#মেঘের_খামে
পর্ব ২২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মুরাদ কিছু কাজ শেষ করে কেবিনের বাহিরে আসে দেখার জন্য সবাই কেমন কাজ করছে। বিশেষ করে মৃণা কি করছে। কিন্তু এসে দেখে অন্য কাহিনি। সাহিদ মৃণার ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলছে। মৃণাও মুখে হাসি নিয়ে তার উওর দিচ্ছে। তাদের আশেপাশে জমাট বাঁধা আরও কতগুলো মেয়ে। সাহিদ মেয়েদের কাছে কলেজের সময় থেকেই পপুলার। অফিসেও মেয়েরা তার পিছনে ভনভন করে।
মুরাদ এক রামধমক দেয় সবাইকে, “সবার মনে হয় কাজ একটু বেশি কম পড়ে গেছে তাই না?”
মুরাদের ধমক সবাই তার দিকে একসাথে তাকিয়ে দৌড়ে নিজের ডেস্কে যেয়ে বসে। সাহিদ তার পার্টনার ও বন্ধু হলেও সে-ও মুরাদকে সাংঘাতিক ভয় পায়। বিশেষ করে কাজের জন্য। সে আমতা-আমতা করে বলে, “দোস্ত আমরা তো কাজ করছিলাম। ব্রেক নিয়েছিলাম পাঁচমিনিটের জন্য আরকি।”
“তোর কাছে তো পাঁচমিনিটের মূল্য নেই দেখছি। আলোরা ইম্পোর্টের ফাইল আগামী মাসে দেবার কথা ছিলো না তোদের ডিপার্টমেন্টের। ওটা এখন পাঁচদিন আগে দিবি।”
সাহিদ যেন আঁতকে উঠে, “দোস্ত…”
“ছয়দিন আগে।”
“কিন্তু…. ”
“সাতদিন।”
সাহিদ বহুকষ্টে নিজের মুখে হাত রেখে ফিরে যায় নিজের কেবিনে।
মৃণা চুপ করে এসব দেখছিল। এবার তার ডাক পড়ে, “আর তুই জলদি আমার অফিসে আয়।”
মৃণা যখন বুঝে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে তখন এক ঢোক গিলে। মুরাদ কেবিনে ঢোকার পূর্বাভাস বলে, “কুইক।”
মৃণা দ্রুত উঠে যায় মুরাদের কেবিনে। তার ধ্যান ছিলো মুরাদের রাগ উঠেছে তাই তাড়াতাড়ি তার মুরাদের সামনে যেয়ে পৌঁছাতে হবে। মুরাদ রাগে ব্লাস্ট হবার আগেই। সে দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার জলদিতে সামনে দেখে না। যেয়ে ধাক্কা খায় মুরাদের সাথে। সাথে সাথে সে সরে নিজের নাক ঢলে। মুরাদের সাথে ধাক্কা খেয়ে তার নাকে লেগেছে।
মুরাদ কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “এখানে তোকে চাকরি দিয়েছি যেন তুই এখন থেকে সব ধরনের কাজ বুঝে যেন গ্রাজুয়েশন শেষে ভালো পজিশনে যেতে পাড়িস। আর এখানে তুই বসে গল্প করছিস?”
মুরাদের ধমক শুনে মৃণা কাঁচুমাচু হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ‘সরি’ বলে।
মুরাদ তাকে আদেশের সুরে বলে, “যেয়ে তোর সব জিনিসপত্র এখানে নিয়ে আয়। তুই এখানে বসে কাজ করবি।”
তার কথা মৃণার মাথায় ঢুকে না। ভাবে, ভুল শুনেছে।
“কোথায় বসে কাজ করব?”
“এখানে আমার রুমে?”
“আমি?”
এবার মুরাদের রাগ উঠে যায়, “এই মেয়ে তুই শুনতে পাড়িস নি কি বলেছি। জলদি যা, নাহলে একটা থাপ্পড়ও মাটিতে পড়বে না।”
মৃণা মুখ ফুলিয়ে বাহিরে যেয়ে নিজের ব্যাগ ও নওশিদের দেওয়া একটা ফাইল নিয়ে এলো। কেবিনে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো। কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় বসব?”
“আমার সামনে দুইটা চেয়ার আছে তা কি চোখে পড়ে না তোর?”
মৃণা গোমড়া মুখে বসলো সেখানে। ওই ডেস্কে তার ভালোই লাগছিল। সে কারো সাথে তেমন কথা না বললেও আশেপাশের সবাই যে ভালো সে বুঝেছিল। কাজের মাঝে টুকটাক সবাই মিলে গল্প করছিল। মৃণারও ভালো লাগলো। কাজের মাঝে একটু গল্প করলে কী হয়?
মুরাদ আবার জিজ্ঞেস করে, “তোর টায়ার্ড লাগলে একটু টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নে। রুমে জায়গা করে একটা সোফা আনিয়ে নিব। ভার্সিটি থেকে এসে রেস্ট নিয়ে তারপর নাহয় কাজ করবি।”
মৃণার মুখ ফুলানো আরও বাড়ল। সবে মাত্র কিছু সেকেন্ডের জন্য কাজ বাদে সবার গল্পে মন দিয়েছে বলে কি বকলো! আর এখন তাকে ঘুমুতে বলছে? বজ্জাত লোক একটা! মনে মনে মুরাদকে কতটা সরল বকা বকে মৃণা কাজে মনোযোগ দিলো। যে টপিক তার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল মুরাদ তাকে সহজে বুঝিয়ে দিলো। তার সাথেই বাসায় এলো মুরাদ।
মৃণা মুরাদের সাথে ভেতরে আসতেই মহুয়ার মা বলে, “তোরা এসেছিস? আমি তোদের জন্য শরবত বানাচ্ছি।”
“উপরে পাঠিয়ে দিও। আমি শাওয়ার নিচ্ছি।” বলে মুরাদ উপরে উঠতে থাকে।
মৃণা দেখল মহুয়া সোফায় বসে টিভি দেখছে ও আঙুর খাচ্ছে। সে যেয়ে মহুয়ার পাশে বসে থপ করে। বিরক্তি প্রকাশ করে প্রশ্ন করে, “মহু একটা কথা জিজ্ঞেস করি? কিছু মনে করবি না।”
মহুয়ার ধ্যান তখন টিভির দিকে। সিনচ্যান কার্টুনের দিকে। তবুও সে উওর দেয়, “বইন তোগো কথায় জীবনে মাইন্ড করছি?”
“আচ্ছা মুরাদ ভাইয়ার কী সমস্যা? পাগল না’কি?”
“তুই আজকে জানলি?” মহুয়া এবার অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে, “আমার আপন র’ক্তের ভাই সুস্থ হইব কেমনে?”
মৃণা মুখ হাত দিয়ে ঢাকে। কোন পাগলকে কি জিজ্ঞেস করে!
তারপর সে সুযোগ বুঝে অন্য জায়গায় শিফট করার কথা বলতে চায়৷ এর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকবার বলেছে। মহুয়া বুঝে নি। তাই আজ সরাসরি বলে, “আচ্ছা দোস্ত আগামী মাস থেকে তো বেতন পাব আমি।”
মহুয়া বোধহয় কথার ভান ধরতে পাড়ে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “তো?”
মৃণা ঢোক গিলে। তবুও সে সাহস করে, “আচ্ছা যদি ভালো একটা বাসা দেখে….”
“ছাদ থেকে আছাড় মারবো তোকে।”
মৃণার আর কিছু বলার থাকে না। সে জানতো এমনই হবে। মৃণাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মহুয়া হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। মৃণা আফসোসের নিশ্বাস ফেলে, “দুই ভাই-বোন সত্যিই একরকম।”
.
.
মোহ সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে সমুদ্র ও তার বন্ধুদের পানিতে খেলতে। তার পানির কাছে যেতে ভয় লাগে। সে সাঁতার জানে না। এই অন্ধকারে পানিতে পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে।
সে একা দাঁড়িয়ে আসমান ও সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। এমন সময় কেউ তার পিছন থেকে বলল, “কী খবর সুন্দরী, এত রাতে একা একা দাঁড়িয়ে কার অপেক্ষা করছো?”
মোহ শব্দ শুনে পিছনে ফিরতেই দেখে তিনটি ছেলে দাঁড়ানো। ছেলেগুলো তাকে দেখে কেমন চমকে গেল। একটি ছেলে বলল, “সুন্দরী তো এমনি বলেছিলাম। চেহেরা দেখে তো সুন্দরী বললেও ভুল হবে। পরী বলতে হবে।”
অন্য ছেলেও তাল মেলায়, “একদম। সাক্ষাৎ যেন পরীর দর্শন করছি। তো পরী, কারো অপেক্ষায় আছো না’কি? চাইলে আমরা তোমার অপেক্ষা মেটাতে পারি।”
মোহ চোখমুখ কুঁচকে নেয় তাদের জঘন্য কথা শুনে। সে সেখান থেকে যেতে নিলে প্রথম ছেলেটি তার হাত ধরে নেয়।
“বেইবি তুমি কি অন্যকারো সাথে এসেছ? সে নিশ্চয়ই তোমার মতো পুতুলকে যত্নে রাখতে জানে না। তুমি চাইলে আমি তোমার যত্ন সারাজীবন করতে পাড়ি।” কেমন জঘন্য ভাবে তাকাল সে মোহের দিকে। মোহের সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। এমন দৃষ্টি সে আরও অনেকবার দেখেছে তা সত্যি, কিন্তু কেউ সরাসরি তার সাথে এত বাজে ব্যবহার করার সাহস পায় নি। সে রেগেমেগে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটির দিকে। তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে অন্য একটি ছেলে বলে, “ভাই ছেড়ে দে, রেগে যাচ্ছে। ওর পরিবার আসলে সমস্যা হবে।”
“তুই চুপ কর। এত সুন্দরী মেয়েকে পরিবার আনলে একা ছাড়বে? এরা আসে অন্য উদ্দেশ্যে।” সে আবার মোহের দিকে তাকিয়ে বলে, “সারাজীবন নাহলে একরাতের সৌভাগ্য দেও। তুমি যত বলবে ততই দিব। তোমার কথা যাও।”
মোহের এবার রাগ মাথায় চড়ে যায়। সে প্রথমে কষিয়ে তার গালে থাপ্পড় মারে আর বুঝ উঠার আগেই জোরে ছেলেটের হাঁটুতে লাথি দেয়। হঠাৎ আক্রমণে ছেলেটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ব্যাথায় মোহের হাত ছেড়ে দেয়। মোহের ইচ্ছা হচ্ছিল তাদের নিজ হাতে শিক্ষা দিতে। কিন্তু এইটা হিতজ্ঞান হারানোর সময় না। বুদ্ধি নিয়ে কাজ করতে হবে। নাহলে ছেলেগুলো রেগে তার ক্ষতি করে দিতে পাড়ে। সে একটা মেয়ে তিনটা ছেলের সাথে পেড়ে উঠবে না। তাই এক দৌড় দিলো সমুদ্রদের দিকে। আর জোরে সমুদ্রের নাম ধরে ডাকতে থাকল।
ঈশা প্রথম তার ডাক শুনে সমুদ্রকে দেখায়। সমুদ্র কপাল কুঁচকে নেয়। মোহ তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো তাহলে অন্যপাশে কীভাবে গেল?
সমুদ্র আধো ভিজে গেছে। সে পানি থেকে উঠে মোহের কাছে যাচ্ছিল। এর আগেই মোহ দৌড়ে এসে তার শার্ট ধরল। ভীষণ ক্ষোভ নিয়ে দেখাল তিনটি ছেলেকে, “এই আপনি জিম করেন না? আজ জিমে ঢালা টাকা কাজে লাগান। ওই তিনটা ছেলেকে দেখছেন? ওদের ভর্তা বানান। চটজলদি।”
সমুদ্র এত গম্ভীরমুখে তাকে এসব বলতে শুনে মুখ বানায়, “মধু তুমি আমার জিমের ফায়েদা তো এভাবে উঠাতে পাড়ো না। বেচারাদের আমি মারব কোন দুঃখে?”
মোহ রাগে ফুসে উঠে, “আপনার বউকে রাত কাটাতে বলছে এই দুঃখে। প্রথম এসেছিল ডিস্টার্ব করতে আমি চুপ ছিলাম কিন্তু শেষ আমাকে কি-না আমার প্রস্ট্রিটিউট বলার চেষ্টা করল।”
সমুদ্রের স্বাভাবিক মুখখানা গম্ভীর হল। মুখে কালো ছায়া এসে বিরাজ করল। সে হাত মুঠো করে নিলো। সে আর এক মুহূর্তও ব্যয় করল না। কথাও শুনার একটু সময়ও দাঁড়ালো না। বাতাসের বেগে ছুটে গেল ছেলেগুলোর দিকে। ছেলেটাকে সবে তার বন্ধুরা বসা থেকে উঠিয়েছিল। দাঁড়াতেই সমুদ্র এসে তার মুখে সজোরে একটা ঘুষি মারে।
ছেলেটা মাটিতে পড়ে যায়। রেগেমেগে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই চুপসে যায়। তাদের থেকে বয়সে বড় হবে লোকটা। সুঠাম শক্ত দেহ। তার মতো হেঙ্গলা পাতলা ছেলে এই লোকের সাথে পেড়ে উঠবে না। তাই সে ভেতরের রাগ চেপে রেখে নরমসুরে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কী চাই ভাই? হঠাৎ এমন আক্রমণ করার কারণ কী?”
সমুদ্রের মাথা তো তাও ঠান্ডা হয় না। সে সরু চোখে তিনজনের দিকে তাকায়। পিছনে তাকিয়ে দেখে মোহকে নিয়ে তার বন্ধুরা আসছে। সে মোহের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, “তোদের মধ্যে থেকে কোন হারামির মুখ থেকে ওর জন্য বাজে কথা বের হয়েছে। তার জিহ্বা কেটে ফেলব আমি।”
ছেলের বন্ধু দুইজন সাথে সাথে প্রথম ছেলেটির দিকে ইশারা করে। সমুদ্র এক দুই না ভেবে তাকে কলার ধরে তুলে একের পর এক ঘুষি মারতে থাকে। ছেলেটি পালটা আক্রমণ করার না সুযোগ পায়, আর না শক্তি। বাকি ছেলে দুইটা পালাতে নিলে লামিন ও তুষার তাদের ধরে নেয়। মোহ তুষারকে বলে, “এই ছেলে আমাকে কিছু বলে নি। একে ছেড়ে দিন।”
ছাড়তেই ছেলে নিজের জান নিয়ে পালায়। লামিনের ধরা ছেলেটাকে তারা দুইজন মিলে সামলায়। মোহ তাদের দেখছিল দাঁড়িয়ে। তার মনে হলো এই মুহূর্তে মৃণা তার সাথে থাকলে তার জন্য কান্না করে দিতো আর মহুয়া বলতো, “এই মুহূর্তে পপকর্ণ আনতে ভুলে গেছি, ছ্যাঁহ!”
ভেবে সে হাসে। তুষারের কথায় তার ধ্যান ভাঙে, “সমুদ্র ছেড়ে দে, ম’রে যাবে।”
এবার মোহ সমুদ্রের দিকে তাকায়। দেখে ছেলেটির মুখে রক্ত জমে গেছে। নাক দিয়ে র’ক্তও বের হচ্ছে। সমুদ্র তাকে মে’রেই যাচ্ছে। সে দ্রুত যেয়ে সমুদ্রের বাহু ধরল, “এবার ছেড়ে দিন। আসলে ম’রে যাবে নাহলে।”
সমুদ্র রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “একটা মেয়ের সাথে এমন বাজে ব্যবহার করার পূর্বে ওর কথাটা মনে ছিলো না?”
“ছেড়ে দিন। পড়ে আমাদের ঝামেলা হবে।”
সমুদ্র ক্ষোভভরা দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মাটিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আবার বলে, “ফারদার কোনো মেয়ের দিকে খারাপ চোখে তাকালে চোখ উঠিয়ে নিব।”
ছেলেটি গড়িয়ে এসে মোহের পা ধরে নেয়, “মাফ করে আপু। আর এমন হবে না। ভাইকে বলেন এবারের মতো ছেড়ে দিতে। আপনাদের আশেপাশেও আর আসবো না।”
ঈশাও বুকের উপর হাত ভাঁজ করে সব দেখছিল। সে বলে, “আগুনে হাত দিলে এমনই হবে। ওর বউয়ের সাথে বাজে ব্যবহার করেছিস, তোকে জানে মা’রে নি এটাই বেশি।”
“যেকোনো মেয়ের সম্মানের জন্যই আমি এমন পদক্ষেপ নিব।” সমুদ্রের কথাটা শুনে মোহের বুকের ভেতর সূক্ষ্ম ব্যাথা হয়। যা হওয়া উচিত না। তার উল্টো খুশি হওয়া উচিত যে সমুদ্র মেয়েদের কত সম্মান করে। কিন্তু তবুও তার হৃদয়ের মাঝে কেমন উদাসীনতা ছড়িয়ে যায়।
.
.
শিকদার ভিলা,
রাত তখন বাজে দেড়টা। শায়ান আর মুহিব ও রাদিনের সাথে বাসায় ঢুকেছে সবে মাত্র। এসময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই তারা নিশ্চিন্তে প্রতিদিনের মতো ভেতরে এলো। কিন্তু আজ এসে ঘরের সব লাইট জ্বালানো দেখে সে অবাক হলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো তাদের বড় চাচা, ছোট চাচা ও দাদী বসে আছে ড্রইংরুমে।
তার চাচারা কিছু না বললেও দাদী বলেন, “এই সময় কোনো ভালো ঘরের পোলাপানরা বাসায় আসে? রাত দেড়টা বাজে।”
কথাটা শুনে মুহিব ও রাদিন একে অপরের দিকে তাকায়। ঠোঁট টিপে হাসে। আজ তারা তাড়াতাড়ি এসেছে উলটো। প্রতিদিন চারটার আগে তো আসেই না। অনেক রাত বাসাতেই আসে না।
শায়ান যেয়ে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তারপর গাল টেনে আদুরে সুরে বলে, “থাক, আমার জামিলা পাখিটা রাগ করে না।”
দাদী তাকে একের পর এক কতগুলো থাপ্পড় মেরে মুখে পান ভরে বললেন, “শয়তান পোলা কোনহানকার। লজ্জার মাথা তো আগেই খেয়ে রেখেছিস। এখন পরিবারের সম্মান ডুবানোর বাকি আছে না’কি? এত রাত কইরা আইছ কেন?”
“একটু পড়া ছিলো আরকি!”
দাদী ব্যাঙ্গ করলেন, “তোর আর পড়া। এত পড়লে টেনেটুনে পাশ আসে কীভাবে রে? তোরা একটা ছেলেও এই বংশের সম্মান আর রাখবি না।”
তারপর দাদী রাদিনের দিকে তাকালেন, “তোর বিয়ে কয়দিন পর আর তুইও এখন বাহিরে ফুর্তি করছিস?”
মৃ’ত আব্দুল্লাহ শিকদারের স্ত্রী জামিলা বেগম। তার তিন ছেলে। বড় ছেলে রিয়াজুর শিকদার। অতিরিক্ত চুপচাপ স্বভাবের। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে রাদিনের বিয়ে এই সাপ্তাহেই। মেঝো ছেলে শারাফ শিকদার। ঘরের কর্তা। তিনি দেশের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত আছেন। একমাত্র ছেলে শায়ান। আর ছোট ছেলে মায়মুন শিকদার। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। মুহিব ও পূর্ণি। তিনি চতুর প্রকৃতির মানুষ হলেও সাংঘাতিক অলস। নামে পারিবারিক ব্যবসায় কাজ করেন। অথচ সব বুদ্ধির কাজ করে মেঝো ভাই ও পরিশ্রম করেন বড় ভাই।
রাদিনকে কিছু বলতে না দেখে ছোট চাচা বললেন শায়ানের দিকে আড়চোখে তাকায়, “সবই সঙ্গদোষ আম্মা। সঙ্গদোষ।”
শায়ান সহজেই বুঝল তার ছোটচাচা তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছেন। সে কম কীসের? সে দাদীর কোল থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে। ছোট চাচার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তো চাচা আপনি বাদাইম্মা হয়েছেন কার সঙ্গদোষে?”
কথাটায় ছোট চাচা চেতে গেলেও কিছু বলতে রাগতে পাড়ে না। দিনশেষে সম্পূর্ণ সংসার চলে শায়ানের বাবার কারণে। স্বাভাবিকভাবেই দাপট দেখাবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “শায়ান আমি তোমার চাচা হই। বড়, সম্মান দিয়ে কথা বলো।”
“সম্মান তো কামানো লাগে ছোট চাচা। আপনি যে মুখের উপর খোঁটা দিবেন সে সাহস নেই আপনার। সম্মান আসবে কোথা থেকে?”
দাদী গম্ভীর গলায় বলে, “শায়ান চুপ করো।”
দাদীর ধমক শুনে শায়ান তার দিকে তাকায় হাসি নিয়ে। এই পৃথিবীতে সে কেবল তিনজনের জন্য হাসে। তার মধ্যে একজন হলো তার দাদী। সে তার দাদীর গাল টেনে বলে, “আহারে আমার মিষ্টি বুড়িটাকে রাগ করলে কত সুন্দর লাগে। দাদাজান দেখলে তো আবারও হার্ট অ্যাটাক করতো।”
এই ছেলেটার সাথে জামিলা বেগম রাগ করেও পারে না। মিছে রাগ দেখিয়ে তার হাত সরালেও তার মুখ দেখলে বুঝা যায় তার রাগ গলেছে। সে আদেশের সুরে বলে, “তোরা সবাই আগামী সাপ্তাহে থেকে নয়টার মধ্যে বাসায় থাকবি। আর আমরা পুরশুই মানিকনগর যাচ্ছি। সব কিছু গোছাতে হবে যেয়ে।” তারপর শায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, “বিশেষ করে তুই তো আমার সাথেই যাবি।”
কথাটায় শায়ান বিরক্ত হয়,”আমি এত দ্রুত যেয়ে কী করব?”
“তোর ভাইয়ের বিয়ে আগে যেয়ে সব কিছু তৈরি করবি।”
“দাদী ক’দিন আগেই এলাম বিদেশ থেকে। এখন ঘুরবো। কোথাও যেতে পাড়বো না।”
“যেতে তো তোকে হবেই, নাহলে তোর বাপকে ফোন দিয়ে আনাব তোর বিচার করতে। কি কি কান্ড ঘটাস সব বলব।”
“ব্লাকমেইল করছো?” শায়ান বিরক্তি নিয়ে তাকায়।
দাদী তার কাঁধে চাপড় মেরে বলে, “ঘরে থাকতে মন চায় না তো? রাদিনের পর তোরই বিয়ের পালা, তোকে সিধা করতে পাড়বে এমন বউ আনবো তোর জন্য। একবারে তোর টক্করের। যেন তোকে আঙুলে নাঁচায়।”
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ২৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মোহ ফরজের নামাজ পড়ে আর ঘুমায় না। গতকাল রাত সবাই দেরিতে এসেছিল। তার ঘুমাতেও দেরি হয়েছিল। এজন্য নামাজ পড়ে আবার শুয়েছিল। ঘুম আসে না। অভ্যাস হয়ে গেছে যে। মানুষ এই অভ্যাসের কাছেই যে হেরে যায়।
ঘুম না আসায় সে গেল ব্যলকনিতে। এখান থেকে সমুদ্র-সৈকত স্পষ্ট দেখা যায়। তবে এইখান থেকে বেশ ছোট লাগছে। সে মুগ্ধ নয়নে দৃশ্যটা দেখে। এখনো সূর্য উঠে নি। আকাশে মেঘ রঙ লাগায় নি। ধূসর নীল আকাশের রঙ যে সাগরের সাথে মিশে যাচ্ছে।
হঠাৎ তার মনে এক ছন্দ আসে এই সৌন্দর্য দেখে,
“মেঘের খামে যদি চিঠি পাঠাই সমুদ্রের নামে
লিখব হে জলধি,
তোমার সৌন্দর্যে হারিয়েছি আমি মোহিত চোখে,
অপূর্ণতার খোঁজে।
ঢেউ উল্লাস করবে যেদিন স্রোতের বুকে
সেদিন সমুদ্র বিলাস করব আমি ভোরের কুঞ্জবনে।”
মোহ ছন্দটা বলে আপনমনে হাসে। চোখ বন্ধ করে এই ভোরের মিষ্টিঘ্রাণ নিতে যায়। তার সকালের ও বৃষ্টির ঘ্রাণ অতিরিক্ত পছন্দের। আরও আজ সৈকতপাড়ে আছে সে। সমুদ্র সৈকতের কাছে বাতাসের ঘ্রাণ কেমন হবে তা জানার জন্য আরও বেশি কৌতূহলী হলো সে।
গভীর নিশ্বাস নিতেই কোনো মিষ্টি ঘ্রাণ তো এলোই না উলটো সিগারেটের বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে ভেসে এলো। তার বমির ভাব এসে পড়লো গন্ধে। সে পাশে তাকিয়ে দেখে পাশের বারান্দায় সমুদ্র বসে আছে। হাতে সিগারেট।
মোহের বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, “সকাল সকাল কেবল আপনিই পাড়েন সিগারেট নিয়ে বসতে। রাতে ঘুমান নি?”
“ঘুম আসছিল না। লামিন যেভাবে হাত পা ছড়িয়ে শোয়। গড়াতে গড়াতে আমি একটুর জন্য নিচে পড়ে যায় নি। এখন আমি তো আর তোমার মতো নির্দয় না সে লাথি মেরে ওকে ফেলে দিতে পাড়ব।”
মোহ চোখ ঘুরায়, “ভেরি ফানি। হাসতে হবে?”
“তুমি ঘুমাও না?”
“নামাজ পড়ে আর ঘুম আসছিল না।”
“তাহলে চলো।”
“কোথায়?”
“বিচে যাই। সূর্য উঠবে একটু পড়ে। এখন গেলে দেখতে পাড়বে। গতকাল সূর্যোস্তও দেখো নি। কক্সবাজার এসে সূর্যোদয় ও সূর্যোস্ত দেখতে না পাড়লেই মিস।”
“দশ মিনিটে আসছি। আপনি রুমের বাহিরে দাঁড়ান।” বলেই মোহ রুমে ঢুকে যায়।
মোহ একটা সাদা সেলোয়ার-কামিজ পরে। চুলগুলো ছেড়ে পাউডার, চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপ্সটিক দিয়ে বের হয় রুম থেকে। দেখে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে রুমের বাহিরেই। তাকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে বলে, “এই সময় এত মানুষ আসবে না বীচের দিকে। এত সাজুগুজু করার কী প্রয়োজন ছিলো?”
“আমি মানুষের জন্য সাজগোজ করি না। আমার ভালো লাগে বলে করি।”
“আচ্ছা এখন চলো।”
মোহ তার সাইড ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সমুদ্রের পিছে রওনা দেয়। নীরব করিডরে কেবল নুপুরের শব্দ হচ্ছে। ছনছন করে। সমুদ্র শব্দ শুনে মোহের পা’য়ের দিকে তাকায়। খেয়াল করে রূপালী রঙের চিকন নুপুর পরেছে। গতকাল থেকে ভিন্ন। মেয়েটার কি নুপুর এত পছন্দ না’কি?
মোহরা একটুর জন্য সূর্যোদয় মিস করে নি। ঠিক সুর্যোদয়ের আগে এসেছে। মোহ আসতেই দেখে সাগরের বুক চিরে বের হচ্ছে সূর্য। নীলচে ধূসর আকাশে কমলা রঙ ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। কী অপরূপ সৌন্দর্য!
মোহ দৌড়ে সাগরের কাছে যেতে নিলেই সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়,
“এই মিসেস অমধু আজ হাত ছেড়ে যাবে না বলে দিলাম, নাহয় গতকালের মতো কান্ড ঘটতে পাড়ে আবারও।”
সমুদ্র মোহের হাত ধরে সাগরপাণে এগোল। তবে মোহের আর সাগরে মন নেই। তার নজর গেঁথে আছে সমুদ্রের ধরা তার হাতে। সে চোখ তুলে তাকায় সমুদ্রের দিকে। সূর্যের প্রথম লালিমায় তার শ্যামলা রঙে যেন চকচক করছে। তার সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে যেন।
সমুদ্র যেয়ে দাঁড়ায় এক স্থানে। দাঁড়ায় মোহও তাল মিলিয়ে। সমুদ্র সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, “কক্সবাজারে এসে সূর্যোদয় দেখাটা আমার প্রিয়।”
মোহ সামনের দিকে একবারের জন্যও তাকায় না। তার দৃষ্টি জুড়ে আছে এই শ্যামসুন্দর পুরুষটি। সে মিষ্টি হেসে উওর দেয়, “আমারও।”
মোহ নিজের কান্ডেই অবাক হয় ভীষণ। সারাজীবনে কতজন তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছে। কিশোরী বয়সে আসতেই কত ছেলে তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত সে কোনো মানুষের জন্য এমন মুগ্ধতায় হারায় নি। অথচ এই পুরুষের সৌন্দর্যে হারিয়েছে? কী হচ্ছে তার সাথে এসব? সে নিজের মন, চোখ কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পাড়ছে না যেন।
তারা দুইজন হাঁটছে সাগর পাড়ে। মোহ হাঁটছে তার পিছনেই। সে চেষ্টা করছে সমুদ্রের পা’য়ের চিহ্নের উপর হাঁটতে। পানির ঢেউ বারবার আসায় সব পা’য়ের চিহ্ন মুছে যাচ্ছে। শীতল জল ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের পা। সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, “তুমি ছন্দ টন্দ করতে পাড়ো না’কি?”
“তেমন না কিন্তু মাঝেমধ্যে হঠাৎ মাথায় আসে।”
সমুদ্র হঠাৎ থেমে যায়। তার দিকে ফিরে তাকায়, “তো মেঘের খামে আমার নামে চিঠিটা যে দিয়েছ, আমিতে বিলাস করতে চাও না’কি?”
সমুদ্রের কন্ঠে দুষ্ট ভাবসাব। যা মোহ স্পষ্ট বুঝে। সে-ও পিছপা হবার মানুষ নয়। সে তাকায় সমুদ্রের চোখে। মৃদুস্বরে বলে, “তো বলুন কীভাবে আপনাতে বিলাস করা যাবে।”
উওরটা সমুদ্র আশা করে নি। সে হকচকিয়ে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পাড়ে না।
মোহ হেসে দেয় তখন। তার খিলখিল হাসি শব্দের সাথে মিশে যায় ঢেউয়ের গর্জন। সমুদ্র এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখ আটকে যায় মোহের হাসিতে। কিন্তু তাকিয়ে থাকে না বেশিক্ষণ। মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেয়।
মোহ জিজ্ঞেস করে, “এখন তো মানুষ খুব কম। আপনিও হাত ধরে আছেন। তাহলে আমি আরেকটু গভীরে নামি। কালকেও নামতে পাড়ি নি।”
সমুদ্রের মায়া হলো তাই সে মানা করল না। তারা একটু গভীর নামলো। মোহের হাঁটু থেকে একটু উপরে পানি পর্যন্ত আসলে সমুদ্র তাকে থামাল, “খবরদার আর গভীরে যাবে না।”
মোহ মুখ ফুলালেও মানল। মোহ সমুদ্রের নোনতা পানি হাতে নিয়ে দেখল ভালো করে কিছুক্ষণ। সমুদ্রও তার এই ধ্যান সহকারে পানি দেখার ব্যাপারটা দেখল কিন্তু কিছু বুঝল না। আচমকা মোহ পানিটা মুখে মারল সমুদ্রের। সমুদ্র এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেও পরের মুহূর্তে সে-ও সাগর থেকে একটুখানি পানি নিয়ে ছুঁড়ে মারে মোহের দিকে। মোহ তো হার মানবেই না। সমুদ্রের একবার পানি মারবার প্রতিশোধ হিসেবে বারবার তার দিকে পানি মারতে শুরু করল। তার হাত ছেড়ে দিয়ে। সমুদ্র তার বাচ্চামো দেখছিল। তার মনে হলো মোহের এই দিকটাই সুন্দর। নিজের বয়সের ন্যায় ব্যবহার করছে এখন মোহ, নাহলে সারাক্ষণ বড় সেজে কথাবার্তা বলে।
সাগরের স্রোত বাড়ে। বড় একটা আসে। মোহ দুষ্টুমি করতে করতে পিছাতেই স্রোতের বেগ সামলাতে পাড়ে না। উল্টো পিছলে যায়। পড়তে নিলেই সমুদ্র তাকে ধরে নেয়। কোমরে তার ছোঁয়া লাগতেই কেঁপে উঠে মোহ। তার শরীরের প্রতিটি শিরা যেন কেঁপে উঠে।
সমুদ্র তাকে উঠাতেই মোহ তার কাছে চলে আছে। সে ডাগর চোখগুলো আরও বড় হয়ে যায়। তার হাত আপনা-আপনি এসে থামে সমুদ্রের বুকে। তীব্র বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। হয়তো বাতাসে যেন প্রেমের নেশা মেলানো ছিলো, নয়তো সমুদ্রের শরীর থেকে আসা পুরুষালী ঘ্রাণের নেশা ছিলো। যা মোহের মনকে মাতোয়ারা করে তুলে। সমুদ্রের নয়নের দিকে তাকিয়ে এই সাগরের অপরূপ সৌন্দর্যও তুচ্ছ লাগছে।
তার হৃদয়টা কেমন আকুম-বাকুম করতে লাগল। নিজের নিয়ন্ত্রণের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাইছে খুব করে।
হয়তো এই মাতোয়ালা অনুভূতিটা কেবল একপক্ষিকই ছিলো। তাইতো সমুদ্র তার বাহু ধরে তাকে সরিয়ে দিলো। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলো। বলল, “ঘুম ধরে গেছে হঠাৎ করে। চলো হোটেলে যাই।” বলে সমুদ্র এগিয়ে গেল। মোহের হাত ধরল। মোহ তাকাল তার ধরা হাতের দিকে। কিন্তু তার বুকে আর কোনো আনন্দের আভাস পেলো না। তার বুকের ভেতর কেমন সূক্ষ্ম ব্যাথা হচ্ছে বারবার। কেন হচ্ছে সে বুঝতে পাড়ছে না।
.
.
মঙ্গলবারে শায়ানরা তাদের গ্রামে যেয়ে উঠে। দাদীর জোরাজুরিতে তারা সকাল ছয়টায় রওনা দেয়। আড়াই ঘন্টাতেই এসে পড়ে। তারপর সব ভাইরা মিলে দেয় এক ঘুম। উঠে বিকেল চারটায়। উঠে খেয়েদেয়ে সন্ধ্যায় বের হয় কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাদের বাড়ি থেকে হাঁটার পথ দশ মিনিটের। কাছেই। এই সুবাদেই রাদিনের সাথে শ্রাবণীর প্রেম। শ্রাবণীরা এখানে স্থায়ী ভাবে থাকলেও রাদিনরা ঢাকাতেই থাকে। তবে তাদের গ্রামে খ্যাতি অনেক। বংশগতভাবে ধনী। আর সম্মানও আছে অনেক। আব্দুল্লাহ শিকদার ঢাকায় যেয়ে তার ব্যবসায় শুরু করলেও তার শিকড় ভুলেন নি। ব্যবসায় সফলতা আসার পরপরই গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হাস্পাতাল, মসজিদ, সেতু সব তৈরি করে দিয়েছেন। গ্রামের উন্নতিতে তার বিরাট অবদান। এখন তার এই আবদান চালু রেখেছেন তার মেঝো ছেলে শারাফ। তিনি এখনো তার গ্রামের উন্নতিতে অবদান রেখেছেন।
রাদিনরা একসময় গ্রামে বেড়াতে আসে। তাদের যেহেতু গ্রামের মানুষরা অন্যরকমভাবে দেখে সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই অনেকে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়তে চায়। শ্রাবণীর ভাইও এই কাতারে পড়ে। শ্রাবণীর ভাইয়ের দ্বারাই শ্রাবণীকে প্রথমবার দেখে রাদিনের নজর আটকায়। সে তার ভাইদের মতো নয়, তাইতো একবার সম্পর্কে জড়িয়ে শ্রাবণীকেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের বংশে প্রেমের বিয়ে খুবই স্বাভাবিক। আব্দুল্লাহ শিকদারও জামিলা বেগমকে প্রেম করেই বিয়ে করেন। এমনকি তার বাবা ও ছোট চাচাও। তাই পরিবারকে মানাতে কোনো সমস্যা হয় নি। আর শ্রাবণীর পরিবার তো বংশের নাম শুনেই এক পা’য়ে রাজি বিয়ের জন্য। তাই খুব সহজে তাদের প্রেম বিয়ের পথে এগোয়।
শায়ানরা অনেক ফল ও মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত হয় বাসায়। সাথে এনেছে অনেকগুলো বিয়ের ডালা। রাদিনের কথায় আগে দিয়ে নিয়ে এসেছে তারা। অবশ্য তার আসার কথা ছিলো না কিন্তু তার হবু বউকে দেখতে বেশ ইচ্ছে করছিল। যেয়ে দেখে তাদের বাসায়ও টুকটাক মেহমান আসা শুরু হয়েছে। শ্রাবণীদের বাড়িও বেশ বড়। তার চাচা সবার বিল্ডিং আছে এই এলাকায়। জায়গা সম্পত্তিও অনেক। এক কথায় অবস্থা ভালো।
বর পক্ষকে দেখেই আপ্পায়ন শুরু হয়। বড় কেউ আসে নি। শায়ান, রাদিন ও পূর্ণি এসেছে। মহল খুবই শান্ত। কেবল তাদের আপ্পায়নে যতটুকু শব্দ হয় আরকি। কিছু সময়ের মধ্যে টেবিল ভর্তি খাবার আসে। তাদের আপ্পায়নের কোনো খুঁত থাকা যাবে না। রাদিনরা খাচ্ছিল, শ্রাবণী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো মাথায় ঘোমটা দিয়ে। সাথে তার ভাই আজিজ এবং ছোট দুইবোন সিনথিয়া আর আঁখি। তাদের আপ্পায়নে ব্যস্ত। কতগুলো বাচ্চারাও ছিলো সামনে। কেউ সামনের সোফায় বসা, আবার কেউ পাশের রুমে, আবার উঠানে। দশ বারোজন হবে। ছয় থেকে চৌদ্দ বছরের। রাদিন শ্রাবণীকে প্রশ্ন করে, “তোমাদের বাড়িতে তো আগে এত বাচ্চা ছিলো না।”
“ছোট মামী বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। ওরা আসতেই আমার চাচাদের বাচ্চারাও এসেছে খেলা করতে।”
“বাচ্চারা তো দেখি ভীষণ শান্ত, ভদ্র, চুপচাপ।”
পূর্ণিও তাল মেলায় ভাইয়ের সাথে, “আসলেই। আমরা বাচ্চা থাকতে যে পাজি ছিলাম। এখনকার বাচ্চারা কী এত শান্ত শিষ্ট হয়? না’কি আমাদের প্রজন্মই এত দুষ্টু ছিলো?”
শ্রাবণী তো বড় বড় চোখে তাকায় তার দিকে, “এরা শান্ত শিষ্ট? বিচ্ছু…বিচ্ছুর দল এগুলো।”
রাদিন তার কথা মানতে নারাজ, “কী’যে বলো? এদের মতো শান্ত শিষ্ট বাচ্চা আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি।”
শ্রাবণী গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “বিচ্ছুদলের সর্দারনি আসুক। তারপর বুঝবে শয়তানি কাকে বলে। একসাপ্তাহ এসে সাথে থাকলে পরের সাপ্তাহে মেন্টাল হাস্পাতালে যেতে হবে।”
“তাহলে একটু তো বিয়ের বাড়ি মনে হবে,নাহলে দুই বাড়ি যে শান্ত শিষ্ট মনে হচ্ছে বিয়ে তো না মৌনতা প্রতিযোগিতা রাখা হয়েছে।”
রাদিন ও পূর্ণি গল্প করার চেষ্টা করলেও শায়ানের এসবে কোনো আগ্রহ নেই।দাদী না বললে সে এখানে আসতোও না। এসব তার কাছে ভীষণ বিরক্তির লাগে।
শায়ান বিরক্তি নিয়েই বিড়বিড় করে বলে, “জীবনটাই ঠিক নেই। এত বোরিং সিচুয়েশনে আমার থাকতে হবে তা কল্পনা ও করিনি কখনো।”
বাহিরে গাড়ির শব্দ আসতেই চিৎকার আসে, ” আপা আসছে।”
আর সব শান্তশিষ্ট বাচ্চারা একসাথে চিৎকার করে বেরিয়ে যায় উঠানের উদ্দেশ্যে। এমনকি শ্রাবণীর বোন আঁখিও। রাদিন তো তাদের চিৎকার শুনে এমন ভয় পেয়েছে যে তার হাতের জুস সব শার্টে পড়ে গেছে। শ্রাবণী তার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে, “এখনো শান্ত শিষ্ট লাগছে? বিচ্ছুর দলের সর্দারনি তাহলে এসেছে।”
শ্রাবণীর কথায় শায়ান ফোন থেকে নজর সরিয়ে দরজার ওপাড়ের উঠানে তাকাল। দেখল দুইজন মধ্যবয়সী পুরুষ ও নারী গাড়ি থেকে নামছে। তাদের রিসিভ করতে এসেছে শ্রাবণীর মা। শায়ান মজার কিছু না পেয়ে চোখ সরাল। সে খেয়াল করল হঠাৎ কক্ষে আবার গর্জন শোনা যাচ্ছে। সে চোখ তুলে তাকাতেই চেনা এক অপছন্দের মুখখানির দর্শন করে। সে সাথে সাথে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট দ্যা ফা…. ” সম্পূর্ণ কথা বলার আগে নিজের ছোট বোন পূর্ণির দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। তারপর আবারও তাকায় তার সামনে দাঁড়ানো মহুয়ার দিকে। তাকে দেখলেই শরীরের শিরায় শিরায় রাগ অতিবাহিত হয় যেন। সে বিরক্তির সুরে বলে, “তুমি এখানে কী করো?”
মহুয়ার চোখেমুখেও তাকে দেখে চরম বিরক্তি। সে-ও শায়ানকে দেখে মোটেও খুশি নয়। সে শায়ানকে নকল করে একই সুরে জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট দ্যা ফুচকা। তুমি এখানে কী করো?”
“ফাজলামো করছো?”
“শুরু কে করেছে?
” তুমি এখানে করোটা কি?”
“নাচি। দেখো না?”
“বেয়াদব মেয়ে।”
“তোমার থেকে অনেক লো র্যাঙ্কে আছি বেয়াদবিতে।”
“তোমার সাহস তো কম না। তুমি জানো আমি কে?”
“নিজে জানো না? আমাকে কেন জিজ্ঞেস করো? দেখো অনেক লম্বা জার্নি করে এসে আমার মাথা গরম। মেজাজ আরও খারাপ করলে মাথা ফাঁটায় দিব একদম।” শেষের কথাটা অনেক জোরে বলল সে।
শায়ানও দ্বিগুণ গলায় বলল, “আর আমি তো তোমাকে ছেড়ে দিব। তোমাকে একদম মাটিতে…”
সম্পূর্ণ কথা বলার পূর্বেই রাদিন তার মুখে হাত রেখে বসিয়ে দেয়। শায়ানের চোখ রাঙানো দেখে পরের মুহূর্তে আবার ছেড়ে অনুরোধের সুরে বলে, “ভাই আমার হবু শশুড়বাড়ি প্লিজ কোনো সিন ক্রিয়েট করিস না। অনুরোধ করছি তোকে।”
শায়ান বিরক্তি নিয়ে তার হাত সরিয়ে নিজের জ্যাকেট ঠিক করল। কিন্তু তার দৃষ্টি মহুয়ার দিকেই। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন পাড়লে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।
মহুয়া অবশ্য তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। শ্রাবণী জিজ্ঞেস করে, “তোমরা একে অপরকে চিনো?”
মহুয়া ও শায়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “ওসব বাদ দেও আমার দুলাভাই কোথায় তা বলো।”
শ্রাবণী রাদিনের সাথে মহুয়ার পরিচয় করাতেই মহুয়া তাদের সামনের সোফায় এসে বসে আয়েশ করে, “তো আপনি আমার দুলাভাই?”
রাদিন হেসে সম্মতি দেয়। মহুয়া তাদের সামনে থেকে পুলি পিঠার প্লেটটা নিয়ে একটা পিঠা মুখে দেয়। খেতে খেতে অস্পষ্ট স্বরে বলে, “আপনি তো দেখতে কিউট আছেন দুলাভাই কিন্তু এই রাক্ষস নামক খাক্ষসটা আপনার সাথে করেটা কি?”
কথায় শায়ান তার দিকে তাকাল অগ্নি দৃষ্টিতে।
রাদিনও তার দিকে তাকিয়ে ভয়ে হেসে মহুয়া বলল, “আমার ভাই।”
উওর শুনে মহুয়া মুখ বানায়। অনেক বিশ্রী কোনো কথা শুনে ফেলেছে সে।
“আপির কাছে তো শুনলাম আপনি ভালো মানুষ। তাই এই রাক্ষস আপনার ভাই হয় কীভাবে?”
শ্রাবণী এসে তার মুখে হাত রাখে। তার পক্ষ থেকে সবার কাছে ক্ষমা চায়। মহুয়াকে বলে, ” মহুয়া তুই তোর বিচ্ছুর দলের কাছে যা। এখানে কি করছিস?”
“খিদে লেগেছে ওদেরকে পাঠিয়েছি চিপ্স আর কোক আনতে। সবাই গেছে প্রতিযোগিতা করে। যে আগে এসে দিবে তাকে জুনিয়র সর্দার বানাব।”
শ্রাবণীর হাত আপনা-আপনি কপালে চলে গেল।
আজিজ আদুরে সুরে বলল, “তুই আমাকে আগে কল দিয়ে বললে আমি এনে রাখতাম তোর জন্য।”
“আপনার নাম্বার আমার ফোনে বের করলে আমার ফোন থেকে পোঁকা বের হয়। বুঝলেন ভাইয়া? আমার ফোন বোধহয় আপনাকে পছন্দ করে না।”
আজিজ লজ্জা পেল এই কথায়। কিন্তু সম্বন্ধীদের দেখে আর কথা বাড়াল না।
শ্রাবণী তাকে ভাগানোর জন্য বলল, “মহুয়া তুই মা চাচীদের সাথে দেখা করেছিস? যেয়ে দেখা করে আয়। ছোট মামীও এসেছে।”
কিন্তু পূর্ণি আটকাল তাকে, “ভাবি আপুটা আরেকটু থাকুক না, ভীষণ মজা লাগছে।”
শায়ান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেও পূর্ণি সেদিকে তাকায়ও নি। সে মহুয়াকে দেখে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপু আপনার নাম তো অনেক সুন্দর। একদম আপনার মতো।”
মহুয়া ধন্যবাদ দেবার আগেই শায়ান শব্দ করে হেসে দেয়। মহুয়ার তো গা জ্বলে উঠে তার হাসিতে। তার ইচ্ছে হয় একমুঠো মরিচ এনে তার মুখে ভরে দিতে। তবুও সে পিঠা মুখে নিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল। এখন কান্ড করলে তার মা তাকে বারোটা বাজিয়ে দিবে।
“পূর্ণি তোর তো ঠাকুমা’র ঝুলির শাঁকচুন্নিকেও ভালো লাগতো ছোটবেলায় তাই না? তোর টেস্ট এখনো বদলায় নি দেখছি।” শায়ান মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল।
মহুয়া দাঁতে দাঁত চেপে এতক্ষণ চুপ থাকলেও তার ধৈর্য্য সীমা কেবল এতটুকুই। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ছোট চোখ করে তাকায় শায়ানের দিকে। তারপর একগাল হেসে মাথা বামদিকে করে তাকায় শায়েনের দিকে, “এখন ছোট থেকে ভাইকে দেখে বড় হয়েছে। ভাই যদি বান্দরের রাজা কিটকিটার মতো দেখতে হয়। বেচারির টেস্ট খারাপ তো হবেই।”
“তুমি আমাকে বান্দর বলেছ? এত সাহস তোমার!”
মহুয়া তাকায় পূর্ণির দিকে, “তোমার কয়টা ভাই?”
“নয়টা ভাই। সব কাজিন মিলিয়ে।”
“তাহলে তোমার বোনের ভাই নয়জন তোমার কেন মনে হলো আমি তোমাকেই বলছি। মাস্ট বি তুমি নিজেও আয়নাতে নিজের চেহেরা দেখে এটাই ভাবো। আর রইলো আমার সাহসের কথা,” মহুয়া তার গলায় লাগানো ব্যান্ডেজের দিকে তাকায়, “আমার সাহস সম্পর্কে তো তোমার ভালোই জানার কথা।”
শায়ান উঠে দাঁড়ায়, “অনেকক্ষণ হয়েছে। চলো এখন।” বলে সে যেতে নিলে আবার থেমে তাকায় মহুয়ার দিকে, “দেখে নিব তোমাকে।”
“কিন্তু তোমার মতো বান্দর কিটকিটাকে দেখার দুই পয়সার ইন্টারেস্টও আমার নাই।”
শায়ান তো রাগে ক্ষোভে তার দিকে তেড়ে আসে। কিন্তু রাদিন পিছন থেকে তাকে ধরে নেয়। জোরপূর্বক হেসে শ্রাবণী ও আজিজকে বলে, “আমরা তাহলে পড়ে আসি। পূর্ণি জলদি আয়।”
তারপর সে শায়ানকে জোর করে বাহিরে নিয়ে যায়।
পূর্ণিও উঠে ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু যাবার আগে মহুয়ার দিকে তাকায় চকচক করা দৃষ্টি নিয়ে, “আপু তুমি কত কুল! আমি আজ পর্যন্ত শায়ান ভাইয়ার সামনে কাওকে কথা বলতে দেখলাম না। কেবল চাচা ও দাদী ছাড়া। আর তুমি ভাইয়াকে কথা দিয়ে পুরাই ধুঁয়ে দিলে। আমি তো এক্ষুণি যেয়ে দাদীকে সব জানাব।”
মহুয়া জোরপূর্বক হাসে।
শ্রাবণী এতক্ষণ কিছু না বললেও সবাই চলে যেতেই মহুয়ার উপর শ্রাবণীর রাগ বর্ষণ হয়। সে জোরে জোরে তার মা’কে ডাকতে থাকে। আজিজ তাকে থামাতে চাইলেও সে মানে না। তার ডাকে কেবল তার মা না সকলেই উপস্থিত হয়।
“কী হয়েছে এমন চেঁচাচ্ছিস কেন?” শ্রাবণীর মা জিজ্ঞেস করে।
“দেখছ না রাদিনরা নেই।”
“দেখছি তো। উঠানে দেখা হয়েছে।”
“তো কার কৃপায় এত জলদি গেছে তাও জিজ্ঞেস করো।”
সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তাকায় মহুয়ার দিকে। মহুয়ার তো এতে কিছু আসে যায় না। সে নিজমনে পিঠা খাওয়ায় ব্যস্ত।
মহুয়ার মা তা দেখে বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আবার কি করেছিস তুই?”
“আমি আবার কী করলাম?”
“কী করেছিস?” শ্রাবণী রাগে ফুঁসে উঠে, “মামী ও আমার দেবরের সাথে বেয়াদবি করেছে।” তারপর মা’য়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো চোখে নালিশ দেয়, “তাও যার তার সাথে না, শায়ানের সাথে। ওই বাসায় শায়ানের বাবারই তো সব কথা মানা হয়। যদি শায়ান এই বিয়ে ভাঙিয়ে দেয়?”
ফুপু তখন মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে, “তুই কী বড় হবি না? জ্ঞান বুদ্ধি হবে না তোর?”
“আমি কী করেছি আজব? শুরু তো ওই লুইচ্চা ব্যাটা করেছিল। এখন আপুর দেবর বলে সম্মানের খাতিরে তাকে কী আমি মুখের উপর লুইচ্চা বলেছি? বলিনি। কত জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে কাজ করেছি। আর তোমরা আমাকে বকছো?”
“এসব কোন ধরনের ভাষা? এত সম্মানিত বাড়ির ছেলেকে তুই কী বলছিস? চিনিস তুই ওকে?”
“লুইচ্চা বলছি। সাথে গুন্ডাও। আমার ভার্সিটিতেই পড়ে তো আমি চিনবো না। হুদাই আমার সাথে লাগতে আসে। জেরিন মহুয়ার সাথে। গতবার ভালো শিক্ষা পায় নি তো এজন্য আবারো আজ লাগতে এসেছিল।”
কথাটা শুনে ফুপি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, “তুই ওর সাথে লেগেছিসও?” বলে সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। তার ভাই অর্থাৎ মহুয়ার বাবা তাকে এসে ধরে, “আপা আপনি চিন্তা করেন না। কিছু হবে না। যদি কিছু হয় তাহলে মহুয়া নিজে ক্ষমা চাইবে ছেলেটির কাছে।”
কথাটায় মহুয়া কপাল কুঁচকে নেয়। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আমি ক্ষমা চাইব কেন? আমি কোনো ভুল করিনি।”
“তোর বোনের বিয়ের কথা উঠছে। ক্ষমা চাইলে ছোট হয়ে যাবি না।”
“একতো তারা কিছু বলে নি তোমরা হুদাই নিজের মন মতো বানিয়ে বিয়ে ভেঙে দিচ্ছো। আর দ্বিতীয়ত, ক্ষমা চাওয়ার কথা উঠলে ওই শায়ান আগে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে। তারপর আমি।”
ফুপি রেগে যায়, “এই মেয়ের মাথা কী খারাপ হয়েছে? এতবড় বংশের ছেলে ওর কাছে ক্ষমা চাইবে কেন?”
“তো আমি কেন ক্ষমা চাইব? মগের মুল্লুক না’কি বললেই আমি ক্ষমা চাইবো। যেখানে আমি ভুল না সেখানে আমাকে কেউ ক্ষমা চাওয়াতে পাড়বে না।”
“আমার মেয়ের এত ভালো পরিবারে বিয়ে হচ্ছে দেখে তোর সহ্য হচ্ছে না। জ্বলছে তোর। একারণে এসব করছিস?”
কথাটা শুনে মহুয়া মুখ বানিয়ে তাকায়, “সিরিয়াসলি? আমি জ্বলছি? তাহলে আমি যে বিয়েতে আসতে চাই নি একশোবার কল করে এনেছ এসব শুনানোর জন্য? আমার মানুষের মতো এত জ্বলার অভ্যাস নেই বুঝলেন ফুপি? যদি আপনার তাই মনে হয় তাহলে গাড়ি এখনো আছে আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি। আমার ভাই যখন কল দিবে তখন আপনাদের জ্বলন কথন শুনিয়েন। ওকে?”
মুরাদের কথা শুনতেই ফুপির রঙ ঢঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। মুরাদ বলেছে সে আজিজকে চাকরি দিবে। আর তার মেঝো মেয়ে সিনথিয়ার সাথেও মুরাদের বিয়ের কথা চালাতে চাচ্ছেন তিনি। তাই মুরাদকে হাতছাড়া করা যাবে না। এখন মুরাদের জান মহুয়ার মধ্যে বসবাস করে। একবার মেয়ের সাথে মুরাদের বিয়ে দিতে পাড়লে সে মহুয়াকে দেখে নিবে।
সে মহুয়ার হাত ধরে বলে, “তুই চলে যাবি মানে? তোর বোনের বিয়ে তুই কীভাবে যাবি? তোকে ছাড়া বিয়ে হবে কী করে? চিন্তায় আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের কথা। মেয়েদের জন্য বিয়ের ব্যাপার অনেক নাজুক হয় জানিস তো। তাই ফুপির একটু মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। রাগ করে না সোনাটা।” তার মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোরাও আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
এহেন নাটক দেখে মহুয়ার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। অথচ তার বাবা মা কিছু বুঝতেও পাড়লেন না। তার মা বললেন, “আপা আপনি আমাদের বড়। ক্ষমা চাচ্ছেন কেন? আর মহুয়া কোথাও যাবে না। এমনিতেই মজা করে বলছে তাই না মহু?”
মা চোখ রাঙালো তার দিকে। মহুয়া তা পাত্তা দিলো না। এসব নাটক দেখে তার মাথা ধরে গেছে। সে উঠে আঁখির বাহু ধরে বলল, “চল তো যেয়ে একটু ঘুরে আসি।”
আঁখির সাথে বাহিরে ঘুরতে এসে মহুয়া তার বিচ্ছুর দলকে পায়। তাদের থেকে চিপ্স নিয়ে তাদের নিয়ে বের হয় গ্রাম ঘুরতে। এই গ্রামে এই নিয়ে তার তৃতীয়বার আসা। গ্রামটা ভীষণ ভালোই লাগে তার দিকে। তারা চিপ্স খেতে খেতে ঘুরে দেখছিল। এমন সময় দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় সেখানে দেখতে পায় শায়ানদের। তাকে দেখেই মেজাজ গরম হয়ে যায় মহুয়ার। সে দ্রুত যেতে নিলেই আজিজ ডাক দেয় আঁখিকে। আজিজ শায়ানদের সাথেই ছিলো। শায়ান বসেছিলো তার বাইকে আর দশবারোজন তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।
মহুয়া সেদিকে যেতে না চাইলেও আঁখির আকুতিতে যায়। তার ফুফাতো ভাইবোনদের মধ্যে আঁখিকেই কেবল তার পছন্দ। ভীষণ সরল সহজ মেয়ে। তার বড় ভাইবোনদের মতো না। আঁখির অনুরোধে সে যায় ঠিকই কিন্তু মুখ পেঁচার মতোই করে রাখে। স্পষ্ট বুঝায় তাদের দেখে সে একটুও খুশি না।
শায়ান আজিজকে বলে, “ওদের সবাইকে দোকানে নিয়ে যাও। আমার ট্রিট।”
“আরে না ভাই আপনি কেন…”
কিন্তু শায়ান তাকাতেই তার শীতল দৃষ্টি দেখে সে চুপ করে যায়। আজিজ সোজা মহুয়াকে বলে, “এখানের চা আর মিষ্টি সবচেয়ে সেরা। গতবার বলেছিলাম তোকে খাওয়াব কিন্তু হয় নি। চল আজ।”
“এই লোকের টাকা দিয়ে কেনা বিষও আমি না খাই।”
“মহু তুই…”
শায়ান আজিজকে থামিয়ে, “ওকে ছাড়া সবাইকে নিয়ে যাও। তোরা সবাইও যা।”
শায়ানের ইশারায় সবাই ঢুকে যায় দোকানে। আঁখি মহুয়াকে ছেড়ে যেতে না চাইলেও। তার ভাইয়ের জন্য যেতে হয়। সবাই যাবার পর শায়ান বাইক থেকে নেমে মহুয়াকে বলে, “ওদিন তো জাহানের টাকায় ঠিকই খেলে এখন আমাকে ইগো দেখাচ্ছো?”
“ওদিন আমার ট্রিট ছিলো। জাহান আমাকে একদিন খাইয়েছিল আর ওদিন আমি ফেভার রিটার্ন করেছি। আর জাহানকে আমি পছন্দ না করলেই ও তোমার থেকে হাজারোগুণ বেশি ভালো আছে। অন্তত মেয়েদের সম্মান করতে তো জানে।”
শায়ান তাচ্ছিল্য হাসে, “ও মেয়েদের সম্মান করতে জানে? ভুল ধারণায় বাঁচছো। যদি মেয়েদের প্রতি এতই সম্মান হতো তাহলে আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব এভাবে শেষ হতো না।”
কথাটায় মহুয়ার কপালে ভাঁজ পড়ে, “মানেটা কি?”
মহুয়া খেয়াল করল শায়ানের নীলাভ চোখজোড়র আশেপাশে লাল হয়ে যাচ্ছে। এমন কি হয়েছিল যার কথা বলতে যেয়েও শায়ানের রাগে দৃষ্টি রাগান্বিত হয়ে গেছে।
“নাথিং।” শায়ান চোখ বন্ধ বলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক মুহূর্তের জন্য তার কন্ঠ কেঁপে উঠেছিল। তারপর আবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আগের মতো কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়, “আজিজ থেকে শুনলাম আজ না’কি আমার সাথে বেয়াদবি করার কারণে তোমার ক্লাস লেগেছে? আচ্ছা যদি তোমার কারণে বিয়েটা ভেঙে যায় তাহলে কেমন হবে?”
শায়ান ত্রূর হাসি দিয়ে তার দিকে এক’পা এগোয়, “মিস জারিন মহুয়া আমার কথা মতো কাজ না করলে আমি তোমার বোনের বিয়ে ভেঙে দিব। এটা আমার জন্য পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। যার দোষারোপ সবাই তোমাকে করবে। সো এই মুহূর্ত থেকে আমি যা বলবো, তুমি তা শুনবে।”
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ২৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
শায়ান ত্রূর হাসি দিয়ে তার দিকে এক’পা এগোয়, “মিস জেরিন মহুয়া আমার কথা মতো কাজ না করলে আমি তোমার বোনের বিয়ে ভেঙে দিব। এটা আমার জন্য পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। যার দোষারোপ সবাই তোমাকে করবে। সো এই মুহূর্ত থেকে আমি যা বলবো, তুমি তা শুনবে।”
মহুয়া তাচ্ছিল্য হাসে। তার হাত বুকের উপর ভাঁজ করে বলে, “আমার মাথায় কী ছাগল লেখা আছে? অন্যকারো বিয়ে হোক বা না হোক আমার কী? হ্যাঁ আমার একটু কষ্ট লাগবে বিয়েবাড়ির বিরিয়ানির, রোস্ট, জর্দা আরও কত মজার খাবার খেতে পাড়ব না তাই বলে আমি তোমার মতো গাঁধার কথা শুনতে যাব না’কি? বাসায় যেয়ে ফুড পান্ডাতে অর্ডার করে খাব।”
শায়ানের তার কথা হজম হয় না। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি তোমার বোনের বিয়ের কথা বলছি। আমি মজা করছি না। আমি একবার বললে এই বিয়ে ক্যান্সেল হয়ে যাবে।”
“হোক।”
“তোমার বোনের বিয়ে।”
“বোন না, ফুফাতো বোন। আমাকে কি এত সাধু মনে হয় যে আমি মানুষের জন্য সেক্রিফাইস করব? আমি যাদের ভালোবাসি তাদের বাদে সবার জন্য চরম স্বার্থপর মানুষ। আর এদের জন্য তো সবচেয়ে বেশি। আমার মা বাবা ভুলতে পাড়ে কিন্তু আমরা ভুলিনি, যখন আমার বাবার চাকরি গিয়েছিল তারা কীভাবে আমাদের অপমান করেছিল। ছোট করে দেখেছিল। কত কথা শুনিয়েছিল আমার মা বাবাকে। এখন আমার ভাইয়ের ব্যবসা চলছে বলে তাদের প্রেম উথলে পড়ছে। এসব স্বার্থপর মানুষদের জন্য নিঃস্বার্থ হয়ে ত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না। আমি তো বলি করে দেও ক্যান্সেল, চরম একটা নাটক দেখতে পাড়ব।”
শায়ান তার কথা শুনে বাকরূদ্ধ হয়ে যায়। মনে হয়, এমন চরম লেভেলের পাগলের সাথে এর আগে তার দেখা হয় নি। তাকে কিছু বলতে না দেখে মহুয়া যেয়ে উঠে বসে শায়ানের বাইকে।
শায়ান তো তার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পাড়ে, “হাউ ডেয়ার ইউ। আমার বাইকে বসার সাহস হলো কীভাবে তোমার?”
“শালার ব্যাটা তুই দাঁড়া করালি, দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমার পা ব্যাথা হলো, তো আমি তোর বাইকে না বসে কী তোর ঘাড়ে বসবো?”
“তুই কার সাথে তুই তুকারি করছিস, আবার গালিও দিচ্ছিস। বেয়াদব মেয়ে।”
“আহা নিজে কত সাধুবাদ, নিজেও তুই করে বলে আসছে প্রশ্ন করতে।”
“তো শুরু কে করেছে?”
“তোর চেহেরা দেখলে প্রথম দুইদিনের কথা মনে করেই গালি আসে।”
শায়ান হাসে তাচ্ছিল্যভাবে, “তারপরও বুকে ডর ভয় নেই?” শায়ান তার দিকে এগিয়ে আসে, “যদি এখানে সবার সামনে কিছু করে দেই। এখানে তো জাহানও নেই তোকে বাঁচানোর জন্য।”
মহুয়া তার গলার ব্যান্ডেজের উপর আলতো হাত করে ছুঁয়ে তাকায় তার দিকে, “এখনো মনে হয় আমার কারো প্রয়োজন আছে? এছাড়া শুনেছি এখানে তোমার বাবার অনেক সম্মান। ভুলেও তুমি আমার সাথে কিছু করবে না। করতে হলে এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরতে না। সোজা গলা চেপে ধরতে।”
শায়ান তাকায় মহুয়ার চোখে। তার দৃষ্টিতে এত নির্ভরশীলতা দেখে রাগে তার গা শিরশির করতে থাকে।
মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “অবশেষে আমার তোমার একটা জিনিস ভালো লেগেছে।”
কথাটা শায়ানকে কৌতুহলী করে তুলে। যদিও সে মুখে কিছু বলে না। তবে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
মহুয়া উওর দেয়, “তোমার বাইক। আই লাইক ইট।”
মহুয়া তার বাইকে হাত দিতে নিলে শায়ান তার হাত ধরে নেয় শক্ত করে, “নিজের নোংরা হাত দিয়ে আমার বাইক ছুঁবেও না। আমার বাইকের যে দাম, তোমাকে বিক্রি করলেও এই বাইক কিনতে পাড়ব না।”
মহুয়া এই কথা শুনে শায়ানের হাতে জোরে খামচি দেয়। এত জোরে দেয় যেন র’ক্ত বের হয়ে আসে।
শায়ান দ্রুত নিজের হাত সরায়। নিজের হাতের এমন অবস্থা দেখে মহুয়াকে বলে, “পেত্নী কোথাকার!”
“তুই পেত্নী, তোর সব প্রেমিকা পেত্নী, তোর বউ…না তোর বউ হবে কেমনে? তোর মতো শালা লুইচ্চা ব্যাটা আজীবন অবিবাহিতই থাকবি।” বলে জিহ্বা বের করে ভেঙিয়ে গেল শায়ানকে। তার কিছু বলার আগেই। এক লাফে নেমে দৌড়ে ঢুকলো দোকানে। তার এক ডাকে আঁখিসহ বাচ্চা সবগুলো বের হলো।
শায়ান তাদের যেতে দেখেও কিছু বলতে পাড়লো না। রাগে, ক্ষোভে লাথি দিয়ে তার প্রিয় বাইকটা ফেলে দিলো।
রাতে শায়ান বাড়িতে ফিরার পরই তার দাদীর রুমে যায়। পূর্ণিও দাদীর সাথে গল্প করছিল। শায়ান সোজা যেয়ে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। দাদী হেসে জিজ্ঞেস করে তাকে, “আমার দাদুভাইটা খেয়েছে?”
“খিদে নেই। মাথা ব্যাথা করছে।”
“কত করে বলি রাগটা কমা। রাগলেই তো তোর মাথা ধরে। এত রাগ ভালা না। এত রাগ থাকলে তোর বউয়ের কপালে শনি আছে।”
পূর্ণি ঠোঁট টিপে হাসে, “তাহলে দাদী এমন ভাবি এনে দেও যে ভাইয়াকে লাইনে আনতে পাড়বে। যেন ভাইয়ার কপালে শনি ঘুরঘুর করে।”
শায়ণ কপাল কুঁচকে তাকায় পূর্ণির দিকে। সে বুঝতে পাড়ছে কথাটা কোন দিকে যাচ্ছে।
দাদী বলল, “তাহলে তো অন্য গ্রহ থেকে আনতে হবে।”
“না না দাদী এই গ্রহেই আছে। আজ সন্ধ্যায় এই অবিশ্বাস্য ঘটনা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি।”
“কী হয়েছে রে?”
পূর্ণি কিছু বলার আগে শায়ান তার বেণি ধরে টান দেয়। চোখ রাঙায় তার দিকে। তার চোখ রাঙানো দেখে পূর্ণি চুপ করে যায়। এই বাড়িতে শায়ানকে সবচেয়ে কম ভয় পায় পূর্ণি। তার আদরের বোন বলে কথা। একমাত্র পূর্ণিকেই আদর করে শায়ান। তবুও পূর্ণির তো নিজের জানের ভয় আছে। তাই সে কথাটা সামনে এগোয় না।
দাদীর নজর পড়ে তার হাতে। তার হাত দেখে আঁতকে উঠে, “তোর হাতে এ’কি হয়েছে?”
শায়ান তাকায় নিজের হাতের দিকে। মহুয়ার খামচির দাগ হাতে দেখে তার মাথায় রাগ আবার টগবগ করতে শুরু করে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “রাস্তায় একটা জংলী বিড়ালের সাথে দেখা হয়েছিল। খামচি দিয়েছে।”
পূর্ণি মিটিমিটি হেসে বলে, “সন্ধ্যার সে কিউট বিড়ালটা না’কি?”
শায়ান এবার তাকে তাড়া করে, “তোর আজকে খবর আছে।”
ধমক খেয়ে এক দৌড়ে পালায় পূর্ণি। শায়ানও তাকে মারতে তার পিছনে যায়।
.
.
রাতে মোহরা আরেকটি রেস্টুরেন্টে এসেছে। ‘coral station’। ঈশার কাছে শুনেছে এখানের বারবিকিউ তাদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের। ফিস আর চিকেন দুইটাই অনেক মজার। জায়গাটা দেখে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। চারদিকে শুধু ফুল আর ফুল। সে যেন ফুলের সমরাজ্যে এসে পড়েছে। তার ফুল ভীষণ প্রিয়। রং-বেরঙের ফুল দেখে তার মনটা প্রজাপতির ন্যায় নেচে উঠে। কেবল ফুল বলে তো নয়, নিশীরাতের ঘন আঁধারে খোলা আকাশে দঁড়ির সাথে কতগুলো প্রদীপ লাগানো। ভেতরে বড় ঘর থাকলেও বাহিরেও রঙিন বসার স্থান আছে।
সমুদ্র লামিন ও তুষারের সাথে ভেতরে খাবার অর্ডার দিতে যায়। মোহের ফুলগুলো দেখে ভালো লেগেছে বিধায় ঈশাকে তার সাথে রেখে গেছে। অথচ সমুদ্র অর্ডার দিয়ে এসে ঈশাকে জুসবারের কাউন্টারে একা দেখে। ঘাবড়ে যাবার সাথে রেগেও যায়। ঈশাকে কতগুলো ঝারি দিয়ে নিজে আসে মোহের খোঁজে৷ বাগানের দিকে খুঁজেই মোহকে পায় না। সাথে সাথে তার ভয় হয়। ঘাবড়ে যায় সে। রেস্টুরেন্টের অপর পাশেই বীচ। আবার বীচের দিকে যায় নি তো? তার ভীষণ রাগ হলো, মেয়েটা তার কথা শুনে না কেন? বারবার মুশিবতকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে। দ্রুত সামনের বীচের দিকে যেতে নিলে থেমে যায় সে। রেস্টুরেন্টের একপাশে কিড’স জোনে দোলনা আছে দু’টো। একটায় বসা মোহ। তাকে দেখে আটকে থাকা নিশ্বাস ফেলে সমুদ্র।
সমুদ্র মোহের কাছে যায় বকার জন্য। কিন্তু তাকে খুশিমনে দোলনায় দুলতে দেখে তা মোটেও পাড়ে না। সে দেখে মোহ তাকে চুলে বেণিতে রং-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজিয়ে একপাশে রেখেছে।
সমুদ্র গভীর নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কী আমাকে জ্বালাতে খুব বেশিই ভালো লাগে মধু?”
কথাটা শুনে সে পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় সমুদ্রকে। তার দিকে কাঁধ বাঁকা করে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
সমুদ্র দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবারও। এত ইনোসেন্ট মুখ দেখে অবশ্যই সে বকতে পারে না। সে যেয়ে বসে মোহের পাশে। সাথে সাথে মোহ আঁতকে উঠে, “এ’মা কি করছেন? ভেঙে যাবে তো।”
“তুমি এতক্ষণ ধরে বসে আছো তাতে ভাঙে নি। আমি বসলেই ভেঙে যাবে?”
“আপনাকে দেখেন আর আমাকে দেখেন।”
সমুদ্র চোখ রাঙালে মোহ হেসে উঠে।
সমুদ্র বলে, “এভাবে হঠাৎ চলে যাবে না যেখানে ইচ্ছা। তুমি যেভাবে মুশিবত ডাক দিয়ে আনো। সারাক্ষণ বেঁধে রাখতে হবে দেখছি।”
“আমি কি মুশিবিত এনেছি? এমন মিথ্যে অপবাদ আমি সহ্য করবো না।”
“গতকাল বলেছিলাম তোমাকে কাছেই থাকবে। তুমি বীচে এসেই আরেক মাথায় চলে গিয়েছিলে কোন সুখে?”
“অন্যমাথায় না, একটু সামনে গিয়েছিলাম শুধু। ছেলেগুলো এত বাজে আমি জানতাম না’কি? ওদের বলেছিলাম, আসো বাবাগণ আমাকে হ্যারেজ করে যাও?”
মোহের কথায় সমুদ্র কিছুক্ষণ হা করে থেকে হেসে দেয় শব্দ করে। মোহও হাসে। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, “থ্যাঙ্কিউ গতকালের জন্য। এক মুহূর্তের জন্য আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। আপনি যদি সঠিক সময়ে সাহায্যের জন্য না আসেন। আমি না ফাইট করতে চেয়েছিলাম নিজের থেকে। কিন্তু এত সাহস হয় নি। তাই যখন ধ্যান ছিলো না একটা লাথি মেরে আপনার কাছে দৌড়ে এলাম। আর আপনি প্রথমে তো আমাকে বিশ্বাসই করছিলেন না।”
“এমন না বিশ্বাস করছিলাম না। তোমার রিয়েকশন দেখে কে বুঝতে পাড়বে যে ওরা তোমাকে…” সম্পূর্ণ কথাটা সমুদ্রের মুখ দিয়েও বের হয় না। অথচ তার মুখে কালো ছায়া পড়ে।
মোহ তা খেয়াল করে আফসোসের সুরে বলে, “আমার একটাই সমস্যা। আমি কান্না করতে পাড়ি না। আমার সহজে কান্না আসে না।”
“তাই? শেষ কবে কান্না করেছিলে?”
মোহ তাকায় তার দিকে। একবার বলতে চায় আমাদের বিয়ের দিন, আপনার জন্য আমি এতবছর পর প্রথম কান্না করেছিলাম। কিন্তু বলে না।
“যখন আমার আট বছর ছিলো একটা ড্রেসের জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। তখন অবস্থা এত ভালো ছিলো না আমাদের। বাবা অনেক বুঝিয়েছিল আমাকে। কিন্তু বুঝতে চাই নি। বাবা আমার কান্না দেখে মনে করে নিজের ব্যর্থতায় আমাদের সব সুখ দিতে পাড়ছে না। কষ্টে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেদিনের পর থেকে আমি আর কান্না করিনি। আমার কান্না দেখলে আমার ভালোবাসার মানুষগুলোও কষ্ট পাবে কি-না! সেদিন থেকে আমি সিদ্ধান্ত নেই আমার জন্য আমার মা বাবা কখনো কষ্ট পাবে না। আর সেভাবেই চলি। এছাড়া আমার জীবনটা এতদিন সুখেরই গেছে। কান্নার কিছু হয় নি।”
“লাকি ইউ। জীবনে প্রেমে পড়ো নি। যাদের মা বাবা ভালো তাদের জীবনে কান্নার অস্তিত্ব থাকে না যতদিন না পর্যন্ত তুমি প্রেমে না পড়ছো। একবার প্রেমে পড়লে তোমার চোখের জল তোমার প্রতিদিনের সাথী হয়ে যায়।”
মোহ তাকায় তার দিকে। সমুদ্র কি সহজে কথাগুলো বলছে। না মুখে কোনো উদাসী আছে, আর না চোখে কোনো কষ্টের ভাব। কিন্তু মোহ তার কন্ঠে মনে চলা কটু স্মৃতির ধাঁচের আভাস পায়। সে তেঁতো হাসে, “তাহলে এই জীবনে আমি আর প্রেমে পড়তে চাই না।”
মোহ গভীর নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। ভাবে, “স্বপ্ন তো সব ভেঙে চুরমার হয়েই গেছে আপনার আমার জীবনে আগমনে। এই কষ্টটাই নাহয় বুকে গাঁথুক। চোখের জলের সঙ্গ আমার পছন্দ হয়।”
“যাওয়া যাক?” মোহ প্রশ্ন করে।
সমুদ্র এখনই যেতে চায় না। তার সৈকতের পাশে মিষ্টি বাতাসের সাথে মোহের চুলে লাগানো ফুলের ঘ্রাণটা বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু মোহ তো নিজের মন মতোই সব করে। সে নিজের মন মতো চলেও গেল। সমুদ্রের আর কি করার? সে পিছনে গেল মোহের। যেয়ে দেখে ঈশা ও তুষার ভাই গানে নাচছে। লামিন তাদের ভিডিও করছে। মোহ আগ্রহ নিয়ে তাদের দেখছে।
রেস্টুরেন্টে তাদের ছাড়া কেউ নেই। তাই নিজেদের পছন্দ মতো গান ছেড়ে নাচছে তারা। মোহের চোখে উৎসুকভাব ভেবে সমুদ্র হাসে। সবে বলল কখনো প্রেমে পড়বে না আর এক মিনিট না যেতেই এই সামান্য প্রেমের দৃশ্য দেখে তার চোখদুটোতে উৎসুকভাব জ্বলজ্বল করছে। তারপর সমুদ্র ভাবে, মোহ যতই ম্যাচিউর বিহেভ করুক অবশ্য সবে অষ্টাদশী পাড় করে উনিশে পা রাখা কন্যা-ই তো। তাই এসব দেখে সংবেশিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে কণুই দিয়ে মোহকে খোঁচা দেয়, “এই মধু…”
মোহ বিরক্তি নিয়ে তাকে সরিয়ে দেয় কাঁধ দিয়ে ঠেলে।
সমুদ্র আবারও খোঁচায় তাকে।
মোহ বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে।
সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, “নাচবে?”
এইটুকু প্রশ্নে মোহের বাদামী চোখের মণিতে উৎসুকতা জ্বলজ্বল করে। সমুদ্র হাসে। স্বাভাবিক, ছোট থেকে মা বাবার আদর্শ মেয়ে হবার খাতিরে জীবন তেমন উপভোগ করতে পাড়ে নি মোহ। এখন সুযোগ পাবার পর এই ছোট ছোট কাজও তার চোখেমুখে খুশির ঝলক নিয়ে আসে।
মুখ দিয়ে না বললেও তার চেহেরা উওর দিয়ে দেয়। সমুদ্র তার হাত ধরে তাকে তুষার ও ঈশার পাশে নিয়ে আসে।
“আমি আগে কখনো আপুদের মতো কাপল ডান্স করিনি তাই পাড়ি না।” মোহের কথায় সমুদ্র তার হাত ধরে তার কাঁধে রাখে, “আমি আছি তো।”
মোহ গাঢ় হাসে। সমুদ্র তার আরেক হাত ধরে। অন্যহাত কোমড়ে রাখতে যেয়ে দ্বিধাবোধ করে তারপর পিঠে আলতো করে ছোঁয়। সম্পূর্ণ হাতও রাখে না। কিন্তু তার এই সামান্য ছোঁয়ায় মোহের শরীরে যেন বিদ্যুৎ এর চমক বয়ে গেল।
“ফলো মাই লিড।” সমুদ্রের কথায় মোহ তার দিকে তাকায়। মুহূর্তে মুগ্ধ হয়ে যায়। উপরের বাতির মৃদু আলোয় সমুদ্রের শ্যামবর্ণ মুখখানা মনোমুগ্ধকর লাগছে। চোখ ধাঁধানোর মতো সুন্দর। সরু চোখ, লম্বা উঁচু নাক, সরু ঠোঁটজোড়া। মোহের নিশ্বাস আটকে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হয়? পুরুষ মানুষের এত সুন্দর হতে হবে কেন?
সমুদ্র খেয়াল করে মোহ তার কিছু বলা ছাড়াই তার থেকে ভালো নাচছে। সে কপাল কুঁচকায়, “তুমি যে বললে আগে কাপল ডান্স করো নি। দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
“কখনো করিনি, এমনি দেখেছি মুভিতে।”
“দেখে শিখে নিয়েছ?”
“টিভিতে দেখে আগে নাচ করতাম। তারপর স্কুল, কলেজের ফাংশনেও নাচ করেছিলাম। অনেকগুলো প্রাইজও পেয়েছি জানেন?”
“তাই না’কি?” সমুদ্র মোহের কথা বলার সময় খুশি দেখে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে।”
“জানেন আমাদের স্কুল কলেজের তো আমার টিচাররা নিজের থেকেই নাম লিখে দিতো। আমাকে জিজ্ঞেসও করতো না।”
“বাহ তাহলে তো খুব ভালো নাচ জানো তুমি। জানো জবার খুব ভালো নাচ করতো। কলেজে ওর নাচ দেখেই প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম। ওকে দেখে অন্য রাজ্যেই হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল চারপাশে আঁধার হয়ে গেছে। আমার সামনে উজ্জ্বল কেবল জবা আছে।”
মোহ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তার মনে হলো তার বুকের ভেতর কামড়াচ্ছে কিছু। তবুও সে তার হাসি উড়াল না এবার। তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের দিকে উদাসীন হাসি নিয়ে। দেখলো সমুদ্রের মুগ্ধতায় ডুবে থাকা নয়ন। মেয়েটার নাম নিতেই সমুদ্র মুগ্ধতায় ডুবে গেল? আচ্ছা মেয়েটা কী তার থেকেও বেশি সুন্দর? সমুদ্র কি একটিবারও তার দিকে এই দৃষ্টিতে তাকাতে পাড়ে না? এই জীবনে মোহ কাওকে কখনো হিংসা করে নি। অথচ আজ এক অচেনা, অজানা মেয়ের প্রতি তার ঈর্ষা হচ্ছে। সে নিশ্চিত সমুদ্র এই মুহূর্তে তার সাথে গানের সুরে নাচলেও তার চোখের সামনে জবা নামক মেয়েটাই ভাসছে…
I would never fall in love again until I found her
I said, “I would never fall unless it’s you I fall into”
I was lost within the darkness,
but then I found her
I found you….
.
.
মৃণা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। ভাবে মহুয়া না থাকার সুবাদে সে পালাবে। একটা রুম ভাড়া নিয়েছে পাঁচদিন হলো। মহুয়ার ভয়ে সে যেতে পাড়ে না। একারণে যখন মহুয়া তাকে নিজের সাথে যাবার কথা বলে, কিন্তু অফিসের কাজের অজুহাত দেখিয়ে মৃণা আর গেল না। তারপর সে নিচে গেল। সে নিচে যেয়ে দেখল মুরাদ টেবিলে বসে খাচ্ছে। মুরাদ তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন ওখানে? এদিকে আয়।”
মৃণা এগোল। সে পানি নিতে এসেছিল। মুরাদ ডাকায় সে গেল তার সামনে।
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস। খাবার খাবি না?”
“খেয়েছি। মল্লিকা খালা খাচ্ছিল, তার সাথে খেয়ে নিয়েছি। খালা কী বাসায় নেই?”
“না, একটু বাহিরে গেছে। তার ঔষধ আনতে।”
মুরাদের খাওয়া শেষে সে প্লেট রেখে হাত ধুঁয়ে চা বসাল। মৃণাকে প্রশ্ন করল, “চা খাবি?”
মৃণা চোখ কপালে তুলে, “আপনি বানাবেন?”
“এত অবাক হওয়ার কি আছে। এই টুকটাক রান্নাবান্না আমিও পাড়ি।”
“আমি বানিয়ে দিচ্ছি। আপনি যেয়ে বসুন।”
মুরাদ মানা করার পূর্বে মৃণা আবারও বলে, “আমি চা ভালো বানাতে পাড়ি। মোহ, মহুয়া, আন্টি, আংকেল, আমার দাদী সবাই অনেক পছন্দ করে। মোহ তো না’কি বিয়ের পরদিন আমার মতো করে সবাইকে বানিয়ে খাইয়েছিল। সবাই অনেক পছন্দ করেছে।”
কথাটায় মুরাদের কপাল কুঁচকে যায়, “মানে আমাকে ছাড়া তুই সবাইকে খাইয়েছিস?”
প্রশ্নটায় মৃণা জোরপূর্বক হাসে। মুরাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে ক্ষেপে গেছে। কিন্তু এখানে রেগে যাবার কি হলো তা মৃণা বুঝলো না।
মুরাদ বলল, “দোতলার ব্যলকনিতে আছি। সাথে তোর জন্যও নিয়ে আসিস।” বলে সে উপরে চলে গেল।
মৃণা খুশি হলো সুযোগ পেয়ে। কাওকে না বলে তো আর যেতে পাড়ে না। মুরাদকে বলে যাবে। মুরাদ মহুয়াকে বুঝালে সে-ও বুঝবে।
মৃণা দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে যায় দোতলার বড় ব্যলকনিতে। যেয়ে দেখে মুরাদ ল্যাপটপে কাজ করছে।
মুরাদের সামনে চা রেখে মৃণা বলল, “ভাইয়া কিছু কথা…” সম্পূর্ণ বলার আগেই মুরাদ তার দিকে তাকায়। মৃণা ভড়কে যায় তার তাকানো দেখে। তারপর দ্রুত শুধালো, “মানে স্যার… স্যার একটা কথা ছিলো।”
“এই সোফায় ঠাডা পড়ছে দেখেছিস?”
“হেঁ?” মুরাদের হঠাৎ এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মৃণা।
“ঠাডা না পড়লে তুই চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কোন দুঃখে? সোফায় বসতে আমন্ত্রণ দেওয়া লাগবে।”
মৃণা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। মহুয়া তো তাও সারাক্ষণ ত্যাঁড়া কথা বলে তাই তার কথাগুলো স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু মুরাদ সারাক্ষণ শান্ত থেকে হঠাৎ কোথা থেকে এই মহুয়ামার্কা কথাবার্তা বলে কে জানে!
মুরাদ তাকে আবারও এত গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে বলে, “এত কী ভাবছিস তুই? এমন মনোযোগ দিয়ে ভাবছিস যে Riemann Hypothesis সলভ করবি।”
“হেঁ?”
“বসতে বলেছিলাম তোকে?”
মৃণা সাথে সাথে বসে মুরাদের পাশে। মাঝখানে জায়গা খালি রেখে। একটু দ্বিধাবোধ করে বলে, “মুরাদ ভাই…মানে স্যার আমি তো অনেকদিন হলো এখানে আছি তাই….”
“তাই?” মুরাদ তার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সম্পূর্ণ কথা বললে কাঁচা গিলে খাবে। তার বুকের ভেতর ভয় ধরপর করতে শুরু করল। তবুও সে অনেক সাহস জোগাল। মুরাদ বেশি হলে একটা থাপ্পড় দিবে। মহুয়ার মতো ছাদ থেকে আছাড় মারার হুমকি তো দিবে না। সে আমতা-আমতা করে বলে, “আমি একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। ওখানে থাকব।”
মুরাদের কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় হয়, “এখানে কেউ তোকে কিছু বলেছে? কোনো সমস্যা আছে? কীসের অভাব তোর এখানে?”
“না না মুরাদ ভাই এখানে সবাই অনেক ভালো। আমার অনেক বেশি আদর করে। আন্টি তো আমাকে মহুয়ার মতোই আদর করে।”
“তাহলে কী সমস্যা?”
“আমি নিজের যোগ্যতায় নিজের জীবন গড়তে চাই।”
“প্রয়োজন নেই।”
মৃণা থতমত খেয়ে যায় তার উওরে। এই লোক তো মহুয়া থেকেও বেশি ত্যাঁড়া। মৃণা গভীর নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি যাবই।”
মৃণা এক চোখ খুলে প্রথমে মুরাদকে দেখে। মুরাদ চোয়াল শক্ত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মৃণার হাত ধরে বলে, “তোর কি ইচ্ছা আমি আবারও তোর টেনশনে ম’রবো? ক’দিন আগে এত বড় মুশিবত থেকে বেরিয়ে এসেছিস তোকে আমি কোথাও যেতে দিব না।”
“আমি যাবই।”
“তুই তো বড্ড বেয়াদব হয়ে দেখছি। থাপ্পড় দিব একটা।”
“আপনি থাপ্পড় দিলেও আমি যাব।”
মুরাদের এবার মেজাজ খারাপ হয়। সে মৃণার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে টান দেয়। মৃণাকে টান দিয়ে কাছে আনলে। তার দিকে তাকায় রাগী কিন্তু অসহায় দৃষ্টিতে,
“তোর কেন আমাকে ছেড়ে যেতে হবে?”
মৃণা প্রশ্নটা শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মুরাদ শুধায়, “মানে আমাদের। আমাদের সবাইকে। বাসার সবাই তোকে অনেক ভালোবাসে।”
মৃণার মন তার দৃষ্টি দেখে নরম হয়ে যায়। তবুও সে অনুরোধের সুরে বলে, “প্লিজ ভাইয়া আমি এটা চাই। আমি নিজের নতুন জীবন নতুনভাবে শুরু করতে চাই। আপনার দয়ায় আমি ওদিন মরি নি, আপনার দয়ায় চাকরিটাও পেয়েছি কিন্তু সারাজীবন আপনার দয়ায় তো এখানে থাকতে পাড়ব না। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন মুরাদ ভাই। যার দায় আমি কখনো দিতে পাড়ব না। কিন্তু এবার আমি নিজের জন্য কিছু করতে চাই। নিজের জীবন নিজে গড়তে চাই। প্লিজ মুরাদ ভাই।”
মুরাদ চোখ বড় করে নেয়, “আমি তোর উপর দয়া দেখিয়েছি? আমি যা করেছি সব দয়া করে?”
মুরাদ ঠেলে মৃণাকে সরিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে অভিমানের সুরে বলে, “যা করার মহুয়া আসার পর করিস৷ আমি ওকে কোনো জবার দিতে পাড়ব না।”
বলে সে চলে গেল রুমে।
“ভাইয়া আমার কথা তো শুনুন।”
মৃণা তার পিছু যায়। কিন্তু মুরাদ তো কিছু শুনেই না। উলটো তার মুখের উপর শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
মৃণা আকুতি করে বলে, “মুরাদ ভাই অন্তত চা’টা খেয়ে নিতেন।”
এই কথাটা শুনে তো মুরাদের মাথা আরও গরম হয়ে যায়। সে উঁচু স্বরে বলে, “তোর ওই চা’তে চুবানি দে। যা এখান থেকে বেয়াদব মেয়ে।”
মুরাদ মেজাজ খারাপ করে পায়চারি করে কতক্ষণ। তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে বসে বিছানায়। রাগ কমানোর জন্য কতক্ষণ গভীর নিশ্বাস ফেলে।
মাথা একটু ঠান্ডা হলে তার চশমা খুলে রাখে বেডের সাইডের টেবিলের উপর। আর ড্রয়ের খুলে একটি ডায়েরি বের করে। ডায়েরির মাঝখান থেকে একটি ছবি বের করে।
ষোড়শী বয়সী এক কৃষ্ণকলির ছবি। যার মুখে মায়া ভরা। হাঁটু অব্দি কৃষ্ণকালো চুল। তাকে দেখেই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুরাদ বলে, “তোর কী আমাকে জ্বালাতে একটু বেশিই ভালো লাগে ময়না? এতবছর তোর চিন্তা করে করে কাটিয়েছি। অবশেষে তোকে যখন কাছে এনে চিন্তামুক্ত হলাম তখনই তুই আবার দূরে যাওয়ার কথা বলছিস? তুই কবে একবারে আমার হবি ময়না? আমার তো তোকে আমার চোখের সামনের থেকে সরাতে মন চায় না’রে। তোর জন্য এই বুক জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে যন্ত্রণায়। তবুও তুই বুঝিস না। আমাকে কি শেষ করেই তোর শান্তি হবে ময়না?”
চলবে….