মেঘের খামে…
পর্ব ১৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মোহ তাচ্ছিল্য হাসে, “তো আপনি সব ছেড়ে দেবদাস হতে চাচ্ছে বুঝি? দেবদাস কিন্তু বিয়ে করে নি। আপনি করে ফেলেছেন। একারণে আপনাকে দেবদাসের খেতাব দেওয়া হবে না। যদি বিয়ে না করে চন্দ্রমুখীকে খুঁজতেন তাহলে হয়তো দেবদাস হতে পাড়তেন।”
“আমার জীবনে পারুই ছিলো, দ্বিতীয় চন্দ্রমুখীর স্থান নেই।”
মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বুকে হওয়া সূক্ষ্ম ব্যাথাটা প্রকাশ করল না, “আপনি কী ডিবেট টিইমে ছিলেন আগে?”
“কীভাবে বুঝলে?”
“তর্ক করে হাঁপিয়ে গেছি।”
“আইস্ক্রিম খাবে?”
“খাওয়াবেন?”
“চলো যাই। ভালো কোনো আইস্ক্রিম পার্লার আছে? তোমার কোন ফ্লেভার পছন্দ?”
“বাটারস্কচ বা ওরিও আইস্ক্রিম। আপনার?”
“মিন্ট চকোলেট ।”
“ইউ…. আপনার টেস্ট বাজে।”
“তুমি স্বাদ বুঝো না। আচ্ছা মিতাকে নিয়ে যাব? আহিনকেও ডাকলাম। মজা হবে।”
মোহ বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়, “আপনি চান আপনার আইস্ক্রিমে আমি সুপার গ্লু মিশিয়ে দেই?”
সমুদ্র ডানেবামে মাথা নাড়ায়। মোহ উঠে আদেশের সুরে বলে, “তাহলে আসুন।”
সমুদ্র হেসে উঠে পড়ে। পিছু যায় মোহের। মোহ তার মা’কে বলে বের হয় সমুদ্রের সাথে। ঘরের জামা পড়েই বের হয়। হাল্কা গোলাপি রঙের একটি সুতি জামা। মুখে কোনো প্রসাধনী নেই। চুলগুলো খোঁপা করা ছিলো তা ছেড়ে ক্লেচার দিয়ে বেঁধে নিলো।
রাস্তার পাশাপাশি হাঁটছে সমুদ্র, মোহ। দুইজনে চুপচাপ। হঠাৎ সমুদ্র তার হাত ধরল। সাথে সাথে ধুক করে উঠে মোহের বুকটা। নিশ্বাস আটকে আসে এক মুহূর্তের জন্য। নিশ্বাস নিতে যেন ভুলেই যায়। শিরশির অনুভূতি হয় তার লোমকূপে। মুহূর্ত না গড়াতেই এক টান অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে এক গাড়ি দ্রুত যাচ্ছিল। সমুদ্র তাকে রাস্তার পাশ থেকে সরিয়ে নিজে গেল। হাতটা ছেড়ে দিলো। ব্যাপারটা ভালো লাগলো মোহের। সে সবসময় মহুয়া এবং মৃণাকে এভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করে। সে সাবলম্বী। তাই তাকে রক্ষা করার কারো প্রয়োজন হয় নি। কিন্তু আজ সমুদ্রের তাকে রক্ষা করাটা ভালো লাগলো তার। মনের ভেতর কেমন ভালো লাগা কাজ করল। সে আড়চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে। নিচের ঠোঁটের কিছু অংশ কামড়ে হাসে। এই নীরব মুহূর্তটাও সুন্দর লাগলো তার কাছে।
আইস্ক্রিম শপে মোহ বসে ছিলো এক চেয়ারে। সমুদ্র গেছে দুইজনের জন্য আইস্ক্রিম নিতে। হঠাৎ একটি ছেলে এসে দাঁড়ায় মোহের সামনে। কলেজের ইউনিফর্ম পরা।
“মোহ… আপু।”
মোহ ফোন থেকে নজর সরিয়ে তাকায় তার দিকে।
“আরে সাকিব কেমন আছো?”
ছেলেটা হঠাৎ কর্কশ কন্ঠে বলে,
“আপনি অনেক খারাপ আপু। অনেক নির্দয়।”
মোহ থতমত খেয়ে গেল। ছেলেটার সাথে তার কেবল দুইবার কথা হয়েছে। এবার সে ইন্টার ফার্স ইয়ারের। তার মা সহ তার কলেজের বই নিতে এসেছিল। আরেকদিন রাস্তায় দেখা। এ থেকে তাকে এমন কেন ব্লছে সে বুঝতে পারে না।
“আমি কী করেছি সাকিব?”
সাকিব কান্না কান্না কন্ঠে বলল, “আপনি বিয়ে কেন করলেন আপু? আর ছয় সাত বছর অপেক্ষা করলে আমি আপনাকে বিয়ে করতাম। আপনি কেন বিয়ে করলেন? আপনি অনেক খারাপ। অনেক।” বলে সে ক্ষেপে চলে যায়।
মোহ হা করে তাকিয়ে থাকে। কী হলো এটা! সে দেখে সমুদ্র হাসতে হাসতে আসছে।
“কী সাংঘাতিক প্রাপোজাল ছিলো ভাই। এই তোমার প্রেমিকদের নমুনা?”
মোহ লজ্জায় পড়ে। এই ঘটনাটা সমুদ্রের সামনেই ঘটতে হলো?
সমুদ্র বলে, “তুমি আসলেই পপুলার। রাস্তায় আসার সময়ও ছেলেরা তোমার দিকে দু:খভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল আর আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিল যেন খেয়ে ফেলবে।
ফিক করে হাসল মোহ। আইস্ক্রিমে বাইট দিয়ে বলল, “ইয়ামি।”
মোহ আড়চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে। আচমকা তার আইস্ক্রিমে বাইট বসিয়ে দেয়।
“এটা কী হলো?” সমুদ্র অসহায়দের মতো তাকায় মোহের দিকে।
“শাস্তি দিয়েছি।”
“কীসের শাস্তি?”
“আমার উপর হাসার শাস্তি।” বলে মুখ বাঁকাল।
“তুমি আসলেই নির্দয়া মধু।”
মোহ হাসে। ধীর শব্দে বলে, “আপনার সাথে বন্ধুত্ব করাই যায়।”
“কী বললে?”
“বললাম আপনি মজার মানুষ। বন্ধু হিসেবে মন্দ না।”
“আমার নয় বছর ছোট মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করলে মান সম্মান থাকবে না। তাও বউ বলে করলাম। ফ্রেন্ডস?”
সমুদ্র হাত বাড়ায়। মোহও হ্যান্ডশেক করর, “ফ্রেন্ডস।”
মোহ বলে, “এই খুশিতে আরেকটা বাইট দিতাম কিন্তু আপনারটার টেস্ট খারাপ। মনে হচ্ছে টুথপেষ্ট খাচ্ছি।”
“তাহলে তোমারটা দেও দেখি।”
“আসছে। আমারটা কেন দিব?”
“তুমিও তো আমারটা খেলে।”
“আমি আপনার আইস্ক্রিম খেতে পাড়ব, আপনি আমারটার দিকে তাকাতেও পাড়বেন না।”
.
.
.
মুরাদ অফিস থেকে এসে দেখে মা ও মৃণা ড্রইংরুমে বসে গল্প করছে। সে এসে নিজের টাই লুজ করে গা এলিয়ে বসলো অন্য সোফায়, “আম্মু একটু শরবত দিতে পাড়বে।”
মা ভ্রু কপালে তুলে বলে, “তুই তো অফিস থেকে সোজা রুমে যেয়ে শাওয়ার নিয়েই আসিস। আজ কী হলো? তোর শরীর ঠিক আছে তো?”
“ক্লান্ত লাগছে।”
“তুই বস এক্ষুণি নিয়ে আসছি।”
মা’য়ের পিছনে মৃণাও যায়। একটু পর সে আসে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে। মুরাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “আন্টি বলেছে আরেকটু বসতে। নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছে।”
বলে যেতে নিলে মুরাদ ডাক দেয়, “এই শুন…”
“জ্বি ভাইয়া?”
“তুই আম্মুর পিছে এতো ঘুরঘুর করিস কেন? তোর আর কোনো কাজ নেই?”
মৃণার কথাটায় মুখ লটকে যায়। সে মাথা নিচু করে নেয়।
মুরাদ বলে, “কাজ নেই বলেই তো এত ঘুরঘুর করিস। নে তোকে কাজ দিচ্ছি।” বলে একটি খাম তার দিকে এগিয়ে দেয়।
“কী ভাইয়া এখানে?”
“এপোয়েন্টমেন্ট লেটার। আমার এসিস্ট্যান্টের না’কি এসিট্যান্ট লাগবে। ক’দিন ধরে মাথা খেয়ে ফেলছে। ভাবলাম তুইও চাকরি দেখতে বলেছিলি তাই তোকে দেই। পড়াশোনার পাশাপাশি পাড়বি তো?”
মৃণা একগাল হেসে বলে, “পাড়ব ভাইয়া। অবশ্যই পাড়ব। থ্যাঙ্কিউ দো মাচ ভাইয়া।”
“কিন্তু চাকরি করায় পড়াশোনার ক্ষতি হলে তোর খবর আছে। ফার্স্ট থেকে সেকেন্ড হতে পাড়বি না।”
“ওকে ভাইয়া।”
মুরাদ বিরক্তির সুরে বলে, “এই তোকে না বলেছি মহুয়াই কেবল আমার বোন। আমি তোর কোন জনমের ভাই লাগি? প্রতিবাক্যে এক কচু বলোস?” বলে সে উঠে যেতে নিলে মৃণা বলে, “ভাইয়া নাস্তা খেয়ে যাবেন না?”
“রেডি হলে আমার রুমে নিয়ে আসিস।”
“আচ্ছা ভাইয়া।”
মৃণা দাঁড়িয়ে আছে মুরাদের দরজার সামনে। কতক্ষণ ধরে নক করছে দরজা খুলছেই না। সে আর অপেক্ষা না করর ভেতরে গেল। কাটলেট ঠান্ডা হয়ে যাবে যে! ভেতরে যেয়ে দেখতে পায় মুরাদ রুমে নেই। সে বিছানার পাশের টেবিলে ট্রে রেখে যেতে নিবে তখন দেখে মুরাদ ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। কেবল টাউজার পরা। কোনো শার্ট গেঞ্জি পরা নেই। মুহূর্তে মৃণার চক্ষুদ্বয় বড় হয়ে যেতেই নিজের চোখের উপর হাত রেখে দেয় মৃণা। অস্বস্তিতে আমতা-আমতা করে, “ভাইয়া.. ওই নক দিচ্ছিলাম…ওই কেউ ছিলো…. নাই তাই…আমি যাই। সরি ভাইয়া…সরি।” বলে চোখের উপর হাত দিয়ে দৌড়ে যেতে নিলেই কিছুতে লেগে পড়ে যেতে নিলেই মুরাদ তাকে হাত ধরে নেয়।
মৃণা আঁতকে উঠে চোখ থেকে হাত সরায়। একটুর জন্য মেঝেতে পড়ে নি। মুরাদ সঠিক সময় তার হাত ধরে নিয়েছে। সে শান্তির নিশ্বাস ফেলে।
মুরাদ হাত হাত ধরে টান দিতেই সে যেয়ে পড়তে নেয় মুরাদের উদাম বুকে। খানিকের জন্য নিজেকে সামলে নেয়। এসময় ভীষণ সুন্দর একটা ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগে। মৃণা চোখ তুলে তাকাতেই দৃষ্টি মিলন হয় দু’জনের। এক মুহূর্তের জন্য। সাথে সাথে মৃণা দৃষ্টি নামিয়ে নেয় লজ্জায়, অস্বস্তিতে।
“সরি মুরাদ ভাই।” মৃণা মাথা নামিয়ে বলে। তার দিকে আরেকবার তাকিয়ে যেতে নিলেই মুরাদ ডাক দেয় তাকে, “দাঁড়া, যেতে বলেছি তোকে?”
মৃণা থেমে যায়। দরজার কাছে এসে। কিন্তু পিছু ফিরে তাকায় না, “জ্বি বলেন।”
“তোর বান্ধবী কোথায়? ঘরে তো মনে হচ্ছে নেই। ও ঘরে থাকলে ঘরে এমন শান্তি থাকে?”
“কল দিয়েছিলাম। বলল একটু ঘুরতে গেছে। এসে পড়বে।”
এতক্ষণে মুরাদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃণা তাকে গেঞ্জি পরা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তার দৃষ্টি একইভাবে নত থাকতে দেখে মুরাদের খুব বিরক্তি লাগে। সে ডান হাতের প্রথমা আঙুল দিয়ে মৃণার থুতনিতে রেখে মুখ উঁচু করে। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “এভাবে মাথা নিচু করে কথা বলিস কেন? কথা বলার সময় দৃষ্টি লুকালে মানুষ তোকে দুর্বল ভাববে। চোখে চোখ রেখে কথা বলবি। বুঝেছিস?”
মৃণা আবারও মাথা নিচে নামায়, নরমস্বরে বলে, “বুঝেছি।”
মুরাদ গভীর নিশ্বাস ফেলে, “তোমাকে ঠিক করতে আমার অনেক কষ্ট পোহাতে হবে। অনেক ধৈর্য্য লাগবে।”
মৃণা তাকায় তার দিকে। সরল মুখে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
মুরাদ হাসে, “কিছু না। ধৈর্য্য রাখতে আমার আপত্তি নেই। এবার যা।”
“আচ্ছা।”
সে যেতে নিলে মুরাদ আবার তাকে থামায়, “আচ্ছা মৃণা শুন।”
মৃণা পিছনে ফিরে তাকায়, “জি?”
“তোর বয়ফ্রেন্ডের খবর কী?”
“তন্ময়ের কথা বলছেন? তাকে আমার বয়ফ্রেন্ড বলবেন না মুরাদ ভাই। সে এখন অন্যকারো বয়ফ্রেন্ড। অন্যকারো মানুষের পিছুটান ধরে লাভ নেই, আপনিই তো বুঝালেন।”
মুরাদ প্রশস্ত হাসে, “আচ্ছা ময়না যা। আগামী রবিবার থেকে জয়েন করবি অফিস।”
মৃণা যায় সেখান থেকে মহুয়ার রুমে। ফোন নিয়ে কল দেয় মহুয়াকে। মুরাদ ভাই তার কথা জিজ্ঞেস করেছে। দেরি করে আসলে যদি রাগারাগি করেন? এমনিতেই মুরাদ ভাইকে কেন যেন সে ভয় পায়। কথায় কথায় বলে থাপ্পড় দিব। যদি কোনোদিন সত্যি দিয়ে দেয়?
মহুয়াকে কল দিয়ে জানিয়ে দেয় সে। তন্ময়ের কথা উঠায় তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করল মৃণার। কয়দিন ধরে ফোনও তেমন ব্যবহার করছে না। ফোন বন্ধ রাখা হয়। কোনো সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঢোকা হয় না। আজ ফেসবুকে ঢুকে তন্ময়ের পেইজে যায় সে। প্রথমেই একটি এওয়ার্ডসহ তন্ময়ের ছবি দেখে সে খুশিতে লাফিয়ে বসে বিছানায়। তারপর স্ক্রল করতে শুরু করে। গতকাল বছরের সেরা গায়কের এওয়ার্ড পেয়েছে সে। তার মনে হলো অন্তত একবার তন্ময়কে কল দিয়ে অভিনন্দন জানানো উচিত। অন্যকেউ না জানলেও সে জানে তন্ময় এই দিনটার জন্য কত অপেক্ষা করেছে। অন্যকেউ না দেখলেও সে দেখেছি সারাদিনের পরিশ্রম, সে শুনেছে নির্ঘুম রাতের তার ক্লান্ত কন্ঠ।
স্ক্রল করতে করতে একটি ভিডিও আসে তার সামনে। স্টেজে তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে একটি এওয়ার্ড হাতে নিয়ে। মাইকে বলছে, “এই এওয়ার্ডটা আমার বহু অপেক্ষার। এতবছর এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। থ্যাঙ্কিউ এই মুল্যবান জিনিসটা আমাকে দেবার জন্য। ধন্যবাদ জানাই আমার ফ্যানদের যাদের কারণে এটা আমার হাতে, আমার মা বাবা, সহকর্মীদের, আর লাস্ট বাট নট দ্যা লিস্ট আমার ভালোবাসার মানুষকে যে আমাকে এই এওয়ার্ডের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে ইফতে খাতুন বুশরাকে।”
ভিডিও শেষ হয়ে যায় অথচ মৃণা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে। তার নয়ন সিক্ত হয়ে উঠে। তারপরও মৃদু হাসে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে। আননোওন নাম্বার। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা তুলে, “আসসালামু আলাইকুম। কে? ”
ওপাশ থেকে একটি পুরুষালি কন্ঠ শোনা যায়, “মৃণা তুমি কী ঠিক আছো? তোমার ফোনে কল যাচ্ছে না কেন? আমি গত তিনদিনে কতবার তোমাকে কল দিয়েছি ধারণা আছে?”
“কেন দিয়েছ?”
“কেন দিয়েছি মানে? তুমি ওদিন কল দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে। আমি কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম তুমি জানো? তারপর থেকে তোমার ফোন বন্ধ। কী হয়েছিল?”
মৃণা কিছু সময় চুপ থেকে উওর দেয়, “এমনি কল দিয়েছিলাম।”
“তাহলে ফোন বন্ধ ছিলো কেন?”
“ফোনে সমস্যা ছিলো।”
“তাই বলো। তোমার ফোনে আসলে সমস্যা। তোমাকে অনলাইনে দেখেও আমার নাম্বার থেকে কল দিয়েছিলাম যায় নি তারপর ফ্রেন্ড থেকে ফোন নিয়ে কল দিলাম। ফোন ঠিক করবে জলদি।”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা শুনো একটা খুশির খবর আছে।”
“কী?”
“আমি এবছরের সেরা গায়কের এওয়ার্ড পেয়েছি।” ওপাশ থেকে উৎসুক কন্ঠ শোনা গেল। কিন্তু মৃণা আগের মতো অনুভূতিশূন্য কন্ঠেই উওর দিলো, “অভিনন্দন।”
“তুমি খুশি হও নি?”
“এখানে আমার খুশি হবার কী আছে? তুমি পেয়েছ তুমি খুশি হলেই তো হলো।”
“কী বলছ এসব? আমি যতবার হার মেনে নিয়েছিলাম এই প্রফেশন ছাড়তে চেয়েছিলাম তুমি আমাকে সাহস দিয়েছ। তুমি আমার থেকে বেশি আমাকে ভরসা করেছ। তুমি সর্বপ্রথম আমার গান শুনতে। এই গানটাও তো তুমিই বেছে দিয়েছিলে। মনে নেই?”
“মনে পড়ছে না।”
“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন মৃণা? তুমি জানো এওয়ার্ড পাওয়ার পর তোমাকে ব্যাপারটা জানাতে আমি কত উৎসুক ছিলাম? ব্যাকস্টেজে যেয়ে সর্বপ্রথম তোমাকে দিয়েছি। গতকাল থেকে প্রতিঘন্টায় পনেরো বিশবার করে কল দিচ্ছি। কাল সারারাত জেগে তোমাকে কল দিয়েছি। আর তুমি এভাবে কথা বলছ?”
মৃণা এবার বেশ খানিক্ষণ চুপ থাকে। তাকে চুপ থাকতে দেখে তন্ময় বলে, “কিছু তো বলো।”
“তন্ময় শুনো…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।”
“বুশরা আপু যদি জানে তোমার সাথে আমার এখনো কথা হয় তাহলে কষ্ট পাবে। আমাদের আর কথা বলা উচিত না।”
আঁতকে উঠে তন্ময়, “কী বলছ তুমি? এমন কিছু হবে না। হলেও আমি সামলে নিব।”
“দরকার কী? কথা না বললেই তো হলো।”
“না, হলো না। তুমি জানো মৃণা আমি তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না। তোমার কন্ঠ না শুনলে আমার ঘুম আসে না। তুমি জানো গত দুইটা রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি।”
“মানুষ অভ্যাসের দাস। সাত বছরের অভ্যাস ছুটতে সাতদিন তো অন্তত লাগবে। রাখি তাহলে?”
“তুমি এমন কেন করছ মৃণা। এমন নিষ্ঠুরতা করো না। আমার মৃণা তো তো নিষ্ঠুর না।”
“আমি তোমার না। তুমি এখন অন্যকারো সাথে সম্পর্কে আছো একথা বলতেও তো দ্বিধাবোধ করা উচিত তোমার। তুমিই না ওদিন বললে বুশরা আপু আমার সাথে কথা বলার কথা জানলে রেগে যাবেন। তাহলে অকারণে সম্পর্কে ভেজাল ধরানোর দরকার কী? আর আমরা কেন কথা বলব? কী সম্পর্কের অধিকারে কথা বলব। আমাদের মাঝে তো কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই?”
“কী সম্পর্ক আছে বলো?”
তন্ময় কিছু সময় স্থির থেকে বলে, “বন্ধুত্বের?”
মৃণা হেসে বলে, “বন্ধুত্ব প্রেমের আগে থাকে। পড়ে না। ভালো থেকো তন্ময়। আমি দোয়া করি এমন এওয়ার্ড তুমি প্রতিবছর পাও। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ হোক। সেরা গায়ক হবার, জনপ্রিয় হওয়ার, তোমার মা বাবার নিকট নিজেকে প্রমাণ করার এবং…. বুশরা আপুকে পাওয়ার। রাখি তন্ময়। আজ এই কলের সাথে আমাদের মায়ার সম্পর্ক এখানেই শেষ হলো।” বলেই সে কল কেটে দেয়। আর বন্ধ করে দেয় ফোন।
স্থির হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে মৃণা। অদ্ভুতভাবে আজ তার কান্না আসছে না। কিন্তু বুকের ভেতটা কেমন ভারী লাগছে।
.
.
মৃণার কল পাবার পর জাহান জিজ্ঞেস করে, “বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে? স্পিড বাড়াব?”
“আরে না। মৃণা অকারণে চিন্তা করে। আপনি উল্টো একটা বেকরিতে গাড়ি থামান। খাবারের টাকা যেহেতু ভাগ করতে দেন নি সুইটস আমার ট্রিট।”
“তোমার ট্রিট দেবার প্রয়োজন নেই।”
“কীভাবে নেই? আমি কারো ঋণ রাখি না।”
“তাহলে যেদিন তুমি নিজে কামাই করবে ওদিন তোমার টাকা দিয়ে খাইয়ো।”
“এহ এভাবে বলছেন যেন আপনি নিজের টাকা দিয়ে খাইয়ে এনেছেন। আমি আমার ভাইয়ের টাকা খরচ করলে আপনিও তো আপনার বাবার টাকা খরচ করছেন।”
“না ম্যাডাম, আমি আমার টাকাই খরচ করছি।”
“আচ্ছা কী কাজ করেন আপনি তাহলে?”
“ষোল বছর বয়স থেকেই বাবা আমাকে বলেছে পার্ট টাইম জব করতে। আমি ক্যাশে জব করেছি শো রুমে। আঠারো বছরে একটি কোম্পানিতে দুইবছর পার্ট টাইম জব নিয়েছি। ভার্সিটিতে উঠার পর বাবা আমাকে নিজের কোম্পানিতে যুক্ত করেছেন। এমনকি আমার পাইলটসহ অন্যান্য স্টাফদের কাজেরও ট্রেনিং চলছে। সো আমি বাপের হোটেলে আকাইম্মা খাই না। তুমি মনে করছ আমার বাবা অনেক বড়লোক তাই আমি হয়তো বাবার টাকা উড়াব এমন ছেলে। কিন্তু আঠারো বছর পর থেকে বাবা আমাকে হাত খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং ভার্সিটিতে উঠার পর পড়াশোনার খরচও বন্ধ করে দিয়েছে।”
তার কথা অবাক হয় শুনে, “বলছো কী?”
“জ্বি। বাবা নিজে অনেক পরিশ্রম করে এসব দাঁড় করিয়েছেন তাই তিনি চান তার ছেলে মেয়েও পরিশ্রমের মূল্য বুঝুক। আর যারা পরিশ্রম করে তাদের সম্মান করুক। কাওকে যেন ছোট না ভাবুক। ইনফ্যাক্ট জিনিও এখন পার্টটাইম জব করে।”
“তোমার বাবা তো আমার ভাই থেকে বেশি ডেঞ্জারাস। আমার ভাই তো তাও বলছে জব না করা পর্যন্ত বিয়ে দিবে না।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে ব্রেক কষে জাহান। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় মহুয়ার দিকে, “তু…তুমি মজা করছ তাই না?”
“এই ব্যাপারে মজা কেন করব?”
“তোমার গ্রাজুয়েশনে কয় বছর বাকি?”
“যদি পাশ করি তাহলে চারবছর। যদিও এর সম্ভাবনা খুব কম।”
জাহান নিজের বুকের বাম পাশে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আমার হৃদয় এত বছরের অপেক্ষা কীভাবে সহ্য করবে?”
মহুয়া মুখ বানিয়ে বলে, “ঢঙ না করে গাড়ি চালাও। জ্যাম লাগলে লোক এসে ধোলাই দিয়ে কাকতারুয়া বানায় দিবে।”
জাহান পুণরায় গাড়ি চালানো শুরু করল উদাসীন মুখ নিয়ে। হঠাৎ করে কি ভেবে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “এত দীর্ঘশ্বাস ফেলছো কেন?”
“ভাবছি আমার যে বউ হবে সে তো পড়াশোনায় শুধু লাড্ডু মারে। টেনে টুনে পাশ করবে কবে, গ্রাজুয়েশন করবে কবে, জব পাবে কবে আর আমি বাসররাত করব কবে।”
“ওহ।” কথাটা মুখ দিয়ে বের করে তার টনক নড়ে। সাথে সাথে সে চেঁচিয়ে উঠে, “শালা নিলজ্জ কী ভাবতাছিস তুই? আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবলে গাড়ি থেকে লাথি মেরে ফেলে দিব। ছিঃ!”
জাহান শব্দ করে হাসে তার কথায়, “ম’রার পরও তোমার পিছু ছাড়ব না। ভূত হয়ে তোমার ঘাড়ে চড়ে থাকব। মানুষ থেকে তো ভয় পাও না তাই ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে পড়াবো। গ্রাজুয়েশন করার পর বাস….”
মহুয়া তার মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে, “এই শব্দ উচ্চারণ করলে ভালো হবে না।”
জাহান আলতো করে মহুয়ার হাতে চুমু খেতে সে হাত সরিয়ে নেয়, “ছিঃ! ইয়াজভান জানুমান।” সে ভেংচি কাটে।
“এটা আবার কি?”
“জাহান+ হনুমান=জানুমান।”
জাহানকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “মাথায় কি ঠাডা পড়সে? হাসতাসো কেন?”
জাহান মাথা নাড়ায়, “কিছু না ম্যাডাম। কিছু না।”
তারপর বিড়বিড় করে বলে, “বকার ঠেলায় তাও আদুরে নামে তো ডাকছে। প্রেমিকার স্ক্রু একটু ঢিলা হলে লাভই আছে।”
বাসার খানিকটা সামনে এসে জাহান গাড়ি থামায়। মহুয়া বিরক্তি নিয়ে বের হয় গাড়ি থেকে। বের হয়ে খানিকটা ঝুঁকে জানালা দিয়ে তাকায় জাহানের দিকে, “আজকে সারাদিন ভালো কাটলো শেষ মুহূর্তে এসে আমার মুডটার চৌদ্দটা বাজায় দিলা। তোমার জন্য আমার ডেসার্টও খাওয়া হলো না।”
“হয়তো অন্য একদিন।”
“তোমার সাথে আর বের হচ্ছি না। অসভ্য কথা বলো।”
জাহান বাঁকা হাসে, “ঋণ পরিশোধ করবে না? তুমি কিন্তু আমার কাছে এখন ঋণী।”
মহুয়া ভেংচি কাটে।
জাহান মধুর কন্ঠে বলে, “আই লাভ ইউ জান।”
মহুয়া কথাটা শুনে মুখ বানায়, “আই হেইট ইউ।” বলে হনহনিয়ে চলে যায়।
জাহান হাসে। তার সিটে হেলাম দিয়ে চোখ বন্ধ করে। ঘন নিশ্বাস ফেলে। তার ওয়ালেট বের করে খুলতেই দেখতে পায় তার মা’য়ের ছবি, “ও মা তুমি জানো আমি হয়তো এই পাগল মেয়েটার প্রেমে ডুবে যাচ্ছি। মেয়েটা একটু অন্যরকম। একটা পিস বটে।” বলে হাসে জাহান। আবারও বলে, “মা তুমি তো আমার জান্নাত। তোমার কোলে যে শান্তি পেতাম তার তুলনা তো কখনো হয় না। তুমি যাবার পর আমি কখনো এত শান্তি অনুভব করিনি। কিন্তু ওর সাথে আমি শান্তি অনুভব করি। ওর প্রতিটি ছোঁয়া আমার বুকের ভেতরের আঁধার যেন দূর করে দেয়। অনুভূতিটা কেমন যেন! যখন সেদিন প্রথম দরজা খোলার পর ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল বিশ্বাস করো মা আমার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল। হঠাৎ আমার হৃদয়ে এক উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে গেল। কিন্তু আবার আরেক যন্ত্রণা, এরপর থেকে চোখ বন্ধ করতেই ওর ভেজা চোখদুটো আমার হৃদয়কে জ্বালাতে শুরু করল। আকর্ষণ ভেবেছিলাম মাত্র। প্রথম এই অনুভূতিটা ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। অথচ যত সময় ওকে দেখি ততই ওর প্রেমে পড়ছি। যে রাগ, কথা, জেদ আগে বিরক্তিকর লাগতো তা এখন আমার ভালো লাগে। ও কবে বুঝবে মা? কবে আমাকে ভালোবাসবে? আমার কাছে সব আছে। সব। তবুও একটা অপূর্ণতা আছে। সব থেকেও কেমন একাকী লাগে। সারাদিন মানুষের মাঝে ঘেরা থাকলেও মনে হয় কেউ ভালোবাসে না। বাবাও তুমি যাবার পর থেকে কাজেই ব্যস্ত। বুঝি তো, তোমার আমানত সামলানোই তো তার জীবনের লক্ষ্য। ভালোবাসা পাবার জন্য তৃষার্ত আমি। আর আমি জানি, কেবল মহুয়াই আমার এই অপূর্ণতা মেটাতে পাড়বে।” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার মা’য়ের ছবির পিছন থেকে একটি রিং বের করল, “আজ তুমি থাকলে ওকে ছেলের বউ হিসেবে দেখে নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হতে। তাই না মা? আমাদের দেওয়া তোমার শেষ উপহারের উওরাধিকার পেয়ে গেছি বোধহয়। আই উইশ, তুমি নিজের চোখে তাকে দেখতে পাড়তে।”
.
.
দুইদিন শশুড়বাড়ি থাকার পর সমুদ্র বাড়িতে চলে যায়। মিতার বিয়ে এই শত্রুবারই হবে আর শনিবার বৌভাত। মোহের এই বিয়েতে থাকার ইচ্ছা না থাকলেও বাবা মা’য়ের কথায় সে মানা করতে পাড়ে না। কিন্তু সে বলে দেয় এই বিয়ের কোনো আয়োজনে সে নেই। এর আগেরবারে আয়োজন করে নিজে বিয়ে করে বসে আছে। এখন আর কোনো ঝুঁকি নিতে সে প্রস্তুত নয়।
রাতেরবেলা মোহের ভালো লাগছিল না। কেমন খালি খালি লাগছিল রুমটা। সমুদ্র থাকলে এতক্ষণে তাকে কতটা বিরক্ত করতো! ভেবেই হাসে মোহ। এই পাঁচদিনে সমুদ্রের অভ্যাস হয়ে গেছে তার?
ফেসবুকে ঢুকে আজ এতদিন পর সে সমুদ্রের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করে। তার প্রফাইলে ঢুকে তার ছবিগুলো দেখে। ছবি ভরা কিছু তার কাজিনদের সাথে, কিছু তার বাইকের সাথে আর সব বন্ধুদের সাথে। তার বন্ধুমহল বেশ বড়। হবেই বা না কেন? সমুদ্র মিশুক মানুষ বুঝাই যায়। তবে ছবিগুলোর মধ্যে চারজনকে বেশি দেখা যায়। দুইটি ছেলে ও দুইটি মেয়ে তার সাথে। তার একটি ছবি বের করে মোহ। বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পিছন থেকে সূর্য উঠছে। ক্যাপশনে লেখা,
“মেঘের খামে তোমার নামে এক চিঠি পাঠালাম,
ও ললিতা, শুনো এক প্রেমকাব্য,
তোমার হাসিতে হারালাম নিজেকে,
যে হাসিতে আমার প্রাণ জুড়ে,
সে হাসিতেই আমার হৃদয় পুড়ে।”
ছবিটা মনে ধরল মোহের। সে ছবিটা জুম করে দেখতে থাকলো। তার বর কী আগের থেকেই এত বেশি সুদর্শন ছিলো না’কি এখন তাকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে?”
তার দেখার মাঝেই মেসেজ আসে সমুদ্রের, “এত রাতে ফেসবুকে কী মধু?”
মোহ তার মেসেজ দেখে মুচকি হাসে। উওর দেয়, “আপনি যা করছেন তাই।”
“আমি তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। তুমি তো আমার ছবি যাচাই করছ। বিষয়টা কী এক হলো?”
মোহ এবার লজ্জায় লাল হয়ে যায়, “আমি আপনার ছবি যাচাই করছি? কবে?”
“দেড় বছর আগের ছবিতে লাইক দিয়েছ তুমি। মানে আমার প্রফাইল স্টক করছ। ব্যাড ম্যানার্স মধু, ভেরি ব্যাড।”
“এমন কিছু না। সামনে এসেছিল আরকি।”
“বুঝেছি বুঝেছি। এত হ্যান্ডসাম বর হলে একটু দেখতে তো মন চায়-ই। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”
“হ্যান্ডসাম আর আপনি? মোটেও না।”
“আমি আমার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি লাইফে কতগুলো মেয়ের ক্রাশ ছিলাম জানো?”
“আমি কতজনের ক্রাশ হিসাব দিব?”
“হিসাব লাগবে না ভাই। পছন্দের কাওকে থাকলে বলো। আমি সেটিং করায় দিব। তখন ইতিহাসে আমার নাম আসবে, এই প্রথম কোনো স্বামী নিজের স্ত্রীকে অন্যাকারো সাথে সেটিং করিয়ে দিয়েছে।”
“সামনে থাকলে আপনাকে বিছানা থেকে এক লাথি দিয়ে ফেলে দিতাম।”
“কল্পনা করেই আমার কোমর ব্যাথা করতেছে। হাহা। আচ্ছা মজার কথা পড়ে। তোমার আগামী সাপ্তাহে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে?”
“না। কেন?”
“তুমি জার্নি করতে পারো?”
“টুকটাক।”
“আচ্ছা আমি সামলে নিব। মিতার বৌভাতের পর আমার আরেকটা অনুষ্ঠান আছে। আমার অনেক কাছের দুইজন ফ্রেন্ড ঈশা ও আর তুষার ভাইয়ের এনগেজমেন্ট। চট্টগ্রামে। ওখানে যাব। ঈশা জোর করছে তোমাকে নিয়ে যেতে। এনগেজমেন্ট শেষে রাতেই আমরা রওনা দিব কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সেখানে দুইদিন থেকে আসব।”
মেসেজটা পড়েই মোহ তাকে মেসেঞ্জারে কল দেয়। তার কন্ঠ শোনাল ভীষণ উৎসুক, “আমরা সাগর দেখতে যাব? সত্যি? জানেন আমার ছোট থেকে সাগর দেখার খুব শখ। কখনো যাওয়াই হয় নি।”
“আচ্ছা তাহলে এবার দেখে নিও। ঈশা তোমার সাথে দেখা করতে চায়। আমাদের বৌভাতে আসতে পারে নি। তোমার ছবি দেখে পাগল হয়ে গেছে। বলল ছোটমোটো একটা ক্রাশ খেয়েছে। বলছিল আমার না’কি সৌভাগ্য এত সুন্দর বউ পেয়েছি।”
“তাই না’কি? তো আপনি কী বললেন?”
“যা সত্যি।”
“কী সত্যি?”
“সত্যি বলতে আমার কাছে তোমাকে নরমালই লাগে। বাকি সব মানুষদের মতো। মানুষের মতো দুই চোখ, দুই কান, নাক, ঠোঁট আছে। সবাইকে একই লাগে আমার। মানুষ সৌন্দর্য নিয়ে এত মাতামাতি কেন করে আমি বুঝি না। এই’যে তোমাকে বললাম কতগুলো মেয়ে আমার উপর ক্রাশ খেয়েছিল এসব দেখলে আমার বিরক্ত লাগতো। মানুষ সৌন্দর্য দেখে পছন্দ করে কীভাবে কাওকে? মনকে পছন্দ করতে হয়। সৌন্দর্যকে না। কাওকে পছন্দ করলে কি আপনা-আপনি সে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে যায় না?”
মোহ ছোট করে বলল, “হু।”
কথাগুলো সুন্দর। মোহের ধারণাও এমন। ছোট থেকেই নিজের সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনতে শুনতে সে বিরক্ত। এই সৌন্দর্যের কারণে তার অন্য গুণ কারো চোখে পড়ে না। আশেপাশে সবাই যখন তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগে। আগে রাস্তায় হাঁটার সময়, ক্লাসে, অনুষ্ঠানে তার দিকে সবাই যখন তাকায় তার নিজের জঘন্য লাগতো। কতগুলো ছেলে তো তার সাথে বেয়াদবিও করেছিল। ভাগ্যিস সে নিজেকে রক্ষা করতে শিখেছিল। তার এসব পছন্দ ছিলো না কোনোকালেই। কিন্তু এখন সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। এসব তার কাছে এখন ভীষণ স্বাভাবিক। তার নিজের সৌন্দর্য এতটা পছন্দ নয়। তার কাছে তার সৌন্দর্য আশির্বাদের সাথে অভিশাপও বটে। কেননা সে জানে তাকে কেউ ভালোবাসলে তার সৌন্দর্যকে ভালোবাসবে। তাকে না। যা সে চায় নি কখনো। সে চেয়েছে এমন কেউ থাকুক যে তার সৌন্দর্য ছাড়াও তাকে ভালোবাসুক। অথচ আজ তার বুকের ভেতর এক আশা জন্মেছে। সমুদ্র কী তার সৌন্দর্যকেও একটু ভালোবাসতে পাড়ে না? কেন পাড়ে না? নিজের বউকে কেউ কীভাবে ভালো না বেসে থাকতে পারে?
“মধু…এই মধু… কোথায় তুমি?” সমুদ্রের ডাকে ঘোর ভাঙে মোহের, “আছি তো।”
“তাহলে চুপ কেন? রাগ করেছ? মধু শুনো, তুমি অসুন্দর এটা বলিনি। যাস্ট আমার কাছে সবাইকে একইরকম লাগে। সমস্যা আমার বুঝেছ?”
মোহ হাসে, “বুঝেছি। রাগ করিনি। আর আপনি ঠিকই বলেছেন। একারণেই আমারও তেমন কোনো ছেলে চোখে লাগে নি আজ পর্যন্ত।”
“এ দোষেই তো ফেঁসে গেলে মধুরাণী। প্রেম করলে আমার আমাকে বিয়ে করতে হতো না।”
“দোষ আমার না, আপনার ও মিতা আপুর। দুইজনে না এত কাহিনি ঘটাতেন আর না এই বিয়ে হতো।”
“তাহলে যে তোমার বোন আজীবন কষ্টে থাকতো। ভালোবাসা না পাবার কষ্টটা তুমি বুঝবে না মধু।” শেষ বাক্যে সমুদ্রের কন্ঠ উদাসীন শোনাল।
“আমি বুঝতে চাই না।”
“আমিও চাই না তুমি বুঝো। তাইতো বারবার বলছি অন্যকাওকে পছন্দ করো। আমি নিজে তোমাদের এক হতে সাহায্য করব। এই বিয়েটা নাম মাত্র। এই বিয়েতে তুমি বন্ধুত্ব,সম্মান, পরিবার সবই পাবে ভালোবাসা পাবে না। যেটা তুমি চাও।”
মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আর পাঁচমাস চব্বিশদিন অপেক্ষা করুন। আপনাকে মুক্তি দিয়ে চলে যাব। ডোন্ট ওয়ারি।”
“বিয়ে থেকে মুক্তি দিতে পাড়ো, পেতে পাড়ো কিন্তু সমুদ্র কারো সাথে একবার বন্ধুত্ব করলে ভাঙ্গে না। আজীবন এই সম্পর্কে বন্দী থাকতে হবে।”
“আচ্ছা রাখি, ঘুম পাচ্ছে। আমি আগে দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রাখব।”
“ওকে। আর আগে দিয়ে ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার বন্ধুরা একটু পাগল। কথাবার্তা শুনে বেহুশ হয়ে যেও না আবার।”
“মহুয়ার সাথে দেখা হয়েছে না আপনার। ওকে ভুলে গেলেন? ওর থেকে কি বেশি পাগল?”
সমুদ্র শব্দ করে হাসল, “তুমি নেই বলে আজ রাত আইস্ক্রিম মিস গেল। আইস্ক্রিমকে মিস করছি।”
মোহ মৃদু হাসে, “রাখি।”
সে কল রাখার পর ফোনের দিকে তাকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যাক তাকে মনে না করলেও তার কারণে আইস্ক্রিমকে তো মনে করছে। এতটুকু জায়গা তো তার জীবনে হলো।
রাতে আর ঘুম হলো না মোহের। ফজরের নামাজ পড়ে কতক্ষণ কোরআন শরীফ পড়ল। তারপর গেল বারান্দায়। তার ভোরের সময়টা পছন্দের। একটু বেশিই পছন্দের। তার বাসা এপার্টমেন্টের ছয়তলায়। এখান থেকে আকাশটা খুব সুন্দর দেখায়। মনে হয় আকাশটা তার খুব কাছে। আকাশে ভাসা মেঘগুলো আরও কাছের।
ভোরে শীতল বাতাসে এক মিষ্টি আভাস এসে ছুঁয়ে যায় তাকে। তার শরীর শিরশির করে উঠে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। অনেক সময় ধরে। সবসময় এই পরিবেশটা তার খুব ভালো লাগে কিন্তু আজ তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। সে মৃদুস্বরে বলে, “এই সম্পর্কের সমাপ্তি কী হয় তা জানার জন্য আমি অতি আগ্রহী সমুদ্র। আপনি জানেন আপনার প্রতি আমার কেমন মায়া জমে গেছে। আজ পর্যন্ত যে আমার কোনো পুরুষকে চোখে লাগে নি, এই সম্পর্কে বাঁধার পর আপনাকে আমার মনে লেগেছে। আপনার জন্য আমার খুব মায়া। কিন্তু আমি দু’নৌকায় চড়ে আছি। কোন নৌকায় ঠায় নিব বুঝতে পাড়ছি না। এই সম্পর্ক ছিন্ন করব না মেনে নিব? জানি না। সময়ের উপর সব ছেড়ে দিলাম। যদি আল্লাহ চায় তাহলে মোহের সমুদ্রে আমরা একত্রে ভেসে বেড়াব, নাহয়…. ” বাকিটুকু মুখ দিয়ে বের হলো না মোহের। সে আরেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আপনার কী আজও আপনার জবাফুলের জন্য কষ্ট হয় সমুদ্র? হয়তো। আপনার চোখে দেখতে পাই, আপনার কন্ঠে বুঝতে পাড়ি। আপনি কী কখনো এই মোহের জন্য এমন কষ্ট হবে সমুদ্র? হবে কখনো?”
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ১৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
আজ অনেকদিন পর তিন বান্ধবী একত্রে ভার্সিটিতে আসবে। তাই মহুয়া ও মৃণা আগে দিয়েই এসে অপেক্ষা করছে পুকুরপাড়ের ক্যান্টিনে। আজ মোহের বিয়ের পর প্রথম তাদের দেখা। কত কথা জমে আছে! তাই আধাঘন্টা আগে এসে তারা হাজির।
অপেক্ষায় কাতর হয়ে মহুয়া প্রায় ঘুমিয়ে যাওয়া অবস্থা। অন্যদিকে মৃণা পড়াশোনায় ব্যস্ত। হঠাৎ-ই জাহান এসে উপস্থিত হয় সেখানে। মহুয়ার কপালে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী ধানিলংকা রাতে ঘুম হয় নি? আমার কথা ভাবছিলে না’কি?”
মহুয়া বিরক্তি নিয়ে টেবিল থেকে মাথা তুলে। কপাল ডলে
বলে, “সকাল সকাল নিজের চেহারা দেখালে কোন দুঃখে?”
জাহান আশেপাশে চোখ বুলাল। শায়ানকে কোথাও না দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তারপর দৃষ্টি স্থির করল,
“সকাল সকাল হবু বরের চেহারা দেখলে দিন শুভ যায়।”
“হবু বর মাই ফুট। তোমাকে বন্ধুও বানাব না।”
“বন্ধু কে হতে চেয়েছি? আমি চেয়েছি? ডাইরেক্ট প্রেম করব? বন্ধু টন্ধুরা চুমু খেতে পারে না-কি? প্রেমিক পাড়ে।”
তার কথা শুনে মৃণা চক্ষু ছানাবড়া করে তাকায় জাহানের দিকে।
মহুয়া টেবিলের নিচে তার পা’য়ে একটা লাথি দিয়ে বলল, “অসভ্যমার্কা কথাবার্তা বললে আশেপাশে আসবা না।”
“ছিঃ ফাজিল মেয়ে নিজের হবু বরকে লাথি মারতে লজ্জা করে না?”
“না।”
“আমার তো নিজের হবু বউ থেকে লাথি খেতে লজ্জা লাগে। কিস এর কথাই তো বলেছি। এত চেতে যাচ্ছো কেন? আচ্ছা যাও তুমি প্রথম চুমু না খাওয়া পর্যন্ত আমি কোনো চুমু খাবো না প্রমিজ। কিন্তু একবার চুমু দিলে আর তোমাকে ছাড়ব না। যেখানে পাব ওখানেই চুমু খাব। এরপরের যা হবে সব দায়ভার তোমার।”
“তোমাকে চুমু খাওয়ার জন্য তো আমার বয়েই গেছে। এদিন কখনো আসবে না। কখনোই না।”
“দেখা যাবে।”
মহুয়া জিহ্বা বের করে তাকে ভেঙিয়ে দিলো।
জাহান মৃণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর ইউ ওকে?”
মৃণা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নড়ে-চড়ে বসে। সাধারণত তার সাথে কেউ কথা বলে না তাই সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মৃদুস্বরে উওর দেয়, “জ্বি… জ্বি ভাইয়া।”
“তোমার… কি হয় খোদা জানে। মা বাবা শব্দের তো যোগ্য না। তারা তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে একবার শুধু আমাকে জানাবে তাদের বংশের নাম ভুলিয়ে দিব।”
মহুয়া মুখ বানিয়ে বলে, “এহ আসছে। ওদিন কচু করসো তুমি? সব তো আমি করলাম।”
জাহান তার দিকে তাকায় বাঁকা হাসি নিয়ে। নিজের চোখের সামনে আসা গাবলি চুলগুলো আঁচড়ে সরায়, “আমার বাঘিনী মাঠে নামলে আমি তার সামনে আগানোর সাহস করতে পাড়ি? বাঘিনী মাঠে নামলে বাঘকে একপাশে তো বসে থাকতেই হয়।”
মহুয়া বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
মৃণা বলে, “ধন্যবাদ ভাইয়া। ওদিন আপনি আমার সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। মহুয়া বলেছে।”
“ভাইয়া বলে থ্যাঙ্কিউ দিচ্ছো? আসলে ভাইয়া মনে করলে তোমার কোনো সমস্যা হলে আমার কথা জানিও। যেহেতু ভাইয়া বলেছ তুমি আমার বোনের মতো।”
মহুয়া ফট করে বলে, “আমিও তাহলে ভাইয়া ডাকব?”
জাহান চকিতে তাকায় তার দিকে। তার চোখদুটো ছোট হয়ে গেছে। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মহুয়ার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “বেশি ফাজলামো করলে এই পুকুরে ছুঁড়ে মারবো। তোমাকে ভালোবাসি বলে ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিও না। ইয়াজভান জাহানের রাগ সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। ও তোমার উছিলায় আমার বোন হয়েছে। তোমার বান্ধবী মানে আমার শালী। আর শালী মানেই বোন।”
“আর কে আপনাকে ওকে ভালোবাসার পারমিশন দিয়েছে?” মেয়েলি কন্ঠ শুনে জাহান পিছনে তাকাল। মোহকে দেখে সে বলে, “বিয়ের চারদিন পরই ভার্সিটিতে চলে এলে?”
মোহ কপাল কুঁচকে তাকায়, “আপনি কীভাবে জানলেন আমার বিয়ে হয়েছে?”
“আমি তো এটাও জানি কীভাবে হয়েছে।” বলে তাকায় মহুয়ার দিকে। মোহও কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে। মহুয়া সাথে সাথে বলে, “আমি বলি নাই এই ব্যাটা আমার কথা শুনছে। সব বাদ দে আমার দুলুভাই কেমন আছে? আর তুই বিয়ের পর এত সুন্দর হয়ে গেলি জা….” বলে তাকে জড়িয়ে ধরতে নিলেই মোহ হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। তাকে সরিয়ে একটি চেয়ার নিয়ে বসে বলে, “সামনে বসুন।”
“ওহ ইন্টারেস্টিং।” জাহান কৌতূহল নিয়ে বসে চেয়ার টেনে।
ক্যান্টিনের সকলেও তাদের আশেপাশে জড়ো হয় কৌতূহল নিয়ে। হচ্ছেটা কি এখানে!
মোহ বুকের উপর হাত ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করে, “কতটুকু পছন্দ করেন মহুয়াকে?
” পছন্দ করতাম, এখন মেবি ভালোবাসি।”
“মেবি?”
” কেবল ওর প্রতি আমার মনে ফিলিংস আছে। দিনদিন বাড়ছে। প্রতি মুহূর্তে। এখন এই অনুভূতির সীমানা আমি জানি না। তাই এখনই যদি বলে দেই ভালোবাসি তাহলে ভবিষ্যতে কী বলব?”
“ওর কিন্তু রাগ বেশি। জেদ বেশি।”
“আমার পছন্দ।”
“ও কিন্তু তারছেঁড়া। উপরের তলা খালি। সামলাতে পাড়বেন?”
মহুয়া এতক্ষণ মোহ এবং জাহানের কথোপকথন শুনছিল। তবুও তার মাথায় কিছু ঢুকছিল না প্রথমে। মোহ করতে চাইছেটা কী? প্রথমে ভেবেছিল হয়তো জাহান থেকে পিছু ছুটাতে সাহায্য করছে এখন তো দেখি রীতিমতো তার নামে মশকরা করছে। তাই এবার চেতে মেতে সে মোহকে বকতে যায়, “মোহের বাচ্চা তুই…”
মোহ তার কথার মাঝেই তাকে চুপ করায়, “কীসের বাচ্চা? কোত্থেকে এলো বাচ্চা? আমার হাতে কোনো বাচ্চা দেখছিস? তুই নিজে একটা বাচ্চা। এবার ভালো বাচ্চার মতো চুপচাপ বসে থাক, নাহলে তোর সিক্রেট সবাইকে বলে দিব।”
“না। তুই বলতে পাড়বি না।”
“আমাকে চ্যালেঞ্জ করছিস। দাঁড়া বলছি সবাইকে।” বলে দাঁড়াতে গেলে মহুয়া সাথে সাথে বলে, “আমি চুপ। আমি কোনো কথা বলছি না। কিন্তু পড়ে তোকে পাই কি করি দেখিস।”
মোহ ঠোঁট টিপে হাসে। আবার গম্ভীরমুখে তাকায় জাহানের দিকে,”দেখলেন তো উপরের তলা খালি। সামলাতে পাড়বেন তো?”
“জেনে বুঝেই প্রেমে পড়েছি।”
“দেখেছি আপনি সিগারেট খান। ওর কিন্তু সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না। এর উপায়?”
“ও একদিন বলেছিল। এরপর আমার সাথে সাথে সবার সিগারেট খাওয়া বন্ধ।”
মোহ অবাক হয়ে তাকায় জাহানের দিকে, “একদিনে সিগারেট ছেড়ে দিলেন?”
“অফকোর্স। নট আ বিগ ডিল।”
মোহ তার বড় বড় ডাগর চোখ দুটো আরও বড় করে নেয় বিস্ময়ে। এমনি আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেমেয়েদের মাঝে একটি ছেলে বলে উঠে, “জাহান ভাই কি শুধু নিজে ছেড়েছে? আশেপাশের সব দোকানে সিগারেট ব্যান করে দিয়েছে। আমরাও মরছি সিগারেটের তৃষ্ণায়।”
মহুয়াও অবাক দৃষ্টিতে তাকাল জাহানের দিকে। সে এতদিন খেয়াল করে নি। কিন্তু সত্যিই তো কিছুদিন ধরে তার আশেপাশে কেউ সিগারেট খায় না। সিগারেটের ধোঁয়াও পায় না। যেখানে রাস্তায় আগে বের হলেই সিগারেটের গন্ধে থাকা যেত না। বিশেষ করে ভার্সিটির বাহিরে। জাহান এসব করেছে? তার জন্য?
হঠাৎ তার মনে পড়ে তার বাসার আশেপাশেও এখন আর কেউ সিগারেট খায় না। ওদিন জাহান তিসানের সাথে তার বাসার সামনেও এসেছিল এক কাজে। এই ছিলো সে কাজ?
মোহ নিজের খুশি লুকিয়ে আগের মতো গম্ভীরভাব বজায় রেখে জিজ্ঞেস করে, “আর ফিউচার প্লানিং কি? কী করতে চান?”
মহুয়া বিরক্তি নিয়ে বলে, “তুই এভাবে জেরা করছিস কেন? আসলে বিয়া করায় দিবি না’কি? কচুর ডিম।”
মোহ ঝারি দেয় তাকে, “তোকে বলেছি না চুপ করতে। বড়রা কথা বলছে দেখতে পাড়ছিস না?”
“শালী তুই আমার থেকে চারমাসের ছোট হোস।”
“আমি তোর শালী হবো না, তোর জামাইয়ের হবো। ওইটারই ইন্টারভিউ নিচ্ছি। ডোন্ট ডিস্টার্ব।”
ভিড় থেকে একটা অচেনা মেয়েও বলে উঠে, “এইটাই তো। এত ধ্যান সহকারে আমরা কথাগুলো শুনছি আর মাঝখানে বারবার আঙুল ঢুকাচ্ছো কেন? চুপ করে থাকো তো।”
অচেনা একটা মেয়ে থেকে এভাবে ঝারি খেয়ে বেক্কলের মতো তাকিয়ে রইলো মহুয়া।
জাহান বলে, “আমি অলরেডি জব করছি আমার বাবার ব্যবসায়ে। ট্রেনিংও নিচ্ছি। ফিউচারে ওইটাই বড় করার ইচ্ছা আছে। এনি আদার কুয়েশ্চন?”
“ভবিষ্যতে আপনি যদি মহুয়াকে কষ্ট দিলে আপনার কী শাস্তি পাওয়া উচিত?”
“যা ইচ্ছা শাস্তি দিবে। কঠিন থেকে কঠিনতর। আমি রাজি।”
“ভবিষ্যতে যদি এখনের মতো মহুয়ার প্রতি অনুভূতি না থাকে তাহলে?”
“অবশ্যই থাকবে না। আরও গাঢ় হবে। ভালোবাসার সীমানা আছে কী-না আমার জানা নেই। শেষ সীমানা পর্যন্ত ভালোবাসব তোমার বান্ধবীকে। নিজের জান প্রাণের বিনিময়ে হলেও।”
“সবে তো বললেন ভালোবাসা বাড়ছে। এত জলদি জান প্রাণ দিতে রাজি? যদি ভবিষ্যতে অন্যকারো জন্য এই অনুভূতি আসে তখন?”
জাহান ঝুঁকে বসে। হাঁটুর উপর দুই হাত রেখে দুইহাতের আঙুল একত্র করে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “আমি বুঝ হবার পর থেকে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই হৃদয় কেবল একজনেরই হবে। এখন তোমার বান্ধবীর জন্য এই হৃদয় ব্যাকুল হয়েছে। কী করার বলো? ওকে না পেলে সারাজীবন নিঃস্ব কাটাব তবুও অন্যকাওকে এই হৃদয় মায়ায় বাঁধবে না। মানুষ একবারই ভালোবাসে, বারবার না।”
কথাটি শুনে মোহের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে। ঠিকই তো, মানুষ একবারই ভালোবাসে। সমুদ্র সে ভালোবাসা অন্যকাওকে লিখে দিয়েছে। তাকে কী করে ভালোবাসবে? বহু কষ্টে তার দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকল। হাত বাড়িয়ে জাহানকে বলল, “কনগ্রেটস ইয়াজভান জাহান আপনি আজ থেকে মোহ আর মৃণার আনঅফিসিয়াল জিজু।”
তারপর একগাল হাসে।
জাহান একবার মোহের হাতের দিকে তাকায় আবার মহুয়ার দিকে। মহুয়াকে হা করে থাকতে দেখে ঠোঁট টিপে হাসে। মোহের হ্যান্ডশেক করে বলে, “থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। অফিসিয়াল হবার অপেক্ষায় থাকব।”
“জলদিই হবেন ইনশাআল্লাহ।”
মহুয়া পাশ থেকেই লাথি দেয় মোহকে, “মীরজাফর লেডি ভার্সন প্রো ম্যাক্স তোকে আমি আজ কাঁচা খেয়ে ফেলব।”
মোহ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ওহ জিজু ভুলেই গিয়েছিলাম এই মেয়ে মাঝেমধ্যে রাক্ষসীতে কনভার্ট হয়ে যায়। সো অল দ্যা বেস্ট।”
“দেখাচ্ছি তোকে আমি। তুই কার সাইডে আমার না এই হনুমানের?” বলে মোহকে দৌড়ানি দেয়। মোহও দৌড়ে পালাতে নেয়।
মৃণা তাদের দেখতে থাকে নীরব দর্শক হয়ে।
মোহ দরজা দিয়ে বেরোতে নিলে এক আগুন্তক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধাক্কা খেতে যেতেও সামলে নেয় নিজেকে। সে ডাগর ডাগর পুতুলের মতো নয়ন তুলে তাকায় তার দিকে, “সরি ভাইয়া।”
সে তো জানে না সে চোখদুটো ঝড় তুলে যুবকটির বুকে। সে ঝড়ে মিশে আছে এক আকাশ সুখ ও দুঃখ। তার মুখখানির দর্শন পাওয়াটাই ছেলেটির সুখ ও তাকে পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলাটা তার এক আকাশ দুঃখ।
মহুয়াও তিসানকে দেখে থেমে যায়। দৌড়ে যায় জাহানের কাছে। টেবিলে শব্দ করে হাত রেখে জাহানকে মৃদুস্বরে বলে, “তোমার বন্ধুকে এখান থেকে নিয়ে যাও। ওর ছ্যাঁকার চক্করে আমি ওদিন কত মজার খাবার মিস করেছি। আজ মোহকেও মারতে পাড়লাম না। এখন আবার দেবদাসগিরির জন্য আজকের খাবার মিস করতে পাড়ব না।”
“তুমি তো দেখি বহুত স্বার্থপর জান। একজন প্রেমিক মানুষ তার প্রেমিকা হবার আগেই ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়েছে আর তুমি খাবারের চিন্তা করছ?”
“তোমার বয়স কত?”
“তেইশ।”
“তো মিস্টার তেইশ বছরের হনুমান তুমি কি খাবার খেয়ে বেঁচে আছো না প্রেম খেয়ে?”
“পয়েন্ট তো আছে।”
“তাহলে এবার নিয়ে যাও।”
“আগে ওদিনের বকাটা দেও। জাহান প্লাস হনুমানেরটা।”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় মহুয়া। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি মগজে বোম্ব ব্লাস্ট হইছে? বকা শুনতে চান কেন?”
“তাহলে নিচ্ছি না। এখানেই বসে থাকব। প্রতিদিন তোমার খাবারের সময় ক্যান্টিনে নিয়ে আসব।”
“ওকে, ওকে। মিস্টার জানুমান ওকে নিয়ে যাও।”
“আদুরে গলায় বলো।”
“জানুমান প্লিজ।”
“উফফ!” জাহান চোখ বন্ধ করে তার বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে বলে।
মোহ তিসানকে জিজ্ঞেস করে, “এমনি ভাইয়া একটা কথা বলি? আপনি ও মহুয়া রিলেশনশিপের অনেক বাজে নাটক করেছেন। আমি দুইদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম দুইজনে নাটক করছেন। ও তো পাগল আপনি এই কাজটা কেন করলেন বলুন তো।”
তিসান উওর দেয় না। মোহের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ সে পড়েছে লাল রঙের সেলোয়ার-কামিজ। অপরূপা সুন্দরী দেখাচ্ছে তাকে। নববধূ লাগছে। ভাবতেই বিরক্তি লাগল। নববধূই তো সে। অন্যকারো বউ। তাকে দেখে মুগ্ধ হবার প্রশ্নই আসে না। তিসান তার দৃষ্টি সংযত করল। অন্যদিকে তাকাল। ছোট করে উওর দিলো, “কারণ ছিলো।”
“অসুস্থ আপনি? প্রতিবার দেখা হলে তো অনেক কথা বলতেন। আজ এত কম কথা বলছেন?”
“প্রতিবার তো তুমিও অল্প কথা বলতে। আজ প্রথম এত কথা বলছ যে আমার সাথে।”
“এভাবে কেন বলছেন? এতদিন তো কথা বলার মতো কিছু ছিলো না তাই বলিনি। এখন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। না কথা বললে বলবেন না। আজব।” বলে সে যেতে নিলে তিসান তাকে থামায়, “না ওয়েট। আসলে সকাল থেকে একটু মাথা ব্যাথা। এ-কারণে মেজাজ চিটচিটে হয়ে আছে। সরি।”
“ইট’স ওকে।” বলে সে আবার যেতে নিলে জাহান এসে দাঁড়ায় তিসানের পাশে। তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “চল একটু বাহিরে যেয়ে ঘুরে আসি।”
মোহের এই দৃশ্য দেখে চোখ কপালে উঠে যায়, “এক মিনিট আপনারা না শত্রু ছিলেন? কী হলো? এই খাতির কীভাবে হলো? এক সাপ্তাহ ভার্সিটিতে আসি নি এর মধ্যে এতকিছু কীভাবে হয়ে গেল?”
“তোমারও তো একটু সময়ের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল।” তিসান বলে।
“আপনিও জানেন? এই মহুয়ার বাচ্চাকে তো আমি….”
তিসান বিরক্তি নিয়ে জাহানকে বলে, “চল অনেক মাথা ধরেছে একটু বাহিরে যাই।”
জাহান সম্মতি জানায়। তবে যাবার পূর্বে মোহের সামনে যেয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “মোহ শুনো, এই তোমার বান্ধবীর সিক্রেট কি?”
মোহ মহুয়ার দিকে এবার তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। তারপর ফিসফিস করে বলে, “জিজু বলবেন না আমি বলেছি ওকে?”
“ওকে।”
“ও একটা ডোরেমন এডিক্ট।” বলে হেসে দেয়।
জাহানও চোখ গোল গোল করে তাকায় মহুয়ার দিকে, “ওর যে বাচ্চামি। অবাক হবার বিষয় না।”
“বুঝলেন ভাইয়া মনে করে সবাই জানলে ওর মজা উড়াবে। ভয় পাবে না।”
“ওকে কেউ ভয়ও পায়?”
মোহ মিটিমিটি হাসে, “আপনার চোখের সামনে ছু’রি ধরেছিল ভুলে গেলেন?”
“ওদিন ভয় পায় নি বাট….”
“বাট?”
জাহানের মনে পড়ে যেদিন তাকে ভয় দেখাতে যেয়ে মহুয়া হঠাৎ তার কাছে এসেছিল সেদিন সে ভয় পেয়েছিল। হঠাৎ করে মহুয়ার মতো মেয়ে একটা এমন কাহিনী করবে সে ভাবে নি। আর এখন কাছে টানতে চায় মেয়েটা ধরাই দেয় না। আফসোসের নিশ্বাস ফেলে মোহকে বলে, “কিছু না। তোমাদের খেয়াল রেখো। আসি।”
“ওকে ভাইয়া।”
মোহ যাবার পর জাহান খানিকটা দূরে দাঁড়ানোর ছেলেদের দিকে তাদের দেখিয়ে ইশারা করল।
“কী ইশারা করছিস?” তাসিন জিজ্ঞেস করে।
“ওদের দেখে রাখতে। শায়ান ওদিন মহুয়ার সাথে…”
“শুনেছি।”
“মহুয়ার কিছু হলে ওই হারামিটার আমি কি অবস্থা করব জানি না। এককালের বন্ধুত্বের খাতিরে এতদিন সব মাফ করেছি ওর দিকে নজর দিলে কলিজা ছিঁড়ে ফেলবো।”
তাসিন জাহানের দিকে তাকায়। সে মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সে খুশি হয় আবার চিন্তিতও হয়। জাহান ও শায়ান দু’জনে ভীষণ জেদি। এই জেদ তাদের কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় খোদা জানে। সে বলে, “কিছু হবে না চল।”
মোহ এসে টেবিলে বসার সাথেই মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “কী কথা বলছিলি ওই হনুমানের সাথে?”
“তুই জেনে কী করবি?”
“তুই এমন মীরজাফরগিরি করতাসোস কেন ভাই?”
মৃণা বই পাশে রেখে বলে, “সব ছেড়ে তুই বল তুই জাহান ভাইয়াকে কি বলে ডেকেছিস?”
“কেন?”
“এমনি বল না।”
“হনুমান।”
“না না একটু আগে। ভাইয়াকে যখন বললি তাসিন ভাইয়াকে নিয়ে বাহিরে যেতে।”
“ওহ নিউ বকা বের করছি আমার ডিকশিনারির জন্য। কিন্তু ওই শালায় বকা শোনার জন্য এত ব্যাকুল কেন বুঝলাম না।”
“শোনা তো আগে।”
“তুই আবার শোনার জন্য এমন করছিস কেন? নাম রাখছি জাহান প্লাস হনুমান। জানুমান। ওয়েট জানু…জানুমান…জানেমান!” অনুভূতি হতেই কপালে হাত চলে যায় মহুয়ার। আর মৃণা ও মোহ হেসে কুটি কুটি।
মহুয়া কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে, “বকার চক্করে প্রেমের ডাক দিতেছিলাম আমি ঔ হনুমানকে? ছিঃ!”
মোহের হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে পড়ল। সে বলল, “ভাই এমনি এমনি বলি তোর উপরের তলা খালি?”
“এইটা ঠিক না। তোর নতুন বিয়ে হইসে আমি তোর সাথে মজা নিব বলে মেন্টালি প্রিপারেশন নিয়ে এসেছি আর এখানে তুই মজা নিচ্ছিস? নট ফেয়ার।”
“না বাবু থাক কাঁদিস না। মাঝেমধ্যে তোর মাথায় আবার এক্সট্রা বুদ্ধি এসে পড়ে। যা আমাদের মাথায় কখনো আসবেও না।”
“সান্ত্বনা লাগবো না তোর। আমি ওই জাহানকে জানুমান বলেছি এই ভেবেই ডিপ্রেশনে যাচ্ছি গা।”
“আরে এসব কিছু না। টেনশন করিস না। বাদ দে…জানুমান।”
“মজা নিবি না শালী।”
“শালী তোর না তো। তোর জানুমানের।”
“থাকবই না তোদের সাথে।” বলে উঠতে নিলে মোহ তার হাত ধরে আবার বসিয়ে দেয়, “আচ্ছা মজা করব না। প্রমিজ।”
মহুয়া বসতে বসতে বলে, “আচ্ছা এক শর্তে মাফ করতে পারি।”
“কী শর্ত?”
মহুয়া ফিসফিস করে বলে, “জলদি নিজের বাসররাতের কাহিনী বল। ডিটেইলে।”
“ছিঃ মহুয়া এসব কী বলিস?” মৃণা চোখমুখ কুঁচকে নেয়।
“তোরটাও শুনুম। বেস্টফ্রেন্ডগত অধিকার।”
“আমি থাকব না তোর সাথে নিলজ্জ কোথাকার। ”
মোহ চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে, “বস বস। ডিটেইলে বলব না, শর্টে বলি। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বধূবেশে। সমুদ্র এলো, আমায় বলল সে আমাকে কখনো ভালোবাসতে পাড়বে না কারণ সে অন্য কাওকে ভালোবাসে। সে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর সে হ্যাপি দেবদাসের চরিত্র পালন করছে। তারপর আমি একটুখানি কেঁদেকুঁদে তাকে লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে ওয়ার্নিং দিলাম। তারপর তাকে মেঝেতে বালিশ দিয়ে আমি আয়েশ করে তার নরম তুলতুলে বেডে ঘুমালাম। ভাই আসলে ব্যাটার তোশকটা সেই। এত জোস ঘুম আসছে।”
একটানে কথাগুলো বলে মোহ নিশ্বাস ফেলল ঘন ঘন। তাকিয়ে দেখল মৃণা তার দিকে সান্ত্বনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর মহুয়া চোখমুখ কুঁচকে। মোহ তার মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে, “তোরে আবার কোন কুত্তা কামড় দিলো? মুখ এমন রাখলি কেন?”
“আগে বল এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
“কি আর সিদ্ধান্ত নিব? আব্বু বলেছে ছয়মাস দেখতে। একসাথে থাকব না’কি থাকব না।”
শোনা মাত্রই মহুয়া হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “শালী তোর সাহস কত বড় আমার এত কিউট দুলুভাইকে তুই লাথি মারসোস?”
মোহ তার প্রতিক্রিয়াতে চমকে উঠে, “তুই বান্ধবীটা কার?”
“তুই আমার বেস্ট দুলুভাইকে লাথি মারসোস কোন সাহসে।”
“বেস্ট মাই ফুট। তুই জানিস তার নিজের প্রাক্তনের সাথে এখনো কথা হয়। তাও কী হেসে হেসে কথা বলে।”
“তো হাসবে নয় কি কাঁদবে? ফ্রেন্ডশিপ রাখতেই পারে। আমার দুলুভাই এই ভালো তার সাথে কেউ দুশমনি রাখবে না’কি?”
মোহ গভীর নিশ্বাস ফেলে, “মাফ কর আম্মা। তোর সাথে তর্কে আমি জড়াচ্ছি না। আমাকে মীরজাফর প্রো ম্যাক্স বলেছিলি না? তুই হলি মীরজাফর আলট্রা প্রো ম্যাক্সের প্রো ম্যাক্স।”
মৃণা দুইজনের কথোপকথনে বলে, “ভাই তোরা কি এবার মীরজাফর নিয়ে টানাটানি বন্ধ করবি? আজ সে জীবিত থাকলে তোদের টানাটানিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত।”
মোহ বলে, “যাই হোক। এই সাপ্তাহে মিতা আপুর বিয়ে। তোরা আসিস।
মহুয়া সাথে সাথে বলে, ” না ভাই না। গতবার পালিয়েছে বলে তোকে ধরে বিয়ে দিয়েছে এবার তো তুই আর স্টকে নেই। আমাকে বা মৃণাকে যদি ধরে দিয়ে দেয়। রিক্স নিব না।”
“আপুর তো প্রেমিকের সাথেই বিয়ে হয়েই গেছে।”
“তোর বোনের উপর ভরসা উঠে গেছে।”
“তোর দুলুভাইও কিন্তু কান্ডে সাথে ছিলো।”
“আবার তুই আমার দুলুভাইয়ের পিছু লাগছিস। বেচারা এত ভোলাভালা দেখে তাকে সব জায়গায় টেনেটুনে নিয়ে আছোস।”
“থাক ভাই তোদের আসা লাগবে না। আমিও শুধু ফর্মালিটির জন্য উপস্থিত থাকব। না থাকলে বাঁচতাম। বৌভাতের দিনই চলে যাব চট্টগ্রামে। সমুদ্রের ফ্রেন্ডের এনগেজমেন্টে।”
মহুয়া মজা নিতে শুরু করে, “এনগেজমেন্টে যাবা না হানিমুনে যাবা জান?”
“জান তো তুমি। তোমার জাহানের।”
“এই মুডটা নষ্ট কইরা দিলি ছ্যাঁচ্চর মাইয়া।” রেগে সে ব্যাগ নিয়ে উঠে যায়। মোহ ও মৃণাও যায় তার পিছনে। তিনটা স্যান্ডউইচ নিয়ে রওনা দেয় ক্লাসের উদ্দেশ্যে।
ক্লাসরুমে স্যার পড়াচ্ছিলেন। মৃণা অতি ধ্যান সহকারে তা নোট করছিল। মোহের টুকটাক মনোযোগ থাকলেও মহুয়ার ক্লাসে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে ঝিমুচ্ছে। হঠাৎ তার কিছু মনে পড়ে। সে মোহকে নিজের দিকে টান দিয়ে তার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “আজকে দুলাভাই তোকে নিতে আসবে?”
“না, কেন?”
” আমার সাথে যাবি এক জায়গায়?”
“কোথায়?”
“ওই তন্ময়ের বাচ্চার হাড্ডি ভাঙতে।”
কপাল কুঁচকায় মোহ, “ওইটা আবার কী করল?”
“দেখোস নাই? সে এওয়ার্ড পাইসে। জাত গুষ্টি সবাইকে ধন্যবাদ দিসে। বিশেষ করে তার ভালোবাসা বুশরাকে। যেখানে কেউ তার খোঁজও রাখে না। একটাবারও মৃণার নাম উচ্চারণ করল না অথচ মেয়েটা দিনরাত ওর সাহায্য করেছে, ওর উপর ভরসা রেখেছে, সাহস দিয়েছে। এত অকৃতজ্ঞ মানুষ হয়?”
মোহ একপলক মৃণার দিকে তাকিয়ে আবার মহুয়াকে বলে, “মৃণুর সাথে এই বিষয়ে কথা বলিস নি তো তাই না?”
“না।”
“ও তো তোর সাথেই ঘুমায়। এখন কথা বলে?”
“না। এখন আর কথা বলে না। বলেছিল নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে।”
“শুন আপনা-আপনি এই সম্পর্কে সমাপ্তি ঘটতে দে। মাঝেমধ্যে কষ্ট পাওয়াটাও ভালো। কষ্ট থেকে অনেককিছু শিখা যায়, নিজেকে শক্ত করা যায়। ও কতটা কষ্ট পেয়ে ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে আল্লাহ জানে। এই বিষয়ে ঘাটিস না। কেবল দোয়া কর ওর জীবনে এমন কেউ আসুক যে ওর যোগ্য।”
“বলছিস হাত পা ভাঙব না?”
মোহ হাসে, “ক্ষোভ জমায় রাখ সুযোগ পেলে ভাঙিস। আমার পক্ষ থেকেও একটা দুইটা দিস।”
.
.
মহুয়া ও মৃণার একসাথে যাবার ছিলো মহুয়াদের বাসায়। কিন্তু মৃণা বলল তার কিছু সময়ের জন্য তার বাবার বাসায় যাওয়া লাগবে। তার দাদীর দেওয়া কিছু টাকা এখনো রয়ে গেছে সেখানে। সে লুকিয়ে রেখেছিল। মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “তুই একা ঐ বাসায় যাবি? যদি আবার কিছু করে?”
“আমি সামলে নিব।”
“শিউর? পাড়বি তুই?”
“পাড়তে হবে না?”
“আমার থেকে আপাতত… ”
“না দোস্ত একথা বলবি না। এমনিতেই তোদের বাসায় থাকছি, খাচ্ছি আর কোনো উপকার নিতে পাড়ব না। এই ঋণ শোধ করব কীভাবে তাও জানি না।”
“জুতার বাড়ি চিনিস। তোর আর আমার মধ্যে উপকার, ঋণ আসল কবে থেকে?”
“তোর ও আমার মধ্যে না। তুই আর মোহ আমার পরিবার। তোদের উপর আমার অধিকার আছে কিন্তু সে বাড়ি তো তোর ভাইয়ের। তার কোনো জিনিসে আমার অধিকার তো নেই। তাও উনি দয়া করে থাকতে দিচ্ছে এটাই অনেক। এর উপর একটা চাকরিও দিয়েছে। আমি মেস বা হোস্টেল খুঁজে উঠব। আপাতত দাদীর দেওয়া টাকা দিয়ে উঠব তারপর বেতন থেকে দিতে পাড়ব। এইজন্য আমার টাকা আনতে যেতে হবে। প্লিজ দোস্ত মানা করিস না। আংকেল আন্টি অনেক আদর করে বলে।তাদের সামনে লজ্জা না লাগলেও তোর ভাইয়ের সামনে যেতে আমার সত্যি লজ্জা লাগে।”
“আচ্ছা যা তাহলে।”
মৃণাকে মহুয়া রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করল। তারপর তার পিছু নেয়। তাকে ওই শয়তান মহিলার সাথে একা সে মোটেও ছাড়বে না। সে সাবধানেই তার স্কুটি চালাচ্ছিল। হঠাৎ করে তার পিছনে কতগুলো বাইক আসতে শুরু করে। প্রথমে সে বিষয়টিকে পাত্তা না দিলেও একসময় সে খেয়াল করে বাইকগুলো তারই পিছু নিচ্ছে। এর মধ্যে একটা বাইক।খুব দ্রুত তার পিছনে থেকে পাশে এসে পড়ে আর হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়ায়। সাথে সাথে সে ব্রেক লাগায়। নীল বাইকটি থেকে নেমে আসে একটি কালো গেঞ্জির উপর কালো জ্যাকেট পরা ছেলে।
মহুয়া চিল্লিয়ে উঠে, “ম’রার শখ জাগলে অন্য কোথাও যেয়ে মরতে পাড়িস নি? আমার স্কুটির সামনেই আসা লাগলো?”
ছেলেটি হেলমেট খুলে। মহুয়া শায়ানকে দেখে বিরক্ত হয়। এখন আফসোস হচ্ছে তার ব্রেক কষে। একে উড়িয়ে দিলেই ভালো হতো। সে দেখে পিছনের আরও চারটা বাইক থেকে সাতজন ছেলে নেমেছে। সব তাসিনের বন্ধুবান্ধব। তাসিনের সাথে আগে দেখেছে। সে শুনেছিল শায়ান তাসিনের বন্ধু। ওদিন নাম শুনেও ব্যাপারটা মাথায় আসে নি। তাহলে এটাই সে শায়ান যার সাথে জাহান ও তাসিনের বন্ধুত্ব ছিলো। কিন্তু শায়ানের তার সাথে কী কাজ? তাকে আটকালো কেন?
মহুয়া বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী চাই?”
শায়ান হেলমেটটা বাইকের উপর রেখে হাতের গ্লাভস খুলতে থাকে। এগিয়ে বলে, “শুনেছিলাম তোমার খুব তেজ। লন্ডন থেকে কৌতুহল নিয়ে এসেছিলাম তোমায় দেখতে। বাট স্যাডলি কিছুই সত্যি পেলাম না। একদম ভেজা বিড়াল তুমি।”
“ভাই দেখো আমার তোমার সাথে কথা বলার দুই পয়সার ইন্টারেস্ট নেই। আজকাল আমার মুড ভালো সো স্টে আওয়ে।”
“মুড ভালো? জাহানের জন্য? তোমার মনে হয় ইয়াজভান জাহান তোমার মতো একটা মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন কাটাবে? এমন কী আছে তোমার মধ্যে? খোঁজ নিয়ে দেখলাম না তুমি আমাদের লেভেলের রিচ, না বেশি বুদ্ধি আছে আর… ” শায়ান হেসে তার দিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকায়, “না এত এক্ট্রাক্টিভ। তোমার থেকে কত এক্ট্রাক্টিভ মেয়ে আমি ধরি আর বিছানায় এক রাত কাটিয়ে ছেড়ে দেই।”
মহুয়া উওর দেয় না। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে।
শায়ান আবার বলে, “তুমি কী জাহানের টাকা দেখে ওকে আকর্ষণ করতে চাইছ? ওর থেকে বেশি টাকা আছে আমার কাছে। সাথে ক্ষমতাও।” সে মহুয়ার স্কার্ফ ধরে হাত বুলায়। এবার কাছে এসে তার দিকে ঝুঁকে তার কানে বলে, “কাম অন বেবি তোমার কেবল একরাত আমার সাথে কাটালেই হবে। ওর মতো এত সময় আমার পিছনে খরচ করা লাগবে না। তুমি যত টাকা চাও তত টাকা দিব সাথে তোমার ভাইয়ের কোম্পানির সাহায্য করব। আমার এত ক্ষমতা আছে। ভাবতে পারো তোমার এত মূল্য কেন? কারণ জাহান তোমার প্রতি আকর্ষিত হয়েছে। আমিও দেখতে চাই যে ছেলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েকে নাচক করেছে দিয়েছে সে তোমার প্রতি আকর্ষিত হলো কীভাবে?”
শায়ান কথাগুলো বলে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পূর্বেই মহুয়া এক কষিয়ে চড় মাড়ল তার গালে।
মহুয়ার পিছনে দাঁড়ানো ছেলেগুলো দৌড়ে আসতে চাইল। শায়ান তার হাত উঁচু করে তাদের থামাল। মহুয়ার দিকে তাকাল র’ক্তিম দৃষ্টিতে। তার নীলাভ চোখের মণির আশপাশটা লালচে হয়ে গেছে খুব দ্রুতই। সে রাগে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই জানিস আমি কে? কত বড় সাহস তোর তুই শায়ান শিকদারের উপর হাত তুলেছিস। আমার বাবা পর্যন্ত আমার উপর আজ পর্যন্ত হাত তোলার সাহস পায় নি আর তুই…”
“এজন্যই তো এত বেয়াদব হয়ছিস। মেয়েদের সম্মানটুকু করতে পাড়িস না। আর তুই কে আমি জেনে কি করব? প্রধানমন্ত্রী হলেও আমার কিছু আসে যায় না। ফারদার আমার সামনে এসে এসব কথা বললে জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।”
মহুয়া যেতে নিলে শায়ান তার হাত ধরে নেয়। গতকালের ক্ষত স্থানে। মহুয়া আঁতকে উঠে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। সে শায়ানের চোখে চোখ রাখে। শায়ান রাগে কটমট করে বলে, “আমার সাথে তুই-তুকারি করছিস? তোর ভাইয়ের কোম্পানি ডুবাতে আমার কয়দিন সময় লাগবে জানিস?”
“এই সবাই আমার ভাইয়ের পিছনে পড়ে আছিস কেন বল তো? আমার সাথে কিছু হলে আমার ভাইকে নিয়ে টানাটানি। আমার সাথে তর্কের সাহস নাই না’কি? যা করার কর যা। আমার ভাই নিজের জন্য সবার পূর্বে চিন্তা করতে শিখিয়েছে। আমার ভাই যদি জানে তুই আমাকে কী বলেছিস ভাই নিজেই তোর খুন করে দিবে। তোর বোন আছে? তাহলে তোর বোনকে কারো কাছে একরাতে জন্য পাঠিয়ে…”
“খবরদার আমার বোনকে নিয়ে বাজে কথা মুখেও আনবি না।” হুঙ্কার দিয়ে উঠে শায়ান।
“আর তুই আমাকে নিয়ে যা তা বলতে পাড়িস তাই না? আমি কারো বোন না? তোদের মতো ছেলেদের কাছে মেয়েদের সম্মান হাতের ধূলা হতে পারে কিন্তু আমার কাছে আমার সম্মান সবচেয়ে মূল্যবান। আমার সম্মান ও চরিত্রে দাগ লাগার আগে আমি হয়তো সামনের জনের জীবন নিয়ে নিব অথবা নিজের জীবন দিয়ে দিব।”
শায়ানের হাতের মুঠো হাল্কা হয়। তার শক্ত চোয়াল স্বাভাবিক হয়ে উঠে। র’ক্তাক্ত দৃষ্টি নরম হয়।
মহুয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে বলে, “আমার সামনে এসব টাকা ও ক্ষমতা দেখাতে আসবে না। জেরিন মহুয়া এসবকে ভয় পায় না।”
সে নিজের স্কুটির কাছে যেয়ে বিড়বিড় করে বলে, “এই গোরিলার জন্য দেরি হয়ে গেল। ধ্যুর ভাল্লাগে না।” সে নিজের হেলমেট ঠিক করে পড়ে উঁচু স্বরে বলে, “গোরিলামার্কা চেহেরাটা দেখে মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। তোমাদের মতো ছেলে আমার চরম অপছন্দ।”
মহুয়া স্কুটি ঘুরিয়ে নেয় উল্টো দিকে। জোরে স্টার্ট দিয়ে ছেলেদের সামনে দিয়ে নিয়ে যায়। ওরাও ভয়ে পিছিয়ে
যায়। সে তাদের জিহ্বা বের করে ভেঙিয়ে সামনে দিয়ে চলে যায়।
মুহিব শায়ানের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “শায়ান ভাইয়া আপনি মেয়েটাকে যেতে দিলেন কেন? দেখেছে ও কত বেয়াদব?”
শায়ান হাসে,”এখন বুঝতে পাড়ছি। জাহান কীভাবে ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড হলো।ওর এই সাহস দেখে জাহান প্রেমে পড়েছিল তাই না? এই সাহস জুতার নিচে মিশিয়ে দিব। শায়ান শিকদারকে এখনো চিনতে পাড়ে নি।”
“ওর ভাইয়ের কোম্পানির খোঁজ নিব?”
“না। ও বলে গেল না ওর সাথে দুশমনির সাহস নেই আমার? ওর উপরই সব আ’ক্রমণ করব। দেখি কতটুকু সহ্য করতে পারে।”
“আপনি বললে উঠিয়ে আনব।”
“প্রয়োজন নেই। শায়ান শিকদার কোনো মেয়েকে জোর করে কাছে আনে না। এটা আমার নীতির বাহিরে। মেয়েরা নিজে আসে আমার কাছে। মেয়েজাতই লোভী, বেঈমান। মুখে যত বলুক ও আমার টাকা আর ক্ষমতার কাছেই ঝুঁকবে। প্রায় সব নারীই বেঈমান।” সে মহুয়ার যাবার পথে তাকায়, “জাহান কেবল একটি নারীকেই ভালোবাসতে পাড়বে মিস জেরিন মহুয়া। আর সে মেয়ে তুমি হতে পাড়বে না। জাহানকে এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি কিন্তু যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি সে জাহানকে ভালোবাসে। তাই জাহান কেবল তার হতে পাড়বে। কেবল তার।”
চলবে….
মেঘের খামে…
পর্ব ১৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মৃণা কলিংবেল দেওয়ার পর দরজা খুলে তার ছোট ভাই। তাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৌড়ে যায় রুমের ভেতরে। মৃণা সেদিকে ধ্যান দেয় না। নিজের রুমে যায় সোজা। মাঝরাস্তায় তার আরেক ভাইয়ের সাথেও দেখা হয়। সে কারো সাথে কথা বলে না। সোজা রুমে যেয়ে আলমিরার পিছন থেকে একটি পলিথিন বের করে। এখানে বারো হাজার টাকা বাকি আছে। সে টাকা একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে তার বাকি প্রয়োজনীয় জিনিস ঢুকাতে থাকে। এমন সময় এসে হাজির হন রুবিনা খাতুন। তাকে দেখেই রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে যায়।
“তুই কোন সাহসে আমার বাড়িতে পা রেখেছিস? তোর জন্য আমাদের জীবন নরক হয়ে গেছে। আমার কী অবস্থা, ঘরের কি অবস্থা, তোর বাবার চাকরি গেল, এখন এই ঘরের মালিক আমাদের রাখবে না। কই যাবো আমরা?”
যখন সে দেখল তার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মৃণার, তখন সে তেড়ে গেল মৃণার কাছে। তার চুলের মুঠি ধরে বলল, “তোর কানে কথা যায় না? তুই আজই যেয়ে তোর ওই বান্ধবীকে বলবি যেন তোর বাপের চাকরি, এই বাড়ি সব ফিরিয়ে দেয়। আর ওই হারামজাদি যেন আমার কাছে এসে পা ধরে মাফ চায়। দেখ…দেখ আমার হাত পা’য়ের কী অবস্থা করেছে!”
মৃণা ব্যাথায় প্রথমে আঁতকে উঠে। কিন্তু আজ সে তা সহ্য করে না। শক্ত করে ধরে রুবিনা বেগমের হাত। কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় রুবিনা খাতুনের দিকে। রুবিনা খাতুন বিস্ময়ে তাকান, “তুই আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস? এত বড় কলিজা হলো তোর!”
“আমার বান্ধবীকে গালি দেওয়ার সাহস আপনি কোথা থেকে পেলেন? একদম ঠিক করেছে ও। এতটুকু ব্যাথা আপনার সহ্য হচ্ছে না আর আপনি যে সে দশ বছর বয়স থেকে আমার উপর অত্যাচার করছেন তার কী? দশ বছর বয়সের বাচ্চার উপর আপনার রহম হয় নি। খুন্তি দিয়ে কি নির্মমভাবে আমার পিঠ পুড়িয়েছিলেন মনে আছে? আপনার মনে না থাকলেও আমার আছে। দাগ আছে এখনো আমার শরীরে। এমন কত আঘাত এখনো আমার আপনার অত্যাচারের কথা মনে করায়। তাও আমি কেন আপনার সাহায্য করব?”
রুবিনা খাতুন অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন মৃণার দিকে। তার চোখে আজ ভয় না দেখতে পেয়ে কুঁকড়ে গেলেন। সে মৃণার চুলের মুঠি ছেড়ে দিলে। তবুও ঝাঁজালো গলায় বললেন, “আচ্ছা যা তোর সাথে আর কিছু করব না। তোর বিয়েও দিব না। আগের মতো এখানে চলে আয়। আর তোর বান্ধবীকে বল যেন…”
“আমি কিছু বলতে পাড়ব না। আপনারা যা করেছেন তার শাস্তি আপনার ভোগ করতেই হবে। আমি আপনাদের সাথে থাকবোও না।”
“তুই এত স্বার্থপর মৃণা? এতদিন দুধভাত দিয়ে কালসাপিনী পেলেছি। তোর বাপ ভাইয়ের কথাও ভাবলি না?”
“আমার কেউ নেই। আমার পরিবার বলতে দুইটা বান্ধবী আছে মাত্র। যেদিন আপনি আমাকে প্রথম মেরেছিলেন আর আমার বাবা চুপ ছিলো। সেদিনই সে ম’রে গেছে আমার জন্য। আর আমাকে পেলেছেন আপনারা? এই বাসায় কাজ করে খেয়েছি। যদি কাজের হিসাব করি তাহলে আপনার থেকে হিসাব পাওয়া আছে।”
“এত্তো বড় সাহস তোর…” রুবিনা খাতুন হাত উঠাতে নিলে মৃণা বলে, “ভুলেও এমন কাজ করবেন না, নাহয় এবার পুলিশের কাছে থাকতে হবে আপনার।”
“তুই আমাকে পুলিশে দিবি? তোর মুখ এত চলতে শুরু করেছে?”
“মানুষের ধৈর্যের সীমানা থাকে। সেদিন আমাকে বিক্রি করে আমার ধৈর্য্য শেষ করে দিয়েছেন আপনারা। এখন আমি অনাথ। আপনাদের কারো সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এখন থেকে আমার জীবন আমি নিজে সাজাবো। আপনাদের কারো এই জীবনে না জায়গা আছে, আর না অধিকার।”
মৃণা শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল। ডাইনিং রুমে এখনো তার ভাই বড়টা দাঁড়িয়ে আছে। মৃণা যাবার সময় সে হঠাৎ বলল, “সরি আপু। আমিও মা’য়ের সব দোষ দেখেও চুপ থেকেছি। ভাই হওয়ার দায়িত্ব পালন করিনি।”
মৃণা থেমে গেল। তাকাল তার ভাইয়ের দিকে। সে ক্লাস এইটে পড়ে। বাচ্চা মানুষ। তাদের কখনো দোষারোপ করেনি মৃণা। দায়িত্ব পালনের বয়স তাদের হয় নি। মন গলতে শুরু করে মৃণার। তার দুই ভাইয়ের তো দোষ নেই। তাদের কষ্ট পাওয়া কী উচিত হবে? দুর্বল হবার পূর্বেই মৃণা বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রিক্সা নিয়ে চলে যায় না ফেরার উদ্দেশ্যে।
তার রিক্সায় উঠার পরই মহুয়া আসে। তাকে সঠিক অবস্থায় যেতে দেখে হাসে। তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল মৃণাকে নিয়ে। হয়তো মোহ ঠিকই বলেছিল কষ্ট পেয়েই শক্ত হতে হবে মৃণাকে। যেমনি আগুনে পুড়ে স্বর্ণ হয় তেমনি কষ্টে পুড়েই মানুষ সাহসী হতে পারে। মহুয়াও সিদ্ধান্ত নেয় এখন থেকে মৃণার সব কাজে নাক গলাবে না। ওর জীবন ওকে গুছাতে দিবে। ভুল করলে শিখতে দিবে। সবসময় রক্ষা করবে না, যেন মৃণা নিজেকে রক্ষা করা শিখতে পারে।
.
.
রোজ শুক্রবার। মোহ তৈরী হয়েছে মিতার কাবিনের উদ্দেশ্যে। তার ইচ্ছে ছিলো না বেশি তৈরি হওয়ার। কিন্তু মা’য়ের জোরাজোরিতে হওয়া লাগল। তার কথা নতুন বউ, বোনের বিয়েতে তৈরি না হলে হবে না। মানুষ কথা বলবে। সে তৈরি হলো কিন্তু তবুও মানুষ কথা বলছে। বোধহয় আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে তাদের পরিবারই নতুন গবেষণার পাত্র। সে বের হতেই প্রথমে তার চাচী তাকে ধরল, “কী’রে মোহ কী অবস্থা তোর?”
“ভালো চাচী। আপনি ভালো আছেন?”
“ভালো কীভাবে থাকি বল? গতসাপ্তাহে যেভাবে মিতার জায়গায় তোর বিয়ে করা লাগল একথা শুনে তো আমার ঘুমই হারাম হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম আপদটা বিদায় হলে তোকে নিজের ঘরের বউ করে নিব। ভাইয়ের সাথে কথা বলব। কিন্তু তোর বোন এমন হতে দিলো কই?” বলে আফসোসের নিশ্বাস ফেলে, “তোদের সব চাচাদের পরিবারের মধ্যে একমাত্র তুই আমার পছন্দের ছিলি রে। ভেবেছিলাম তুই যে সুন্দর তোর কপালও এমন সুন্দর হবে কিন্তু শুনেছি জামাই না’কি বুড়ো। অসুস্থ ছিলাম বলে আসতে পারি নি তাই ছেলে দেখে নি। কি কথাটা সত্যি না’কি রে?”
“না চাচী এমন কিছু না।”
“কি না তোর চাচা বলেছে তোর থেকে দশ বারোবছরের বড়। আমার ছেলেটা কি সুন্দর ছিলো। তোর সাথে কি মানাতো।”
এমন সময় সেখানে এসে হাজির হয় সমুদ্র। অচেনা এক মহিলার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে হাসলো। বলল, “আমাকে কি সত্যি এত বুড়ো দেখা যায় না’কি মধু?”
সে এসে দাঁড়ায় মোহের পাশে। মোহ তাকাল তার কথা শুনে। কালো রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে দেখে মুগ্ধ হল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার চোখ ফিরল না।
চাচী উপর থেকে নিচ পর্যন্ত যাচাই করল সমুদ্রকে বারেবারে। আমতা-আমতা করল, “মোহ এটা তোর জামাই?”
মোহের ধ্যান ভাঙল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। সাথে সাথে মহিলাটি লজ্জায় বাঁধল। বলল, “জামাই বাবাজি আমি তোমার চাচীশাশুড়ি। লোকের কথা শুনে বলেছিলাম। কিছু মনে করো না।”
তিনি লজ্জা পেয়ে চলে গেলেন।
সে যেতেই আরো দুইজন এলো। একজন বলল, “এই মোহ তোর না’কি বিয়ে হয়ে গেছে সত্যি?”
মোহ জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়ায়।
অন্য মহিলাটি বলে, “মিতার কান্ড শুনেই চলে গিয়েছিলাম। তোর মা’কে বলেছিলাম মেয়েটাকে লাগাম দিতে শুনল কই? দেখ ওর জন্য তোর মতো মেয়ে আমাদের থেকে হাতছাড়া হয়ে গেল।”
প্রথমজন আবার বলল, “আজ খেয়াল রাখিস। আবার না পালায়।”
“আন্টি আপনারা খেয়েছেন?” মোহ কথা এড়াতে জিজ্ঞেস করে।
সমুদ্র তখনই বলে উঠে, “মধু শুধু কথাই বলবে? না’কি এগুলো কোথায় রাখবো বলবে? হাত ব্যাথা হয়ে গেলো তো।” সমুদ্র মিষ্টির প্যাকেট দেখিয়ে বলে।
একজন মহিলা তখনই বলে, “এইটাই জামাই না? সুন্দর আছে। তোর সাথে তো অনেক মানিয়েছে মোহ। তোর মতো সুন্দরী মেয়ের সাথে এত সুন্দর ছেলেই যায়।”
“আপনারা খাওয়া-দাওয়া করুন আন্টি আমি আসি।”
“তোর মতো ভালো মেয়ে পাব না ভেবেই তো খাওয়া দাওয়া উঠে গেছে।”
মোহ সমুদ্রকে রান্নাঘরে নিয়ে যাবার সময় রাস্তায় আরও তিনজনের সাথে দেখে হলো। তাদের সাথে কথা মিটিয়ে মোহ সমুদ্রকে রান্নাঘরে। মিষ্টি রাখতে। সমুদ্র সব রেখে বলে, “আমার কাঁধ ব্যাথা হয়ে গেছে। মানুষরা এত কথা বলে কেন? ভাইকে পালালো না পালালো, কার সাথে কার বিয়ে হলো এসব নিয়ে এদের এত ইন্টারেস্ট কেন? কিন্তু তোমার তো দেখি হাই ডিমান্ড মধু। ছেলেরা বাদ দেও ছেলের মা’য়েরাও লাইন মারে। ইম্প্রেশিভ।”
মোহ আড়চোখে তাকায় তার দিকে। কিছু বলে না বিরক্তি নিয়ে বের হয় রান্নাঘর থেকে।
ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে তার শশুড় শাশুড়ী বসে আছে। তার বাবার সাথে কথা বলছিস। তাকে দেখেই তার শাশুড়ী উঠে দাঁড়ায়। মোহের দিকে তাকায় মুগ্ধ হয়ে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকায় মোহের দিকে, “মোহ মামণি এই নীল শাড়িতে তো তোমাকে নীল পরী লাগছে একদম। কারো নজর না লাগুক।”
সে মোহের বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বেয়াই সাহেব আপনার মেয়েটাকে দেখলে আমার ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ নিজের কাছে যত্নে রেখে দিতে।”
সমুদ্র তখন বলে, “নিজের ছেলেকে নিয়ে তো এ ভাবনা কখনো তোমার এলো না।”
তার মা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, “আমার তো মেয়েরই ইচ্ছা ছিলো সবসময়। আল্লাহ তোকে দিয়ে দিলো।”
“এমন আফসোসের ভঙ্গিতে বলছো কেন?”
“তোর কি হিংসা হচ্ছে না’কি?”
“সে যাই হোক, সারাক্ষণ ওকে নিজের কাছে রাখলে তো হবে না গো মা। মধু এখানে ওখানে মিলিয়ে থাকবে। মিতা চলে গেলে তো আংকেল আন্টি একা হয়ে যাবে তাই না?”
কথাটা শুনে মোহ তাকাল সমুদ্রের দিকে। মুগ্ধ নয়নে তাকাতেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তার কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো মোহের।
সমুদ্রের মা বললেন, “তা তো বটেই। আমি তো ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। মোহ তো এখনো এমনিতেও ছোট। মা বাবা থেকে বেশিদিন দূরে থাকলে ওর মনও খারাপ হবে। আর ওর হাসি আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। ও হাসলে ওর চোখদুটো আরও সুন্দর লাগে। আমারও দেখতে ভালো লাগে।”
মোহের তখন আফসোস হলো। সমুদ্র যদি আগে কখনো কাওকে ভালো না বাসতো তাহলে তার জন্য কত পার্ফেক্ট ছিলো সে। পার্ফেক্ট ছিলো তার পরিবার। অথচ এই একটি কারণে তার কাছে এই সম্পর্ক কি নিজের জীবনও এলোমেলো লাগছে।
সমুদ্র মোহের বাবাকে বলে, “আংকেল মধু হয়তো আপনাকে বলেছি আগামীকাল… ”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও। তোমাদের একে অপরের সাথে সময় কাটানোও উচিত। তাহলেই তো চিনবে জানবে। তবে একটা শর্ত আছে। আংকেল না আব্বু ডেকো। আমাদের তো ছেলে নেই। তোমরাই তো এখন আমাদের ছেলে।”
“জ্বি। এখন জলদি বলুন কি কি কাজ বাকি আছে?”
“কি বাকি থাকবে। তুমি তো দুইদিন ধরে আমার সাথে ছিলে। সব এত সুন্দর মতো সামলে নিয়েছ।” মোহের বাবা তার কাঁধে হাত রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
মোহ সমুদ্রের দিকে তাকায় নয়ন দুটোয় কিছুটা বিস্ময় নিয়ে। তাকে যতটা ছন্নছাড়া মনে হয়, হয়তো সে এতটাও নয়। দায়িত্বশীল আছে। মোহ তাকায় তার বাবার দিকে। মোহ তার বাবা মা’কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার জন্য পৃথিবীতে তাদের মতো মূল্যবান আর কিছু নেই। তার বাবা নরম মনের মানুষ নন এতটা। কিন্তু তার সন্তানদের জন্য সে প্রচুর নরম। বিশেষ করে তার জন্য। সে-ও ছোট থেকে তাকে গর্বিত করতে অপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এমন কোনো কাজ করে নি যার কারণে তার বাবা মা’কে লজ্জিত হতে হবে। তাদের সন্তুষ্টির জন্য সে সব করতে পারে। তাইতো হঠাৎ বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবে নি। আর সে সন্তুষ্টি সমুদ্র দুইদিনে অর্জন করে নিলো? কীভাবে? সে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল সমুদ্রের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে আপনা-আপনি হাসি এঁকে উঠে।
তারা বাসার কাজ সেরে যায় সেন্টারে। মোহ গতবার গেইট ধরেছিল। টাকাও সে উসুল করেছিল। কিন্তু অবশেষে তার বউ হবার কারণে তাকে একটা টাকাও দেয়া হয় নি। এই দুঃখে এবার সে গেইটই ধরে নি। সে মেহমানদের দেখাশোনায় ব্যস্ত। যদিও সে শর্ত রেখেছিল সে কোনো কাজই করবে না এই অনুষ্ঠানে কিন্তু সে নিজের মা বাবাকে চিন্তায় দেখতে পাড়ে না তাই সে-ই মেহমানদের দেখতে শুরু করল। এরই মধ্যে তার পাশে এসে উপস্থিত হলো সমুদ্র। তার হাত ধরে এক বান্ডিল টাকা গুঁজে দিলো লুকিয়ে।
মোহ হতবাক, “এটা কী?”
“মধু তুমি কী বয়রার সাথে অন্ধও না’কি? টাকা পর্যন্ত চিনতে পাড়ছো না? এত খারাপ পর্যায় এসে পড়েছে? আয়হায় তোমাকে নিয়ে আগামীকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
“আমার চোখ আর কান দুইটাই সহি সালামত আছে। আপনি আমাকে টাকাটা কেন দিচ্ছেন তা জিজ্ঞেস করছি।”
“তুমি তো গেইট ধরতে যাও নি। তুমি একমাত্র শালী, তোমার হক সবার আগে। তাই আহিনকে ব্লাকমেইল করে তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। তুমি সব পিচ্চিগিচ্চিদের মধ্যে ভাগ করে দিও।”
মোহ বিরক্তির ভঙিতে শুধায়, “আমি পাড়ব না।”
“ছিঃ মধু! তুমি এতটুকু পিচ্চিগিচ্চিদের হক মেরে সম্পূর্ণ টাকা নিজের কাছে রাখতে চাইছ? ওদের অভিশাপ লাগবে।”
মোহ চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকায়। এমন সময় আরিশ আসে সেখানে। ডাক দেয়, “মোহ…”
মোহ ডাক তার দিকে তাকায়, “কেমন আছেন ভাইয়া?”
আরিশ সংশয় নিয়ে তাকায় তার দিকে। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। জোরপূর্বক হেসে বলে, “আছি কোনো একরকম। তুমি ঠিক আছো? হ্যাপি আছো?”
প্রশ্ন করে আরিশ আড়চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে। মোহ বুঝতে পাড়ে আরিশ তার বিয়ে সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে। সে বিয়েতে সুখে আছে কি নেই এটা এখনো সে জানে না। কিন্তু অবশ্যই তার পারিবারিক ব্যাপার সে বাহিরের লোকের কাছে বলতে যাবে না।
সে মিষ্টি হেসে উওর দেয়, “জ্বি ভাইয়া, হ্যাপি আছি।”
উওরটা যেন আরিশের পছন্দ হলো না। তার ঠোঁটের হাসি উল্টো উড়ে গেল। সে কেবল বলল, “ওহ আচ্ছা। তোমার কোনো সমস্যা হলে জানিও। আমার আহিন ও মিতার সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না। থাকলে হয়তো…. ” বলে আরিশ গভীর নিশ্বাস ফেলে। তারপর আবার বলে, “আচ্ছা আমি ওদিকের কাজ দেখে আসি।”
আরিশ যাবার পর সমুদ্র বুকের উপর হাত ভাঁজ করে তার যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে ধ্যান সহকারে। বলে, “এবার বুঝলাম।”
মোহ তাকায় তার দিকে, “কী বুঝলেন?”
“আমিও ভাবছিলাম এই লোককে চিনি না, জানি না কিন্তু আসার পর থেকে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলো যেন পাড়লে আমাকে বারবিকিউ করে ফেলে। কারণটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। এখন বুঝলাম, কারণটা তুমি। তোমাকে পছন্দ করে, তাই না?”
“হ্যাঁ করতো। কয়েকবছর ধরে প্রতিমাসে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো।”
“আর আমার কারণে তার পাতা কেটে গেছে। তোমার পছন্দ না’কি? একবার আমাকে বলো আমি সেটিং করিয়ে দিব।”
মোহ তার দিকে তাকায় সরু দৃষ্টিতে, “এরপর আর অতিরিক্ত কথা বললে আমি আপনার মাথার সেটিং নষ্ট করে দিব। এখন বিরক্ত না করে যান। আমিও যাই, কাজ আছে।”
মোহ যেতে নিলে সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়। মোহ পিছনে ফিরে একবার কপাল কুঁচকে তাকায় তার হাতের দিকে, আবার সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র শান্ত স্বরে বলে, “আমি জানি তোমার মন মানসিকতা আজ এত ভালো নয়। হঠাৎ তোমার সাথে যে ঘটনা ঘটেছে এর কারণে ভালো না হওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু আজ তোমার বোনের জন্য অনেক বিশেষ দিন। তোমার এমন মন খারাপ থাকলে ওর ভালো লাগবে না। আরও উল্টো সবাই ওকে খারাপ কথাও শোনাবে। আর তোমার বাবা যদি ওকে ক্ষমা করতেও চায় তাও তোমার মলিন মুখখানা দেখে পাড়বে না। সো প্লিজ স্মাইল, মিথ্যে হলেও। অন্তত তোমার বোনের জন্য।”
মোহ হাসল জোর করে। মাথা নাড়িয়ে তার কথার সম্মতি দিলো।
সুন্দর মতো বিয়ে সম্পূর্ণ হলো তাদের। সারাদিন মোহ সবার খেয়াল রাখল, কাজ সামলাল, নিজের দায়িত্ব পালন করল। কিন্তু বিদায়ের সময় মোটেও বাহিরে দাঁড়াল না। মিতার আশেপাশেও এলো না। সে নিজের বোন হবার দায়িত্ব পালন করেছে কিন্তু মিতাকে ক্ষমা করে নি। তার এক ভুলের জন্য মোহের সম্পূর্ণ জীবন ওলট-পালট হয়ে গেছে অথচ মিতা একবার ক্ষমাও চায় নি।
.
.
পরদিন বৌভাত শেষ হবার আগেই মোহ বাসায় এসে ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি। তার মনে হচ্ছে সে এক তীরে দুই শিকার করছে। একতো এখান থেকে গেলে তার আত্নীয়দের সমোচলনা থেকে মুক্তি পাবে, কাউকে নারাজ না করেই। এর উপর সে কখনো ঢাকার বাহিরে ভালোভাবে ঘুরতে যায় নি। এখন সে চট্টগ্রামের সাথে সাথে কক্সবাজারও যাবে তাই সে ভীষণ উৎসুক।
সবার কাছে সেন্টার থেকে বিদায় নিয়ে আসায় সে দ্রুত জামা পরিবর্তন করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়। দেখে সমুদ্র তার জন্য বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে। সে বাসা লক করে সমুদ্রের কাছে আসে। তাকে দেখে বলে, “আপনি কোনো ব্যাগ নিবেন না?”
সমুদ্র তার কাঁধের ব্যাগটা দেখিয়ে বলে, “এটা কী?”
“দুইদিনের জন্য এতটুকু নিবেন?” তার কন্ঠে যেন চরম অবিশ্বাস। সমুদ্রও তার মতো ব্যঙ্গ করে তার একটা সুটকেস আর একটা বড় ব্যাগ দেখিয়ে বলে, “দুইদিনের জন্য এতটুকু নিবে?”
মোহ মুখ বানায় প্রথমে। তারপর মুখ ঝামটে এগিয়ে গেল।
সমুদ্র রিক্সা ডাকলে মোহ উঠে প্রথমে। তারপর সমুদ্র। সমুদ্র তার পাশে বসতেই মোহের সম্পূর্ণ দেহের শিরায় শিরায় কেমন শিহরণ উঠে যায়। কাচুমাচু হয়ে যায় সে। সে সরে বসতে চায় কিন্তু রিকশায় এতো জায়গা পায় না। এই প্রথম কোনো পুরুষের এতটা কাছে বসেছে সে। বুঝ হবার পর থেকেই সে পুরুষ সঙ্গ এড়িয়ে চলতো। এমনকি কোনো কাছের ছেলেবন্ধুও নেই তার। হয়তো একারণেই সমুদ্রের এত কাছে থাকায় তাকে লজ্জায় ঘিরে ধরেছে।
আড়চোখে তাকায় মোহ সমুদ্রের দিকে। শ্যামবর্ণ তার স্বামীটা সত্যিই ভীষণ সুদর্শন। কবুতরের ন্যায় সরু চোখ, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি কপাল ছুঁয়ে যাওয়া চুল, জিম করা পেশিবহুল দেহ। অথচ তার চোখ যেয়ে আটকায় তার গলার ডানপাশের তিলটির দিকে। শার্টের প্রথম বোতামগুলো খোলা রাখলে যা স্পষ্ট দেখা যায়। ভীষণ আকর্ষণীয় লাগে তার কাছে এই তিলটি। সমুদ্র তার দিকে তাকাতেই মোহ চোখ ফিরিয়ে নেয়। লজ্জায় সে মিইয়ে যায়।
সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, “তুমি কী দুপুরে কিছু খেয়েছ?”
মোহ অন্যদিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ায়, “এত ভারী খাবার খেয়ে জার্নি করলে খারাপ লাগবে।”
“তাহলে তোমার জন্য কিছু কিনে নিব বাসে উঠার সময়। চট্টগ্রামে যেয়ে তোমাকে মেজবান খাওয়াবো। চট্টগ্রামের খাবার বেস্ট। আমরা চারজন যখনই চট্টগ্রামে যেতাম ঈশা প্রতিবার এত মজার মজার খাবার খাওয়াতো… উফফ। আজ তো সময় পাবে না, নাহলে দুইদিনে তোমাকে খাইয়ে ফুলিয়ে দিতো।”
“আজ যার এনগেজমেন্ট?”
“রাইট।”
“আর চারজন কে?”
“আমি, তুষার ভাই, লামিন আর জবাফুল।”
জবা নামটা শুনে মোহের মনটা উদাসী হয়ে গেল। সে ঠোঁট গোল করে শুধু উওর দিলো, “ওহ।”
“আমরা স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। আর কলেজে উঠার সময় তুষার ভাই আমাদের সিনিয়র ছিলেন। ঈষার সাথে রিলেশনের পর উনিও আমাদের সাথে থাকতেন। সবসময়। লাইফের বেস্ট সময় ছিলো। তুমিও ইনজয় করে নেও। একসময় এই দিনগুলো হারিয়ে যাবে। অনেক মনে করবে এইদিনগুলো, কিন্তু আর ফিরে পাবে না।”
বাসে করে চট্টগ্রামে যেয়ে উঠতে উঠতে দুপুর থেকে রাত হয়ে গেল। সমুদ্র ঘুমাল আরাম করে কিন্তু মোহের একবিন্দুও ঘুম এলো না। সে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে লাগলো। যখন তারা অর্ধেক পথ পেরিয়ে এলো তখন মোহের মাথায় এলো সেখানে তো সমুদ্রের প্রাক্তনও থাকবে। এর উপর সমুদ্রের বন্ধুরা তাকে নিশ্চয়ই ভীষণ অপছন্দ করবে। যেহেতু তারা জবারও বন্ধু। তাদের দুইজনের সম্পর্ক এত কাছ থেকে দেখার পর তাকে দেখে নিশ্চয়ই তারা খুশি হবে না। এর উপর অনুষ্ঠানে থাকবে জবা। তার স্বামীর প্রাক্তনের সাথে কী করে কথা বলবে সে? কী বলবে? এই কথা তার মাথায় আগে এলো না কেন? ঘুরতে যাবার উৎসুকতায় সব ভুলেই গিয়েছিল সে।
.
.
শনিবার দুপুরে তো মহুয়া আরামে নিজের বিছানায় ছড়িয়ে শুয়ে কে-ড্রামা দেখছিল। হঠাৎ তার ফোনে কল আসে। সে এত কল ধরে মুখে পপকর্ণ নিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “কে?”
ফোনের ওপাশ থেকে আশে ভারী কন্ঠ, “কি ম্যাডাম হ্যালো, হাই, সালাম কিছু না, ডাইরেক্ট কে?”
মহুয়া জাহানের কন্ঠ বুঝে জিজ্ঞেস করে, ” এই দিন দুপুরে কী চাই?”
“উফফ জান একটু মিষ্টি করেও তো জিজ্ঞেস করতে পাড়ো।”
“না বললে ফোন রাখলাম।”
ফোন রাখতে যেতেই জাহান বলে, “এই দাঁড়াও, তুমি না বলেছিলে আমাকে ট্রিট দিবে। আজ নিব। তোমার গলির সামনে আছি এসে পড়ো।”
“আজ পাড়ব না।”
“তুমি না আসলে আমি তোমার বাসায় এসে পড়বো।”
“আসো। আমার ভাই তোমার মতলব জানলে তোমার ধুমতানা তুমতানা বাজিয়ে দিবে।”
জাহান বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে। এই মেয়ের কি কিছুতেই ভয় লাগে না? সে বলল, “জান দ্রুত আসো।একটা ক্যাফেতে নিয়ে যাব ওখানে অনেক মজার খাবার পাওয়া যায়। বেস্ট।”
মজার খাবারের কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠে বসে, “ওদিন এত মজার খাবার খাওয়ালে তাই তোমার টেস্টের উপর আমার ভরসা আছে। দশ মিনিটে আসছি।”
মহুয়া উঠে গতরাতের নাইট ড্রেস পরিবর্তন করে পরে একটি গাঢ় কমলা রঙের সেলোয়ার-কামিজ। চুলগুলো আঁচড়ে ছেড়ে দেয়। লিপজেল লাগিয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে যায়। নিচে যেয়ে মৃণা মা’য়ের সাথে পুডিং বানাচ্ছে আর দুইজনে গল্প করছে। সে মৃণাকে জিজ্ঞেস করে, “মৃণা বাহিরে যাবি। একটা মজার ক্যাফের খোঁজ পেয়েছি।”
“না তুই যা, আমি আন্টির থেকে পার্ফেক্ট পুডিং বানানো শিখছি।”
“পুডিং? ইয়ামি। আমার জন্য সবচেয়ে বড় পিস রাখবি কিন্তু।”
মা বলেন, “তুইও এসে শিখে নে। আমার কত ইচ্ছা ছিলো আমার মেয়ে আমার সাথে রান্নাবান্না করবে আর গল্প করবে। আমার সাথে টিভি দেখবে। শপিং এ যাবে। আর তুই!”
“এজন্যই তো মৃণাকে আল্লাহ তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর সাথে সব শখ পূরণ করো। ও একদম তোমার মন মতো মেয়ে। তোমরা মজার রান্নাবান্না একসাথে করো আমাকে শুধু রান্না করে ডাক দিও। আমি যাই।” বলে সে মৃণা ও তার মা’কে চুমু খেয়ে দৌড় দেয়।
জাহান গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মহুয়ার জন্য। সে সাদা রঙের শার্ট ও ব্রাউন প্যান্ট পরেছিল। বাম হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি ও দুইটা রিং পরা। অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ দেখে দূর থেকে কেউ আসছে। তাকে দেখেই হাসি এঁকে উঠে তার ঠোঁটের কোণে। প্রথমা আঙুল থেকে একটি রিং খুলে তা সামনে ধরে। এক চোখ বন্ধ করে সে রিং এর মাঝে দেখতে পায় মহুয়াকে। আজ তাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে কমলা রঙের সেলোয়ার-কামিজে। যেন সূর্যোস্ত সময়ের আসমানের এক চিলতে মেঘ তার মাঝে লেপ্টে গেছে। তাকে দেখে জাহানের বক্ষপিঞ্জরটায় সূক্ষ্ম মিষ্টি ব্যাথা হলো। সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল তার সামনে এগিয়ে আসা তেজি কন্যাটার দিকে।
আচমকা মহুয়া এগিয়ে এসেই তার হাত থেকে খপ করে রিংটা নিয়ে নিলো। জাহান এহেন কান্ডে চমকে উঠল। হাত বাড়িয়ে রিংটা নিতে যেয়েও থেমে গেল। মহুয়া দুই কোমরে হাত রেখে বলে, “এই হনুমান চ্যাঁকাম্যাকা এভাবে তাকিয়ে থাকো কেন? সে গলির ওমাথা থেকে দেখছি রিং এর মাঝে দিয়ে দেখছ। আশেপাশের কেউ দেখলে কি ভাববে?”
“তোমার তাদের ভাবায় কিছু আছে যায়?”
“পয়েন্ট আছে।” বলে সে গাড়িতে উঠে বসে। জাহানও ড্রাইভিং সিটে বসে। দেখে মহুয়া তার রিং-টা নিজের আঙুলে পরে দেখছে। যা ভীষণ ঢিলা হচ্ছে তার আঙুলে। জাহান হাসে তার কান্ড দেখে। মহুয়া মুখ ঝামটে বলে, “দাঁত কেলাবে না। তুমি আগে বলবে না ক্যাফের কথা আমি আমার ড্রামা মাঝপথে ছেড়ে এসেছি। এর শাস্তি হিসেবে রিংটা পাবে না।”
জাহান তার দিকে ফিরে সামনে ঝুঁকে আসে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ওহ লাভ, তোমার হাতে তো আমি ম’রতেও রাজি। তোমার হাতে সব শাস্তি পেতে রাজি, কেবল এই রিং ছাড়া।”
সে মহুয়ার হাত থেকে রিংটা নিতে গেলে মহুয়া তা মুঠোবন্দী করে নেয়, “তাহলে এই রিংটা তোমার জন্য স্পেশাল। এখন তো আরও পাবে না।”
“এমন কেন করছ জান? জেদ করো না, দিয়ে দেও।” বলে তার হাত থেকে নিতে গেলে মহুয়া হাত সরিয়ে নেয়। হেসে বলে, “মোটেও পাবে না।”
জাহান আরেকটু এগিয়ে নিতে গেলে সে মহুয়া খেয়াল করে জাহান তার একটু বেশিই কাছে এসে পড়েছে। তার হাসিমাখা চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায় সে।
তার এই স্তব্ধতা এড়ায় না জাহানের দৃষ্টিও। উল্টো তাকে আরও আকর্ষণ করে নেয়। তাদের দৃষ্টি মিলে। সাথেই জাহানের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠে। তার নিশ্বাস আটকে যায় মহুয়ার দৃষ্টির ছোঁয়াতে। সে আলতো করে তার গালে হাত রেখে এক আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় তার বাম চোখের নিচের তিলটা। মৃদু কন্ঠে বলে, “এত কাছ থেকে তোমার এই তিলটা একটু বেশিই সুন্দর লাগে।” বলে এক ঢোক গিলে, ” আর….তোমাকেও।”
চলবে…