মেঘের খামে পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
3

মেঘের খামে…
পর্ব ১৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

নিশীরাতে এক কৃষ্ণকলি দাঁড়িয়ে ছিলো ব্যলকনির কিনারায়। তাকিয়ে ছিলো দূর মেঘে ঢাকা গগনের পাণে। মনে করছিল সে উজ্জ্বল মস্তবড় চন্দ্রকে। তার সাথী হাজারো তারাকে। আকশে সে জ্যোৎস্নাময় চাঁদ না থাকলেও তার সিক্ত নয়নজোড়া চিকচিক করছিল। তার হাতে আবদ্ধ একখানা মুঠোফোন। যা বারবার বেজে উঠছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে তার প্রিয় মানুষটির নাম। কিন্তু আজ তার মান দেখে কৃষ্ণকলি আফসোসের দৃষ্টিতে তাকায়। আজ তার প্রিয় কন্ঠটি শোনার ইচ্ছা নেই তার। গভীর নিশ্বাস ফেলে সে। এই দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় এই দুঃখভরা নগরীতে।

হঠাৎ এক আগুন্তকের আগমনের আভাসে সে পাশে ফিরে তাকায়। মুরাদ ভাই এসেছেন।
“ওহ আপনি?”
“তাহলে এত রাতে আমার বাড়িতে আর কাকে আশা করছিলি?”
“ভয় পেয়েছিলাম। ভূত টূত না’কি?”
কথাটায় স্বশব্দে হেসে দেয় মুরাদ, “তুই আস্তো এক ভীতু।”
“ঠিক বলেছেন মুরাদ ভাই। আমি আসলেই ভীতু। তাইতো এতকিছু হচ্ছিল অথচ সাহস কুলিয়ে তাদের ছাড়তে পারি নি, কাওকে কিছু বলতে পাড়ি নি। এই ঘটনার পেছনে আমারও দোষ আছে। নাহলে কীভাবে তারা আমাকে কোনো জিনিস ভেবে বিক্রি করতে যায়?”
“অফকোর্স তোর দোষ আছে। এই সমাজে এখন মানুষ থেকে জানোয়ার বেশি থাকে। তাদের ফাইট করতে শিখতে হয়। একবার দুর্বল পেলে তারা পশুর মতো তোর আত্নাকে ছিঁড়ে মুচড়ে খাবে।”

মৃণা মৃদু হেসে তাকায় মুরাদের দিকে, “আপনি জানেন মুরাদ ভাই মহুয়া অনেক ভাগ্যবান আপনার মতো ভাই পাবার জন্য। কেবল এজন্য নয় যে আপনি ওকে ভালোবাসেন বা ও যা চায় সব এনে দেন কিন্তু আপনি ওকে শক্ত হয়ে শিখিয়েছেন। ওর সামনে কেউ বাজেভাবে কথা বললেও তাকে ছাড়ে না। আই রিয়ালি এডমায়ার হার। এন্ডু ইউ টু। আমি দেখেছি। যখন আংকেলের চাকরি চলে যায় আপনি তখন হয়তো সেকেন্ড ইয়ারে ছিলেন। টিউশনি করেছেন। দিনরাত কাজ করেছেন। পড়াশোনাও করেছেন। আবার নিজের স্টার্টআপের কাজও শুরু করেছেন। পড়াশোনা শেষ হবার পর যখন ফুল টাইম স্টার্টআপ করলেন তখন আপনার কোম্পানির গ্রোথ ফুল স্পিডে উঠে। আপনি সাড়ে তিন বছরে কোম্পানিকে যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন মানুষ দশ বছরেও তা পারে না। মধ্যবিত্ত থেকে এ পর্যায়ে এসেছেন। যাস্ট ওয়াও। আপনি সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট।”

মুরাদ ফর্সা মুখ হাল্কা লাল হয়ে আছে। সে মাথা চুলকে আকাশের দিকে তাকায়। নিজের চশমা ঠিক করে বর্ডারে হাত রাখে। শান্ত কন্ঠে বলে, “একটা কথা কাওকে বলি নি। আজ তোকে বলি। ভুলেও মহুয়াকে বলবি না। আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে তখন হঠাৎ বাবার চাকরিটা যাবার পর বাবা মা’য়ের অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েছিলাম। এত টাকার বেতনও ছিলো না যে জমানো টাকা দিয়ে সব ভালোভাবে চলবে। বড়জোর দুইবছর থাকতে পাড়তাম। মহুয়াও স্কুলে পড়তো। একদিন রাতে আমি প্রথম বাবাকে কান্না করতে দেখি। সে নিজেকে দোষারোপ করছিল আমাদের ভালো না জীবন দেওয়ার কারণে। তখন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সে ভালো জীবনের দায়িত্ব আমি নিব। তারপর শুরু করলাম সবকিছু। কয়দিন মনপ্রাণ দিয়ে সব করলেও একসময় রক্তে আগুন যেন নিভে যায়। অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়ি আমি। অনেক বেশি। বয়স কত ছিলো তখন? একুশ? হয়তো। একদিন ভেঙে যেয়ে কান্না পর্যন্ত করে দেই। তখন একজন এসে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। ভরসা দেয়। নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে বলে।”

এতক্ষণে মুরাদ একটু থামে। নিশ্বাস নেয় গভীর। তাকায় মৃণার দিকে, “জানিস ময়না, সেদিনের পর নিজের উপর কখনো বিশ্বাস হারাই নি। সেদিনের পর থেকে আর পিছু ফিরেও তাকাই নি। এই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ, প্রতিদিন এই আকাশের জ্যোৎস্নাময় চন্দ্রের সঙ্গী হিসেবে হাজারো তারা জ্বলমল করে। আজ এই জ্যোৎস্নাময় আকাশ কৃষ্ণমেঘে ঢাকা। জীবনটাও কী এমন না? কখনো জ্যোৎস্নাময় আলো কখনো কৃষ্ণকালো আঁধারের মতো। কেবল আমরাই পারি আমাদের আকাশের মেঘ সরিয়ে নিজের জীবন জ্যোৎস্নার ন্যায় উজ্জ্বল করতে।”
মুরাদ তাকায় মৃণার দিকে, “তুই পাড়বি না?”
মৃণা তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। প্রশ্নটা শুনেই সে চমকে উঠে। সে পাড়বে? সে সত্যি পাড়বে?

মুরাদ তার উওর না পেয়ে মৃদু হাসে। বলে, “জানিস আমি যা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সব প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছি। একটি বাদে।”
“কোনটি বাদে?” মৃণা প্রশ্ন করল। নরম স্বরে।
“ছিলো একজন। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাকে সবসময় রক্ষা করব। পাড়ি নি।” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“কে সে?”
মুরাদ এবার হাসে, “তোর না জানলেও চলবে। আগে তুই নিজের জীবন গুছানো নিয়ে চিন্তা কর।”
“তাই ভাবছি। আচ্ছা ভাইয়া আমি কি আপনাদের বাসায় ক’দিন থাকতে পারি?”

প্রশ্নটায় মুরাদের মুখ কালো হয়ে যায়। সে কপাল।কুঁচকে তাকায় মৃণার দিকে। তা দেখে মৃণা বলে, “আমি যত দ্রুত সম্ভব একটি চাকরি খুঁজে হোস্টেল বা মেসে সিফট হয়ে যাব। আপাতত এত টাকা নেই তো তাই…”
“সাট আপ।” মুরাদ ধমকের সুরে তাকে বে, “কেউ তোকে এখানে থাকার জন্য কিছু বলেছে? আমি বলেছি? মহুয়া বলেছে? কে বলেছে মা? বাবা?”
মৃণা ডানে বামে মাথা নাড়ায় দ্রুত, “কিন্তু আমারও তো একটা বিবেক আছে। আপনাদের বাড়িতে….”
“এটা তোরও বাড়ি। ফারদার তোর মুখে এসব শুনলে একটা আছাড় মারব। বেয়াদব মেয়ে। আমার ভালো মুড তুই দেখতে পাড়িস না। তাই না?”

মৃণার উওর দেবার পূর্বে আবার তার ফোন বাজে। মুরাদের চোখও সেদিকে যায়। স্ক্রিনে নামটা দেখে সে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই মৃনা ডাকে, “মুরাদ ভাই….”
মুরাদ পিছু তাকায়। মৃণা কাঁচুমাচু করে বলে, “আমার জন্য একটা চাকরি খুঁজে দিবেন প্লিজ। যেন পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করতে পারি? আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে চাই।”

কথাটায় খুশি দেখা যায় মুরাদকে, “আমি জানি তুই নিজের আকাশের আঁধার সরিয়ে জীবন গড়তে পাড়বি।”
কথাটা শুনে এই দুইদিন পর একগাল হাসে মৃণা। তার কপালের ব্যান্ডেজে ভাঁজ পড়ে। গালের দাগ হাল্কা হয়ে আসছে। আঁধারে তাকে বিশেষভাবে বুঝা না গেলেও তার হাসিটা মুরাদের ভালো লাগে। সে মনে খুশি হলেই মুখে হাসি আনে না যেতে নিলে আবারও থামায় মৃণা, “আরেকটা জিনিস।”
“কী?”
মৃণা তার ফোনের দিকে তাকায়। আবার তাকায় মুরাদের দিকে, “উপদেশ লাগতো। আমার কী এমন কারো পিছনে ছুটা উচিত যাকে আমি ভীষণ পরিমাণে ভালোবাসি কিন্তু সে অন্যকারো?”
“ভালোবাসা তো ত্যাগের অন্য নাম তাই না? তুমি যাকে ভালোবাসো তার সুখকে, খুশিকে ভালোবাসো। তার সুখ যদি অন্যকারো মাঝে হয় তাহলে তোমাকে দূর থেকে তার সুখ দেখে সুখী হওয়া উচিত।” কথা শেষে সে মৃণার দিকে। সে ফোনটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তখন মুরাদ আরও যোগ করে, “মৃণা শুন, ভালোবাসার মানুষের সুখের জন্য নিজের সুখী হওয়া ভালো কথা। কিন্তু নিজের সকল সুখের মাধ্যম হিসেবে অন্যকাওকে বেছে নেওয়াটা অধমের কর্মকাণ্ড। যেখানে তার কাছে তুমি মূল্যহীন। সর্বপ্রথম নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে হয় তারপর অন্যকাওকে। নিজেকে মূল্যবান বানাতে হয়। নিজের পূর্বে অন্যকাওকে ভালোবাসলে শত খোঁজার পরও সুখ পাওয়া যায় না।”

মৃণা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মুরাদ চলে যাচ্ছে। সে আবার ফোনের দিকে তাকায়। তন্ময়ের নাম বারবার ভেসে আসছে। তারবকল রিসিভ করতে যেয়ে থেমে যায়। সে চোখ বন্ধ করে কিছু চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর কল কেটে দেয়। নাম্বারসহ সব জায়গা থেকে ব্লক করে দেয়। সে এখন আর কারো কাছে মূল্যহীন হয়ে থাকতে চায় না, নিজেকে মূল্যবান করে গড়তে চায়।
.
.
সারাদিন মোহের কাটলো সবার সাথে গল্প করতে করতে। সন্ধ্যায় সমুদ্রের কাজিনরা তাকে ধরে বসে রইলো গানের কলি খেলার জন্য। তা খেলা শেষ হতে হতে রাত হয়। খাবার শেষে অবশেষে তাকে ছাড়ে। এতক্ষণ সবার সাথে তার ভালো লাগছিল না, আর এখন একাকী বিরক্ত লাগছে। মনটা কেমন উদাসীন লাগছে। রুমটা ভীষণ ফাঁকা লাগছে। সমুদ্র যে সে সকালে নাস্তা খেয়ে গেল আর বাসায় ফিরল না। কোথায় গেল সে তাও জানে না।। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গেল। তার আঁধার পছন্দ না। তার আলো পছন্দ। কিন্তু আজ কেন যেন সে এই আঁধারের সাথে তার জীবনকে মেলাতে পাড়ছে। তার জীবনটা যে এলোমেলো হয়ে গেছে। সে কি করবে, কি করা উচিত কিছু বুঝে উঠতে পাড়ছে না।

হঠাৎ ভারী কন্ঠ তার কানে এসে লাগল, “এই অমধু, এই বেরাতে চুল খুলে বারান্দায় কি করছ? কোনো ভূত দেখলে ঘাড়ে চাপবে তো।”
মোহ বুঝল কন্ঠটা সমুদ্রর। কিন্তু সে তার কথা কানে নিলো না। পিছনে ফিরেও তাকাল না। তার ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ সামনে একটা আইস্ক্রিম এসে উপস্থিত হলো। সাথে সাথে মোহের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সে খপ করে আইস্কিমটা নিলো হাতে। হাসিমুখে সমুদ্রর দিকে তাকাল। সেও একটি আইস্কিম খুলে তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে গ্রিলে হেলান দিলো। বলল,
“তোমার বোনকে খোঁজ নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম। বলল তোমার চকোলেট আইস্কিম পছন্দ তাই নিয়ে এলাম।”

মোহ তার কথার তোয়াক্কা না করে তার হাত ধরে সমুদ্রর আইস্কিমে একটা বড় বাইট বসিয়ে দিলো।
“এটা কী হলো? তোমার আইস্ক্রিম আছে না?” সমুদ্র বড় বড় চোখে তার দিকে তাকায়। হতবাক দৃষ্টি তার। মোহ মুখ টিপে হেসে বলে, “আজ সকালে আমার চা খেয়েছেন না? তার প্রতিশোধ।”
” সে চা তো আমার উদ্দেশ্যেই এনেছিলে তাই না?”
“তো? আপনাকে বিয়ে করে আমার সারাজীবনের কল্পনা ত্যাগ করেছি আপনি নিজের একটু আইস্ক্রিম ত্যাগ করতে পাড়বেন না?” বলে সে নিজের আইস্কিমটা খুলে খেতে শুরু করে। সমুদ্রও নিজের আইস্ক্রিম আয়েশ করে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “কি কল্পনা ছিলো তোমার?”

মোহ তার পুতুলের মতো চোখদুটো ছোট ছোট করে নেয়, বলে, “আপনি তো কথাই বলেন না। আপনার জন্যই আমার যত জল্পনা কল্পনা ভেসে গেল। কোথায় ভেবেছিলাম জীবনে প্রথম প্রেমটা আমার স্বামীর সাথে বিয়ের পর করব আর এখানে…” সম্পূর্ণ কথা শেষ না করেই ভেংচি কেটে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়।
“তুমি চাইলে বিয়ে খারিজ করতে পারি। আমার সমস্যা নেই।”
সমুদ্রের স্বাভাবিকভাবে বলা এই কথাটা মোহের ভালো লাগল না। যদিও সে-ও মনে মনে এটাই ভাবছিল। কিন্তু নিজের পরিবারের সাথে কথা না বলে এ বিষয়ে কথা এগোল না সে।

সমুদ্র হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “ওয়েট প্রথম প্রেম মানে? তুমি আগে প্রেম করো নি?”
মোহ ডানে বামে মাথা নাড়ায়। সমুদ্র আবার বলে, “অবশ্য তুমি তো পিচ্চিই প্রেম করার সময় কই পেলে?”
“সময় তো ছিলো অনেকই। জানেন পাঁচ বছর আগে প্রেমের না সোজা বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছি। যে এখনো আমাকে বিয়ে করার জন্য বাবার আগেপাছে ঘুরছে। এরপর তো নব্বইটা প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি। সিরিয়াসগুলো।”
“তুমি গুনেছ?”
“তো গুণব না? এতজন আমার পিছে ঘুরছে কিন্তু আমি কেবল আমার স্বামীর জন্য আমার সব ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি। গর্ব করার বিষয় না?”
সমুদ্র হেসে তার দিকে তাকায়, “মানে সারাজীবন একজনকে ভালোবেসে যাওয়াটাই গর্বের কথা তাই না?”
মোহ তার দিকে তাকায়। কিন্তু কোনো উওর দেয় না।

সমুদ্র আবার বলে, “তোমার বিয়ের পর ভালোবাসার ইচ্ছা ছিলো আর আমার আগে। ব্যাপারটা তো প্রায় একই তাই না?”
এবারও মোহ উওর দিলো না। সে তাকিয়ে রইল সমুদ্রর দিকে। সমুদ্র বলে, “জানো আমি তোমার বয়সে থাকতেই প্রথম প্রেম হয়। যখন ষোল বছর তখন ওর সাথে দেখা হয়, তারপর তিন বছরের বন্ধুত্ব, ছয় বছরের প্রেম। যাত্রাটা লম্বা ছিলো। সুন্দর ছিলো।”
“তাহলে আলাদা হলেন কেন?”
সমুদ্র প্রশ্নটায় কেমন উদাসীন হাসে। বলে, “গেইমিং ডিজাইনার হওয়ার প্যাশন ছিলো। তাই বিদেশে যাই। সেখানে টেনিং নেই। তারপর নিজে কিছু করার চেষ্টা করি। একটা টিমও বানিয়েছিলাম। ততদিনে ওর ফ্যামিলি থেকে বিয়ের প্রেশার আসে। ও আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু হয়তো আমার ভাগ্যে ও ছিলো না। কতদিন আর অপেক্ষা করতো ও?” শেষ কথাটা বলে কেমন উদাসীন হাসে সে।
তার এই উদাসীনতা মোহের মনটাকেও উদাসী করে তুলে। সমুদ্র তা বুঝে হয়তো। সে তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বাঁকা হেসে বলে, “এই মেয়ে তোমার আমার জন্য আফসোস করার প্রয়োজন নেই। আপাতত তোমার নিজের জীবনই এলোমেলো হয়ে আছে তা গুছাও।”
সে তার হাত এগিয়ে রাখল মোহের মুখে কাছে। বৃদ্ধাঙ্গুলি
দিয়ে আলতো করে মুছে দিলো তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা আইস্ক্রিম। মুহূর্তে মোহ কেঁপে উঠে। পরক্ষণেই স্থির হয়ে যায়। তার মনে হয় তার শরীরের শিরায় শিরায় কারেন্টের মতো কিছু অতিবাহিত হয়েছে। তার পুতুলের ন্যায় বড় বড় নয়ন দুটো সে আরও বড় করে নেয়। এই শ্যামবর্ণ সুদর্শন পুরুষকে এতটা কাছে দেখে তার নিশ্বাস আটকে এলো।

“তোমার ইচ্ছা ছিলো তোমার স্বামীই তোমার প্রথম প্রেম হবে। তা তোমার প্রথম স্বামী হতে হবে এমন তো নয়।”
পরক্ষণেই এই কথা শুনে মোহের অস্বস্তি লেগে যায়। যতই সমুদ্র এই বিয়েতে নারাজ ছিলো। কিন্তু এখন তো সে তার স্ত্রী। তাহলে কীভাবে এত সহজে অন্য বিয়ের কথা বলতে পারে সে। তার কথায় বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা নেই।

মোহ বিরক্ত হয়ে সমুদ্রর হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। বলে, “আপনার আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।” বলে সে রুমে চলে যেতে নিলে সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়। মোহ তার দিকে তাকায় জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে, “যে কথা বলার জন্য তোমার সাথে ফ্রী হতে চাচ্ছিলাম তাই বলা হলো না। তুমি চাইলে এই বিবাহ থেকে মুক্ত হতে পারো, নাহলে তুমি চাইলে আমরা এই বিয়েটা বন্ধুত্বের সাহায্যে কাটাতে পারি। সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছা।”
“বন্ধুত্বের জন্য আপনি বেশিই বুড়ো না?”
উওরটা শুনে কিছু মুহূর্ত সমুদ্র থমকে রইলো, তারপর হেসে দিলো, “এইত্তো তোমার সাথে আমার ভালো জমবে।”
সে মোহের হাত ছেড়ে দেয়। মোহ রুমে যেয়ে গুটিশুটি মেরে শোয় বিছানায়। ভাবে, কি করবে সে? কি করাটা ঠিক হবে? বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয় যে একদিনে এত বড় সিদ্ধান্ত সে নিবে। কিন্তু যদি সমুদ্রর মন তার জন্য না পালটায় তাহলে কী সারাজীবন এই ভালোবাসাহীন বিয়ের খাঁচায় সে বন্দী হয়ে থাকবে?

চিন্তায় তার রাতে ঘুম এলো না। সে শুয়ে ছিলো চোখ বন্ধ করে। সে অনুভব করল সমুদ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে, তারপর বাহির থেকে খাবার এনে খেল, তারপর আবার সিগারেট খেলো, তারপর মুভি দেখল, তারপর আবার সিগারেট খেতে বারান্দায় গেল। সে ফজরের নামাজ পড়বার জন্য উঠেও দেখে সমুদ্র সিগারেট খাচ্ছে। এই লোক কতটা সিগারেট খায়? সে ওড়না নাকে চেপে জিজ্ঞেস করে, “নামাজ পড়বেন না?”
সমুদ্র তাকায় পিছনে, “উঠে গেছ? আর ঘুমাবা না?”
“বোধহয় না?”
“তাহলে আমি যেয়ে ঘুমালাম।”
“নামাজ পড়বেন না?”
সমুদ্র উওর না দিয়ে সিগারেট নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে দ্রুত বারান্দার দরজা আটকায়। আর উচ্চস্বরে বলে, “আমার আশেপাশে সিগারেট খাবেন না। আমার মাথা ঘুরায়।”
সমুদ্র উওর দেয় না। সে এত জলদি ঘুমিয়ে গেল না’কি? মানুষ এত জলদি ঘুমুতে পারে?
.
.
বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্টেজে মোহ একা বসে আছে কমলা রঙের একটি বেনারসি পড়ে। কমলা রঙে ও স্বর্ণের গয়নায় তার সোনালী ত্বক আরও নমনীয় দেখাচ্ছে। চারদিকে বধূর সৌন্দর্যের প্রশংসার গুঞ্জন হচ্ছে অথচ বর তার পাশে নেই। বর ব্যস্ত তার বন্ধুমহলে। আড্ডায় মেতে আছে সে। আর সকল মেহমানের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে হচ্ছে মোহের। যেখানে সে কাউকেই চিনে না। কী বিরক্তিকর পরিস্থিতি!

এরমধ্যে সে দশবার তলব করেছে অথচ তার পরিবারের কেউ এখনো আসে নি। সে নিজের ফোনটাও ভুলে বাসা থেকে আনে নি। মৃণা ও মহুয়ার তার পরিবারের সাথে আসার কথা। তাদের সাথে কথা হয় না গতপুরশু থেকে।
তার ভেতরের অস্থিরতা কাটানোর জন্য হলেও তার এই দুইজনকে প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতেই তার কানে শব্দ এলো, “মোহ….”

শব্দটা এত জোরে ছিলো যে কেবল সে না। হলের প্রায় সবাই শুনে। মহুয়া তার গাউন একহাত দিয়ে তুলে তার দিকে দৌড়ে আসছে। এক লাফ দিয়ে স্টেজে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার এই কান্ডে মোহ নিজের অস্বস্তি ভুলে হেসে দেয়।

তার এমন কান্ড দেখে স্টেজ থেকে নেমে যায় মেহমানরাও। সে মোহকে না ছেড়ে তাকে জড়িয়ে ধরেই দুলতে দুলতে বলে, “তুই আমাদের ছাড়া বিয়া করলি কেমনে মীরজাফর? তোর বিয়ার কত স্বপ্ন দেখছি দিলি তো মাটিতে মিশায়া।”
“শখে করি নাই। কিভাবে কি হলো তা এখনো বুঝতে পাড়তেছি না। তোদের আসতে এতো দেরি হলো কেন? আর তুই এভাবে লুঙ্গির মতো গাউন উঠিয়ে আসতাছিলি কেন?”
“তোকে দেখার তাড়ায়। তোর বাসায় যেয়ে বসে ছিলাম সন্ধ্যা ছয়টায়। সে কাহিনী হইসে ভাই!” মহুয়া মোহকে ছেড়ে বলে। মোহও ভারী ইন্টারেস্ট নিয়ে তার কথা শুনে, “কী হয়েছে?”
“তোর বোন এসেছে। বিয়ে করে। এন্ড গেস কর কার সাথে?”
“কার সাথে?”
“আহিনের সাথে।”
চমকায় মোহ, “আহিন ভাইয়া! আরিশ ভাইয়ার ছোট ভাই?”
“ভাই যে নাটকটা ঘটল। তোকে আর পপকর্ণকে অনেক মিস করেছি।”
“আমার লাইফটাই সিনেমার মতো হয়ে গেছে। পপকর্ণ খাওয়ার আরও সময় পাবি। আগে বল মা বাবা, মৃণা কোথায়?”
“কি জানি? দেখলাম একটা লোক তাদের রিসিভ করছে।
কি কথা হচ্ছে তাদের সাথে। আগে আমাকে বল আমার দুলুভাই কই?”

“জানি না।” ক্ষেপে বলে উঠে মোহ, “ওই লোক এখানে আমাকে ঝামেলায় ছেড়ে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারাচ্ছে। বদমাইশ একটা।”
“আমাকে দেখা। আমি কান ধরে টেনে তোর কাছে নিয়ে আসছি।”

মোহ তাকে হাতের ইশারায় একটি দলকে দেখাল। রুমের শেষদিকে কতগুলো ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। মহুয়া প্রশ্ন করে, “নাম কী যেন আমার দুলুভাইয়ের? ভুলে গেছি।”
মোহ সেদিকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “সমুদ্র।”

মহুয়া যেমন লাফ দিয়ে উঠে এসেছিল তেমন লাফ দিয়ে নেমে গেল। আবারও লুঙ্গির মতো তার গাউন ধরে এক দৌড়ে গেল সে। সেখানের ছেলেগণের মাঝে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলে, “এটেনশন প্লিজ…”
সবাই গল্প করছিল। হঠাৎ একটা মেয়ের উঁচু স্বরে তারা কথা থামায়। সবার চোখ যায় একটি বাচ্চা মিষ্টি মেয়ের উপর। মেয়েটা গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করে, “এখানে সমুদ্র কে?”

কয়েকজন আঙুল তুলে সমুদ্রের দিকে ধরল। সাথে সমুদ্রও। কিন্তু তারা বুঝল না এই বাচ্চা মেয়েটি সমুদ্রকে খুঁজছে কেন? হঠাৎ করে গম্ভীর থাকা মেয়েটি সমুদ্রের সামনে এসে লাফিয়ে দাঁড়ায়। আহ্লাদে গদগদকন্ঠে বলে, “দুলুভাই আমি আপনার শালীকা হই। আপনার বউয়ের বেস্টফ্রেন্ড।”
সমুদ্রের এক বন্ধু বলে উঠে, “আয়হায় সমুদ্র আমাদের বেয়াইন দেখি একটা পিচ্চি।”

মহুয়া তাদের দিকে তাকায় গম্ভীরমুখে, “পিচ্চি হলেও আপনাকে দশবার বিক্রি করে কিনে আনতে পাড়ব। মাইন্ড ইট। আর আপনাদের লজ্জা লাগে না? আমার মোহ ওখানে একা বসে আছে আর আপনার মোহের সমুদ্রকে এখানে আটকে রেখেছেন? জঘন্যরকমের দেবর আপনারা।”
তারপর সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, “তাহলে যাওয়া যাক দুলুভাই, নাহয় আপনার বউ যে সাংঘাতিক রেগে আছে আজ আপনার খবর আছে।”
“এটা আর নতুন কী শালীসাহেবা? রাগ তো আমার বউয়ের নাকের ডগায় সারাক্ষণ থাকে।”
“ইশশ আমার বান্ধবী একবারে মিষ্টি। উল্টো কথা বলবেন না। চলুন আগে।”

সমুদ্র তার এক কথায় রাজি হয়। সে মহুয়ার সাথে যায় যায় স্টেজে। স্টেজে উঠতেই মোহ মুখ বানিয়ে বলে, “তোর না এর কান ধরে আনার কথা ছিলো। তুই দেখি তাকে আদবের সাথে নিয়ে আসছিস।”
“আরে যত যাই হোক আমার দুলুভাই বলে কথা। আর তাও এত হ্যান্ডসাম দুলুভাই। হায়!” মোহ চোখ ঘুরায়। বিরক্ত নিয়ে বলে, “ভার্সিটির সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে তোর পিছু পড়ে আছে, তুই পাত্তা দিস না আর একে তোর হ্যান্ডসাম লাগল।”
সমুদ্র বলে, “আমার শালীসাহেবার টেস্ট ভালো আছে বুঝলে?” তারপর সে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এত মিষ্টি, তাহলে তোমার বেস্টফ্রেন্ড এমন অমধু কীভাবে হয়?”
“দুলুভাই বেস্টফ্রেন্ড বলতে এই সেই বেস্টফ্রেন্ড না বুঝলেন? একদম চাইল্ডহুড বেস্টফ্রেন্ড আমরা তিনজন। আপনার থেকে এগারো বছর আগে এসেছি ওর জীবনে। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমাদের মোহ থেকে ভালো, মিষ্টি, গুণী আর সুন্দরী মেয়ে আর পাবেন না। আমি যদি ছেলে হতাম তাইলে তো আপনার চান্সই থাকতো না এখানে। আমিই ওকে বিয়েটিয়ে করে রেখে দিতাম।”

সমুদ্র হাসে। মহুয়া এবার একটু চেতে যায়, “আমি কিন্তু সত্যি বলছি। কতজন আপনার জন্য ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছে জানেন? এখনও তো সবাই জানেই না বিয়ের ঘটনা। ও গণহারে সবাইকে রিজেক্ট না করলে আজকে আপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন নামতো।”
“ওকে ওকে শালীসাহেবা মানছি আমি। কিন্তু আমার আরেকটা শালীসাহেবা কোথায় তা বলুন।”
“আরেকটা কে? মিতা আপু না’কি? সে তো আজ বিয়ে সেরে এসেছে।”
“মিতা না, তুমি বলেছিলে তিনজন বেস্টফ্রেন্ড তো আরেকজন আছে। আর মিতার ব্যাপারে তো আমি জানি, আমিই ওর বিয়ে করিয়েছি।”

কথাটা শুনে মহুয়া যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে ড্যাবড্যাব করে তাকায় সমুদ্রের দিকে। বলে কি তার দুলুভাই? সে নিজে তার হবু বউকে পালাতে সাহায্য করেছিল? একারণে তার বিয়ে হলো মোহের সাথে? এতটুকুতেই আকাশ-কুসুম ভেবে বসে মহুয়া সে খপ করে সমুদ্রের হাত ধরে লাফিয়ে উঠে, “বলেন কি দুলুভাই আপনি তাহলে মোহকে আগে থেকে পছন্দ করতেন? লাভ এট ফার্স্ট সাইট ছিলো না’কি? ওকে বিয়ে করার জন্য আপনি মিতা আপুকে পালাতে সাহায্য করেছেন?”
সমুদ্র তার ভাবনা দেখে অবাক হয়ে তাকায় মোহের দিকে। মোহ বিরক্তি নিয়ে তার মাথায় হাত রাখে, বলে, “কার সাথে কথা বলতে গেছেন আপনি? ও সবসময় দুই বাক্য বেশি বুঝে। এটা নিয়ে নিজের মাথায় একটা সিনেমা বানিয়ে নিয়েছে দেখেন।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ১৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মোহ বিরক্তি নিয়ে তার মাথায় হাত রাখে, বলে, “কার সাথে কথা বলতে গেছেন আপনি? ও সবসময় দুই বাক্য বেশি বুঝে। এটা নিয়ে নিজের মাথায় একটা সিনেমা বানিয়ে নিয়েছে দেখেন।”

এমন সময় আসে মোহের বাবা, মা ও মৃণা। আসতেই মোহের চোখ মৃণার উপর পড়ে। তার চেহেরার এমন দশা দেখে সে আঁতকে উঠে। দ্রুত তার কাছে ছুটে যেয়ে তার দুইগালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “তোর এই অবস্থা কেন মৃণু? কী হয়েছে? এই দাগ, আর কপালে ব্যান্ডেজ কেন?”
“তেমন কিছু না। তোকে পড়ে জানাব। এখন জানানোর পরিস্থিতি নেই। আর যা হয়েছে ভালো হয়েছে, এখন একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। নতুনভাবে। ভালোভাবে। এসব নিয়ে চিন্তা করিস না।”

মোহের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেল। তবুও সে ঘাটলো না। মৃণার সময় হলে সে নিজেই বলবে।
মোহ তার বাবা মা’কে জড়িয়ে ধরে নিলো। তার মা তো কান্নাই করে দিলেন। তার ইচ্ছা ছিলো মোহকে আরও চার বছর পর বিয়ে দেবার। পড়াশোনা শেষ হতো। তারা মানসিক প্রস্তুতি নিতো। একসাথে তাদের দুই মেয়ে তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে এটা সে মানতে পাড়ছে না।
কান্নাকাটি শেষে তার চোখ পড়ে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র সংযত হয়ে সালাম দেয় মোহের বাবা -মা’কে।
অবাক হয় মোহ, সাথে খুশিও। সমুদ্র তার ছন্নছাড়া ভাবটি তার বাবা মা’য়ের সামনে দেখায় নি। উলটো অতি সম্মানের সাথে কথা বলেছে। জিনিসটা ভালো লাগলো মোহের। সে সমুদ্রকে যতটা বিরক্তিকর ভেবেছিল সে এতটাও নয়। সে খেয়াল করে সমুদ্রের দিকে শ্যামবর্ণে নীল রঙের ব্লেজারটা তাকে বড্ড মানিয়েছে। একহাত পকেটে রেখে সে সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। তার হাসিটা সুন্দর। সুন্দর তার চোখদুটোও। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো তার গলার কাছের তিলটা যা শার্টের কলারের জন্য দেখা যাচ্ছে না। মুখে মানতে নারাজ হলেও মোহ জানে তার বরটা আসলেই ভীষণ সুদর্শন।

হঠাৎ সে চাইল মোহের দিকে। দৃষ্টি মিলতেই ধুক করে উঠল তার বুকখানা। হঠাৎ ডাকল সে,
“এই মধু…”
ডাকে লজ্জা পেল সে। আরও তার মা বাবার সামনে! সে দেখল মৃণা ও মহুয়া হাসছে। কিছু হয়েছে?
“হুঁ?”
“আন্টি তোমাকে ডাকছে শুনছো না যে?”
“ও….” সে ফিরে মা’কে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে মা?”
“তোরা আজ না এসে কাল আসিস। তোর বাবা কথা বলে নিয়েছে সমুদ্রের বাবা মা’য়ের সাথে।”
“কেন?” ভ্রু কুঁচকায় মোহ, “মিতা আপুর জন্য না’কি? ভালো হয়েছে। আপুর সাথে আমার কথাও আছে।”
“আপাতত বাসায় অনেক মেহমান। আজ মিতা এমনিতেই যা তামাশা ঘটালো। তুই আজ যাস না। জামাইবাবুও কি না কি মনে করে!” কথাগুলো আস্তে বলে মোহের মা।

মোহ তাকায় সমুদ্রের দিকে। সে বিড়বিড় করে বলে, “তুমি তো জানো না মা। এই সব কান্ড তোমার জামাইবাবুরই ঘটানো।”
সমুদ্র এসে তার পাশে দাঁড়ায়, “এই মধু তোমার কী খিদে পেয়েছে?”
মোহের এবার মেজাজ খারাপ হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমার নাম মধু না। হয়তো মোহ ডাকবেন, নাহলে মধুরা।”
“আমার তো মধুই ভালো লাগল।”
“আপনার ভালো লাগলে কি হবে শুনি? যেটা আমার নাম সেটাই ডাকবেন আমায় বুঝলেন? হয়তো ডাকবেন মোহ, নাহয় মধুরা।”
“আমার কোনো নামই পছন্দ হয় নি। আমার মধু নামটা ভালো লেগেছে।”
মোহের বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে যায়, ” আজ পর্যন্ত সকলের কাছে আমার নামের প্রশংসা শুনে এসেছি আর আপনি বলছেন আমার নাম সুন্দর না?”
“সবার টেস্ট খারাপ।”
“সবার টেস্ট খারাপ কেবল আপনারই ভালো?”
“অফকোর্স।”
মোহ বিরক্তিতে তাকে কিছু বলল না। সমুদ্র তার হাত ধরে বলে, “চলো খাবে।”
“আশ্চর্য তো! মেহমান আসছে দেখা করতে, ছবি তুলতে। খাবো কি করে?”
“খাবে মুখ দিয়ে। আর কীভাবে খায়?”
“ফাজলামো করবেন না।”
“আচ্ছা বাবা শুনো, ইমা বলেছিল তুমি সে দুপুর থেকে খাও নি। পার্লারের চক্করে তুমি খাও নি। সো তুমি খাবে। এরা ছবি তুলতে আসছে, তুলুক। তুমি আমার সাথে আসো।”
কথাটা শুনে মোহ খুশি হয়। লোকটাকে যত খারাপ ভেবেছিল এতটাও খারাপ না। অন্তত যত্ন করে, চিন্তা করে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠে, “না, আমার এত খিদে লাগে নি। সময় অনুযায়ীই আমরা খাব। সব মেহমান খেয়ে নিক তারপর। আর আপনি আমার সাথেই থাকবেন। বন্ধুদের কাছে গেলে আমিই কান টেনে নিয়ে আসবো।”
“লজ্জা করো, তোমার থেকে নয় বছরের বড়।”
“কান্ডকারখানা তো নয় বছরের বাচ্চার মতো।”
কথাটা শুনে সমুদ্র মুখ গোমড়া করে নেয়। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিচে নেমে যায়। মোহের ভীষণ রাগ উঠে সমুদ্রের উপর। সবে বলল থাকতে তার সাথে। কথাটা শুনল না এই বদমাশ লোকটা। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ফিরে এলো এক প্লেটভর্তি মিষ্টি নিয়ে। প্লেটটা মহুয়ার হাতে ধরিয়ে বলল, “নেন শালীসাহেবা, আপনি মিষ্টির ভান্ডার তাই আপনার জন্য মিষ্টি নিয়ে এলাম। চাইলে আপনার বান্ধবীকেও খাইয়ে দিতে পাড়েন।”
“আহা দুলুভাই বললেই তো হয় বউয়ের জন্য এনেছেন।”
মোহ মৃদু হেসে তাকায় সমুদ্রের দিকে আড়চোখে। সে দেখে সমুদ্র এবার নিজে মেহমানদের সাথে নিজেই কথা বলছে। মহুয়া তাকে ধরে নিয়ে মিষ্টি খাওয়ায়। মোহ বুঝতে পাড়ে সমুদ্র তাকে খাওয়ার জন্য সময় করে দিচ্ছে।

মোহের সমুদ্র নামক লোকটাকে একদম অসহ্য লাগতো। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে এতটা অসহ্যকর লাগছে না। লোকটা খারাপ না এতটা। তার মা বাবাকে কতটা সম্মান করল, বান্ধবীদের সাথে এত সুন্দরভাবে কথা বলল, আর তারও চিন্তা করছিল। হ্যাঁ, লোকটা এতটাও খারাপ না।
তবে এই ধারণাটা ঠিক কতক্ষণ সে ধরে রাখতে পাড়বে কে জানে?

রাতে বাসায় এসে এত ভারী শাড় ও গয়নাগাটি খুলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। তার থেকে বোধহয় বেশি ওজনের শাড়ি ও গয়না পরেছিল। আর এত ভারী মেকাপ করা লাগে! উঠাতে তার পাক্কা বিশ মিনিট লেগেছে। সে বড়ই সাজগোজ পছন্দ করা মেয়ে। সাজগোজ করলে তার মনটা ফুরফুরে থাকে। তাই বলে এত ভারী সাজও তার পছন্দ না। আজ তো মেকাপের পর সে নিজেকেই চিনতে পারে নি।

সে রাতে গোলাপি রঙের একটি সুতি সেলোয়ার-কামিজ পরে মাত্রই গোসল করে বের হলো সে। দেখল সমুদ্র ফোনে কথা বলছে। তার ঠোঁটে লাগানো একরেশ হাসি। এত সুন্দর করে তার তাকে হাসতে দেখে নি মোহ। তার হাসিটা দেখে মোহের নিজেরও ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠে। সে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে থাকে। আচমকায় বারান্দা থেকে সমুদ্রের কথা শোনা যায়, “এই মধু শুনছ?”
মোহের বুকের ভেতর কড়া নাড়লো। লোকটার মুখে মধু ডাকটা তার কাছে এমন মিষ্টি লাগছে কেন?
সে মুচকি হাসে, “শুনছি।”
“জবাফুল তোমার প্রশংসা করেছে। বলছে তোমাকে আজ খুবই সুন্দরী লাগছিল।”
মোহ মনে মনে বলে, “বদলোক আপনি ছাড়া আজ সবাই আমাকে প্রশংসা করেছে।”
তবে মুখে বলল, “ধন্যবাদ বলে দিয়েন আমার পক্ষ থেকে।”

মোহ এসে বিছানায় বসে ফোন চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদে সমুদ্র এলো। তার মন মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে। সে এসে লাফ দিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ল বিছানার অন্যপাশে। মোহ তাকে দেখে একটু সরে বসল। তার দৃষ্টি ফোনে থাকলেও তার ধ্যান পাশে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে। মাথার নিচে হাত রেখে সে-ও ফোন চালাচ্ছে। হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে,
“ফেসবুক চালাও?”
“কে না চালায়?”
“না তুমি তো আবার নতুন জেনারেশনের। তোমরা ফেসবুক চালাও না’কি অন্যকিছু কে জানে। আমি কিন্তু তোমার এক জেনারেশন বড়। সম্মান করবা বুঝলে। এই কথায় কথায় লাথি মেরে ফেলে দিবে না।”
মোহ মুখ চেপে হাসে। সমুদ্র বলে, “আইডি পাচ্ছি না-তো।
“ফোনটা দেন।”
মোহ ফোনটা নিয়ে নিজের আইডিতেই রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে মালিকের হাতে দিয়ে দেয়।
“নিজেই তো আমার আইডিতে রিকুয়েষ্ট দিতে পাড়তে।” মুখ বাঁকিয়ে বলে সমুদ্র।
“মোহ কাওকে রিকুয়েষ্ট দেয় না।”
“এত ভাব রাখো কোথায় মিস অমধু….সরি মিসেস অমধু।”
“আচ্ছা জবাফুল আপু কি আপনার বান্ধবী?”
“বলতে পারো। হ্যাঁ। আর ওর নাম জবা। জবাফুল আমি ডাকি।”
“তাহলে বিয়েতে এলেন না কেন?” তার এই ব্যাপারে কৌতুহল বিশেষ একটা নেই। তাও সে জিজ্ঞেস করল। সমুদ্রের সাথে কথোপকথন এগোনোর বাহানা মাত্র।
“দুইটা ঝামেলা ছিলো। তাই আসতে পাড়ে নি।”
“কীসের ঝামেলা? উনি ঠিক আছে তো?”
“আরে ও তো ঠিক আছে। এক ঝামেলা হলো আমার মা, যে ওকে সহ্য করতে পাতে না। দ্বিতীয় ঝামেলা হলো ওর স্বামী, যে আমাকে সহ্য করতে পারে না।”

মোহ চুপ রইল। কথাটা ধরতে তার কিছু সময় লাগে। সে চমকিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “উনিই কি আপনার প্রাক্তন?”
“বাহ বুদ্ধি আছে তাহলে তোমার। গতকাল ওর কথা বলেছিলাম না তোমায়?”
মোহ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। যে মানুষ তাকে ছেড়ে অন্যকাওকে বিয়ে করে নিয়েছে। তার সাথে এখনো কথা কীভাবে বলে? তাও এত হেসে হেসে। আর তার জন্য সে আজও বিয়ে করতে চাইতো না। এতটা ভালোবাসতো? এতটাই যে তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে প্রথম রাতেই বলে দিয়েছিল।সে অন্যকাওকে ভালোবাসতে পাড়বে না? তার কী সে বিশ্বাসঘাতক মেয়েকে ঘৃণা করা উচিত ছিলো না?

মোহ এর থেকে বেশি কিছু ভাবতে পাড়ল না। সে মোবাইল রেখে শুয়ে পড়ল। গম্ভীরমুখে বলল, “ঘুম আসছে আমার। লাইট বন্ধ করে নিচে শুয়ে পড়ুন।”
“রিকুয়েষ্ট তো এক্সেপ্ট করলে না।”
“ঘুম ধরেছে। এখন পাড়ব না।”
.
.
গতকাল ভার্সিটি আসা হলো না। তাই আজ এসেছে মহুয়া। না চাইতেও আসতে হলো। এতদিনের নোট নিতে হবে। পরবর্তীতেও নিতে হবে। মৃণাকে ডাক্তার আপাতত প্রেশার নিতে মানা করেছেন। মোহেরও নতুন বিয়ে সে আসতে পাড়বে না। তাই আজ তার আসা লাগলো জীবনের সবচেয়ে বোরিং কাজ করার জন্য।

মহুয়া স্কুটি পার্ক করে হাঁটছিল। হঠাৎ এক বাইক তার দিকে ছুটে এলো বাতাসের গতিতে। সে বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হঠাৎ কাছে আসায় তারও হুঁশ এলো। সে সরতে গেল। কিন্তু বাইরে স্পিড যেন আরও বাড়লো। সামনে থেকে সরতেও হোঁচট খেয়ে নিচে পড়লো। মহুয়া দেখল তার হাতের কণুই থেকে তালু ছিঁলে গেছে। হাঁটুতেও ব্যাথা অনুভব করছে। এর মধ্যে বাইকটি থামে। বাইকের মালিকটি উচ্চস্বরে বলে, “ম’রতে হলে অন্য রাস্তা ছিলো না? আমার বাইকের সামনেই আসতে হলো?”
এই এতটুকুতেই মাথায় আগুন ধরে উঠে মহুয়ার। সে দাঁড়িয়ে ক্ষোভে তাকায় শায়ানের দিকে, “চোরের মা’য়ের বড় গলা? নিজে ভার্সিটিতে না দেখে চালাচ্ছে আমাকে কথা শোনায়। যেখানে ভার্সিটির ভেতরে ড্রাইভিং ব্যান। এই ছাগল দুই নাম্বার বাছা বাইক যদি চালাতে না জানো তাহলে বাইক ধরলে কেন? আমার কাছে এসো আমি শিখিয়ে দিব।”

ছেলেটি হেলমেট খুলে। তার নীলাভ চোখ দুটো সরু করে তাকায়, “তুমি আমাকে শিখাবে বাইক কীভাবে চালায়? জানো আমি কে?” তার চোখে মুখে ক্ষোভ স্পষ্ট।
“কেন নিজে জানেন না? প্রধানমন্ত্রী হন বা পুলিশ হন আই ডোন্ট কেয়ার।”
“কত্তো বড় সাহস তোমার বেয়াদব মেয়ে।”
“দোষ করে অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন? বেয়াদব ছেলে।”

ছেলেটা রাগে কটমট করতে করতে তেড়ে এলো মহুয়ার কাছে। তার হাতের যে অংশে ছিঁলে গেছে সে অংশ শক্ত করে ধরতেই আর্তনাদ করে উঠে মহুয়া। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটির দিকে, “আমাকে যা তা ভেবেছ? আমার সাথে শত্রুতা কতটা ভারী হতে পারে তোমার ধারণাও নেই। মানুষকে আগুনে পু’ড়িয়ে ছাই করতে আমার একটিবারও বুক কাঁপে না। আর এদিকে তুমি এক পিচ্চি মেয়ে। তোমার এই অহং আমার জুতার নিচে চাপা দিতে এক মুহূর্তও লাগবে না।”

মহুয়া ছেলেটির পা’য়ে এক জোরে লাথি মারে। তার বড় নখ দিয়ে ছেলেটির হাত খামচায়। ছেলেটা এক পা’ও নড়ে না। উলটো তার ক্ষত স্থানে আরও শক্ত করে ধরে হাত মুড়িয়ে নেয়। মহুয়া চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। তার চোখের কোণায় পানি জমে যায়। সে অন্যহাত দিয়ে বহু কষ্টে তার জিন্সের পকেট থেকে তার ছু’রি বা স্প্রে বোতল বের করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। এর পূর্বেই ছেলেটা তার হাত মুড়ি তার পিঠের কাছে নিয়ে যায়। মহুয়া চিৎকার দিয়ে চোখ খুলে। ছেলেটাকে নিজের এত কাছে দেখে সে হতভম্ব হয়ে যায়। দূরে সরতে চাইলে ছেলেটা আরও জোরে তার হাত চেপে ধরে। ছেলেটা বলে,
“তিন মাসের জন্য কেবল বাহিরে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে ভেজা বেড়ালরা বাঘিনী সাজতে এসেছে। যেখানে কেউ আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস রাখে না সেখানে তুই আমার সাথে বেয়াদবি করিস?”

মহুয়ার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু সে চোখ নামায় না।।উলটো আরও দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“চোখ নামাতে বলেছি।” ছেলেটি হুঙ্কার দিয়ে উঠে। তার নীলাভ চোখের মণির আশেপাশের সাদা অংশ লালচে হয় আসে।
“মনে হয় আমি ভয় পাই। একবার হাত ছেড়ে দেখো, প্রাণ নিয়ে নেবার সাহস আছে।”
“তুই এখন আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস। তোদের মতো মেয়েদের আদব কীভাবে শেখাতে হয় তা ভালো করে জানা আছে আমার।”
“আগে নিজে আদব শিখে আসো।”
ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করতে করতে মহুয়ার গাল চেপে ধরে, “তোর দেখি আসলে জা’নের ভয় নেই। চোখে পানি ভর্তি অথচ এখনো চোখ নামাচ্ছিস না। অনেক তেজ আছে তাই না? মেয়েদের তেজ কোথায় যেয়ে শেষ হয় জানিস?” বাঁকা হাসে সে, “নিজের সম্মানে। এই’যে এতগুলো মানুষ এখানে তোর সম্মান শেষ হলে কী করবি?”

কথাটি শেষেই মহুয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ভয় ভেসে উঠে। সে ছটফট করতে থাকে। যা দেখে ছেলেটি স্বশব্দে হেসে উঠে, “আই লাইক ইট। আমার সামনে চোখে ভয় থাকাটা বাধ্যতামূলক। এরপর থেকে আমার সাথে চোখে চোখ রাখার সাহস করবি না।”

সে মহুয়াকে ছাড়তে নিলেই হঠাৎ গালে এক আঘাত অনুভব করে। সাথে সাথে ছিটকে পড়ে সে মাটিতে। মহুয়া পাশে ফিরে দেখে জাহানকে। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে, “শায়ান এটা ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং, খবরদার জাহানের জানকে হাত লাগালে হাত ভেঙে দিব।”
জাহানের দৃষ্টি শায়ানের দিক থেকে সরিয়ে মহুয়ার দিকে স্তব্ধ করল। মুহূর্তে তার অগ্নিময় দৃষ্টি নম্র হয়ে এলো। সে এক হাত এগিয়ে তার হাত আলতো করে ধরে কাছে টেনে নিজের প্রশস্ত বুকে ভরে নিলো। তার কঁধে এক হাত রাখলো অন্যহাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “সরি মাই লাভ আমার দেরি হয়ে গেল, তুমি কী বেশি ব্যাথা পেয়েছ?”

মহুয়া স্তব্ধ হয়ে ছিলো জাহানের বুকেতে। সে হঠাৎ এমন কাজ করবে সে ভাবে নি। তবে তার ভয়টা একটু একটু কমে। জাহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ায় সে আশ্বাস পায়। তবুও কোনো উওর দেয় না।

শায়ান উঠে দাঁড়ায়, হেসে বলে, “ওহ তাহলে তোর নামের প্রেমিকা এটা না’কি? শুনেছিলাম ওর কথা কিন্তু চিনতে পারি নি। চিনলে তোর আগেই আমিই দুই চারটা চুমু খেতে নিতাম।”
“শায়ান!” জাহান হুঙ্কার দিয়ে উঠে।

শায়ানের এসবে মাথা ব্যাথা নেই। সে বলতে থাকে, ” যদিও মন ভরতো না। ব্লাডি হেল, তোর টেস্ট অনেক খারাপ রে জাহান। শুনেছি ইয়াজভান জাহান একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে কল্পনা করেছিলাম সেরা সুন্দরী হবে অথচ এই মেয়েকে তোর পছন্দ হয়েছে। এভারেজ একদম।”
“তোর অপনিয়ন চেয়েছি? আমার কথা শুনে রাখ শায়ান ওর থেকে দশ কদম দূরে থাকবি। ওকে ছোঁয়া তো দূরের কথা তোর দৃষ্টিও যেন ওর দিকে না যায়।”
শায়ান হাসে, “এখন তো ওর উপরই আমার দৃষ্টি থাকবে। তোর প্রথম দুর্বলতায় তো হাত দিতে পাড়ব না। কিন্তু তোর দুর্বলতাকে ছেড়ে দেওয়াটা বোকামি হবে তাইনা?”
“তোকে….”
“টাইম নেই। তোর হু’মকি আরেকদিন শুনব। যদিও এই হাওয়ায় উড়ানো হুমকিতে শায়ান শিকদারের কিছু আসে যায় না। ” বলে সে বাইক নিয়ে চলে যায় ভার্সিটির বাহিরে।

জাহান রাগে ফুঁসতে থাকে। জয় পাশে এসে দাঁড়ায় তাদের, “ভাই ভাবির হাত ছিঁলে গেছে।”
জাহান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “তোকে একটা কাজ দিয়েছিলাম সেটাও করতে পাড়লি না?”
জয় জাহানের রাগ দেখে কিছু বলে না।

জাহান মহুয়াকে বলে, “ডাক্তারের কাছে চলো।”
মহুয়ার তখন হুঁশ আসে। সে সরে যেতে নেয়, “লাগবে না।”
“তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি। চলতে বলেছি।”
“বলেছি তো, যাব না। আমার ক্লাসে যেতে হবে।”
“হায়রে আমার ফাঁকিবাজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগররে। প্রতিদিন ক্লাস থেকে পালানোর বাহানা খুঁজে আর আজ পড়াশোনার জন্য প্রেম উতলে পড়ছে না?”
জাহান আচমকা তাকে কোলে তুলে নিলো। হঠাৎ এহেন কান্ডে মহুয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“করছেনটা কী? নামান, নামান বলছি।” সে ছটফট করতে থাকে, “এই ধানিলংকা এত নড়চড় না করে স্থির থাকতে পারো না তুমি?”
আরও বেশি ছটফট করতে থাকে মহুয়া। এমনকি না মানায় নখ দিয়ে খামচে দেয় জাহানের ঘাড়ে।
“উফফ লাভ এমন করো না তো।”
“নামান বলছি, নাহয় আরও জোরে দিব। ব্যাথা পেলে বুঝবেন।”
“ব্যাথা দেও সমস্যা নেই। কিন্তু আমার তো ফিলিংস জেগে যাচ্ছে। আরও দেড় বছর অপেক্ষা করো। গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট হোক। তারপর বিয়ে সেরে ফেলব তারপর ইচ্ছামতো খামচি দিও।”
প্রথমে মহুয়া তার কথার মানে বুঝলো না যখন বুঝল যখন তার চক্ষু যেন কপালে উঠে যাবার ন্যায়।
“নিলজ্জ লোক!”
জাহান বাঁকা হাসে, “তাহলে ধনিলংকার লজ্জাশরম আছে দেখছি।”
“লজ্জা মাই ফুট! লজ্জা পাচ্ছি না, আপনার নিলজ্জ মনোভাবে অবাক হচ্ছি।”
জাহান হাসে। জয় এসে তার গাড়ির দরজা খুলতেই জাহান মহুয়াকে বসিয়ে দেয়। সে ড্রাইভিং সিটে যেতে যেতে মহুয়া অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে জাহান ধরে নেয় তাকে, “তোমার কি আমাকে বিরক্ত করতে একটু বেশিই ভালো লাগে?”

সে এক হাত দিয়ে তাকে তুলে নেয়। আবার বসিয়ে দরজা লক করে দেয়। দ্রুত যায় ড্রাইভিং সিটে এবারও মহুয়া বের হতে নিয়েছিল। জাহান আগেই এসে পড়ে। এর এবার ক্ষ্যাপা বাঘের ন্যায় রাগান্বিত স্বরে বলে, “আই সোয়ার এরপর পালানোর চেষ্টা করলে তোমাকে কোলে বসিয়েই ড্রাইভিং করব।”

তাকে সরিয়ে আগের সিটে বসায় জাহান। নিজে বসে ড্রাইভিং সিটে। সিটবেল্ট লাগিয়ে তাকায় আড়চোখে তাকায় মহুয়ার দিকে। ফুলো গাল দুটো আরও ফুলিয়ে রেখেছে, নাকটা লাল হয়ে আছে, কপালে ভাঁজ পড়া। তার কাছে মহুয়াকে কিউট লাগলো। সে খানিকটা হেসে দেয়। মহুয়া তাকায় তার দিকে। রাগে ফুঁসছে সে। বলে, “হাসির কী হলো? আমার মুখে কি জোকস লেখা?”
“না, তোমাকে কিউট লাগছে।”
“কিউট লাগলে হাসতে হবে?”
“তোমার নাকের ডগায় কি সারাক্ষণ রাগ থাকেই থাকে?”
“হ্যাঁ, থাকে তো?”
“রাগলে তোমাকে কিউট লাগে। গালদুটোর রসগোল্লার মতো হয়ে যায়।”
জাহান হাসে প্রথমে। তারপর গম্ভীর চোখে তাকায় মহুয়ার দিকে। হাত হাতে হাল্কা হাল্কা জমে থাকা র’ক্ত দেখে তার বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠে। স্টেরিং এ থাকা তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায়। তার শায়ানের উপর ভীষণ পরিমাণে রাগ উঠে। কিন্তু মহুয়া তার পাশে বলে সে নিজেকে শান্ত করে। তাকায় তার দিকে। মৃদু হাসে।

“মৃণা এখন কেমন আছে?” জাহান জিজ্ঞেস করে।
“আগের থেকে ভালো আছে। ক্ষতগুলো কমেছে। আম্মু তো ওকে পেয়ে যে খুশি। ওর মতো শান্ত শিষ্ট মেয়ের আম্মুর শখ ছিলো, পেল আমার মতো তারছেঁড়াকে।”
জাহান তার কথায় অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তার হো হো করে হেসে উঠল।
মহুয়া আবারো বলল, “ও নিজেও আম্মুর পিছনে ঘুরঘুর করে। মুরগির ছানা যেমন মুরগির পিছু ঘুরে। ওর মা নেই তো। ছোটবেলায় আন্টির খুব ক্লোজ ছিলো। খুব মিস করে আন্টিকে।”

কথাটা শুনে জাহানের মুখে মেঘ নেমে এলো। কিছু সময় জাহানের কোনো শব্দ না শুনে। মহুয়া তাকাল জাহানের দিকে। তাকে ভীষণ শান্ত দেখাচ্ছে। তার শান্ত থাকাটা সঠিক ঠেকল না মহুয়ার কাছে। জাহানের মুখে কেবল দুইটি ভঙ্গিই দেখেছে মহুয়া হয়তো ক্ষোভ, নাহলে হাসি। কিন্তু তাকে শান্ত দেখে নি। যদিও তার সাথে ঠিক দেখা হয় না জাহানের কিন্তু তার কাছে জাহানকে উদাসীন মনে হলো।
“হঠাৎ মন খারাপ লাগছে?” মহুয়া প্রশ্ন করে।
“উঁহু, হঠাৎ আমিও আমার মাম্মাকে মিস করছি।”
“কেন আন্টি কোথায়?”

জাহান গভীর নিশ্বাস ফেলে, “মৃণার মা যেখানে, সেখানে।”
মহুয়া চকিতে তাকায় জাহানের দিকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এবার তার জাহানের জন্য ভীষণ খারাপ লাগে।

জাহান আবার গম্ভীর স্বরে বলে, “তুমি ভাবো আমি তোমার সাথে প্রেমের নাটক করছি? ডু ইউ নো জান, হোয়াট ইজ লাভ ফর মি? আমার মাম্মা পাপা তাদের ভালোবাসার জন্য লড়াই করেছে। আমার মাম্মা তার ফ্যামিলির প্রিন্সেস ছিলো সে নিজের সুখের রাজমহল ছেড়ে এসেছিল আমার বাবার কাছে যেখানে দু’বেলা ভাত খাওয়ার রাজভোগের ন্যায় ছিলো। আর আমার বাবা দিনরাত পরিশ্রম করেছে আমার মা’কে তার রাজমহল গড়ে দেওয়ার জন্য।”
আপনা-আপনি হাসি এঁকে উঠে জাহানের ঠোঁটের কোণে, “আমার মা তার ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করে নি। তারা দুইজন নিজের ভালোবাসার জন্য সব সীমানা পাড় করেছে। একজন জীবন দিয়েছে, আরেকজন শূন্য জীবন পাড় করছে। সেখানে আমি, তাদের অংশ, কীভাবে ভালোবাসার নাটক করতে পারি লাভ?”

জাহান হঠাৎ গাড়ি থামায়। তাকায় মহুয়ার দিকে।তার দৃষ্টিতে বিস্ময়। জাহান সিটবেল্ট খুলে খানিকাটা ঝুঁকে এলো মহুয়ার কাছে। মহুয়াও পিছনে ঝুঁকে গেল পিছনে। কপালে ভাঁজ আনল।
জাহান ভারী গলায় বলল, “একবার আমায় কেবল ভালোবেসে দেখো লাভ, তোমার জন্য না বাঁচতে দ্বিধাবোধ করব আর না ম’রতে। একবার ভালোবাসো, আমাকে আরেকটু তোমায় ভালোবাসায় ডোবার সুযোগ দেও, এরপর যতবার আমার ভালোবাসার পাগলামো দেখতে ততবার আরও বেশি ভালোবাসবে।”

মহুয়া জাহানের কাছে আসায় আরও পিছনে সরে বসে। তার অস্বস্তি লাগে। সে সাথে সাথে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
জাহান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসে। তারপর বাহিরে যায়। দেখে মহুয়া দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশেই। তাকিয়ে আছে সামনের বিল্ডিং এর দিকে। চুপচাপ।
জাহান গাড়ি লক করে তার কাছে এলো, “ধনিলংকা আজ এত চুপ কীভাবে?”
মহুয়া তার দিকে তাকায় ঠোঁট উল্টে, “হাস্পাতালে না গেলে হয় না?”
“হয় না।”
“এতটুকু ব্যাথার জন্য কেউ হাস্পাতাল আসে? আমার বন্ধুরা শুনলে হাসবে।”
“তোমার বন্ধুদের ইনজেকশন লাগিয়ে দিব। তারপর আর কেউ হাসবে না।”
“ইঞ্জেকশন? আমাকে ইঞ্জেকশন দিবে? আমি নাই। আমি গেলাম। ”
সে দৌড় দিতে নিলেই জাহান তার বাহু ধরে নেয়, “তুমি কি খুব করে চাও আমি তোমাকে এখন কাঁধে তুলে নিয়ে যাই হাস্পাতালে?”
“আমি কি আলুর বস্তা যে বারবার কাঁধে তুলে নিবেন।”

জাহান উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকায় মহুয়ার দিকে, “আগে খেয়াল করি নি তো। আসলেই আলুর বস্তা। একদম সেইম। হাইট, সাইজ, সেম টু সেম।”
মহুয়া হা হয়ে গেল, “আপনি আমাকে আলুর বস্তা বললেন? এত সাহস?”
বলে সে অন্যহাত দিয়ে জাহানের বুকে ঘুষি মারতে শুরু করল। এতে জাহান এক চুলও নড়ল না। কিছুক্ষণ পর মহুয়া নিজেই হাঁপিয়ে গেল। জাহান বলল, “হয়েছে? এবার নিজে হেঁটে যাবে না কোলে তুলব?”
“আজকে আমার ছু’রিটা আনতে ভুলে গেছি, নাহলে আপনার নাজেহাল অবস্থা করতাম।”
“তাই? ভালো করে দেখো তো পকেটে আছে না’কি?’
মহুয়া চোখ কপালে তুলে তাকায় জাহানের দিকে। আমতা-আমতা করল। সে মিথ্যে বলেছিল, ছু’রিটা তার সাথেই আছে। তার পকেটে। সেদিন মৃণার ব্যাপারে সাহায্য করার পর জাহানকে আর অসহ্যকর লাগে না মহুয়ার। ভালোও লাগে না। কিন্তু তার মনে হলো জাহান ভালো মানুষ। আজও কীভাবে সাহায্য করল তাকে! প্রেম না করলেও বন্ধুত্ব করাই যায়। বন্ধুত্ব না করলেও টুকটাক আড্ডা দেওয়া যায়।

মিথ্যা কথা বলে ধরা পড়ায় সে লজ্জা আমতা-আমতা করে, ” যখন এসেই পড়েছি তাহলে ভেতরে যাই চলুন।”
“চলো। এখানে আমার এক আংকেল কাজ করে। বাবা মা’য়ের কলেজের বন্ধু। উনার কাছে যাব। উনি এত ভালো চিকিৎসা করবে ব্যাথাও পাবে না।”

কিছুক্ষণ পর,
“মা’গো ব্যাথা পাচ্ছি।” হাতে তুলা দিয়ে স্যাভলন লাগাতেই মহুয়া কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে। এতটুকুতেই রাগ উঠে যায় জাহানের। সে চেঁচিয়ে উঠে নার্সের উপর, “আপনি কাজ পারেন না? কী কাজ করেন? ও ব্যাথা পাচ্ছে কেন? যান, অন্যকোনো ভালো নার্সকে পাঠান।”
তার হুঙ্কারে ভয়ে কেঁপে উঠে নার্সটি। ডা. নাহিদ ইসলাম গালে হাত দিয়ে তার বন্ধুর ছেলের কান্ড দেখছেন। সে বলল, “ও সবচেয়ে ভালো নার্স। কাজ করতে দেও ওকে।”
“সবচেয়ে ভালো নার্স? তাহলে ও ব্যাথা পাচ্ছে কীভাবে?আপনার হাস্পাতালই এত জাতের না চাচা। ও আরেকটু ব্যাথা পেলে আপনার হাস্পাতালের নামে কেইস করব। কেইস না করতে পাড়লে ব্যাড রিভিউ দিয়ে দিব।”
নাহিদ ইসলাম দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। নার্সকে বলল, “সাবধানে করো।”
দেখল জাহান গোল গোল চোখ করে, তার ধাঁরাল চোয়াল ঝুলিয়ে রেখে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে।

নাহিদ ইসলাম চোখ ঘুরায়। বিড়বিড় করে বলে, “আমার খাবারের টাইমে এসে একতো আমাকে বিরক্ত করল।এর উপর আবার কান্ড করছে।” বলে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। তার মনে পড়ল অতীত কথা। ভেবেই হাসল, “ব্যাটা একদম বাপের মতো হয়েছে। ওর বাপও জান্নাতের কিছু হলে আমাকে পাগল করতো, এখন ওর ছেলে করে।” অতীত মনে করতেই মন ভারী হয়ে এলো তার। আজ জান্নাত বেঁচে থাকলে হয়তো সবকিছু আলাদা হতো, আরও সুন্দর হতো। সে নিশ্চয়ই খুশি হতো তার ছেলেকে দেখে। জান্নাতের কাছে তার ভালোবাসা ছিলো পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবন থেকেও বেশি। সদ্য প্রেমে পড়া সকল লক্ষ্মণ দেখতে পাড়ে নাহিদ জাহানের মধ্যে। সে গাঢ় হাসে। জানালার বাহিরে তাকায়। বিকেল ঘনিয়ে আসছে। এই গোধুলি বিকেলটা খুব পছন্দের ছিলো জান্নাতের। জান্নাত ও অহিদ প্রায়ই এই সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “দেখছিস জান্নাত, তোর সে ছোট আদুরে জাহানটা আজ প্রেমে পড়েছে। তোর ও আহিদের অংশ প্রেমে পাগলামোটা তো করবেই। এখন দেখার বাকি, তোর পাগলামো ওর মধ্যে বেশি এসেছে না অহিদের।”

নাহিদ বলেন, “তোমরা কী লাঞ্চ করেছ? অর্ডার দিব?”
মহুয়া সাথে সাথে বলে, “আমার পেটে হাতিরা হাডুডু খেলতেছে।”
নাহিদ হেসে দেয় তার কথা শুনে। সে কল দিয়ে অর্ডার করে। মহুয়া তাকে ওয়ার্নিং দিয়ে বলে, “আংকেল সাবধানে অর্ডার দিবেন। আমার খাবার ভালো লাগলে আপনার কেবিনকে পরে রেস্টুরেন্ট ভেবে এসে পড়ব।”
“তুমি মজার মানুষ আছো। আসতে পারো। আড্ডা দিতে মজা লাগবে।”
“আমার থেকে আপনার সব ইঞ্জেকশন দশ হাত দূরে রাখলে অবশ্যই আসব।”
জাহান নাহিদের সামনের চেয়ারে বসে, “কোনো সমস্যা হবে না তো চাচ্চু।”
“সমস্যা? যাস্ট একটু ব্যাথা পেয়েছে। তুই এমন করছিস যেন বড় কোনো এক্সিডেন্টই হয়ে গেছে। এটা তো স্যাভলন লাগালেই ঠিক হয়ে যায়।”
“মেডিসিন লাগবে?”
“বলেছি তো ওর কিছুই হয় নি।”
“দেখো কিন্তু ওর কিছু হলে তোমার উপর কেইস করে দিবো।”
নাহিদ মুখ বানায়, “তুই তো দেখি তোর বাপ থেকেও বেশি পাগল প্রেমিক হয়েছিস ব্যাটা। অহিদও তো আমাকে এত ছোট বিষয়ে হু’মকি দেয় নি।”
মহুয়া কথাটা শুনে তাকায় তার দিকে। উৎসুকভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “অহিদ কি জাহানের বাবা?”
“হ্যাঁ মামণি। আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
“মানে আপনি ওর মা বাবার লাভ স্টোরি দেখেছেন? জাহান একটু আগেই তাদের কথা বলল। কথা শুনে তাদের লাভ স্টোরি শুনতে ইচ্ছা করছে। আই লাভ লাভ স্টোরি’স।”
জাহান আড়চোখে তাকায় মহুয়ার দিকে, “এজন্যই তো আমার লাভ স্টোরি কমপ্লিট হতে দিচ্ছো না।”
মহুয়া তার দিকে ভেংচি কেটে নাহিদের দিকে তাকায়, “আংকেল আপনি বলুন।”
“আজ তো সম্ভব নয়। এখন খাবার আসবে। পনেরো মিনিট পর থেকে পেসেন্ট দেখা লাগবে। তোমার দাওয়াত রইল জাহানের সাথে আবার এসো। স্টোরি শুনাব।”

হাস্পাতাল থেকে বের হয়ে মহুয়া বলে, “আর জীবনেও এই হাস্পাতালে আসব না। খাবার একদম বাজে।”
জাহান হাসে, “তুমি তাহলে কী ভেবেছিল হাস্পাতালে ফাইভ স্টার খাবার পাবে?” হঠাৎ কিছু মনে করে বলে, “আমার সাথে যাবে একজায়গায়? ভীষণ সুন্দর জায়গা। মজার খাবার পাবে।”
“বাহ! আপনি দেখি চালাক আছেন। বুঝে নিলেন মজার খাবারের কথা বলে আমাকে নিয়ে যেতে পাড়বেন।”
“বুঝে নিতে হয় ম্যাডাম। আপনি তো নিজ ইচ্ছায় সময় কাটাবেন না, সময় কাটানোর বাহানা খুঁজে নিতে হয়।”
.
.
শায়ান ক্লাবে বসে আছে। হাতে ম’দের গ্লাস। তার পাশে একটি মেয়ে বসা। তাসিন আসে সে সময়। বসে তার পাশের সোফায়, “কী খবর দোস্ত? কেমন আছিস? ট্রিপ কেমন গেল?”
“তুই কথা বলিস না। আমি আসলাম দুইদিন হলো তোর খোঁজই নেই।”
তাসিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার জ্যাকেটটি খুলে রাখে। আচমকা একটি মেয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, “হে বেবি তুমি কেমন আছো? দু’সাপ্তাহ ধরে দেখছি না তোমায় কোথাও ছিলে?”
তাসিন বিরক্তি নিয়ে মেয়েটিকে সরিয়ে দেয়, “ভালো লাগছে না। অন্যকারো কাছে যাও।”
“হোয়াট ইউ মিন বাই অন্যকারো কাছে যাও। তুমি তো এভাবে কথা বলছো যেন আমি কোনো রাস্তার মেয়ে। এক ছেলে ছেড়ে আরেকজনের সাথে থাকি। তুমি ওদিন আমার সাথে ডান্স করলে, ড্রিংকস করলে, নাম্বার নিলে এজন্য কথা বলতে এসেছিলাম।”
“কথা হয়েছে? যাও এবার।”
মেয়েটা রেগেমেগে চলে গেল। শায়ান সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “কী হয়েছে তোর? একটু চেঞ্জ চেঞ্জ লাগছে। তোর ওই নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেছিস না’কি?”
“ফালতু কথা বলবি না। ওর সাথে সময় কাটানোর পর ওকে আমার নিজের বোনের মতো লাগে। তন্নির মতো মহুয়াও আমার বোন এখন থেকে।”
শায়ান তার ম’দের গ্লাসের দিকে তাকায়, “মহুয়া? মহুয়া তাহলে ওই বেয়াদব মেয়ের নাম। সাউন্ডস গুড।” তাসিনের দিকে আবার তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে টিটকারির সুরে বলে, “ফেইক গার্লফ্রেন্ড থেকে বোনের সফরটা কেমন লাগলো ব্রো?”
“ফাজলামো করবি না।”
“করলাম না। কিন্তু এতো এট্যাচ হওয়া লাগবে না ওর সাথে।”
“কেন?”
“কেন আবার? ও জাহানের প্রেমিকা। জাহানকে কষ্ট দিতে হলে ওকে তো কষ্ট পেতেই হবে। আজ আমি জাহানের চোখে দেখেছি। ওই মেয়ে জাহানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ওর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ওকে শেষ করব।”
তিসান আঁতকে উঠে কথাটি শুনে। সে বলে, “তোর সাথে মহুয়ার দেখা হয়েছে?”
“হয়েছে মানে? ভয়ে কেঁপেছে। বাঘিনী সাজতে এসেছিল, ভেজা বিড়াল একটা।”
“মহুয়া ভয় পেয়েছে। আমার বিশ্বাস হয় না। ও বাঘিনীই। আমি নিজের চোখের সামনে দেখেছি, একজনের হাতে ছু’রি ঢুকিয়ে দিয়েছিল।”
শায়ান শব্দ করে হাসে। যেন কোনো রসিকতা শুনেছে। বলল, “এতটুকু ব্যাস? আমি কারো বুকে ছু’রি দিয়ে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করি না।”
তিসান আমতা-আমতা করল, “দোস্ত চল না সব শত্রুতা ভুলে অতীতের মতো বন্ধু হয়ে যাই।”
“আমরা তো বন্ধুই।”
“না মানে…আমি, তুই আর জাহান।”
শায়ান ড্রিংকস এ চুমুক দিতে যেয়েও থেমে যায়। কপাল কুঁচকে তাকায় তিসানের দিকে, “আমাদের সাথে আরেকজনও ছিলো তাকে ভুলে গেছিস? না’কি নিজের বোনের প্রত্যাখ্যান ভুলে গেছিস?”
“সব মনে আছে। কিন্তু এখানে জাহানের দোষ নেই। ও কাওকে জোর করে তো ভালোবাসতে পারে না। আমাকেও তো জিনি কতবার প্রাপোজ করেছে। এ হিসেবে তো আমিও জাহানের শত্রু হতাম তাই না?”
শায়ান মুখ চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, “এসব তোকে কে বুঝিয়েছে? ওই মেয়ে?”
“যেই বুঝাক সঠিক বুঝিয়েছে। আর তুই মহুয়া থেকে দূরে থাকবি। ওর সাথে কিছু করার চিন্তাও করবি না।”
“যদি করি তাহলে?”
“তাহলে জাহানের সাথে এখন আমিও ওকে প্রটেক্ট করার জন্য।” বলে সে উঠে চলে যায়।
শায়ান চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকে তাসিনের যাওয়ার দিকে। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। সে তার ড্রিংকের গ্লাসটা চেপে ধরে রাখে। আচমকা রাগ সামলাতে না পেরে গ্লাসটা চেপে ধরে মা’রে সামনের কাঁচের গ্লাসে। মুহূর্তে হাত র’ক্তাক্ট হয়ে যায়। টুপ টুপ করে পরতে থাকে র’ক্তের বিন্দু।

তার পাশের মেয়েটা আঁতকে উঠে, “জান আর ইউ ওকে?”
সে র’ক্তাক্ত হাতটা ধরতে গেলেই শায়ান হাতটা ঘাড়ের পিছনে নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আছে। রুক্ষভাবে চুমু খেতে থাকে তাকে। মেয়েটা ব্যাথা বারবার আর্তনাদ করে। তাকে সরানোর চেষ্টা করলে আরও কাছে টেনে নেয় শায়ান।
“তোমার হাতে কাঁচ ঢুকেছে শায়ান। আমার ঘাড়ে লাগছে। প্লিজ ছাড়ো।”
“আমাকে না ভালোবাসিস তুই? ভালোবেসে এতটুকু সহ্য করতে পাড়বি না?”
মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরাতেই মেয়েটি মেঝেতে পড়ে যায়। তার ঠোঁটে বিভিন্ন অংশ কেটে গেছে।
“ভেবেছিলাম তোকে আজ রাতে ফার্ম হাউসে নিয়ে যাব। তুই এর যোগ্য না। আমার চোখের সামনের থেকে যা।”
মেয়েটি নিজের জান নিয়ে পালায়।

শায়ান নিজের র’ক্তাক্ত হাতটা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে, “মিস মহুয়া তোমাকে এর দায় পরিশোধ করতে হবে। খুব বাজে ভাবে।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সন্ধ্যার প্রথম ভাগে জাহান ও মহুয়া পৌঁছায় জায়গাটিতে। একটি নদীর উপর কাঠের রঙ্গিন খাবারের ঘর। পাশে দাঁড় করানো দুটো নৌকা। যতদুর চোখ যায় ততদূরই সবুজ শ্যামলী ও সচ্ছ জল। জায়গাটা দেখেই মহুয়া উৎসুক হলো। সে লাফিয়ে উঠে জাহানের হাত ধরল, “খাওয়া শেষে আমরা নৌকায় উঠব ওকে?”
“এজ ইউর উইশ।”
উওরটা শুনে মহুয়া খুশি হয়। সে লাফাতে লাফাতে হেঁটে উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়, “আমার নৌকা উঠা খুব পছন্দের। কিন্তু ভাইয়া উঠতে দেয় না।”
“কেন?”
“আমি যদি পানিতে পড়ে যাই?”
জাহান হাসে, “আজ উঠো তাহলে। আমি সাথে থাকতে তোমার কিছু হবে না।”

মহুয়া থেমে যায়। পিছনে ফিরে তকায় জাহানের দিকে। আঙুল তুলে বলে, “দেখো আমরা কিন্তু এমনি ঘুরতে এসেছি। পরে তুমি বলবা না আমার সাথে ঘুরেফিরে প্রেম করতে মানা করছে। কত্তো খারাপ মেয়ে!”
জাহান আসে, “বলবো না। কেবল তোমার প্রেমে পড়ার অপেক্ষায় থাকব। যতবছর যাক।”
মহুয়া পুণরায় উঠতে শুরু করে, “যতবছর যাক? যদি পাঁচবছর লাগে?”
“লাগলো।”
“দশবছর।”
“অপেক্ষা করব।”
“বিশবছর।”
“লাগুক।”
“তাও অপেক্ষা করবে?”
“আমার হৃদয় কি তোমার খেলনা মনে হয় যে সবাইকে দিয়ে বেড়াব?”
“আচ্ছা কি বুঝে আমাকে হৃদয় দিলে?” মহুয়া পিছু ফিরে উল্টো উপরে উঠতে থাকে।
“যেদিন প্রেমে পড়বে সেদিন জানবে।”
“তুমি তো খারাপ দেখছি।”
“কেন আগে জানতে না?”
“আচ্ছা যদি আমি অন্যকাওকে ভালোবেসে ফেলি?”
জিজ্ঞেস করতেই পা পিছলে যায় মহুয়ার। সে যেয়ে পড়ে জাহানের উপর। জাহানের কাঁধে তার মুখ গুজানো। তার পিঠে জাহানের হাত। জাহানে অন্যকাঁধের শার্ট খামচে ধরে আছে সে।

মহুয়া ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। সে ভেবেছিল আজ তার আর খাওয়া লাগবে না। সবাই ক’দ্দিন বাদে তার চল্লিশা সবাই খাবে। সে জাহানের হাত তার পিঠে অনুভব করতেই চমকে উঠে। সাথে সাথে মুখ তুলে তাকায় জাহানের দিকে। তাকাতেই চোখাচোখি হয়।

জাহান ভারী স্বরে বলে, “দেখলে তোমার নিজের দেহও তোমার কথায় সায় দিলো না। কারণ এটা আমার আমানত। এই’যে তুমি একটু পর পর আমার আমানতে আঘাত দিচ্ছো এর শাস্তি তোমাকে বিয়ের পর দিব। আর রইল অন্যকাওকে ভালোবাসার কথা, তোমার সাথে তোমার হৃদয়টাও আমার আমানত। একসময় আমার মাঝে এসেই থামবে।”
মহুয়া মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “যদি না থামে?”
জাহান তার পিঠে রাখা হাত আরও শক্ত করতেই আঁতকে উঠে মহুয়া।
জাহান মাতায়ারা স্বরে বলে, “আমার ভালোবাসা যত সুন্দর তার থেকে বেশি ভয়ানক হতে পারে জান। তোমার জন্য সম্পূর্ণ পৃথিবীর সাথে লড়তে পাড়ব, প্রয়োজনে তোমার সাথেও।”

ডুবন্ত সূর্যের লাল রশ্মি এসে পড়ছিল তাদের উপর। জাহানের মুখের উপর সূর্যের মৃদু রশ্মি পড়ছে। তার গাবলি চুলগুলো চোখের পাতা ছুঁয়ে যায়। তার নেশালো দৃষ্টিতে আত্না কাঁপিয়ে দিলো মহুয়ার। এই প্রথম তার জাহানকে আকর্ষণীয় লাগল।

মহুয়া মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সংযত করে জাহানকে সরিয়ে দেয়। নিজের স্কার্ফটা ঠিকঠাক করে বলে, “নৌকায় উঠবো।”
“হেঁ?”
“বলেছি নৌকায় উঠবো।”
“খেয়ে নেই।”
“না, সূর্য ডুবছে। আমার সূর্যাস্ত ভীষণ পছন্দের। আমি নৌকায় বসে সূর্যাস্ত দেখতে চাই।”
“তোমার ইচ্ছা পূরণ করা আমার কর্তব্য জান। আসো।”
জাহান হাত বাড়ায় কিন্তু মহুয়া তার হাত ধরে না। পাশ কাটিয়ে চলে যায়। জাহান নিজের খালি হাতটা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে। পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় টবে লাগানো মিষ্টি রঙের একটি গোলাপ। ফুলটা দেখে তার মহুয়ার কথা মনে পড়ে। সাথে সাথে সে ফুলটি ছিঁড়ে নেয়। পিছু যায় মহুয়ার।

মহুয়া ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে। জাহান নিচে যাবার পর মাঝির সাথে কথা বলে নৌকা ঠিক করে। তারা দুইজন উঠে বসে নৌকায়।

ডুবন্ত সূর্য। লালচে কমলা রশ্মি এসে পড়ে স্বচ্ছ জ্বলে। চারপাশে মিষ্টি ঘ্রাণ। জলের মাঝে নৌকায় বসে আছে মানব মানবী।

মহুয়া তার হাত দিয়ে জল নিয়ে খেলছিলো। তার ঠোঁটের কোণে একগাল হাসি। পানি নিয়ে খেলা করতে যেয়ে কিছু বিন্দু জল ছিটিয়ে আছে মহুয়ার মুখেতে। শেষ সন্ধ্যার কমলা রশ্মি তার মুখে এসে পড়ছে। সে আড়চোখে একবার তাকাল জাহানের দিকে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। কী বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে জাহান! এভাবে, একদৃষ্টিতে কেউ তাকিয়ে থাকে?

মুগ্ধ নয়নে তার পছন্দের মানুষটিকে পরখ করছিল জাহান। কোনো দৃশ্য এত সুন্দর হতে পারে তার জানা ছিলো না। একটি মানুষ কতটা সুন্দর হলে প্রকৃতিকেও সুন্দর করে তুলতে পারে! জাহানের ইচ্ছে হচ্ছিল সময়টিকে এই মুহূর্তেই থামিয়ে দিতে। পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দিলো। সময় এখানেই থেমে গেলে মহুয়ার সাথে বাকি স্মৃতিগুলো বানাবে কীভাবে?

সে উঠে যেয়ে বসে মহুয়ার পাশে। একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মহুয়া তার দিকে তাকায়। আবারও একইদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার বিরক্তি লাগছে।”
জাহান উওর দেয় না। পকেট থেকে মিষ্টি রঙের গোলাপটি বের করে মহুয়ার কানের পাশে গুঁজে দেয়।
“এটা আবার কেন?”
“সুন্দর লেগেছিল। দেখেই তোমার কথা মনে পড়ল। দেখো তোমার ফতুয়ার সাথে ম্যাচ কর…”
সম্পূর্ণ করবার আগেই মহুয়া ফুলটি খুলে ফেলে দিতে নেয় আর জাহান তার হাত ধরে নেয়, “এমন করছো কেন?”
“আমার ফুল পছন্দ না।”
“আমার তো পছন্দ।”
“তাহলে তুমিই পরো। আমাকে কেন দিচ্ছ?”

জাহান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। মনে মনে বলে, “কন্ট্রোল জাহান কন্ট্রোল। তোর জান লাগে। আর নিজের জানের ক্ষতি করতে নেই। ওর সামনে অন্তত মাথা ঠান্ডা রাখ। তোর জানের মাথার ঢিলা স্ক্রু এটা জেনেই প্রেমে পড়েছিস। এবার ঠেলা সামলা।”
আর মুখে বলে, “একটু পরে থাকো না প্লিজ। আমার জন্য।”
তার করুণার সুর শুনে মহুয়া আরও স্থির হয়, সে কিছুতেই পরবে না।
“তুমি এমন কেন বলো তো।” জাহান জিজ্ঞেস করে।
“আমার কেবল নিজের পছন্দ মতোই চলি। অন্যের পছন্দের কিছু করাটা আমার অপছন্দের।”
বলে সে ঘুরে পা ভেজায় পানিতে। জাহানো আবার বসলো তার আগের জায়গায়। মহুয়াকে স্পষ্ট দেখার জন্য। জাহান তার ফোন বের করে ক্যামেরা বের করে। অন্যহাতে ফুলটা সামনে রেখে মহুয়াসহ ক্যামেরাবন্দী করে।

জাহান প্রথমে তাকাল র’ক্তিমা লালিমা ছড়ানো আকাশের দিকে তারপর মহুয়ার দিকে। তার ভীষণ ইচ্ছে হলো মহুয়াকে বুকের ভেতর ভরতে। তাকে বুকে ভরে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রেমিকাকে নিজের বক্ষপিঞ্জরে জড়িয়ে রেখে একটি প্রেমের গান গাইতে। কিন্তু আজ সে পাড়বে না। সে ভাবে, “আজ এই ইচ্ছেগুলো বক্ষপিঞ্জরেই বন্দী রাখি। মহুয়া আজ তাকে এই অধিকার দিবে না। অধিকার তো দূরের কথা, এই আশাগুলো পূরণ করতে গেলে কখন এই ধানিলংকা পানিতেই ঠেলা মেরে ফেলে দেয়। ভরসা নাই। ঢিলা স্ক্র-ই তো।”
তার মনে হলো তার জলদি সাঁতার শেখা উচিত।

আজ তার ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ থেকে গেল।
হয়তো আরেকদিন তারা একত্রে সূর্যোস্ত দেখবে,
হয়তো তার ইচ্ছে একদিন পূরণ হবে,
হয়তো, অন্য একদিন….

তারা এরপর যায় রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট বললেও ভুল হবে। পানির উপর কাঠের একটি সুন্দর স্থান। জায়গাটি মহুয়ার মনে ধরল। এরথেকে বেশি বেশি মনে ধরল সেখানের খাবার। কালাভুনা ও খিচুড়ির সাথে আমের আঁচার অমৃত লাগলো তার কাছে। সে আঙুল চেটেপুটে খেল। খাওয়া শেষে তারা এসে দাঁড়াল সামনের খোলা বারান্দায়। আকাশের দিকে তাকাল। এখনো আকাশটা লালচে হয়ে আছে।
মহুয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে জাহানকে বলল, “আচ্ছা তোমার কি কোনো স্বপ্ন আছে? যা করার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে থাকে।”
“আছে তো।”
“কী?”
“ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে একটা বড়সড় ফুটবল টিম বানাব।”
মহুয়া বিরক্ত হয়ে তাকায় তার দিকে। জাহান ভড়কে যায়, “এভাবে দেখছো কেন? তোমার নজর তো সঠিক লাগছে না আমার।”
মহুয়া চোখ ঘুরিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। জাহান হেসে তার ছোট আঙুল টা নিজের ছোট আঙুল দিয়ে ধরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “আমার সারাজীবন একটাই স্বপ্ন ছিলো। পার্ফেক্ট ফ্যামিলির। মা যাবার পূর্বে কখনো এই ব্যাপারটা নিয়ে এত ভাবি নি। কিন্তু মা যাবার পর বুঝেছি, পার্ফেক্ট ফ্যামিলি সবার ভাগ্যে হয় না। একজন না থাকলে সম্পূর্ণ পার্ফেক্ট ফ্যামিলিও ইমপার্ফেক্ট হয়ে যায়।” জাহানের বুক চিরে গভীর বেরিয়ে আসে, “আমি এখন কেবল আমার পার্ফেক্ট ফ্যামিলি চাই। আর সে ফ্যামিলি আমি তোমার সাথে গড়তে চাই মহুয়া।”
জাহান তাকায় মহুয়ার দিকে। মহুয়া তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। জাহান তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। সাথে আঙুলটাও ছাড়িয়ে নিলো।

জাহান হাসল। উদাসী হাসি। প্রশ্ন করল, “তোমার কী ইচ্ছা?”
মহুয়া আকাশের দিকে তাকিয়েই উওর দিলো, “আমি এই আকাশে উড়তে চাই।”
“কী?” উওরটা শুনে অবাক হয় জাহান।
“আমি এই আকাশে পাখির মতো মেঘের ভাঁজে ভাঁজে উড়ে বেড়াতে চাই। নানান আকৃতির মেঘগুলোকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। মেঘের রাজ্যে নিজের ঘর বাঁধতে চাই।”
.
.
মোহ ফেরার জন্য তাদের বাড়িতে এসেছে। তার আসার পর থেকে তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তার বাবা মোতালেব কাঁদলেন না। কিন্তু এই প্রথমবার তাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন অনেকক্ষণ। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। ছোট রাজকন্যাটাকে এত জলদি দূরে সরিয়ে দেবার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর সমুদ্র ঢুকল দুইহাত ভর্তি মিষ্টি ও ফল নিয়ে। তার মা পাঠিয়েছে। সে ভেতরে ঢুকে দেখে মোহের বাবা মেয়েকে জড়িয়ে আছেন। তার চোখের পানি দূর থেকে চিকচিক করছে। আর মা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। সে হেসে বলল, “আপনারা এত কাঁদবেন জানলে আপনাদের মেয়েকে নিয়েই যেতাম না।” তার কন্ঠে সবার হুঁশ আসে।

মোহ বাবার বুক থেকে উঠতেই দেখা যায় তার মুখ লাল হয়ে আছে। চোখে পানি নেই কিন্তু মনে হচ্ছে এই কেঁদে দিবে।
সমুদ্র এগিয়ে আসে, “আংকেল আন্টি এটা মোটেও ঠিক না, আসতে না আসতেই আপনারা আমার বউকে এভাবে জড়িয়ে কাঁদছেন? এখন যদি আমার বউ বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়? ভেরি ব্যাড।”
মা বাবার সামনে বউ ডাক শুনেই মোহ লজ্জায় মিইয়ে গেল। লোকটার আসলে লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই।
মোহের মা তার সামনে এগিয়ে এসে বলে, “বাবা এসো বসো। আর এসব কেন আনলে? তাড়াতাড়ি বসো। আমি শরবত নিয়ে আসছি। নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গেছো তুমি।”
সে জলদি যায় শরবত করতে। তার বাবাও যায় সমুদ্রের কাছে। তাকে বসায়।

দুইজনে জামাইয়ের খাতির যত্নে ব্যস্ত। মোহের দিকে তাদের খেয়ালই নেই। মোহ সেদিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দেয়। সাথে সাথে তার চিৎকার শোনা যায়। মা, বাবা, সমুদ্র তিনজন ছুটে যায় তার রুমের দিকে। যেয়ে দেখে মোহের সামনে মিতা দাঁড়িয়ে আছে।

“মা এই মেয়ে এখানে কী করছে?” রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে মোহ।
মিতা বলে, “এই বড় বোনের সাথে বেয়াদবি করছিস কেন? আমার বাসা আমি থাকব না?”
“তোমার বাসা? তুমি ভুলে গেছ যে দুইদিন আগে তুমি এই বাসা থেকেই পালিয়ে গেছো। বাসা ভর্তি মেহমানের সামনে। বাবা মা’য়ের সম্মানের কথা ভেবেছিলে একবার? বাধ্য হয়ে তোমার স্থানে আমার বিয়ে করতে হয়েছে। যেখানে আমি এত জলদি আমার জীবনে বিয়ের প্লানই করিনি।”
“তোকে কে বলেছিল বিয়েতে আমার জায়গায় বসতে?”
“কারণ তোমার কাছে আমাদের বাবা মা’য়ের সম্মান মূল্যহীন হতে পারে কিন্তু আমার কাছে জীবনে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।”

কথাটা শুনে মিতার কন্ঠস্বর নেমে গেল, “আমি আহিনকে ছাড়া বাঁচব কি-না জানতাম না।” সে মাথা নিচু করে নেয়।
“তাহলে বিয়েতে রাজি হয়েছিলে কেন? তোমাকে তো কেউ জোর করে নি। তুমি নিজে হ্যাঁ বলেছিলে।”
“ও চাকরি পাচ্ছিল না বলে প্রস্তাব পাঠাচ্ছিল না তাই জিদে…”
“জিদে? জিদে তুমি আমার জীবন শেষ করে দিয়েছ।”
মা মোহকে যেয়ে থামায়, “মোহ চুপ কর। জামাইবাবু এখানে আছে।”
মিতা বলে, “জীবন কোথায় নষ্টা হলো তোর। সমুদ্র সব দিকে দিয়ে ভালো। ছেলে ভালো, পরিবার ভালো, বংশ, অর্থ, পড়াশোনা সব ভালো।”
মোহ মিতার চোখে চোখ রেখে কড়া কন্ঠে বলে, “তুমি সব সত্যি জানো। জানো না?”
মিতা তাকায় সমুদ্রের দিকে তার চোখ নামিয়ে নেয়।

“যদি আমার জীবন নষ্ট হয়, আমার স্বপ্নগুলো অপূর্ণ থেকে যায় তাহলে আমি এই জীবনে তোমাকে ক্ষমা করব না। মনে রেখো। আমাকে নিজের চেহেরাও দেখাবে না। যাও এখান থেকে।” মোহ রাগান্বিত স্বরে বলে।
বাবাও কড়াসুরে আদেশ করেন, “মোহের মা নিজের বড় মেয়েকে বলে দেও যেন আমার সকালের কথা মনে রাখে। রুম থেকে বের হতে মানা করো ওকে। আমার আর আমার মেয়ের সামনে যেন না আসে।”
তারপর সে মোহের সামনে যায়। তার মাথায় হাত রেখে বলে, “চিন্তা করিস না মা। আরিশের পরিবারের সাথে কথা হয়েছে। ওদের আগামী সাপ্তাহে উঠিয়ে দিব। তারপর এই মেয়ে এই বাসায় আশেপাশেও ঘেঁষবে না। এই বাসার দরজায়ও ওর জায়গা নেই।”
মা আঁতকে উঠে, “কী বলছ এসব?”
“যা বলেছি শুনতে পেয়েছ। এখন এখানে কান্নাকাটি না করে জামাইয়ের জন্য টেবিলে খাবার দেও।”
বাবা সমুদ্রর কাঁধে হাত রাখে, “আসো বাবা সমুদ্র।”
মোহ ডাক দেয়, “বাবা…”
বাবা পিছনে ফিরে, “হ্যাঁ মামণি বলো।”
মোহ তাকায় সমুদ্রের দিকে, “খাবারের পর তোমার আর মা’য়ের সাথে আমার জরুরি কথা আছে।”

খাওয়াদাওয়া শেষে মোহ সময় ব্যয় করল না। তার মা বাবাকে ধরে নিয়ে গেল রুমে। তখনই মিতা উঁকি মারে ডাইনিং রুমে। কারো শব্দ না পেয়ে বের হয়। দেখে ড্রইংরুমে সমুদ্র টিভি দেখছে। সে দ্রুত যেয়ে বসে সোফায়, “হোয়াটসঅ্যাপ পার্টনার?”
সমুদ্র তাকায় মিতার দিকে, “ভালো নেই পার্টনার।”
“কেন?”
“তোমার বোনের কারণে। এই অবলা পুরুষের উপর এই দুইদিন কতটা অত্যাচার করেছে তুমি জানো? লাথি মেরে আমায় নিচে ফেলে দিয়েছে। কোমড় ব্যাথায় জিমে যাই না দুইদিন।”
কথাটা শুনে মিতা হেসে দেয়। তারপর আবার মন খারাপ করে বলে, “আমার না খারাপ লাগছে আমার কারণে মোহের সাথে এমনটা হলো। আমি অনেক খারাপ একটা কাজ করেছি। তাই না পার্টনার?”
“একদম না। সেদিন তুমি আহিনকে চুজ না করলে সারাজীবন আফসোস করতে। তোমরা দুইজন কষ্টে জীবন কাটাতে। বাঁচতে ঠিকই, কিন্তু বুকের এক কোণে থেকে যেত একরাশ আফসোসের দীর্ঘশ্বাস।”
মিতা হাসার চেষ্টা করে, “থ্যাঙ্কিউ সমুদ্র তুমি না থাকলে আজ হয়তো আমি আহিনকে পেতাম না। আমি বিয়েরদিন পর্যন্ত নিজের জেদ ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু যখন আহিন ফোন করে কান্না করলো তখনই আমার মন গলে গেল। তখন কোনো উপায় পাচ্ছিলাম না আমি। তোমাকে ফোন দিলাম আর তুমি আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিলে। সব ব্যবস্থা করে দিলে। আমি তোমার এই ঋণ কখনো শোধ করতে পাড়ব না। থ্যাঙ্কিউ সমুদ্র, থ্যাঙ্কিউ।”
“ধ্যুর পার্টনার। ফ্রেন্ডশিপে নো সরি, নো থ্যাঙ্কিউ।”
.
.
“সরি বাবা, সরি মা কিন্তু আমি এই বিয়ে রাখতে চাই না।”
মোহের এহেন কথা তার বাবা মা আকাশ থেকে পড়ে। মা তো ক্ষেপে যায়, “এসব কী বলছিস তুই। বিয়ে কী ছেলেখেলা এই করলি আর এই ভেঙে দিলি? এমন কথা ভাবতে পাড়লি কি করে তুই? সমুদ্র বাবা কত ভালো, কত ভদ্র! তোর ভাগ্য কত ভালো জানিস!”

বাবা শান্ত গলায় বলেন, “এত কথা না বলে আমার মেয়ের কথা শুনতে দেও। আমি জানি, আমার মোহ অনেক বুদ্ধিমতী। বড় কারণ না থাকলে এই কথা কখনো বলবে না। মোহ, মামণি তুমি বলো।”
মোহ বলল, “ছেলেখেলা না বলেই তো ভাঙার কথা বলছি। তোমরা জানো সে কী বলেছে? প্রথম দিনই তার প্রেম কাহিনি শুনিয়েছে।”
“তো প্রাক্তন থাকতেই পারে। তোর বাবারও ছিলো।” বলে মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মোহের বাবার দিকে। বাবা তাকালেন না। আমতা-আমতা করে বললেন, “আহা মেয়েকে কথা তো বলতে দেও।”
“যেদিকে আমি ছেলের দিকে তাকাই নি সেদিকে তোর বাবা পুরো একবছর প্রেম করেছে।”
মোহ তাদের খুনসুটিতে ধ্যান না দিয়ে নিজে বলল, “উনার এখনো উনার প্রাক্তনের সাথে যোগাযোগ আছে। এমনকি গতকাল রাতেও ফোনে কথা বলেছিলেন। শুধু এটাই না উনি বলেছেন এখনও সে মেয়েকেই ভালোবাসে, আমাকে মেনে নিবে না। এমনকি উনি বিয়ে করতে চান না বলে আপুকেও পালাতে সাহায্য করেছেন।”

মোহের মা বাবা একে অপরের দিকে তাকালেন। হয়তো কি বলবেন ভেবে পাচ্ছে না। সবার আগে মা বললেন, “আমি বেয়াইনের সাথে কথা বলব? যদি জামাইকে বুঝায়।”
“সে সব জানে মা।”
বাবা বললেন, “আমার তোমার উপর ভরসা আছে। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে ভুল হবে না।”
মোহের মা তখন বললেন, “এসব কী বলছো? বাচ্চা মেয়ে একটা। ওর উপর সব সিদ্ধান্ত কীভাবে ছাড়তে পারো? সমাজের কথা ভেবেছ? ডিভোর্সিদের এই সমাজে কীভাবে দেখে জানো না?”
“আহা মোহের মা চুপ করো।”

বাবা চেয়ার থেকে উঠে মোহের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মোহের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমার মোহ মামণি বয়সের তুলনায় অনেক বুদ্ধিমান। ও কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না। সমাজের জন্য তো আমার মেয়ে সারাজীবন নিজের মন মে’রে বাঁচতে পাড়বে না। আমার মেয়ে কখনো আমার সম্মানহানি করে নি উলটো সম্মান বাড়িয়েছে। আমি চাই না আমার মেয়ে একসময় আমাদের দোষারোপ করুক যে আমাদের সম্মান বাঁচাতে যেয়ে ওর জীবন শেষ হয়ে গেছে।”
এই কথা শুনে মা কিছু বললেন না।

বাবা আবার মোহকে বললেন, “মামণি তুমি আমার সৌভাগ্য জানো। তোমার মতো মেয়ে পাওয়াটা আমার ভাগ্য। তুমি আমার গর্ব। তুমি কখনো আমার কথা ফেলো নি। এমনকি বিয়েরদিন এই আসহায় বাবার একটিবার জিজ্ঞেস করায় তুমি রাজি হয়ে গেলে। জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিতীয়বার ভাবলে না। আজ আরেকটা জিনিস চাইব, দয়া করে রাখবে?”
মোহ সাথে সাথে তার বাবার হাত মাথা থেকে নামিয়ে নিজের হাতে নিলো, “এভাবে বলো না বাবা।”
“ছয়মাস সময় দেও তোমাদের এই সম্পর্কের। ছয়মাস। আমি চাই না আমার মেয়ে লড়াই ছাড়া হেরে যাক। আমার এত লক্ষ্মী মেয়েকে কেউ ভালোবাসবে না এত কঠিন মনের মানুষ হয় না’কি? ছয়মাস পর যদি তোমার মনে হয় এই সম্পর্ক টিকবে না তাহলে এসে পড়বে। এই বাসা তো তোমারই। আমি নিজে তোমার জন্য তালাকনামা তুলে আনব। এই ছয়মাস নিজের বাবার জন্য এই সম্পর্কে থাকবে?”
মোহ কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার বাবার দিকে। তারপর বলল, “আজ পর্যন্ত তোমার কোনো কথা অমান্য করেছি আমি?”

মোহ মা বাবার সাথে কথাগুলো বলে বের হয়। ড্রইংরুমে শব্দ শুনে সেদিকে যেয়ে দেখতে পায় সমুদ্র ও মিতা গল্প করছে। তাদের দুইজনকে হাসতে দেখে বিরক্তি লাগে মোহের। এই দুইজনের কারণে তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। সে বিরক্তি নিয়ে যেতে নিলেই ডাক দেয় সমুদ্র, “এই মধু কোথায় যাচ্ছো? আসো, বসো। তিনজনে গল্প করি।”
মোহ তার দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। চোখ রাঙিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। সমুদ্র মিতাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার বোনের বয়স সবে উনিশ। এই পিচ্চি মেয়ে চোখ দিয়ে আমাকে শাঁসাচ্ছে। ভাবতে পারো?”
মিতা হাসল, “ও ছোট বয়স থেকেই বড়দের মতো বিহেভ করে। ম্যাচুরিটি দেখায়।”
“দেখে আসি। তোমার অমধু বোনের আবার কী হলো?”

সমুদ্র মোহের পিছু পিছু যায়। যেয়ে দেখে মোহ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে বিছানার এক কোণায়। আড়চোখে সমুদ্রকে দেখতেই হাতে ফোন নিলো। তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই মোহের।
“এই মধু শুনো…” সমুদ্র তার টেবিলের চেয়ার টান দিয়ে নিলো জানালার কাছে।
“আমার নাম মধু নয়, মোহ কিংবা মধুরা ডাকেন।”
“এত ক্ষেপে আছো কেন গো? আংকেল আন্টি বকা দিলো না’কি?”
“আমার বাবা আমায় বকে না। আর আমি বকার মতো কাজও করি না। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম।”
সমুদ্র মোহের বুকসেল্ফের দিকে চোখ বুলাল। জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“আমি চেয়েছিলাম সম্পর্কটা ভেঙে দিতে। বাবা ছয়মাস সময় নিতে বলল।”
“তারপর?”
“আমি কখনো বাবার কথা অমান্য করি না।”
“এইতো তো ভুল করলে মধু। বাবার কথা অমান্য করলে ছয়টা মাস তোমার নষ্ট হতো না, বিয়ে করতে হতো না, এই কিশোরী বয়স প্রেমহীন কাটতো না। প্রথম প্রেমের মিষ্টি অনুভূতিগুলো অপূর্ণ থাকতো না। ভুল করলে মধু, সাংঘাতিক ভুল।”
মোহ ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় বলে, “আপনার উপদেশ চেয়েছি?”

সমুদ্র বুকসেল্ফ থেকে একটি বই বের করে।
দেবদাস।

শরৎচন্দ্রের বইটি বের করে সে জানালার কাছে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলে, “এত প্রেমের উপন্যাস পড়লে তো মনটা প্রেম প্রেম করবেই। না এত প্রেমের উপন্যাস পড়তে আর না মিথ্যে স্বপ্ন সাজাতে। এই তোমার প্রেম ট্রেমে ইন্টারেস্ট না থাকলে আমরা বন্ধুত্ব দিয়ে সুখে একসাথে থাকতে পাড়তাম। সব এই উপন্যাসের দোষ।”
“আপনার সাথে বন্ধুত্বে আমার ইন্টারেস্ট নেই।”

সমুদ্র বইটি খুলে, “বলো তো মধু দেবদাস উপন্যাসে সবচেয়ে অভাগা কে ছিলো? পার্বতী? দেবদাস? না’কি চন্দ্রমুখী?”
“আপনার কী মনে হয়?”
“যার গল্পে উপন্যাস লেখা নিশ্চয়ই সে হবে।”
“অবশ্যই সে না।”
“প্রেমের কারণে সব হারাল যে সে নয়? পরিবার, ভালোবাসা, সম্পত্তি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল। হারাল তো হারাল, বেচারা জীবনও হারাল।”
“অবশ্যই সে নয়। দেবদাসরা ম’রে মুক্তি পায়, জ্যান্ত পুড়ে তো পার্বতী ও চন্দ্রমুখী। পার্বতী তো তবুও ভালোবাসা পেয়েছিল কিছু সময়ের জন্য হলেও। চন্দ্রমুখী? সে কী পেল? দেবদাস শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত পারুকে চাইল, তার চৌকাঠে নিশ্বাস ত্যাগ করল। চন্দ্রমুখীর মধ্যেও খুঁজল পার্বতীকে। এত ভালোবাসলো। আর চন্দ্রমুখী সে কী পেল তার ভালোবাসার বিনিময়ে। দেবদাস কী এক মুহূর্তের জন্য তাকে ভালোবেসেছিল? এক মুহূর্তের ভালোবাসাও তার কপালে জুটে নি।”
“বলছ দেবদাস সবচেয়ে সুখী চরিত্র ছিলো?”
মোহ এ পর্যায়ে তার মুখের সামনে থেকে ফোন সরাল। তাকাল সমুদ্রে দিকে। তাচ্ছিল্য হেসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী নিজেকে দেবদাস মনে করছেন? নিজের জীবনকে দেবদাসের সাথে মিলাচ্ছেন?”
“মন্দ কী? দেবদাসের মতোই তো জীবন। এই’যে প্রেমে পড়লাম, তার বিয়ে হলো অন্যকারো সাথে, আমি আজও ভুগছি এই হতাশায়।”
“দেবদাস ছিলো ভন্ড। নিজে ছেড়ে গেল পার্বতীকে। পরিবারের সামনে কথা বলতে পাড়ল না। আর বিয়েরদিন তার প্রেম উতলে পড়ছিল? প্রেম আর মানুষ করে না? বিরহ হলেই সব ছেড়ে দিয়ে দেবদাস হতে হবে?”
“সব ছেড়েছিল বলেই তো আজও প্রেমে বিরহী পুরুষদের দেবদাস বলে, নাহলে মনে রাখতো কে?”

মোহ তাচ্ছিল্য হাসে, “তো আপনি সব ছেড়ে দেবদাস হতে চাচ্ছেন বুঝি? দেবদাস কিন্তু বিয়ে করে নি। আপনি করে ফেলেছেন। একারণে আপনাকে দেবদাসের খেতাব দেওয়া হবে না। যদি বিয়ে না করে চন্দ্রমুখীকে খুঁজতেন তাহলে হয়তো দেবদাস হতে পাড়তেন।”
“আমার জীবনে পারুই ছিলো, দ্বিতীয় চন্দ্রমুখীর স্থান নেই।”

চলবে…