মেঘের খামে…
পর্ব ৩১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
রোজ শুক্রবার, সমুদ্র বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার ঘড়ি দেখছে। বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোমরা কি আসবে না? না আসলে আমি চলে গেলাম।”
সমুদ্রের মা বাবা এলো। হাতে কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে। সমুদ্র বলে, “আসতে এতক্ষণ লাগে? তোমাদের এত বলায় ওই বাসায় যাচ্ছি। আরেকটু হলে আমার মত চেঞ্জ হয়ে যেত। মধু কোথায়?”
“ও রেডি হয়েছে। আসছে।” ছোট করে উওর দিলেন সমুদ্রের মা। তারপর যেয়ে বসে গেলেন গাড়িতে।
সমুদ্র আবারও বিরক্ত হয়ে ঘড়ি দেখে, “মধু তাড়াতাড়ি আসো।”
“আসছি…”
সমুদ্রের কানে নুপুরের শব্দ বাজে। সে তাকায় সামনের দিকে। মোহ হাতে ব্রেসলেট পরতে পরতে এগিয়ে আসছে।কালো রঙের আনারকলি পরেছে সে। নিচের অংশে মোটা সোনালি রঙের কাজ। তার আঁকা বাঁকা চুলগুলো ছাড়া। কানে সোনালী রঙের দুল।
তাকে হঠাৎ সামনে থেকে আসতে দেখে সমুদ্রের চোখ আটকে যায়। মোহ তার কাজল কালো চোখ তুলে তাকিয়ে হাসি দেয়। সাথে সাথে সমুদ্র চোখ সরিয়ে নেয়। আবারও তাকায়। মোহ তার সামনে এসে তার হাত এগিয়ে দেয়, “ব্রেস্টলেটটা লাগিয়ে দিন তো।”
সমুদ্র তাকায় তার দিকে। গম্ভীরস্বরে বলে, “আজ সুন্দর লাগছে।”
প্রথমবার সমুদ্রের মুখে প্রশংসা শুনে সে অবাক হয়ে তাকায়।
“কী বললেন?” মোহ অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে। বিয়ের পর এই প্রথম সমুদ্র একটু প্রশংসা করলো।
কিন্তু সমুদ্র আর কিছু বলে না। তার ব্রেসলেট লাগিয়ে নিজে যেয়ে বসে বাইকে। সমুদ্রের মা’ও ডাক দেয় মোহকে গাড়িতে বসার জন্য।
মোহ যেয়ে গাড়ীতে উঠে বসে তার শশুড় শাশুড়ীর সাথে। তার শাশুড়ী মা পাশ থেকে তার হাত ধরে বলে, “মোহ তোমার থেকে একটা জিনিস চাই?”
মোহ অবাক হয় তার কথায়। এই কয়দিন তারা দু’জন তাকে অনেক আদরের সাথে রেখেছেন। সমুদ্রের সাথে তাদের একটা দূরত্ব আছে হয়তো একারণে তাকে দুইজনের আদর একসাথে ঢেলে দিচ্ছেন। তারও এই দুইজনের প্রতি মায়া জন্মে গেছে। সে তার শাশুড়ীর হাতের উপর হাত রাখে, “বলুন আন্টি। জিজ্ঞাসার কী আছে?”
“আজ সমুদ্রের ফুফাতো বোনের এনগেজমেন্ট। সমুদ্রের ফুপি অনেক বছর ধরে চাচ্ছিলেন ওদের বিয়ের জন্য। ওর সাথে আগে সমুদ্রের বিয়ের কথা চলছিল কিন্তু সমুদ্র বিয়ের কথা শুনলেই রেগে যেত। রেগে ভাঙচুর করতো। তারপর আমার জন্য বিয়ে করতে রাজি হলেও ওর রাগ আর বেপরোয়া ভাব দেখে ওর ফুপু পিছিয়ে যায়। এ নিয়ে আমাদের পরিবারে অনেক ঝামেলা হয়েছে। ওর ফুপি এখনো রাগ। মাঝেমধ্যে একটু কটু কথা বলে দেয়। তুমি কেবল আজকের জন্য একটু কিছু বললে গা’য়ে লাগিও না। একটুর জন্য আমার সম্পর্ক যে সুতো দিয়ে বেঁধে আছে সে সুঁতোও ছিঁড়ে যাবে। তোমার আংকেল অনেক কষ্ট পাবে। তার একমাত্র বোন। ওয়াদা করো আমাকে।”
মোহ তার কথা বুঝে, মাথা নাড়ায় সে বুঝেছে।
তারা ফুপির বাসায় যেয়ে দেখে মেহমানে বাসা গিজগিজ করছে। তারা ভেতরে যায়। এখনো ছেলেপক্ষ আসে নি। তারা জোহরের নামাজের পড়ে আসব। তারপর আংটি পরাবে। সমুদ্রকে দেখতেই তার কাজিনরা দৌড়ে আসে। তাকে ঘিরে ধরে। সবাই সমুদ্রের ভক্ত। মোহ আবার বাচ্চাদের থেকে বড়দের সাথে সহজে কথা বলতে পাড়ে। কিছুক্ষণেই তার প্রশংসা হয়ে যায় সারা বাড়ি। সবার মন জয় করলেও তার ফুপিশাশুড়ীর তাকে পছন্দ হয় নি বলাটা ভুল হবে না। সে কথা বলতে গেলেই মুখ বাঁকিয়ে চলে যান তিনি। মোহও সেদিকে ধ্যান দেয় না। তার শাশুড়ী আগেই এইসব হবে বলেছিল। এমনিতেও সে কেবল কাছের মানুষদের দেওয়া কষ্টে কষ্ট পায়, নাহলে এককান দিয়ে কথা ঢোকায় অন্য কান দিয়ে বের করে।
মোহ তাদের কাজও এগিয়ে দিচ্ছিল। তাকে শাশুড়ী মানা করলেও বিয়ে বাড়িতে কাজ বেশি বলে সে সাহায্য করে দিচ্ছিল। সে দেখে নামাজ থেকে সবাই এসেছে কেবল সমুদ্র ছাড়া। অহিলকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পাড়ে সমুদ্র আড্ডা দিতে বেরিয়ে গেছে।
মোহ একরুমে রেগেমেগে কল দেয় সমুদ্রকে, “এই লোক আপনি কোথায়?”
“ছিঃছিঃ মধু নিজের একমাত্র স্বামীর সাথে কেউ এভাবে কথা হবে? পাপ হবে।”
“মিস্টার স্বামী আপনি এটা বলেন আগে যে অনুষ্ঠান ছেড়ে কীভাবে আড্ডা দিতে যেতে পাড়েন?”
“আরে এদের আমি এত পাত্তা দেই না। তুমিও দিও না। বেশি পাত্তা দিলে মাথায় চড়ে নাচে এরা।”
“চুপ করেন। আর দ্রুত আসেন এখানে।”
“দেখো মধু আমি থাকলে ওখানে একটা ঝামেলা হবে।”
“কী ঝামেলা হবে শুনি?”
“ছোট থেকে শ্রেয়ার সাথে ফুপি আমার বিয়ের জন্য অনেক কিছু করেছেন। শ্রেয়াও কম ছিলো না সারাক্ষণ আগেপিছে ঘুরতো। আংটি পরানোর সময় কোনো আত্নীয় কিছু বলে ফেললে এনগেজমেন্টে সমস্যা হবে। তারপর ফুপি মা বাবাকে কথা শুনাবে। তখন আমার আবার রাগ উঠবে। আমি কিছু বলে ফেললে ফুপি আবার মা বাবাকে কথা শুনাবে। তো মেইন কথা হচ্ছে আমি থাকলে এনগেজমেন্টটা ভালো মতো যাবে না। তাই এনগেজমেন্ট শেষে আসবো। অহিল ছেলেপক্ষ চলে গেলে আমাকে কল দিয়ে জানাবে।”
মোহ কিছুক্ষণ ভেবে বলে, “আচ্ছা তাড়াতাড়ি এসে পড়েন কিন্তু।”
“ওহ মধু আমাকে এখন থেকেই মিস করছ না’কি?”
“এহ আসছে রাখেন তো।”
কল রাখার পর সমুদ্র ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসে। তারপর তাকায় তার দুইজন বন্ধু লামিন ও রিফাতের দিকে। লামিন জিজ্ঞেস করে, “ফোনের দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসছিস কেন?”
“এখন আমার বউটা এত পিচ্চি কি করব? ওর কথা, কাজ, রাগ সব কিউট লাগে। মাঝেমধ্যে মজা করলে লজ্জাও পেয়ে যায় তখন বেশি কিউট লাগে।”
রিফাত বলে, “প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস না’কি ভাই? ভাবি এত সুন্দর প্রেমে পড়া অস্বাভাবিক কিছু না।”
“পাগল না’কি? আমি এতটুকু নিশ্চিত আমার আর প্রেমে পড়া হবে না।”
“কে কখন কোথায় প্রেমে পড়ে যায় কেউ জানে না দোস্ত। আর তোরও সুন্দর জীবন কাটানোর অধিকার আছে।” লামিন বলল। রিফাতও তার সাথে তাল মেলায়, “বিশেষ করে যেখানে জবা তোকে ছেড়ে ওই কারিমের সাথে টা….” লামিন তাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে চুপ করায়। আর বলে, ” মানে ও বলতে চাচ্ছে জবা কারিমের সাথে হ্যাপি আছে তাই তোরও এখন জীবনে হ্যাপি হওয়ার অধিকার আছে।”
“আর মধুরও আছে। আমি ভাবছি ওর বাবা মা’য়ের কথা অনুযায়ী ছয়মাস পর ডিভোর্স নিয়ে নিব। এর আগে একটা ভালো ছেলে খুঁজতে হবে।”
লামিন ও রিফাত দুইজনই তার দিকে তাকায় জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে। লামিন জিজ্ঞেস করে, “ছেলে দেখবি মানে?”
“ওকে আরেকটা বিয়ে দেবার জন্য। ”
উওর শুনে দুইজনে আকাশ থেকে পড়ে।
“এমন আজব কথা এই পৃথিবীতে আর শুনি নি। কে নিজের বউকে অন্যকারো সাথে বিয়ের কথা ভাবে?”
সমুদ্র বলে, “আমি-ই পৃথিবীতে প্রথম ব্যক্তি হবো। সো কুল।”
“না ভাই তুই ব্লাডি ফুল।” লামিন বিরক্তির স্বরে বলে, “মোহ এত মিষ্টি, ভালো, সুন্দর। আর মেইন কথা তোর মুখে হাসি আনে। এমন মেয়েকে কীভাবে ছাড়ার কথা ভাবতে পাড়িস তুই?”
“এজন্যই আমি এমনটা ভাবেছি। ওর স্বপ্ন ছিলো বিয়ের পর ওর স্বামী ওকে অনেক ভালোবাসবে।
” তো তুই ভালোবাসবি ওকে। কে মানা করেছে? কেউ-ই সারাজীবন এক স্থানে পড়ে থাকে না চাই। যে-কেউ চাইলে মুভ অন করতে পাড়ে।”
“সবাই পাড়ে না।”
“যারা চায় না।”
সমুদ্র টেবিলে জোরে একটা বাড়ি মেরে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোর হঠাৎ কী হলো? ঈশার ভূত তোর মধ্যে ঢুকে গেছে না’কি?”
“না, তোর স্টুপিডিটি দেখে পাগল হয়ে গেছি।”
রিফাত তাদের থামায়, “ভাই রেস্টুরেন্টে এসেছি। মানুষ দেখছে। ঝাগড়া না করে কিছু অর্ডার দেই।”
সমুদ্র প্রথমে একটা হোটেলে তাদের সাথে লাঞ্চের জন্য বসে। তারপর তারা বাইক নিয়ে সারাদুপুর ঘুরে। তারপর চা’য়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতে। এমন সময় অহিদের কল আসে তার কাছে। বিকেলের শেষ ভাগে। ছেলেপক্ষ চলে গেছে। তাই সমুদ্র দ্রুত উঠে যায়। সে তার ফুপির আশেপাশে মোহকে একা রাখতে চায় না। যদিও সে জানে তারা বেশি খারাপ পর্যায়ে যাবে না কিন্তু মোহ তো এখনো ছোট। সে কষ্ট পাবে তাদের কথায়। আর উল্টো কিছু বলে দিলে তার ফুপি আবার বাবা, মা’য়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে তখন তারা কষ্ট পাবে।
সমুদ্র বাড়ির সামনে বাইক পার্ক করে, তখনই ভেতর থেকে শব্দ শুনতে পায়। সে দরজাতেই দেখতে পায় সকলে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকপাশে তার ফুপি ও মোহ দাঁড়িয়ে আছে৷ মোহের মাথা নিচে নামানো আর তার ফুপি ভীষণ রেগে আছে। সোফায় বসে আছে তার ফুফা ও তার ফুফাতোবোন শ্রেয়া।
সমুদ্র ভেতরে ঢুকে। তার কপাল কুঁচকানো, “কি হচ্ছে এখানে?”
তাকে দেখে ফুপি চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু তার হাতে থাকা নুপুর তখনও বাজছে। সমুদ্র একদেখায় চিনিতে পাড়ে এটা মোহের নুপুর।
শ্রেয়া উঠে দাঁড়ায়, “সমুদ্র ভাইয়া তুমি জানো আজ এই মেয়ে কী করেছে? এই মেয়ে…”
সমুদ্র তার দিকে তাকায় শীতল দৃষ্টিতে, “এই মেয়ে? ও তোর ভাবি হয়।”
তার রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে শ্রেয়া এক মুহূর্তের জন্য চুপ হলেও আবারও বলে, “এই বিয়ে যে তোমার কাছে মূল্যহীন তা সবার জানা আছে ভাইয়া। তোমার কাছে ওর মূল্য নেই। তাই ওঁকে কোনো কিছু সম্বোধন করতে হবে আমার মনে হয় না।”
“তোর কী মনে হয় তা আমি জানতে চেয়েছি?” সমুদ্র তার ফুপি ও মোহের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে ডাক দেয়, “অহিল…”
“জ্বি…জ্বি ভাই?”
“কী হয়েছে?”
ফুপি রাগী গলায় বলল, “আমি বলছি কী হয়েছে! তোর বউ আজ আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙতে চেয়েছে।”
সমুদ্র হুঙ্কার অরে বলল, “অহিল আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি। প্রথম থেকে বল।”
সমুদ্র মোহকে নিজের দিকে ঘুরায়। মোহ তখনও মাথা নিচু করে ছিলো। সমুদ্র তার থুতনিতে হাত রেখে মুখ তুলে। তার কাজলকালো চোখে পানি দেখে তার হৃদপিণ্ড শীতল হয়ে যায় আর মস্তিষ্কে আগুন জ্বলে উঠে।
সমুদ্রকে দেখে মোহের চোখে জমে থাকা জল গাল গড়িয়ে পড়ে। সমুদ্র তার সে গাল আলতো করে ছুঁয়ে জলের ধারার চিহ্ন মুছে দেয়।
অহিল বলতে শুরু করে, “ছেলেপক্ষ এসে বসেছিল আংটি পড়ানোর জন্য। সব ঠিকই যাচ্ছিল। ভাবি সবার সাহায্য করছিল। রান্নাঘর থেকে খাবার ডাইনিংরুমে নিয়ে রাখছিল। এইরুম থেকে দরজা দিয়ে সে রাস্তায় একটু দেখা যায়। ভাবি যাবার সময় ছেলে নুপুরের শব্দ শুনে তাকায় সেদিকে। ভাবিকে দেখে ছেলে তার মা’কে বলে ঘরের অন্য মেয়েকে তার ভালো লেগে গেছে। আর আজ তাকে আংটি পরাতে চায়। এই নিয়ে ভালোই কাহিনী হয়েছে কতক্ষণ ধরে। তারপর যখন জানা যায় ছেলেটি ভাবিকে দেখেছিল। তখন বিবাহিত জানার পর ঝামেলা থামে।”
“তারপর?” সমুদ্র তার ফুপির হাত থেকে নুপুরজোড়া নেয়। মোহের হাত ধরে তাকে নিয়ে বসায় সোফায়।
“তারপর,” অহিল আবারও বলতে শুরু করে, “আম্মু ভাবিকে বলে ভেতরের রুমে যেয়ে বসতে। ভাবি তাই করে। এনগেজমেন্ট সম্পূর্ণ হলে আম্মু ভাবিকে রুম থেকে আনে।”
সমুদ্র মোহের সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে। তার পা ছুঁতেই মোহ ঘাবড়ে যায়। তাকে সরাতে চাইলে সমুদ্র তার দিকেও তাকায় রাগান্বিত দৃষ্টি। যেন সাবধান করছে তাকে বাঁধা না দিতে। সে মোহে পা নিয়ে নিজের হাঁটুর উপরে রাখে। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। সবার যেন চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।
কিন্তু সমুদ্রের এতে কিছু আসে যায় না। সে মোহের পা’য়ে নুপুর পড়ানো অবস্থাতেই অহিলকে বলে, “তোকে থামতে বলেছি?”
অহিল আবারও শুরু করে বলা, “সবার যাবার পর আম্মু ভাবিকে এখানে এনে কটু কথা বলে।”
“কী বলে?”
অহিল মাথা নিচু করে নেয়, “ভাবিকে নিয়ে আমি এসব মুখে আনতে পাড়বো না।”
সমুদ্র তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালে সে ফটাফট ছোট করে বলে, “ভাবির চরিত্র নিয়ে খারাপ কথা বলেছে।”
ফুপিও তেজ গলায় বলে, “বলেছি তো কি? মিথ্যা বলেছি না’কি? একটু রূপ আছে বলে তা দিয়ে ছেলেদের আকর্ষণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। এমন মেয়েদের চরিত্রে সমস্যা থাকে। রক্ত তো একই। বোন বিয়ের দিনে ভেগে গেছে। এই মেয়ে কীভাবে ভালো হবে?”
সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো শুনল। সযত্নে মোহের পা মেঝেতে রেখে উঠে দাঁড়াল। তার ফুপির দিকে তাকিয়ে বলে, “তো মধু কী শ্রেয়ার হবু জামাইয়ের সামনে এসে চিল্লিয়ে বলছিল যে এই ভাই দেখেন আমাকে। চোখের কোটর বের করে দেখেন।”
“এ’কি…”
“চুপ। আপনি অনেক বলেছেন। এবার আমি বলছি আপনি শুনুন। ওই ছেলের নাম আমার জানা নেই, জানার ইচ্ছাও নেই। তার চরিত্রে সমস্যা আছে, নাহলে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আংটি পরাতে এসে একজন মেয়েকে একপলক দেখেই এনগেজমেন্ট কে ভাঙতে চায়? বিয়ের সময় শ্রেয়া থেকে সুন্দর মেয়ে দেখে বিয়ে ভাঙতে চাইবে না এই কী গ্যারান্টি আছে? এক কাজ করেন ঘরের সব মেয়েকে এক রুমে বন্দী করে রেখেন। বিয়ের পর ছেলে যে রাস্তা দিয়ে হাঁটবে সে রাস্তায় সাইন লাগিয়ে দিবেন যেন ওই রাস্তায় কোনো মেয়ে না আসে।” সে তারপর গলার স্বর উঁচু করে তার আত্নীয়দের উদ্দেশ্য বলে, “আপনারা বিয়ের সময় ভুলেও আপনাদের মেয়ে বা বউদের নিয়ে আসবেন না। ছেলের যদি পছন্দ হয়ে যায় তাহলে তাদের আমার ফুপি চরিত্রহীন বানিয়ে দিব। আর রইলো আমার আসার কথা,” সমুদ্র আবার তার ফুপির দিকে তাকায়, “যে ঘরে আমার বউয়ের অপমান হয়েছে সে ঘরে আসা তো দূরের কথা আমি সম্পর্কও রাখবো না।”
মোহ দ্রুত উঠে তার হাত ধরে। সমুদ্র তার দিকে তাকালে সে মাথা নাড়ায় ডানে বামে। সমুদ্র হাত হাত ধরে, “চলো এখানে থাকার আর দরকার নেই। এদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।”
মোহ এতক্ষণে মুখ খুলে, “এভাবে বলেন না। ফুপির সাথে কিছু মা বাবা অনেক কষ্ট পাবে।”
ফুপিও তার কথা শুনে বলে, “তুই কথাটা ফিরিয়ে না নিলে আজকের পর থেকে কেবল তোর সাথে না তোর মা বাবার সাথেও সব সম্পর্ক শেষ আমাদের।”
কথাটা শুনে সমুদ্রের বাবা বলে, “আপা এসব কী বলছেন আপনি?”
কিন্তু সমুদ্র এই কথায় পাত্তা দেয় না। সে মোহকে বলে, “চলো।”
“এমন করেন না সমুদ্র। এতগুলো সম্পর্কে ভেঙে যাবে।”
“তোমার এতকিছু ভাবার দরকার নেই।
” আমি যাব না।”
“এতকিছুর পরও তুমি থাকবে?”
মোহ তাকায় সমুদ্রের মা বাবার দিকে, “আমি ওয়াদা করেছি। আর এমনিতেও পরের কথায় আমার কিছু আসে যায় না।”
“তাহলে কান্না করলে কেন?”
মোহ একপলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়, “আমার চরিত্র নিয়ে কথা উঠলে আমার সহ্য হয় না।”
সমুদ্র তার গালে হাত রেখে মুখ তুলে। নরম স্বরে বলে, “তুমি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি পবিত্র। কেবল যারা অন্ধ তারাই তোমার চরিত্রে প্রশ্ন উঠাতে পাড়ে।”
ফুপা এবার গম্ভীর স্বরে বলে, “সমুদ্র তোমার নিজের মুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। তোমার ফুপি হন।”
“আপনি আপনার ওয়াইফকে এতটুকু বলাতে ক্ষেপে গেলেন। তাহলে আমার বউকে যে অপমান করা হয়েছে এতে তো আমার আপনাদের ঘর আ’গুন লাগিয়ে পু’ড়িয়ে দেওয়া উচিত। আমার ফুপি বলেই এতক্ষণ এটা করিনি।”
সমুদ্র এক দুই না ভেবে মোহকে কোলে তুলে নেয়। আচমকা এমন কিছু সমুদ্র করবে মোহ ভাবতেও পাড়ে নি। সে তার ডাগর চোখজোড়া বড় করে নিলো। সে সমুদ্রের বুকে ধাক্কা মেরে বলল, “কি করছেন? সবাই দেখছে, নামান।”
“তোমার এতক্ষণ মুখ খুলে নি। এখনো খোলার দরকার নেই।”
সমুদ্র মোহকে নিয়ে যেতে নিলে আবার ফিরে তাকায় তার মা বাবার দিকে, “মধু আপনাদের জন্য নিজের চরিত্রের উপর তোলা প্রশ্নও সহ্য করেছে। কিন্তু আপনারা কীভাবে শুনলেন? ওকে না আপনারা নিজের মেয়ে মেনেছেন? ওর মা বাবা তো একথা শুনতে পাড়তো না। নিজের কথার মান না রাখতে পাড়লে সে কথা মুখ দিয়ে বের করাও উচিত না।”
তারপর সে অহিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বাসায় যদি মধুকে নিয়ে একটা ভুল কথা হয় আমাকে জানাবি। মানুষসহ এই বাড়িও পুড়িয়ে দিব।” শেষের কথাটা বলার সময় তার কন্ঠস্বর উঁচু হয়ে যায়। তার গলার স্বরে তার রাগ ভাব স্পষ্ট হয়ে যায়।
সমুদ্র মোহকে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে বাড়ি থেকে। বাড়ির বাহিরে যেয়ে তাকে কোল থেকে নামিয়ে বাইকে বসায়। তারপর আবার সিঁড়ির কাছে যেয়ে তার জুতা নিয়ে এসে পড়িয়ে দেয়। মোহ তাকে থামাতে চাইলে এবার তারও ক্লাস নেয় সে, “তুমি তো কথাই বলো না। আমার সামনেই তোমার মুখে শুধু কথা ফুটে তাই না? তখন তুমি ফুপিকে কিছু বলো নি কেন?”
মোহ ঠোঁট উল্টে নেয়। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ” দুই পরিবারে আরও ঝামেলা বাড়তো এজন্য।”
“তুমিও তো আমাদের পরিবার। তারা যে মুহূর্তে তোমার অপমান করেছে সে মুহূর্ত থেকেই সব সম্পর্ক শেষ। সবকিছু তাদের ইচ্ছামতো হবে আরকি। সে আমার জেদ তোমার উপর বের করছিল। শ্রেয়ার বিয়ে আমার সাথে দিতে পাড়ে নি। জবার প্রতি আমার পাগলামো দেখে ভেবেছিল আমি বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবো। কিন্তু তোমার সাথে আমাকে দেখে তাদের সহ্য হচ্ছে না।”
সমুদ্র তার সকল ক্ষোভ বের করে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর মোহের দিকে তাকিয়ে বলল, “এরপর থেকে আর নিজের সম্মানের উপর কথা এলে সহ্য করবে না। তা যার দাঁড়াই হোক।”
মোহ মাথা নাড়ায়।
সমুদ্র বাইকে উঠে বসে, “ভালো করে ধরে বসো। পড়ে গেলে হাড্ডি ভেঙে যাবে।”
মোহ সমুদ্রের কাঁধে হাত রাখল। সমুদ্র বাইক চালু করে। মোহ একপাশ থেকে দেখছিল সমুদ্রকে। তার চোখের পলকও পড়ছিল না। না তার ঠোঁটের হাসি মলিন হচ্ছিল। আজকের বাতাসটাও তার মিষ্টি লাগছিল। আকাশটা অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল মেঘেরা খেলছে সে বিশাল আকাশে। সে তার হাত নিচে নামিয়ে সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে।
সমুদ্র তাকায় তার হাতের দিকে, ” স্পিড কম করবো?”
মোহ প্রশ্নে মিথ্যে উওর দেয়, “উঁহু একটু মাথা ঘুরাচ্ছে কেবল।” বলে সে সমুদ্রের পিঠে মাথা রাখে।
সমুদ্রের স্পর্শে হৃদস্পন্দন থেমে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। তার মাতালো ঘ্রাণে শরীরের শিরায় শিরায় কেঁপে উঠে। তার ইচ্ছে হয় এই মুহূর্তটা যেন এখানেই থেমে যায়। আজকের সবকিছু তার অন্যরকম লাগছে, নতুন লাগছে। এমনকি বাতাসটাও। সে চোখজোড়া বন্ধ করে। মনে মনে চিঠি লিখল তার সমুদ্রকে, “হে শ্যামসুন্দর পুরুষ, আপনি জানেন বিয়ের প্রথম মুহূর্ত থেকেই আপনার উপর আকর্ষিত হয়েছি। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কখনো আপনার প্রেমে পড়বো না। কত নিয়ন্ত্রণে রেখেছি এই মন। কিন্তু থাকলো কই? আপনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দিলেন কোথায়? আমার জন্য, আমার সম্মানের জন্য আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে লড়াই করে নি। বিশ্বাস করেন, আপনার প্রেমে আমি পড়তে চাই নি, কিন্তু এই মন আমার কথা শুনে নি। আপনার প্রেমে পড়েই গেলাম। এখন আমার পিছু ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও, সারাজীবনের জন্য আপনাকে ছাড়ছি না। হয়তো আপনি আমাকে ভালোবাসবেন না। তাতে কি, আপনার পক্ষ থেকে নাহয় বন্ধুত্বই থাকুক, আমার অনুভূতি দিয়েই এই সম্পর্কে ভালোবাসা ভরিয়ে দিব।”
চলবে….
মেঘের খামে…
পর্ব ৩২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
শিকদার ভিলার সামনে গাড়ি এসে থামে। মহুয়ার পরিবার তার ফুফা, ফুপি ও আজিজের সাথে আসে। তাদের রিসিভ করতে আসে বাড়ির বড় ও ছোট ছেলে। ভেতরে প্রবেশ করার পর পূর্ণি দৌড়ে এসে মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে। তারপর ছেড়ে বলে, “আপু আমি কত এক্সাইটেড ছিলাম তুমি আসবে বলে। এত দেরি হলো কেন তোমার?”
“আরে বলো না আমি লেভেলের ব্যস্ত ছিলাম।”
“তোমাদের এক্সাম হয়েছে না’কি?”
“ধ্যুর এক্সামে কোন পাগলে টেনশন করে? আমি না একটা হরর মুভি দেখছিলাম। কিন্তু ভূত দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। তো আমি টেনশনে পড়ে গেলাম আমার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে না মাথা। এটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর উঠতে অনেক আলসামি লাগছিলো তারপর আবার টেনশনে পড়ে গেলাম আমি বিছানা থেকে উঠলে আবার আমার আলসামি কষ্ট পাবে না’কি?”
পূর্ণি তার কথায় জোরে হেসে দেয়। আর মহুয়ার ফুপি তার মা’কে বলে, “ওকে মুখ খুলতে মানা কর। এত বড় মানুষদের সামনে সম্মান ডুবিয়ে ছাড়বে।”
শায়ান তার ভাইদের সাথে পাশের চেয়ারে বসেই গেইম খেলছিল। মহুয়ার কথা শুনে তার গেইম থেকেও মন উঠে গেল। সে মুখ বানিয়ে বলে, “সারাদিন নিজের চেহেরা আয়নাতে দেখলে ন্যাচারালি ভূত দেখে ভয় লাগবে না।”
তার কথাতেও তার ভাইয়েরা হেসে দেয়।
পূর্ণি তার কথার বিরোধিতা করে বলে, “ভাইয়া এসব কী বলছো? আপু কত কিউট দেখো।”
“নট ইন্টারেস্টেড।”
মহুয়া আর কিছু বলার আগে তার মা চোখ রাঙায় তাকে। মহুয়াও আর কথা বাড়াল না। তার প্রিয় ঘুম ছেড়ে সে এখানে আসায় এমনিতেও বিরক্ত।
তারা বসে সোফায়। কথা বলার মাঝে শারাফ শিকদার তার মা জামিলাকে ধরে হাঁটিয়ে আনেন। সবাই দাঁড়িয়ে তাদের সালাম দেয়। জামিলা বেগম সবাইকে সালামের উওর দিয়ে মহুয়ার হাত এসে ধরে, “কেমন আছো বোইন? আমিও ভাবছিলাম তুমি আসবা কি-না! আমি তো এজন্য পূর্ণিকেও তোমাকে ফোন দিয়ে আসতে বললাম। তুমি ভালো আছো?”
মহুয়া উওর দেবার আগে শারাফ শিকদার তাকে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে তুমি মহুয়া। অনুষ্ঠানের পর থেকে মা’য়ের মুখে কেবল তোমার নামই শুনছি। অনুষ্ঠানের সময় তো আর ভালো করে দেখা হয় নি। তুমি না’কি শায়ানের ভার্সিটিতেই পড়ো। কি’সে সাবজেক্ট নিয়ে পড়ো তুমি?”
“মার্কেটিং ফার্স্ট সেমিস্টারে।”
“তোমার ভাইয়েরও মার্কেটিং নিয়েই বিজনেস। পড়া শেষে কি ভাইয়ের কোম্পানিতে ঢুকবে না’কি?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ আংকেল কি বলেন? আমি ঢুকলে একমাসে আমাদের পথে বসতে হবে। আমি বারোটা বাজালে আমাদের কোম্পানির বাজাবো না’কি? রাইভাল কোম্পানিতে ঢুকে বারোটা বাজাব।”
তার সোজা প্রশ্নের এত ত্যাড়া উওর শুনে শারাফ শিকদার হেসে দিলেন ঠোঁট চেপে। কাওকে বুঝতে দিলেন না হাসিটা। বললেন, “মা ঠিকই বলেছিল, তুমি আসলে অন্যরকম।”
শায়ান তার বাবার কথা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সেদিকে। তারপর বিরক্তি নিয়ে তাকায় মহুয়ার দিকে। তারপর উঠে চলে যেতে নিলে শারাফ শিকদার তাকে থামায়। তার কন্ঠস্বর আময়িক থেকে কর্কশ হয়ে যায়, “মেহমানদের মাঝ থেকে উঠে যাওয়াটা কোন ধরনের ভদ্রতা শায়ান?”
শায়ান তার চরিত্র থেকে বহির্ভূত স্বভাবে যেয়ে নম্র স্বরে উওর দিলো, “একটু কাজ আছে। শেষেই আসছি।”
শায়ান উঠে যাবার পর দাদী পূর্ণিকে কিছু ইশারা দিলো। পূর্ণিও মহুয়ার হাত ধরে বলে, “মহুয়া আপু আসো, তোমাকে আমি আমাদের বাড়ি দেখাই।”
শ্রাবণী বলে, “আমিও আসছি।”
“ভাবি তুমি আসবে? এতদিন পর আংকেল আন্টি এসেছে। তাদের সময় না দিলে পরে তো তোমার কষ্ট লাগবে। তুমি নাহয় এখানে থাকো। আমি আপুকে দেখিয়ে আনি।”
মহুয়ার তো উঠতেও আলসামো লাগছিল। তবুও পূর্ণির কথায় সে উঠে গেল তার সাথে।
তাদের যাবার পর দাদী মুহিবকেও বাহিরে পাঠাল। তারপর শারাফকে বলল, “এখন কথাটা সেরে ফেল।”
শারাফ শিকদার আময়িক হেসে মহুয়ার বাবার দিকে তাকান, “ভাইসাব আমার ছেলে শায়ানকে তো দেখেছেনই। ওর ভার্সিটি শেষ হতেই বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছি। ছোট থেকে ওর মা নেই। আমিও কাজে ব্যস্ত থাকি। ওর দাদীই ওকে পেলে বড় করেছে। ওর দাদীর মহুয়াকে পছন্দ হয়েছে। আম্মা খুব করে চায় শায়ানের সাথে মহুয়ার সম্বন্ধ করতে।”
এমন প্রস্তাব শুনার প্রস্তুতি নিয়ে আসে নি মহুয়ার মা বাবা। তাদের থেকে বেশি আশ্চর্য হয় মহুয়ার ফুপি। তার মেয়েকে ছেড়ে মহুয়ার জন্য এত ভালো প্রস্তাব আসবে সে বিশ্বাসই করতে পাড়ছে না। সে কিছু বলতে নিলে শ্রাবণী তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
মহুয়ার বাবা হঠাৎ এমন প্রস্তাব শুনে আশ্চর্য হয়ে যায়। সে বলে, “আপনারা অনেক সম্মানিত ব্যক্তি। আপনাদের সাথে সম্বন্ধ করতে পারা পরিবার ভাগ্যবান হবে কিন্তু আমরা এখনই আমাদের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি না।”
“শায়ানেরও যেহেতু একবছর বাকি আছে আমরাও এত তাড়া করছি না। আপনারা চাইলে আগামী বছর কাবিন করিয়ে রেখে মহুয়ার পড়া শেষে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে আনবো।”
মহুয়ার বাবা মহুয়ার মা’য়ের দিকে তাকায়। তারপর ইশারায় কিছু কথা বলে সে উওর দেয়, “আমরা আমাদের ছেলের সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করে নেই। আমরা মহুয়ার মা বাবা হলেও ওকে ছোট থেকে দেখেশুনে বড়ই করেছে ওর ভাই। আর বিয়ের সিদ্ধান্তটাও মুরাদই নিবে।”
“আচ্ছা ভাইসাব। আপনি আমাদের জানিয়েন।”
পূর্ণি মহুয়াকে বাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে শুরু করে। বাড়ি দেখাতে দেখাতে দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে একপাশে কয়েকটা রুম আছে। বাকি অংশটুকু ছাদ। ছাদে জিমের ইক্যুয়েপমেন্ট ভরা। রুমের সাথেই কেবল ছাদ দেওয়া, বাকিটুকু খোলা অংশ। সেখানে মিউজিক স্পিকার, তিনটা বিনব্যাগ ও ক্যারামবোর্ড রাখা। যা দেখে মহুয়া স্পষ্ট বুঝে যায় এটা শায়ানের রুমই হতে পাড়ে। সেদিন ক্যাফেতেও তাদের জায়গায় এমনই জিনিসপত্র ছিলো।
পূর্ণি তাকে বলে, “এখানে শায়ান ভাই থাকে।”
“তোমার ভাই একা এত বড় জায়গা দখল করেছে?”
“ভাইয়ার একা থাকা পছন্দ তো তাই। ভাইয়া ছাদে কাওকে নিজে না আনা পর্যন্ত কারো আসা নিষেধ। কেবল আমি বাদে। আমি ভাইয়ার সবচেয়ে বেশি আদরের কি-না! আচ্ছা আপু তোমার ভাইয়াকে কেমন লাগে?”
“ফালতু।” মহুয়ার সরাসরি উওর শুনে পূর্ণির ঠোঁটের হাসি উড়ে যায় সাথে সাথে। সে বলে, “এভাবে বলো না আপু। আমার ভাইয়া কিন্তু অনেক ভালো। কাওকে দেখাতে পাড়ে না শুধু। কিন্তু মনের অনেক ভালো।”
মহুয়া তার কথা শুনে জোরপূর্বক হাসে। মনে মনে বলে, “বোনদের জন্য ভাইরা সাধুই থাকে। তোমার ভাই যে কতবড় লুইচ্চা ওটা তো তুমি জানো না। জানলে এই কথার আর বলতা না।”
পূর্ণি আবারও বলে, “আপু তুমি এখানে একটু বসো, আমি আমাদের জন্য নাস্তা উপরে নিয়ে আসি। নিচে সব বড়দের মাঝে বোর হয়ে যাবে।”
“ভালো আইডিয়া।”
পূর্ণি যাবার পর মহুয়া বিনব্যাগে বসে। হঠাৎ বিড়ালের শব্দ পেয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়। শায়ান কি তাহলে তার বিড়ালছানাকে সত্যি ঢাকায় এনেছে? আশেপাশে তাকায় সে। কিন্তু কিছু দেখে না। রুমের দরজাতেও কান লাগায় কিন্তু সেখান থেকে শব্দ আসছিল না। তারপর আবারও শব্দর দিকে এগোতে থেকে সে ছাদের পিছন দিকে যায়। সেখানে দেখতে পায় সরু এক জায়গার শেষ মাথায় বসে আছে শায়ান তার কোলে তিনটা বিড়াল ছানা। এর মধ্যে একটা তার বিল্লুভাই। কারো আভাস পেয়ে শায়ান চোখ তুলে তাকায়। তারপর চোখ ঘুরায় বিরক্তিতে, “গেট লস্ট।”
মহুয়া কি কারো কথা শোনার মেয়ে? সে সোজা বসে পড়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। শায়ান তার দিকে তাকায় কপাল কুঁচকে, “কী?”
“কী মানে? আমার বিল্লুভাইকে দেন।”
নামটা শুনে শায়ান মুখ বানায়, “এই নামে ডাকলে জীবনেও দিব না।”
“আমার বিল্লুভাইয়ে দেখাদেখি নিজেও দুইটা বিড়াল নিয়ে আসছ, এখন আবার কাহিনী করছ?”
“তোমার দেখাদেখি? এই সাদাটা আমার আগের বিড়ালের বাচ্চা। আর কালোটা আমি সাদাটার সঙ্গী হিসেবে এনেছি। আর ফর ইউর কাউন্ড অফ ইনফরমেশন। দুইজনের অনেক সুন্দর নাম আছে। সাদাটার নাম মার্শম্যালো আর কালোটার নাম কুকি।”
“বিড়ালদের এত ইয়ামি নাম কোন গাঁধায় রাখে? আচ্ছা তাহলে ওদের নাম মিলি আমার বিল্লুভাইয়ের নাম ক্রিম পাফ। আমার বিল্লুভাই ক্রিমপাফের মতো কিউট তাই না?”
শায়ান ঠোঁট টিপে হাসে খানিকটা। তারপর বিড়ালগুলোকে কোল থেকে নামালে ক্রিমপাফ ও কুকি মহুয়ার কাছে গেলেও মার্শম্যালো শায়ানের পা’য়েই মুখ ঘেঁষে শুয়ে থাকে। মহুয়া তো দু’টো বিড়ালছানাকে কোলে তুলে আদর করে। তারপর তাকিয়ে বলে, “ওটা তোমাকে মনে হয় বেশিই ভালোবাসে?”
“অফকোর্স জন্ম থেকে আমিই পেলেছি। ওর আম্মু ম’রে যাবার পর সবগুলো বাচ্চাকে এডোপ্টে দিয়ে দিয়েছিলাম। অন্যসবগুলো এডজাস্ট করে নিলেও মার্শম্যালো আমাকে ছাড়া থাকবেই না। চারটা ঘর পাল্টেছে। মানুষ থেকে পশুরা বেশি লয়াল।”
“ওর আম্মুকেও তুমিই পেলেছিলে?”
প্রশ্নটায় শায়ানের ঠোঁটের কোণে সরল হাসি এঁকে উঠে, “হ্যাঁ আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো। আমার অন্ধকারের সাথী। কখনো আমাকে একা ছাড়ে নি। যখন ছয় বছরের ছিলাম তখন আমিও একজনের মতো তাকে বাগানে বক্সের ভেতর লুকিয়ে রাখতাম।”
মহুয়া তখন মুখ ফুলায়, “এই মানে তুমি জানতে এটা আমার বিড়ালছানা। চোর।”
“আমি নিয়েছিলাম বলেই এখন তোমার কোলে আছে। এত হলে নিয়ে যাও।”
“মুরাদ ভাইয়ার এলার্জি না হলে ঠিকই নিয়ে যেতাম। তোমার মতো বান্দরের কাছে আমার এত কিউট ক্রিম পাফকে রাখার আমার এত শখ নেই।” মহুয়া তার বিড়ালছানাকে আদর করতে করতে আবার কৌতূহলী চোখে তাকায় শায়ানের দিকে, “আচ্ছা তোমাদের সমস্যা কী?”
“হোয়াট? কী সমস্যা?”
“মানে তোমার আর জাহানের মধ্যে। তোমরা একে অপরকে দেখতে পাড়ো না কেন?”
শায়ান মার্শম্যালো থেকে চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। ভ্রু উঁচু করে। এক হাঁটু মুড়িয়ে হাঁটুর উপর হাত রাখে। পিছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা তুমি তোমার জাহানকেই জিজ্ঞেস করো না কেন?”
“আমার? ও হ্যালো, আমার সাথে ওর কিছু চলছে না।”
“এটা হলেই ভালো, নাহলে তোমার অবস্থা কি হবে তুমি কল্পনাও করতে পাড়বে না।”
“এই মিস্টার আমি তোমাকে ভয় পাই না। এটা তুমিও জানো। এসব হুমকি অন্যকাওকে দিও। আর আমার মন যাকে চাইবে আমি তার সাথেই প্রেম করবো। আর জাহানের প্রেমে পড়েনি কারণ…কারণ…” মহুয়া ভাবলো। কিন্তু খুঁজে কোনো কারণ পাচ্ছিল না। সে মনে করতে চাইল। শুরু থেকে তাদের দেখা থেকে সব ভাবতে লাগল। তার চোখের সামনে ভাবলো তাদের স্মৃতিগুলো। প্রেমে না পড়ার কারণতো ভেবে পেল না। কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠল। যা দেখে কপাল কুঁচকে তাকাল শায়ান।
“তুমি স্মাইল করছ কেন? দেখো আমি তোমাকে বলে দিয়েছি তুমি জাহানের কখনো হতে পাড়বে না ইম্পসিবল।”
“ওয়াটএভার আমি ওর কথা ভাবছিও না। আর ভাবলেও আমি তোমাকে ভয় পাই না বুঝলে? তুমি রশ্মির জন্য একথা বলছো। তাকে ভালোবাসো বলে। অফকোর্স ও জাহানকে তোমার আগে বেছে নিবে। জাহান তোমার থেকে তো হাজারো গুণে ভালো আছে। যেকোনো মেয়ে ওকেই চুজ করবে। তোমার মতো লুচু তো না।”
সে ভেংচি কেটে কুকিকে হাতে নিয়ে আদর করতে থাকে।
তার উওরে শায়ান বিদ্যুতের গতিতে এসে মহুয়ার হাতে ধরে টান দেয়। সাথে সাথে তার হাত থেকে কুকি পড়ে যায়। আচমকা এমন কিছু হওয়ার কল্পনাও মহুয়া করে। শায়ান তার ঠিক সামনে। যাকে এতটা কাছে দেখে মহুয়ার অবাক চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
শায়ান রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “রিয়ালি? আমি এত লুচু হলে তোমার সাহস কীভাবে হয় আমার সাথে এখানে একা বসে থাকার। আমি যদি তোমাকে কিছু করে দেই তাহলে?”
“তাহলে?” মহুয়া মৃদু হাসে। যা শায়ান মোটেও আশা করে নি। এই প্রতিক্রিয়া তো মোটেই না।
“তাহলে আমি সোজা তোমার আব্বুর কাছে বিচার দিব। তাকে যে বাঘের মতো ভয় পাও ওটা আমি ধরে নিয়েছি।”
শায়ান তার হাত ছেড়ে বিরক্তি নিয়ে বলে, “শায়ান শিকদার কাওকে ভয় না।”
মহুয়া তার গাল টেনে বলে, “নিজের বাবাকে তো পায় বাবুটা। একটু আগে যেভাবে ভয়ে ভয়ে মিথ্যে বলছিল আমি তো তখনই ধরে ফেলেছি। এছাড়া যদি দাদী আর পূর্ণি জানে তুমি আমাকে কত সম্মান দিয়ে কথা বলেছ তখন কি ভাববে বলো তো।”
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার।”
শায়ানের মুখে ভয় ও রাগ দেখে তো মহুয়ার আরও মজা লাগে। সে মজা করে বিড়ালছানাদের মতো শায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “না বাছা ডেয়ার তো ভুলেও দিও না। গতবার ডেয়ার দেবার পর আমি মুহূর্তে পূরণ করেছিলাম। ভুলে গেছ?”
শায়ানের কানে যেন তার কথাও যায় না। সে কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে। মহুয়া তার আজব দৃষ্টি দেখে অবাকও হয়। তার দৃষ্টি কেমন নরম হয়ে গেছে। সে হাত সরাতে চাইলে শায়ান তার হাত ধরে নেয়। মহুয়া বুঝে না কিছু। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
শায়ান তার দিকে তাকিয়েই থাকে। তার হাতও সরায় না। মহুয়া কিছুই বুঝে না। সে জিজ্ঞেস করে, “কিছু কি হয়েছে?”
শায়ানের গলা কেঁপে উঠে, “আমার মা’ও ছোট থাকতে এভাবেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।”
“তোমার মা? আন্টিকে তো অনুষ্ঠানেও দেখলাম না। আজও দেখলাম না। সে কোথায়?”
প্রশ্ন শুনে শায়ানের ধ্যান ভাঙে। সে মহুয়ার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। তারপর হঠাৎ জোরে বলে উঠে, “খবরদার আমার আশেপাশেও আসবে না তুমি।”
“হেঁ?”
শায়ান সেখান থেকে চলে যায়। মহুয়া তো কি হলো কিছুই বুঝল না৷ সে সেদিকে পাত্তাও দিলো না। তার বিড়ালছানা গুলোর সাথে খেলতে শুরু করল।”
.
.
সমুদ্র বাইক থামায় একটি চা’য়ের দোকানের সামনে। তার বন্ধুরা এখনো সেখানে আড্ডা দিচ্ছিল। রিফাত অবাক হয়ে লামিনকে ডাকল, “দেখতো সমুদ্র বাইকে মেয়ে নিয়ে আসছে।”
লামিন সেদিকে তাকায়। তারপর রিফাতের মাথায় চাটি মারে, “ওটা ভাবি।”
“তো ভাবি মেয়েই তো। ছেলে হবে না’কি? গর্দভ। সমুদ্র আমাদেরই বাইকে নেয় না সেখানে ভাবিকে নিয়ে আসছে। সমুদ্র একজন ছাড়া কাওকে নিজের প্রিয় বাইকে কখনো তুলে নি।”
লামিন কথাটা ভেবে তাকায় তাদের দিকে। দেখে সমুদ্র বাইক থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মোহের দিকে। তা দেখে সে মৃদু হাসে। তার ফোন বের করে দৃশ্যটা ভিডিও করে পাঠায় ঈশাকে। আর বলে, “হয়তো মানুষটা চেঞ্জ হচ্ছে।”
সমুদ্র মোহকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার বন্ধুরা এখানে আছে তাই এসেছি। আমরা রেস্টুরেন্টে যেয়ে ডিনার করে একবারে বাসায় যাব। তো এখনই কি রেস্টুরেন্টে যাবে? না’কি আগে চা খেয়ে নিবে।?
“চা।”
“আগে কখনো দোকানে বসে চা খেয়েছ না’কি?”
“কলেজে থাকতে খেয়েছি। শীতে যখন সকালে কোচিং থাকতো তখন মহু ও মৃণার সাথে।”
“আচ্ছা আসো আজ এখানের চা খাওয়াই। চাচা সেকেন্ড বেস্ট চা বানায়।”
সমুদ্র মোহের হাত ধরে সামনে নিয়ে যায়। দোকানের সামনে যেয়ে উঁচু স্বরে বলে, “চাচা দেখেন কাকে এনেছি। আপনার বানানো চা’কে আমার ফেভারিটের লিস্ট থেকে কিক মেরে বের করে দেওয়া আমার বউকে।”
মোহ তার কথা শুনে তাকে চিমটি কাটে, “এটা কী বলছেন?”
“আরে আমরা কলেজ থেকে এখানেই চা খাই। তারা অনেক কাছের।”
সমুদ্র তাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে। সামনেই রিফাত আর লামিন বসা ছিলো। লামিনকে দেখে মোহ গাঢ় হাসে, “কেমন আছেন ভাইয়া?”
“এইত্তো পিচ্চি ভাবি। আমরা তো ভালো ছিলাম। একটা দৃশ্য দেখে আর ভালো নেই।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“আপনার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন। চৌদ্দ বছরের বন্ধুত্ব আজ পর্যন্ত ওর বাইকে উঠায় নি। তার বাইকে কেউ বসলে তো রাগ উঠে যায় জনাবের। আজ তাহলে কী হলো?”
কথাটা শুনে মোহ অবাক হয়ে তাকায় সমুদ্রের দিকে। তার একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, “তাহলে তাকে কেন নিজে বসাল? সে কি এখন সমুদ্রের জন্য স্পেশাল?” কিন্তু জিগ্যেস করল না।
সে হেসে আশেপাশে জায়গাটা দেখতে থাকলে সে দেখতে পায় পাশে বাইকের কাছে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে অস্বস্তি বোধ করে তা দেখে। সমুদ্রের বাহু ধরে নেয় শক্ত করে।
সমুদ্র তার বন্ধুদের সাথে গল্প করার সময় তার বাহুতে মোহের হাত রাখার আভাস পেয়ে তার দিকে তাকায়। দেখে সে অস্বস্তিতে মাথায় নিচু করে আছে। প্রথমে সে বুঝল না। একটু আগেও তো মেয়েটা হাসছিল। কিন্তু পরক্ষণে সামনের ছেলেদের বাজে নজর দেখে তার মাথায় র’ক্ত উঠে গেল। সে উঠতে নিলে মোহ তার বাহু আরও শক্ত করে ধরে, “বাচ্চা পোলাপান। মনে হয় স্কুল কলেজে পড়ে। বাদ দিন।”
“লামিন, রিফাত…” সমুদ্র তাদের ইশারা দেয় তাদের ভাগিয়ে দিতে। তারা উঠেও যায় সাথে সাথে।
সমুদ্র তার বাহুতে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে আনে আচমকা। তারপর তার অপরপাশের বাহুতে হাত রেখে বলে, “এমন কিছু হলে জানাও না কেন?”
“আমার অভ্যাস আছে।”
“এমন অভ্যাস থাকা ভালো না। এতবছরের অভ্যাস এখনই বিসর্জন দেও। দেখো স্নেহ, আকর্ষণ, ভালোবাসা আর লালসার দৃষ্টি থাকে ভিন্ন ভিন্ন। ওরা তোমার দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আমি থাকতে কেউ তোমার দিকে বাজে নজরে তাকালে তাদের চোখ উঠিয়ে ফেলবো। এখন তুমি আমার দায়িত্ব বুঝেছ? আমি থাকা অবস্থায় আমার কাছে থাকবে। কেউ তোমার দিকে বাজে নজরে তাকালে তার চোখ তুলে ফেলব।”
মোহ তার বাহুতে সমুদ্রের হাত দেখে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়।
.
.
মৃণা সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছে আজ। নতুন বাসায় এসে এই প্রথম সারাদিন থেকেছে। অফিস ছিলো না যে। আজ নিজের সব গুছিয়ে নিয়েছে। সেই খুশিতে আজ খিচুড়ি রান্না করেছে। সাথে ডিমভাজা। সে খিচুড়ি দুই প্লেটে বাড়ল। তারা চারজন থাকলেও দুইজন গতকালই বাসায় গিয়েছে। একপ্লেট নিয়ে রাখল তার রুমমেট লামিয়ার সামনে। লামিয়া তাদের একবছরের ছোট। এবার এইচএসসি দিবে।
“না না আপু আপনি খান আমার এসব লাগবে না।” লামিয়া মানা করল।
“তুমি তো দুপুরেও কিছু খাও নি। খেয়ে নেও।”
“আমার অভ্যাস আছে আপু।”
“অভ্যাস আছে? তুমি না খেয়ে থাকো?”
“মাঝেমধ্যে। সবসময় না। একটা টিউশনিতে টাকা দেয় নি এমাসে এখনো।”
“তোমার পরিবার টাকা দেয় না?”
“আমার পরিবার? আমাদের বাড়িতে মেয়েদের জানেরও মূল্য নেই। আমি তো বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি এস এস সি এর পর। হয়েছে কি আমার আব্বা দাদীর কথায় আমাকে একটা চেয়ারম্যানের ছেলের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল আমার ভাইয়ের কলেজের জন্য। ছেলে ওইটার নজর যে খারাপ আমাদের গ্রামের কতগুলো মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল। আমাকে ধরতে নিয়েছিল তখন ইট দিয়ে মাথা ফাঁটায় দেওয়ার পর জেদে আমাকেই বিয়ে করবে। এরপর আমার সামনে মেয়েদের ধর্ষণ করবে। তাই আমিও রাতে আমার দাদীর স্বর্ণের চেইন চুরি করে ভেগে এসে পড়েছি ঢাকায়। আমার তো পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। দেখেন আপু একসময় আমি পড়াশোনা অনেক টাকা কামাব তখন অনেক রকমের খাবার খাব।”
মৃণা তার দিকে তাকাল মায়ার দৃষ্টিতে। তার মাঝে মৃণা নিজের ঝলক দেখতে পেল। কিন্তু এই মেয়েটার জীবন তার থেকে কত কষ্টে হয়েও সে কতটা সাহসী।
মৃণা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হেসে বলে, “আচ্ছা এখন এটা খেয়ে নেও। পরে বাকিসব খেও।”
“আপনি আমাকে খারাপ মনে করবেন না তো আপু?”
“খারাপ কেন মনে করব?”
“ওই বাকি দুই আপু আছে না? একবার তাদের ডাল আমি এক তাক থেকে অন্য তাকে সরিয়ে রেখেছিলাম। আমাকে চোর বলেছিল। কিন্তু সত্যি আমার দাদীর চেইন ছাড়া আমি কিছু চুরি করি নি।”
মৃণা হাসে, “তোমার খিদে লাগলে আমার খাবার থেকে খেয়ে নিও। এমাসে আমার টানাটানি আছে এজন্য এমাসে মাছ, মাংস কিছু আনতে পড়বো না। ডিম এক ডজন এনেছি। এরপর আনতে পাড়বো কি-না জানি না। কিন্তু আগামী মাস থেকে আমি বেতন পাব। তোমার কি খেতে মন চায় বলো। তোমার জন্য আনবো।”
“কিন্তু আপু আপনি কেন আমার জন্য আনবেন? আমি আপনার খাবার খেলে সমস্যা হবে আপনার।”
“কোনো সমস্যা হবে না। এখন তুমি খাও যখন তুমি অনেক টাকা কামাবে তখন আমাকে খাইয়ো, ঠিকাছে?”
লামিয়া হেসে মাথা নাড়ায়, “আমি যখন কামাব তখন আপনাকে বিরিয়ানি খাওয়াব। তাও হোটেলের।”
থালাটা হাতে নিয়ে বলে, “জানেন আপু আমার দাদী আমাকে কখনো ডিমও খেতে দেয় নি। বলতো এসব ছেলেরা খায় শুধু। এজন্যই শুধু তারই চেইন চুরি করেছি।” বলে হেসে খাবার মুখে নিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “আপু এগুলো কি মজা! অনেক মজা। আমি এর আগে এত মজার খাবার খাই নি।”
মৃণা খাবারে হাত দেবার পূর্বেই দেখল লামিয়া খাবার প্রায় শেষ করে ফেলছে। সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকল। এতটুকু মেয়ে মাঝেমধ্যেই না খেয়ে থাকে! তার অন্তত কখনো ক্ষুধার্ত ঘুমাতে হয় নি। তার দুঃখের সময় পাশে দাঁড়ানোর জন্য, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য, তাকে ভালোবাসার জন্যও মানুষ আছে। অথচ মেয়েটার কিছু নেই। কএউ নেই। মানুষ কত আজব, তাদের মনে হয় এই পৃথিবীতে তারাই কেবল দুঃখী। অথচ তার মতো বাঁচাটা যে কত মানুষের স্বপ্ন তা ভাবে না।
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ৩৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
cloud café -তে বসে আছে মহুয়া ও মৃণা। তাদের ছাড়া সবাই লেইট। তাদের গল্পের মাঝখানে জাহান আসে। তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় জাহান। সানগ্লাস খুলে বসে, “আসতে দেরি হয়ে গেল না’কি?”
মৃণা বলে, “না না ভাইয়া। আমরাও একটু আগে এসেছি।”
কিন্তু মহুয়া তো মহুয়া। সে কী সোজা উওর কীভাবে দেয় তা জানে? একদম না। সে বলে, “তোমাকে কেউ আমন্ত্রণ করে নাই যে তোমার অপেক্ষা করব। এভাবে বলছ যেন সবাই কান্নাকাটি শুরু করেছে তুমি না আসায়।”
জাহান চেয়ার টেনে মহুয়ার পাশে বসে, “তোমার মুখে সোজা কথা আসে না?”
“সামনে দুইটা খালি চেয়ার দেখছ না? এখানে এসে ঘেঁষে বসছো কেন?”
“ছিঃ জান তুমি চাও আমি দুইজন বিবাহিত জুটির মাঝখানে বসে তাদের আলাদা করব? এই পাপ আমার দ্বারা হবে না।”
মৃণা তার কথায় হাসে। মহুয়া চোখ ঘুরায়। দরজা দিয়ে কারও ঢোকার শব্দ পেলে তারা ভাবে মোহ এসেছে। তিনজনে একসাথে তাকায়। দেখে তিসান এসেছে। তাকে দেখেই মহুয়া জাহানের কাঁধে ধাক্কা দেয়, “তুমি ওকে ডেকেছ কোন দুঃখে?”
“আমি ডাকবো কোন দুঃখে? আমি ডাকিনি।”
মৃণা তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ডাকলে কী হয়েছে? এমন রিয়েক্ট করছিস কেন?”
“এখানে থাকা যাবে না। এই হনুমান চেঁকামেঁকা থাকুক নিজের বন্ধুর সাথে। আমরা মোহ আর দুলুভাইয়ের সাথে অন্য জায়গায় বসবো।”
“কেন?”
জাহান আবারও শুধায়, “আরে আমি ডাকিনি তো।”
“তো তিসান টিকটিক্কা কি তাল গাছ থেকেই টপকেছে?”
এতক্ষণে তিসান তাদের টেবিলের সামনে এসে পড়ে, “তোরা এখানে?”
“তুই এখানে?” জাহান একই প্রশ্ন করল।
“একটা ব্রান্ডের ফটোস্যুটের জন্য কথা বলতে এসেছি এজেন্টের সাথে।”
মহুয়া তখনই দাঁড়িয়ে পড়ে, “আমরা লাঞ্চ করতে এসেছিলাম। করা শেষ, এখন চলে যাচ্ছি।”
“একটু বসো সিসফ্রেন্ড। আমার কন্টেক্ট সাইন করতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সব কথা শেষ। শুধু সাইন করবো আজ।”
“না না এখন যেতেই হবে।” বলে সে মৃণাকে উঠায়। মৃণা তো তাদের কোনো কথাই বুঝতে পাড়ে না। তারা এমন আজব ব্যবহার করছে কেন?
তখন মোহের কন্ঠ ভেসে আসে, “তোরা কি করছিস?”
মোহের কন্ঠ শুনে পিছনে ফিরে তাকায় তাসিন।
আর মহুয়া সাথে সাথে বসে পড়ে। টেনে বসায় মৃণাকেও। মৃণা জিজ্ঞেস করে, “তোরা এত অস্থির হচ্ছিলি কেন?” “বাদ দে। এমনিতেও যা হবার হয়েই গেছে।”
তিসান দেখে মোহ আজ সেই কমলা কামিজ পরে আছে যেটাতে সে তাকে লাইব্রেরীতে দেখে পাগল হয়েছিল। সেদিনই সে ভেবে নিয়েছিল এই মেয়ের সাথেই সে জীবন কাটাবে। অথচ প্রেমটাও প্রকাশ করার ভাগ্য হলো না।
মোহ তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। জাহানকে ও তিসানকে সালাম দিলো। তিসান জোর করে হাসার চেষ্টা করল, “আমি এখানে একটু কাজে এসেছি তো। তোমরা বসো।”
তিসান যেয়ে অন্য টেবিলে বসে পড়ল।
জাহান উঠে সমুদ্রের সাথে হ্যান্ডশেক করল, “হ্যালো ভাইয়া।”
“সাচ আ হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান।” মহুয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার শালীসাহেবার বয়ফ্রেন্ড না’কি?”
“এমন কিছু না দুলুভাই। আর মোটেও আপনার থেকে বেশি হ্যান্ডসাম না।”
“মোহ তো সেদিন বলল ভার্সিটির সবচেয়ে পপুলার ছেলে তোমাকে ভালোবাসে। আমি মোটেও এত পপুলার ছিলাম না।”
মোহের ভেতর থেকে বেশি বাহিরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলো। সে উৎসুকভাব নিয়ে জাহানকে জিজ্ঞেস করে, “জিজু আমি কি গার্ডেন থেকে কয়টা ফুল নিতে পাড়ব।”
“আদনান আংকেল কাওকে ধরতে তো দেয় না। আমাদের ছাড়া। তুমি যেহেতু আমার বোন সেহেতু তোমার জন্য সব মাফ।”
মোহ তো দৌড়ে গেল গার্ডেনে। সমুদ্র চেয়ারে বসে হাসল, “শালীসাহেবারা বুঝলে তোমাদের বান্ধবী নিজেকে এত ম্যাচুউর প্রেজেন্ট করে। ভেতর থেকে একটা বাচ্চা।”
সমুদ্র হেসে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। আচমকা তার চোখ তিসানের দিকে যেয়ে থামল। অপরপাশে দুই টেবিল বাদেই বসা সে। তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। সমুদ্র বাহিরে তাকাল। ছেলেটা কী মোহকে দেখছে?
মোহ যখন একগাদা রং-বেরঙের ফুল নিয়ে এলো তখনও ছেলেটার দৃষ্টি তার দিকেই আটকে ছিলো। কিন্তু তার দৃষ্টিতে কোনো প্রকার লালসা ছিলো না। দৃষ্টিটা পছন্দের। তার মনে পড়ে মোহ এই ছেলের সাথে একটু আগে কথাও বলেছে।
মোহ ফুল এনে সবার আগে মৃণার কৃষ্ণকেশ সাজাল ফুল দিয়ে। তারপর মহুয়ার ছোট চুল মুড়িয়ে বেঁধে তার চুলেও ফুল লাগিয়ে দিলো। তা দেখে জাহানের চোখ বড় হয় যায়, “তোমার না ফুল পছন্দ না। আমি দুইবার চুলে ফুল লাগিয়ে দিয়েছিলাম আর তুমি খুলে ফেলেছিলে।”
“তোমাকে কী আমি আমার মোহের মতো ভালোবাসি না’কি?” বলে সে পিছন থেকে মোহকে টেনে তার গালে টুপ করে চুমু দিলো।
এতে জাহানের মুখ বিগড়ে গেল। জ্বললো তার বুকে। তার মুখ দেখে মোহ হাসে। নিজের খোলা ভুল বেণি করতে করতে যেয়ে বসলো চেয়ারে। বলল, “জিজু যদি আপনাদের বিয়েও হয় তারপরও ও আমাদেরই কিন্তু বেশি ভালোবাসবে।”
জাহান নিরাশার শ্বাস ফেলল। হতাশাজনক কন্ঠে বলল, “দুলাভাই যেহেতু দুইটা সতীন সামলাতে পাড়ছে। আমিও পাড়বো।”
সবাই হেসে দিলো। এতক্ষণে মোহেরও চুলে ফুল লাগানোর কাজ শেষ। মৃণা বলল, “তোকে তো একদম ফুলের রাজ্যের রাজকুমারী লাগছে।”
এমন সময় এক অজানা ব্যক্তি এসে হাজির হলো টেবিলের সামনে। মোহকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এক্সকিউজ মি ম্যাম, আপনি কী মডেলিং এর জন্য ইন্টারেস্টেড? আমরা তাহলে… ”
“না।” সরাসরি উওর দিলো মোহ।
লোকটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল, “তবুও আমাদের কার্ড রাখতে পাড়েন। অনেক ভালো একটা প্রজেক্ট আছে। মিস্টার তিসানও আমাদের সাথে কাজ করে। একটা মেকাপ ব্রান্ডের কাপল ফটোশ্যুট হবে। অনেক ভালো সুযোগ। আপনাদের একসাথে অনেক মানাবেও। আপনি যদি ভাবতেন…” মোহ বিরক্তি নিয়ে আবারও তার কথা কাটে, “আমি মানা করেছি। আমি ম্যারেড। আমার হাসবেন্ড মাইন্ড করবে।”
সমুদ্র সাথে সাথে বলে, “আমি মোটেও মাইন্ড করব না।”
মোহ সরু চোখে তাকাল সমুদ্রের দিকে। তার পা’য়ে লাথি দিলো একটা। সাথে সাথে সমুদ্র দম আটকে বলল, “আমি মাইন্ড করি। বড্ড মাইন্ড করি।”
অন্যকেউ তার অবস্থা দেখে না হাসলেও মহুয়া হো হো করে হেসে দিলো।
লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে হাসল, “ওহ আপনার ওয়াইফ? আপনাদেরও একসাথে অনেক সুন্দর মানায়।”
একথাটা মহুয়ার পছন্দ হলো না। সে বলল, “আপনাদেরও মানে? আমার দুলুভাইয়ের সাথেই কেবল আমাদের মোহকে মানায়। বুঝেছেন? এবার দফা হোন।”
লোকটা যাবার পর তারা খাবার অর্ডার দিলো। খাবার খেল, গল্প করল, ছবি তুলল। মুরাদও দেখতে চেয়েছিল মোহের স্বামীকে। তাই ছবি তুলেই পাঠাল মুরাদকে। তারপর সমুদ্র ও মোহকে জোর করে নিয়ে গেল বাগানে। তাদের আলাদা ছবি তুলে দিবে। তাদের যেতেই টেবিল একদম শান্ত হয়ে গেল। মহুয়া ও সমুদ্রই বেশি কথা বলছিল এখানে। তাদের যেতেই তিসান এসে যুক্ত হয় সেখানে। বাহানাটা যদিও জাহানের সাথে কথা বলা ছিলো। কিন্তু আসল কারণ ছিলো উঁকি মেরে দেখা মোহকে। সে জানে এই কাজটা কতটা অনুচিত, কিন্তু তার মনটা যে অবাধ্য।
এমন সময় মৃণার ফোন বেজে উঠে। মুরাদের কল। সে কল ধরে, “আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। মহুয়া কোথায়? কল দিচ্ছিলাম, ধরছে না।”
“মোহ আর ভাইয়ার ছবি তুলছে বাহিরে।
” মোহের সাথে যে লোক সে কী ওর স্বামী?”
“জ্বি।”
“তার নাম সমুদ্র?”
“আপনাকে সমুদ্র ভাইয়াকে চিনেন মুরাদ ভাই?”
তার কথাটা আকর্ষণ করল জাহান ও তিসানকে।
ফোনের ওপাশ থেকে মুরাদের কর্কশ গলা ভেসে আসে, “মোহের মা বাবা কী না খোঁজ নিয়েই বিয়ে দিয়ে দিলো? বিয়ের আগে খোঁজ নেয় নি?”
তার কথায় মৃণার মুখে চিন্তার ছাপ বিদ্যমান, “এভাবে বলছেন কেন মুরাদভাই? সমুদ্র ভাইয়াকে তো ভালোই মনে হলো।”
“সে নিঃসন্দেহে অনেক ভালো। অনেক বেশি। আমরা তার জুনিয়র ছিলাম। উনার মতো ভালো মানুষ আর হয় না। উনার হৃদয় স্বর্ণের মতো একদম।”
“উনি এত ভালো হলে আপনি তার ছবি দেখে রেগে গেছেন কেন?”
“কারণ ও আমার বোনের মতো। আমি ওর কেয়ার করি। তোর মনে আছে সাহিদ তোকে আমাদের সিনিয়র এক ভাইয়ের কথা বলেছিল। সে পাগলের মতো তার প্রেমিকাকে ভালোবাসতো। এমনকি তার দেওয়া ধোঁকার পরও তার ব্যাপারে খারাপ কোনো কথা সহ্য করতে পাড়ে না। সে সমুদ্র ভাই। আচ্ছা মোহ আর সমুদ্র ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক কেমন জানিস?”
মৃণা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে। তার বুকের ভেতর আকুম-বাকুম করছে। তার তো অভিজ্ঞতা আছে ভালোবাসার মানুষের মনে অন্য মানুষ থাকলে তার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হয়। সে আনমনে বলে দেয়, “সমুদ্র ভাইয়া এখনো মোহকে সম্পূর্ণ মেনে নিতে পাড়ে নি। শুরুতেই বলে দিয়েছিল ভালোবাসতে পাড়বে না। কিন্তু মোহের প্রতি তার ব্যবহার ভালো।”
“হাসিখুশি আছে?”
“আছে।”
“আচ্ছা। ওর দিকে খেয়াল রাখবি। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।”
“আচ্ছা।”
মৃণা আনমনে ফোনটা রেখে দেয়। কিন্তু তার দৃষ্টি আটকানো বাহিরের দিকেই। তখন তিসানের কন্ঠ ভেসে আসে, “মোহের বিবাহিত জীবনে কোনো সমস্যা চলছে?”
তিসানের কন্ঠ শুনে মৃণা তার দিকে তাকায়। তার কন্ঠে একরকম কৌতূহল, আনন্দ। যার কারণ বুঝল না মৃণা। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “এমন কিছু না। অন্য বিষয়ে কথা বলছিলাম।”
সে ব্যাগ নিয়ে উঠে গেল। বাহিরে যেয়ে মহুয়া ও মোহকে জানাল তার বাসায় যেতে হবে। আগামীকালের কাজ আছে। মহুয়া বলল, “তুই কিন্তু নিজের কথা রাখছিস না। তোর প্রতি শুক্র,শনিবার আমার বাসায় থাকার কথা।”
“আগামীকাল রাত তো আমরা তিনজন তোর বাসায় থাকবো। এখন একটু কাজে যেতে হবে।”
মোহ জিজ্ঞেস করে, “তোর কি কিছু নিয়ে মন খারাপ দোস্ত?”
মৃণা তার দিকে তাকায় নরম দৃষ্টিতে। তারপর শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা এমন কান্ডের কারণ মোহ, মহুয়া কেউ বুঝল না। একে অপরের দিকে তাকাল অবাক হয়ে। মৃণা তাদের ছেড়ে বলল, “কালকে কথা হবে।।” বলে সে চলে গেল। সমুদ্রের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হলো না তার। তাকে কিছু না বলে চলে গেল। মোহ আর মহুয়ার তার ব্যবহার ভীষণ আজব লাগলো। মোহও কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে এলো। একসাপ্তাহ পর তার মা বাবার কাছে এসেছে। তাদের সাথেও সময় কাটাতে হবে।
তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো তিসান। তা খেয়াল করে জাহান। সে তিসানকে ওয়ার্নিং দেয়, “শুন, নিজের চোখ সামলে রাখ। ও বিবাহিত।”
“মৃণার কথা শুনিস নি?”
“সাট আপ তিসান। তুই তোর কানে শুধু এতটুকু কথা ঢুকিয়ে রাখ ও এখন বিবাহিত। ওর দিকে তাকানোও তোর জন্য পাপ।”
তিসান তার কথার পাত্তা দিলো কি-না বুঝা গেল না। কিন্তু চুপ করে গেল। মহুয়াও এলো কিছুক্ষণের মাঝে। তবে তারা কেউ কথাটা তুলে না। মহুয়াও যেতে চাইলে জাহান জানায় সে তাকে দিয়ে আসবে বাসায়। তারপর সে ও তিসান তার বাড়িতে যাবে আড্ডা দিতে।
গাড়ি পার্ক করতে হয় রাস্তার সামনে। জাহান গাড়ি আনতে এগিয়ে গেলে তিসান ও মহুয়া ক্যাফের সামনে দাঁড়ায়। মহুয়া তিসানকে প্রশ্ন করে, “তুমি ওকে ব্রোফ্রেন্ড?”
“আমার কি হবে?”
“মানে আজ মোহ আর দুলুভাইকে একসাথে দেখে।”
“এজন্যই তুমি অন্যজায়গায় উঠে যেতে চেয়েছিলে? ডোন্ট ওয়ারি। আমি ঠিক আছি।”
তার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মহুয়া। ভাবে তিসান মোহ থেকে মুভ অন করে ফেলেছে। মোহকে নিয়ে তার মনে আর কোনো অনুভূতি নেই।
তারপর সে আবার তাকায় তিসানের দিকে। তাদের ভালো মুডে দেখে দ্বিধা নিয়ে হলেও প্রশ্ন করে, “আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি ব্রোফ্রেন্ড? সত্যি উওর দিতে হবে।”
“অফকোর্স। জিজ্ঞেস করো।”
মহুয়া বা’পাশে ঝুঁকে খুবই গোপনপূর্ণ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, “জাহান আর শায়ানের মধ্যে ঠিক কী হয়েছে? আর রশ্মির সাথে এর কী সম্পর্ক?”
প্রশ্নটা মহুয়ার কাছে মোটেও আশা করে নি তিসান। সে উওর দেবার পরিবর্তে উলটো জিগাস্যুক দৃষ্টিতে তাকায় মহুয়ার দিকে।
মহুয়া বলে, “আরে জাহানকে জিজ্ঞেস করলে বলবে না। আরও মুখ শক্ত করে রাখবে। মনে হলো তোমাকে জিজ্ঞেস করাটাই উচিত হবে। এছাড়া গ্রামে থাকতে শায়ান একবার বলেছিল জাহান মেয়েদের সম্মান আসলে করে না। অনেক ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল তাকে। এর মানে কী?”
তিসান কিছু একটা ভাবল বলার পূর্বে। মহুয়া যেহেতু তার ও জাহানের বন্ধুত্ব ঠিক করতে পেড়েছে। হয়তো শায়ানের সাথেও সব ঠিক করতে পাড়বে। তাই সে বলল, “সময় লাগবে এসব বলতে গেলে। জাহান তো কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে।”
মহুয়ার কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো। তাই সে জাহানকে কল দিয়ে বলল তার খুব করে পেস্ট্রি খেতে মন চাইছে। উলটো পথের একটি দোকানের নামও দিলো। জাহান তো তার ইচ্ছা পূরণ করতে পেয়ে আরও খুশি। সাথে সাথেই রাজি হলো। মহুয়াও তিসানের সাথে যেয়ে বসলো গার্ডেনের দোলনায়। তাদের গল্প শোনার জন্য।
“রশ্মি ও জাহানের মা’য়ের আগের থেকেও বান্ধবী ছিলো। সে হিসেবে তারা জন্ম থেকেই একসাথে। নার্সারিতে জাহান ও রশ্মির সাথে বন্ধুত্ব হয় আমার। আর সর্বশেষে আমাদের বন্ধুত্বে যুক্ত হয় শায়ান। তখন জাহানের বাবা ইভান এয়ারলাইনসের ব্যবসায় ক্ষতিতে যাচ্ছিলেন। শুরুর দিকে। তখন শায়ানের দাদা তার কোম্পানিতে ইনভেস্ট করে। সে সুবাদে আমাদের দেখা হয়। আমাদের মধ্যে রশ্মি সবার আগে ওর সাথে কথা বলে। শায়ান ওর দাদার সাথে আসলে রশ্মিই ওর সাথে সেধে যেয়ে কথা বলতো। শায়ান প্রথম কারো সাথে স্বাভাবিক হয়। এই দেখে ওর দাদা আমাদের স্কুলেই শায়ানের ভর্তি করায়। তারপর শায়ানও আমাদের ভালো বন্ধুত্বও হয়।” এই পর্যায়ে এসে তিসান তাকায় মহুয়ার দিকে, “তুমি তো জানো জাহানের মা মারা গেছে জাহানের বারো বছর বয়স থাকতে।”
মহুয়া মাথা নাড়ায়। সে জানে।
“তুমি কী এটা জানো যে শায়ানের মা নেই?”
প্রশ্নটা শুনে মহুয়া থতমত খেয়ে যায়। সে জানতো না। উল্টো গতকাল শায়ানকে তার মা’য়ের খবর জিজ্ঞেস করছিল। ভাবতেই তার খারাপ লাগল।
“আমি জানতাম না সে-ও মারা গেছে।” মহুয়া ছোট কন্ঠে বলল।
“মারা যায় নি। ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ছয় বছর বয়সে।”
কথাটা মহুয়ার হজম হলো না। সে অবিশ্বাস্য সুরে বলল, “কোনো মা তার বাচ্চাকে কীভাবে ছেড়ে যেতে পাড়ে?”
“ঠিক কি হয়েছিল আমি জানি না। কিন্তু শায়ান ছোটবেলায় অনেক উদাসীন ও চুপচাপ থাকতো। ওর দাদা-দাদীই ওকে পেলেছে। ওর বাবাকে আমরা হয়তো এক দুইবার দেখেছি। ওর বাবার সাথেও সম্পর্ক ভালো ছিলো না। আমরা বেশিরভাগ জাহানদের বাসাতেই খেলতে যেতাম। জাহানের মা’য়ের জীবন ছিলো তার বাচ্চাদের মধ্যে। শায়ান প্রায়ই তাকিয়ে থাকতো যখন সে জাহান ও জিনিকে আদর করতো। আন্টি শায়ানদের বাসার অবস্থাও জানতো তাই তো ওকেও আদর করতো আলাদাভাবে। কিন্তু শায়ান দূরে থাকতো। তারপর আন্টিও এক্সিডেন্টে মারা যায়। আমরা সবাই-ই জাহানের সাথে থাকি। বিশেষ করে রশ্মি। ও জাহানকে এখন থেকে না। ছোট থেকে ভালোবাসে। আর শায়ান রশ্মির জন্য ছোট থেকে প্রেটেক্টিভ ছিলো। রশ্মি জাহানকে এরপর সব সময় দিলেও শায়ান কিছু বলতো না। ও নিজেও জাহানের সাথে থাকতো। তারপর সময় যায়। আমরা আরও বড় হই। আর শায়ানের আচরণও পরিবর্তন হয়।”
“রশ্মির জন্য? ”
এর উওর খানিকটা ভেবে দেয় তিসান, “সম্ভবত হ্যাঁ আবার না। তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিতে দেখলে আমার মনে হয় শায়ান ছোট থেকেই জাহানের সাথে হিংসা করতো। জাহানের কাছে সে সব ছিলো যা শায়ানের ছিলো না। যা সে চাইতো। এক পরিবার। কিন্তু যখন জাহানের মা চলে গেল সে ভেবেছিল ওর জীবনটাও হয়তো এখন শায়ানের মতো হয়ে যাবে। একাকী। তাই জাহানের প্রতি সে সময়ে বিশেষ নরম হয়ে যায়। কিন্তু কিছুমাসে দেখে এমন কিছুই না। জাহানের সাথে তার বন্ধুরা, তার বোন, তার বাবা এমনকি তার বাবা মা’য়ের সব বন্ধুবান্ধব সবাই ওকে অনেক ভালোবাসে। তখন ও বুঝল জাহানের জীবন ওর মতো না।”
“কিন্তু শায়ানের পরিবার তো আরও বড় তাই না?”
তিসান এই কথায় কতক্ষণ চুপ থাকে। সে বলে, “ছোট থাকতে ওর জন্য কতগুলো এট্যাক হয়েছিল। ওর মা যাবার পর। ওর চাচাদের মধ্যে কেউ-ই করেছিল।”
“কি ফালতু কথা বলছ? তাদের আমি দেখেছি। ভালোই লোক। তারা কেন ওর উপর আক্রমণ করবে?”
“কারণ অর্ধেক সম্পত্তিই হচ্ছে শারাফ আংকেলের। আর সে তার ছেলের কোনো খবরই রাখেন না। তারা ভেবেছে শায়ান না থাকলে সব তাদের হবে। এরপরই তার দাদা দাদী এগিয়ে আসেন। আর মারা যাওয়ার পূর্বে শায়ানের দাদা তার ইউলে তার নিজস্ব সম্পত্তি সবার মধ্যে সমান ভাগ করলেও লিখে যান তার মেঝো নাতি শায়ানের কিছু হলে তার ব্যবসাসহ সকল সম্পত্তি অনাথ আশ্রমে চলে যাবে। কেউ কিছু পাবে না। এরপর সব এট্যাক বন্ধ হয়।”
মহুয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সম্পত্তির জন্য মানুষ একটা বাচ্চার ক্ষতি কীভাবে করতে পাড়ে? মানুষ কী এতটাই নিচু মনের হয়?”
তিসান আবার বলে, “এবার তোমাকে বলি রশ্মি কথা। রশ্মির দেখতে অনেক সুন্দর। ওকে একসময় আমিও পছন্দ করতাম। সবসময় একসাথে থাকলে একটা আকর্ষণ হয়েই যায়। কিন্তু ওর দৃষ্টি ছিলো কেবল জাহানের দিকে। জাহান ওর দুনিয়া, ওর সব ছিলো। কিন্তু জাহানই কেবল ওকে সে চোখে কখনো দেখেনি। ইনফেক্ট ও কোনো মেয়ের দিকেই ধ্যান দেয় নি। রশ্মিই একমাত্র ওর মেয়ে বন্ধু ছিলো। এমন না ও রশ্মির প্রেমকে উসকানি দিতো। ও প্রথম থেকেই মানা করে এসেছে। সবসময় বলতো, কেবল একজনকেই ভালোবাসবে যা রশ্মি ছিলো না। রশ্মিকে ও দেখতো জিনির মতো। কখনো সে ফিলিংস আসেই নি। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না? শায়ান কেন বলেছিল জাহান মেয়েদের সম্মান করতে জানে না?”
মহুয়া মাথা নাড়ায়।
তিসান জাহান, “বিষয়টা কমপ্লিকেটেড। কীভাবে গুছাব বুঝতে পাড়ছি না। সেদিন রশ্মির ঊনিশতম জন্মদিন ছিলো। রশ্মির বড়ভাই পার্টি রেখেছিল। সেখানে সবাই-ই ছিলো। আমরা সবাই পার্টি করছিলাম। রশ্মি জাহানকে নিজের রুমে নিয়ে যায় একটা উপহার দেখাবে বলে। জাহান একা যেতে চায় না কিন্তু রশ্মির জেদের বসে যায়।”
এরপর চুপ হয়ে যায় তিসান। মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে সামনের ঘটনা জানার জন্য। কিন্তু তিসান মুখ খুলে না।
মহুয়া বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তারপর?”
“হঠাৎ রশ্মির রুম থেকে শব্দ আসে। আমরা সবাই সেদিকে গেলে দেখতে পাই…রশ্মি মেঝেতে পড়ে আছে তার পাশেই শপিজ ভাঙা। তার গালে লাল দাগ, তার… শার্ট খোলা। আমার মাথা তো তখন ব্লাঙ্ক হয়ে গিয়েছিল। কি হচ্ছে বুঝে উঠছিলাম না। শায়ান ও রশ্মির ভাই রাজ দৌড়ে যায় রশ্মির কাছে। রশ্মির ভাই তো এসে ওর কলার ধরে নেয়। ভাবে ও ভুল কিছু করেছে কিন্তু… ”
“জাহান এমন করতেই পাড়ে না। অসম্ভব।”
তিসান তার কন্ঠে এমন দৃঢ় বিশ্বাস দেখে প্রথমে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর হাসল। আবারও বলতে শুরু করে, “কিন্তু জাহান এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দেয়। তারপর রশ্মির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি এখন কিছু বলছ না কেন? এতক্ষণ তো আমায় ভালোবাসো বলে আমার উপর চড়ছিলে। এখন বলো তুমি কীভাবে নিজের শরীর দেখিয়ে আমাকে …মুখে আনতেও ঘৃণা লাগছে। শরীর বিলিয়ে দিয়ে ভালোবাসা কেনা যায় না রশ্মি।’
তখন রশ্মি উঠে এসে আবার তাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। অস্থির হয়ে বলে, ‘তুমি শুধু আমার। আর আমারই থাকবে। আমি তো আমার জন্ম থেকেই কেবল তোমার। তোমার আমাকে ভালোবাসো কেবল অনুভব করতে পাড়ো না। এই’যে দেখো তুমি আমাকে ছাড়া কারো সাথে কথাও বলো না।’
তখন জাহান তাকে ঠেলে সরিয়ে উওর দেয়, ‘কারণ আমি তোমাকে আদর করতাম। জিনির মতো। তুমি কখনোই আমার কাছে অন্যরকম কিছু মনে করি নি। আর এখন… এখন তো তুমি আমার কিছু না। তোমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের চেহেরাও আমি দেখতে চাই না। তোমার এমন জঘন্য কাজকে ভালোবাসার নামও দিবে না।’
একথা শুনে শায়ান তেড়ে এসে ঘুষি মারে জাহানকে। জাহান তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে-ও উল্টো আঘাত করে। তাদের মাঝখানে মারামারি হয়। আমরা যেয়ে থামাই তাদের। শায়ানের ক্ষোভ উঠে যায় রশ্মির ব্যাপারে একথা বলায়। তাও এতগুলো মানুষের সামনে। জাহান সেখানেই তাদের বন্ধুত্ব ভেঙে দেয়। আর তাদের বাড়ি থেকে চলে আসে। আসার সময় রশ্মি বারবার চিৎকার করে বলে যে ও জাহানকে ভালোবাসে বলে নিজের সম্মানও বিসর্জন দিতে রাজি। জাহান তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। রশ্মি প্রেশার সহ্য করতে না পেড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপরও বিভিন্নভাবে জাহানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। জাহানের বাবাও তার সাথে কথা বলে কিন্তু জাহান এতই রেগে ছিলো যে আমার বাড়িতে এসে কতদিন ছিলো। পার্টির পড়ে আশেপাশে রশ্মির বদনাম বাড়ে। না পেড়ে ওর বাবা মা ওকে আর ওর ভাইকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে শায়ানও ঘৃণা করে জাহানকে। আর রশ্মিকে তার সব খুশি দিতে চায়। ব্যাস, এখানেই বন্ধুত্বের ইতি ঘটে।”
মহুয়া তার কথা ধ্যানমগ্ন হয়ে শুনে। বলে, “আর রশ্মির খুশি জাহান। এজন্য যেভাবেই হোক জাহানকে রশ্মিকে দিতে চায়। কিন্তু তাহলে ওর খুশির কী?” মহুয়া তাকায় তিসানের দিকে, “ছেলে মেয়ে দুইজনের সম্মান ও কনসেন্ট দুটোই আছে। এখানে যদি ঘটনাটা উলটো হতো তাহলে তো ছেলেকে ধ’র্ষণ করার প্রচেষ্টার অভিযোগে জেলে পাঠানো হতো।”
“সত্যি একটা কথা বলি?”
“কী নিয়ে?”
“তোমার আর তোমার বান্ধবীদের বন্ধুত্ব দেখলে মাঝেমধ্যে হিংসা লাগে। এই দুইমাসে তোমাদের কখনো ঝগড়া করতে দেখিনি। তোমরা সবসময়ই একে অপরের সাথে থাকো। আমিও এমন বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম। ছিলোও…” বলে এক মুহূর্তের জন্য থামে তিসান। আবার বলে, “হয়তো কখনো সে বন্ধুত্ব ছিলোই না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা একে অপরের কেবল প্রয়োজন ছিলাম। কেবল আমার সাথে এখনো সবার সাথে যোগাযোগ আছে কিন্তু শায়ান আর রশ্মির সাথে আমার বন্ধুত্বটা আর অনুভব হয় না। কেবল বিচ্ছিন্ন মনে হয়।”
মহুয়ার ঠোঁটে আপনা-আপনি হাসি এঁকে আসে মৃণা ও মোহের কথা শুন। সে আকশের দিকে তাকিয়ে বলে, “কারণ আমরা ভিন্ন। আমরা তা জানি, তা মানি। আমরা একে অপরের পাশে থাকলেও কখনো অন্যের জীবনে জোর করে দখল করার চেষ্টা করি না। সবার নিজস্ব অনুভূতি আছে। কষ্টের সময় পাশে থাকি, খুশির সময় তার আনন্দের মাঝে থাকি আর প্রয়োজনের সময় লড়াই করি একে অপরের জন্য। কিন্তু তাদের অনুভূতিতে নিজের সম্পত্তি ভেবে তা ঘুরানোর চেষ্টা করি না। উপদেশ দেই, নিজের মন্তব্য প্রকাশ করি কিন্তু তার জীবন তার নিজের এটাও জানি। আকাশটা দেখছ? কী সুন্দর আকাশ তাই না? কিন্তু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত রঙ বদলায়। সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যোস্ত, আবার রাতের আঁধার হওয়া পর্যন্ত কতবার রঙ পালটায়। আমরা তিনজনও এই আকাশের তিন রূপের মতো ভিন্ন। আকাশের রঙ পালটায়, রূপ বদলায় কিন্তু মেঘেরা অলংকারের ন্যায় এই আসমানের সৌন্দর্য বিদ্যমান রাখে। সে মেঘেদের মতো আমাদের বন্ধুত্ব আমাদের ব্যক্তিত্ব বদলায় না, বরং সৌন্দর্য বাড়ায়।”
.
.
মোহ ও সমুদ্র বাসায় এসে দেখে তার বোন মিতা ও আহিনও এসেছে। তাদের দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করা মোহ নিভে গেল। তারা আজ পর্যন্ত নিজের ভুলের জন্য একবারও ক্ষমাও চায় নি। যেন তাদের কোনো ভুলই ছিলো না। তাহলে সে ক্ষমা করবে কীভাবে? তবুও ভদ্রতার খাতিরে আহিনের সাথে কথা বলল। তারপর ফ্রেশ হয়ে সে গেল রান্নাঘরে নিজের মা’য়ের কাছে। মা পাকোড়া ভাজছিল, নুডুলস রান্না করছিল। মোহ তার সাহায্য করল। চা-ও বানিয়ে দিলো। তারপর বেরিয়ে দেখল সমুদ্র, আহিন, মিতা আড্ডা দিচ্ছে, টিভি দেখছে। এমনকি তার বাবাও এসে বসেছে তাদের সাথে। মা তাদের খাবারগুলো দিচ্ছে। মিতার পছন্দ মতো তার প্লেটে আলাদাভাবে চিলি সসও দিয়েছে। যেখানে তার মা বাবা দেড়মাস আগে তার চেহেরাও দেখতে চাইতো না সেখানে সেখানে এখন মনে হচ্ছে সবই স্বাভাবিক। তার মনে হলো সবাই কত জলদি মুভ অন করে। কত সহজে ক্ষমা করতে জানে। তারই তাহলে কোনো সমস্যা আছে? একবার কারো উপর তার মন উঠে গেলে সে তাকে ক্ষমা করতে পাড়ে না কেন?
মোহ আর সেদিকে গেল না। গেল রুমে। তার জিনিসপত্র গুছাতে হবে। আগামী পনেরোদিন সে এখানে থাকবে। তাই তার বই আর কসমেটিক আবার গুছিয়ে রাখছে। টেবিলে বই রাখার সময় সমুদ্রের রাখা ওয়ালেট নিচে পড়ে গেল। যা মোহ উঠাতে যেয়ে তার চোখে পড়ে ওয়ালেটের ভেতরে থাকা ছবি। সে ওয়ালেটটা নিয়ে দাঁড়ায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের সাথে একটা মেয়ের ছবি দেখে। তারা এক ইটের দেয়ালের উপর বসা। পিছনে মেঘে খেলা আসমানী আকাশ। মেয়েটির হাতে একটি কাশফুলের লাঠি। চিকন, শ্যামলা, ঘন কোঁকড়া চুল, মায়াবী মুখশ্রী, ঠোঁটের নিচে আকর্ষণীয় এক তিল।
মেয়েটি নিশ্চয়ই জবা। সমুদ্রের জবাফুল। তার সব সহ্য হলো কিন্তু সহ্য হলো না সমুদ্রের মোহেভরা দৃষ্টি। সমুদ্র তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন সারা পৃথিবীর সব সৌন্দর্য সে মেয়ের মাঝে অবস্থির। আচ্ছা সমুদ্র কী কখনো তার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়েছে? কখনোই না। এক মুহূর্তের জন্যও না।
মোহের বুকের ভেতর এমভাবে কামড় দিলো যেন মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র পশু তার কলিজা কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সে নিজের বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে পিছিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। অজান্তেই তার চোখের ঝাপসা হয়ে এলো। তবুও সে চোখ সরাল না। ছবিটির উপর দু’ফোঁটা বিন্দু জল পড়লো।
চলবে…