগলো। কীভাবে বাঁচবে সে? কে বাঁচাবে? কেউ-ই নেই তেমন। মহুয়া বা মোহের নাম্বারও তার কাছে মুখস্থ নেই। কী করে কল দিবে তাদের?

মাথা অনেক বাজে চিন্তাভাবনা আসলো না। একবার ফ্যানের দিকে তাকাল। কিন্তু মোহ আর মহুয়ার কথা ভেবে এবার আর সাহস পেল না। তারা তার একমাত্র শক্তি কিন্তু আজ দুর্বলতা হিসেবে কাজ করছে। সে আবারও তাকাল ফোনের দিকে। বেহায়ার মতো আবারও তন্ময়কে কল দেবার জন্য। সে কল অপশনে ঢুকে আননোওন একটা নাম্বার দেখে। মিসকল এসেছে মিনিট দশেক আগেই। নাম্বারটা চেনা চেনা লাগছিলো। হঠাৎ তার নাম্বারটা মনে পড়ে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এক আশার কিরণ তার চোখে ঝলকে উঠে। সাথে সাথে সে কল দেয় নাম্বারটিতে।

মহুয়া সবে বের হয়েছিলতার উদ্দেশ্য ছিলো রিক্সা নিয়ে প্রথমে পার্লারে যাবে। তখনও মৃণার সাথে যোগাযোগ না হলে ওর বাসায় যাবে। তারপর ওকে নিয়ে যাবে মোহদের বাড়িতে।
সে বিরক্তির সুরে বলে, “আল্লাহ জানে ওর মা শাঁকচুন্নি কটকটি আবার কি অত্যা’চার শুরু করেছে মেয়েটার উপর!”
সে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা পাচ্ছে না। স্কুটিটা সকালে আসার সময় দিয়ে এসেছে গ্যারেজে। বিরক্ত হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার ফোন বাজে। মৃণার সৎ মা’য়ের নাম্বার দেখে কল ধরে,
“আন্টি আসসালামু আলাইকুম।”
“দোস্ত…দোস্তরে আমার জীবন শেষ করে দিতে চাচ্ছে এরা।”
মৃণার এমন কান্নায় আতঙ্ক ছড়িতে যায় মহুয়ার শিরায় শিরায়। বুকের ভেতর ভয়ে হু হু করে।
“কী হয়েছে তোর? কান্না করছিস কেন?”
“আমার সৎ মা আর বাবা মধ্যবয়সী লোক এনেছে আমাকে বিয়ে দেবার জন্য। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। টাকা নিয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বিক্রি করে দিচ্ছে আমাকে। প্লিজ মহু কিছু কর। এই বিয়ে হলে আমি কিন্তু বাঁচবো না। ম’রে যাব।”

চলবে….

মেঘের খামে…
পর্ব ১১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“কী হয়েছে তোর? কান্না করছিস কেন?”
“আমার সৎ মা আর বাবা মধ্যবয়সী লোক এনেছে আমাকে বিয়ে দেবার জন্য। পঞ্চাশ বছরের হবে। টাকা নিয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বিক্রি করে দিচ্ছে আমাকে। প্লিজ মহু কিছু কর। এই বিয়ে হলে আমি কিন্তু বাঁচবো না। ম’রে যাব।”
মহুয়া হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “এসব অলক্ষুণে কথা বললে তোর খবর আছে। তোর কিছু হলে আমরা কীভাবে বাঁচবো? তুই একটুখানি সামলা আমি আসছি।”

সে কল কেটে আশেপাশে অস্থির হয়ে রিকশা খুঁজতে থাকে। বাসাতেও একটা গাড়ি নেই। সে হাঁটতে শুরু করে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে রিক্সার হর’তাল চলছে। পড়ে যায় সে বিপাকে। কী করবে এখন? তার বাসা থেকে মৃণার বাসা দূরে। রিকশাতেই চল্লিশ মিনিট লাগে। হেঁটে যেতে আরও সময় লাগবে। এত সময় হাতে নেই। সে রাস্তাতেই বসে পড়ে চিন্তায়। মাথা ধরে। হঠাৎ তার মাথায় আসে মুরাদের অফিস মৃণার বাসা থেকে বেশ কাছে। তার গাড়িও আছে যেতে দশ মিনিটেরও কম লাগবে। সে জলদি কল দিয়ে মুরাদের ফোন অফফ পায়। সাথে সাথে সে ইমাজেন্সি নাম্বারে কল দেয়। মুরাদের এই নাম্বারটা অল্প কয়জন জানে। বিশেষ প্রয়োজন বাদে এই নাম্বারে কারো কল দেওয়া মানা। সে মিটিং বা জরুরি কাজে থাকলে এই সিম অন রাখে।

মুরাদ মিটিং এ ছিলো। ভীষণ বড় প্রজেক্ট। তখন তার ফোনে কল আসে। তার ইমাজেন্সি নাম্বারে এর পূর্বে কখনো মহুয়া কল দেয় নি। তাই একটু সময় নিয়ে বাহিরে আসে সে, “সব ঠিক আছে তো মিষ্টি? ”
মুরাদ আদর করে তার বোনকে মিষ্টি ডাকে। একটামাত্র আদুরে বোন কি-না! ফোনের ওপাশ থেকে গভীর নিশ্বাস শুনে আতঙ্কিত হয় মুরাদ, “কী হয়েছে মিষ্টি? সব ঠিক আছে তো?”
“কিছু ঠিক নেই ভাইয়া। তুমি প্লিজ জলদি মৃণার বাসায় যাও। প্লিজ। আমি এদিকে রিকশা পাচ্ছি না।”
“মৃণা? কী হয়েছে মৃণার?”
“ওর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে জোর করে। টাকার বিনিময়ে। তাও মধ্যবয়সী কারো সাথে। এর উপর ও উল্টাপাল্টা কথা বলছে। প্লিজ ভাইয়া কিছু করো।”
“এখনই যাচ্ছি।” বলে সে যেতে নিলেই তার পিএ আটকায়, “স্যার কোথায় যাচ্ছেন। ক্লাইন্ট অপেক্ষা করছে।”
“মিটিং ক্যান্সেল করো।”
“স্যার এই ডিলের প্রফিট মার্জিন অনেক বেশি….”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
সে সাথে সাথে বেরিয়ে যায়।
.
.
মহুয়া দ্রুত হাঁটছে। হাল্কা ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামছে অনবরত। এত দ্রুত হেঁটেও নিজের এলাকাটাই পাড় করতে পাড়ছে না। মৃণার বাসায় সময়ে পৌঁছাবে কীভাবে? এমন সময় কল এলো তার ফোনে। তিসান কল করছে।
“হেই মহুয়া কী খবর? কোথায় তুমি?”
“আমি কোথায় জেনে তুমি কী করবে?”
“রেগে যাচ্ছো দেখি। অল ওকে?”
“চিন্তায় ম’রছি।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“তোমার না জানলেও চলবে।”
“আচ্ছা পার্সোনাল ব্যাপার? তোমার এলাকায় এসেছিলাম তাই তোমার থেকে মেহমানদারি আদায় করব ভেবেছিলাম। স্যারপ্রাইজও ছিলো একটা তুমি সম্ভবত ব্যস্ত। পরে দিব নে।”
“ওয়েট ওয়েট… তুমি এই এলাকায়?”
“হ্যাঁ।”
“গাড়ি এনেছ?”
“অফকোর্স।”
“গ্রেট। প্লিজ একটা হেল্প করো। জলদি আমার বলা ঠিকানায় আসো গাড়ি নিয়ে। একটা জায়গায় ইমাজেন্সিতে যেতে হবে। জীবন মৃ’ত্যুর প্রশ্ন।”
তিসানের কন্ঠ এবার গভীর শোনায়, “কী হয়েছে?”
“বলছি জলদি আসো। আমি হোয়াটসঅ্যাপে জায়গার নাম ও ছবি পাঠাচ্ছি।”
“ওকে।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটি গাড়ি হাওয়ার বেগে তার সামনে ছুটে এলো। পিছনের গ্লাস নামানো। সেখান থেকে মুখ বের করে তিসান বললো, “তোমার এ’কি অবস্থা?”
“খুব খারাপ অবস্থা।”
“না মানে আজ মেয়ে মেয়ে লাগছে তাই বললাম। প্রতিদিন তো জিন্স আর কুর্তি পরে চলে আসো। চুলগুলোর যা অবস্থা! আজ সুন্দর লাগছে!”
সাথে সাথে সামনে থেকে একটি হাত এসে কয়টা মারল তিসানের মাথায়। সে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করে , “তোমার ড্রাইভার তোমাকে মারছে?”
সামনের জানালা নিচে নামে। তার চেনা ভারী কন্ঠটি আবার কানে বাজে, “কে ড্রাইভার ম্যাডাম?”

জাহানকে দেখে চোখমুখ কুঁচকায় মহুয়া। বিরক্তি প্রকাশ করে, “এই হনুমান এখানে কি করে?”
“ধানিলংকার অনুরোধে এসেছি।”
“কে ধানিলংকা?”
জাহান উওর দেয় না। তাকিয়ে থাকে।
তিসান বলে, “জলদি চলো। তোমার না কী ইমাজেন্সি আছে?”
মহুয়া দ্রুত পিছনের সিটে বসতে নিলে জাহান বলে, “সামনে এসে বসুন ম্যাডাম। আপনার ড্রাইভার নই আমি, আপনার হবু বাচ্চার একমাত্র বাবা।”
“উল্টাপাল্টা কথা বললে এখানেই চোখ উঠিয়ে হকি স্টিক দিয়ে মারব।”
“সামনে না বসলে দুইজনকে রাস্তার মাঝে ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে যাব।”
তিসান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি আবার কী করলাম?”
“আমার হবু বউকে আমার আগে প্রশংসা করলি কেন?”

মহুয়া বিরক্তি নিয়ে বসে সামনের সিটে। জাহানের পাশে। রাগান্বিত স্বরে বলে, “এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে গাড়ি চালান। মৃণা বড়সড় এক মুশিবতে আছে।”
“কী হয়েছে?”
“জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। বলতে গেলে মধ্যবয়সী এক লোকের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে।”
তিসান অবাক হয়ে বলে, “হোয়াট!”
জাহানও বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়, “তার আপন মা বাবা?”
“বাবা আপন, সৎ মা।”
“আপন বাবা মেয়ের সাথে এমন করছে? কীভাবে সম্ভব?”
“এটা বাস্তব জীবন জনাব। বাস্তব জীবনে মানুষ স্বার্থপর হয়। জীবনে সবই সম্ভব। এখন জলদি গাড়ি চালান।”
“ঠিকানা না দিলে কোথায় যাব?”
ঠিকানা দেয় মহুয়া। জাহান গম্ভীরমুখে বলে, “যেহেতু জলদি যেতে হবে স্পিডে চালাচ্ছি। সিটবেল্ট লাগাও।”
“লাগাচ্ছি। চালান আপনি। আমার কথা ভাবতে হবে না।”
“বললেই হলো? তোমার কিছু হলে আমার ভবিষ্যতের বাচ্চাগাচ্চারা তো এই পৃথিবী দেখতে পাড়বে না।”
.
.
মৃণা মাথা নিচু করে বসে আছে সোফায়। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। দরজা ভেঙে তাকে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে এখানে। তার পাশে বসা তার বাবার থেকেও বয়স্ক এক লোক। সামনে কাজি বিয়ে পড়ানোর জন্য বসে আছে। মৃণা কিছুইতেই কবুল বলবে না। এর কারণে একটু আগে তার উপর ঝড় গেছে একটা। তাকে অসীম অত্যাচার করা হয়েছে। তার বাবা সৎ মা’কে টেনে বুঝাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। চিৎকার চেঁচামেচি করে আবার ফিরে আসে তার সৎ মা। হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “তুই কবুল বলবি কি-না বল। না বললে তোর কী হাল করবো ভাবতেও পাড়বি না।”

মৃণা কিছু বলে না। সে মাথা নিচু করে থাকে। রুবিনা খাতুন অর্থাৎ তার সৎ মা চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে একসাথে তিনটা থাপ্পড় মারে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় মৃণা, “বলবি কি-না বল।”
মৃণা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “না।”
আরো কতগুলো মারতে যেয়ে শুনতে পায় কলিংবেল বাড়ছে। রুবিনা খাতুনের বড় ছেলেকে বলে, “খবরদার যাবি না। এই বিয়ে শেষ হওয়ার আগে দরজা খুলবি না।”
কলিংবেল বাজতে থাকে। দরজায় ধাক্কা বাড়তে থাকে। এক সময় এত জোরে ধাক্কার শব্দ শোনা যায় যে মৃণার বাবা না পেরে বলে, “রিয়াদ দরজা খুল। একটা দরজা ভেঙে গেছে। এত মেরামতের টাকা নাই আমার।”

দরজা খুলতেই মুরাদকে দেখে সবাই হতচকিত হয়ে যায়। মুরাদকে এখানে কেউ আশা করে নি। ভেবেছিল মৃণার দুই বান্ধবী বাদে আর কারো আসার সম্ভব না। মুরাদকে দেখেই মৃণার বাবার ভাব নরম হয়ে যায়, “স্যার…স্যার আপনি এখানে?”

মুরাদের দৃষ্টি যায় মৃণার দিকে। তার ছোট মুখখানির এমন বেহাল অবস্থা দেখে তার বুকখানি কেঁপে উঠে। সে এগিয়ে তাদের সামনা-সামনি দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি মৃণাতে স্থির। মৃণার বাবা বলে, “স্যার আসলে আমরা তো…”
মুরাদ মৃণার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে হাত উঠিয়ে থামায় তাকে। মৃণাকে আদেশের সুরে বলে, “এদিকে আয়।”
মৃণা আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। ধীর পায়ে হেঁটে আসে তার সামনে। তার চিবুক গলার সাথে মিশানো। মুরাদ প্রথমা আঙুল তার চিবুকে রেখে তার মুখ তুলে। তার মুখে এত দাগ দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়।

সে সোফায় বসে। পায়ের উপর পা তুলে তাকায় তার সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের দিকে। তার দৃষ্টিতে যেন অগ্নিশিখা ভাসছে।
“এক্সপ্লেইন মিস্টার মোফাজ্জল হোসেন। এক্সপ্লেইন।”
শেষ শব্দে হুঙ্কার দিয়ে উঠে মুরাদ।
ভয়ে মৃণার বাবা গুটি মেরে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু রুবিনা খাতুন এতে সামলায়? সে আরও তেজ দেখিয়ে বলল, “আপনাকে সাফাই দিব কেন? আপনি কে? আপনি যান তো এখান থেকে এটা আমাদের পারিবারিক ব্যাপার।”
“রিয়ালি? সো যদি আমি এখন আপনার পরিবারকে শেষ করে দেই এটাও পারিবারিক ব্যাপার হবে? মিস্টার মোফাজ্জল আপনি দুইবছর আইন নিয়ে পড়েছেন তাই না? এখন জেলে গেলে কয়বছর কাটাতে হবে আপনাদের জানেন?”
সে একই দৃষ্টিতে তাকাল সেজে আসা বর ও তার তার মেহমানদের দিকে। তারা মুরাদের দৃষ্টি দেখেই দ্রুত পালায়।

মুরাদ আবারও তার দৃষ্টি সংযত করে মৃণার পরিবারের উপর, “আপনারা ভুল জায়গায় আক্রমণ করেছেন। জীবনের তো মায়া নেয় আপনাদের। তাই না?”
রুবিনা খাতুন আবার বলতে নেয়, “আপনি… ”
তখনই মৃণার বাবা ধমক দেয় তাকে, “চুপ করো তো। উনি আমার বসেরও বন্ধু হয়। কথা বললে চাকরি থাকবে না। আরেকটা শব্দ বের করলে খবর আছে।”
মৃণা অবাক হয়ে তাকায় তার বাবার দিকে। তার উপর এত অত্যাচার করা হয়েছে এতবছর ধরে। তার বাবা একটা শব্দও বলে নি। অথচ এখন রুবিনা খাতুনকে ধমক দিচ্ছেন? তার কাছে এই মুহূর্তে রুবিনা খাতুনকে না, বরং তার বাবাকে সবচেয়ে বড় পাষাণ, স্বার্থপর ও ঘৃনার ব্যক্তি মনে হচ্ছে।

“সেটা এমনেও থাকবে না মোফাজ্জল হোসেন। কর্মের আগে তার ফলাফল চিন্তা করা উচিত। যার জন্য আপনাদের সংসার চলছে তাকে বিসর্জন দিতে যাচ্ছেন? মৃণার কমফোর্টেবল লাইফের জন্য আপনাকে চাকরি দিলাম। আর আপনি ওর জীবন নিয়ে খেলছিলেন? এর পরিণাম বুঝতে পাড়ছেন তো মিস্টার মোফাজ্জল? অভাবের পর এত টাকা দেখে চোখ বেশি বড় হয়ে গেছে তাই না? তাহলে আপনাদের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত। না, আগের থেকেও করুণ পরিস্থিতিতে।” মুরাদ শান্ত গলায় হুমকি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মৃণার দিকে তাকিয়ে বলে, “চল এখান থেকে।”

মৃণা নড়ে না প্রথমে। মুরাদ কপাল কুঁচকে নেয়, “শুনতে পাড়ছিস না?” বলে সে মৃনার হাত ধরে নিতে গেলেই সে শব্দ করে উঠে। মুরাদ থেমে যায়, “কী হয়েছে?”
মৃণা ডানে বামে মাথা নাড়ায়।
“মৃণা আমি জিজ্ঞেস করেছি কী হয়েছে?”
“পা…পায়ে ব্যাথা।”
“শাড়ি একটু উপরে তুল।”
মৃণা চকিতে তাকায় মুরাদের দিকে, “থা…থাক…”
“বলেছি দেখা। কানে যায় না কথা?”

মৃণা তার শাড়ি পা’য়ের গোড়ালি পর্যন্ত তুলে। কৃষ্ণরঙা পা কেমন ধূসর রঙের হয়ে গেছে। চামড়া আলগা হয়ে আসছে। এর উপর আলতা দেয়া। চোখ বন্ধ করে নিলো মুরাদ। তার আর দেখার ক্ষমতা নেই। সে চোখখুলে তাকায় মৃণার মুখের দিকে। এক ঝটকায় তাকে কোলে তুলে নেয়। তাকায় তার পরিবারের দিকে। তার দৃষ্টি দিয়ে যেন ভস্ম করে দিতে চায় সবাইকে। সাবধানবাণী দেয়, “এর পরিণাম কতটা ভয়ানক হবে তা আমি কল্পনা করতে পাড়ছি না। আপনারা করতে শুরু করুণ। অন্তত তৈরি থাকবেন।”
মৃণাকে নিয়ে যেতে নিলে মৃণা ধীরসুরে বলে, “আমি হাঁটতে পাড়ব মুরাদ ভাই।”
“চুপ করে থাক। তোকেও ছাড় দিব ভাবিস না। তোর কপালেও শনি আছে।”
ধমকে চুপসে গেল মৃণা। চুপ হয়ে গেল।

বাহিরে যেয়ে মুরাদ বলল, “দরজাটা খুল।”
চুপচাপ আদেশ পালন করল মৃণা। দরজা খুলার পর মুরাদ তাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসলো।

নীরবতা ভারী হয়ে আসছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। মৃণা এখনো ভয়ে কাঁপছে। আজ মুরাদ ভাই সময়ে না আসলে কী হয়ে যেত! ভাবতেই তার বুকের ভেতর ঝড় উঠে।

“তুই আগে কাওকে জানাস নি কেন?” মুরাদের প্রশ্নে তার ধ্যান ভাঙে।
“আমিও জানতাম না মুরাদ ভাই। বলেছিল মেহমান আসবে। রান্না করতে। সকাল থেকে রান্না করছিলাম। জোহরের আগ দিয়ে রান্না শেষ হলো। নামাজ পড়ে তৈরি হলাম মিতা আপুর বিয়েতে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে শুনি পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সে লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আপনিই বলেন মুরাদ ভাই। একজন বাবার কাছে কী মেয়ের মূল্য মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা? আমি কী কোনো জিনিস যে আমাকে বিক্রি করবে?” বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আরও যোগ করে, “আমার সৎ মা’য়ের কথা নাহলে বাদই দিলাম। আমি উনার অংশ না। কিন্তু বাবা….বাবার তো প্রথম সন্তান আমি। একমাত্র মেয়ে। মোহ এবং মহুয়ার বাবাদের তো দেখেছি। তাদের জান তাদের মেয়ের মধ্যে। তাহলে আমার বাবা এমন কেন মুরাদ ভাই? মা মারা যাওয়ার পর আমাকে আদর করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের পর আমার কাছেও আসে নি, ভালোবাসা তো দূরের কথা নিজের দায়িত্বও পালন করে নি। দাদি ও ছোট চাচার দয়ায় বড় হয়েছি। সব মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ…আজ উনি নিজের চোখের সামনে তার অংশকে এত আঘাত পেয়ে দেখেও চুপ রইলেন। অথচ আপনি যখন বললেন চাকরি থাকবে না তখন ধমক দিলেন? মানুষ এমনও হয় মুরাদ ভাই? বাবারা এমন হয়?”

মৃণার কান্নার মাত্রা বাড়ল। মুরাদ তাকাল তার দিকে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। এক গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “সবার ভাগ্যে এক নির্দিষ্ট পরিমাণে ভালোবাসা থাকে। হয়তো তোর বাবার ভালোবাসাটা তোর ভাগ্যে নেই।”
“কোনো ভালোবাসাই আমার ভাগ্যে নেই মুরাদ ভাই। আমি সে ভাগ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে আসি নি।”
মুরাদ তাকাল তার দিকে। দিয়ের চোখের চশমাটা প্রথমা আঙুল দিয়ে নাকের আগা থেকে একটু উঁচায়, “আছে। হয়তো এখন তোর পাওয়ার সময় হয় নি। হতে পারে কেউ তোকে নিজের জীবন থেকে বেশি ভালোবাসে। তা তুই অনুভব করতে পারিস না।”

মৃণা চকিতে তাকায় মুরাদের দিকে। দুইজনের চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয় মুরাদ, “মোহ ও মহুয়ার কথা বলছি। ওরা তোকে ভীষণ ভালোবাসে। আর তোর…. সো কল্ড বয়ফ্রেন্ডও তো আছে।”
“নেই।”
মৃণার উওরে মুরাদ তাকায় তার দিকে।
মৃণা আবারও বলে, “আমি মরিচীকার পিছনে ছুটছিলাম মুরাদ ভাই। কল্পনায় ছিলাম। ভুল আমার ছিলো। আমি কী করে ভাবলাম তন্ময়ের মতো এত সুদর্শন ও সফল ব্যক্তি আমার মতো একজনকে নিজের জীবনে চাইবে। জানেন বিপদে পড়ে সবার পূর্বে ওকেই মনে পড়েছিল। কল দিয়েছিলাম সে ব্যস্ত। ব্যস্ত নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে।” বলে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

এবার ভারী বিরক্ত হয় মুরাদ। সে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মৃণার দিকে তাকিয়ে বলে, “কান্না বন্ধ কর মাথা ব্যাথা করছে। তোর চোখের টাঙ্কি কি শেষ হয় না?”
মৃণা কান্না থামায় না। মুরাদ এবার ধমক দিয়ে উঠে, “কান্না বন্ধ না করলে এক থাপ্পড়ে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিব। বলেছি না কান্না বন্ধ করতে।”

সাথে সাথে মৃণা কান্না বন্ধ করে নম্র দৃষ্টিতে তাকায় মুরাদের দিকে। ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকে। মুরাদ বলে, “যে তোর যোগ্য না তার জন্য চোখের পানি নষ্ট করছিস? যার সাথে তুই স্ট্রাগলের সময় ছিলি সে সাফল্য পেতেই তোকে ভুলে গেল এমন মানুষের জন্য তুই কান্না করছিস? আর ইউ সিরিয়াস মৃণা? দু:খের সময় তুই যার কাছে ছিলি সে তোকে ভুলে গেলে এমন অকৃতজ্ঞ মানুষের জন্য নিজের চোখের পানি নষ্ট করলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিলাম।”
মৃণা মাথা নিচু করে রইল।

মুরাদ আড়চোখে তাকাল তার দিকে। আচমকায় বলল, “এসির মধ্যেও তোর নাক ঘামছে? শুনেছি নাক বেশি ঘামলে সে মেয়েদের স্বামী না-কি তাদের অনেক ভালোবাসে। তোর জামাই তোকে অনেক ভালোবাসবে রে মৃণা।”
মৃণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে, “সে দিন আর আসবে না বোধহয়।”
মুখে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছি মুরাদ ভাই?”
“আর কোথায়? বাসায়।”
“মহুয়াকে কল দিয়ে বলে দিবেন আমি ওখান থেকে বের হয়েছি। চিন্তা করবে।”
মুরাদ তার ফোনটা দেয় মৃণার হাতে, “ড্রাইভিং করছি। তুই দে। পাসওয়ার্ড 67462।”
মৃণা ফোনটা হাতে নিলো। কন্টেক্টে যেয়ে দেখে অল্প কয়টা নাম্বার। ঠিক ছয়টা। সে অবাক হলো তা দেখে। মুরাদ বলল, “এই নাম্বারটা ইমাজেন্সি হলে কেউ কল।দেয়। মিটিং ছিলো বলে অন্য সিম অফফ রেখেছি।”
“আপনি মিটিং ছেড়ে এসেছেন মুরাদ ভাই?”
“মহুয়া কল দিয়েছিল। তখনই বের হয়েছি।”
“জানেন মুরাদ ভাই মহুয়া অনেক ভাগ্যবান আপনার মতো ভাই পাওয়ার জন্য। ওর কষ্ট না দেখতে পেরে আপনি নিজের মিটিং ছেড়ে এসেছেন। কী ভাগ্য ওর!” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে দেখে সে ছয়টি নাম্বারে একটি নাম্বার তারও। সেইভ করা ‘Moyna Pakhi’ দিয়ে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। তখনই মুরাদের কন্ঠস্বর শুনতে পায়,
“আমাকে সবার আগে কল দিলে তোকে এত কষ্ট পেতে দিতাম না’রে ময়না।”
.
.
মহুয়াকে গভীর নিশ্বাস ফেলতে দেখে আড়চোখে তাকায় জাহান। মেয়েটা এসির মাঝেও ঘামছে অনবরত। বারবার তাকাচ্ছে মোবাইলের দিকে। সময় দেখছে। জাহান একটি বোতল বের করে এগিয়ে দিলো মহুয়ার দিকে, “রিলেক্স। কিছু হবে না।”
মহুয়া বোতলটা হাতে নিয়ে এক নিশ্বাসে পানি শেষ করল। চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিশ্বাস ফেলল।
“ওর কিছু হলে সব কয়টাকে শেষ করে দিব।”
মহুয়ার এমন বাণী শুনে তিসান ও জাহান তাকায় ওর দিকে। দেখে এখনো ওর হাত কাঁপছে। তিসান বলে, “ডোন্ট ওয়ারি। কিছু হবে না।”
জাহান কিছু বলে না। বাম হাত দিয়ে মহুয়ার কাঁপা কাঁপা হাত ধরে।
এহেন কান্ডে মহুয়া তাকায় জাহানের দিকে। তার চোখ সামনে। ড্রাইভিং এ মনোযোগ। তার জাহানের হাত ধরাটা অস্বস্তিকর মনে হলেও হাতটা ছাড়ায় না। তার ভেতরের ভয়টা একটু কাটে। সূক্ষ্ম একটা আশ্বাস জন্মে। সে সিটে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে।

হঠাৎ তার ফোন বাজে। মুরাদ ভাইয়ার কল দেখেই সঙ্গে সঙ্গে কল ধরে, “ভাইয়া মৃণার….”
“আমি বলছি।” মৃণার কন্ঠ শুনে নিশ্বাস আসে মহুয়ার।
“সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ ভাইয়া সঠিক সময়ে এসেছে। আমি ঠিক আছি।”
হঠাৎ মুরাদের কন্ঠ শোনা যায়, “ঠিক নেই। গালে থাপ্পড়ের দাগ, শরীরেও দাগ, পা’য়ে পুরো ফসকা পড়ে গেছে….”
মৃণা তাকে থামায়, “এসব মহুয়াকে বলছেন কেন? টেনশন করবে।”
মুরাদ তার কথায় পাত্তা দিলো না। বলল, ” মিষ্টি তুই তোর ক্ষোভ বের করে আয়। আমি তাদের পরে দেখব।”
মৃণা আতঙ্কিত সুরে বলে, “কিছু করার প্রয়োজন নেই। মহুয়া তুই সোজা বাসায় আয়।”
“মাথা গরম করবি না মৃণার বাচ্চা, নাহলে তাদের পরে তোর খবর করব। ফোন রাখ।” বলে নিজেই ফোন কেটে দিলো। মৃণা একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আবার মুরাদের সিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল, “দুই ভাইবোন একই রকম।”

মহুয়া ফোন রাখতেই তার ভীত দৃষ্টি রাগান্বিত হয়ে গেল, “এর থেকে বেশি জোরে চালানো যায় না?”
জাহান তাকায় তার দিকে বলে, “এই রাস্তায় যায় না।”
“হাত ছাড়েন।”
জাহান হাত ছাড়লো না। মহুয়া হাত উপরে উঠিয়ে কামড় বসাল জোরে। জাহান সাথে সাথে হাত ছেড়ে হাওয়ায় ঝারতে লাগলো, “পাগল না’কি মেয়ে তুমি?”
“তাহলে হাত ধরেছিলে কেন? বলার পড়েও ছাড়লে না। একদম ঠিক করেছি।”
“জংলী বিড়াল একটা।” জাহান কথাটা বলে আবার দুষ্টু হাসে, “থাক ভালোই হলো। বাচ্চাদের শুনাতে পাড়ব তাদের আম্মুই নিলজ্জের মতো প্রথম লাভ বাইট দিলো।”
কথাটা শুনে মহুয়ার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল সে। আর পিছনের সারিতে বসে তিসান জোরে জোরে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

মহুয়া জাহানকে কিছু বলতে না পেরে বকা দেয় তাসিনকে, “এই ব্রোফ্রেন্ড তোমার বেশি হাসি আসতেছে তাই না? গাড়ি থেকে ফিক্কা মেরে ফালাই দিব।”
তাসিন সাথে সাথে চুপ হয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল মহুয়ার দিকে, “আমার গাড়িতে আমারই সম্মান নাই। গাড়ি থেকে একজন রাস্তায় ফেলে দিব আরেকজন ফিক্কা দিব। আমাকে কি আবর্জনা মনে হয়?”
হঠাৎ মহুয়ার টনক নড়ে। সে তাৎক্ষণিক পিছনে ঘুরে একবার তিসানের দিকে তাকায় আবার জাহানের দিকে, “ওয়েট ওয়েট তোমরা দুইজন একসাথে কীভাবে? এই চমৎকার কীভাবে হলো?”
জাহান মিররে তাকায় তিসানের দিকে। তিসানও তাকায়। দুইজন হাসে। তিসান উওর দেয়, “সিক্রেট।”
“হোয়াট ইয়ার তুমি তো আমার প্লানের বারোটা বাজায় দিলা।” মহুয়া মুখ ফুলিয়ে বলে।

এতক্ষণে তারা মৃণার বাসার সামনে এসে পড়েছে। তিসান জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তোমার বান্ধবী চলে গেলে আমরা এখানে কেন এসেছি?”
“এদের বারোটা বাজাতে।”
“মানে?”

মহুয়া রাগে হনহনিয়ে ঢুকলো মৃণার বাসায়। দরজা খোলায় ছিলো। ভেতর থেকে রুবিনা খাতুনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। সাথে মোফাজ্জল সাহেবেরও টুকটাক কথা শোনা যাচ্ছিল। মহুয়া ঢুকেই তাদের দেখে রাগে ফুঁসতে থাকে। তার পিছনে আসে জাহান ও তিসানও।
রুবিনা খাতুন মহুয়াকে দেখেই রেগে হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “এতক্ষণ ভাই কম ছিলো এখন বোনও এসে উঠেছে?”
মোফাজ্জল হোসেন বলল, “তুমি চুপ করবে? আমার চাকরিটা গেলে তোমার খবর আছে বলে দিলাম।”
“কচু যাবে। এদের মুখে সব কথা। এই মেয়ে বের হও এখান থেকে। আর তোমার ভাইকে বলবা আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিতে। এত রান্নাবান্না বাজারে দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর পেলাম কিছুই না।”
মহুয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। তারপর মৃণার দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল, “যেয়ে তোমার মৃণা আপুর সব জিনিস গুছিয়ে আনো।”
“নবাবজাদী হবি তুই নিজের ঘরের। তোর সাহস কম না আমার ছেলেদের আদেশ করোস। ওই কাজের মেয়ে কোথাও যাবে না। আমার বাসায় হয়তো কাজ করবে নয়তো ওর পরিবর্তে টাকা দিয়া যা।”
মহুয়া উচ্চস্বরে আদেশ দেয়, “শুনতে পারো নি? দশমিনিট দিচ্ছি। কুইক।”

ভাইরা ভয়ে ভয়ে তাদের মা’য়ের দিকে তাকায়। রুবিনা খাতুন আরও জ্বলে উঠে, “তোর সাহস তো কম না। আমার বাসায় এসে উঁচু স্বরে কথা বলছিস? আমি কি করতে পারি তুই জানিস? তোর বান্ধবী তো তোদের কিছু বলতো না। ওর কি অবস্থা করতাম দেখাই তোকে।” বলে সে তেড়ে এলেন।
তিসান এবার রাগান্বিত হয়। সে মহুয়াকে রক্ষা করতে এগিয়ে যেতে চাইলে জাহান তাকে বাঁধা দেয়। গম্ভীরমুখে বলে, “ডোণ্ট ইন্টারফেয়ার।” বলে সোফায় গা এলিয়ে বসল। তিসানকেও হাত টেনে বসাল।
আফসোসের সুরে বলল, “পপকর্ণ মিস করছি।”
তিসান অবাক হয় তার কথায়। রাগে তাকে কিছু বলতে যাবে। এর পূর্বেই তার চোখের সামনে এক ঘটনা ঘটে।

রুবিনা খাতুন তেড়ে আসছিলেন মহুয়ার দিকে। তার সামনে এসে হাত উঠাতেই মহুয়া তার হাতের ধাঁ’রাল ছু’রিটা তার হাতের তালুতে ঢুকিয়ে দেয়। আর্তনাদ করে উঠে রুবিনা বেগম। ব্যাথায় কাঁপতে থাকে। কিছু বলতে নিলে তার পূর্বেই মহুয়া বলে, “একটা শব্দ গলা দিয়ে বের হবে নেক্সট ছু’রিটা আপনার গলায় আটকাবে।” বলে ছু’রি বের করল। সবার দিকে তাকাল এক দৃষ্টিতে। ছেলেরা বাবার পিছে যেয়ে লুকিয়েছে। মহুয়া আরও যোগ করল, “আপনার ছেলেরা এত ভীতু? ছ্যাঁহ! কিন্তু আপনি তো মোটেও ভীতু নয়, তাই না? তো এখন আপনি যেয়ে মৃণার সব জিনিস গুছাবেন। জামা, বই, ফোন, কাগজপত্র। সবকিছু। আর একফোঁটা র’ক্ত কোথাও লাগলে আপনি শেষ। ”
“কীভাবে সম্ভব। গড়গড়িয়ে আমার হাতে….”
“চুপ। কথা বলতে মানা করেছি না? না’কি নিজের জীবন ভালোবাসেন না?”
“এই তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? কল দেও পুলিশকে। জলদি।” রুবিনা মোফাজ্জলকে বললেন।
তখন জাহান বলে উঠে, “তাহলে সবার পূর্বে আপনাদের উপর কেইস করা হবে। আমার ফুফা হাইকোর্টের জর্জ। কোন কোন কেইস আপনাদের উপর ফাইল করা হতে পারে খোঁজ নিব?”
রুবিনা ঢোক গিললেন, “যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি।”
বলে সে একটি ছোট রুমে গেলেন। সেখানে খাট ছিলো না। একটা পুরনো আলমিরা আর ভাঙা পড়ার টেবিলে ছিলো। এখানেই মৃণা ও তার দাদি থাকতো। মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাতো।

তিসান মহিলাটির পিছনে যেয়ে রুমটা দেখে ভরকে উঠে। ছুটে এসে জাহান ও মহুয়াকে বলল, “তোমার বান্ধবী এই রুমে থাকতো? আমার কুকুরের রুমও এর থেকে বড়। এখানে মানুষ থাকে কীভাবে?”
মহুয়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল তিসানের দিকে।
“আমি মজার ছলে বলছি না। এটা একটা কনসার্নের বিষয়। এখানে মানুষ থাকতে পারে না। একটা জানালাও নেই।” তিসান নিজের কথা পরিষ্কার করে।
মহুয়া তাকে কিছু না বলে মৃণার বড় ভাইকে বলল, “চুলায় এক পাতিল পানি গরম দেও।”
তার ভাই কোনো প্রশ্ন করে না। মহুয়ার আদেশ পালনে ছুটে পড়ে।

রুবিনা খাতুন এক হাত দিয়ে একটি ব্যাগ গড়াতে গড়াতে আনে। মোফাজ্জল হোসেন তাকে দেখে সাহায্য করতে এগোয়।
“ফোনও আছে ভেতরে?” মহুয়ার প্রশ্নে রুবিনা খাতুন দ্রুত মাথায় নাড়ায়। আছে।
“গুড।”
সে তিসান ও জাহানকে বলে, “তোমাদের কি সিনেমা দেখাতে নিয়ে এসেছি। জলদি ব্যাগ গাড়িতে তুলো।”
“আমাদের কি কুলি মনে হয়?” জাহান প্রশ্ন করে।
মহুয়া ব্যাঙ্গ করে বলে, “বডি হয়ে লাভ কি একটা ব্যাগও যদি উঠাতে না পারো?”
জাহান এগিয়ে আসে তার দিকে, “স্বয়ং তোমাকে একহাতে উঠাতে পাড়ব। দেখতে চাও?”
মহুয়া তার কথায় একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে তিসানের করুণ তাকিয়ে বলে, “ব্রোফ্রেন্ড, প্লিজ হেল্প।”

তিসান মাথা নাড়ায়। ব্যাগটা উঠিয়ে তারা যেতে নিলেই মহুয়ার কিছু একটা মনে পড়ে থেমে যায়, “আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।” বলেই সে দৌড়ে যায় রান্নাঘরে। ধোঁয়া উঠা এক মগ গরমপানি নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় রুবিনা খাতুনের। একগাল হাসি নিয়ে বলে, “আপনি আমার বান্ধবীর এত খাতিরদারি করেছেন। তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে না?”
এক মুহূর্ত দেরি করে না মহুয়া, বুঝে উঠার আগেই ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয় রুবিনা খাতুনের পা’য়ে। গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠে সে। ছটফট করতে থাকে। আবার মুখ খোলার পূর্বেই মহুয়া তার সামনে ছু’রিটা ঘুরায়। চুপ করে যায় সে।

তিসান হা হয়ে যায়। পাশে ঝুঁকে জাহানের কানের কাছে যেয়ে বলে, “কী ডে’ঞ্জারেস মেয়ে রে বাবা!”
“জাহানের জান বলে কথা। ডে’ঞ্জারেস হতেই হবে।”

মহুয়া মগটা রেখে আবারও একগাল হেসে রওনা দিতে নিয়েও থেমে যায়। পিছনে ফিরে তাকায় মোফাজ্জল হোসেনের দিকে। হাসি বজায় রেখেই তার উদ্দেশ্যে বলে, “আচ্ছা আংকেল একটা কথা বলুন তো, আল্লাহর দরবারে যদি আপনার মৃণার মা’য়ের সাথে কখনো দেখা হয় তখন কী জবাব দিবেন তাকে? আপনার মতো বাবা পাওয়ার থেকে অনাথ হওয়া ভালো।”
মহুয়া বেরিয়ে গেলে জাহান তিসানকে বলে, “তিসান তোর এই জায়গাটা ভালো লেগেছে?”
“না, কেন?”
“তাও আংকেলকে এই জায়গাটার কথা বলিস। এপার্টমেন্ট বিল্ডিং হিসেবে খারাপ হয় না। আর জলদি বলিস আমি কিছু মানুষকে হোমলেস দেখতে চাই।”
“এখন ভালোই লাগছে জায়গাটা।”
.
.
জাহান, মহুয়া ও তিসান একটি ক্যাফেতে বসে আছে। গাড়িতেই মহুয়ার খিটখিটে মেজাজ দেখে জাহান এক জায়গায় পার্ক করে। আসতেই সে অনেককিছু অর্ডার দেয়। অপেক্ষা করতে না পেরে একটি পেস্ট্রি অর্ডার দেয়। রেড ভেলভেটটা মুখে নিতেই শান্তিতে চোখ বন্ধ করে নেয়, “ইয়ামি।”
“পেট খারাপ হবে।”
জাহানের কথায় কপাল কুঁচকে নেয় মহুয়া, “কেন?”
“যেভাবে খাচ্ছো। কেক না খাওয়া ব্যক্তিদেরও লোভ লাগে।”
“তুমি খেলে আনিয়ে নেও। আমার পেস্ট্রির দিকে নজর দিবা না। আমি দিচ্ছি না।”
“আমি এসব খাইও না। সব আজেবাজে খাবার অর্ডার দিয়েছ। এসব মানুষে খায়?”
“মানুষেই খায়। ঘাস পাতা গরু ছাগল খায়। ওহ সরি তুমি তো গরু ছাগলই। তুমি তো খাবাই।”

তিসান বলে, “বাট জাহান ঠিকই বলেছে। তোমাকে দেখে আমারই খেতে মন চাচ্ছে। বাট আফসোস সম্ভব না। মডেলিং করতে গেলে কতকিছু মানতে হয়। তুমি ফুড মডেলিং ট্রাই করতে পারো। তোমাকে খেতে দেখে অন্যেরও ওইটা ক্রেভিং হয়ে ওঠে।”
“ধ্যুর তোমরা সবাই আমার খাবারে নজর দিচ্ছো কেন? শান্তি মতো খেতে দেও তো।”
“আচ্ছা মহুয়া, আমি তো তোমার ব্রোফ্রেন্ড তাই না? ব্রো মানে ভাই, জানো তো?”
“তুমি না বললা আমি তোমার বোনের মতো। তাই অফকোর্স তুমি আমার ভাই।”
“তাহলে ভাইয়ের জন্য একটা কাজ তো করতেই পাড়বে তাই না?”
“কী?”
“তোমার ওই ফ্রেন্ড আছে না?”
“মৃণা?”
“না না। আরেকজন, মোহ। ওকে জানাতে পাড়বে তোমার আমার মাঝে কিছু ছিলো না। সব নাটক।”
“আমি আগে থেকেই বুঝেছি তোমার নজর ওর দিকে। আইসা যেমনে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় থাকতা যে জীবনে মেয়ে দেখো নাই।”
“ওর মতো দেখিনি। ওদিন লাইব্রেরিতে যখন ওকে জানালার পাশে বসে দেখেছিলাম মনে হচ্ছিল সদ্য কোনো পরী আকাশ থেকে নেমে এসেছে। আমার হৃদস্পন্দন এতটা দ্রুত হয়ে গিয়েছিল যেন হঠাৎ থেমে যায়। মনে হচ্ছিল….”

মহুয়া তার কথা মাঝপথে থামায়, “হইসে হইসে বুঝছি। অনেক সুন্দর গীতিকাব্য করছো কিন্তু লাভ নাই ব্রো। ও রিলেশন করবে না।”
“কেন?”
“তোমার মনে হয় ও রিলেশনে ইন্টারেস্টেড থাকলে এখনো সিঙ্গেল থাকতো? ও ডিরেক্ট বিয়ে করবে। গ্রাজুয়েশন শেষে। তাও আরেঞ্জ ম্যারেজ। তোমার আগে হাজারজনের সিরিয়াল আছে ওর জন্য। একজন তো চারবছর ধরে প্রতিমাসে ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনে। একজন আংকেলের অফিসেই কাজ করে। আংকেলকে পটাতে ব্যস্ত। আমার নিজের কাজিনই তো ওর যোগ্য হওয়ার জন্য পিএইচডি করতে বিদেশে গেছে। যাওয়ার আগে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে গেছে। আরও শুনতে চাও। আরও আছে।”

তিসানও ভাব নিয়ে বলে, “আমি কোনো অংশ থেকে কম না’কি? হ্যান্ডসাম আছি, ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছি, বংশ ভালো, বংশগত অর্থ থাকলেও নিজে কামাই করে নিজের খরচা চালাই। দেশে আমার চেহেরার বিলবোর্ড লাগে। কোন অংশে কম আমি?”
“ভাই দেখো আমি এসবে নাই। আমার কাজিন যদি জানে আমি তোমাকে হেল্প করছি তাহলে আমাকে বটগাছে শাঁকচুন্নির সাথে উলটা লটকায় দিবে। বিয়ার প্রস্তাব দেও আংকেল নিজে বুঝবে। এমনিতেও সময় আছে। পড়াশোনা শেষ হবার পূর্বে আংকেল ওকে বিয়ে দিবে না।”

জাহান টেবিলে কণুই দিয়ে গালে হাত রেখে তাদের কথা শুনছিল। মহুয়ার শেষ বাক্যের পরিবর্তে সে বলে, “তাহলে বটগাছে উলটে লটকে তোমার জমজ বোনের সাথে লুডু খেলো।”
মহুয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মুখ বানায়। কিন্তু তার পেস্ট্রি খাওয়ায় ব্যাঘাত পড়বে বলে ঝগড়া করতে উঠেপড়ে লাগে না।

তিসান বলে, “সিসফ্রেন্ড তাও প্লিজ একবার মোহের সাথে ফ্রেন্ড হতে সাহায্য করো। গ্রাজুয়েট করতেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব ওদের বাসায়। করাও না প্লিজ।”
জাহান তার মাথায় চাটি মেরে বললে, “সিসফ্রেন্ড কি’রে? ভাবি বল।”
“ভাবি বললে জীবনেও হেল্প করবে না। তোর প্রেম থেকে আমার প্রেম হওয়ার চান্স বেশি আছে।”
“এমন ফালতু কথা বললে লাথি খাবি সবার সামনে। যতটুকু সম্মান আছে ততটুকুও থাকবে না।”
“ধ্যুর তোর থেকে তো শায়ানই ভালো। এমন হুমকি তো দেয় না।”
“যা শালা, ওর কাছেই যা। পড়ে যখন বড়ভাবে ফাঁসাবে তারপর আমার কাছে আসিস কান্না করতে করতে।”

হঠাৎ মহুয়ার ফোন বেজে উঠে। ব্যাগ থেকে বের করে দেখে মোহের নাম্বার। সে সাথে সাথে কপালে হাত রাখে।
“কী হয়েছে?” জাহান জিজ্ঞেস করে।
“এতকিছুর মাঝে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজ মিতা আপুর বিয়ে ছিলো।”
“মিতা আবার কে?” তিসান প্রশ্ন করে।
“মোহের বড় বোন।”
“বলো কি? বিয়েতে যাবা। আমাকেও নিয়ে চলো না। মোহ আজ নিশ্চয়ই সেজেছে। অপ্সরী লাগছে একদম, আমি কল্পনা করতে পাড়ছি।”
“সাড়ে পাঁচটা বাজে। এতক্ষণে বিয়ে শেষ। আমাকে ঝাড়তে কল দিয়েছে। আল্লাহ যেন বাঁচায় আমাকে।”
“শেষ হলে কী? সাজুগুজু তো করে আছে। চলো না যাই, এই সুযোগে শশুড়বাড়িও দেখা হয়ে যাবে।”
মহুয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তার দিকে। বকা দেয়, “আরেকটা শব্দ করলে জিহ্বা কে’টে দিব একদম।”

সে আমতা-আমতা করে ফোন ধরে হঠাৎ ভাবভঙ্গি পালটে নেয়। নরমসুরে বলে, “জান, পাখি রাগ করিস না। আমি না বের হয়েছিলাম বিয়ের জন্য এর মাঝেই মৃণা….”
হঠাৎ ওপাশ থেকে মোহের কন্ঠ শুনা যায়। তার কথা কা’টা যায়, “দোস্ত আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মহুয়া কতক্ষণের জন্য। পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে বলে, “মজা করিস আমার সাথে? আসি নি বলে এমন মজা করছিস?”
ওপাশ থেকে মোহ শান্ত কন্ঠে বলল, “তোর মনে হয় এই ব্যাপারে মজা করব? মিতা আপু পালিয়ে গেছে। আর তার বদলে আমার বিয়ে করতে হয়েছে। বরের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে মহু। বিবাহিত আমি।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ১২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা.

“আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মহুয়া কতক্ষণের জন্য। পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে বলে, “মজা করিস আমার সাথে? আসি নি বলে এমন মজা করছিস?”
ওপাশ থেকে মোহ শান্ত কন্ঠে বলল, “তোর মনে হয় এই ব্যাপারে মজা করব? মিতা আপু পালিয়ে গেছে। আর তার বদলে আমার বিয়ে করতে হয়েছে। বরের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে মহু। বিবাহিত আমি।”

মহুয়া এবার ক্ষেপে যায়, “তোর বোন পালিয়ে গেলেই তুই ঠ্যাংঠ্যাং করে বিয়ে করে ফেলবি। একবার তুই, একবার মৃণা সবাই কি বিয়ে বিয়ে খেলছিস?”
“মৃণার আবার কী হলো?”
” সে কথা বাদ দে, এখন ঠিক আছে।”
“আচ্ছা সময় নেই। পাত্রদের বাড়িতে সবাই রওনা দিবে।”
“তুই বিয়েতে রাজি হলি কোন দু:খে?”
“বাবা বলেছিল।”
“আংকেল বলল আর তুই রাজি হয়ে গেলি?” মহুয়া অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে।
“তো আমি তো শুরু থেকেই ধরে রেখেছিলাম বাবা মা’য়ের পছন্দে বিয়ে করব। বাবা বলেছে তাই রাজি হয়ে গেছি মন্দ কী?”

মহুয়া নিজের কপালে হাত রাখে, “তোর বিয়ের কত স্বপ্ন দেখেছিলাম রে। এই সাজব, নাচব, দুলুভাইরে বিরক্ত করব। তুই আমার সব স্বপ্নে কেরেসিন ঢেলে আ’গুন ধরিয়ে দিলি।” তারপর আবার একপলক তিসানের দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে যায়। মুখের উপর হাত রেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “দুলুভাই দেখতে কেমন?”
“শ্যামসুন্দর।”
“উপন্যাসিক ভাষায় না বলে আমার ভাষায় বল।”
“হ্যান্ডসাম আছে। তবে একটু বয়স বেশি। এতে বোধহয় আরও চার্মিং লাগে।”
“ডোন্ট টেল মি তোর একদিনেই পছন্দ হয়েছে।”
“একদিনে না এক ঘন্টায়। পছন্দ না আকর্ষণ। জানিস আমি এতদিন উনাকে দেখেছি আমার মন টানে নি। অন্যান্য পুরুষের মতোই দেখতাম কিন্তু যেই আমি কবুল বলে কাবিন নামায় সই করে তার দিকে তাকালাম হঠাৎ তার দিকে মন টানল। ভীষণ আকর্ষণীয় লাগলো তাকে। জানতান না একটা শব্দে আর স্বাক্ষরে এত শক্তি থাকে।”
“চালিয়ে যাও বাছাগণ। এখন আসব?”
“না, চলে যাব ওবাড়ি। এসেও পাবি না। পুরশু বৌভাত। জলদি বাসায় এসে ওখান থেকে আসবি।”
“আচ্ছা, শুন ছেলের নাম কী?”
“সমুদ্র।”

মহুয়া কল কেটে ঘুরে তাকাল তাসিনের দিকে। তাসিন বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে জোরপূর্বক হাসল। তাসিন জিজ্ঞেস করে, “মোহের কল এসেছিল তোমার ফোনে? তাহলে কার সাথে কথা বলছিলে?”
মহুয়া আমতা-আমতা করল, “মোহের মধ্যে কী আছে? তুমি আরো…না আরো সুন্দর তো হয় না কিন্তু ওর থেকে একটু কম সুন্দর মেয়েও পাবে।”
তাসিন গম্ভীরমুখে ভ্রু কুঁচকায়, “কী হয়েছে?”
“ওর বিয়ে হয়ে গেছে।” বলেই মুখে হাত দেয় মহুয়া। তিসান শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে, “তুমি বলেছিলে গ্রাজুয়েশনের আগে ওর বিয়ে হবে না।”
“পরিস্থিতি। ওর বোন পালিয়ে…”
“ওর বোন পালালেই কি ওর বিয়ে করতে হবে?” গর্জে উঠে তিসান। জাহান উঠে তাকে সামলায়।
এদিকে ওয়েটার এত বাজে সময় খাবার এনেছে।
মহুয়া চুপচাপ বসা। তার মনে এক আকাশ দু:খ রাশ করেছে। মোহের বাচ্চা একটু পরে কল দিতে পাড়তো না? এত মজার মজার খাবার তার সামনে কিন্তু সে ধরতেও পাড়ছে না তিসানের পরিস্থিতি দেখে। সে বিড়বিড় করে বলে, “কী ঢঙ! একদিনে কে প্রেমে পড়ে ভাই? এর নাটকের চক্করে আমার খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এত খাবার সামনে রাখা কিন্তু ছুঁতেও পাড়ছি না। হায় দুঃখ! ব্রোফ্রেন্ড থেকে তো আমার দুঃখ বেশি। অথচ আমি প্রকাশ করলে হয়ে যাব নির্দয় নারী। ধ্যুর ভাল্লাগেনা।”
মহুয়া তিসানের দিকে তাকায় আবার তাকায় টেবিল ভর্তি খাবারের দিকে। কষ্টে চোখ বন্ধ করে নেয়।
.
.
চারদিকে ফুলের সুবাস ভাসছে। মৌ মৌ এই সুবাসের মাঝে বারবার বিচলিত হয়ে উঠছে মোহ। সে বসে আছে বধূবেশে গোলাপের পাঁপড়ির মাঝে। সে চোখ বুলায় চারদিকে। রুমটায় কেবল একটি আলমিরা, টেবিল, ড্রেসিংটেবিল ও বিছানা। খাটের একপাশে একটি সাইডবক্স আছে। রুমটা সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে সাজানো। মোহ তার হাঁটু ভাঁজ করে হাতদুটো দিয়ে হাঁটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। কপালটা হাঁটুতে ঠেকিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে। সে জানতো একদিন এক অজানা কারও সাথেই তার বিয়ে হবে। সে নিজেও এটাই চেয়েছিল। তবে সবকিছু এমন হঠাৎ হবে সে ভাবে নি। সে কবুল বলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। তার বাবার এক নরম স্বরে সে রাজি হয়ে গেল। দ্বিমত করার প্রশ্নও উঠে না। তার পরিবারের সম্মানের কথা ছিলো। আর সে-ও তো চেয়েছিল তার বাবা মা যেখানে বলবে সেখানে সে বিয়ে করবে। বিয়ের পর নিজের স্বামীকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবে। তারা একে অপরকে নতুন করে চিনবে, জানবে, বন্ধুত্ব করবে, ভালোবাসবে, সবকিছুর মধ্যে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব থাকবে। সে চেয়েছিল জীবনে কেবল একটি পুরুষকে ভালোবাসতে। তার স্বামীকে। আজ সে দিন এসেছে। আজ থেকে তার নতুন জীবন শুরু হবে। তার জীবনের প্রেমের উপন্যাসের সূচনা হবে।

এগুলো ভাবতেই তার মন হাল্কা হয়ে গেল। সে ফুলের মাঝ থেকে উঠে তার লেহেঙ্গাটা তুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে দাঁড়াল। তাড়াহুড়োয় বিশেষ সাজগোজ হয় নি তার। কিন্তু মেরুন এই লেহেঙ্গাটা তার উপর ফুটে আছে। দেখে মুচকি হাসে সে। বউ সেজে তাকে ভালোই মানিয়েছে। আচ্ছা তার হবু স্বামী কি তাকে দেখেছে ঠিক মতো? তার নাম কী যেন? হ্যাঁ, সমুদ্র।

দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পিছনে তাকায় মোহ। দেখতে পায় সাদা রঙের শেরোয়ানিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। লম্বা, সুদাম দেহ, শ্যামবর্ণ, সুদর্শন একটা পুরুষ। তার সামনের এই লোকটি আজ থেকে তার স্বামী ভাবতেই তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। সে চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইল। আচ্ছা লজ্জা পেলে না’কি মেয়েদের গাল গোলাপি হয়ে যায়। তার কী হয়েছে? পিছনে ফিরে আয়নায় দেখবে সে?

চিন্তায় বাঁধা পড়ে। পুরুষালি এক কন্ঠ তার কানে আসে,
“তোমার বয়স কত?”
হঠাৎ এই প্রশ্নে হতচকিত হয়ে যায় মোহ। সে অবাক হয়ে তাকায় তার সামনে দাঁড়ানো পুরুষটির দিকে। তারপর মৃদুস্বরে উওর দেয়, “উ…উনিশ।”
লোকটার মুখে নিরাশা ও বিরক্ত দুইটাই ভেসে উঠে। সে সরাসরি বলে বসে, “আমার বয়স আটাশ। নয় বছরের বড় তোমার। তোমার মা বাবা না বুঝেশুনে তোমাকে এত বড় বয়সের একটি লোকের সাথে বিয়ে করতে বলল আর তুমি নেচে নেচে বিয়ে করে ফেললে? চিনো না, জানো না, একবার তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম সালাম দিয়েছ এতটুকুই। এরপর দুইএকবার দেখা। কথা হয় নি। বিয়ে করার কথা মাথায় আসলো কীভাবে তোমার? যাই হোক, বিয়ে করেছ ঠিক আছে। বউদের মতো ভাবসাব করতে আসবে না। এইটা কেবল নামমাত্র বিয়ে। তুমি তোমার মতো থাকবে, আমি আমার মতো। এমনিতে আমার এই বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো না।”
কঠোর এই কথাগুলো বলে সমুদ্র কি সুন্দর মতো আলমিরা থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। আর এদিকে মোহ দাঁড়িয়ে রইল। নিথরভাবে। সমুদ্র কি বলল না বলল সে ঠিক বুঝতে পাড়ল না। নিশ্চয়ই সে ভুল শুনেছে। সমুদ্র রেগে আছে? নিশ্চয়ই রেগে থাকার কথা, তার বোন বিয়ে থেকে পালিয়ে গেছে। তার এবং তার পরিবারেরও অপমান হয়েছে এতে। এর উপর অচেনা একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে করিয়ে দিলো। সমুদ্রর রেগে থাকাটাই তো স্বাভাবিক।

তার ভাবনার মাঝেই সমুদ্র তার পোশাক পালটে এসে পড়েছে। সাদা শেরোয়ানির পরিবর্তে টাওজার এবং টি-শার্ট পরে আছে। সে কিছু না বলেই মোহের পাশ কাটিয়ে বিছানার কাছে যাচ্ছিল। আর মোহ তাকে ডাক দিলো, “শুনুন…”
সমুদ্র পিছনে তাকায়। তার সরু চোখদুটো আরও তীক্ষ্ণ করে তাকায়। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করে না। তাই মোহ নিজেই বলে, “আমি জানি আপু যা করেছে তা ঠিক করে নি। এভাবে পালিয়ে ঠিক করে নি। এতে আমাদের দুইজনের পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়েছে। আমি আপুর পক্ষ থেকে আপনার কাছ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি।

হঠাৎ সে খেয়াল করে সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি। তার দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়। সে থপ করে বিছানায় বসে হেসে উঠে, ” তুমি আমার থেকে ক্ষমা চাচ্ছো? আমিই তো ওকে পালাতে সাহায্য করলাম।”

মোহের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল কথাটা শুনে। কিছু মুহূর্তের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে গেল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
“মশকরা করছেন আপনি?” মোহ খুব কষ্টে তার গলা দিয়ে কথাগুলো বের করে।
আবারও হাসে সমুদ্র, “তোমার আমাকে দেখে মনে হয় মজা করছি?” সে উঠে মোহের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, “দেখো তোমার বোন অন্য কাওকে পছন্দ করতো। আর আমাকে মা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে বিয়েটা দিচ্ছিল। বিয়ে তো কখনো আমি করতেই চাই নি। তাই গতকাল কথা বলে প্লান করলাম আজ ওকে পালাতে সাহায্য করেছি। আমিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।”
মোহের মাথা ঘুরিয়ে উঠে। এই লোকের মাথা খারাপ? কি যা তা বলছে এই লোক?

সবকিছু শেষে তার মাথায় কেবল একটি কথাই ঘুরে “বিয়ে তো কখনো আমি করতেই চাই নি।” মানে সে বিয়েটা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করেছে?
সে প্রশ্ন করে, “আপনি বিয়ে করতে চান নি কেন?”
সমুদ্র সোজাসাপটা উওর দেয়, “কারণ আমি অন্যকাওকে ভালোবাসি। তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। হলো না।” সে পিঠ করে বিছানাটার কাছে যেতে যেতে কথাগুলো বলে। দাঁড়িয়ে যেয়ে তার দিকে তাকায়। গম্ভীরমুখে বলে, “নিশ্চয়ই আমার স্ত্রী আমার থেকে একটুখানি ভালোবাসার আবদার করবে কিন্তু আমার বুকে আর ভালোবাসা নেই। আমি বিয়েটা না করার যথেষ্ট চেষ্টা করে হেরে গিয়েছি। এখন তুমি সত্যিটা জেনে চাইলে থাকতে পারো, নাহয় চলে যাও। তোমার ইচ্ছা। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তোমার যেখানে ইচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো।”
সত্যি সত্যি লোকটা শুয়ে পড়ল বিছানায়।

এদিকে মোহ দাঁড়িয়ে রইল হতবাক হয়ে। সে হাজারো কল্পনা সাজিয়েছিল তার বিয়ের পরের সময়ের। এমন কিছু তো তার কল্পনায় ছিলো না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? এ কেমন দু:সপ্ন! এই দু:সপ্নে তার বুকের ভেতর এমন ব্যাথা করছে কেন। সে খেয়াল করল তার হাতে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। সে পিছনে আয়নাতে তাকায়। তার চোখ দিয়ে এই জল পড়ছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে তার গালে হাত দিলো। সে শেষ কবে কান্না করেছিল তার মনে নেই। সে আয়না থেকে ঘুমিয়ে থাকা লোকটিকে দেখল। একটু আগে মনে ধরা এই পুরুষটিকে তার চরমভাবে অপছন্দ হলো। যে মেয়ে এতবছরে কাঁদে নি তার সাথে দেখা হওয়ার কয়েক মিনিটে তার চোখে অশ্রু এনে দিলো এই লোক? কান্নার সাথে সাথে তার রাগ উঠে। সে তার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে নিজের চক্ষু মুছে বিছানার দিকে এগোয়। দুইহাতে লেহেঙ্গা খানিকটা তুলে বিছানায় উঠে দাঁড়ায়। এক লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেয় সমুদ্রকে।

সমুদ্র মেঝেতে শুয়ে বিস্মিত হয়ে তার সামনের মেয়েটাকে দেখছে। একটু আগের শান্ত, চুপচাপ মেয়েটা এমন কিছু করতে পারে তা কল্পনাও করতে পারে না সমুদ্র।যখন তার চোখেমুখে বিস্ময় তখন মোহ তার লেহেঙ্গাটা উঁচু করে বিছানায় বসে পড়ে। তার দিকে তাকিয়ে হাত গালে রেখে রাগে ফুঁসে বলে, “এই লোক যদি বিয়ে করতে না হতো তাহলে এত কাহিনি না করে আমাকে এসে বলতেন। আমি ব্যাপার সামলে নিতাম। হোয়াট ইউ মিন বাই আমি কাওকে ভালোবাসতে পাড়ব না? আমি কি তাল গাছ থেকে পড়েছি? নিজে কবুল বলে স্বাক্ষর করে বিয়ে করেছেন না?”

তার হঠাৎ প্রশ্নের ধরণ দেখে সমুদ্রর গলা দিয়ে উওর বের হলো না। মনে হলে উওর দিলে এসে গলাই চেপে ধরবে।
মোহ উওর না পেয়ে আরও রেগে দিয়ে বলল, “আপনি জানেন আমি আজ পর্যন্ত একটা প্রেম তো করিইনি, ক্রাশ পর্যন্ত খাই নি যাস্ট আমার স্বামীর জন্য। একমাত্র তাকে ভালোবাসবো বলে। আর এদিকে আপনি….আপনার উপর আমার যা রাগ উঠছে। মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।”
রাগ বের করে ঘন ঘন নিশ্বাস নেয় মোহ। স্বাভাবিকভাবে তার এত রাগ নেই। কিন্তু লোকটার উপর তার ভীষণ রাগ লাগছে। ভীষণ রাগ। সে রাগ বের করে চোখমুখ কুঁচকে তাকায় সমুদ্রর দিকে, “বের হন।”
“কী?” বিস্মিত স্বরে বলে সমুদ্রের দিকে।
“বললাম বের হতে আমি এই ভারী লেহেঙ্গা পালটে মুখ ধুঁয়ে ঘুমাবো।”
“আমি কোথায় যাব?”
“জাহান্নামে যান। যাস্ট আধাঘণ্টার আগে ফিরে আসবেন না।”
সমুদ্রের এক দৌড়ে বারান্দায় গেল। ঘরে সব মেহমান। সবাই তাকে ভীষণ ভয় পায়। তার রাগ বেশি একারণে। আর সব কাজিনরা তাকে সম্মান করে। আইডল মানে। যদি কেউ জানে তার নববিবাহিতা পিচ্চি এই বউ তাকে লাথি মেরে বের করে দিয়েছে তাহলে তার মান সম্মান আর থাকবে না। সে বারান্দায় যেতেই মেয়েটা তার পিছন দিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সিগারেট জ্বালায় একটা।
“এজন্যই বিয়ে করতে চাই নি। আরও মা উল্টো এই পিচ্চি মেয়েকে কাঁধে ঝুলিয়ে দিলো। আচ্ছা ভালো কথা মেয়েটার নামই জিজ্ঞেস করা হলো না। মেয়েটার নাম কী?”

সমুদ্র তা বাদ দিয়ে তার সিগারেটে ধ্যান দিলো। একসময় ছিলো যখন তার সিগারেটের গন্ধে বমি আসতো। আর এখন সিগারেট না খেলে যেন তার নিশ্বাসই আসে না। মনে হয় হৃদপিণ্ডে প্রচন্ড ব্যাথা উঠে। মনে হয় এই সে মরে যাবে। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে সব বেদনাও উড়িয়ে দেয়। একে একে দুইটা সিগারেট শেষ করে তিন নাম্বারটা জ্বালায় সমুদ্র। তখনই দরজা খোলার শব্দ পায় সে। পাশে তাকাতে দেখে সে মেয়েটা চোখ মুখ কুঁচকে এমন করে রেখেছে যেন খুব বিশ্রীরকম কোনো দৃশ্য দেখে নিয়েছে। সে নাকে হাত দিয়ে চাপা গলায় বলে, “ছি: আপনি সিগারেট খান? এখনই ওটা ফেলে রুমে এসে দরজা বন্ধ করেন, নাহলে আমি এখনই দরজা বন্ধ করে দিব। তারপর সারারাত বারান্দায় কাটিয়েন।”
“আমার রুম থেকে তুমি আমাকে বের করবে?”
মেয়েটা সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করতে নিলে সমুদ্র বলে, “নিভাচ্ছি তো। সময় তো দিবে না’কি?”
সে সিগারেট নিভিয়ে রুমে আসে। এসে দেখে সে তার লেহেঙ্গা, চুড়ি, গয়না, মেঝেতে পড়ে আছে। স্যুটকেসের আশেপাশে এলোমেলো হয়ে আছে কতগুলো কাপড়। সেদিকে তার ধ্যান ছিলো তখনই মেয়েটা বলে, “আগামীকাল আপনার আলমিরা অর্ধেকের বেশি খালি করে দিবেন।”
“কেন?”
“তো আমার জামা-কাপড় কি আপনার মাথায় রাখব?”
তার ঝারি শুনে সমুদ্র আমতা-আমতা করে বলে, “ঠিকাছে। কিন্তু তুমি আসলে থাকবে?”
“ভেবে দেখতে হবে তো। আর ভাবতে সময় লাগে। এতদিন কি আমি আমার জামা-কাপড়….”
“জামাকাপড় আমার মাথায় রাখা লাগবে না আমি জায়গা করে দিব।”
সে দেখে মেয়েটা মাথার চুল হাতদিয়ে খোঁপা করে বিছানায় শুতে যাচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তোমার নাম কি?”
মেয়েটা এবার তার দিকে এমন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় যেন বাহিরের গ্রহের প্রাণী দেখছে। সে আরও বিরক্ত হয়, “কবুল বলার সময় কী কানে তুলা দিয়ে রেখেছিলেন? অন্তত তখন তো নাম শুনেই কবুল বলেছিলেন। তাই না?”

সমুদ্র তার বাম হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো নেড়ে মাথা নিচু করে নেয়। তখন মোহের তাকে কিউট লাগে। কে বলবে এই লোক তার থেকে নয় দশ বছরের বড়? মোহের হঠাৎ করে রাগটা কমে আসে। সে মৃদুস্বরে উওর দেয়, ” আমার নাম মধুরা মোহ।”
“সুন্দর তো। ওহ আমার নাম…”
“জানি। আমি কবুল বলার আগে কান খোলা রেখেছিলাম।”
“আচ্ছা তাহলে আমি কোথায় ঘুমাব?”
“তো আপনি যখন বলেছিলেন যেখানে ইচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো তখন কী ভেবে বলেছিলেন?”
সমুদ্র আমতা-আমতা করে কিন্তু উওর দেয় না। মোহ তার পাশের একটি বালিশ সামনে দিয়ে বলে, “মেঝেতে ঘুমান। নিজে তো এটাই ভেবেছেন কেঁদেকেটে মেঝেতে বিছানা করে আমি ঘুমিয়ে পড়ব। ঠিক বলেছি না? এতটুকু পিচ্চি থেকে এরথেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না।”
সমুদ্র উওর দেয় না। সে ঠিক এটাই ভেবেছিল।
মোহ চাদর মুড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে।

সমুদ্রও আর কোনো উপায় না পেয়ে একটি চাদর বিছিয়ে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ল। কি একটা ঝামেলায় পড়ল সে! বিয়ে নামক ঝামেলা কম ছিলো? এই তো সাক্ষাৎ একটা ঝামেলা তার জীবনে এসে হাজির হলো। সে মুখ তুলে তাকাল মোহের দিকে। সে গভীর ঘুমে। এই মেয়ের কি একটু চিন্তাও হচ্ছে না। এত আরামে ঘুমাচ্ছে কীভাবে?

নিজের বিছানা থেকে বহিষ্কার হয়ে আর ঘুম হলো না রাতে তার। এর উপর মোহকে এত আরামে ঘুমাতে দেখে আরও রাগ হলো তার।

সকালের তীক্ষ্ণ রোদ চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙে মোহের। সে উঠে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখ খুলে দেখতে পায় অচেনা একটি কক্ষ। সে প্রথমে বিস্মিত হলেও পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গতকালের বিয়ের ঘটনা। বিয়ের কথা মনে করেই গভীর নিশ্বাস ফেলে মোহ। ঘুম থেকে উঠতেই যদি সে জানতো এটি কেবল স্বপ্ন ছিলো!

মোহের চোখ পড়ে টেবিলে বসে থাকা সমুদ্রের দিকে। সে ল্যাপটপে বসে মুভি দেখছে। নিচে বিছানাও নেই। সে জিজ্ঞেস করে, “আপনি ঘুমান নি রাতে?”
সমুদ্র উওর দেয় না। তার কানে হেডফোন দেখে সে উঠে যায় তার পাছে পিছন থেকে উঁকি মেরে হরর মুভি দেখছে সমুদ্র। এমন দৃশ্য যেখে সে নিজের ভয় পেয়ে যায়। তার সবচেয়ে অপছন্দের হরর মুভি। আর এই লোক সকাল সকাল এটাই দেখছে। এই লোকের কি মাথা খারাপ?

সে সমুদ্রকে ডাকার উদ্দেশ্য তার কাঁধ ছুঁতেই হঠাৎ সমুদ্র খপ করে তার হাত ধরে নেয়। এবার ভয়ে রুহ কেঁপে উঠে মোহের। সমুদ্র পিছনে তাকিয়ে মোহকে দেখে বলে, “ওহ তুমি? আমি আরও ভাবলাম ভূতের ছবি দেখতে দেখতে কোন ভূত আমার আমার কাঁধে এসে বসলো।”
“তো আপনি ভূতের হাত এভাবে ধরতেন?”
“এইত্তো ধরেছি।”
মোহ হাতের দিকে তাকিয়ে রেগে ছাড়িয়ে নেয়।
তারপর জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঘুমান নি?”
“এই শক্ত জায়গায় আমার ঘুম আসে না। নিজে তো আরামে আমার তুলতুলে বিছানায় ঘুমিয়েছ।”
মোহের তার জন্য একটুও খারাপ লাগে না। এই লোক গতকাল তাকে এই মেঝেতে ঘুমানোর পরিকল্পনা করেছিল। সে একগাল হেসে বলে, “তাহলে প্রাক্টিস করে নিন। কারণ এখন থেকে এই শক্ত ফ্লোরেই ঘুমাতে হবে। এখন এই মুভি বন্ধ করে ঘুমালেও তো পারেন তাই না?”
“নাম তো মধুরা কিন্তু কাজ বিষের মতন।”
“আপনার মতো লোকের সাথে মধু দিয়ে কাজ নেই জনাব। এখন ঘুমুলে ঘুমান, নাহয় দুপুরে যখন আম শুব তখন বিছানায় থাকলে গতকালের মতো এক লাথিতে ফেলে দিব।”
“নির্দয় মেয়ে কোথাকার। তোমার নাম মধুরা না, অমধু রাখা উচিত ছিলো। অমধু।”
মোহ তাকে পাত্তা না দিয়ে তার লাগেজ থেকে একটি সেলোয়ার-কামিজ ও তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।

ফিরে দেখে সমুদ্র আয়েশে ঘুমাচ্ছে বিছানায়।
মোহ চুল মুছতে মুছতে সেদিকে যায়। তোয়ালেটা টেবিলের উপর রেখে বিছানার পাশের মেঝেতে বসে। বিছানায় হাত রেখে তাকিয়ে থাকে তার সামনে থাকা ঘুমন্ত পুরুষটির দিকে। নির্দ্বিধায় সে সুদর্শন পুরুষ। তার শ্যামা রঙে মুখ যেয়ে মায়া উতলে পড়ে। জামকালো ঠোঁট দুটো। চোখের পাঁপড়িগুলো কী ঘন! নিঁখুত চেহেরা গঠন। সে অনুভব করল সে পুরুষটির দিকে ভীষণ আকর্ষণ অনুভব করছে। অবাক হলো সে। এর পূর্বে কোনো পুরুষের ভাবনা তার মনে আসে নি। এত পুরুষ তার পিছু ঘুরলো অথচ সে কারো প্রতি আকর্ষণ অনুভবও করে নি। আর এই যে পুরুষ তাকে তুচ্ছ করল, তাকে স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করল তার প্রতি সে দুর্বল হচ্ছে?
ব্যাপারটা ভাবালো মোহকে। সে ঘাবড়ে গেল। তার এত বছরের তার স্বামীরই প্রেমে পড়ার ইচ্ছার কারণে এমন অনুভব হচ্ছে না তো? না’কি বিয়ের পবিত্র বন্ধনের কারণে। তার মনে পড়ল যে মুহূর্তে সে লোকটির দিকে একবার তাকিয়ে কবুল বলেছিল, সে মুহূর্তে তার হৃদসম্পন থেমে গিয়েছিল। বিচলিত হয়ে সরে গেল মোহ। না, এমন হতেই পারে না। এমন পুরুষের প্রেমে সে পড়বে না প্রতিজ্ঞা করল। এতবছর সে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, সামনেও করবে।

ভেবেচিন্তে সে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বের হলো রুম থেকে। বের হয়েই দেখতে পেল ঘর ভর্তি মেহমান। সবার আগে সামনে পড়া ফুপিকে সে সালাম দিলো। কিন্তু তিনি উওর দিলেন না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে চলে গেলেন।
একটি ছেলে এসে দাঁড়ায় সামনে, কিশোর বয়সের। সে বলল, “ভাবি আমি আপনার দেবর হই। অখিল। ইউ ক্যান কল মি এ-কে। আমার মা’কে পাত্তা দিবেন না। সে একটু বেশি বুঝে। গতকাল থেকে বলছিল আপনি মেকাপ থুপে না-কি সুন্দর হয়েছে। এমনি এত সুন্দর না। এখন আপনাকে সকাল সকাল এত সুন্দর দেখে তার ভালো লাগছে না। ইউ আর সো ড্যাম প্রিটি ভাবি। আপনার কোনো ছোট বোন নেই কেন?”

এমন সময় সমুদ্রের মা এলো। সে বলল, “সকাল সকাল মেয়েটাকে জ্বালাস না তো অখিল। যা নাস্তা খেয়ে নে।”
সেও মোহকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখলেন। এক মুহূর্তে তার চোখে খুশি জ্বলজ্বল করল, আরেক মুহূর্তে সে গম্ভীর হয়ে চোখমুখ কুঁচকে বললেন, “তুমি জামা পরেছ? বিয়ের প্রথম দিনে? নতুন বউদের শাড়ি পরতে হয় জানো না?”
“বিয়ে তো তাড়াহুড়োয় হলো। শাড়ি আনিনি।”
“আমার সাথে আসো।”
তিনি হাত ধরে মোহকে নিজের রুমে নিয়ে এলেন। তারপর আলমিরা থেকে কিছু কাপড় বের করে তার সামনে রাখতে রাখতে ঠেস মেরে বললেন, “তোমার বোন নিজে তো পালিয়েছে দেওয়া কাপড় নিয়েও পালিয়েছে না’কি?”
“না, লাগেজ আছে। আমি সবকিছু এত কম সময়ে গুছিয়ে আনতে পারিনি।”
“তা যা বলেছ। তোমার বোন সময় দিয়েছে না’কি আমাদের? বিয়ের দিনে পালিয়ে নিজের সাথে আমাদের পরিবারেরও সম্মান খেলো।”
“আপনি কী জানেন আপনার ছেলে নিজে আপুকে পালাতে সাহায্য করেছে?”
মোহের এমন সরাসরি প্রশ্নে থমকে গেলেন আমেনা খাতুন। সে চমকে তাকায় মেয়েটির দিকে। তার সরাসরি তার চোখে তাকিয়ে আছে।

মোহ সরাসরি তাকে প্রশ্ন করে, “আপনার ছেলে যেখানে বিয়ে করতেই চায় নি তাহলে অকারণে তাকে বিয়ে করিয়ে অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করার কী দরকার ছিলো আপনার?”
ঘাবড়ে গেলে আমেনা খাতুন। এসির মধ্যেও তার ঘাম ছুটে গেল। সে এক প্রকার ছুটে এসে মোহের হাত ঝাপ্টে ধরলেন, “সমুদ্র তোমাকে কিছু বলেছে?”
“অবশ্যই বলেছে। আমি যখন বধূবেশে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজারো স্বপ্ন বেঁধে তখন সে অন্যকাওকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিলেন। অকারণে এতগুলো জীবন নষ্ট করলেন কেন? দিয়ে দিতেন তাকে ওই মেয়ের সাথে বিয়ে।”
“ওই বিশ্বাসঘাতক মেয়ে অন্যকারো সাথে ঘর বেঁধেছে দুই বছর আগেই। ওই মেয়ের কথা শুনলে গা জ্বলে আমার। আমার ছেলের এই অবস্থা কেবল ওই মেয়ের জন্য।” তার চোখে জল চলে এলো। সে মোহের হাত ধরে আকুতির স্বরে বলে, “শুনো মা, আমার ছেলেটা খারাপ না। কেবল ভুল মানুষকে ভালোবেসে ভুল দিকে চলে গেছে। তুমি ধৈর্য্য ধরো দেখো একদিন সে তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। তোমার কল্পনার থেকে বেশি ভালোবাসবে। আমি যেদিন…যেদিন প্রথম তোমার বাসায় যাই, সেদিনই তোমাকে আমার নিজের সমুদ্রর জন্য পছন্দ হয়। আমি তোমাকে নিজের ঘরের বউ করে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বয়সের পার্থক্যের জন্য কথা তুলিনি। কিন্তু দেখো ভাগ্যের খেলা, সে তুমিই আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে এলে। কোনো না কোনো কারণ আছে নিশ্চয়ই। বিধাতার ইশারা যে তুমিই আমার ছেলেকে সঠিক পথে আনতে পাড়বে। বলো না মা তুমি আমার ছেলেকে শুধরাবে না?”

মোহ তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বিস্মিত স্বরে বলে, “কী স্বার্থপর আন্টি আপনি? এই মাত্র আমাকে খোঁটা দিচ্ছিলেন, আর এখন আমাকে অনুরোধ করছেন? আর আশ্চর্য আমি কী শিক্ষক না-কি আমার থেকে নয় বছর বড় একটা পুরুষকে আমি শুধরাবো কী করে? আন্টি আমি এই বিয়েটা মানতে পাড়ছি না। আমার ডিভোর্স চাই।”
“এ কি বলছ তুমি মা? আমার উপর রাগ করে বলছ? আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে। মাফ করে দেও। তাও এই কথা বলো না। আমি তখন তোমার সাথে শক্ত হয়েছিলাম, তোমার বোনের কথা শোনাচ্ছিলাম যেন তুমি অনুতপ্ত হয়ে এখানে চুপচাপ এখানেই থাকো। কিছু বলতে না পারো।”
তাচ্ছিল্য হাসে মোহ, “ভুল করেছে আমার বোন, আমি কেন অনুতপ্ত হবো? আমার তো কোনো দোষ নেই। তাহলে আপনি শাস্তির জন্য আমাকে কেন বেছে নিলেন? একটি মেয়ের কত কল্পনা বুনে তার বিয়ে ও সংসার নিয়ে অথচ আপনি আমাকে এমন একটি পুরুষের সাথে বিবাহবন্ধনে বেঁধে দিলেন যার মনে এখনো তার প্রাক্তন আছে? আপনি এটা ঠিক করেন নি আন্টি।”
তখনই দরজায় টোকা পড়ল। সমুদ্রের মা তার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, “মা তোমাকে অনুরোধ করছি আত্নীয়দের সামনে আমাদের সম্মান রক্ষা করো। আমরা পরে এই বিষয়ে কথা বলব। আমাদের আত্নীয়দের সামনে আমাদের অপমান হতে দিও না।”
মোহের মন গলে। সে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে শাড়িটা পরে নেয়৷ বাহিরে যেয়ে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে। চা বানিয়ে খাওয়ায় সবাইকে। সকলের অবস্থা, পছন্দ, অপছন্দ জিজ্ঞেস করে। নিঁখুত অভিনয়। কিছু সময়ের মধ্যে সকলের মন জয় করে নেয় সে। সকলে গতকালের সে নাটকীয় বিয়ে ভুলে মোহের প্রশংসা য় জুটে পড়ে।

দুপুর বারোটায় তার রুমে আসার সময় হয়। সে এতক্ষণে ক্লান্ত। যখন সে দেখে সমুদ্র আরামে ঘুমুচ্ছে তখন তার ভীষণ হিংসা হয়। সে শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে পেঁচিয়ে এক লাথিতে সমুদ্রকে নিচে ফেলে দেয়। তারপর বিছানায় বসে সমুদ্রর জন্য আনা চা’টা নিজে আয়েশ করে চুমুক দেয়।

সমুদ্র ঘুম ঘুম চোখে তাকায় লাল রঙের শাড়ি পরিহিতা মেয়েটির দিকে। রেড মানেই ডেঞ্জার। আর এই মেয়ে পুরোই সাংঘাতিক ডেঞ্জারাস। কোথায় ভেবেছিল পিচ্ছি মেয়ে তার কথায় উঠবে বসবে। তা না, তাকে লাথির উপর লাথি দিচ্ছে।
“এই মেয়ে অমধু তোমার মধ্যে কি আসলে মায়া মমতা নেই। কেউ কি ঘুমন্ত ব্যক্তিকে এভাবে লাথি দেয়? পাষাণ কোথাকার!” বলে সে নিজের কোমড়ে হাত রেখে উঠে। বিছানায় বসে খপ করে মোহের হাতের চায়ের কাপ নিয়ে সেটায় চুমুক দেয়।
মোহ অবাক হয়ে বলে, “এটা কী হলো? আপনি বাসি মুখে আপনার জন্য আনা আমার চা’য়ে চুমুক দিলেন? ছি:! খবিশ।”
“মানুষ নতুন বউদের বাসি মুখে চুমু খায় আর আমি তো শুধু চা খেলাম।”
কথাটা শুনে মোহের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আস্তে চাইল। এই লোক তো ভীষণ লজ্জাহীন। সে বলে, “আপনার লজ্জা করে না এসব বলেন?”
“এই সমস্যা পিচ্চি একটা মেয়ে বিয়ে করলে। সত্যি বললেও পাপ।”
“রাখেন আপনার সত্যি মিথ্যা। সে সকাল থেকে আপনার আত্নীয়দের জন্য এত করছি। আপনার নাম করে চা নিয়ে এলাম খাব বলে সে আপনি চা’টাও খেয়ে নিলেন।”
“কে বলেছে তাদের জন্য করতে। একেকটা সার্কাসের জোকার বুঝলে? এই গতকাল কাহিনি হলো তোমাকে খোঁটা শুনাবে। তারপর এখন তুমি তাদের জন্য করলা তো প্রশংসা করবে। আগামীতে আবার এক থেকে দুই হলে আবার তুমি সেই খারাপই। এদের নিয়ে করে লাভ নেই। মা বাবা এদের নিয়ে তুলুতুলু করে। এদের নিয়ে কিছু করা উচিত না। তুমিও করো না। হুদাই সময় নষ্ট। চা কে বানিয়েছে?”
“আমি কেন?”
“মজা লাগল। আজ চা’য়ের দোকানে যেয়ে মামাকে বলব আপনার চা’য়ের টক্কর দিতে আমার বউ এসে গেছে।” বলে শব্দ করে হাসে সে।
এদিকে ‘বউ’ শব্দটা শুনে মোহের হৃদপিণ্ড নামক মাংসপেশিটা থেমে গেল। আবার বেগতিক দৌড়াতে লাগল। সে মুগ্ধ তাকিয়ে রইল তার সামনে বসা পুরুষের দিকে। একটা পুরুষের হাসি এত সুন্দর হয়?

চলবে….