মেঘের খামে…
পর্ব ১৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সে আলতো করে তার গালে হাত রেখে এক আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় তার বাম চোখের নিচের তিলটা। মৃদু কন্ঠে বলে, “এত কাছ থেকে তোমার এই তিলটা একটু বেশিই সুন্দর লাগে।” বলে এক ঢোক গিলে, “আর…. তোমাকেও।”,
মহুয়া মুখ ফিরিয়ে নেয়। জাহান খেয়াল করে সে অস্বস্তিকর অনুভব করছে। সাথে সাথে সে হাত সরিয়ে নেয়। নিজে সরে বসে তার সিটবেল্টটা লাগিয়ে দেয়। মহুয়া মিনমিনে সুরে বলে, “আজ নাহলে থাক, আরেকদিন সবার সাথে যাই?”
জাহান তাকায় ভালো করে মহুয়ার দিকে। সে চোখ নামিয়ে আছে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে, হাতের আঙুল নিয়ে খেলছে। তার এবার নিজের থেকেই বিরক্তি লাগে। তার কী দরকার ছিলো মহুয়ার এত কাছে যাবার? তাকে অস্বস্তিতে ফেলার মোটেও উদ্দেশ্য ছিলো না তার।
জাহান তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে, “তোমার সব ভাই ব্রাদাররাই আসছে।”
“ওহ।” কথাটা শুনে মহুয়া একটু স্বাভাবিক হয়।
জোহান তখন ফোন বের করে মেসেজ দেয় তাসিন ও জয়কে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের সিটবেল্টটা পড়ে। তার আর ডেইটে যাওয়া হবে না বোধহয়।
‘Cloud café’-তে জাহান নিয়ে যায় মহুয়াকে। তাদের ভার্সিটি বেশি দূরে না কিন্তু একটু গলির ভেতরে। ক্যাফেটা বাহির থেকে অতি সাধারণ মনে হলেও ভেতরে একদম আলাদা। উপরে কাঠের ছাদে সবুজ পাতাবাহার ও লাইট দিয়ে সাজানো। প্রেমের মিষ্টি গান চলছিল। কাঠের গোল টেবিল ও চেয়ার। ক্যাফের একপাশ খোলা। সেখানে রাখা একটি দোলনা। আর বাহিরে ছোট ফুল ও সবজির বাগান। সম্পূর্ণ জায়গাটা মনে হচ্ছিল কোনো সিনেমা থেকে বের করে আসলে আনা হয়েছে। মহুয়া হা করে দেখছিল। হঠাৎ তার চোখ এক জায়গায় আটকায়।
সম্পূর্ণ ক্যাফে বাদামী কাঠ ও সবুজ রঙের হলেও একপাশ ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। রং-বেরঙের বিনব্যাগ, ক্যারামবোর্ড, স্পিকার রাখা। যা একদমই মানানসই নয় এই ক্যাফের সাথে। যদিও মহুয়ার রঙ অনেক পছন্দ কিন্তু এত সুন্দর জায়গায় এই অংশটা তার বেশ অমানানসই লাগলো।
সে লাফিয়ে একগাল হেসে জাহানের দিকে তাকায়, “যদিও আমার খাবার থেকেই কেবল মতলব থাকে কিন্তু এই জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর। আমার অনেক ভালো লেগেছে।”
“জানো আমরা স্কুললাইফ থেকে এখানে আসি।”
জাহান তাকে নিয়ে গেল একটি চেয়ারের কাছে। যেখান থেকে বাহিরের দৃশ্যটা স্পষ্ট বুঝা যায়। জাহান তার জন্য চেয়ার টেনে দিলো। তারপর নিজে যেয়ে বসল সামনের চেয়ারে। বলল, “জায়গাটা এত পপুলার না বাট এখানের খাবার সবচেয়ে বেস্ট।”
এমন সময় একটা লোক আসে। হাতে পেন পেপার নিয়ে। লোকটার বয়স হবে ভালোই। এই ষাটের আশেপাশে।
লোকটা জাহানকে দেখে যত গাঢ় হাসল তার পাশে মহুয়াকে দেখে ততই চোখ বড় করল। জাহান তার দিকে তাকিয়ে আময়িক হাসল, “এই হলো আদনান আংকেল। এই ক্যাফের মালিক। আর আংকেল এই হলো মহুয়া। ওর মজার খাবার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। এখানের অনেক প্রশংসা করেছি তাই আপনার সব বেস্ট খাবার নিয়ে আসুন।”
মহুয়া তার তাকিয়ে থাকা দেখে জিজ্ঞেস করল, “আংকেল আমার মুখে কি কিছু লেগে আছে?”
লোকটা মনে হয় জ্ঞানে ফিরে। লজ্জিত বোধ করে বলে, “না আসলে জাহান বাবা এই প্রথম রশ্মি মামণি বাদে কোনো মেয়ের সাথে এসেছে তাই অবাক হলাম। আমি তোমার জন্য এক্ষুণি ক্যাফের বেস্ট খাবার আনছি।”
“আংকেল ভ্যানিলা আইস্ক্রিম থাকলে দিবেন আগে।”
“আচ্ছা মামণি।”
আদনান আংকেল যাবার পর মহুয়া জাহানের দিকে তাকায়। রশ্মি নামটা শোনার পরই জাহানের মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেছে। তা স্পষ্ট খেয়াল করেছে মহুয়া। সে বিষয়টা নিয়ে ঘাটতো না। কিন্তু এখন তার এই বিষয় নিয়ে কৌতূহল জাগল। সে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” তুমি না’কি কোনো মেয়েকে আশেপাশেও আসতে দেও নি তাহলে এই রশ্মিটা কে?”
জাহানের মুখের রাগ ও বিরক্তির ভাবটা আরও গাঢ় হলো। কিন্তু সে বোধহয় দাবাতে চাইল এই অনুভূতি।
স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করল তার বিরক্তিমাখা মুখখানা। বাঁকা হাসে, “হোয়াই লাভ? আর ইউ জ্বেলাস?”
জাহান প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইছে তা বুঝল মহুয়া। আর কোনো প্রশ্ন করার পূর্বে দরজা থেকে জয়সহ ক’জন ‘ভাবি’ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সবাই এসে চেয়ার নিয়ে তাদের দুইজনকে ঘেরা করে বসলো। মহুয়া তো রাগান্বিত স্বরে বলল, “ব্রাদার তোমাকে না বলেছি ভাবি ডাকলে তোমার আর কিছু ডাকার জন্য দাঁত থাকবে না।”
জয় দাঁত কেলিয়ে হাসে কথাটা শুনে। বলে, “ভাবি এখানে অনেক বোর্ড গেইম আছে খেলবা? লুডুও আছে।”
মহুয়া ইশারায় ক্যারামবোর্ড দেখিয়ে বলে, “চলো ক্যারাম খেলি। আমি এক্সপার্ট।”
তার মুখে এই কথা শুনে সবার মুখ লটকে গেল। সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। আবিদ বলল, “আসলে ভাবি ওই ক্যারামবোর্ডটা ধরা যাবে না। ওটা….”
তখনই দরজা থেকে শব্দ শোনা যায়, “আমাদের।”
মহুয়া দরজার দিকে তাকিয়ে শায়ানকে দেখে। চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। এই লোকটাকে তার সত্যিই চরম পরিমাণের অসহ্য লাগে। জাহানের সাথে তার দ্বন্দ্ব ছিলো ঠিক কিন্তু জাহান কখনো তাকে অপমান করে নি। অথচ এই লোকের সাথে যে দুইবার দেখা হয়েছে তার সাথে নোংরা কথা বলেছে। এমন পুরুষদের তার দুই চোখে সহ্য হয় না।
শায়ান এগিয়ে তাদের দিকে আসলে জাহান উঠে দাঁড়িয়ে মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় শায়ানের দিকে। সরাসরি বলে, “গেট লস্ট।”
“কেন তোর বাপের সম্পত্তি না’কি যে আমার যেতে হবে।”
জাহান সাথে সাথে তার কলার ধরে নেয়। হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “তোর এত বড় সাহস আমার বাবার কথা মুখে আনিস?”
তিসান আসে দুইজনের মাঝে। জাহানের হাত ধরে বলে, “ভাই প্লিজ ছেড়ে দে। কোনো সিন ক্রিয়েট করিস না। একটা মেয়ে সাথে আছে ভয় পাবে।”
জাহান একপলক মহুয়ার দিকে তাকায়। ছেড়ে দেয় শায়ানের কলার।
মহুয়া আফসোসের সুরে বলে, “ওহ ব্রোফ্রেন্ড এত জোস একটা নাটক বন্ধ করে দিলে। আমি তো ভেবেছিলাম আংকেল আইস্ক্রিম আনলে তা দেখতে দেখতে ফাইট ইনজয় করব।”
এতক্ষণে আদনান আংকেল আইস্ক্রিম নিয়ে আসে। শায়ানকে দেখে সে-ও ঘাবড়ে যায়। আবার জাহানকে দেখে। মিনমিনে স্বরে বলে, “শায়ান বাবা তুমি তো শনিবার আসো না। আজ এলে যে?”
জাহান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় তিসানের দিকে। তিসানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে এখনই কান্না করে দিবে। সে বলে, “শায়ান তোর মেসেজ দেখেছে আমি কী করব? মহুয়া প্লিজ তুমি বাঁচাও।”
মহুয়ার তো তাদের দিকে ধ্যান নেই। সে উঠে জাহান ও শায়ানের মাঝে দিয়ে যায় আদনান আংকেলের কাছে তার থেকে আইস্ক্রিমের ট্রে নিয়ে আবারো স্বাভাবিকভাবেই নিজের চেয়ারে এসে বসে।
সবাই তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। সে সবার এমন তাকানো দেখে ভড়কে যায়। হেসে বলে, “কন্টিনিউ প্লিজ।”
সাথে সাথে সবাই চোখমুখ কুঁচকে নেয়। সবার যেন ঝগড়ার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে। জাহান তার সামনের চেয়ারে বসে। শায়ানও যেতে নেয় তার স্থানে।
এমন সময় মহুয়া ব্যাগ থেকে বের করে একটা পেপারিকার বোতল বের করে। সে পেপারিকা কিছুটা ঢেলে দেয় ভ্যানিলা আইস্ক্রিমে। তার এই কান্ড দেখে সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো। জাহান তো এক ঢোক গিলে তা দেখে। জয়কে বলে, “এই জয় গাড়ি বের কর। ওকে ইমাজেন্সিতে পাবনায় নিতে হবে।”
তার কথা শুনে শায়ানও থামে। কৌতুহলবশত দেখে তাদের দিকে। সে সাদা ভ্যানিলা আইস্ক্রিমের উপর লাল মরিচের গুঁড়া দেখে তেড়ে আসে, “এই তোমার কি সত্যি মাথায় সমস্যা আছে? আইস্ক্রিমের সাথে কোন গাঁধা মরিচের গুঁড়া খায়? এটা তো অবৈ’ধ।”
“গাঁধা তুই হবি বান্দরের রাজা কিটকিটা। শালা ছ্যাঁচ্চর।”
“তুই -তুকারি কার সাথে করছ তুমি?”
“তাহলে কী আপনি বলে সম্বোধন করবো তোর মতো লুইচ্চা ব্যাটাকে। বেশি বেয়াদবি করলে কাকতাড়ুয়ার সাথে ঝুলায় রাখমু। তারপর কাকতাড়ুয়ার ভূতের সাথে বসে লুডু খেলিস।”
“একে তো আমি….” শায়ান মহুয়ার দিকে এগোতে নিলে জাহান আবারও তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “ওকে ছুঁলেও তোর হাত কেটে দিব। ওর থেকে দূরে থাকবি।” বলে ধাক্কা দিয়ে সরালে শায়ানও তেড়ে এসে তার কলার ধরে। তখনই আদনান আংকেল আসে। তাদের দেখে বলে, “বাবারা তোমরা এসব কী করছ?”
তাকে দেখে দুইজন একে অপরকে ছেড়ে দেয়। আদনান আংকেল বলে, “শায়ান বাবা তোমরা তোমাদের জায়গায় বসো। আমি অর্ডার নিতে আসছি।”
শায়ান তার মান রেখে তার দলকে নিয়ে বসে তাদের স্থানে। জাহানও নিজের চেয়ারে বসে। মহুয়া আবারও আফসোসের সুরে বলে, “আজকে বাসায়ও ড্রামা দেখা হলো না, বাহিরেও হলো না। আহারে!”
তার নজর যায় তিসানের দিকে। তিসান মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার শায়ানের দিকে তাকাচ্ছে, আবার জাহানের দিকে। মহুয়া বোধহয় তার দ্বিধা বুঝল। তাই ডাকল, “এই ব্রোফ্রেন্ড কাম হেয়ার। আমার পাশে বসো।”
মহুয়া পাশের চেয়ারে সরে জায়গা দিলো।
তিসান শান্তির নিশ্বাস ফেলে এগোতে নিলেই জাহান সে জায়গায় বসে পড়ে। তিসান মুখ বানিয়ে জাহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাই গার্লফ্রেন্ড থেকে সোজা বোন বানিয়েছি। এখনো তোর জ্বলতে হবে?”
“যতদিন না পর্যন্ত সম্পূর্ণ আমার হয়।”
মহুয়া কথাটা শুনে তাকায় জাহানের দিকে। তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসে। সে তার আইস্ক্রিম খেয়ে বলে, “আসলে কম্বোটা মজার আছে। নেও, তুমিও খেয়ে দেখো।”
সে জাহানের মুখের সাথে এক চামচ আইস্ক্রিম এগিয়ে দেয়। যদিও সে চামচে আইস্ক্রিম কম, মরিচই বেশি।
জয় তো ভড়কে যায়, “ভাবি জাহান ভাই বেশি ঝাল খেতে পাড়ে না।”
মহুয়া তো আদুরে সুরে বলে, “আমি দিলেও খাবে না?”
মহুয়া ঠোঁট উল্টে বলে। জাহান তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। এক হাত দিয়ে তার চেয়ারটা একদম কাছে টেনে নেয়। মহুয়ার দিকে ঝুঁকে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ভারী অথচ মৃদুস্বরে বলে, “থ্যাঙ্কিউ জান, আমি জানতাম না তুমি এত বোল্ড। ফার্স্ট ইনডিরেক্ট কিস এর ব্যবস্থা তুমি নিজেই করে দিলে।”
মহুয়া থতমত খেয়ে যায় তার কথায়। সে বুঝে উঠার আগেই জাহান চামচে রাখা আইস্ক্রিম মুখে ভরে নেয়।
তিসান ঘাবড়ে বলে, “পাগল না’কি কী করলি এটা?”
জাহান খেতেই গলা জ্বলে কাশি এসে পড়ে। জয় উঠে জলদি পানি নিয়ে আসে। জাহানের চোখ কিছুটা লাল হয়ে গিয়েছিলো। তা দেখে মহুয়াও ঘাবড়ে যায় একটু। সে অতিরিক্ত ঝাল খায়। অবশ্য সে-ও এতগুলো মরিচের গুঁড়া মুখে দিলে তারও ঝালে অবস্থা বেহাল হয়ে যেত। যেহেতু জাহান এই কয়দিন তাকে এত ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেছে তাই তার এহেন কান্ড ঘটানো উচিত হয় নি।
জাহান এক ঢোকে গ্লাসের পানি শেষ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে। আর তখনই শায়ানের দলের দিক থেকে গান শোনা যায়। তারা লাউড স্পিকারে গান চালিয়েছে। কয়েকজন তো নাচছে পর্যন্ত। মহুয়া বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে জাহানকে জিজ্ঞেস করে, “এখনো কী ঝাল লাগছে?”
জাহান তখনই নিশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন, “তোমার মতোই ঝাল ছিলো।”
মহুয়া মুখ ঝামটাল, “সোজা প্রশ্নের উওর সোজা ভাবে দেওয়া যায় না?”
“যেমন তুমি, তেমন তোমার পাওনা উওর।”
“এই’যে মিস্টার হনুমান চেঁকামেকা আমার সাথে সেধে সেধে ঝগড়া লাগতে আসলে তোমার কাকের বাসা চুলগুলোতে চুইঙ্গাম লাগিয়ে দিব বলে দিলাম।”
জাহান আচমকা তার সামনে এসে পড়ে। মুখোমুখি হয়। তাকায় সোজাসুজি তার চোখের পাণে। ভারী তবে নরম সুরে বলে, “তোমার দেওয়া বিষও আমি সুধার ন্যায় পান করে নিব জান, এটা তো কিছুই না।”
সে দৃষ্টিমিলনের মুহূর্তে মহুয়া চোখ সরায় না এবার। ঝালে না জাহানের অবস্থার যে বেহাল হয়েছে তার থেকেও বেশি খারাপ অবস্থা তার হৃদয়খানার। তবুও সে চোখ সরায় না মহুয়ার দৃষ্টি থেকে।
তাদের দুইজনেরই দৃষ্টি সরে গানের শব্দ আরও বাড়ানোর কারণে। দুইজনেই পিছনে ফিরে তাকায় শায়ানের দিকে। সে তো তাদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন কাঁচা গিলে খাবে। মহুয়া মুখ বানায়, জাহান চরম বিরক্তি প্রকাশ করে।
“জাহানের কথা তো বুঝলাম, কিন্তু সিসফ্রেন্ড তোমার এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণটা তো খুঁজে পেলাম না। তুমিও প্রেম পড়লে না’কি?” তিসান উঁচু স্বরে প্রশ্ন করে। গানের শব্দের কারণে।
মহুয়া পরিষ্কার অগ্রাহ্য করে, “আমার পরাজিত হওয়া সবচেয়ে বেশি অপছন্দ। ও তাকিয়ে ছিলো তাহলে আমি কেন চোখ সরিয়ে পরাজিত হবো? এমনিতেও পিছিয়ে আছি আমি- এখনো তিন। এই চেঁকামেকা পাঁচে চলে গেছ।”
তার কথা শুনে জাহানের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। সে বাম ভ্রু উঁচু করে তাকায় তার দিকে। মহুয়া তা আড়চোখে তা দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। মুচকি হেসে ধ্যান দেয় তার পেপারিকা আইস্ক্রিমে।
তিসান প্রশ্ন করে,”সব বাদ দেও। তুমি এই আইস্ক্রিমের সাথে মরিচের কম্বোর মহান আইডিয়া পেলে কোথায়?”
মহুয়া তার দিকে তাকায়ও না। বিড়বিড় করে বলে, “মোহের নাম নিলে ওর যদি আবার দেবদাস মোড অন হয়ে যায় তাহলে আজও আমার খাবারের ত্যাগ করতে হবে।তাহলে তো আমি নিজেই দেবদাসিনী মোডে চলে যাব।”
তাই সে তিসানকে বলে, “স্বপ্নে দেখেছিলাম।”
“তুমি স্বপ্নে খাবার দেখো?” সে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
“আমার জিগায়। আমার সব স্বপ্ন তো খাবার নিয়েই হয়। আমার ট্রু লাভ।”
“এক মিনিট, ” সে মহুয়ার হাতে আংটিটা খেয়াল করে, “এটা জাহানের আংটি না?” সে আবার জাহানের দিকে তাকায় বিস্ময়ে, “সে ছোট থেকে আমাদের কাওকে এই আংটি ছুঁতেও দেস নি। জিনিকেও না। অথচ তুই ওকে ধরতে দিলি?” তার কন্ঠে চরম পরিমাণের অবিশ্বাস।
একথা শুনে মহুয়াও বিস্মিত হয়, “মানে? এই রিং এত স্পেশাল না’কি?”
“অফকোর্স। এই রিং আন্টি মানে জাহানের মা ওর জন্মদিনে দিয়েছিল। তার দেওয়া শেষ উপহার। সে বছর থেকে এই রিং জুয়েলার্সের কাছে বড় করে এনে জাহান এখনো পড়ে।”
মহুয়ার তো ভয় লেগে যায়। তার দোষে এই রিংটা হারালে কী হতো? সে তো জাহানের হাত ধরে তার আঙুলে রিংটা পরিয়ে দেয়। বকুনি দেয় জাহানকে, “তুমি আগে কথাটা জানাবে না?”
জাহান তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে, ” লাভ তোমার এনগেজমেন্ট করার এত তাড়া ছিলো? আগে বললেই তো দুই পরিবারকে ডেকে সোজা কাবিন করে নিতাম।”
তার কথায় আকাশ থেকে পড়ে মহুয়া, “হেঁ?”
“এই রিং দিয়েই তো এনগেজমেন্ট করতাম আমি। যেহেতু তুমি পরিয়ে দিয়েছ সেহেতু আজ থেকে তুমি আমার ফিয়োন্সে।”
মহুয়া বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার কথায়। সে বহু কষ্টে বলে, “পাগল হয়ে গেছ তুমি?’
” হোয়াট লাভ, তুমি এখন আমার দায়িত্বও নিবে না? আংটি পরিয়ে দায়িত্ব নিবে না? এখন কী হবে আমার?” জাহান টেবিলে কণুই রেখে গালে তার দিয়ে তার দিকে তাকায় দুষ্ট ভঙ্গিতে। সবাই হাসিতে মেতে উঠে। দুই একজন তো শিষও বাজায়।
মহুয়া তো এই প্রথম কথার প্রতি উওরে কথাই খুঁজে পায় না। তাই সে জলদি বাহানা করে।
“আচ্ছা যাই হোক, আমি একটু ওয়াশরুমে যাব। কোন দিকে?”
জয় তাকে দেখিয়ে দেয়।
ক্যাশ কাউন্টারের পাশে এক দরজা আছে। সরু করিডরের শেষের দিকেই লেডিস ওয়াশরুম।
সে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই শায়ানকে দেখতে পায়। সে বুকের উপর হাত ভাঁজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। সে তাকে দেখে কপাল কুঁচকায়, “তুমি লেডিস না’কি? তাহলে লেডিস ওয়াশরুমের সামনে কী করো?”
শায়ানকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে, “ধ্যুর হলেও আমার কী?” বলে সে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে শায়ান তার হাত ধরে টান দিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে।
“হোয়াট দ্যা হেল! ছাড়ো বলছি।” মহুয়া আঁতকে উঠে তার হঠাৎ আক্রমণে। শায়ান উলটো তার গলা চেপে ধরে। শীতল দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। বলে, “তোমাকে বলেছিলাম জাহান থেকে দূরে থাকতে। আর তোমার এত বড় সাহস তুমি ওর সাথেই এসে পড়েছ।”
“তোমার কী? তোমার কী ওর উপর ইন্টারেস্ট আছে না’কি?” কথাটা তার মুখ দিয়ে বের হতেই শায়ান এবার তার গলায় চাপ দেয়। মহুয়া এবার চিৎকার করে উঠতেও থেমে যায়। সে যত জোরে চিৎকার করছে শায়ান আরও জোরে তার গলা চেপে ধরে। শায়ান তাচ্ছিল্য হেসে কাঠখোট্টা স্বরে,”বাহিরে লাউডে গান ছেড়ে এসেছি তোমাকে এখানে শেষ করলেও কেউ জানবে না।”
মহুয়া ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়। সে শায়ানের হাত সরাতে চায় কিন্তু তার শক্তির সামনে পাড়ে না’কি? তাই সে একটু থামল। তার কাঁধে ঝুলানো সাইড ব্যাগ খোলার চেষ্টা করতে লাগল। শায়ানের ধ্যান তার দিকে আকর্ষণ রাখতে যেয়ে বলল, “কী চাই?”
“এইত্তো কাজের কথায় এসেছ। শেষ ওয়ার্নিং দিচ্ছি, জাহান থেকে দূরে থাকবে। ওর উপর আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের ইন্টারেস্ট আছে। আর সে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি ও তোমার জন্য একবিন্দুও কষ্ট পায় সেদিন তোমার জীবনের শেষ দিন হবে। এটা শায়ান শিকদারের ওয়াদা। আর শায়ান শিকদার তার ওয়াদা থেকে ফিরে না।”
মহুয়া এতক্ষণে তার সরু ছু’রিটা হাতের নাগালে পায়। মুহূর্ত ব্যয় না করে তা বের করে ধরে তার গলার কাছে। তা দেখে শায়ান হাসে তাচ্ছিল্যভাবে, “আমাকে আঘাত করবে? এত সাহস আছে?”
শায়ান তার গলায় রাখা হাতটা কাঁধে কাছে নিয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়। মহুয়া তো হতবাক হয়ে যায় এহেন কান্ডে। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার এত সাহস দেখে। শায়ান তার হাত ধরে ছু’রিটা তার গলায় ভালো করে লাগিয়ে বলে, “কাম অন। আই ডেয়ার ইউ। আমিও দেখতে চাই শুধু বাহিরেই বাঘিনী সাজো না’কি?”
মহুয়া কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ থাকে। তারপর আচমকা ছু’রিটা চালিয়ে দেয়।
শায়ান বিস্ময়ে কিছু মুহূর্ত ব্যাথাও অনুভব করতে পাড়ে না। সে নিজের ঘাড়ের দিকে হাত দিয়ে দেখে র’ক্ত ঝরছ। সে চেঁচিয়ে উঠে, “আর ইউ ম্যাড? হাউ ফাকিং ডেয়ার ইউ?” বলে ধাক্কা দিয়ে মহুয়াকে সরালে সে দেয়ালের সাথে বাড়ি খায়।
ব্যাথা পেলেও প্রকাশ করে না মহুয়া। বলে, “তুমিই তো দেখতে চাইলে আমার সাহস আছে কি-না! মিস্টার শায়ান শিকদার এবার আমি তোকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি আমার থেকে দশ হাত দূরে থাকবে। এবার তো আঁচড় দিয়েছি এরপর গলায় ঢুকিয়ে দিব। আর তুমি জাহান থেকে দূরে থাকতে বলেছ তাই না? এবার আরও থাকব না। দেখি কি করতে পারো।” মহুয়া তার সামনে এসে তার পরনের সাদা গেঞ্জিতে তার ছু’রিটা পরিষ্কার করে। শায়ান তো তার দিকে এমন ভাবে তাকায় যে চোখ দিয়ে অগ্নি বর্ষণ করে তাকে ভস্ম করে দিবে।
মহুয়া সেদিকে পাত্তা দেয় না। মুখ ঝামটে চলে যায়। কিছুটা হেঁটে দরজার কাছে যেয়ে উঁচু স্বরে বলে, ” তোর মতো বান্দরকে গাছে উলটা কীভাবে লটকাতে হয় আমি ভালো করেই জানি। আর বেশি লাফালে আমার গ্রামে একটা ভুতুড়ে বটগাছ আছে ওইখানের শাঁকচুন্নির কাছে ছেড়ে আসব তো। তারপর সে তোকে বুঝাবে। শালা ছ্যাঁচ্চর।”
শায়ান কঠিন দৃষ্টিতে তাকে যেতে দেখে। ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিজের হাতে র’ক্ত দেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে সে। তারপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় দরজার দিকে। মেয়েটার সাথে এবার সম্ভবত তার ব্যক্তিগত শত্রুতা শুরু হবে।
সে বের হয়ে দেখে মহুয়া ঠিকই সবার সাথে হেসে গল্প করছে ও খাচ্ছে। তা দেখে শায়ানের রাগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।সে তার দলের কাছে যেহেই মুহিব উঠে দাঁড়ায়। তার ঘাড়ে র’ক্ত দেখে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া রক্ত কীভাবে? কী হয়েছে তোমার?”
সকলে এক এক করে শায়ানের কাছে এসে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। যে কারণে আরও রেগে যায় শায়ান। এমনিতেই তার মাথা ধরে গেছে। সে একটি কাঁচের গ্লাস টেবিল থেকে তুলে স্পিকারে ছুঁড়ে মারে।
হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “আরেকটা কথা মুখ দিয়ে বের করলে জিহ্বা কেটে দিব তোদের।”
একজন গান বন্ধ করে দেয় ভয়ে। জাহানরাও পিছনে তাকায়। তিসান তো এই অবস্থা দেখে সেদিকে যায়। তিসানও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, “তোর গলায় রক্ত কীভাবে? কী হয়েছে তোর?”
শায়ান তো তখনও তাকিয়ে ছিলো মহুয়ার দিকে । তার চোখে প্রতিশোধের আগুন। মহুয়াও পিছনে মুখ ফিরাল। তবে বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আরামে তার পিজ্জা উপভোগ করল।
শায়ান শুধু বলল, “এই স্পিকারে আমার মাথা ধরে গেছে। মুহিব আজই পাল্টে আসবি।” আর রাগে ক্ষোভে চলে গেল সেখান থেকে। তার পিছনে গেল তার দলও। তাকে আহত দেখে তিসানও তার সাথে গেল।
চলবে….
মেঘের খামে…
পর্ব ২০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মোহ ও সমুদ্র চট্টগ্রাম যেয়ে পৌঁছায়।
মোহ কিছু বলতেও পাড়ে না। কী বলবে তাকে ঢাকা ফেরত দিয়ে আসতে? সে চুপচাপ যায় সমুদ্রের সাথে। পাঁচতলা এক বিল্ডিং এর সামনে যেয়ে রিকশা থেকে নামে। সম্পূর্ণ বিল্ডিং এ লাইটিং করা। সমুদ্র ভেতরে ঢুকতে নিলেই দারোয়ান তাকে দেখে একগাল হেসে বলে, “আরে সমুদ্র আব্বা যে, ক্যাএন আছন?”
“ভালো আছি কাকা, সবাই এখনো আছে না?”
“আছন আব্বা।”
সমুদ্র মোহকে নিয়ে তিনতলায় যায়। সেখানে মানুষজন গ্যাজগ্যাজ করছে। দরজা খোলাই ছিলো। সমুদ্র ঢুকে পড়লো। তার পিছনে কুড়কুড় করে হাঁটল মোহও। গলার ওড়নাটা মাথায় দিয়ে নিলো। হঠাৎ এক মেয়ের কন্ঠ শুনে সে লাফিয়ে উঠে, “আপা সমুদ্র ভাই আসছে।”
তারপর মেয়েটা সমুদ্রকে ধরে বসল, “ভাইয়া তুমি না’কি বিয়ে করছ? তুমি এমন করতে পাড়লে? আমাদের এতজনের মন ভাঙতে তোমার কষ্ট লাগলো না?এর কী শাস্তি দেওয়া যায় তোমায় বলো?”
“শাস্তি আমার আম্মাজানকে দেও গো রমণী । অবশ্য তোমরাও শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। আমার আমন্ত্রণ প্রতাখ্যানের শাস্তি।”
“সব ঈশা আপুর দোষ। কত বললাম বিয়েতে যেতেই দিলো না।”
ব্যাস এতটুকু কথাতেই তো মোহের বুকের ভেতর ধরপরানি শুরু হয়ে যায়। সে এতো এবার নিশ্চিত সমুদ্রের বন্ধুরা তাকে মোটেও পছন্দ করে না। একারণেই বিয়েতে আসে নি। সে তো এবার কাঁচুমাচু হয়ে সমুদ্রের পিছে লুকিয়ে থাকে। এমন সময় এক মেয়ে বড় গাউন পরে দৌড়ে আসে সমুদ্রের দিকে ভিড় ঠেলে। অর্ধেক মেকাপ করা, চুল অর্ধেক মাথার উপরে ক্লিপ মেরে রাখা। তাকে এই অবস্থায় দেখে সমুদ্র তো বুকে থুথু দিয়ে বলে, “কোন গাছের শাঁকচুন্নি তোদের বাসায় এলো রে রিসা?”
ঈশা চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকায়। সমুদ্র আবার বলে, “দেখ শাঁকচুন্নিটা চোখ রাঙাচ্ছে।”
ঈশা তাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে বল তোর বউ কই?”
তার এমন কথার ধরণে তো মোহ আরও ভয় পেয়ে যায়। মনে হয় মেয়েটা আসলে অনেক ক্ষেপা সমুদ্রের বউয়ের উপর।
সমুদ্র পাশে তাকিয়ে মুখ কুঁচকায়, “এখানেই তো ছিলো।” বলে পিছনে ফিরে মোহকে দেখে অবাক হয়ে বলে, “তুমি আমার পিছনে লুকিয়ে আছো কেন?”
ঈশা তো তাকে ধাক্কা দিয়েই সরায়। মোহকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় বড় চোখে তাকে দেখে।
মোহ ঘাবড়ে কাঁচুমাচু হয়ে যায়। তারপর আমতা-আমতা করে সালাম দেয় তাকে, “আসসালামু আলাইকুম আপু।”
ঈশা তো দুইহাত তার গালে রেখে বলে, “সমুদ্র তুই তো দেখি সাত কপালের ভাগ্য নিয়ে এসেছিস রে। পুরাই পরী বিয়ে করলি।”
তারপর বুঝে উঠার আগেই মোহের হাত ধরে তার সালামের উওর দিয়ে বলে, “তুমি কী কিউট, কী মিষ্টি, কী সুন্দর! উফফ মাশাআল্লাহ। ভাই আমি ছেলে হলে আমি বিয়ে ছেড়ে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম।”
তার হিতের বিপরীত ব্যবহার দেখে মোহ আহাম্মক বনে যায়। এর পরিবর্তে কি উওর দিবে না বুঝে পেরে সে জোরপূর্বক হাসে।
এমন সময় সবাই তাকে দেখার জন্য জড়ো হয়। কিছু মিনিটেই আশেপাশে সবাই ভীড় করে সমুদ্রের নববধূ দেখার জন্য। মোহের ভীষণ অস্বস্তি লাগে। চিনে না, জানে না সবাই এমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে যেন আস্তো এক এলিয়েন। ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছে। তার অস্বস্তিই হয়তো বুঝে ঈশা তাকে নিজের রুমে নিয়ে যায়। সেখানে পার্লারের মেয়ে দু’জন ছাড়া কেউ-ই ছিলো না। মোহ বুঝে সে যে ভয় পেয়েছিল ঈশা মোটেও তেমন নয়, ভীষণ মিষ্টি। তাকে ভীষণ জলদি আপন করে নিয়েছে।
মোহ একটি টিয়া রঙের আনারকলি পরল, সাথে হাল্কা সাজল। অনুষ্ঠান শেষেই না’কি তারা কক্সবাজারের জন্য রওনা দিবে। সে আবার চেঞ্জ করতে পাড়বে না। অনুষ্ঠানে যেয়েও ঈশা তাকে ছাড়ে না। তাকে সাথেই রাখে। যদিও আজ তার অনেক ব্যস্ততা ছিলো, তবুও ব্যস্ততার মধ্যেও সে মোহকে কাছেই রাখে। কিন্তু এদিকে তার স্বামীরই দেখা নেই।
তুষারদের পরিবারও আসে এরই মধ্যে। ঈশার বাবা ও চাচারা কথা বলে ভেতরে নিয়ে যায় তাদের। তুষার আসে সবার আগে ঈশার কাছে। লামিনও তার সাথেই ছিলো। ঈশাকে দেখে বলে, “তুমি কী আজ আমার হার্টঅ্যাটাক করার প্লান করে এসেছ? এত সুন্দর লাগছে কেন তোমাকে?”
“তুমি ফ্লাটিং বন্ধ করে আগে বলো আরেকটা বান্দরকে কোথায় ফেলে এসেছ?”
লামিন ঈশার মাথায় মেরে বলে, “তুই বান্দরনী। আজ সাক্ষাৎ বান্দরনী লাগছে পুরো।”
এই সুবাদে ঈশা তাকে কতগুলো মারল একের পর এক, “শয়তান জানিস এই হেয়ারস্টাইল করতে দুই ঘন্টা লাগছে আমার।”
“আমি তোকে এত আস্তে একবার মারলাম আর তুই আমাকে এতগুলো মাইর দিলি?”
“এসব বাদ দে, সমুদ্র কোথায়?”
লামিন তখন আশেপাশে তাকায়, “সমুদ্র তো আমাদের সাথেই ছিলো। কখন কোথায় গেলো বুঝলাম না।”
তারপর সে ঈশার পাশের মোহকে দেখে বলে, “আরে ছোটো ভাবি চিনেছেন তো আমাকে? বৌভাতে দেখা হয়েছিল।”
মোহ হাসে মৃদু তার কথায়। যদিও সে চিনে নি। বৌভাতে নাহলেও নতুন পাঁচশো জনের সাথে দেখা করেছে। সবাইকে কীভাবে মনে রাখবে?
“কেমন আছেন ভাইয়া?” মিষ্টি করে প্রশ্ন করে মোহ।
“এইত্তো ভাবি আলহামদুলিল্লাহ। তুষার ভাইয়ার সাথে সে গেইট থেকে এখানে আসা পর্যন্ত আপনার জন্য ভাইয়ার ছোট ভাই ও দুইটা কাজিনের প্রস্তাব নিয়ে আসা রিজেক্ট করেছি। তাদের বুঝাতে হয়েছে আপনি আমাদের বন্ধুর পিচ্চি বউ।” কথাটা বলে হাসে লামিন। আর মোহ লজ্জা পেয়ে যায়। সে হাসলে তার গাল দু’টো লাল হয়ে আসে।
তা দেখে লামিন বলে, “সমুদ্রের বাচ্চা কী ভাগ্য নিয়ে এসেছে ভাই। আচ্ছা ভাবি আপনার বোনটোন নেই?”
“গতকালই বিয়ে হলো।”
“ওহ হ্যাঁ, সমুদ্রই তো বিয়ের দিন আপনার বোনকে পালাতে সাহায্য করেছি। বিশ্বাস করেন ভাবি সমুদ্রকে না চিনলে আমি নিশ্চিত ভাবতাম আপনাকে দেখে বোনকে উধাও করে দিয়েছে।”
কথাটায় হাসে ঈশা, “আমি ছেলে হলে এই কাজ ঠিকই করতাম।”
তাদের হাসি ঠাট্টার মাঝে সমুদ্র আসে, “কী ব্যাপার? এত হাসাহাসি কী নিয়ে?”
লামিন তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তোকে নিয়েই। কিন্তু তুই কোথায় ছিলি?”
“জবাফুলকে কল দিয়েছিলাম। ও কখন আসবে। বলছে আসতেই পাড়বে না আজ। ওর মামীশাশুড়ীর বাসায় দাওয়াত আছে।”
সমুদ্র কথাটা স্বাভাবিকভাবে বললেও সেখানের সবার মুখের হাসি উড়ে যায়। তারা বেমানান এক পরিস্থিতিতে পড়েছে যেন। তারা একত্রে তাকায় মোহের দিকে। মোহ তো এক মুহূর্ত তাদের এমন চাহনি দেখে ভড়কে যায়। তবুও জোরপূর্বক হাসে। মোহ বুঝতে পাড়ে সমুদ্রের কথায় সবাই এক অস্বস্তিতে ভুগছে। তাই সে সবাইকে স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করে, “আপু তুষার ভাইয়ার সাথে পরিচয় করালে না?”
তুষার আময়িক হাসে, “গত সাপ্তাহে আমাদের পরিবার দেখা করেছিল তো তাই তোমার বিয়েতে আসতে পাড়ি নি। আমাদের সমুদ্র একটু অবুঝ, কোথায় কি বলতে হয় জানে না কিন্তু ওর মন স্বর্ণের মতো। সবাইকে আপন করতে জানে। তোমরা একে অপরের সাথে মানিয়ে দেখো। জীবন অনেক সুখের হবে।”
মোহ একপলক সমুদ্রের দিকে তাকায়। তারপর তুষারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়।
এনগেজমেন্ট সম্পূর্ণ হয় সুন্দরভাবে। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বাজে একটা। ঈশা চেঞ্জিংরুমে গেছে জামা পাল্টাতে। তুষার ও লামিন তুষারের পরিবারকে গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে।
মোহ ফাঁকা স্টেজে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
তার খোলা চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। হঠাৎ কোথা থেকে সমুদ্র এসে বসল তার পাশে। সে পাঞ্জাবি পালটে সাদা শার্টের উপর ব্রাউন জ্যাকেট পরে নিয়েছে। তার হাতে দু’টো আইস্ক্রিম। মোহ স্বাভাবিকভাবেই একটি আইস্ক্রিম হাত থেকে নিয়ে বলে, “আপনারা সবাই ড্রেস চেঞ্জ করেছেন। আমাকে বলল তো আমিও একটি কমফোর্টেবল ড্রেস নিয়ে আসতাম তাই না?”
সে খানিকটা অভিমানের সুরে বলে আইস্ক্রিমে কামড় দেয়।
সমুদ্র হেসে নিজের আইস্ক্রিমটা খুলে মোহের দিকে এগিয়ে বলে, “নেও, শাস্তি দেও।”
মোহ তার দিকে তাকিয়ে বড় একটা কামড় দিলো তার আইস্ক্রিমে। সমুদ্র হেসে জিজ্ঞেস করে, “তো আমার বন্ধুদের কেমন লেগেছে?”
“অনেক ভালো। ঈশা আপু তো আমার ফেভারিট। আপু সবচেয়ে অনেক ভালো।”
“এক সাপ্তাহ ধরে আমার সাথে আছো একবারও আমাকে ভালো বললে না এই পাঁচ ঘন্টায় ও সবচেয়ে ভালো হয়ে গেল? ও কী আমার মতো তোমার জন্য আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসে? জানো ও জীবনে তোমাকে নিজের আইস্ক্রিমে বাইট দিতে হবে না।”
“এই হিংসা করছেন আপনি? হিংসা করলেও কি? আপুই বেস্ট।”
“তাই না?” সমুদ্র ফট করে তার নাকে, গালে আইস্ক্রিম লাগিয়ে বলল, “তাহলে এই হলো আমার থেকে বেশি ওকে ভালো লাগার শাস্তি।”
মোহ তো রেগে ফুলে গেল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আপনাকে তো আমি….”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার আগেই সমুদ্র এক লাফে স্টেজ থেকে নেমে যায়। মোহও তার পিছনে যায়, “আপনাকে আজ আমি ছাড়ছি না।”
সমুদ্র পিছনে ফিরে বলে, “আগে ধরে তো দেখাও।”
মোহ তাকে ধরতে পাড়েই না। সমুদ্র তো তার মজা নেবার জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখে তার কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর আবার দৌড়ে, “তুমি অনেক স্লো মধু, এমন চলতে থাকলে তোমার আরেক জন্ম নেওয়া লাগবে আমাকে ধরতে। ”
এমন দুষ্টুমি করতে করতে তারা আসে বাগানের কাছে। সমুদ্র খেয়াল করে মোহ তার আনারকলি উপরে আলগে ধরে তাকেই ধরতে আসছে। তবে বাগানের মাটি এখনো ভেজা। সে খেয়াল না করে পা দিলে পিছলে পড়েও যেতে পাড়ে। তাই এবার মোহের বিপরীতে না যেয়ে তার দিকে ছুটে যায়। কাঁদায় পা দেবার পূর্বেই সমুদ্র তাকে ধরে ঘুরিয়ে অন্যপাশে নিয়ে আসে।
মোহ কিছু সময়ের জন্য তার হতজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আচমকায় সমুদ্রের ছোঁয়ায় আপনা-আপনি শূন্য হয়ে যায় তার দেহ ও মস্তিষ্ক। সে অনুভব করতে পাড়ে তার দুই বাহুতে সমুদ্রের উষ্ণ স্পর্শ। তার ছোঁয়ায় মোহের হার্টবিট এত দ্রুত হয় যে তার ভয় হতে থাকে, সমুদ্র যদি এই শব্দ শুনে নেয়! সে মুহূর্ত সে সমুদ্রের বুকে পড়ে নি। তবুও এই প্রথম তার বাধ্য মনটা বেপরোয়া হলো। সে বেহায়ার মতো সে সমুদ্রের পেটের কাছে জ্যাকেট ধরে নেয় দুইহাত দিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য তার বুকে মুখ ভরতেই তার নিশ্বাস আটকে যায়। সে থাকতে পাড়ে না, সাথে সাথেই মুখ তুলে নেয়।
সমুদ্র তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মোহ তো তার বেহায়া মনের দোষে নিজে লজ্জায় পড়ে যায়। তবুও তার মনকে দোষী হতে দিবে না সে। বলে, ” আপনি এভাবে ঘুরালেন কেন? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
স্বাভাবিক হয় সমুদ্রের মুখ। সে উলটো শাঁসালো, “কাঁদা দেখে হাঁটতে পারো না? আমি না সামলালে এতক্ষণে পা পিছলে কোমড় ভাংতে।”
“সব আপনার দোষ। এবার ধরেছি। ছাড়ব না। শাস্তি পেতে হবে আপনার।”
“আচ্ছা ধরেছ, বুঝলাম। এখন কী শাস্তি দিবে বলো?”
মোহ কিছুক্ষণ ভাবলো। কিন্তু এক ভাবনাতে আটকে গেল তার বেয়াদব মন। মনের দোষে এমন দুঃসাহস করল সে। সে সমুদ্রের বুকে নিজের মুখ জোরে ঘষে বলল, “আপনি আমার মুখ নষ্ট করেছেন, আমি আপনার শার্ট। হিসাব বরাবর।” বলে আর সেখানে থাকার সাহস হলো না তার।
সে চলে গেল। পিছনে ফিরে সমুদ্রের মুখের প্রতিক্রিয়াও দেখল না সে।
ঈশার চেঞ্জিংরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল মোহ। সে বের হলে একবারে সেন্টার থেকে বের হলো। দেখলো তুষার একা দাঁড়িয়ে আছে এক খোলা জিপের সামনে। ঈশা প্রশ্ন করল, “ওই দুইটা কোথায়?”
“বিশেষ কাজে গেছে?”
ঈশা এবার রাগল, “আবার সিগারেট খেতে গেছে?”
তুষার ভীত হাসল। তার প্রতিক্রিয়া সব জানান দিলো। কিছু মিনিটের মধ্যে এলো তারা দুইজন। সমুদ্র এসেই বসলো ড্রাইভিং সিটে তাই তাকে আর দেখতে পেল না মোহ। সমুদ্রের পাশে যেয়ে বসল তুষার। ঈশা তো লামিনের কান মলা দিলো সরাসরি, “তোদের না কত মানা করেছি সিগারেট না খেতে। কানে যায় না তোদের?”
লামিন তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে জিপে উঠে বসে। ঈশা নিজেও উঠে মোহকে হাত ধরে উঠায়। মোহ ও ঈশা বসে একপাশে, লামিন অন্যপাশে। সমুদ্র পিছনে ফিরে লামিনের দিকে চুইঙ্গাম ছুঁড়ে মারে, “জলদি খেয়ে নে।”
ঈশা ভ্রু কপালে তুলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “তোমার কী সিগারেট থেকে সমস্যা হয়?”
মোহ মাথা নাড়ায়।
উওর পেয়ে তো ঈশাকে উৎসুক দেখা যায় ভীষণ। সে বলে, “বাহ নিজের বউয়ের খেয়াল রাখা হচ্ছে ভালোই। তুই দেখি শুধরে যাচ্ছিস।”
“আমি সব মেয়েদেরই কমফোর্টেরই খেয়াল রাখি।”
“এহ আমি এত বছর ধরে তোদের বলছি সিগারেট না খেতে তখন তো…” সমুদ্র তার কথা কেটে সিটের উপরই উঠে অবাক দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়, “কি বলোস তুই মেয়ে?”
এতেই হাসির টোল পড়ে। ঈশা উঠে সমুদ্রকে মারতে গেলে সমুদ্র আবার নিজের জায়গায় বসে সিটবেল্ট লাগিয়ে বলে, “বসে পড়, নাহলে গাড়ি চালাতেই পড়ে হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে গেল কালকে নিউজপেপারে আসবে যে বাগদানের দিনই বন্ধুর হাতে পাত্রীর কোমড় ভাঙল।”
ঈশা ক্ষেপে বসে পড়ে। সমুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সজোরে বলে, “কক্সবাজার আমরা আসছি।”
আর বাকি তিনজন ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করে উঠে। হঠাৎ এমন চিৎকারে মোহ ভয় পেয়ে যায়। শুরু হয় তাদের মধ্যরাতের যাত্রা।
চাঁদের ছলছলে আলো, বাতাসের মিষ্টি আভাস ও মধ্যরাতের যাত্রাটা মোহের মন ফুরফুরে হয়ে গেল। ঈশা ও লামিন গল্প করছিল। মোহকে তাদের স্কুল ও কলেজের দিনের গল্প শুনাচ্ছিল। মোহের ভালোই লাগছিল। সময় ভালো কাটছিল। হঠাৎ ঈশা চুপ হয়ে যায়। সে বড় নিশ্বাস ফেলে সমুদ্রকে বলে, “সমুদ্র তুই পিছনে আয়। আজ এমনিতেই জার্নি করে এসেছিস। ক্লান্ত হয়ে বেশিক্ষণ গাড়ি চালাতে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে।”
কথাটা যুক্তিসম্পন্ন। সমুদ্র গাড়ি থামিয়ে আসে পিছনে। ঈশা সামনে যাবার পর তুষার ড্রাইভিং সিটে বসে। লামিন বলে, “এই চুপচাপ মহলে বোর হচ্ছিস না তোরা?”
মোহ তার কথায় অবাক হয়। সে তো ভীষণ মজায় আছে। তার মনে যেন প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। সে কখনো কল্পনাও করে নি সে মধ্যরাতে এত সুন্দর যাত্রা করতে পাড়বে কখনো।
তবে তাকে চমকে দিয়ে লামিন জিপের থেকে একটি গিটার দিলো সমুদ্রকে। সে জানতো না সমুদ্র গিটার বাজাতে পাড়ে। তার বাসার কোথাও সে গিটার দেখে নি। তাকে চমকে দিয়ে সমুদ্র টুংটুং করে গিটার বাজাতে শুরু করে সাথে শুরু করে গানের সুর,
লা ললালা ..
যদি বারেবারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায় ? আর প্রেমই বা কোথায় ?
যদি দিশেহারা ইশারাতে প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়? আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়।
[প্রথম অংশটুকু কেবল সমুদ্র গাইবার পর তার সাথে যোগ দেয় তার বন্ধুগণ। মোহ তাদের সবার দিকে তাকায়। তার মনে হলো এই সুন্দর যাত্রাটার আনন্দ শতগুণ বেড়ে গেছে আচমকায়। গান শুনে আপনা-আপনি তার পা নড়ে উঠে। তার প্রিয় নুপুরজোড়া বেজে উঠে। তা যেন সমুদ্রদের গানের সাথে তাল মেলায়। তাদের গানের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলে। তার নুপুরের শব্দে সমুদ্র তাকায় তার দিকে।]
যদি প্রতিদিন সেই রঙিন হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে শুধু কথা দেয়,
যদি প্রতিদিন সেই রঙিন হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের গানও অসহায়।
যদি অভিযোগ কেড়ে নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয় সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলোকে ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার? বলো কি থাকে আমার?
[সমুদ্র হেসে তার দিকে তাকাতেই মোহে পা’জোড়া আপনা-আপনি থেমে যায়। কিন্তু সমুদ্র ইশারা দেয় চালিয়ে যেয়ে। অনুমতি পেয়ে মোহ আরও খুশি হয়। সমুদ্র তার দিকে তাকিয়েই গান গান, মুখ বানায়, হাসে। মোহের মুখ থেকে হাসি সরবার নাম নেই আজ। তার মনে হয় আজ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত।]
যদি ভালোবাসা সরে গেলে মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে হেরে যেতে ভয়?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা গান হয়ে যায়।
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়।
[শেষে সমুদ্রের হাসিমুখটা কেমন উদাসীন হয়ে যায়। তার চোখে ভেসে উঠে স্পষ্ট দুঃখ। তার চোখ মোহ থেকে সরে আকাশে দিকে স্তব্ধ হয়। যেন সে আকাশের কাউকে খুঁজে যাচ্ছে তার দৃষ্টি, তার মন। মোহ নিজের বুকের ভেতর সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করে। মুহূর্তে তার মনের প্রজাপতিরা ম’রে যায়। তারও দৃষ্টি যেয়ে আটকায় মেঘলাবিহীন আসমানে।]
সময় কাটে। এই মধ্যরাতের আনন্দ আর অনুভব করতে পাড়ে না মোহ। এখন আর কেন যেন ভালো লাগছে না তার। মনের উৎসুকভাবটাও যেন ম’রে গেছে। হঠাৎ তার ক্লান্ত শরীরে ঘুম এসে ভার করলো। ঘুমে ঝিমাতে ঝিমাতেই একসময় ঘুমিয়ে যায়।
সমুদ্র লামিনের সাথে গল্প করছিল। এমন সময় লামিনের চোখ যায় মোহের দিকে। মোহ ঘুমের ঘোরে আছে। পড়ে যাবে যে কোনো সময়। সে আতঙ্কিত সুরে বলে উঠে, “দোস্ত ভাবি….”
সমুদ্র তার দিকে তাকায় আর মুহূর্তে তার পাশে যেয়ে বসে। গাড়ির মোড় ঘুরাতেই তার বুকে ঢলে পড়ে। আচমকা এমন ঘটনায় সমুদ্র অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এরই মধ্যে ঈশাও তাকায় পিছনে। সে দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে, “দোস্ত ভালো করে ধর। পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।”
লামিনও সায় দেয়, “তোর দায়িত্বে কিন্তু ভাবির মা বাবা পাঠিয়েছে। কিছু হলে তোকে মাফ করবে না।”
“একদম। ভালো করে জড়িয়ে ধরে রাখ। যেন না পড়ে যায়।” ঈশা আবারও উপদেশের সুরে বলে।
তুষার হাসে তাদের কান্ডে। সে মৃদুস্বরে বলে, “বেচারাকে একটু ব্রেক দেও।”
“ব্রেকে আছে চার বছর হয়ে গেছে। এখন ওর জীবন গুছানোর সময় এসে পড়েছে।”
সমুদ্র মোহের দিকে তাকায়। সে বিড়ালছানার মতো গুটিসুটি মেরে তার বুকে শুয়ে আছে। নড়েচড়ে আবার তার জ্যাকেটও ধরে নেয়। সে তার হাত মোহের বাহুর কাছে নিজেও গুটিয়ে নেয়। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার। তবে এই অস্বস্তির কারণে তো আর সে মোহকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দিতে পাড়ে না। তাই দ্বিধাবোধ করলেও মোহের বাহুতে হাত রেখে তাকে নিজের আরেকটু কাছে নিয়ে আসে। তাকে ভালো করে ধরে বসে। তার মুখে আসা চুলগুলো আলতো করে কানের পিছে গুঁজে দেয়। তার ওড়না দিয়ে ভালো করে তার হাত ঢেকে দেয় যেন শীত না লাগে। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবে মোহের নড়াচড়ায় আবারো সে তাকায় তার দিকে। সে নেড়েচেড়ে আরও কাছে এসে সম্পূর্ণ তার বুক দখল করে নিয়েছে। সমুদ্র চাঁদের মৃদু আলোয় তাকাল তার নিষ্পাপ মুখখানার দিকে। হাসল খানিকটা। তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আলতো করে।
ঈশা পিছনে ফিরে সবই দেখছিল। হঠাৎ তার চোখ ভিজে গেল। সে স্বস্তির এক নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল। তুষারের এক বাহু জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আশা করছি এতবছর পর সমুদ্র আবার আগের মতো হতে পাড়বে। তার হাসির পিছনে আর কষ্ট থাকবে না। একদিন মোহের মায়ায় সমুদ্র ডুবে যাবে। সব অতীত ভুলে এগিয়ে যাবে। সত্যিই মন খুলে হাসতে পাড়বে। কেননা বুকে কষ্ট ভরে মুখে হাসি এঁকে রাখা যে আরও কষ্টের।”
তুষার আশ্বাস দেয় তাকে, “সব ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।”
রাতের আঁধার পেরিয়ে সূর্য উঠে আসে আকাশের বুক চিরে। সূর্যের প্রথম কিরণ চোখে পড়তেই মোহ নড়েচড়ে উঠে। সমুদ্র সাথে সাথেই তার চোখের সামনে হাত দেয়। যেন তার ঘুম না ভাঙে। লাভ হয় না তবুও। মোহের ঘুম ভেঙে যায়। সে টিমটিম করে চোখ খুলতেই এক হাত দেখতে পায় তার সামনে। ঘুম ঘুম চোখে টিপটিপ করে কতবার চোখ খুলে ও বন্ধ করে। অনুভব হয় তার এই শীতের সকালে একরাশ উষ্ণতা। সে অনুভব করতে পাড়ে এক সুঠাম শক্ত শরীরের মাঝে লেপ্টে আছে সে। সে মুখ তুলে তাকাতেই সমুদ্রকে এতটা কাছে দেখে প্রথমে কিছুটা হতবাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণ হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র স্বভাবতই হাসিটা ঠোঁটের কোণে রেখে জিজ্ঞেস করে, “ঘুম হয়েছে?”
কথাটা যেন মোহের কানের যায় না। সে স্তব্ধ হয়ে রয়। পুরুষালী ঘ্রাণ ম ম করে তার চারপাশে। সমুদ্রকে এত কাছ থেকে প্রথম দেখছে সে। এত কাছ থেকে তাকে আকর্ষণীয় লাগে। অতিরিক্ত আকর্ষণীয়। এতটা আকর্ষণীয় যে তার হৃদপিণ্ডটা ছটফট করতে শুরু করেছে।
“ঘুম ভাঙে নি এখনো?” সমুদ্রের কন্ঠে ধ্যান ফিরে মোহের। সে দ্রুত উঠে বসে। লজ্জায় রঙে যায় তার গাল দু’টো। কানে উপরের দিকটা সামান্য লাল হয়ে আছে। সে মিনমিনে সুরে বলে, “সরি কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝি নি।”
“নো প্রবলেম।” সমুদ্র উঠে আবার যেয়ে বসে লামিনের সাথে। মোহ তাকায় তার দিকে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। তার ভেতটায় কেমন এক অনুভূতি খেলছে। এই প্রথম, অনুভূতিরা ঝাপটে ধরতে চাচ্ছে তাকে। সে তো অনুমতি দেয় নি। তাহলে কেন তার মন তার অবাধ্য হচ্ছে বারে বারে?
সে আরেকপলক তাকায় তার সামনে বসা শ্যামসুন্দর পুরুষটির দিকে। তার ঠোঁটের কোণে নিজ অজান্তেই হাসি এঁকে উঠে। তারপর তার চোখ যেয়ে আটকায় সদ্য সূর্য উঠা আকাশের দিকে। সে দূর আকাশে হলদে গোলাকার সূর্যের আলোয় কিছুটা আকাশ কমলা হয়ে আছে। বাকি আকাশটুকুতে এখনো সূর্যের আলো সম্পূর্ণ আলো ছড়ায় নি। মোহকে আজকের সকালটা বিভোর করল। আজকের সকালটা একটু বেশিই সুন্দর।
চলবে….
#মেঘের_খামে
পর্ব ২১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
আজ ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি বের হলো মৃণা। অফিসে যেতে হবে। কাজের প্রথম দিনে কেমন নার্ভাস আর এক্সাইটেড দু’টোই লাগছে। তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য সে আজ দু’টো ক্লাস ফাঁকি দিয়েই চলে যাচ্ছে। আজ নিজের সবচেয়ে সুন্দর জামাটিও পরেছে সে। নিজের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা উপলক্ষে।
মৃণা ভার্সিটির গেইট থেকে বের হতেই দেখে একটি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়। মুখে মাক্স ও সানগ্লাস পরা। তবুও তাকে চিনতে তার এক মুহূর্তও লাগলো না। তাকে দেখেই তার আনন্দে মাতোয়ারা মনটায় ব্যাথা করল প্রকট। কিন্তু সে গেল না তন্ময়ের কাছে। তাকে না দেখার মতো এড়িয়ে যেতে চাইলো।
তবু তন্ময় তাকে যেতে দিলো না। দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়াল। তাকে কেমন এলোমেলো লাগছে। সবসময় নিজেকে গুছিয়ে রাখা তন্ময়ের চুল আজ উষ্কখুষ্ক। শার্ট আইরন করা না। চশমাটা খুলতে দেখা গেল চোখের নিচের কালো দাগ।
“তুমি আমাকে চিনতে পাড়ো নি মৃণা?” তন্ময়ের কন্ঠে বিস্ময়।
মৃণা উওর দিলো না। সে তো মুহূর্তেই চিনে নিয়েছিল তন্ময়কে কিন্তু তার সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছে না তার। ভাবনাটা আসতেই তার আজব লাগলো। যার সাথে কথা বলার জন্য দিনরাত তার হৃদয়ে তোলপাড় হতো আজ তার সাথে কথা বলতে রুচিতে বাঁধছে? হৃদয় কী এভাবে পালটায়?
তন্ময় আচমকা তার হাত ধরে নিলো। কেমন করুণ সুরে বলল, “তুমি আমার সাথে এমন কেন করছ মৃণা? তুমি তো জানো তোমার সাথে কথা না বললে আমার স্বস্তি লাগে না। তারপরও তুমি কীভাবে আমাকে ব্লক করতে পাড়লে মৃণা? আমি জানি বুশরা ফিরে আসায় তুমি ইনসিকিউরড ফিল করছ কিন্তু তুমি তো আমাকে একেবারে এভাবে দূরে সরাতে পাড়ো না।”
মৃণা তার হাত সরিয়ে নেয়, “কেউ তোমাকে এখানে দেখলে সমস্যা হবে। তুমি যাও।”
“আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি আমাকে ব্লক করেছ কেন? এক্ষুনি ব্লক খুলো।”
“না।” মৃণার উওর তেমন পছন্দ হলো না তন্ময়ের। তার এমনিতেই দুইদিন ধরে প্রচন্ড মাথাব্যাথা। এরমধ্যে মৃণার এমন ভিন্ন ব্যবহার সে মানতে পাড়ছে না। সে মৃণার হাত ধরে নেয়। এবার শক্ত করে, “তুমি এমন বিহেভ করছো কেন আমার সাথে? তুমি তো কখনো আমার সাথে এত রুক্ষ ব্যবহার করো নি।”
মৃণা ব্যাথায় হাত মুচড়ায়, “হাত ছাড়ো। আমি ব্যাথা পাচ্ছি।”
তন্ময় হাতের বাঁধন ঢিলা করলেও ছাড়ে নি। সে আবারও প্রশ্ন করে, “তুমি কেন করছ এমনটা?”
“কারণ আমি তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। প্লিজ লিভ মি এলোন। আমি তোমার চেহেরাও দেখতে চাচ্ছি না। তোমাকে দেখলে এখন আমার নিজের উপর ঘৃণা লাগে যে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।”
কথাটা যেন তন্ময়ের উপর বজ্রনির্ঘোষের মতো লাগল। তার ঠোঁট নড়লো কিন্তু কোনো কথা বের হলো না। সে ঢোক গিলল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মৃণার দিকে। আচমকা সে এক কাজ করে বসলো। সে মৃণার হাত টান দিয়ে তাকে বুকে ভরে নিলো। শক্ত করে ধরল তাকে। ভীষণ শক্ত করে। যেন ছাড়লেই তার পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে মৃণা।
মৃণা হতবাক। কারণ এর পূর্বে কখনো তাকে জড়িয়ে ধরে নি। অথচ আজ যখন সে ধরলো তার অতি অস্বস্তি লাগছে। চরম পরিমাণে। সে স্বপ্ন দেখেছিল অনেক, তার ও তন্ময়ের বিয়ের, তাদের সংসারের, এভাবেই তাকে একদিন কাছে টেনে নেওয়ার। সেদিন সে ভেবেছিল যখন তন্ময় তার কাছে আসবে তখন তার হৃদয়ের স্পন্দন এত বেড়ে যাবে যেন তন্ময় নিজেও শুনতে পাবে। আজ এমন কিছু হচ্ছে না। প্রতিবার তন্ময় তার হাতটা ছুঁলেও তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত অথচ আজ কোনো অনুভূতিই আসছে না একরাশ অস্বস্তি ছাড়া।
মৃণা খেয়াল করল আশেপাশের সকল মানুষ তাদের দেখছে। মৃণা তাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইলে তন্ময় আরও শক্ত করে তাকে ধরে। কেমন ভেজা গলায় বলে, “কী দোষ আমার? আমি বুশরা’কে বেছে নিয়েছি এজন্য তুমি রাগ? তুমি তো জানো ও আমার প্রথম ভালোবাসা, কিন্তু তুমি…তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমার মা বাবা থেকেও তুমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মৃণা। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলো না।”
মৃণা তাচ্ছিল্য হাসে, “কাকে এসব কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছ আমাকে না নিজেকে?”
হঠাৎ তার মাঝে এত শক্তি কোথা থেকে এলো কে জানে? সে নিজের সব শক্তি দিয়ে দূর করল তন্ময়কে। তার দিকে তাকাল ঘৃণার দৃষ্টিতে, “আমি তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাইট? তাহলে যখন তুমি এওয়ার্ড পেয়েছিল তখন তুমি আমাকে ভুলে গেলে কীভাবে? তুমি তাদের সবার শুকরিয়া আদায় করেছ যারা তোমার গানের ক্যারিয়ারকে তুচ্ছ করেছে। তোমাকে তুচ্ছ করেছে। অথচ যে আমি তোমার সাথে সবসময় ছিলাম, প্রতিটা পদে কেবল আমি ছিলাম, তুমি সে আমাকেই ভুলে গেলে? আমি তোমার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হলে তুমি বারবার আমাকে কষ্ট দিলে কেন? আমাকে তোমার অফিসের সবার সামনে অপমান করলে কীভাবে? আমি তোমার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হলে তুমি সেদিন আমার কথা না শুনে ফোন রেখে দিলে কেন? কেবল বুশরা আপুর জন্য? না, তোমার নিজের জন্য। এখানে বুশরা আপুর কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোমার। তুমি জানো সেদিন আমি সময়ে মহুয়াকে কল না দিলে, মুরাদ ভাই সময়ে না এলে আমার… আমার….” শেষ কথাগুলো বলার সময় কান্নায় মৃণার দম আটকে আসছিল। তবুও সে বহু কষ্টে বলল, “তুমি সেদিন কল কাটার পর আমি বারবার তোমাকে কল দিয়েছিলাম। তুমি যখন ধরো নি আমি ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আত্নহ’ত্যার কথা ভেবেছিলাম। আমি সেদিন প্রথম তোমার সাহায্য চেয়েছিলাম। তুমি আসো নি। তুমি তো ব্যস্ত ছিলে তাই না? তুমি আমাকে এত কষ্ট দিয়েছ কিন্তু আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসা বন্ধ করিনি। সেদিন, সেসময় থেকে আমার হৃদয়ের খাম থেকে আমি তোমাকে মুছে দিয়েছি।”
শেষ কথাটায় তন্ময়ের বুকে প্রচন্ড ব্যাথা উঠে। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় মৃণার দিকে, “তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি আমাকে ভালোবাসতে কীভাবে ভুলতে পাড়ো মৃণা। এটা সম্ভব না।” সে মৃণার হাত ধরে রাস্তাতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, “আমি জানতাম না তুমি কোনো সমস্যায় ছিলে মৃণা। বিশ্বাস করো…বিশ্বাস করো আমি জানলে সব ছেড়ে এসে পড়তাম।”
হঠাৎ এক গাড়ি এসে থামে তাদের ঠিক পাশে। আচমকা স্পিডে মারসেডিস এসে থামায় সবাই চমকে যায়। গাড়ির ড্রাইভিং সিটের জানালা খুলতেই দেখা পাওয়া যায় জাহানের। সে ব্যাপারটা দেখে পরিস্থিতির পরখ করার চেষ্টা করল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে দাঁড়াল পকেটে হাত রেখে। আশেপাশে দেখল। কতজন দাঁড়িয়ে আছে আর কতজন ভিডিও করছে। মুহূর্তে সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠে সে, “সারকাস চলছে যে সবাই দেখছে আর ভিডিও করে সাথে নিয়ে যাচ্ছে। সব ভিডিও ডিলিট হবে, রাইট নাউ। যদি কোথাও এই ভিডিও যায় তাহলে তাদের সাথে কি করব আই রিয়ালি ডোন্ট নো।”
সবাই ফোন নিচে করে নিলো সাথে সাথে। জাহান মৃণার পাশে যেয়ে দাঁড়াল, “ও তোমার কেউ হয়?”
মৃণা প্রশ্নটা শুনে দ্বিধাবোধ করে। সত্যিই তো এখন তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বেনাম সম্পর্কের নাম নেই। যে সম্পর্কের নাম নেই, সে সম্পর্কও নেই। তাই সে মাথা নাড়িয়ে মানা করল।
জাহান তাকাল তন্ময়ের দিকে। তাকাল মৃণার হাত ধরা তার হাতে। সাথে সাথে সে তন্ময়ের কাঁধে লাথি মেরে সরিয়ে দিলো তাকে, “হাউ ডেয়ার ইউ? তোর এত্তো বড় সাহস আমার ভার্সিটির সামনে এসে একটা মেয়েকে হ্যারেজ করছিস?”
জাহানের এমন কান্ডে চমকে উঠে মৃণা। জাহান আবার তন্ময়ের কলার ধরে তাকে মা’রতে গেলে সে ঘাবড়ে যায়, “ভাইয়া…ভাইয়া ওকে ছেড়ে দিন। প্লিজ।”
তার কথায় জাহান তন্ময়কে কিছু করল না। তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
ছাড় পেতেই তন্ময় সব ব্যাথা ভুলে আবার এলো মৃণার কাছে। তার দুই গালে হাত রেখে নরম সুরে বলল, “দেখলে তুমি এখনো আমার কষ্ট সহ্য করতে পাড়ো না। ভালোবাসো তুমি আমায়।”
মৃণা পিছনে সরে এলে তন্ময় আবার তাকে ধরতে যায়। জাহান তার হাত ধরে শক্ত করে। জাহান তার হাত জোরে ধরে বলে, “তোকে আর ওর আশেপাশে দেখলে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাবি না।”
“আর আপনি…আপনি কে এটা বলার?”
“ভাইয়া ডেকেছে শুনিস নি? ওর ভাই হই।”
কথাটায় মৃণা অবাক হয়ে তাকাল জাহানের দিকে। কথাটা শুনে তার বুকের ভেতরটা কেমন উষ্ণ হয়ে উঠে। তার মতো অনাথ, সম্পর্কের কাঙাল মেয়ের কাছে এতটুকু কথাও যে অনেক।
জাহান আবারও বলল, “এইখানে আরেকবার তোকে দেখলে বেঁচে থাকার জন্যও রিগরেট করবি ওকে?”
“ডু ইউ নো হু আই এম?” তন্ময় রাগান্বিত স্বরে বলে।
“আই ডোন্ট নিড টু। বাট ডু ইউ নো হু আই এম? ইয়াজভান জাহান।” তার পিছন থেকে জয় বলল, “ইভান এয়ারলাইন্স আর কর্পোরেশনের মালিকের ছেলে।”
কথাটা শুনে তন্ময় পিছপা হয়। সে আর তাকায় না জাহানের দিকে। মৃণাকে বলে, “আমি তোমার সাথে আবার দেখা করতে আসবো।” বলে সে গাড়িতে উঠে চলে যায়।
মৃণা ফিরে তাকায় জাহানের দিকে। নিজের ভেজা দুই গাল মুছে বলল, “থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। আমার জন্য আপনার কষ্ট হলো।”
“ভাইয়া বলেছ না? তাহলে বোনদের রক্ষা করা ভাইদের দায়িত্ব ওকে?”
মৃণার দুই ভাই থেকেও না থাকার মতো। কিন্তু মহুয়ার প্রতি মুরাদের এত ভালোবাসা দেখে সে সবসময় এমন এক ভাই চাইতো। কিন্তু মুরাদ তাকে সবসময়ই মনে করায় তার বোন হবার যোগ্যতা মৃণার নেই। অথচ আজ কেউ নিজ থেকে তাকে বোন বলেছে। তাও জাহান। যদিও মহুয়ার সাথে ঝামেলার কারণে সে জাহানকে অপছন্দ করতো। কিন্তু সে এটা বুঝেছিল জাহান মানুষ ভালো। আচ্ছা জাহান কী তাহলে তাকে দয়া দেখিয়ে কথাটা বলছে? এ ভাবনাতে তার মন খারাপ হয়ে যায়।
“কিন্তু…. ”
মৃণার কথা কেটে জাহান বলে,
“দেখো তুমিও মা হারা, আমিও মা হারা এই মিল তো আছে। এই হিসেবে তুমি আমার বোন ওঁকে? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।”
কথায় কোনো লজিক না থাকলেও মৃণার মন একদম গলে গেল কথাটা শুনে। সে হাসলো মৃদু। জাহান জয়কে বলল, “ওকে রিকশা ঠিক করে দেয়। আমি ভেতরে আছি।”
“জ্বি ভাই।”
জাহান পুণরায় গাড়িতে উঠতে নিলে মৃণা আবারও ডাক দেয়, “ভাইয়া…”
জাহান তাকায় তার দিকে।
মৃণা বলে, “মহুয়াকে এই ঘটনা জানিয়েন না প্লিজ। মহুয়া ওর অফিসে যেয়ে ওকে পিটিয়ে আসবে।”
জাহান কথাটায় হেসে দেয়, “সাউন্ডস লাইক হার। এমনি তোমার বান্ধবী আসে নি?”
“আজ ওর ফুফা বাসায় আসবে দুপুরে। তাই আসবে না।”
কথাটা শুনে মন খারাপ হলো জাহানের। আজ কি তাহলে দেখবে না সে মহুয়াকে?
.
.
মৃণা অফিসে যেয়ে পৌঁছাল আধাঘন্টা পর। রিক্সাতে উঠার পর অর্ধেক রাস্তা এসেছে। আর অর্ধেক রাস্তা হেঁটে এসেছে। তার কাছে আছে এখন সবে ছয় হাজার টাকা। এটা দিয়ে সারামাস চলতে হবে। বাকি ছয় হাজার এডভান্স দিয়ে একটা দুই রুমের ফ্লাট ভাড়া করেছে সে। সে ছাড়া তিনজন আগে থেকেই সেখানে থাকে। তাদের সাথে দেখাও করে এসেছে সে। আজ সেখানে উঠার কথা ছিলো। কিন্তু মহুয়া জানলে তাদের ছাদ থেকে আছাড় মেরে ফেলে দিবে। তাই সে সুযোগ খুঁজছে। এই সাপ্তাহে মহুয়ার গ্রামে যাবার কথা। সবার আগে সে সুযোগ বুঝে মুরাদকে বলবে তারপর তার সাহায্যে মহুয়াকে জানাবে।
সব ভাবনা করতে করতে অফিসে এসে পৌঁছাল। ঘড়ি দেখল। সময়ের আগেই এসে পৌঁছে গেছে।
মুরাদ ভাইয়ের কথা অনুযায়ী সে দোতলায় উঠল। দেখল সবাই কাজ করছে। আবার কয়েকজন গল্প করছে। তাকে এসে একজন জিজ্ঞেস করে, “কাকে চাই?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে তাকাল মৃণা লোকটির দিকে। মেরুন কালার স্যুট পরা গাঢ় শ্যামবর্ণের লোক। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।
সে মিনমিনে সুরে বলে, “মুরাদ ভাইয়ার সাথে দেখা করতাম।”
“মুরাদ ভাইয়া? তুমি কী মহুয়া? না তুমি তো মহুয়া না। আমি ওকে কয়েকবছর আগে দেখেছিলাম। একদম অন্যরকম তুমি।”
মৃণা চোখ নামিয়ে নিলো, “আমি মহুয়ার বান্ধবী।”
“ওহ আচ্ছা তাই বলো। আসো, আমার সাথে আসো। বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম সাহিদ। ইউ ক্যান কল মি সিড।”
মৃণা সবাইকে কাজ করতে দেখে পিছনে গেল সাহিদের। সাহিদ মুরাদের কেবিনের ভেতরে ঢুকল। মুরাদের চোখ ছিলো ফাইলের দিকে। কাজ করছিল। সাহিদ বলল, “মুরাদ দেখ কাকে এনেছি!”
মুরাদ বিরক্তির সুরে বলল, “তোকে না বলেছিলাম নক কেবিনে ছাড়া ঢুকবি না। তুই…” চোখে তুলে মৃণাকে দেখে চুপ হয়ে গেল সে। ঘড়ি দেখল। কপাল কুঁচকে বলল, “তোর তো এখন ক্লাস হবার কথা। এত তাড়াতাড়ি এলি কীভাবে?”
“শেষ দুইটা ক্লাসের পড়া আগেই পড়ে ফেলেছিলাম তাই এসে পড়েছি।”
মুরাদ সাহিদকে জানাল, “ও আজ থেকে আমাদের অফিসে কাজ করবে। নওশিদের এসিস্ট্যান্ট।”
কথাটায় সাহিদ চোখ টমাটোর মতো বড় বড় করে তাকাল মুরাদের দিকে, “তোকে শালা দুইমাস ধরে বলতেছি আমার এসিস্ট্যান্ট গেছে। আমার জন্য একটা এসিস্ট্যান্ট খুঁজে দে। দিলি তো নাই। উলটো নিজের এসিস্ট্যান্টের জন্যও এসিস্ট্যান্ট খুঁজে নিলি?”
“আচ্ছা যা নওশিদ এখন আমার আর তোর দুইজনের কাজ দেখবে। যেহেতু মৃণা আছে ওর হেল্প হয়ে যাবে।”
“এত ঝামেলা না করে আমি এই পিচ্চি মেয়েটাকে রেখে দিলেই তো হয়।” সে মৃণার কাঁধে হাত রেখে বলে।
মুরাদ সে ফাইল থেকে নিজের চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। তার চোখ দেখেই তো সাহিদের জান যেন গলায় আটকে যাবে। চোয়াল শক্ত করে এমনভাবে দেখছে যেন গিলে খাবে তাকে। সাহিদ তো ভড়কে গেল। সে দেখল মুরাদের চোখ মৃণার কাঁধে রাখা হাতে। সে সাথে সাথে হাত সরাল। তার হাত ভাঙার আগে। সে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বলল, “একচুয়ালি দোস্ত তুই ঠিক বলেছিস। তুই তো যা বলিস ঠিকই বলিস।”
মুরাদ তার থেকে চোখ সরাল। মৃণাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই খেয়েছিস?”
মৃণা মাথা নাড়ল। খায় নি।
মুরাদ কল দিলো নিচের ক্যান্টিনে। খাবার দিয়ে যাবার জন্য। সাহিদ তখন বলল, “আমার জন্যও দে ভাই, আমার পেটেও হাতিরা কাবাডি খেলছে।”
কথাটা শুনে মৃণা মুখ টিপে হাসল।
মুরাদ তার দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, “এত হাসছিস কেন? পেটে ক্রিমি হয়েছে না’কি?”
“না ভাইয়া। কী বলেন এসব?”
মুরাদ জোরে টেবিলে থাপড় মারে। এত জোরে যে সাহিদ ও মৃণা একসাথে পিছিয়ে যায়, “এটা অফিস ভুলে গেছিস? এখানে কীসের ভাইয়া? আর আমি তোর কোন কালের ভাই লাগি? স্যার বলবি। মুখ থেকে স্যার বাদে কোনো শব্দ শুনলে মুখ সেফটিপিন দিয়ে আটকে দিব।”
মৃণা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে যায়। কাঁদোকাঁদো মুখ করে নিচে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে পিওন খাবার নিয়ে আসে। মুরাদের ইশারায় মৃণা সামনের চেয়ারে বসে। সাহিদ তার পাশে বসতে গেলে মুরাদের দৃষ্টিতে দ্রুত চেয়ার নিয়ে এসে বসে মুরাদের পাশে। মুরাদের হাতে খোঁচা মেরে তার ধ্যান নিজের দিকে করে। মৃদুস্বরে বলে, “ভাই আমার কেন মনে হচ্ছে তুই যেকোনো সময় আমাকে আছাড় মারবি?”
“লাফালাফি বন্ধ না করলে অবশ্যই তোর কপালে আছাড় খাওয়া আছে।”
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুই ওর প্রতি প্রটেক্টিভ হয়ে এই আছাড়টা মারবি।”
মুরাদ আড়চোখে তার দিকে তাকায়। বিরক্তি নিয়ে। তারপর উঠে যায়। আচমকা তার রাগান্বিত স্বর পালটে নরম হয়। সে শার্টের হাতা বটে কণুই পর্যন্ত তুলে খাবার বেড়ে দেয়। মৃণা দেখে সে বাড়তে আছে তো আছেই। সে তো মুরাদ থেকে এবার খাবার দেখে বেশি ভয় পায়, “ভাইয়া…” ডাকটা শুনে মুরাদ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। ভড়কে যায় মৃণা। আমতা-আমতা করে বলে, “স্যার। আর দিয়েন না। এটা আমি চারদিনেও শেষ করতে পাড়ব না।”
“একারণেই তো শরীরের এই অবস্থা। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না করে কঙ্কাল হয়েছিস। তিনমাস পনেরো কেজি না বাড়ালে ছাদ থেকে ফেলে দিব।”
মৃণা করুণ চোখে তাকাল মুরাদের দিকে। লাভ হলো না। মুরাদের মন গললো না। সে প্লেট টেনে বিড়বিড় করে বলল, “দুই ভাইবোন একরকম। হুমকি দেওয়া তাদের সবচেয়ে পছন্দের কাজ।”
এমন সময় আরও একজন আসলো রুমে, “বাহ তোরা দেখি ভালোই খাওয়া দাওয়া শুরু করে দিয়েছিস। তাও আমাকে ছাড়া।”
“বোস, খাবারে হবে।” মুরাদ বলল, “মৃণা ও হচ্ছে রিয়াজ। রিয়াজ আর সাহিদ আমার বিজনেস পার্টনার।”
মৃণা সালাম দিলো তাকে। রিয়াজ মৃণার পাশে চেয়ার টেনে বসলে সাহিদ ড্যাবড্যাব করে তাকায় মুরাদের। তার ভাবহীন ভঙ্গি দেখে মুখ বানালো। বলল, “আমি বসলে তোর চাহনি দেখে মনে হয় চোখ দিয়ে বোম্ব ছাড়বি এখন কি তোর চোখে ঠাডা পড়ছে? দেখিস না সামনে।”
মুরাদ তার কথা বুঝলেও মৃণা রিয়াজ কেউ কিছু বুঝলো না।
মুরাদ তার দিকে না তাকিয়েই বলল, “তোর মতো ছ্যাঁচ্চর না’কি ও? মেয়ে দেখলেই প্রেম হয়ে যায়। একটা প্রেম করেছে তাকেই বিয়ে করেছে।”
“তুই… তুই আমাকে এভাবে বলতে পাড়লি?” সে রাগে ফুঁসে মৃণার কাছে বিচার রাখল, “এখন মৃণা তুমি বিচার করো। ভার্সিটিতে থাকতে তিনটা মেয়ের সাথে প্রেম করেছি তিনটা মেয়েই ব্রেকাপ করেছে এই বলে যে ভালো চাকরির ছেলে পেয়েছে। এরপর আরও চারটা প্রেম করেছি। এই আমার বাবাজি আমাকে হুমকি দিয়েছে যেন আমি কাওকে না বলি যে আমি এই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। যেন বলি আমি যাস্ট ওয়ার্কার। তাও লো স্যালারির। এটা বললেই পালায়।”
রিয়াজ তখন গর্ব করে বলে, “আমার অহনার মতো মেয়ে খুঁজতে সফল হলি না তাই এখনো সিঙ্গেল বুঝলি? যখন আমাদের ব্যবসা বারবার ক্ষতিতে গেছে তখনও আমার সাথে ছিলো। এখনো আছে।”
মৃণা তার কথায় মুচকি হাসল। এমন সফল ভালোবাসার গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে?
তখন সাহিদ আবারও বিচার দেয় মৃণাকে, “আচ্ছা তুমিই বলো সঠিক মেয়ে পাই না এটা আমার দোষ?”
রিয়াজ বলল, “অফকোর্স তোর দোষ। তুই খুঁজিস মেয়ে সুন্দরী, গুণবতী, ফ্যাশনেবল, হাইলি এডুকেটেড। মেয়েরও তো তোর থেকে তেমনই আশা থাকবে।”
“ধ্যুর এই প্রেমেই ভেজাল আছে। আমার কথা নাহলে বাদ দে আমি অনেক বাছাই করি। মানলাম। কিন্তু আমাদের সিনিয়র ভাই ওইটার কথা মনে আছে?” রিয়াজের সাথে মাঝখানে কথা বাদ দিয়ে মৃণাকে আবার বলে, “জানো মৃণা, আমাদের একটা সিনিয়র ভাই ছিলো কলেজে। ব্রিলিয়ান্ট। টোটালি ব্রিলিয়ান্ট। আর হ্যান্ডসামও। সে একটা মেয়েকে এত ভালোবাসতো যে সম্পূর্ণ কলেজে তার ভালোবাসার গল্প ছড়িয়ে গেছে। পাড়লে আকাশের চাঁদটাও এনে দিতো। মেয়েটা অবশ্য এত সুন্দর ছিলো না। কিন্তু ভাইয়া এত যত্ন করতো, এতো আলগে রাখতো যেন কোনো অমূল্য রতন। ভাইয়াটা বিদেশে পর্যন্ত স্পেশাল কোর্সে চান্স পেয়েছিল। আর এখানে মেয়েটা অন্যকাওকে বিয়ে করে ফেলেছে। বলল তার মা বাবা জন্য নাকি বিয়েটা করতে সে বাধ্য হচ্ছে। অথচ সবাই জানে সে বিয়েটা করছে কারণ পাত্রের অহরহ টাকা আছে। বংশগত বড়লোক। অথচ জানো এই কথা সবাই জানে, মানে। কিন্তু ভাইয়াটা এখনো মানতে নারাজ। এমন একটা মেয়ের বিরুদ্ধে আজও কথা শুনতে পাড়ে না। তার সামনে রক্ষাকবচের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ভাইয়ার সামনে কেউ ওকে একটা খারাপ কথাও বলতে পাড়ে না। প্রেম আসলেই অন্ধ।”
মৃণা লোকটাকে চিনে না কিন্তু তবুও তার খারাপ লাগল তার জন্য। যদিও মৃণা কারো সাথে কথা বলে না সহজে। সে সোশ্যাল না একটুও। তাই এতক্ষণ ধরে চুপ ছিলো। কিন্তু সাহিদে শেষ বাক্যের উওর না দিয়ে তার মন মানল না, “আসলে প্রেম অন্ধ না। কিন্তু প্রেমে পড়ার পর ভালোবাসার মানুষের ভুলগুলো দেখতে ইচ্ছা করে না। কেউ যদি চোখে আঙুল তুলেও দেখিয়ে দেয় তবুও না। তবে যে মুহূর্তে সে ভুলগুলো নিজ হৃদয় থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করে সে মুহূর্তে বুকের সব ভালোবাসা আপনা-আপনি মুছে যায়।”
কথাটা শেষে মৃণা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর দেখলো তিনজনই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হাসি দিয়ে তাকালে সাহিদ ও রিয়াজ স্বাভাবিক হলেও মুরাদ তার দিকে তাকিয়েই রইল। তার মুখের ভাব দেখে তার মনের ভাবনার বই পড়তে পাড়লো না মৃণা। কি ভাবছে তার দিকে তাকিয়ে জানতে পাড়লো না।
.
.
মোহ ঘুম থেকে উঠলো সন্ধ্যায়। তারা সকালে আসার পর সবাই ঘুমিয়েছে মোহ ছাড়া। সে তিনঘণ্টা ঘুমের পর মোহের আর ঘুম এলো না। তাকে ঘুমে ধরল দুপুরে। যখন তারা সকলে খাবার খেতে যেত। সে গেল না। ঘুম পূরণ করল। ঘুম থেকে উঠে ঈশাকে দেখল না। কক্সবাজারে এসে হোটেলে দুইটা রুম নিয়েছিল তারা। একটি রুমে ছিলো সে ও ঈশা আর অন্যরুমে ছেলেরা। সে তৈরি হয়ে কল দেয় সমুদ্রকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঈশা তাকে নিতে আসে। তারা চারতলা থেকে প্রথমে দোতলায় নামে। দেখে সেখানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে ছেলেরা।
ঈশা মোহকে নিয়ে আসার পর সমুদ্র খোঁচা মেরে বলে, “মধু দেখছি কুম্ভকর্ণও তোমার ঘুম দেখে বলবে, আমি তোমার শিষ্য হতে চাই। রাতে ঘুমিয়ে আমার কাঁধ ব্যাঁকা করে এখনো এত লম্বা একটা ঘুম কীভাবে দিতে পাড়ো তুমি?”
ঈশা চাটি মারলো সমুদ্রের কাঁধে, “বাচ্চা মেয়েটাকে বিরক্ত করিস না তো।”
“কে বাচ্চা? ও?” সমুদ্র ভ্রু নাঁচিয়ে তাকাল মোহের দিকে। তার মুখ শুঁলাল বলার জন্য এই বাচ্চা মেয়েটা বাসররাতে তাকে কীভাবে লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু নিজের সম্মানের খাতিরে বহু কষ্টে চুপ থাকলো।
মোহ ঈশার দিকে তাকিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, “আপু আমার না অনেক খিদে পেয়েছে। তোমরা কি দুপুরে খেয়ে ফেলেছ?”
সমুদ্র আবারও কথার মাঝে হাত ঢুকায়, “মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। এখনো দুপুরের খাবার খাব না?”
“জানি, নামাজ পড়েই এসেছি। কিন্তু আমার আর সহ্য হচ্ছে না। মহুয়ার ভূত আমার মাঝে ঢুকছে।”
“কার?” লামিন অবাক হয়ে তাকায় মোহের দিকে।
মোহ তাকে বুঝায়, “মহুয়া হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বুঝলেন ভাইয়া? আর ওর জীবন শুধু খাবারের চারপাশে ঘুরে। আপনি খাবার দিয়ে ওকে কিডন্যাপও করতে পাড়বেন।”
“ওহ। সিঙ্গেল আছে কী?”
“শুধু কিডন্যাপের পর আপনার জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিবে। চোখ বা হাত থাকবে না’কি তার গ্যারান্টি নেই।”
“সিঙ্গেল থাকুক বা মিঙ্গেল আমার কী তাই না?”
“আচ্ছা আমরা কী অন্তত নাস্তা খেতে পাড়ি?”
ঈশার হঠাৎ মনে পড়ে, “তুমি তো সকাল থেকেই কিছু খাও নি। না, গতকাল রাত থেকে। তুমি রাতেও খাবার খাও নি।”
কথাটায় কপাল কুঁচকে তাকায় সমুদ্র মোহের দিকে, “তুমি তো দুপুরেও খাও নি। মানে তুমি দুইদিন ধরে না খেয়ে আছো?”
সমুদ্রে মুখ হাসি থেকে গম্ভীর, গম্ভীর থেকে রাগান্বিত হয়ে যায়। সে আচমকা চেঁচিয়ে উঠে, “তোমার কী জ্ঞান বুদ্ধি নাই? দুইদিন ধরে না খেয়ে শরীর খারাপ করতে চাও তুমি?”
হঠাৎ সমুদ্রের এমন চেঁচানিতে ভড়কে যায় মোহ। এক মুহূর্তের জন্য ভয়ও পায়। সে আশেপাশে দেখে তিনজন চুপ। তাদেরও আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। যে ঈশা আপু সমুদ্রকে বকে সে-ও কিছু বলতে না। সে আবার তাকায় সমুদ্রের দিকে। রাগে তার চোয়াল শক্ত ও চক্ষুবর্ণ লাল হয়ে গিয়েছে। এভাবে তাকিয়ে আছে যেন কাঁচা গিলে খাবে। এই দেখে তারও রাগ উঠলো। সে-ও একই সুরে বলল, “আপনার সাহস তো কম না আমাকে চোখ রাঙান? আজ পর্যন্ত আমার বাবা আমার উপর চোখ রাঙায় নি আর আপনি রাঙান? চোখ নামান বেয়াদব লোক।”
সেখানে দাঁড়ানো তিনজন সদস্য দৃশ্যটা হা করে দেখল। তাদের বন্ধু সমুদ্র অনেক ইজি গোয়িং। সকলের সাথে ভালো। রসিক মানুষ। কিন্তু যখন তার রাগ উঠে তখন তার সামনে কেউ কিছু বলতে পাড়ে না। তার রাগ ভয়ংকর। তা সবাই জানে। একারণে তার পরিবার হোক, আত্নীয় হোক কিংবা বন্ধুমহল সবাই সে রাগলে চুপ করে যায়। তাইতো এতটুকু একটা মেয়ে সমুদ্রের সাথে এভাবে কথা বলাটা যে হজম হচ্ছে না। তাকে কি-না সোজা বেয়াদব বলে দিলো! তারা তিনজনে একত্রে তাকাল সমুদ্রের দিকে। তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সে এখনো রেগে আছে কিন্তু আগের মতো অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না।
তিনজনে তাজ্জব খেয়ে গেল। যে সমুদ্র রাগলে তার হুঁশ হারিয়ে ফেলে সে একটা পিচ্চি মেয়ের কথা শুনছে?
সমুদ্র স্বাভাবিকভাবে মোহের হাত ধরে বলে,”আসো, খেতে যাবে।”
মোহ অটলভাবে বলে, “যা তা খাবো না কিন্তু। এখানে স্পেশাল যা পাওয়া যায় ওটা খাব।”
সমুদ্র একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার বিরক্তি নিয়ে পিছনে তাকায় তার বন্ধুদের দিকে, “তোদের কি আমন্ত্রণপত্র দিতে হবে?”
সকলে অটোরিকশায় উঠে গেল ডলফিন রোডে। পউষী রেস্টুরেন্টে। সেখানে যেয়ে সমুদ্র নানা রকম ভর্তা, ইলিশ মাছের পাতুরি, পাহাড়ি মুরগি, ডাল, আঁচাল, রুপচাঁদা মাছ ভাজা সব অর্ডার করেছে। আর ভাত এনিয়েছে কেবল একপ্লেট। সে মোহের দিকে তাকিয়ে বলল, “খাচ্ছো না কেন?”
মোহ ড্যাবড্যাব করে তাকায় তার দিকে, “খাব মানে? আপনাদের ভাত কোথায়?”
“আমরা দুপুরে খেয়েছি। কুম্ভকর্ণর শিষ্য আমরা নই।”
মোহ সরু চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে, “এগুলো আমি একা খাব? ব্রেন কী ঢাকাতেই ফেলে এসেছেন?”
“না খেলে বাকিগুলো প্যাক করে নিব।”
“সবার জন্য ভাত আনান। সবাই খাব।” মোহের কন্ঠে আদেশের সুর। কিন্তু সে যখন ঈশার দিকে ফিরে তাকাল তার ভঙ্গিই বদলে গেল। সে মিষ্টি সুরে বাচ্চামো করে বলল, “আপু তুমি আমার সাথে খাবে না?”
ঈশা তো নিজের বুকে হাত রেখে দেয়। মোহের সৌন্দর্যে তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “তুমি এত কিউটভাবে বললে তো আমি বিষও খাবারের সাথে খেয়ে নিব।”
এই কথায় মুখ বানায় সমুদ্র, “যত্তসব ঢঙ!”
ঈশা মুখ কুঁচকে তাকায় সমুদ্রের দিকে। দুইহাত মোহের গালে রেখে মুখ ফেরায় সমুদ্রের দিকে, “ভালো করে দেখ এত্ত প্রিটি ও কিউট ফেসকে কে রেজিস্ট করতে পাড়ে?”
সমুদ্র হাসতে হাসতে ডাকে ওয়েটারকে। বাড়তি ভাত ও খাবার অর্ডার দেয়।
খাওয়া শেষে তারা কলাতলী বিচের কাছে যায়। গাছ গাছালীর পিছন থেকে সৈকত এই প্রথম চোখের সামনে দেখে মোহের মন আনন্দে আত্নহারা। সে ঈশার হাত ছেড়ে দৌড়ে সামনের দিকে যায় সাগরের এই অপরূপ দৃশ্য আরেকটু কাছের থেকে দেখার জন্য। আকাশের বুকের সাথে মেশানো সাগরের থৈথৈ ঢেউ সূক্ষ্ম বালির কণার সাথে এসে মিশে যাচ্ছে। সামনেই ছাতার নিচে কতগুলো লাউঞ্জ চেয়ার রাখা। সে দৌড়ে সামনে যেতে নিলেই সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়, “এমনি তো নিজেকে কত ম্যাচিউর দেখাও, এখন বাচ্চাদের মতো দৌঁড়াচ্ছো? সবার সাথে থাকো।”
সমুদ্রের আদেশের সুরে মোহ মুখ ফুলায়। সে সমুদ্রের সাথেই থাকে।
তাদের দেখে ঈশার চোখ সিক্ত হয়ে আসে। সে নরমসুরে বলে, “দেখেছিস সমুদ্র মোহের কত খেয়াল রাখে। একদিন এই খেয়াল রাখতে রাখতেই প্রেমে পড়তে পাড়ে তাই না?”
সে আশান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় লামিন ও তুষারের দিকে। তারা তার কথায় একমত নয়। লামিন বলে, “কিন্তু সমুদ্র তো সবারই এমন খেয়াল রাখে। এর উপর ও নিজের দায়িত্বে মোহকে এনেছে।”
“কিন্তু দেখ ওর দৃষ্টিতে….”
“ওর দৃষ্টি যেভাবে জবাকে খুঁজতো, ওর দিকে আটকে থাকতো তেমন কিছুই ওর দৃষ্টিতে মোহের জন্য দেখতে পাড়ছি না’রে। তুই অকারণে আশা বেঁধে আছিস।” লামিন তাকায় সমুদ্র ও মোহের দিকে৷ তারা একটু সামনে এগিয়ে গেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “যদি মোহের প্রতি সমুদ্রের দৃষ্টিতে একবিন্দুও ভালোবাসা দেখতে পাড়তাম…যদি দেখতে পাড়তাম।”
ঈশার মন উদাসী হয়ে যায়। কথাটা সত্যি হলেও সে মানতে চায় না। সমুদ্রের জবার প্রতি উন্মাদের মতো ভালোবাসা দেখেছে সে। এমন ভালোবাসার পরিণতি এত জঘন্য হতে পাড়ে এই কল্পনা সে কখনো করেনি। সমুদ্রের বুকের ভেতর কত-শত তুফান আছে তারা জানে। এক সময়ের ক্যারিয়ার নিয়ে উদ্যমী তার স্বপ্ন পূরণের সব দোয়ার নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে। এই মোহ-ই তাদের শেষ আশা।
“মধু তুমি যেভাবে খুশিতে লাফাচ্ছো মনে হচ্ছে কক্সবাজারে না চাঁদে এসে পড়েছ।” সমুদ্র মোহের দিকে তাকিয়ে বলল। সে এতদিনে ভেবেছিল মোহ তার বয়সের গুলনায় অতিরিক্ত ম্যাচিউর আর গম্ভীর। কিন্তু এখন দেখছে সে বাচ্চামোও করতে জানে।
“আপনি কীভাবে বুঝবেন? আমি প্রথমবার সমুদ্র দেখছি। ইশশ কী সুন্দর!” মোহ মুগ্ধ সুরে বলল।
সমুদ্র সেখানে থেমে যায়। সমুদ্রের হাত ধরে থাকায় মোহও থেমে যায়। সে পিছনে ফিরে তাকালে সমুদ্র তার খানিকটা কাছে এসে বলে, “মোটেও প্রথমবার দেখো নি। ভালো করে দেখো।”
সমুদ্র কাছে আসায় মোহের দৃষ্টি তার দিকে আটকে যায়। এই জীবনে শ্যামবর্ণের পুরুষটিই কেবল তার হৃদয়ের স্পন্দন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। একবার নয়, বহুবার।
এই প্রথম সে সরাসরি সমুদ্রের চোখের দিকে তাকাল। চোখজোড়া হাল্কা বাদামী রঙের। যেন তার দেহের রঙের সাথে মিলে যাচ্ছে। ঘন লম্বা পাঁপড়ি আরও সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে। সে নিজের নয়নজোড়ার প্রশংসা শুনেছে বহুবার। কিন্তু আজকের আগ পর্যন্ত অন্যকোনো চোখজোড়া তাকে আকর্ষণ করে নি। তার বলতে ইচ্ছে হলো, “হে শ্যামসুন্দর পুরুষ, আমি নিসন্দেহে বলতে পাড়ি তোমার চোখের সৌন্দর্যের কাছে এই সৈকতের সৌন্দর্যও তুচ্ছ।”
চলছে…