মেঘের খামে পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
5

মেঘের খামে…
পর্ব ৩৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

একথা শুনে মহুয়া দেবে যায়। জাহান যদি তার বিয়ের কথা শুনে তাহলে নিশ্চিত এটাও প্রশ্ন করবে যে শায়ানের বাড়ির লোকেরা তাকে চিনে কীভাবে? এক ঢোক গিলে সে। এই খবর জাহানের কানে গেল কীভাবে?

সে আমতা-আমতা করে বলে, “বাসায় ফুফা ফুপিরা আছে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি নিচে আসো, নাহলে আমি বাসায় আসছি।”
মহুয়া চোখ বন্ধ করে মনে মনে কতগুলো বকা দিলো প্রথমে জাহানকে, তারপর নিজেকে। বলল, “আচ্ছা আসছি।”
মহুয়া আয়নায় নিজেকে দেখে ভাবে একবার চেঞ্জ করে যাবে। আবার ফোনের দিকে তাকায়। জাহান আর আসারও দিন পায় নি। সে বিরক্তিতে নিজেই একটা চিৎকার করে শান্ত হবার চেষ্টা করল। তারপর দরজা খুলে দিলো উঁকি দিলো বাহিরে। সিঁড়ির কাছেও যেয়ে দেখল কেউ নেই।
সে আবার রুমে ঢুকে প্রথমে রুমের চাবি নিলো। লাইট বন্ধ করে দরজা লক করে চুপি চুপি বের হলো বাড়ি থেকে। সামনের দরজাতে দারোয়ান থাকে বলে পিছনের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে গেল গলির সামনে। যেয়ে দেখে একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে জাহান বাইকের উপর বসে আছে। তার দিকে হঠাৎ তাকাতেই মহুয়া থেমে যায়। আজ, এই প্রথম তার ভয় লাগছে। তার ভয় লাগছে ভেবে সে নিজেই অবাক হয়। সে তো কাওকে ভয় পায় না। বিশেষ করে জাহানকে তো মোটেও না। তাহলে আজ এমন ভয় ভয় কেন লাগছে তার?

সে আস্তে-ধীরে হেঁটে জাহানের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। জাহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে নিচ থেমে উপর পর্যন্ত দেখে তাকে। ভ্রু কপালে তুলে বলে, “বাহ ছেলেপক্ষ দেখতে আসায় এত সুন্দর সাজ দিয়েছ? ওই ছেলের ফেভারিট কালার পরেছ। আর আমি সেদিন চারঘন্টা ধরে তোমাকে এত রিকুয়েষ্ট করলাম যে একদিন সেলোয়ার-কামিজ পরে দেখা করতে এসো। ইচ্ছা করে ওদিন আরও জিন্সের সাথে টপ আর জ্যাকেট পরলে। ওহ তোমার তো কামিজে কমফোর্টই লাগে না। আজ লাগছে?”
মহুয়া প্রথমে এক ঢোক গিলে। তারপর জোরপূর্বক হাসে, “হয়েছে কি….”
জাহান তার কথা পূরণের সময়ই দেয় না। হাতে হেলমেট ধরিয়ে বাইকে উঠে বলে, “জলদি বাইকে উঠো।”
“এখন? এই সময়?”
জাহান তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন চিবিয়ে খাবে। মহুয়াই বা বড় গলায় কী বলবে? সে মিথ্যা তো নিজেই বলল। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে হেলমেট পরে উঠে বসে বাইকে।
জাহান রাগের মাঝেও ভারী গলায় বলল, “শক্ত করে ধরো, নাহলে ফোঁস করে উড়ে যাবা।”
“আমি এত দুর্বল না যে জোরে চালালেই ফোঁস করে উড়ে যাব। আমিও স্কুটি চালাই বুঝলা।”
মহুয়া বাইকের পিছনেই ধরে বসে। জাহান একবার তার দিকে ফিরে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকায়।
তারপর বাইক চালু করে। এত জোরে বাইক শুরু করে যে মহুয়া চিৎকার দিয়ে উঠে। নিজেই পিছনের হাত ছেড়ে জাহানকে শক্ত করে ধরে বসে। চোখ দু’টো শক্ত করে বন্ধ করে নেয়। জাহান যেন বাতাসের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। ভয়ে মহুয়ার কলিজা শুকিয়ে যায় এবার। তার বিয়ের কথা শুনে ছেলেটা পাগল হয়ে গেল না’কি?

মহুয়া উঁচু স্বরে বলে, “পাগল হয়ে গেলে না’কি? আস্তে চালাও।”
“শায়ানের সাথে তোমার কী তা বলো?”
“এই অবস্থায়? বাইক চালানোর সময় কেউ কথা বলে? ম’রার ইচ্ছা জাগছে তোমার?”
“তোমার সাথেই ম’রবো। তোমার ওর পরিবারের সাথে পরিচয় কীভাবে আর বিয়ের কথার মানে কী? এর উপর ওর ফেভারিট রঙ পরেছ। বাহ!”
“ভাই আমি কী জানি ওর ফেভারিট রঙ কী?”
“এখন ওকে বিয়ে করার জন্য এত এক্সাইটেড যে আমাকে ভাই বানিয়ে দিলে?”
“আরে ধ্যুর কীসের বিয়ে? কোনো বিয়ে না।”
এই কথায় জাহান বাইকে ব্রেক মারে। হঠাৎ ব্রেক মারায় মহুয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে খামচে ধরে জাহানের বুকের দিকটা।
জাহান হেলমেট খুলে পিছনের দিকে তাকায়, “মানে কোনো বিয়ে নেই?”
জাহান নিজেই মহুয়ার হেলমেট খুল দেয়।
মহুয়া বিরক্তি নিয়ে বলে, “না, নেই।”
“পূর্ণি তাহলে কী বলল?”
“আরে এনেছিল বিয়ের প্রস্তাব। তাই বলে কি আমি রাজি হয়ে যাব?”
“তুমি রাজি হও নি তাহলে? ” জাহান এইবার শান্তির নিশ্বাস ফেলে।
“আমার ভাইয়াই মানা করে দিয়েছে। বলেছে আমি চাকরি পাওয়ার আগে বিয়ে দিবে না। দাদী কাবিন করে রাখতে চেয়েছিল। তার জন্যও মানা করে দিয়েছে।”
জাহানের কপাল কুঁচকায় এবার, “মানে তুমি মানা করো নি। তোমার ভাই মানা করেছে।” তার মুখে স্পষ্ট অসন্তুষ্টি।
“আমিই আগে মানা করেছি।”
“তাহলে ঠিক আছে। তোমার ভাইয়ের এই পাঁচ বছরের পলিসি আমার কোনো তো কাজে লাগলো।”
“মেজাজ ঠিক হলে বাসার বাসার দিকে ফিরো।”
“বাইরে তো এসেই পড়েছ। একটুখানি রাত্রিবিলাশ করো। এমনিতেও তোমার সাথে কিছু প্রশ্ন আছে।”
“আবার কি প্রশ্ন?”
জাহান আবারও হেলমেট পরতে পরতে বলল, “এই সামান্য প্রশ্ন। যেমন শায়ানের ফ্যামিলি তোমাকে চিনে কীভাবে?”

জাহান বাইক এনে থামায় ক্লাউড ক্যাফের গেইটের সামনে। মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “এটা তো বন্ধ।”
“জানি। কিন্তু আমার কাছে চাবি আছে।”
জাহান বাইকের কী-চেইনের গুচ্ছের মধ্যে একটা বের করল। তাকে ক্যাফের পিছনে নিয়ে যেয়ে পিছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “ক্যাফের চাবি তোমার কাছে কীভাবে?”
“কারণ আদনান আংকেল আমাদের নিজের বাচ্চাদের মতো দেখে। আঠারো বছর হবার পর আমরা রাতে বাইক রেইসিং করতাম। তারপর ক্লান্ত হয়ে এসে এখানে আসতাম। আমি, তিসান আর…” জাহান বলতে বুতে হঠাৎ থেমে যায়। এতক্ষণে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের লাইট জ্বালায় সে সাথে সাথে বড় গাছে পেঁচানো ফেইরিলাইটগুলো জোনাকির মতো টিমটিম করে জ্বলে উঠে।

জাহানকে একই স্থানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে দেখে মহুয়া তার কথা সম্পূর্ণ করে, “আর শায়ান।”
জাহান তাকায় তার দিকে, “হুম, আর শায়ান। কিন্তু তুমি আমাকে এটা জানাও যে তুমি কীভাবে শায়ানের পরিবারকে চিনো?”
মহুয়া জোরপূর্বক হাসে, “এই গাছে ফেইরিলাইট লাগানোর আইডিয়াটা কার ছিলো? কী সুন্দর লাগছে!”
“টপিক চেঞ্জ করবে না। শায়ানের পরিবার তোমাকে কীভাবে চিনে?”
জাহান তার একদম সামনে এসে দাঁড়ায়।
“ওকে আমার ফুফাতো বোনের বিয়ে শায়ানের ভাইয়ের সাথে হয়েছে। জেনেছ, এবার খুশি?” মহুয়া খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলে। বলে আবার মুখ ফুলিয়ে নেয়।
জাহান তার কাছে এসে তার কোমড় ধরে টান দিয়ে নিজের এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “মানে তুমি এতদিন এই কথা আমার থেকে লুকিয়েছ। ওদিন আমি যে হলুদে গেলাম তখনও শায়ান সেখানে ছিলো বলে আমাকে অনুষ্ঠানের দিকে যেতে দেও নি। আজকের বিয়ের কথাটা না জানলে তো এটাও বলতে না তাই না? তারপর বিয়ে করে ফেলার পর বলার মতলব ছিলো?”
মহুয়া চোরের মতো মুখ লুকানোর চেষ্টা করে তার বাহুতে। যা দেখে জাহান অবাক হয়। আগে মহুয়াকে ধরলেই সে ছ্যাঁত করে উঠতো। ধাক্কাধাক্কি করতো। আজ কী মহুয়াকে ভূতে ধরল না’কি? আজ এত অনুগত্য কীভাবে?

মহুয়া মিনমিনে গলায় বলল, “আমি কী ওই বান্দর ক্যাটক্যাটাকে বিয়ে করতাম না’কি?” সে আবার মুখ তুলে বলে, “আমরা দুইজনই তো বিয়েতে সম্পূর্ণ নারাজ। আর শায়ান তো রশ্মিকে ভালোবাসে রাইট? তাহলে তুমি এত ভাবছো কেন? আমরা তো একে অপরকে দেখতেও পাড়ি না। শুধু আমার ক্রিমপাফের জন্য ওর সাথে কথা বলি, নাহলে তো আমাদের কথা বলার মতোও কিছু নেই।”
“ক্রিমপাফ?”
“আরে আমার বিল্লুভাই। এই কিউট একটা বিড়ালছানা। আমার ভাইয়ের এলার্জি তো নাহলে আমি নিয়ে আসতাম। আপাতত ওর কাছে আমানত হিসেবে রেখেছি। আমাদের বিয়ে হলে নিয়ে আসবো।”
“আমাদের!” চমকে উঠে জাহান এই কথায়।
মহুয়াও নিজের কথায় অবাক হয়। সে এই কথাটা বলল কেন? এতক্ষণে খেয়াল করে জাহানের বাহুডোরে আবদ্ধ সে,অথচ এত শান্ত।

সে ভাবনা এলো সেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে সে জাহানকে। আমতা-আমতা করে বলে, “আমার আর আমার হবু জামাইয়ের কথা বলেছি। তোমার কথা বলিনি কিন্তু।”
জাহানের রাগ এবার ছুঁ মন্তর হয়ে গেল। এই মেয়ের সামনে তার রাগ গলে যায়। চেয়েও রাগ দেখাতে পাড়ে না।
সে মহুয়াকে তো ছাড়লোই না উলটো তার এক হাতের মাঝারে মহুয়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে অন্যহাত দিয়ে তার নরম তুলতুলে গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “আমাদের মানে তুমি তোমার আর আমার কথা বুঝেছ জান। ঠিক বলেছি না?”
মহুয়া কাঁপানো সুরে বলে, “না। ছাড়ো এবার।” আর মুখ ফিরিয়ে নেয়।
জাহান অনুভব করতে পাড়ে তার দেহের কাঁপুনি। তার দেহ, নরম ফোলা ঠোঁট, চোখের পলক সবটা কাঁপছে। নিশ্বাস ঘন হয়েছে। সে ঠোঁটজোড়া দেখে তার ছুঁয়ে দিয়ে ইচ্ছা হলো নিজের জামকালো ঠোঁট দিয়ে। কিন্তু আফসোস! তার প্রেমপ্রেয়সী নারীটি এতই জেদি যে নিজের ভালোবাসাও স্বীকার করল না আজ পর্যন্ত। তাকে এই অধিকার দেওয়া তো দূরের কথা।

সে মহুয়াকে ছেড়ে বাগানের গাছ থেকে একটি ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যেয়ে বসে গাছের নিচে। মহুয়াকে ইশারা করে এসে বসতে। মহুয়া এসে বসে ঠিকই কিন্তু অভিযোগের সুরে বলে, “তোমার ইচ্ছা আমরা বাসায় না যেয়ে এখানে রাত কাটাব?”
আচমকা জাহান তার কোলে মাথা রেখে বলে, “একদম তাই।”
“আমার কোল কী পাবলিক প্লেস যে না বলে কয়ে শুয়ে পড়েছ?”
“আমার প্রাইভেট প্লেস।”
মহুয়া মুখ ঝামটাল।

জাহান জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তাহলে পাঁচ বছর পর কাকে জীবনসাথী হিসেবে বেছে নিবে তুমি?”
“সে পাঁচবছর পর দেখা যাবে। এর মাঝে কত ছেলে আসবে?”
“সে কত শত ছেলেদের মধ্যেও আমাকেই বাছবে।”
“এত কনফিডেন্স?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম। আমার ভালোবাসা যে তোমার মন দুর্বল করে দিবে তা আমার জানা আছে।”
জাহান তার হাতে থাকা ফুলটা গুঁজে দিলো মহুয়ার কানের পিছে। তবে মহুয়া কিছু বলল না। জাহান তার হাত ধরে নিজের গাবলি চুলের উপর রেখে আবদারের সুরে বলে, “একটু হাত বুলিয়ে দেও না।”
“মামার বাড়ির আবদার না’কি?”
“ছোট থাকতে মা প্রতিরাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিতো আমার।”
এমন আবেগপ্রবণ কথা শুনে মহুয়া আর কী করবে? দিলো তার মাথায় হাত বুলিয়ে। জাহান মুচকি হেসে তার আরেকহাত নিজের বুকের কাছে এনে ধরে রাখল।

মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। যেহেতু ব্যক্তিগত সেহেতু না বললেও সমস্যা নেই।”
“করো জান।”
“তোমার মা কীভাবে মা’রা গিয়েছিলেন? আই মিন আংকেলের জন্য গিয়েছিলেন এটা জানি কিন্তু কীভাবে? ”
প্রশ্নটা শুনে জাহান চুপ থাকে কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমরা প্রতি শুক্রবার পরিবারসহ কোথাও না কোথাও ঘুরতে যেতাম। সেবারও গিয়েছিলাম বসুন্ধরা। বাবা আমাদের দিয়ে কাজে গিয়েছিল। বাবা মা’য়ের এনেভার্সিরি ছিলো পরের সাপ্তাহে। আমরা সবাই মালদ্বীপ যাবার প্লান করেছিল উইকেন্ডে। মা শপিং এর জন্য গিয়েছিল। আমাকে আর জিনিকে নিয়ে প্লান করেছিল সেখানে যেয়ে বউ সেজে বাবাকে স্যারপ্রাইজ দিবে। আমরাও খুব এক্সাইটেড ছিলাম। মা লাল বেনারসি কিনলো একটা। যখন তাদের বিয়ে হয় তখন বাবার বেনারসি কিনে দেবার মতো টাকা ছিলো না কিন্তু বাবার খুব শখ ছিলো মা’কে বউবেশে দেখার। মা তাদের পনেরোতম এনেভার্সিরির জন্য এই বিশেষ মুহূর্তটা ভেবে রাখে। সব ঠিক চলছিল। সব। শপিং শেষে আমরা বের হই। বাবাও আমাদের নিতে আসে। একসাথে আরও ঘুরে ডিনারে যাব। আমরা বসুন্ধরা মার্কেটের অপসিট রোডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জিনি অনেকক্ষণ ধরে কান্না করছিল আইস্ক্রিম খাবে। মা আমাদের রাস্তার পাশের খাবার খেতে দিতো না। কিন্তু বাবা সবসময়ই আমাদের আবদার পূরণ করতো। মা’য়ের কথা না শুনে। সেদিনও বাবা তাই করে। রেড সিগনাল ছিলো। তাই বাবা পাড় হবার জন্য এগোয় আর মা তাকে বারণ করতে থাকে যেন জিনিকে বাহিরের আইস্ক্রিম না দেয়। মা’ও তার পিছনে যায়। কিন্তু একটি গাড়ি সিগনাল না দেখে এগোয়। এত স্পিডে আসে যে…” জাহানের গলা লা ধরে এলো এই সময়। তার বন্ধ চোখের কোণা দিয়ে এক ধারা জল বয়ে গেল। তা চোখে পড়লো মহুয়ারও কিন্তু সে কিছু বলল না। সে সান্ত্বনা কিভাবে দেয় তা জানে না। বিশেষ করে এমন মুহূর্তে। মুখে কিছু না বললেও সে জাহানের বুকে রাখা হাতটা তার চোখের উপরে এনে রাখে। যেন সে দেখে নি তার চোখের নোনাপানি।

জাহান তার এই কাজে মৃদু হাসে। আজকের হাসিটি এত সুন্দর নয় বলে মনে হলো মহুয়ার। কেমন বিষাদের হাসি। জাহান বলে, “কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি মা বাবাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে কিন্তু নিজে সরে যাবার সময়টা পায় নি। মুহূর্তের মধ্যে মা’য়ের র’ক্তাক্ত দেহ রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। আমি জিনির হাত ধরে সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আশেপাশে ভিড় জমেছিল। আমি সব দেখছিলাম কিন্তু নড়তে পাড়ি নি।” কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস ফেলল জাহান। তার চোখের উপর রাখা মহুয়ার হাত আবারও ভিজে গেল।

জাহান এবার তার হাত সরিয়ে তাকায় মহুয়ার দিকে। সিক্ত চোখে। উঠে বসে মহুয়ার দুই কাঁধ ধরে বলে, “জানো মহুয়া, মা বাবার একটু পিছনে ছিলো। ভাবলেই মা সরে যেতে পাড়তো। নিজে বাঁচতে পাড়তো। কিন্তু মা বাবাকে বাছাই করল। আমি যখন ঘোর কেটে এগোই তখন দেখি মা’য়ের লাল বেনারসিটা তার পাশেই পড়ে আছে। রক্ত লাগানো। বাবার ইচ্ছাটা আর পূরণ হলো না।
মা’কে বউবেশে আর দেখা হলো না তার।”
তার চোখে পানি দেখে মহুয়ারও চোখ ভিজে যায় প্রথমে তারপর সে জোরে কেঁদে উঠে শব্দ করে।

তার এমন কান্ডে জাহানও আশ্চর্য হয়ে যায়। কান্নাও ভুলে যায়। মহুয়া এভাবে কাঁদছে কেন?
জাহান বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “জান তুমি এভাবে কান্না করছো কেন?”
মহুয়া ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করা অবস্থাতেই বলে, “আমি আস্তে কাঁদতে পাড়ি না।”
জাহানের এবার হাসি পায়। সে নিজের দুঃখ ভুলে মহুয়াকে জড়িয়ে বুকে চেপে বলে, “থাক আর কান্না করা লাগবে না। সব ঠিক আছে।”
“আংকেল কেন আইস্ক্রিম আনতে গেল? এই আইস্ক্রিম যে আবিষ্কার করছে তাকে ধরে পিটানো উচিত।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। পিটাবো নে।”
“সে তো মরে গেছে। কীভাবে পিটাবা?”
“তাহলে পিটাবো না।”
“না পিটাবা। তার ভূত ধরে পিটানো উচিত।”
জাহান এবার শব্দ করে হেসে দেয়।
এতে চেতে যায় মহুয়া সে জাহানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে, “আমি কাঁদছি তোমার জন্য আর তুমি হাসছো?”
জাহান কান ধরে বলে, “সরি বাবা। ভুল হয়ে গেছে।” সে আবারো হাত এগিয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় মহুয়াকে। বলে, “আজ যখন শুনলাম তোমার বিয়ের কথা, তখন আমার বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো। ভাবলাম আমি যদি তোমায় না পাই তাহলে কীভাবে থাকব? কখন, কীভাবে তোমায় এত ভালোবেসে ফেললাম নিজেও জানি না। তুমি জানো তোমাকে বুকে জড়ালে আমার কত শান্তি লাগে? সেদিন যখন তুমি ভুলে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরেছিলো এই স্থির রাখা হৃদয়টা সেদিন এলোমেলো হয়েছিলো আর আজ তোমাকে বুকে নিয়ে এই এলোমেলো হৃদয়টা শান্ত হয়ে গেল। তুমি জাদু জানো?”
“জানতেই পাড়ি।”
” বাবা মা’কে দেখার পর জীবনে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এই জীবনে একজনকেই ভালোবাসবো। এখন ওটা তুমি হয়ে গেলে, তাহলে কী করব?”
মহুয়া তার বুকে মেরে বলে, “এত আফসোসের সুরে বলছ কেন?”
জাহান হাসে, “মজা করছি। আচ্ছা এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”
“না।”
“আচ্ছা করলাম। তোমাকে যখন হলে আটকে দিয়েছিলাম প্রথমে তুমি ভয় না পেলেও পরে এত ভয় কেন পেয়েছিলে সে কান্না করে দিয়েছ। তোমাকে কখনো এত ভয়ে দেখিনি। মোহ বলল তোমার চাইল্ডহুড ট্রমা আছে।”
“তখন আট বছরের ছিলাম। ঈদের দিন মা’কে বলে সালামির জন্য বের হলাম বিকেলে। মা’কে বলেছিলাম এলাকাতেই আছি। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম স্কুলের এক বান্ধবীর বাসায়। বাসা থেকে বেশি দূরে ছিলো না। যাওয়ার সময় ওর বাসা যেমন তেমন করে চিনলাম। কিন্তু আসার সময় রাস্তা ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে একটা বাড়ির ভেতর দিয়ে শর্টকাটে এসেছিলাম সেটা বন্ধ করে দিয়েছিল। হারিয়ে গেলাম। রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যেন যেয়ে আটকালাম। দেখলাম সে রাস্তা একদমই চিনি না। এরপর দেখলাম চারজন লোক আমার পিছু করছে। তখন আবার ছেলেধরা বেড়েছিল অনেক তাই ভয়ে দিলাম এক দৌড়। ওই লোকগুলোও পিছনে দৌড়াল। হঠাৎ হোঁচড় খেয়ে পড়ে গেলাম। রাস্তাটার অবস্থা অনেক খারাপ ছিলো। ইট পাথরে ভরা। আমার মাথায়, পা, শরীরের কয়েকটা অংশ ছিঁলে গেল। কিন্তু তারপরও আমি উঠে দৌড়ালাম। একটুর জন্য হাতে লাগিনি লোকগুলোর। কিন্তু আমার খুবই মাথা ঘুরাচ্ছিলো। রাস্তার পাশে একটা ঠেলা দাঁড় করানো ছিলো। পিলিথিন দিয়ে ঢাকা। সে ঠেলার পলিথিনের ভেতর ঢুকে যাই। সেখানে ছিলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাহিরে তখনও লোকদের শব্দ। ভয়ে না র’ক্তশূন্যতায় জানি না কিন্তু অনেকক্ষণ পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর যখন চোখ খুলে আমি হাস্পাতালে ছিলাম। মা, বাবা, ভাইয়া সবাই ছিলো সেখানে। কাঁদছিল। আমার না’কি একদিন পর জ্ঞান ফিরেছিল। সে ঠেলার মামা আমাকে পেয়ে হাস্পাতালে নিয়ে যায়। আর আমার পরিবার তো আমাকে না পেয়ে খুঁজছিলোই। সেদিনের পর থেকে মুরাদ ভাইয়া আমাকে আর আদুরে বোনের মতো ট্রিট করেনি। শক্ত করে বানিয়েছে। প্রতিদিন আমাকে দুইঘন্টা করে কসরত করাতো। এমন ট্রেনিং দিয়েছে যেন আমি আর কখনো ভয় না পাই। কখনো কোনো মুসিবতে পড়লে নিজে লড়াই করতে পাড়ি। কিন্তু আজও আমার রুম বাদে অন্য কোনো অন্ধকার জায়গায় আমার ভয় লাগে। সে রাতটার কথা আমার চোখে ভাসে। বারবার ভাবনা আসে যদি তারা আমাকে ওদিন ধরে নিতো তাহলে কী করতো আমার সাথে। আর কখনো কী বেঁচে ফিরতে পাড়তাম? আমার আপন মানুষদের দেখা পেতাম আবার?”
জাহান আরও জোরে চেপে ধরে মহুয়াকে তার বুকের সাথে, “সরি জান আমার কারণে সেদিন আবার তোমার এত ভয়ানক স্মৃতি মনে করা লেগেছে।” তার কন্ঠে আতঙ্ক।
মহুয়া তার কথা শুনে মুখ তুলে তার দিকে একবার তাকায়। তারপর বলে, “হয়ে হয়েছে। অনেক সেন্টিমার্কা কথা বলেছি আজ। টপিক চেঞ্জ।”
“টপিক চেঞ্জে মনে পড়েছে। থার্ড ইয়ারের এক্সাম যেহেতু শেষ আমি একমাসের ট্রেনিং এ যাচ্ছি ছুটিতে।”
চকিতে মহুয়া সরে বসে। তাকায় তার দিকে, “কবে?”
“পরশু।”
মহুয়া জাহানের বুকে একে একে কয়টা ঘুষি মারলো, “আমার উপর তেজ দেখাচ্ছিলে না? নিজেও তো যাচ্ছো যে এই কথা লুকালে।”
জাহান তার হাত ধরে নেয়। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি এঁকে রেখে জিজ্ঞেস করে, “কেন আমাকে মিস করবে?”
“আমি? তোমাকে? চেহেরা দেখেছ নিজের?”
কথা বলেও সে মুখ ফুলিয়ে নেয় রাগে।
জাহান হাসে, “কাল আমার সাথে সূর্যোস্ত দেখতে যাবে?”
“না।”
“সেদিনের মতো নৌকায় বসে সূর্যোস্ত দেখবো।”
“তাও না।”
“একমাস কিন্তু দেখা পাবে না আর।”
কথাটায় মহুয়া নরম দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তারপর মিনমিনে স্বরে বলে, “আচ্ছা।”
জাহান ঠোঁট কামড়ে হাসে। মহুয়া ধরে আরেকটু কাছে এনে তার কানে বলে, “জান তুমি আমার প্রেমে গেছো।”
মহুয়া মুখ ঝামটাল, “স্বপ্ন দেখো না।”
জাহান তার চুলের ভাঁজে এখনো তার দেওয়া ফুলটা দেখে বলে, ” কিন্তু আমি তো তোমার প্রেমে ডুবে গেছি।”
সে তার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটি রিং বের করে। রিংটি দুই আংগুলে ধরে আকাশের দিকে তুলে রিংটার মাঝে চাঁদ দেখে একবার আর বলে, “যখন এক্সিডেন্টের সময় মা’কে হাস্পাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন মা আমাকে তার আঙুলের আংটি খুলে দিয়ে বলেছিল যেন এটি আমি তাকে পরাই যে আমার জীবন সঙ্গী হবে।” জাহান এবার সে রিংটি মহুয়ার দিকে ফেরায়। তার চাঁদের মতো মুখখানা দেখে মিষ্টি হাসে। তারপর বলে, “আজ পেয়ে গেছি।”

মহুয়ার হাতটা তার হাতে নেয়। বাম হাতের আনামিকা আঙুলে রিংটা পরিয়ে সে হাতে চুমু খায়। মুহূর্ত খানিকের জন্য কাঁপুনি অনুভব করে মহুয়ার। তার দিকে তাকায় মুগ্ধ নয়নে। দেখে মহুয়াও একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকে দেখতেই চোখ সরিয়ে নিলো। তার মুখে মুচকি হাসি। তবুও ভান করে বলে, “তাহলে আমায় কেন দিলে? বিয়ের সময় তোমার জীবন সঙ্গীকে দিও।”
“মনে মনে বিয়ে করে ফেলিছি। আজ অফিসিয়ালি এনগেজমেন্টও হলো। তুমি আমার অফিসিয়াল ফিয়োন্সে।”
“তা কীভাবে?”
“সেদিন তুমি আমায় রিং পরালে। আজ আমি।”
“বললেই হলো আরকি।”
“এই একমাস আমার আমানতের খেয়াল রেখো। এই একমাস তোমার নিজের আর এই আংটির সারাজীবনের।”
.
.
মৃণা ভাত ও সবজি বসিয়েছে সবে। লামিয়া পড়ছিল। আর নিতু ও মিতু মোবাইল চালাচ্ছিল। দুইজনই পড়ে অনার্স থার্ড ইয়ারে।

মৃণা চুলায় খাবার বসিয়ে রুমে এলো তার কাপড় গুছিয়ে রাখতে। তাকে দেখে নিতু বলে, “আচ্ছা মৃণা তুমি বলেছিলে তোমার পরিবারের সাথে সম্পর্ক নেই তাই না?”
“জ্বি?”
“তুমি কী কাজ করো?”
“একটা মার্কেটিং কোম্পানিতে ইন্টার্নি করি আপু।”
“বাহ ইন্টার্নি করে এত বড় ভার্সিটিতে পড়ো আবার গাড়ি চড়ে বাসায় আসো। কোনো বড়লোক ছেলেকে ফাঁসিয়েছ না’কি?”
তার কিছু বলার আগে মিতু মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “এই রূপ দিয়ে ছেলে ফাঁসানো সম্ভব না। দেখ কাজের পিছনে অন্যকোনো ব্যবসা করে না’কি? না করলে এত বড় গাড়ি দিয়ে লোক ছাড়তে আসে না-কি?”
কথাটা শুনে মৃণা থমকে গেল। তাকে কখনো এই কথা শুনতে হবে সে কল্পনাও করে নি। কথাটা শুনে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। নিজ অজান্তেই চোখজোড়া ভিজে গেল।
নিতু বলল, ” এই এই সত্যি এমন কাজ করলে এখানে থাকতে পাড়বে না। আমরা ভালো পরিবারের মেয়ে। তোমার জন্য পড়ে আমাদের নাম খারাপ হবে। এজন্যই তো বলে মাঝেমধ্যে রাতে বাইরে থাকো কেন? পরিবার এজন্যই মনে হয় বের করে দিয়েছে। কালকেই আনোয়ার কাকার সাথে কথা বলতে হবে।”
তাদের এমন কথাবার্তায় মৃণা স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে জলধারা বইতে শুরু করে। তারা এত সহজে তার সম্পর্কে কিছু না জেনে কীভাবে চরিত্রে কথা তুলতে পাড়ে?
সে কিছু বলার পূর্বেই লামিয়া বলে, “আপনারা কী ভালো হবেন না? আপনারা যেয়ে কী দেখে এসেছেন মৃণা আপু কী কাজ করে?”
নিতু বলে, “এই মেয়ে তুমি চুপ করো।”
“আমি কেন চুপ করবো? আপনার বোন একদিন ছেলে নিয়ে এসেছিল বাসায়। আমি নিজে যেতে দেখেছি। নিজেদের চরিত্রে ঠিক নাই আসছে অন্যকে কথা শুনাতে।”
“তোমাকে তো…” নিতু তেড়ে আসে লামিয়ার দিকে কিন্তু মাঝখানে মৃণা এসে দাঁড়ায়। সে শক্ত গলায় উওর দেয়, “আপনাদের জানানোর প্রয়োজন মনে না করলেও জানাচ্ছি। এই ভার্সিটিতে আমি নিজের যোগ্যতায় স্কলারশিপে পড়ছি।”
লামিয়া তখন পিছন থেকে আবার টিপ্পনী কেটে বলল, “স্কলারশিপ জানেন তো কি? না মানে আপনারা তো আবার বইয়ের চেহেরা চিনেন না’কি সন্দেহ আছে তাই।”
মৃণা তার কথায় হাসে। নিজের চোখের পানি মুছে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আর রইলো সে গাড়ির কথা সেটা আমার পরিচিত একজনের। উনি অনেক সম্মানিত ব্যক্তি। এই পৃথিবীতে আমি তাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করি। তিনি আমার জন্য অনেক করেছেন যা নিজের পরিবারও করে না। তাই ভুলেও এমন কিছু বলবেন না যেন আমার অসীম ধৈর্যের বাঁধ ও ভেঙে যায়। আর আমার পরিবারের অবস্থা, আমাকে ও আমার পরিস্থিতি না জেনে চরিত্রে প্রশ্ন তুলবেন না। আমার পরিশ্রম করেই এসব করার ক্ষমতা আছে এর জন্য চরিত্র বিক্রি করতে হবে না। এই বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে আমার পড়াশোনার খরচ সব আমি নিজে বহন করতে পাড়ি। আর কখনো আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুললে আপনাদের জন্য ভালো হবে না। এটা আমার ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং।”
.
.
সমুদ্র অফিস থেকে আসে ক্লান্ত শরীরে। চারমাস ধরে অফিসে যাচ্ছে সে। মোহের শর্ত পূরণ করতে। নিজে যদিও প্রথমে পাঁচঘন্টা কাজ করতেও নারাজ ছিলো সেখানে সে আজকাল নয় ঘন্টাও কাজ করে মাঝেমধ্যে। জায়গাটায় থাকতেই তার শান্তি লাগে। আবার মনটা ছটফট করে বাসায় আসার জন্য।

হঠাৎ তার কানে হৃদয় নাচানো শব্দ এলো। ছনছন শব্দ। সে তাকাল দরজার দিকে। মোহ তার জন্য চা নিয়ে আসছে। চা’য়ের কাপটা রাখলো টেবিলে। তার পাশে বসে ওড়না একপাশ দিয়ে তার ঘুম মুছে দিয়ে বলল, “ইশশ কতটা ঘামিয়ে গেছেন। আপনি কী বাবার সাথে গাড়ি দিয়ে আসতে পাড়েন না? এই গরমে বাইক দিয়ে আসাটা কি খুব প্রয়োজনীয়?”
সমুদ্র তার হাত ধরে টান দিলে মোহ আধশোয়া অবস্থায় তাকায় তার দিকে বিরক্তি নিয়ে। সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, “কেন মধু আমি ঘামালে আমাকে জড়িয়ে ধরবে না।”
“না, ছাড়ুন। ”
সমুদ্র এবার তাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, “আমি তো ধরবো।”
“খারাপ লোক।”
সমুদ্র হাসে। মোহের মুখের সামনে আসা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে জিজ্ঞেস করে, “কী করেছ সারাদিন?”
“সারাদিনে? সকালে আপনি যাবার পর মাম্মার সাথে গল্প করেছি, তারপর ফোনে আম্মু আব্বুর সাথে গল্প করেছি, তারপর বিকেলে গারলিক চিজ ব্রেড বানিয়েছি, এরপর ঈশা আপু কল দিয়েছিল তাকে ভিডিকলে বিয়ের শাড়ি পরে দেখিয়েছি তারপর আপনার আসার অপেক্ষা করেছি।”
“আমিই তোমাকে আজ পর্যন্ত শাড়িতে দেখলাম না, ঈশাকে দেখিয়ে দিলে?”
“আপুর বিয়ে তাই আপুকে দেখিয়েছি। আপু বলেছে আপনার কালো রঙ না’কি ভীষণ পছন্দ তাই কালো শাড়ি পরতে একটা ফাংশনে।”
“আমার পছন্দে পরবে কেন?”
“থাক তাহলে আপনার পছন্দে পরবো না। ওখানে অন্যকোনো ছেলে আমার পছন্দ হলে তার পছন্দে পরবো।”
কথাটায় চেতে গেল সমুদ্র। সে এক ঝটকায় মোহকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে বলল, “দুইদিন পর পর এই কচুর কথা বলবে না৷”
“কী বললাম যে আপনি এত রেগে যাচ্ছেন?” মোহ সরল গলায় জিজ্ঞেস করে। কিন্তু তার মুখে দুষ্টুমি হাসি।
সমুদ্র তা দেখে বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। আলমিরা থেকে গেঞ্জি ও টাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। শব্দ করে লাগালো দরজা।
তার অবস্থা দেখে মোহ হাসতে হাসতে কাহিল। তার নজর যায় চা’য়ের উপর। সে উঁচু স্বরে বলে, “চা’টা যে নিলেন না?”
“লাগবে না তোমার চা।”
“ঠিকাছে তাহলে আমি খেয়ে নিলাম।”
“খবরদার আমার চা’য়ের দিকে তাকাবে না।”
মোহ তার কান্ড দেখে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার শাশুড়ী খাবার গরম করছিল রাতের জন্য। মোহও গেল তার কাজে সাহায্য করতে। যেয়ে দেখে শশুড় আগে থেকেই সেখানে। তার শাশুড়ীকে সাহায্য করছে । তাদেরকে মোহের অনেক কিউট লাগে। সে ভাবে একসময় সে এবং সমুদ্রও এমন হবে। একসাথে সংসার গড়বে, একসাথে এমন বয়স্ক হবে, একসাথে ভালোবেসে…এখানেই তার ভাবনা থেমে গেল। ভালোবাসা? সমুদ্র কি কখনো তাকে ভালোবাসতে পাড়বে?

খাবার টেবিলে দেওয়ার পর সবাই খেতে বসে। এখন সমুদ্র নিজ থেকেই আসে। মোহের পাশে বসে। টুকটাক কথাও বলে তার মা বাবার সাথে। তাকে দেখে এখন তার মা বাবাও খুশি। আগের মতো মুখ মলিন করেন না। উল্টো তাকে দেখার পর বড় এক হাসি তাদের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে। তারা যেন তাদের পুরনো সমুদ্রকে ফিরে পাচ্ছে।

সমুদ্র রাতের সিগারেট খাওয়ার সেশন শেষ করে এসে দেখে মোহ ল্যাপটপে কিছু একটা দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। সমুদ্র তার পাশে যেয়ে বসে, “কী করছ?”
মোহ তার কথা ঠিকভাবে শুনতে না পেয়ে হেডফোন খুলে জিজ্ঞেস করে, “কিছু বললেন?”
“জিজ্ঞেস করছি কি করো?”
“অন্য ছেলের সাথে প্রেমালাপ করছি।”
এমন ত্যাঁড়া উওর শুনে সমুদ্রের মেজাজ বিগড়ে গেল৷ সে মোহে কোল থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে দেখলো মোহ কে-ড্রামা দেখছে। সেখানে নায়ক নায়িকার রোমেন্টিক সিন চলছে। তা দেখে সমুদ্র মোহের মাথায় টোকা মেরে বলল, “এই পিচ্চি মেয়ে এসব কী দেখো? এসব দেখার বয়স হয়েছে তোমার?”
“আমার বয়স হয়েছে না’কি? সাড়ে উনিশ বছর আমার। কিছু মাস পর বিশে পড়বো। এরা একটু কিশমিশই তো করছে। বেশি আর কি? আপনার মতো পানসে জামাই পেয়েছি বলে, অন্যকোনো রোমেন্টিক জামাই পেলে একটা বাবুও থাকতো কোলে।”
সমুদ্র তার কথা শুনে বোকা বনে যায়। সে হতবাক হয়ে মোহের দিকে তাকিয়ে থাকে। ল্যাপটপটা পাশে রেখে সে বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “আমি পানসে?”
মোহ মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে পা তুলে বসলো। ভাব নিয়ে বলল, “তো নয় কি? আচ্ছা শুনেন না, বিয়ের তো ছয়মাস হলো। চলেন ডিভোর্স নিয়ে নেই।”
কথাটায় কপাল কুঁচকায় সমুদ্রের, “পড়ে কী করবে?”
“পড়ে? পড়ে একটা রোমেন্টিক ছেলে দেখে বিয়ে করব। যে আমাকে অনেক ভালোবাসবে। তিসান ভাইয়াও খারাপ অপশন না তাই না? আপনি না বললে তো আগে খেয়ালও করতাম না। আপনি বলাতে আজকাল খেয়াল করি। দেখা হলেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন আমার থেকে বেশি সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। যেভাবে তাকিয়ে থাকে মনে হয়…”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বে সমুদ্র ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে তাকে চেপে ধরে খাটের সাথে। কঠের সাথে ধাক্কা লাগায় মোহ ব্যাথাও পায় খানিকটা। বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কী অবস্থা! এত জোরে কি কেউ…”
আচমকা সমুদ্র তার গাল চেপে ধরে। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কপালের রগ ফরফর করছে। দাঁতে দাঁত পিষে গভীর নিশ্বাস নিচ্ছে সে।

তাকে দেখে মোহের কলিজার পানি শুকিয়ে গেল৷ সমুদ্রের দুর্বলতা জানতে পাড়ে সে সেদিন। জানার পর থেকেই মাঝেমধ্যে মজা নেয়। তার ভালোই লাগে। কিন্তু আজ কি বেশি হয়ে গেছে? সমুদ্র এত রেগে গেল যে! মোহও বুঝতে পাড়ে আজ বেশিই বলে ফেলেছে সে। সে আমতা-আমতা করে কিছু বলতে যাবে এর আগে সমুদ্র
গম্ভীরমুখে বলে, “আমার সামনে অন্য ছেলের কথা মুখে আনলেও তোমার খবর আছে। এই জীবন তুমি কেবল আমার সাথেই কাটাতে পাড়বে বুঝলে? আর ওই তিসান…. সে তোমার সৌন্দর্যের কারণে তোমার থেকে চোখ সরায় নি। ও কী আমার মতো তোমার যত্ন নিতে পাড়বে? আমার মতো তোমার খুশির জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে পাড়বে? তোমার একফোঁটা চোখের জলে আমার বুক কেঁপে উঠে, অন্যকোনো ছেলে তোমার চোখের জল দেখে মাতোয়ারা হবে? তুমি শুধু আমার মধু, আমার বউ, বুঝলে? তুমি অন্যকারো হতে পাড়বে না।”
কথাগুলো বলতে বলতে কি হলো, কে জানে সমুদ্রের চোখ সিক্ত হয়ে গেল।

মোহ তা দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্রের হাত সরিয়ে কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই সমুদ্র এমন কিছু করে ফেলল যা সে কল্পনাও করে নি। আচমকা সমুদ্র তার ঘাড়ের পিছনে হাত রেখে তাকে কাছে নিয়ে আসে। কিছু মুহূর্তে নীরবতা পালন করে। কি যেন দেখে মোহের চোখে। হঠাৎ চোখ বন্ধ করে তার ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের দখলে নিয়ে নেয়।

মোহ চোখদুটো বড় করে ফেলে। এমন কিছু সে মোটেও কল্পনাও করে নি। সে মাঝেমধ্যে মজা করে কথাগুলো বললেও সমুদ্র যে আসলে তাকে চুমু খেয়ে নিবে তার ধারণার আশেপাশেও ছিলো না। সে সমুদ্রের বুকে হাত রেখে তাকে সরাতে চাইলে সমুদ্র তার পিঠে হাত রেখে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। মোহ আবারও তাকে ঠেলতে চায়। কিন্তু তার জোরের সাথে পাড়ে? তাই কামড় দিয়ে দেয়। সমুদ্র তাকে ছেড়ে দেয়। তার ঠোঁটে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “বিরক্ত করছ কেন?”
সমুদ্র তার দিকে তাকাতেই মোহের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। লোকটা এমন মাতালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেন তার দিকে? যে এই দৃষ্টি দিয়ে তার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিবে। মোহ তার দৃষ্টি দেখে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করে, “এমন কেন করছেন?”
সমুদ্র তার লজ্জামাখা মুখখানা দেখে যেন আরও উন্মাদ হয়ে উঠে। সে মোহের গালে হাত রেখে তার মুখ তুলে, “আমি তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করতে চাই মধু। তোমার মাথায় যেন আর কখনো অন্যকোনো ছেলের ভাবনাও না আছে।”
“আমি মজা করছিলাম তখন।”
“জানি। কিন্তু মজাতেও আমি তোমাকে অন্যকারো সাথে কল্পনা করতে পাড়বো না। তোমাকে ছোঁয়ার, তোমার যত্ন নেওয়ার, তোমাকে আদর করার, তোমাকে জড়িয়ে ধরার সব অধিকার কেবল আমার আছে আর থাকবে।” বলেই সে আবারও চুমু খেল মোহের ঠোঁটে। তার মোহে ভাসতে চাইল, ডুবতে চাইল এই নেশায়। কিন্তু মোহ আবারও থামাল। তার নিশ্বাসও ঘন। সে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকায়, সমুদ্রের দিকে, “ভালোবাসেন?”
কী আশাভরা দৃষ্টি তার!
যেন তার শত শত প্রশ্নের উওর এই একটি প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ।

চলবে….

মেঘের খামে…
পর্ব ৩৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“ভালোবাসেন?”
কী আশাভরা দৃষ্টি তার!
যেন তার শত শত প্রশ্নের উওর এই একটি প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ।
তবে এই প্রশ্নের দ্বিধায় দেখাল বেশ সমুদ্রকে। তার চোখে আর নেশাটি নেই। আছে তো দ্বিধা।
মোহ এবার অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে, “বলুন না, আমার এত যত্ন নেন, আমাকে নিয়ে এত ভাবেন, আমার চোখের জল যে সহ্য হয় না আপনার। অন্যকোনো ছেলের কথা মুখে আনলে যে আপনার রাগ উঠে যায়। এর মানে আমি কী ধরবো? ভালোবাসেন?”
সমুদ্র অনেকক্ষণ চুপ রইল উওর দেওয়ার আগে, ভাবল, তারপর বলল, “ভালোবাসি না, কিন্তু তুমি আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন কল্পনা করতে পাড়ি না আমি।”
মোহ তাকিয়ে রইলো তার দিকে বিনাবাক্যে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, “জবা আপু আপনার জীবনে না আসলে কী আপনি কেবল আমাকে ভালোবাসতেন সমুদ্র? এখন কি আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না?” তার কন্ঠটা কাঁপা কাঁপা।

সমুদ্র তার প্রশ্নে স্থির হয়ে রয় কিছু সময়। মোহ থেকে চোখ লুকিয়ে নেয়। মোহের হাত ছেড়ে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি ড্রামা দেখো, আমি একটু আসছি।”

মোহ তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের যাওয়ার দিকে। তার চোখ দুটোয় এসে জমলো জল। সমুদ্র তার চোখ থেকে উধাও হতেই সে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। তার নরম দু’টো গালে দুঃখের ধারা বয় যায়।

সমুদ্র বারান্দায় গিয়েছিল। সিগারেট খেলো দুই তিনটা।
রুমে এসে দেখে মোহ শুয়ে পড়েছে। লাইট জ্বালানো। মুখে ওড়না দেয়া। সমুদ্র চোখ বন্ধ করে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে। মোহের মুখ থেকে ওড়না সরায় আলতো করে। তার নাক, গাল লাল হয়ে আছে। চোখের পাতা ফুলে লাল হয়ে গেছে। ঠোঁট ফুলে গাঢ় গোলাপি হয়ে আছে। মোহ কাঁদলে মুখের অবস্থা এমন বেহাল হয়। আর এই মুখখানা দেখলে তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। সে মোহের বাহু ধরে টান দেয়। কিন্তু মোহ নড়ে না। শক্ত হয়ে থাকে। সমুদ্র ডাকে তাকে, “মধু আমার দিকে তাকাও।”
মোহ নড়ে না।
“মধু আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। আমার দিকে তাকাও দেখি।”
মোহ তাও তাকায় না। চোখ চেপে বন্ধ করেই রাখে।

সমুদ্র উঠে বিছানায় শোয়। তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখটা এনে মৃদুস্বরে বলে, “আমার মধুর কান্না আমার মোটেও সহ্য হয় তা জানা সত্ত্বেও কেন কষ্ট দেও নিজেকে। সাথে আমাকেও।”
উওর আসে না ফেরতে।
সমুদ্র আবারও বলে, “প্লিজ মধু তাকাও আমার দিকে। অভিমান করো না। অভিমান করে যখন তুমি কথা বলো না তখন প্রতিটা মুহূর্ত আমার নিশ্বাস আটকে আসে। তাকাবে না তুমি? তুমি কী চাও বলো? ”
মোহ তবুও কিছু বলে না।
“এত অভিমান কেন তোমার মধু? তুমি তো জানো তুমি আমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাই না? একটু সময় তো দিবে আমাকে। আমার পক্ষে অতীত ভোলাটা এত সহজ না। কিন্তু আমি চেষ্টা করছি। তোমার মতো নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটুখানি সময় দেও মধু। আমি তোমাকে….তোমাকে ভালোবাসারও চেষ্টা করব। আই প্রমিজ।”
মোহ সাথে সাথে ঘুরে তার বুকে মুখ লুকায়। মুহূর্তে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
“এই মধু কাঁদছ কেন?”
মোহ কিছু বলে না। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সমুদ্রকে। খামচে ধরে তার গেঞ্জি। তার কান্না দেখে সমুদ্রের বুকের ভেতর ব্যাথা উঠে। সে মোহকে বুক থেকে উঠিয়ে তার মুখখানা দেখে। লালচে। নম্র। তার চোখ, ঠোঁট ফুলে উঠছে।
সমুদ্র তার গালে হাত রাখে, “প্লিজ মধু কান্না করো না। মাফ করে দেও। তুমি এমন করলে আমি কীভাবে থাকবো বলো।”
মোহ মুখ ফুলিয়ে তাকায় তার দিকে। কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “আপনি অনেক খারাপ। যেখানে আমি সারাজীবন কাঁদিনি সেখানে আপনি এই কয়মাসে কত কাঁদালেন! আপনার জন্য আমার এত কান্না আসে কেন?” তার মায়াভরা মুখের এমন অবস্থায় সমুদ্রের বুকখানা মোচড়ে উঠে। সে উন্মাদের মতো তার সারামুখে চুমু খেতে শুরু করে। কপালে, গালে, চোখে, নাকে। অবশেষে ঠোঁটে মধু সুধা পান করে দীর্ঘ সময় ধরে। মোহও তার মাঝে ডুবে যায়। কিছু মুহূর্তের জন্য ভুলে যায়, সমুদ্রের ভালোবাসা না পাবার ব্যর্থতা।

সকালে উঠে সমুদ্র দেখে মোহ তার পাশে নেই। ঘড়িতে দশটা বাজে। উঠে গোসল করে বের হয় নাস্তা করতে। তখন দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি চলছিল। মোহ তাড়াহুড়ো করে একটা পরোটা আর ডিমভাজি করে দিলো তাকে। সে যেতে নিলে সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়।
“কী?” মোহ পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে।
“কালকের মতো চুমুটা দেও না।”
“লজ্জা টজ্জা কী নেই? সবাই বাসায়। এসব কী বলছেন!”
“আচ্ছা চুমু না দিলে চা দেও।”
“আনছি। হাত ছাড়েন।”
মোহ জোর করে হাত ছাড়িয়ে গেল চা বানাতে। চা বানিয়ে এসে দেখে সমুদ্র খাওয়া শেষে চলে গেছে ডাইনিংরুম থেকে। সে রুমে যেয়ে দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে সমুদ্র। চা টেবিলে রেখে সে-ও বারান্দায় যায়। বলে, “আপনার চা টেবিলে রেখেছি।” বলে চলে যেতে নিলে সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়। হাতের সিগারেটটা ফেলে তাকে টান দিয়ে কোমর জড়িয়ে বলে, “রুমে তো কেউ নেই। এখন একটা চুমু দিয়ে যাও।”
“এত শখ হলো কেন আজ?”
“নেশা ধরে গেছে তোমার ঠোঁটের।”
মোহ উলটো তার মুখে হাত রেখে সরিয়ে দেয়, “সিগারেটের সাথে এই নেশা করাটা ভুল আপনার জনাব। আপনি সিগারেট ছাড়তে পাড়বেন না আর আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না। তাই আপনার চুমু খাওয়া বাতিল।”
মোহ তার এত সুন্দর ভাবনায় পানি ঢেলে হাসিমুখে চলে যেতে নিলে সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়, “কাল তো খেলে।”
” আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম। আবেগ কালকেই শেষ হয়ে গেছে।”
“মানে আমাকে নেশা লাগিয়ে তোমার আবেগ শেষ?”
“হ্যাঁ। মানুষ এক সময়ে একটা নেশাই করতে পাড়ে বুঝলেন?”
সমুদ্র মোহের কথার অর্থ যথার্থ ধরতে পাড়লো। এই মেয়ে এখন লেগেছে তার প্রাণপ্রিয় সিগারেটের পিছনে। ইচ্ছা করেই এমন করলো। তাই সে বিরক্তি নিয়ে উঁচু স্বরে বলল, “তুমি অনেক নির্দয় মধু।”
মোহও অন্যরুম থেকে উওর দিলো, “জানি।”
সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে আরেকটা সিগারেট বক্স থেকে বের করলে কিছু একটা ভেবে রেখে দেয়।

কিছুক্ষণ বাদেই উঁকি দেয় রান্নাঘরে। মা ও মোহ মিলে রান্না করলো। সমুদ্র পকেটে হাত দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, “কী করছ মা?”
তাকে রান্নাঘরে দেখে তার মা’য়ের সাথে সাথে তরকারি কুটতে বসা খালাও তাকিয়ে থাকে হা করে।
মোহ একপলক তাকে দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। ময়দার ডো করছে সে।
“তুই রান্নাঘরে?” অবাক কন্ঠে বলল।
“হ্যাঁ আমি। তোমরা এমন ভাবে তাকাচ্ছো কেন যে ভূত এসেছে?” সে তার মা’য়ের কাঁধে হাত রেখে চুলায় দেখে জিজ্ঞেস করে, “কী রান্না করছ?”
“কাচ্চি।”
“ওহ তোমার হাতের কাচ্চি সেই। জানো মধু মা সেরা কাচ্চি রান্না করে।”
মোহ তো তাও তার দিকে তাকায় না।
“এই মধু একটু ব্রাউনি বানিও তো ওদিনের মতো।” আবার তার ধ্যান নিজের দিকে ফেরানোর ব্যর্থ প্রয়াস।
মোহ তার দিকে না তাকিয়েই বলে, “ডার্ক চকোলেট এনে দিয়েন, বানিয়ে দিব।”
“আচ্ছা একটা জিনিস পাচ্ছি না। একটু এসো তো।”
“কাজ শেষে আসছি। আজ তো আর আপনার অফিস নেই যে তাড়া আছে।”
সমুদ্র আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলো। আর কী করার?

তার মা হেসে বললেন, “আগে সমুদ্র প্রতিদিন এসে এভাবেই উঁকি মেরে দেখতো কি রান্না করেছি। আজ ছয় বছর পর রান্নাঘরে এলো। তবে দেখার জন্য নয় যে কী রান্না করছি? তাই না মধু?”
মোহ চোখ বড় করে তার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার গাল দুটো লাল হয়ে গেছে।
মা বললেন, “জলদি যাও বেচারা কত আনবান করে তোমাকে ডাকছিল। তুমি তো তাকালেই না। দেখে আসো তোমার স্বামীর কী লাগবে।”
“এই ময়দা…”
“আমি করে নিব। তুমি যাও। আর আজ ছুটি আছে। ওকে বলে বাহিরে ঘুরতে যাও দুইজন।”
“জ্বি আম্মু।”
মোহ লজ্জা পেয়ে হাত ধুঁয়ে বেরিয়ে পড়ল।

রুমে এসে দেখে তাকে লজ্জা দিয়ে জনাব এসে বিছানায় পা’য়ে পা তুলে মোবাইল দেখছে। মোহ এসেই তার ফোন হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলে, “এই নিলজ্জ লোক আপনার কী ওখানে আসাটা এত বেশিই প্রয়োজনীয় ছিলো? জানেন আমি কত লজ্জা পেয়েছি।”
সমুদ্র তো মোহকে দেখে লাফিয়ে বসে। হাত ধরে তাকেও বসায়।
“তোমাকে কত ইশারা করছিলাম তুমি আমার দিকে তাকাও নি কেন?”
“কেন তা বলেন।”
“ডিল করতে।”
“ডিল?”
“হ্যাঁ ডিল। তোমার সিগারেট থেকে প্রবলেম রাইট? তাহলে সিগারেট খাওয়া কমিয়ে দিব।”
“আচ্ছা কয়টা কমাবেন?”
“এখন তো এগারোটা বারোটা খাই। দশটাতে কমিয়ে আনবো।”
তার কথায় মোহ মুখ বানিয়ে তাকায়। বলে, “থাক আপনার দ্বারা হবে না।” উঠে যেতে নিলে আবারও আটকায় সমুদ্র হাত ধরে বলে, “আচ্ছা বলো তাহলে কয়টা?”
“দিনে দুইটা সিগারেট খেতে পাড়বেন। কিন্তু আমাকে চুমু খাওয়ার আগে না। সকালে আর রাতে স্ট্রিক্টলিভাবে মানা।”
“তুমি এত নির্দয়া হতে পাড়ো না মধু। এই সিগারেট আমার দুঃখের সময়ের সবচেয়ে কাছের সাথী। তুমি এভাবে বলছ ছেড়ে দিতে?”
“থাক ছেড়েন না। তাহলে চুমু খাওয়ার ভাবনা ছেড়ে দিন।”
বলে আবার উঠতে নিলে সমুদ্র বলে, “আহা বারবার চলে যাচ্ছো কেন? দরদাম তো করতে দেও। দেখো হঠাৎ করে ছাড়া তো সম্ভব না। দুইটা করে ছাড়ি কেমন আটটা খাব নে এখন থেকে।”
“এখন ছয়টা প্রতি সাপ্তাহে দুইটা করে কমাবেন। একমাসে সিগারেট খাওয়া যেন বন্ধ হয়, নাহলে ওই বাসায় চলে যেয়ে একমাস থাকবো। আপনাকে ছাড়া। ঘুমিয়েন তখন বালিশ জড়িয়ে।”
“কী হাই লেভেলের হুমকি দেও তুমি। আচ্ছা আমি রাজি। তাহলে ছয়টা সিগারেটের বদলে ছয়টা চুমু দিবে?”
“দুইটা কেবল সকাল ও রাতে।”
“তোমার নীতি তো ভালো না দেখছি। নৈতিক বিচার করলে না। আচ্ছা যাই হোক তাহলে এখনেরটা দিয়ে যাও।”
সমুদ্র মোহের হাত টেনে তার গালের লাগা ময়দার গুঁড়ো আলতো করে পরিষ্কার করে দেয়। নেশাভরা কন্ঠে বলে, “আজ কী তোমায় সুন্দর লাগছে বেশি?”
“আপনার কাছে আমাকে সুন্দর লাগছে?”
“লাগছে তো।”
“কেন আগে না বলতেন আপনার কাছে সবাইকে একইরকম দেখায়। দুই চোখ, নাক, ঠোঁট। ”
“কিন্তু ক’মাস ধরে মনে হচ্ছে তোমার মাঝে মায়াদেবী এসে ভর করছে। তোমায় কেবল মায়াবিনী দেখায়।”
“আগে দেখাতো না?”
“উঁহু, না।”
মোহ ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসে।
সমুদ্র ঢোক গিলে একটা, “আমাকে বিরক্ত করতে চাইছ?”
সে মোহের থুতনিতে হাত রেখে তার ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দেয়। গতকালের অনুভূতিটা অনুভবের তীব্র আকাঙ্খা এসে ভর করে তার মাঝে। সে আবারও ঢোক গিলে সে ঠোঁটের সুধা পান করার ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে এগোয়। আর মোহ তার হাত রেখে দেয় তার মুখের উপর। তাকে সরিয়ে বলে, “অলরেডি সিগারেট খেয়েছেন তাই সকালের চুমু নাই। বাই।” বলেই দিলো এক দৌড়।

সমুদ্র তো হা হয়ে তার দৌড় দেখলো। তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে উঁচু স্বরে বলল, “তুমি ঠকবাজ হয়ে গেছ মধু।”
তার মধু দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, “জুম্মার নামাজে যাবেন। তারপর সবার সাথে বসে খাবেন। সবার সাথে সুন্দর মতো গল্প করবেন। তাহলে দুপুরে রুমে এসে ভাবতে পাড়ি।” এই বলে আবারও গায়েব হয়ে গেল।
.
.
লাল টিমটিমে র’ক্তিমা ছড়িয়ে রেখেছে আকাশের বুকেতে। সে রক্তিমা রঙা সন্ধ্যার ঝলক পড়ে ছোট এক পুকুরের জলে। জলে ভাসছে কতগুলো নৌকা। তার মাঝেই একদিকে মাঝি বৈঠা দিয়ে নৌকা চালাচ্ছে, অপরপাশে বসে আছে দুই মানব মানবী। নীরবতা বিরাজ করছে তাদের মাঝে। যা খুবই বিরল। মানবটি সামনে থেকে যেয়ে বসে মানবীর পাশে। চুপটি করে। তার হাতটা হাতে নেয়। আঙুলে আঙুল ডুবিয়ে মুঠোবন্দী করে নেয়। মানবীটি তাকায় তার দিকে। ভাবে কিছু বলবে। অথচ চুপটি করে তার কাঁধে মাথা রেখে আবারও তাকাল আসমানের দিকে। কেমন উদাসীন তার চেহেরা। মলিন কন্ঠে সে বলল, “এই হনুমান চেঁকামেঁকা জলদি এসে পড়বে কিন্তু…. ” তারপর চুপ করে গেল। কতগুলো মুহূর্ত কাটার পর বলল, “আমার কাছে। আমরা আবার এখানে আসবো সূর্যোস্ত দেখতে।”
.
.
রাত করে বাসায় এসেছে মহুয়া। আসার সময় নিয়ে এসেছে মৃণাকে। তার বাসায় যেয়ে। যেয়ে দেখাও করে এসেছে সবার সাথে। লামিয়ার সাথে তো তার সেই ভাব। দাওয়াতও দিয়ে এসেছে বাসায় আসার জন্য। পরীক্ষা দেখে লামিয়া আসতে মানা করল। পরের সাপ্তাহে যাবে মৃণার সাথে।

মুরাদ ডাইনিং টেবিলে মৃণাকে দেখে খুশি হয়। কেবল সে কেন মহুয়ার মা বাবাও অনেক খুশি। মহুয়ার মা তো মৃণা আসতেই তার পছন্দের চিংড়ি আনিয়ে রান্না করেছে।

মৃণাকে দেখার পর থেকে মুরাদের দৃষ্টি তার থেকে সরছেই না। কিন্তু এদিকে মৃণা তার দিকে একপলকের জন্যও তাকায় না। এড়িয়ে যায়। কেবল ডাইনিং টেবিলের কথা হলে তাও সে বুঝতো। রাতে মৃণা বড় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছিল আকাশে ছড়িয়ে থাকা কিছু টিমটিমে তারা। অথচ মুরাদের আসার আভাসেই এক দৌড়ে পালালো। মুরাদ এই দেখে হতবাক। তবুও সে ভাবলো হয়তো তার কোথাও ভুল হচ্ছে। অথচ না, সকালেও মুরাদকে দেখে সেখান থেকে চলে গেল সে। দুপুরেও খাবারের টেবিলে তাকাল না। এবার রাগ উঠলো মুরাদের। মেয়েটার সমস্যা কী? এমন আজব ব্যবহার করছে কেন?

সেদিনই বিকেলে যখন মুরাদ নিচে বসে টিভি দেখছিল। মহুয়াও এলো তার চিপ্স নিয়ে। তার কার্টুন দেখার সময় হয়েছে। টিভির রিমোট চাইলে একটা মিরেকাল হয়। একবার বলায় মুরাদ তাকে রিমোট দিয়ে উঠে চলে যায়।
মহুয়া এই দৃশ্য তার উনিশ বছর জীবনীতে দেখে নি। সে হা করে মুরাদের যাওয়া দেখে তারপর তাকে বাদ দিয়ে তাকায় টিভির দিকে। চিপ্স খেতে খেতে তার কার্টুন দেখে।

মৃণা পড়ছিল টেবিলে বসে। নেক্সট সেমিস্টারের পড়া বই পেতেই সে শুরু করে দিলো। পড়ার মাঝে নক শুনে সে তাকায় ফিরে, দরজার দিকে। দেখে মুরাদ খোলা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বুকের উপর ভাঁজ করা। সে তাকালে বলল, “গতকাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
মৃণা এত জলদি উঠে যে তার চেয়ারটাও পড়ে যায় নিচে। সে আমতা-আমতা করে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল,কিন্তু কোনো কথা বের হলো না। সে চেয়ারটা তুলে ঠিক করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর দ্রুত তার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “মহুয়া নিচে। আমি ওকে ডেকে আনছি।”
সে দ্রুত পালাতে চায় সেখান থেকে। তাইতো দৌড়ে যেতে নেয়।
ঠিক সময়ে মুরাদ তার বাহু ধরে নেয়। তাকে ধরে ঘুরিয়ে দরজার সাথে চেপে ধরে। এক হাত তার কাঁধের পাশে রেখে তার দিকে ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করে, “এখনো পালাচ্ছিস? সমস্যা কী?”
মৃণা চোখ লুকায়, “কি…কিছু না।”
“কেউ কিছু বলেছ?”
মৃণা এবার তার দিকে তাকায়। চশমার পিছনে থাকা সে গভীর দৃষ্টি তার বুক কাঁপিয়ে তুলে। সাথে সাথে চোখজোড়া সরিয়ে নেয়। উওর দেয় না।
মুরাদ আবারও প্রশ্ন করে, “কিছু জিজ্ঞেস করছি।”
মৃণার তার বাহু থেকে মুরাদের হাত সরানোর চেষ্টা করে, “কেউ দেখে নিলে সমস্যা হবে মুরাদ ভাই। ছাড়ুন।”
“কী সমস্যা হবে শুনি?”
“কলঙ্কিত হবো আমি। আপনি কেন নিজের মতো সব করতে চান বলেন তো? সেদিন আমি মানা করেছিলাম আপনার আমাকে বাসায় দিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপনি শুনলেন? শুনলেন না। সেখানে থাকা দুই আপু আমাকে কী বলেছে জানেন? জিজ্ঞেস করছিল আমি কীভাবে এত দামী গাড়িতে চড়ে আসি? আমি কী কোনো খারাপ কাজ….” কথাটুকু মুখ দিয়েও বের হলো না মৃণার।

কিন্তু এহেন কথায় মুরাদের মাথা ঠিকই গরম হলো। সে হাত মুঠোবন্দী করল আর চোয়াল শক্ত। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মৃণার দিকে, “আর তুই চুপচাপ শুনেছিস?”
মৃণা মাথা নিচু করা অবস্থাতেই নাড়ায়, “না ওয়ার্নিং দিয়েছি।”
“তুই?” মুরাদের এবার সত্যিই চমকিত হয়। সাথে সাথে একগাল হেসে বলে, ” গুড। প্রাউড অফ ইউ। আমি এটাই চাই যে তুই লড়তে শিখিস। মানুষ কথা বলবেই। তাদের কাজই এটা। মানুষের সবচেয়ে পছন্দ কাজ কী জানিস? অন্যের জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি করা। তাদের জন্য নিজেকে তো আর বন্দী করে রাখতে পাড়বি না তুই। এভাবেই লড়াই করতে হবে।”
এইবার মৃণাকে সত্যিই বিরক্ত দেয়খায়। সে মুরাদের দিকে তাকায়, “কতজনের সাথে? সবাই তো আপনার এমন ব্যবহার দেখে কথা বলবেই। কতজনকে চুপ করাব?”
মুরাদ তাকায় তার দিকে নরম দৃষ্টিতে। বলে, “চুপ করাতে না পাড়লে আমার বউ হয়ে যা। বিয়ে করবি আমায়?”
কথাটা শুনে মৃণা চমকিত হয়ে তাকাল মুরাদের দিকে। সে দৃষ্টিতে যেন অনুভূতির সাগর ভাসছে। কিন্তু সে চাইলেই তো সে সাগরে ডুব দিতে পাড়ে না। এই সাগর তার নাগালের বাইরে। এই সাগরে ডুব দেওয়া তো দূরের কথা, ছোঁয়ার সামর্থ্যও তার নেই।
সে চোখ নামিয়ে নেয় অসম্মতিতে।
তখন মৃদু শব্দ শুনে কিছু একটা পড়ার। আচমকা পাশে তাকিয়ে দেখে মহুয়া দাঁড়ানো। তার হাত দুটো হাওয়ায়। চিপ্সের প্যাকেট পড়ে গেছে মেঝেতে। সে হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

অন্যদিকে মুরাদ ও মৃণাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মৃণার হুঁশ ফিরলে সে একবার তাকায় মুরাদের দিকে। এত কাছে তাকে দেখে সাথে সাথে ধাক্কা দিয়ে সরায় তাকে। দ্রুত যায় মহুয়ার কাছে। তার হাত ধরে বলে, “মহু…মহু তুই যেমন ভাবছিস এমন কিছু না। ভাইয়া…ভাইয়া যাস্ট অফিসের কথা বলছিল।”
মহুয়া ড্যাবড্যাব করে তাকায় তার দিকে, “এভাবে অফিসের কথা বলছিল?”
মৃণা চিন্তায় এক ঢোক গিলে, “আমি ভাইয়াকে মানা করেছিলাম। আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি। তুই চিন্তা করিস না আমি ভাইয়ার আশেপাশেও আর আসবো না। প্রয়োজনে চাকরি থেকেও রিজাইন করে দিব। তুই রাগ করিস না শুধু। তুই রাগ করলে আমি কীভাবে থাকবো।”
“রাগ?” মহুয়া ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে। মৃণার হাত ঝাড়িয়ে সে যায় মুরাদের সামনে। মুরাদ তখনও পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “এসব কী ভাইয়া? তুমি কী মৃণাকে পছন্দ করো? সত্যি বলবে।”
“হ্যাঁ।”
“না।” মৃণা বলে, “এমন কিছু না।”
“কবে থেকে?”
“ওর যেদিন বয়স ষোলো হলো।”
মহুয়া আবার মৃণার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। গম্ভীরমুখে তাকায় তার দিকে, “ভাইয়া তোকে পছন্দ করে। তুই জানতি?”
“বিশ্বাস কর দোস্ত আমি জানতাম না। কয়মাস আগে বলল সত্যি। তখন থেকে আমি নিজ থেকে ভাইয়াকে এড়িয়ে যাচ্ছি।”
“কেন?”
“কী?”
“এড়িয়ে যাচ্ছিলি কেন?”
মৃণা প্রথমে প্রশ্নটা ধরতে পাড়ে না। তারপর আমতা-আমতা করে বলে, “পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তোকে আর মোহকে হারাতে পাড়বো না।”
“তাহলে আমার জন্য এক কাজ কর।”
“তুই বল আমি সব করতে পাড়ব। আমার জীবনও তোর জন্য হাজির।”
“তাহলে সারা জীবনের জন্য আমার ভাবি হয়ে যা।”
“হেঁ?” মৃণা যেন আকাশ থেকে পড়ে প্রস্তাব শুনে।
তার বুকে উঠার আগেই মহুয়া তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লাফাতে লাফাতে। বলে,”ওয়াও কী জোস! তুই আমার ভাবি হবি। আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো। এক বাড়িতে। আমার তো মিষ্টি খাইতে মন চাইতেছে।” সে আবার মৃণাকে ছেড়ে তার কাঁধে হাত রেখেই তাকায় মুরাদের দিকে একবস্তা ভাব নিয়ে তাকায় মুরাদের দিকে, “তখন আমার এই খারুশ ভাই বোন হিসেবে বকতেও পাড়বে না সারাদিন। তখন তো শালীও হবো। আমার আবদার পূরণ না করলে তোরে নিয়ে আইসা পড়ব। আহ কী জীবন! আমার তো লটারি লেগে গেছে। আমি এখনই মোহকে কল দিয়ে ওকে আনিয়ে এই নিউজ দেই।”
মহুয়া ফুরুৎ করে রুমে ঢুকে গেলে মৃণা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

মুরাদ হেসে পকেটে হাত রেখেই তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে হা করে থাকতে দেখে থুতনিতে আঙুল দিয়ে মুখ বন্ধ করায়। ধ্যান ভাঙলে মৃণা তাকায় তার দিকে। মুরাদ বলে, “তোমার ননদ তো রাজি। তাহলে কী কাজি ডাকব?”
“কী যা তা বলেন মুরাদ ভাই।” মৃণা বিরক্তি নিয়ে গেল মহুয়ার পিছনে।
.
.
মোহ টেবিলে বসেছিল। লিখছিল তার ডায়েরিতে। আচমকা তার লেখার মাঝেই সমুদ্র পিছন থেকে এসে ডায়েরিটা নিয়ে নিলো। ডায়েরিটা নিয়ে পড়তে শুরু করে,
“তখন আমি উনিশ বছরের যুবতী তুমি আটাশ বছরের যুবক। না ছিলো মিলনের কথন, না হবার ছিলো তোমার আমার আখ্যান। আচ্ছা কখনো ভালোবাসার হবে এই উপাখ্যান? অজান্তে মানুষ ডুবে কখনো মোহের সমুদ্রে, যেখানে নেই কোনো প্রেমের সৌরাজ্য?”
এতটুকুই লেখা ছিলো। যা দেখে সমুদ্র কপাল কুঁচকায়, “এসব কী লিখেছ?”
“কিছু না।”
সমুদ্র ডায়েরির প্রথম পেইজে দেখতে পায় দু’টো শব্দ, “মোহের সমুদ্র।”
সে হাসে শব্দ দু’টো দেখে, “এসব কী যা তা লিখছো তুমি?”
এই কথা শুনে মোহ তো রেগে যায়। সে ডায়েরিটা খপ করে সমুদ্র থেকে নিয়ে বলে, “আপনি অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস এভাবে পড়বেন কেন?”
সমুদ্র খানিকটা ঝুঁকে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “তুমিই তো সম্পূর্ণ আমার তাহলে তোমার আলাদা ব্যক্তিগত জিনিস হয় কীভাবে?”
মোহ হাসে তার কথা শুনে। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠে। এসময় মহুয়ার কল দেখে সে জলদি করে রিসিভ করে, “হ্যালো বল দোস্ত।”
“জলদি বাসায় আয়। এক্ষুণি।”
“এখন?”
“হ্যাঁ এখনই। অনেক জরুরি কথা আছে।”
মোহ অবাক হয় যদিও, তাও আসতে রাজি হয়ে যায়। সমুদ্রকে জানালে বলে, “চলো তাহলে। আমি তোমাকে বাইকে দিয়ে আসবো। তারপর আমি নাহয় আড্ডা দিতে গেলাম। তোমাদের গল্প শেষ হলে কল দিবে আমি নিয়ে আসবো তোমাকে। আসার সময় ডিনার করে আসবো বাহির থেকে।”
কথাটা মন্দ লাগে না মোহের। সে দ্রুত গেল তৈরি হতে। উৎসুকভাব নিয়ে। তৈরি হয়ে এলো জলদিই। সমুদ্রের পছন্দের কালো কামিজ পরেছে সে। অথচ তার সাদা ও কালো একটুও পছন্দ না। ফিকে লাগে তার কাছে। তার কাছে রঙিন সবকিছু পছন্দ। অথচ তার আজকাল সাদা ও কালোই পরা হয় বেশি। সমুদ্রের পছন্দ যে। একসময় নিজের পছন্দ থেকে নিজের ভালোবাসার মানুষের পছন্দটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।

মোহ তৈরী হয়ে এসে দেখে সমুদ্রও তৈরি হয়ে নিয়েছে। সে-ও কালো শার্ট পরে নিয়েছে। মোহ তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তার কলারটা ঠিক করতে করতে লজ্জামাখা মুখে বলে, “হ্যান্ডসাম লাগছে।”
“আমাকে তো সবসময়ই হ্যান্ডসাম দেখায় মেডাম।”
মোহ হাসে।
সমুদ্র বলে, “তো তোমার ডায়েরির নামটায় কী মধুর সমুদ্রে চেঞ্জ করা যাবে? আংকেলের থেকে আমার দেওয়া নামটা বেশি সুন্দর। একদম তোমার সাথে মিলে। দেখো মধুর মতো মিষ্টি দেখাচ্ছে তোমায়।”
“এত চিজি লাইন। ইশশ!” আবারও মোহ বলে, “শুনেন আপনি কী আপনার বন্ধুদের আড্ডা দিতে আসতে বলেছেন?”
“না কেন?”
“তাহলে বাসার ভেতরে এসেন। শুনলাম মুরাদ ভাইয়া আপনার জুনিয়র ছিলো।”
“আমার?” সমুদ্র অবাক হলো। তারপর বলল, “তাহলে তো দেখা করতে হয়। নামটাও চেনা লাগছে। যাওয়ার সময় ফল মিষ্টি নিয়ে যাব তাহলে। প্রথমবার যাচ্ছি।”
মোহও সম্মতি দেয়। তারা তৈরি হয়ে বের হতে নিবে এমন সময় ফোন আসে সমুদ্রের। সে ভাবে এখন কলটা কেটে দিবে কিন্তু নাম দেখে থেমে যায়। সে মোহকে বলে, “একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।”
“অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু?”
“না।”
“তাহলে পড়ে কথা বলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।”
“একটু আসছি।”
মোহ তার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলল, “ওখানে যেয়ে কথা বলতে…” সে স্ক্রিনে নাম দেখে থমকে যায়।
“Jobaful” নাম ভেসে উঠে স্ক্রিনে।
সমুদ্র খপ করে তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “এভাবে কারো ফোন নেয় কেউ? ব্যক্তিগত স্পেস আছে সবার।”
মোহ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের দিকে। দেখে তাকে ফোন কানে নিয়ে বারান্দায় যেতে।
সেখানে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মোহ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। তার শাশুড়ীকে জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে মহুয়ার বাসার উদ্দেশ্যে।

প্রায় আঠারো মিনিটের কথা বলার পর সমুদ্র রুমে আসে।
“মধু এখন চলো…”
সমুদ্র রুমে এসে মোহকে আর দেখতে পায় না। সে তাকে ডাকতে ডাকতে বের হলে তার মা এসে জিজ্ঞেস করে, “কিছু হয়েছে?”
“মধুকে পাচ্ছি না।”
“ও তো বাহিরে গিয়েছে মিনিট দশ পনেরো হবে। তোকে বলে নি?”
সমুদ্রের কপাল কুঁচকায়, “আমাকে ছেড়ে চলে গেছে? ওর তো আমার সাথে যাবার কথা ছিলো। একটা ফোন এলো বলে ওকে বললাম দাঁড়াতে। দশ মিনিট অপেক্ষা করতে পাড়লো না।”
“এটা কেমন কথা। কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতেই পাড়ে। দশ মিনিটই তো। তোকে ছেড়ে… ” হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। তারপর প্রশ্ন করলেন, “কার কল ছিলো?”
“জবাফুলের।”
তার মা’ও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালেন সমুদ্রের দিকে। এই কয়মাসে সমুদ্রের পরিবর্তন দেখে তিনি ভেবেছিলেন সমুদ্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাদের সাথেও এখন আগের মতো স্বাভাবিক হয়েছে সমুদ্র। তাদের সাথে সময় কাটায়। টুকটাক অফিসেও যায়। সব কৃতিত্ব মোহের। অথচ যে মেয়ের কারণে তার জীবন ধ্বংস হয়েছে তার জন্য আজ এই ছেলে মোহকে কষ্ট দিয়েছ। আবার বুঝতেও পাড়ছে না নিজের দোষ।
সে বিরক্ত হয়ে জোর গলায় বলে, “মানুষ ঠিকই বলে কুত্তার পেটে ঘি হজম হয় না।”
“মা! এসব কোন ধরনের কথা? ঘরের বউকে কেউ এভাবে বলে?” উঁচু স্বরে বলে সমুদ্র। তার মা আরও গলা উঁচিয়ে বলেন, “তোকে বলছি হতচ্ছাড়া। তোকে বলে দিচ্ছি তোর জন্য যদি মোহ রাগ করে তাহলে ওকে রেখে তোকে ঘর থেকে বের করে দিবো। ওই মেয়ের জন্য নিজের জীবন একবার নষ্ট করে তোর শান্তি হয় নি? নিজের সাথে আমাদের জীবনের শান্তিও নষ্ট করেছিস। আবারও উঠেপড়ে লেগেছিস নিজের গুছানো জীবন নষ্ট করার জন্য।”
“উফফ মা এমনিতেই মধুর জন্য মেজাজ খারাপ। এই সন্ধ্যায় কেউ একা বের হয়? যদি ওর কিছু হয়ে যায়?”
“তাহলে ওকে অপেক্ষা করিয়ে ওই দু’মুখো সাপিনীর সাথে কথা বলতে কে বলেছ তোকে?”
“মা প্লিজ!” এবার গর্জে উঠে সমুদ্র, “তোমাদের সাথে এজন্যই কথা বলতে চাই না আমি। যখন কথা না বলতাম তখনই ভালো ছিলো।”
“বলিস না। তোকে তো একারণেই এত আল্লাহর কাছে কান্না করে চেয়েছিলাম আমি। যেন একদিন এমন এক মেয়ের জন্য নিজের মা বাপের সাথে বেয়াদবি করিস যে তোর কঠিন দিনে তোকে ফেলে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে করেছে। হাতে হীরা এনে দিলেও গোবরেই হাত মাখবি।”
সমুদ্র রাগে গর্জে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তার আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

চলবে….

মেঘের খামে…
পর্ব ৩৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মোহ রুমে বসে আছে মৃণা ও মহুয়ার সাথে। দুইজনকেই তার কাছে আজ স্বাভাবিক আবার আজব লাগছে। মৃণা চুপচাপ তবুও আজ তাকে অতিরিক্ত চুপচাপ দেখাচ্ছে। তার মুখেও কেমন চিন্তা স্পষ্ট। অন্যদিকে মহুয়াকে বেশিই উৎসুক দেখাছে। তাকে এমন তখন দেখা যখন সে কোনো বোম্ব ফাঁটায়। তাই সে সরাসরি মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে, “কী ধামাকা করবি সরাসরি বল। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।”
“আমার কী এত কন্ট্রোল আছে না’কি? ফোনে তোকে এতক্ষণ কীভাবে বলিনি আমি জানি। জানিস কী চলছে?”
“তুই জাহান ভাইয়ের প্রাপোজাল এক্সেপ্ট করে নিয়েছিস?”
তার নাম শুনতেই মহুয়ার মুখ চুপসে গেল। সে নিজের বাম হাতের অনামিকা আঙুলের আংটিটা স্পর্শ করে বলে, “এমন কিছু না।”
“এই এক মিনিট…তুই লজ্জা পাচ্ছিস?”
“আমার কথা শুনবি। হট নিউজ। যা তুই কল্পনাও করতে পাড়বি না।”
“কী?”
“মুরাদ ভাইয়া…”
“মুরাদ ভাইয়ের কী হয়েছে?”
“মুরাদ ভাইয়া প্রেম করে।”
“এজন্য তো সন্ধ্যায় এত তাড়া দিয়ে আমাকে ডেকেছিস। করতেই পাড়ে। এই বয়সেও কী ভাইয়া একটা প্রেম করবে না? আজব।”
“গেস কর কার সাথে করে?”
“আমি কী ভাইয়ার চেনা সবার সাথে পরিচিত না-কি যে আমি…”
“শুধু পরিচিত না তোর অনেক কাছের?”
“আমার কাছের?”মোহ অবাক হয়। তার বে, “ভাইয়া আর আমার পরিচিতদের মধ্যে কেবল রয়েছে তুই আর মৃ….” সে হঠাৎ থমকে যায়। মৃণার দিকে তাকায়। এই কথা সে কল্পনাতেও ভাবতো না কিন্তু তার মুখের ভাবসাব দেখে তার মৃণার নামটাই মাথায় আসে। তাকে হা করে মৃণার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহুয়া এক লাফে তার কাছে যায়। তার মুখ বন্ধ করে বলে, “আমারও সেইম রিয়েকশন ছিলো জান। তুই তো তারপর শুনেছিস। আমি তো লাইভ রোমেন্টিক সিন দেখেছি। উফফ আমার তো বলতে লজ্জা লাগতেছে যত যাই হোক আমার ভাই তো।”
মৃণা তো লজ্জায় সম্পূর্ণ লাল হয়ে যায়৷ এরা কীসব কথা বলছে!
মোহ তো মৃণার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “কবে থেকে চলছে এসব? জলদি বল। আর তুই আমাদের আগে জানাস নি কেন?”
“আরে কিছুই চলছে না।”
মহুয়া তখন কথাটার বিরোধিতা করে, “ঠাডা মিথ্যা কথা। আরে জানিস মৃণাকে দরজায় ঠেকিয়ে ভাইয়া তার সামনে এক হাত কাঁধের পাশে রেখে ওর দিকে ঝুঁকে…”
“তোর না লজ্জা লাগছিল একটু আগে। তোর আপন ভাই হয় গাঁধি।” মোহ তাকে মনে করায়।
“ওহ হ্যাঁ।” মহুয়া এবার ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ বসে।

মৃণা জানায়, “সত্যিই এমন কিছু না।”
“ভাইয়া নিজে বলেছে ওকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়।” মহুয়া আবারও বলে, “তাও এখন থেকে না চার বছর আগে থেকে।”
“বলিস কী!” মোহের কন্ঠে স্পষ্ট বিস্ময়।
“এজন্যই তো বলি আমার ভাইয়ের এত বয়স হয়ে যাইতেছে একটা প্রেম করে না কেন? এখন বুঝলাম কেন? সে তো আমাদের মৃণুর প্রেমে লাড্ডু ছিলো। দোস্ত চিন্তা কর ভাইয়ার সাথে মৃণার বিয়ে হলো। তারপর গুনি গুনি কতগুলো বাবু হবে আমি ফুফু হবো। দোস্ত আমার ভাই আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বেবি। আমি তো ভেবেই ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি।”
মৃণা অবাক হয় তার কথা শুনে। এর থেকে বেশি অবাক হয় তার চিন্তায়। এত দূরের চিন্তা কীভাবে করে মেয়েটা?
সে সরাসরি বলে দেয়, “ভাইয়ার সাথে আমার কিছু হওয়া অসম্ভব। দিনে স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর।”
“কেন? তুই অন্যকাওকে পছন্দ করিস? ডোন্ট টেল মি তুই তন্ময়কে এখনো ভুলতে পাড়িস নি। ছয় মাস হয়ে যাচ্ছে।”
“এমন কিছু না। ও যেভাবে আমাকে অবহেলা করেছে, আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, এমনকি বুশরা আপুকে মিথ্যা বলেছে যে আমি ওর পিছনে পড়ে ছিলাম।আমাকে কত ছোট করেছে। ওর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি থাকলে নিজের সাথে অন্যায় করব।”
“তাহলে বল আমার ভাই কোনদিক থেকে খারাপ? আমার ভাই হ্যান্ডসাম আছে, মাশাআল্লাহ ভালো ব্যবসা আছে, ভালো ফ্যামিলির। মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। যে বয়সে মানুষ বাবার টাকা উড়ায় সে বয়সে ভাইয়া দিন রাত কিছু না মেনে পরিশ্রম করেছে। এমন ছেলে তুই কই পাবি বল? প্রেশার দিচ্ছি না যে তোর আমার ভাইয়ের সাথেই বিয়ে করতে হবে। কিন্তু আমি এটা জানি ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ে হলে এই দুনিয়ার কোনো দুঃখ তোকে ছুঁতেও পাড়বে না। তোকে সবদিক থেকে রক্ষা করবে। তোর সারাজীবনের পাওয়া দুঃখগুলোও মিটিয়ে দিবে।”

মৃণা বলতে চায়, “এটাই তো সমস্যা। তার সাথে আমার কোনোদিক থেকেই মিল নেই। না রঙ, না রূপ, না অর্থে আর না বংশে।” তবে কথাটা মুখে আনার সাহস করে না সে। এসব মোহ আর মহুয়ার সামনে বললে তাকে মে’রেই ফেলবে। তাদের কাছে সে পার্ফেক্ট। কারণ তারা মৃণাকে ভালোবাসে। কিন্তু দুনিয়ায় কাছে সে পার্ফেক্ট না। সে এই দুনিয়ার কাছে কিছুই না। সে মূল্যহীন। মুরাদ নিজের মতো সুন্দর আর সফল কাওকে যাওয়ার যোগ্য। তার মতো মূল্যহীন কাওকে নয়। কিন্তু কথাগুলো সে মুখ দিয়ে বলে না। মহুয়াকে আর কিছুই বলে না। একসময় যখন মুরাদ ভাই নিজের মতো কাওকে পেয়ে আবেগ ভুলিয়ে দিবে তখন মহুয়াও এইসব ভুলে যাবে। তাই কথাটা বাড়ায় না সে। সে হেসে মাথা নাড়ায় মহুয়ার দিকে।

মহুয়া তো সম্মতি পেয়ে অনেক খুশি। কেবল নিজের ভাইয়ের প্রেম পাওয়ার জন্য নয়। মৃণা অবশেষে একটা পরিবার পাবে, একটা ভালো কাওকে জীবনসাথী হিসেবে পাবে এই ভেবেই তার হৃদপিণ্ড উষ্ণতায় ভয়ে যায়। মৃণাকে নিয়েই তারা চিন্তায় থাকতো। মোহ আর সে নিজে নিজের জন্য লড়াই করতে জানলেও মৃণা জানতো না। তাদের পিছনে নিজের পরিবার থাকলেও মৃণার সাথে সে আর মোহ ছাড়া কখনো কেউ ছিলো না। সে নিশ্চিত, মুরাদ ভাই যেহেতু তাকে ভালোবাসে সেহেতু সে নিজেই মৃণাকে রক্ষা করবে আবার নিজেকে রক্ষা করা শিখাবে।

মহুয়া খুশি মনটা হঠাৎ উদাসীন হয়ে পড়ে। তার হঠাৎ মনে পড়ে কিছু। সে চিন্তিত ভাব নিয়ে বলে, “সব ঠিক আছে কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”
“কী?” প্রশ্ন করে মোহ।
“তুই আর মৃণা আমার বেস্টু। তোদের দুইজনের বাচ্চার খালা হইতাম আমি। এখন যদি মৃণার বাচ্চা আমাকে ফুফু কয় তার মানে কেবল তুই-ই আমার একমাত্র আশা খালা হওয়ার।” মহুয়া খপ করে মোহের হাত ধরে বলে, “মোহ জলদি আমার খালা বানিয়ে দে।”
মোহ যেন আকাশ থেকেই পড়ে তার কথা শুনে।

মোহ শক খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলে, “তুই কী আসলেই পাগল হয়ে গেছিস? কী উল্টাপাল্টা কথা বলছিস?”
“ছয়মাস হলো বিয়ে করেছিস আমাকে একটু খালা বানাতে পাড়বি না? কত নির্দয় তুই। আমার জন্য এতটুকু করতে পাড়বি না তুই?”
মহুয়া যেন এলিয়েন ভাষা বলছে এমনভাবে তাকিয়ে রইল মোহ তার দিকে। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠে। দেখে সমুদ্র কল দিয়েছে। তার মেজাজ খারাপ হলো। এতক্ষণে সমুদ্র সময় পেল তাকে কল দেওয়ার? অবশেষে তার জবাফুলের সাথে কথা শেষ হয়েছে? সে সমুদ্রের সাথে কথা বলতেই চাইল না। সে ফোন কেটে দিতে চাইলে মহুয়া তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করে।

মহুয়া তো উৎসুক হয়ে কল ধরে। সমুদ্র ফোনের ওপাশ থেকে প্রশ্ন করে খিটখিটে মেজাজে, “মধু তুমি আমাকে রেখে এভাবে চলে গিয়েছিলে কেন? দশ মিনিট অপেক্ষা করলে কী হতো বলো তো?”
“আপনার মধুর মহুয়া বলছি দুলুভাই। আপনাকে রেখে এসেছে এর খবর ওর থেকে পড়ে নিচ্ছি আগে আপনি নিজে শালীসাহেবার সাথে কথা বলুন।”
“তো শালীসাহেবা বলুন, কী খবর আপনার?”
“খবর তো ভালো না। বেশ চিন্তায় আছি।”
“আমি থাকতে আমার শালীসাহেবার চিন্তা হবে? অসম্ভব। আমাকে বলো, আমি তোমার চিন্তা দূর করার যথাযথ চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা না দুলুভাই আপনিই পাড়বেন আমায় চিন্তামুক্ত করতে।”
“বলে দেখো।”
“আমাকে দ্রুত খালামণি বানিয়ে দিন।”
তার কথায় মোহ ও মৃণাও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তারা মোটেও ভাবে নি মহুয়া আসলে কথাটা সমুদ্রকে বলবে।

মোহ দ্রুত তার হাত থেকে ফোন নিতে চাইল কিন্তু মহুয়া এক লাফে নিচে নেমে গেল। আবারও প্রশ্ন করল, “দুলুভাইয়া দিবেন তো? আপনিই আমার শেষ আশা ভরসা।”
সমুদ্র ফোনটা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বোকা বনে গেছে সে মহুয়ার কথায়। কী উওর দিবে ভেবে না পেয়ে সে কলই কেটে দিলো।

মহুয়া কথা বলতে থাকে কিন্তু কোনো উওর আসে না। সে দেখে কল কেটে গেছে। মহুয়া মোহকে ফোন ফেরত দিয়ে বলল, “কী ফালতু ফোন তোর! কথার মাঝখানে কল কেটে যায়।”
মোহ একবার তার ফোনের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে। সমুদ্র কথাটা না শুনলেই হলো।

আধা ঘন্টা থেকেই মোহ বের হয় বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে। যদিও মুরাদ তাকে দিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মোহ জানাল সে একা যেতে পাড়বে। সে সামনে থেকে রিক্সা নিয়েই যেতে পাড়বে। মহুয়ার বাসার গলি থেকে বের হতেই অনেক রিকশা পাওয়া যায়। সেদিকে যাবার পথেই সে দেখে সমুদ্র তার বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বাইকে বসে বুকের উপর হাত ভাঁজ করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সরাসরি।

মোহ তাকে দেখেও এড়িয়ে যেতে চাইল। তার পাশ কাটিয়ে যেয়ে নিলে সমুদ্র লাফ দিয়ে বাইক থেকে নেমে তার হাত ধরে নেয়।
“কি সমস্যা তোমার? এমন করছো কেন?”
মোহ তাকায় তার দিকে। কঠিন গলায় বলে, “হাত ছাড়ুন।”
” না ছাড়লে কী করবে? তুমি বুঝেছ যে আমি তোমার জন্য দুর্বল তাই বলে আমাকে এভাবে ঘুরাও তাই না? তোমার কথামতো সব কিছু করছি আমি। অফিস থেকে শুরু করে বাসায় পর্যন্ত। সিগারেট ছাড়ারও চেষ্টা করছি। তুমি দশমিনিট আমার জন্য অপেক্ষা করতে পাড়ো নি?”
“আচ্ছা আমার কথায় সব করেন? আজ বলেছিলাম জুম্মান নামাজ পড়তে পড়েছিলেন? আমি বলেছিলাম আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তাও আপনি কলটা ধরলেন। এতক্ষণ কথা বললেন।”
“কারণ ওটা জবা ছিলো। ওর প্রয়োজন ছিলো।”
“তাহলে ওর কাছেই যান। এক কাজ করুন আপনারা সারারাত কথা বলুন। আজ কেন আরও দশদিন বলুন। আমি আমাদের বাসায় যাচ্ছি।”

মোহ আবার যেতে নিলে সমুদ্র তার ধরা হাত হাল্কাভাবে মুচড়ে তার পিঠের সাথে মিলিয়ে নেয়। তার কাছে এসে অন্যহাত তার পিঠে রেখে তাকে কাছে টেনে আনে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলে, “ইমার্জেন্সি ছিলো মধু। বুঝতে পাড়ছ না কেন?”
“আমি বুঝতে চাই না। হাত ছাড়ুন। মাঝরাস্তায় এসব সভ্য বাসার ছেলেরা করে না।”
মোহ তার চোখে চোখ রেখে কঠোর গলায় বলে।

তার কথায় সমুদ্র তার হাত ছেড়ে দেয়। কিন্তু তাকে বেশি দূরে যেতে দেয় না। সে বলে, “তুমি তাহলে আমার কথা শুনবে।”
“বলুন।” মোহও রাজি হয়।
“জবা…ওর হাসবেন্ড কারিম ওকে ফিজিক্যাল এবিউস করে মাঝেমধ্যে। হঠাৎ কোনো সিরিয়াস ইমার্জেন্সি হয়ে গেলে এজন্য আমি কল এত দ্রুত ধরেছিলাম।”
কপাল কুঁচকে তাকায় মোহ, “তাহলে এমন মানুষের সাথে থাকছে কেন?”
“ওর মা বাবার জন্য। তারা বলেছে এখান থেকে আসলে ওর চেহেরাও দেখবে না।”
“মানে আপনারা এত বয়স হবার পরও একজন মেয়ের উপর ফিজিক্যাল এবিউস হয় তাকে হেল্প করতে পাড়বেন না। আর সে মেয়ে এত পড়াশোনা করার পরও এবিউস সহ্য করে থাকছেও। তাও এই যুগের মেয়ে হয়ে। অনেক বিশ্বাসযোগ্য সত্যিই।”
“জবা সমসময় এমন ছিলো। চুপচাপ, শান্ত, ভীষণ নরম প্রকৃতির মানুষ। সবাই তো আর একরকম হয় না যে প্রতিবাদের ক্ষমতা রাখবে।”
মোহের তখন মৃণার কথা মনে পড়ে। সত্যি তো সবার পরিস্থিতি এক হয় না। তাই সে কথা বাড়ায় না।
সে বলে, “আচ্ছা, সরি। না বুঝে আমারও রাগ করে আসা উচিত হয় নি।”

সমুদ্র নিজের প্রতি অবাক হয়। একটু আগে তার মা’য়ের সাথে রেগে সে বাসা থেকে বের হলো, বের হয়ে লামিনকে কল দিয়ে রাগে অকারণে চিল্লাচিল্লি করল। অথচ মোহ সামনে আসতেই তার রাগ বিলিন হয়ে গেল কীভাবে? মেয়েটা কী জাদু জানে?
সে হেসে বলল, “আসো, প্লানমতো ডিনারটা করে যাব।”
“উঁহু, এখন ফুসকা খেতে মন চাচ্ছে। তারপর অফকোর্স আইস্ক্রিম।”
“যা তোমার ইচ্ছা। বাইকে উঠো।”
মোহ বাইকে উঠতে উঠতে বলল, “আপনি আমার জন্য তো এতকিছু করলেন। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা ছিলো আমার হাসবেন্ড নামাজ পড়বে সবসময়ই।”
“আগে প্রতিদিন পড়তাম। যখন জবার বিয়ে হচ্ছিল তখন দিন রাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ওকে চেয়েছিলাম। প্রচুর কান্না করেছিলাম। কিন্তু…. কিন্তু আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করে নি।”
মোহ সামনের মিরর দিয়ে সমুদ্রকে দেখে। মৃদু হেসে বলে, “আমরা নামাজ পড়ি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করার জন্য। তার ইবাদতের জন্য। পরকালের হিসাবমুক্ত হওয়ার জন্য। তার কাছে নিজের মনের সকল ইচ্ছা পূরণের জন্য। আল্লাহ তার বান্দার সব ইচ্ছা পূরণ করে। যেগুলো পূরণ হয় না, হয়তো সেগুলো আপনার জন্য সঠিক না। হয়তো আরও ভালোকিছু আপনার জন্য সামনে অপেক্ষা করছে।”
সে আবার সমুদ্রের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “আমি তো প্রতি ওয়াক্তে আল্লাহ কাছে চাই। ইহকালের সাথে পরকালেও যেন আল্লাহ আপনার সাথে আমাকে জান্নাতবাসী করে। আচ্ছা এই দুনিয়ায় তো আপনার জীবনে আচমকা এসে পড়েছিলাম আমি। ওই দুনিয়ায় বাছাই করতে হলে কি আমাকে বাছাই করবেন?”
.
.
রবিবার সকাল সকাল মুরাদ গাড়ি এনে থামায় চারতলা বিল্ডিং এর সামনে। গাড়ি থেকে নেমে তাকায় বিল্ডিং এর দিকে। তারপর যায় ভেতরে। বাড়ীতে ঢোকার আগেই এক মুরব্বির সাথে দেখা হয় তার। তিনি বাজার নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। স্যুট ব্যুটে এক ছেলেকে গাড়ি থেকে নেমে তার বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখে সে প্রশ্ন করে, “আপনি কাকে চান?”
সালাম দিলো মুরাদ। তারপর জিজ্ঞেস করে, “মৃণার বাসাটা কোনটা কাকা?”
“ওকে দিয়ে আপনার কী কাজ? একটা মেয়ের বাসায় কেন যাবেন?” সে আবার তার পিছনে গাড়ি দেখে৷ তার কপালে আরও গভীর ভাঁজ পড়ে। কিন্তু তার কোনো ভুল বোঝার আগেই মুরাদ বলে, “ওর সাথে দেখা করার আগে বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করতাম। একটু কথা ছিলো। উনি কয়তলায় থাকে?”
“আমিই মালিক। বলো কী দরকার? দেখো আগে দিয়ে বলে দেই আমরা ভালো খানদানের লোকজন। এখানে একা মেয়ে থাকতে দেই কারণ অনেক মেয়েরা থাকার জায়গা পায় না সহজে। আলাদা কেউ থাকতে দেয় না। এভাবে কোনো ছেলে বাড়ি আসলে আমাদের সে সম্মান থাকবে না। তাহলে আমার আবার বিষয়টা নিয়ে ভাবা লাগবে।”
“এমন করেন না কাকা। আসলে আমি মৃণার হবু স্বামী। ওর খেয়াল রাখার জন্যই আপনাকে বলতে এসেছিলাম।”

একথা শুনে তো কাদের মিয়ার ভাবভঙ্গি পালটে যায়, “ওহ তোমার বাগদত্তা। এইটা কও। তো তোমার এমন গাড়ি থাকতে হবু বউকে এত কষ্টে থাকতে দেও কেন?”
“জেদি কাকা। আমার সাহায্য নিবে না। নিজে কষ্টে পড়াশোনা করবে। এতদিনও করে এসেছে। মা নেই তো। সৎ মা আর বাবা অনেক অত্যাচার করতো। ছোট থেকেই। এখন নতুন জীবন শুরু উদ্দেশ্যে নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়েছে।”

কথাটা শুনে মনের সাথে চোখও নরম হয় কাদের মিয়ার, “আহারে এতটুকুনি মেয়ে এত কষ্ট করছে!”
“একটু খেয়াল রেখেন ওর কাকা। আসলে ওর রুমমেট কেউ বোধহয় আমার সাথে দেখে ভুল বুঝে অনেক খারাপ কমেন্ট করেছে। আমার ময়নার আবার মন তুলোর মতো নরম। সহজে কষ্ট পেয়ে যায়। ও সহ্য করে, কিন্তু ওর কষ্ট পেলে আমার সহ্য হয় না।”
“আহা তোমাকে দেখে তো আমার নিজের দিনের কথা মনে পড়ে গেছে। তোমার কাকীকে আমিও অনেক ভালোবাসি। এই দেখো ওর পছন্দের রুই মাছ নিয়ে আসছি। আসো তোমাকে মৃণার ফ্লাটে নিয়ে যাই। কথা বললে ওরাই বুঝে যাবে তোমাদের সম্পর্ক। হালাল সম্পর্ক হলে মানুষকে বলতেও লজ্জা নাই। জলদি বিয়ে করে হালাল করে নিবে।”
“জ্বি কাকা, দোয়া করেন।”

লামিয়া বই পড়ছে আর ব্রাশ করছে। তার আজ এক্সাম। নিতু ও মিতুও তৈরী হচ্ছিল ভার্সিটির জন্য। মৃণার পরীক্ষা শেষে ভার্সিটি একমাসের জন্য বন্ধ তাই সে পড়ছিল এতক্ষণ। সবে উঠে রান্নাঘরে গেল ভাত বসাতে।

কলিংবেলের শব্দে লামিয়া দরজা খুলে। কাদের মিয়াকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। অস্পষ্টভাবে কিছু বলল কেবল। ভেতরের রুম থেকে মিতু ও নিতু তাকে দেখে মুখ ঝামটাল। কেবল মৃণা রান্নাঘর থেকে তাকে দেখে সালাম দিলো।

“সকাল সকাল তোমাদের বিরক্ত করতে এসেছি। মেহমান নিয়ে এসেছি।” কাদের মিয়ার পিছনে সুদর্শন পুরুষ এসে উপস্থিত হতেই তাকে দেখে সবাই যেন ঝটকা খেল। লামিয়া এক দৌড়ে গেল বাথরুমে মুখ ধুঁতে। নিতু ও মিতু তাকে দেখেই এলো দরজার কাছে। নিজের চুল, ওড়না সব ঠিক করল। কিন্তু তাকে দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক মৃণা, “মুরাদ ভাই আপনি?”
“ভাই?” কাদের মিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় মুরাদের দিকে, “তুমি তো আমাকে অন্যকিছু বললে।”
মুরাদ হাসে, “আমার বোনের বান্ধবী তো। ছোট থেকে বলে। অভ্যাস ছুটতে সময় লাগবে।”
“অহ তাই বলো। তুমি কথা বলো, আমি তোমার কাকীকে মাছ দিয়ে আসি।”
কাদের মিয়া যাবার পর লামিয়াও মুখ ধুয়ে বের হয়। সে মৃণার পাশে যেয়ে তার হাত ধরে বলে, “আপা এই সুন্দর পোলাডারে আপনি চিনেন?”
“হ্যাঁ আমার…”
“উনার ফিয়োন্সে।”
তার কথায় চারজনই একসাথে তার দিকে তাকায় বিস্ময়ের দৃষ্টিতে।
লামিয়া তো খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, “সত্যি? আপা তুমি আমাকে বলো নাই কেন?”

আর মিতু ও নিতুর তো চেহেরা হয়েছে পেঁচার মতো। তারা একবার মুরাদকে দেখে আবার ভালো করে দেখে মৃণাকে। নিজের চোখকেই তারা বিশ্বাস করতে পাড়ে না। মৃণা তাদের এমন চাহনিতে লজ্জা পায়। সে মুরাদের কাছে যেয়ে তাকে বলে, “বাহিরে যেয়ে আমরা কথা বলি।”
সে যেতে নিলে মুরাদ তার হাত ধরে নেয়। তাকে ফেরত ঘুরিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে। টিটকারির সুরে জিজ্ঞেস করে, “এখানে কারো না’কি সমস্যা ছিলো আমার হবু বউকে বাসার সামনে ড্রপ করায়। তার সাথে একটু কথা ছিলো।”
নিতু ও মিতু তাকাল একে অপরের দিকে।
“না মানে…” নিতু কিছু বলতে চাইলে মুরাদ তার কথা কেটে বলে, “আই থিংক আপনাদের মাইন্ড একটু পরিষ্কার করা উচিত। অতিরিক্ত নোংরা হয়ে গেছে। এই কম বয়সে এত নোংরা মানসিকতা থাকলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। আপনাদের ভালোর জন্যই বলছি।”
লামিয়া প্রথমে ঠোঁট চেপে হাসতে চায়। কিন্তু তার দ্বারা হয় না। সে জোরে হেসে দেয়।

নিতু আর মিতু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে কিন্তু মুরাদকে কিছু বলতে পাড়ে না। লামিয়া তাকে ভেতরে বসতে ডাকে। মুরাদ প্রথমে দ্বিধাবোধ করলেও মৃণার জন্য যায়। মৃণা যেহেতু এখানেই থাকবে তাকে সবকিছু দেখেশুনে রাখতে হবে।

লামিয়া তাকে চা’য়ের জন্য জিজ্ঞেস করলে সে রাজি হলো। মৃণা চা বানানোর প্রস্তুতি নিলো। মুখে না বললেও সে অনেক খুশি মুরাদ তার বাসার এসে তার হাতের চা খাবে। এত বছর তার জানতে অজান্তে মুরাদ অনেক কিছু করেছে তার জন্য। তার দায় সে পরিশোধ করতে পাড়বে না কখনোই। তাদের বাসায়ও থেকেছে কতদিন। অন্তত তাকে দামী কিছু না খাওয়াতে পাড়লেও কিছু তো খাওয়াতে পাড়ছে।

লামিয়া তার সামনে বিছানায় বসে গল্প করছিল। সব মৃণার প্রশংসা। মাঝেমধ্যে এক দুইটা মহুয়ার কথাও বলল। সে দেখা করতে এসেছিল একদিন আগেই। তারা দুইজনই অনেক ভালো, জানাল লামিয়া। মুরাদ তার কথায় হাসল। হঠাৎ মিতু এসে বসলো তার পাশে। বলল, “আসলে আমাদের দোষ আছে না জেনে-বুঝে আমাদের এসব বলা উচিত হয় নি। মাফ করে দিয়েন প্লিজ।”
মুরাদ দেখল সে ঘেঁষে আসছে বারবার তার দিকে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। কিন্তু কিছু বলে না। মৃণাকে ডাক দেয়। মৃণা তার সামনে এসে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে সে মৃণার হাত ধরে তাকে দুইজনের মাঝে বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে সরে বসে মিতু। মুরাদ বলে, “আই থিংক আপনি ভুল জায়গায় ক্ষমা চাইছেন। ওর কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত না?”
মিতুকে এই সময় ভীষণ বিরক্ত ও লজ্জিত দেখায় একই সাথে। নিতু তো এই সুযোগে তার ব্যাগ নিয়ে বলে, “আমার ভার্সিটির জন্য দেরি হচ্ছে। আমি যাই।”
মিতুও সুযোগ পেয়ে বলে, “আমিও ওর সাথে যাব তো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখা হবে।” সে-ও একসাথে বের হয়ে যায় তার বোনের সাথে।

মুরাদ চা পান করে। লামিয়ার সাথে গল্পও করে বেশি সময় ধরে। কাদের মিয়াও আসে এর মধ্যে। গল্প করে উঠে মুরাদ। লামিয়াকে মৃণার খেয়াল রাখতে বলে এবং তার ফোন নাম্বারও দিয়ে যায় কোনো সমস্যা হলে জানাতে।

কাদের মিয়ার কথায় মৃণা মুরাদকে বাহির পর্যন্ত ছাড়তে আসে। বাহিরে আসার পর মৃণা জিজ্ঞেস করে, “আপনি এমন কেন করলেন মুরাদ ভাই? এত বড় মিথ্যা বলার প্রয়োজন ছিলো? এখন সবাই জানার পর আমি কী বলব?”
“মহুয়া গতকাল জানাল তুই আমার প্রস্তাবে রাজি।”
“আমি হ্যাঁ না কিছু বলিনি। চুপ ছিলাম মহুয়ার জন্য। ও সম্মতি ভেবে নিয়েছে।”
“আমিও ভেবে নিয়েছি।”
“এমন কেন করছেন মুরাদ ভাই? আপনার সাথে আমার কোনো দিক দিয়ে যায় না।”
মুরাদ থেমে যায় কথাটা শুনে। পিছনে ফিরে তাকায় তার দিকে, “আবারো বল তো কথাটা। কোন দিক দিয়ে যায় না?”
“কোনো দিক দিয়েই না। হোক তা রূপ,রঙ কিংবা অর্থ।”
“আচ্ছা তাহলে তোর সফল হবার অপেক্ষা করব আমি। এত বছর অপেক্ষা করেছি আরও চার পাঁচ বছরও করলাম। আমি জানি তুই একদিন অনেক সফল হবি।”
“আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হতে পাড়ে মুরাদ ভাই, মানুষের রঙ রূপের না।”
মুরাদ মৃদু হাসল। তার থেকে দুই কদমের দূরত্ব ছিলো মৃণার। সে এক পা এগিয়ে এসে সে দূরত্ব এক কদমের করল। দুই হাত রাখলো মৃণার গালে। তার মুখ উঁচু করে বলল, “আমার দৃষ্টি দিয়ে একবার যদি তোর একবার দেখার সুযোগ হতো তবে বুঝতি এই জগতে তোর থেকে বেশি সুন্দর আর কেউ নেই।”
মৃণা স্তব্ধ হয়ে যায় তার কথা শুনে। তাকিয়ে থাকে অপলকভাবে। তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছে এই একটা বাক্য শুনে।

মুরাদ তার গাল থেকে হাত সরিয়ে মধুর এক হাসি দেয়। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “খেয়েদেয়ে পড়তে বস। অফিসে জলদি এসে পড়িস। আজ আর মিউজিক ক্লাসে যাওয়া লাগবে না। ওখান থেকে এক জায়গায় যাব।”
“কোথায়?” মৃণা তার দিকে তাকিয়ে থাকে একইভাবে।
“গোল্ডেন স্টুডিও।”
উওরে অবাক হয় এবার মৃণা। তার ধ্যান ভাঙে, “ওখানে কেন যাব?”
“আজ অডিশন আছে। তুই অর্ধেক বছর ধরে গানের ট্রেনিং নিচ্ছিস, একটু ব্যবহার তো করবি।”
“আপনি আমাকে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন? তাও গোল্ডেন স্টুডিও! আপনি জানেন না তন্ময় সেখানে কাজ করে।”
“সাথে আরও অনেকে করে। বাংলাদেশে আপাতত গোল্ডেন স্টুডিও সবচেয়ে বেশি সাকসেস কামাচ্ছে। আমার ক্যালকুশনে আগামী পাঁচ বছরে টপে যাবে। আর আমি চাই সেখানের সবচেয়ে টপ আর্টিস্ট তুই হবি।”
“ভাইয়া আপনি কী যা তা বলছেন? মানুষ ছোট থেকে গান শিখেও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের নাম কামাতে পাড়ে না। আমি কীভাবে করব?”
“সেটা পড়ে দেখা যাবে? আগে অডিশন দিয়ে নে।”
“কিন্তু ভাইয়া তন্ময় কাজ করে। ওখানে…ওখানে আমি আগে গিয়েছিলাম। সবার সামনে একবার তন্ময় কিছু কথা বলেছিল। এখন অডিশনের গেলে সবাই হাসবে সবার হাসাহাসির পাত্র হবো আমি।”
মুরাদ বাঁকা হাসে, “তো বান্ধবীকে নিয়া যাবি তাহলে? হাসলে মুখ সেলাই করে দিবে একদম।”
“মজা করেন না ভাইয়া। আমি যাব না।”
“এজ উইর উইশ।”
মুরাদ পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়িতে উঠে বসে। কিন্তু যাবার পূর্বে জানালা নামিয়ে বলে, “কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবি মানুষ অতীতকে ভয় থাকলে ভবিষ্যৎ গড়তে পাড়ে না। ভয় দূর করার জন্য সবার আগে অতীতের সাথে লড়াই করতে হয়। আর ভয় না দূর করলে স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব। হোক সে স্বপ্ন তোর কিংবা তোর মা’য়ের।”
মৃণা শূন্য দৃষ্টিতে দেখল মুরাদকে যেতে। ভাবাল তার কথাগুলো তাকে। আবারো চিন্তা করল সে কী যাবে অডিশন দিতে? পাড়বে সে?
তখন তার চোখের সামনে হঠাৎ মুরাদের গভীর দৃষ্টি ভেসে উঠে। কানে ভেসে আসে কিছু শব্দ, “আমার দৃষ্টি দিয়ে একবার যদি তোর একবার দেখার সুযোগ হতো তবে বুঝতি এই জগতে তোর থেকে বেশি সুন্দর আর কেউ নেই।”
মৃণার হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য। মাঝরাস্তায় একা দাঁড়িয়ে রইল সে। তার এইবার সত্যিই দেখতে মন চাইল মুরাদের দৃষ্টি দিয়ে। কেমন দেখায় তাকে?
.
.
কেটে গেল আরও একমাস। এই দিনগুলো খুবই বিরক্তিকর কাটলো মহুয়ার। কারণ সে জানে না। আজকাল তার মনে সে মজার ভাবগুলো আসে না। খুবই বিরক্তিকর কাটে দিনকাল। জাহানের দুইদিন আগে আসার কথা ছিলো সে এলো না। তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ সে একমাস ধরে। ট্রেনিংয়ের সময় ফোন ব্যবহার করতে পাড়ে না। তার কথা না বলায় আজকাল তার কিছুই ভালো লাগে না। না কার্টুন দেখতে, না ঘুমোতে আর না খেতে। সারাক্ষণ রুমে পড়ে থাকে সে আজকাল। এখন একমাস পর ভার্সিটি খোলা। এই আশাতেই আছে যে রবিবারে জাহানের দেখা পাবে সে।
.
.
মোহ সমুদ্রের সাথে এসেছে চট্টগ্রামে। ঈশার বিয়ে উপলক্ষে। বৃহস্পতিবার সকালে এসে হাজির তারা। শুত্রুবার বিয়ে তাদের। আজ হলুদ এবং রবিবার ঢাকায় বৌভাত। তারা এসেছে ঈশার দাদুবাড়ি। বাড়িটাতেই বিয়ে হবে ঈশার। সেখানে খোলামেলা জায়গা। আত্নীয়রাও আশেপাশে থাকে। আর সব মেহমানদের ভালোমতো জায়গা হয়েছে। বাড়ি কম, পুরনো মহল মনে হলো মোহের। দো’তলা জুড়ে কতগুলো কক্ষ। বাড়ির সামনে বিরাট বড় বাগান। বাগান জুড়ে বাহারি রকমের ফুল।
মোহের তো ফুল দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। সে নিচে যেয়ে বেণি করে তার চুলে ফুল লাগাতে লেগে যায়।

“এক্সকিউজ মি….” পুরুষালী কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় মোহ। দেখে এক স্যুটবুট পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। এই গরমে স্যুট পরা লোকটিকে দেখে তার নিজেরই গরম লাগতে শুরু করলো। লোকটি পকেটে হাত রেখে তাকে দেখে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত।
“আমি ফোনে কথা বলছিলাম। কথা বলার সময় আপনাকে দেখলাম। সত্যি বলতে ভেবেছিলাম কোনো পরী বা অপ্সরীর দেখা পেয়েছি আলৌকিকভাবে। দেখতে আসলাম সত্যিই কী আপনি মানুষ কি-না!”
লোকটা এমন কথায় মোহের হাসি পেল ভীষণ। সে এই জীবন অনেক চিজি লাইন শুনেছে এমন কথা আগে শুনে নি।
সে হাসি চাপিয়ে রেখে বলল, “দেখে নিয়েছেন ভাইয়া? আমি মানুষই। এবার যেতে পাড়েন।”
“ভাইয়া বলছেন কেন? আমার কোনো বোন নেই। বোন বানানোর ইন্টারেস্টও নেই। আপনার নাম্বার পেতে পাড়ি?”
“সরি, আমি বিবাহিত।”
“কথা বললে যে আপনার স্বামীকে জানাতে হবে এমন তো নয়।”
এমন বিচ্ছিরি কথা শুনে মোহের ঠোঁটে লাগা হাসিটি উধাও হয়ে গেল। বিরক্তি বিরাজ করল। সে কড়া গলায় বলল, “নিজের মুখ আর চোখ সামলে রাখেন। আমার স্বামী একথা শুনলে আপনাকে আস্তো রাখবে না।”
বলে মোহ যেতে নিলে লোকটি তার হাত ধরে নেয়। মোহ তার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পাড়ে না,”আপনার তো সাহস কম না আমাকে ছুঁয়েছেন? হাত ছাড়ুন এক্ষুণি, নাহয় চিৎকার করব।”
“আপনাকে তো রাগলে আরও সুন্দর দেখা যায়। সত্যি বলতে আপনার মতো সুন্দরী আগে চোখে পড়ে নি কেন আমার? আপনার দেখা আগে পেলে ভুলেও অন্যদিকে চোখ যেত না।”

“কারিম! কী করছ তুমি এখানে?” সামনে থেকে একটি মেয়েকে হেঁটে আসতে দেখে মোহ। মেয়েটিকে দেখে সে চিনলো। শ্যামবর্ণ, ঘন কোঁকড়া চুল বেণি করা, মায়াবী মুখশ্রী। মেয়েটি জবা। আগেই তাকে দেখেছে সে ছবিতে। সমুদ্রের সাথে। সে জানতো এখানে জবার সাথে তার দেখা হবে। তবুও সে অস্বস্তিবোধ করল।

জবা এসে দাঁড়ায় কারিমের পাশে। তার চোখ যায় তার ধরা মোহের হাতের দিকেও। কিন্তু সে এমনভাবে তাকায় যেন কিছু দেখে নি। সে উলটো ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি এঁকে মোহের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে সামনা-সামনি প্রথম দেখলাম। ছবি থেকেও বেশি সুন্দর দেখতে তুমি সামনা-সামনি।”

চলবে….