মেঘের খামে পর্ব-৪৭+৪৮

0
5

মেঘের খামে…
পর্ব ৪৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মহুয়া যেতে নিলে জাহান তার হাত ধরে তাকে নিজের গাড়ির সাথে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে ভারী স্বরে বলে, “তোমার এই জেদ পাশে রেখে একবার আমার কথা শোনা যায় না? আমার কথা বুঝতে পাড়ছো না কেন তুমি? আমি তোমার জন্যই বলছি। শায়ানের ফ্যামিলি রাজনীতির সাথে জড়িত। তুমি শায়ানকে এখানে আনিয়েছ আর শায়ান রশ্মিকে ডেকেছে। আমি সব বুঝি মহুয়া কিন্তু তুমি বুঝতে পাড়ছো না ওদের সাথে খেলা খেলে তুমি কত বড় বিপদ ডেকে আনছো। তুমি জানো না রশ্মির ভাইকে। ও….” বলতে বলতে থেমে যায় জাহান।

মহুয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। কথাগুলো তার মাথায় নড়া দেয়। সে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় জাহানের দিকে, “রশ্মির ভাই আর শায়ানের পরিবার! তাহলে এরা তোমার এই বিয়ে করা সিদ্ধান্তের পিছনে আছে?”
জাহান তার হাত পিছিয়ে নেয়, “আমি এমনটা বলিনি।”
মহুয়া উলটো তার কলার ধরে টান দেয়, “সত্যি তো?” ধীর সুরে বলে সে। তার কলার থেকে কাঁধে হাত নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে।

জাহান তাকায় সন্দিহান দৃষ্টিতে। মেয়েটার মাথায় কিছু একটা খিচুড়ি পাঁকাচ্ছে বুঝতেই পাড়ছে সে। কিন্তু কি চলছে তা ধরতে পাড়ছে না। তবে এমন ভাবখানা ভালো ঠেকছে না তার কাছে।

জাহানের কলার ধরে নিচে টান দিয়েও তার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পাড়ে না মহুয়া। পা উঁচু করে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর সুরে বলে, “তাহলে আমি এখন ওদের দুইজনের আশেপাশেই ভনভন করবো।”
কথা বলার সময় তার ঠোঁটটা কানে স্পর্শ লাগে অথবা মহুয়া ইচ্ছে করেই লাগায়।
জাহান সাথে সাথেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার তীরের মতো কথা আর ফুলের মতো ঠোঁটের স্পর্শ, দুটো একসাথে গ্রহণ করতে সময় লাগছিল জাহানের। সে মহুয়ার দিকে তাকাতেই সবার আগে তার নজর যায় তার ঠোঁটের দিকে। মহুয়া ইচ্ছে করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। বেহায়ার মতো কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে এক ঢোক গিলে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়।

পরক্ষণেই তার টনক নড়ে। মাথায় আসে মহুয়ার কথা। সে আবারও তাকায় মহুয়ার দিকে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়, “তুমি ওদের আশেপাশে ভনভন করবে মানে কী?”
“তুমি না বললে আমার কোন ভাবে তো তোমার হঠাৎ বিয়ের রহস্য করতে হবে।”
“একারণেই। ঠিক একারণে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই না। সব কিছুতে মাতব্বরি করতেই হবে তোমার।”
মহুয়া গভীর নিশ্বাস ফেলে। উঠে বসে তার গাড়ির উপর। জাহানের কাঁধে হাত রেখে আফসোসের সুরে বলে, “আহারে এমন মেয়ের প্রেমেই তুমি ডুবে গেলে। কী করবে ঠেলা সামলাও।”
জাহান আচমকা তার কোমড় জড়িয়ে ধরে টানল। ফিসফিস কন্ঠে বলল, “তোমার মনে আছে বলেছিলাম তোমার জন্য সম্পূর্ণ পৃথিবীর সাথে লড়তে পাড়ব, প্রয়োজনে তোমার সাথেও।”
মহুয়া তার চোখেই চোখ রেখে বলে, “আমার মনে আছে। তুমিই ভুলে গেছো।”
“উঁহু, আমি তাই করছি। তোমার এতটুকুই জানা থাক। তুমি ভাবছো আমি বুঝি না তুমি কথা বের করার জন্য আমার এত কাছে আসছো? সবই বুঝি। কিন্তু তুমি বুঝে নেও একবার আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালে আর সামলাতে পাড়বো না।”

“মহুয়া!”
শায়ান দুইজনকে এত কাছাকাছি অবস্থায় দেখে রাগে নিজেকে সামলাতে পাড়ে না। গর্জে উঠে। রশ্মি কাঁদছিল তখনও। সে রশ্মির সাথে বাহির হয়েছিল তাকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। তবে এই দৃশ্য দেখে তার মাথা ঠিক থাকে না। সে রশ্মিকে ছেড়ে মহুয়ার কাছে যায়। তার হাত ধরে টান দিয়ে নিচে নামায় তাকায়। আচমকা এমন টান পেয়ে নিচে নামায় পা’য়ে ব্যাথা পেয়ে যায় মহুয়া। কিন্তু তার বোঝার বা কিছু বলার আগেই শায়ান জাহানকে সাবধানবাণী দেয়, “ফারদার ওর আশেপাশেও আসার চেষ্টা করবি না। তোর বিয়ে রশ্মির সাথে ঠিক হয়েছে। সেদিকে খেয়াল রাখ। মহুয়া ফিউচারে আমার স্ত্রী হবে। আমার মানুষের উপর অন্যকারো দৃষ্টি থাকা আমার অপছন্দ। ছোঁয়া তো দূরের কথা। এটা আমার ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং।”
আর কোনো কথা না সে বলে আর না বলতে দেয়। মহুয়ার হাত ধরে নিয়ে যায়। জাহান তার পিছনে যেতে নিলেই তখনই রশ্মি দৌড়ে আসে তার কাছে। তার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “জাহান রাজ ভাইয়া তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
.
.
মোহ তৈরি হয়ে বের হচ্ছিল। তাকে দেখে মা জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“ওই বাসায় যাচ্ছি মা। আমার সব জিনিসপত্র আনতে হবে। আর শেষবারে মতো আম্মু আব্বু…’ বলতে একটু থামে সে। এক ঢোক গিলে, ” আংকেল আন্টিকর সাথে দেখা করে আসি। তারা আমার অনেক খেয়াল রেখেছে। বউ না মেয়ের মতো রেখেছে। দুইদিন ধরে কল দিচ্ছে আমি ধরিনি। উনাদেরও আমার সিদ্ধান্ত জানানো উচিত।”

এই উওরে মা কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর মৃদুস্বরে প্রশ্ন করেন, “কি হয়েছে তা কী আমাদের একবার বলা যাবে?”
মোহ তাকাল একবার তার মা’য়ের দিকে। কিন্তু কিছু বলতে পাড়লো না। সে কী এখনো সমুদ্রের সম্মানের কথাই ভাবছে? যদি কেউ জানে সে মোহের উপর হাত তুলেছে তাহলে সমুদ্রের সম্মান কমে যাবে। মানুষ কটু কথাও বলতে পাড়ে। এই জেনেই কী সে কাওকে কিছু বলতে পাড়ছে না?
উওর না আসায় মা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়েন। সে বুঝেছে মেয়ে কিছু বলবে না। তাই বললেন, “আচ্ছা আমিও আসি। একা এতকিছু আনতে পাড়বি না।”
“পাড়ব।”

মোহ রওনা দেয়। সে বাসার সামনে পৌঁছায় ঠিকই কিন্তু কলিংবেলে হাত দিয়েও সরিয়ে নেয়। কেমন অস্বস্তি লাগছে তার। এই বাড়িটাকে ক’দিন আগেও নিজের বলতো নির্দ্বিধায়। অথচ আজ কলিংবেল চাপতেও এমন অস্বস্তি লাগছে!

সে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সামনে। কোনো হেলদোল নেই। সাহস কুলাতে না পেড়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে রওনা দেয় সেখান থেকে।

মেইন দরজায় আসতেই তার শশুড়ের সাথে দেখা হয়। সে মোহকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন। বললেন, “আরে মামণি তুমি এসেছ? আগে বলবে না? আমি তোমার আম্মুর জন্য মোগলাই আনতে গিয়েছিলাম তুমি আসবে জানলে তোমার পছন্দের দই আর সমুচা নিয়ে আসতাম। কতদিন পরে এসেছে আমার মেয়েটা আসো।”
মোহ থমকে যায়। তার বুকের ভেতর কেমন অস্থির হয়ে যায়। তবুও সে তার শশুড় আব্বার পিছনে যায় বাড়ির ভেতরে। তার শাশুড়ী তাকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেন এতদিনে তার নিশ্বাস ফিরেছে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থাতে বলে, “এতদিনে আসলে? একটু কল ধরবে না? তুমি তো জানো তোমাকে ছাড়া এই ঘর কেমন খালি খালি লাগে আমার কাছে।” আবার তাকে ছেড়ে বলে, “তুমি ছাড়া তো সারাদিন একাই থাকি। প্রতিদিন কল দিয়ে কথা বলো এই তিনদিন কী হলো?”

মোহ উওর দেয় না।
শাশুড়ী মা তার হাত ধরে ভেতরে আনে। আর বলে, “আর সহ্য করতে না পেড়ে তোমার আব্বুকে বললাম আজ ছুটি নিতে। তোমার আব্বুও কাজে অফিসে থাকেন। আর সমুদ্র তো সমুদ্রই। এসেই এই দুইদিন রুম যে বন্ধ করলো খুলেই না। খায় না কিছু না। কি করে আল্লাহ জানে। তুমি না থাকলে কী বেপরোয়া হয়ে যায় দেখেছ? কেবল তুমিই ওকে সোজা রাখতে পাড়ো। যেয়ে কতগুলো বকা দেও। আমার কথা তো শুনে না। তুমি যে একা আসলে ভালো দেখায়? বেয়াই বেয়াইন কী ভাববে বলো?”

মোহের শশুড় বললেন, “মেয়েটাকে নিশ্বাস ফেলতে দিবে না’কি? মাত্র এলো আর তুমি গল্পের ঝুলি খুলে বসলে।”
“ও হ্যাঁ, তাইতো। ভেতরে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও। তুমি যেহেতু এসেছ আমি তোমার পছন্দের ধনিয়া ভর্তা আর সরিষা ইলিশ করি। কী বলো সমুদ্রের আব্বা?”
“আমারও মুখে পানি এসে পড়েছে।”
“দরকার নেই। আমি তো….” মোহ কিছু বলতে যাবে এর আগেই আবার সমুদ্রের মা বললেন, “অবশ্যই দরকার আছে। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। সমুদ্রও রুমে আছে।”

কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মোহ। আজ ঈশার বৌভাত৷ সে ভেবেছিল সমুদ্র সেখানেই যাবে। তাদের দেখা হবে না। এজন্যই এই সময়টাই এসেছিল সে।

সে দ্বিধায় পড়ে যায় ভেতরে যাবে কী-না! এর পূর্বেই সমুদ্রের মা দরজায় নক করে। প্রথমে সমুদ্র দরজা খুলে না। কিন্তু পড়ে মা যখন বলে মোহ এসেছে। সাথে সাথেই দরজা খুলে দেয়।

রুম খুলতেই সিগারেটের গন্ধ বাহিরেও ছড়িয়ে গেল। মা বিরক্তি নিয়ে তার নাকে ওড়না দিলেন।
“মোহ দেখেছ তোমার স্বামী তুমি বাসায় না থাকায় কী করছে? ভালো একটা শিক্ষা দিবে নিজের স্বামীকে।”

মা রান্নাঘরের দিকে চলে যায় আর বাবা যায় ড্রইংরুমে। টিভি দেখতে। মোহ ধীর পা’য়ে আসে সমুদ্রের সামনে। একপলক দেখে তাকে। দুইদিনে কী অবস্থা হয়েছে! মুখখানায় আগের মতো উজ্জ্বল ভাবখানা নেই। চোখের নিচে কালচে হয়েছে কিছুটা, দাঁড়ি লম্বা হয়েছে, অবস্থা এলোমেলো। তাকে দেখেই বুকের ভেতরে ব্যাথা উঠে যায় মোহের। তার শ্যামসুন্দর পুরুষটার কী অবস্থা হয়েছে! চোখ চোখে পানি আসে। যা সে বহু কষ্টে আটকে রাখে।

রুম থেকে সিগারেটের গন্ধ আসে তীব্রভাবে। সিগারেটের গন্ধে তার বমি চলে আসলে সে নাকে ওড়না দেয়। সাথে সাথে সমুদ্র দৌড়ে যায় রুমে। মোহ তার পিছনে যেয়ে দেখে সমুদ্র বারান্দার দরজা, জানালা খুলে দিয়েছে। ফ্যান ছেড়েছে গন্ধ যাবার জন্য। সম্পূর্ণ রুম এলোমেলো। মেঝেতে কতগুলো আধ খাওয়া সিগারেট।

মোহ কিছু বলে না। সে যেয়েই খাটের নিচ থেকে নিজের লাগেজ বের করে। আলমিরা থেকে নিজের জামাকাপড় বের করে লাগেজে রাখে। সমুদ্র তার কাছে দৌড়ে আসে, “কী করছ?”
মোহ আড়চোখে তাকায় তার দিকে। শীতল দৃষ্টিতে।
“দেখতেই পাড়ছেন। আপনাকে মুক্ত করবার ব্যবস্থা করছি। এখন আপনাকে আর কেউ বিরক্ত করবে না। সারাক্ষণ রুম বন্ধ করে সিগারেট খেয়েন।”
“মধু আই প্রমিজ…আই প্রমিজ আর সিগারেট খাব না।”

মোহের হাত ধরতে নিলেও সে ঝটকায় সরিয়ে নেয় নিজের হাত। তাড়াহুড়ো করে যেমন তেমনভাবে ভরে নিজের লাগেজ।
“যা ইচ্ছা তা করেন। আই ডোন্ট কেয়ার।”
মোহ জামা রেখে নিজের বই নিতে গেল। বইগুলো রাখার সময় চোখে পড়ে তার ডায়েরিটা
‘মোহের সমুদ্র’
মোহের বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো। সে খুব করে চেয়েছিল এই ডায়েরিতে তাদের ভালোবাসার গল্প।লিখবে। সে তো ভুলেই গিয়েছিল যেখানে ভালোবাসাই নেই সেখানে ভালোবাসার গল্প হবে কী করে? হতে পাড়তো তার একতরফা গল্প, তবে এই গল্পের সময়কালটাও বড্ড ছোট হয়ে গেল।

সে আফসোসের নিশ্বাস ফেলে বুক চিরে।
ডায়েরিটা ডাস্টবিনে ফেলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। এন আই ডি কার্ড, কাগজপত্র, সব। লাগেজের চেইন লাগানোর সময় হঠাৎই সমুদ্র এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে। যেন একফোঁটা ছাড় দিলেও হারিয়ে যাবে।

আজও তার ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ কেঁপে উঠে মোহ। শরীরে শিহরণ বয়ে যায় আরও তীব্রভাবে। সমুদ্র তার কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁপানো সুরে বলে, “প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও মধু। সে মুহূর্তে রাগে ক্ষোভে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। আমি কি করে ফেলেছি! এত বড় ভুল…না ভুল না অপরাধ আমি কীভাবে করলাম নিজেও জানি না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পাড়ছি না মধু। আমার নিশ্বাস আটকে আসছে। তোমাকে বুকে না নিয়ে ঘুমাতে পাড়ি না। চোখের সামনে তোমাকে না দেখলে বুক ব্যাথা করে। তোমাকে না ছুঁলে নিজেকে অপূর্ণ লাগে। মধু আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ।”

তার প্রতিটি নিশ্বাসের স্পর্শ কাঁধে লাগতেই অন্তর কেঁপে উঠে মোহের।
সে নিজের আবেগকে বুঝ দিয়ে সামলাল নিজেকে। বলল, “ছাড়ুন। আপনার স্পর্শও আমার অসহ্য লাগছে।”
“মিথ্যে বলো না মধু। তুমি মিথ্যা বলতে জানো না।”
তাচ্ছিল্য হাসে মোহ,
“সেদিন তো নিমিষেই আমাকে মিথ্যাবাদী বলে দিয়েছিলেন।”
সমুদ্র তাকে ছেড়ে নিজের দিকে মুখ করায়। অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “তুমি নিজে যখন বলেছিলে সত্যিই থাপ্পড় দিয়েছ তখনই তো…”
“এত ভালো মতো নিজের মধুকে চিনলে নিশ্চিত বুঝতেন আমি অকারণে এমনটা করবো না। ওহ সরি আপনার জবাফুল যে সামনে ছিলো। তাকে ছেড়ে আপনি আমাকে কেন বিশ্বাস করতে যাবেন?”
মোহ আবার ফিরে নিজের লাগেজ নামাল। সমুদ্র তার হাত ধরে তাকে ফিরায়, “বিলিভ মি মধু আমি শেষ কয়মাস ওকে নিয়ে ভাবিও নি। শুধু তোমাকে নিয়ে ভেবেছি। আমি তো যাস্ট…”
“যাস্ট ভুল হয়েছিল আমার যে আমি ভেবেছি আপনার হৃদয়ের একটুখানি অংশ আমি দখল করতে পেড়েছি। চরম ভুল ছিলো।”
সমুদ্র তার দুইগালে হাত রেখে বলে, “তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ মধু। তোমাকে হারানোর কথা ভেবেই এই বুক হাহাকার করে উঠে।”
“কথা তো সবাই বলতে পাড়ে, কাজেই তাদের নিয়ত দেখা যায়। আর আপনার কাজ দ্বারা নিয়ত আমি দেখে নিয়েছি।”

মোহ তার লাগেজ নিয়ে দরজার কাছে যায়। বের হবার আগেই সমুদ্র আবারও তাকে ধরে নেয়।
“আমার কথা তো শুনো। আমরা বসে কথা বলতে পাড়ি না?”
মোহ হাত ঝটকায় সরিয়ে বিরক্তি নিয়ে উঁচু সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী বলবেন আপনি? আপনার কী বলার আছে? আচ্ছা বলেন। আমি শুনি।”
মোহ তার হাত বুকের উপর ভাঁজ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ডাগর আঁখিজোড়ায় ক্ষোভ জ্বলে উঠে।
সমুদ্রের গলা ধরে আসছিল। সে ঢোক গিলছিল বারবার। কিন্তু এটাও বুঝে যে এখন কিছু না বললে আর সুযোগ পাবে না। তাই গভীর নিশ্বাস ফেলে সে বলা শুরু করে, “বিশ্বাস করো মধু শেষ কয়মাসে কেবল তুমিই আমার জীবনে ছিলে। আমি জবার কথা ভাবতামও না। তোমাকে বলেছিলাম তো কারিম ওর উপর ফিজিক্যাল এবিউস করতো তাই কল ধরতাম। তুমিও আমার জায়গায় হলে একই কাজ করতে। করতে না? আমার ওর প্রতি সহানুভূতি ছিলো। কিন্তু আমি কী জানতাম জবা নিজে এত বড় গেইম খেলছে। বিশ্বাস করো কয়দিন ও তোমার বিরুদ্ধে কথা বলছিল আমি বিশ্বাস করিনি। এক মুহূর্তের জন্যও না। কিন্তু ওদিন তুমিসহ সবাই বলল তুমি ওকে থাপ্পড় মেরেছ তখন আমার মনে হলো তুমি জ্বেলাস ফিল করে এমনটা করেছ। তাই…”
“তাই আপনিও আমার উপর হাত তুলেছেন।”
“না মধু আমি বুঝে…”
মোহ তার সামনে এসে তার হাত ধরে বলে, “জানেন কারিম আমার কোথায় হাত দিয়েছিল?”
মোহ সমুদ্রের হাত তার পেটে রাখে, “এখানে হাত দিয়েছিল।” সে হাত তার পিঠের দিকে উঠাতে নিলেই সমুদ্র হাত সরিয়ে নেয় সাথে সাথে। তার ভেতরের অস্থিরতা মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠে। তার অসহায় দৃষ্টিতে ভেসে উঠে ক্ষোভ, ক্রোধ।

কিন্তু মোহ হাসে। বলে, “এই দৃশ্য স্পষ্ট দেখার পরও সে আপনার অসহায় জবা আমাকে ফেলে গিয়েছিল। উলটো আমার চরিত্র প্রশ্ন তুলেছিল। একবার ভাবুন যদি আমি সাহস না করতাম তাহলে আমার সাথে কী…” ভাবতেও ভয়ে গলা ধরে গেল মোহের। চোখে পানি ভেসে উঠে, “আমি আপনার কাছে গিয়েছিলাম কত আশা নিয়ে। আপনি আমাকে ওয়াদা করেছেন আপনি সবসময়ই আমাকে রক্ষা করবেন। অথচ আপনি তো আমার কথাও শুনলেন না। আপনার আর কারিমের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বলুম। সে-ও নিজের ওয়াইফকে ফিজিক্যাল এবিউস করতো আর আপনিও সে-ই পথেই যাচ্ছিলেন। আপনি আমার উপর হাত তুলতে নিয়েছেন সমুদ্র। সেদিন তুলে থেমে গিয়েছিলেন, হঠাৎ কোনদিন তুলে ফেলবেন। আপনার সাথে না থাকলে আমার হৃদয় পুড়বে কিন্তু আপনার সাথে থাকার অনুমতি আমার সম্মান আমাকে দেয় না।”

হঠাৎ দরজার কাছে শব্দ পায় মোহ। দেখতে পায় সমুদ্রের মা বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চোখে মুখে চরম বিস্ময়। সমুদ্রের মা জিজ্ঞাসা করে, “সমুদ্র… সমুদ্র তোমার উপর হাত তুলেছে মোহ?”

মোহ কি বলবে বুঝতে পাড়ে না। মিথ্যে সে বলতে পাড়বে না, সত্য সে জানাতে চাইছিল না। তবুও তারা জেনে গেল।
সমুদ্রের মা’য়ের চোখে পানি ভরে এলো। সে কাঁপানো সুরে বললেন, “রুম থেকে চিল্লাচিল্লি শুনে এসেছিলাম। ভাবলাম ছোটখাটো কোন ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু সমুদ্র… তুই কীভাবে পাড়লি আমাদের দেওয়া শিক্ষাকে এমন ভাবে অপমান করতে? সারা জীবন তুই আমাদের গর্ব হয়ে ছিলি। জবা যাবার পর তুই যত ছন্নছাড়া হলি, যতই রাগ দেখালি তবুও মনে একটা খুশি ছিল, আমাদের ছেলেটা নেহাৎ ভালো মানুষ। অথচ তুই নিজের স্ত্রীর উপর হাত তুললি? তোর.. তোর এই বাবা এই চল্লিশ বছরে আমার সাথে উঁচু স্বরে একবার কথা বলে নি। এত সম্মান করে নিজের স্ত্রীকে আর তুই তার ছেলে হয়ে… ছিঃ! এজন্য তোকে এত দোয়া করে চেয়েছিলাম আল্লাহর কাছে?”
“মা আমি ইচ্ছা করে করিনি। হঠাৎ রাগে তখন…. ”
তার মা কথা কেটে বলে, “আর মানুষের রাগ নেই? আর কেন রাগ উঠেছিল তোর আমার মোহের উপর? ওই জবার জন্য তাই না? সব ওই মেয়ের জন্য তাই না? ওই মেয়ের জন্য তুই নিজের স্বপ্ন, নিজের পরিবারের খুশি সব বিসর্জন দিলি। এখন নিজের সংসারটা এমন বিসর্জন দিয়ে দিলি? নাহ, তোকে কি বলছে সব তো আমার দোষ। তোকে সে অবস্থাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কি করব? মা’য়ের মন তো। আমি তো শুধু তোকে খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোর বিয়ে দিলে জীবনটা আবার গড়ে উঠবে। কিন্তু উলটো আমি একটা মেয়ের জীবন বরবাদ করে দিলাম।”

সমুদ্রের মা নিজের ওড়না দিয়ে কান্না মুছে তাকালেন মোহের দিকে। হাত জোড় করে বললেন, “মাফ করে দে, তোকে বিয়ে করিয়ে এনে তোর জীবন তছনছ করে দিয়েছি। এই কুলাঙ্কার এত বেশি খারাপ হবে জানলে কখনোই তোর বিয়ে ওর সাথে দিতাম না। তুই আমার মেয়ের মতো। প্রথমদিকে তোর সাথে এত ভালো ব্যবহার করিনি। কিন্তু এই কয়েক মাসে তুই আমার সেই সব স্বপ্ন পূরণ করেছিস যা আমি আমার মেয়ের জন্য সাজিয়ে ছিলাম। সমুদ্রের মা হিসেবে আমি তোর কাছে আকুতি মিনতি করতে পাড়তাম। আমার ছেলের সুখের খাতিরে। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে কখনোই এমন সংসারে থাকার জন্য জোর করব না। তুই ওর সাথে থাকবি কি থাকবি না তোর ইচ্ছা কিন্তু মনে রাখিস এখানেও তোর মা বাপ আছে।”

আবেগে মোহের কান্না এসে পড়ে। সে তার শাশুড়ী মা’য়ের হাত ধরে বলে, “এভাবে বলবেন না আম্মু। আপনারা একয়মাস আমার অনেক খেয়াল রেখেছেন কিন্তু…. “মোহ থামল। একবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আবার বলে, ” কিন্তু উনার সাথে থাকলে আমি নিজেকে ক্ষমা করব পাড়বো না। এ বাড়িতে আর আসা হবে কি-না জানি না কিন্তু আপনারা নিজের মেয়েকে দেখতে এসেন।”
সমুদ্রের মা নিজেকে সামলাতে আর জোরে কান্না করে দেয়। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে তাকায় সমুদ্রের দিকে, “তোকে তো সে কবেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ তোর জন্য আমার আরেক সন্তানও হারালাম। এর থেকে আল্লাহ আমাকে নিসন্তান রাখতেন তাও ভালো ছিলো।”
কান্না করতে করতে তার মা চলে গেলেন। বাবাও গেলেন তার পিছনে তাকে দেখতে।

মোহ তাদের দেখে নিজেকে আর সামলাতে পাড়ে না। ঠোঁট কামড়ে কান্না করে দেয়। সে একপলক শত স্মৃতি বাঁধানো এই কক্ষটা দেখে বুকে এক বড় পাথর নিয়ে এগোল। বের হওয়ার জন্য। তবে সমুদ্র দরজা বন্ধ করে দেয়।
মোহ তাকায় তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে, “কী করছেন আপনি?”
সমুদ্র তার বাহু ধরে তাকে পাশের দেয়ালে চেপে ধরে। একহাত তার গালে রেখে বলে, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না? নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে কীভাবে থাকবে?”
“ভালোবাসা চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েছি।”
“মধু আমি যদি পাড়তাম সে মুহূর্তে আবারও যেতাম। সে ভুলটা আমি কখনো করতাম না। প্লিজ মধু এই একটা ভুল ক্ষমা করে দেও।”
“একটা ভুল?” মোহ তাকায় সমুদ্রের দিকে। তাচ্ছিল্য হাসে, “আপনার মনে হয় বিয়ের এই সাড়ে সাত মাসে আপনি এই একটা ভুল করেছেন? আপনার জন্য আমি যত কেঁদেছি এই জনমে কারো জন্য এত কাঁদিনি। যতবার আপনার চোখে জবার জন্য ভালোবাসা দেখেছি আমি কেঁদেছি, যতবার আপনার মুখে তার নাম শুনেছি আমার নিশ্বাস আটকে গেছে, যতবার শুনেছি আপনি আমায় ভালোবাসেন না আমার বুকে পীড়ন হয়েছে। আপনার ভালোবাসায় ডুবে আমি পুড়েছি সমুদ্র। আর সাহস আমার নেই। আর ধৈর্য নেই। আর আমার পরীক্ষা নিবেন না। আমি আপনাকে আর কখনো ভালোবাসতে চাই না।”

সমুদ্র অপলক তাকিয়ে রইলো মোহের দিকে। তার চোখ সিক্ত। তার ঠোঁট কাঁপছে। তার শ্যামবর্ণা মুখও লালচে হয়ে গেছে। সে ঠোঁটজোড়া খুলেও কিছু বলতে চাইল। যা মুখ দিয়ে বের হলো না। অপলক তাকিয়ে রইলো তার সামনে থাকা মায়াদেবীর দিকে। তার বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। এতটা যে আর সহ্য করতে পাড়ছে না। আচমকা এই বুকের জ্বালা মেটানোর জন্য সে তার পাশের রাখা ড্রেসিংটেবিলে জোরে ঘুষি মারলো। আগের ক্ষত হাতে আবারও ঢুকে গেলে ভাঙা কাঁচের টুকরো। র’ক্ত গড়িয়ে পরতে থাকে। অথচ তার দৃষ্টি একপলকও পড়ে নি। সে একইভাবে তাকিয়ে থাকে মোহের দিকে।

আকস্মাৎ তীব্র শব্দে ভয় পেয়ে যায় মোহ। কানে হাত রেখে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ধীর গতিতে যখন চোখ মেলে তাকায় তখন দেখতে পায় র’ক্তাক্ত দৃশ্যপট। সে নিজেকে আশ্বাস দিয়েছিল সে নিজেকে শক্ত রাখবে। কিন্তু এই অবস্থা দেখে তার কোমল হৃদয়টা কেঁপে উঠে। সে আরও ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের দিকে। অথচ তার চোখের নোনাপানি টুপ টুপ করে বয়ে পড়ছে নরম গালে। সে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়ালো সে র’ক্তাক্ত হাতটা ধরার জন্য। কিন্তু তার মস্তিষ্ক সায় দিলো না। সে হাত দিয়েই বুকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিলো। লাগেজ নিয়ে যেতে চাইলেও দরজায় থেমে গেল। তার মন যেতে রাজি না। কী করবে সে? সে যে নিজের সাথে লড়াই করছে। এই ভালোবাসা ও সম্মানের লড়াইয়ে কাকে জিততে দিবে সে?

সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজা খুললো। তারপর তাকাল সমুদ্রের দিকে। সে আগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন সে জানে মোহ পরবর্তীতে কী করবে!
তাই হলো।
মোহ ধীর স্বরে বলল, “ডাক্তারের কাছে যাবেন।”
“তুমি নিয়ে গেল যাব।”
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না।”
“আচ্ছা।”
“ব্যান্ডেজ করিয়ে নিবেন।”
“না।”
মোহ ভারী বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি আপনার সাথে গেলেও আপনাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমার অটল।”
“কিছু মুহূর্ত তোমার সঙ্গের অনুভূতি তো বুকে জমাতে পাড়বো।”
“মানুষ এসব কথা শুনলে ভাববে কত ভালোবাসেন! অথচ…” বলতে গিয়ে ঢোক গিললো মোহ। বলল আবারও, “আসুন। ব্যান্ডেজ করার পর আমি বাসায় চলে যাব।”
.
.
শায়ান মহুয়ার হাত ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছিলো। মহুয়া ব্যথায় আরও বিরক্ত হয়। সে শায়ানকে জিজ্ঞেস করে, “থামবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমার স্কুটি পার্কিং করা ওখানে।”
“রাখো তোমার স্কুটি।”
“তুমি এমন বিহেভ করছো কেন? আর ওখানে কী উল্টাপাল্টা কথা বলছিলে তুমি? বেশি বেশি হয়ে গেল না?”
শায়ান থামে। তাকায় পিছনে ফিরে মহুয়ার দিকে দাঁতে দাঁত চেপে। তবে কিছু বলে না। রাগ গিলে নেয় নিজের।

মহুয়া পা’য়ের ব্যাথা অনুভব করে আবারও। বলে, “শয়তান শায়ানের বাচ্চা এত জোড়ে কেও টান দেয়? পা’য়ে ব্যাথা পেয়ে গেছি।”
সে বসে পড়ে রাস্তার পাশে পরিষ্কার জায়গা খুঁজে। শায়ানও তার সামনে বসলো হাঁটু গেড়ে, “সরি। আমি বুঝিনি। বেশি লেগেছে? ব্যাথা করছে খুব?”
“না অনেক মজা লাগছে। মজায় নাচতে ইচ্ছে করছে।”
“সোজা উওর তোমার মুখ দিয়ে বের হয় না?”
শায়ান দেখলো মহুয়া বাম পা ধরে আছে। চোখমুখ কুঁচকে রেখেছে। সে হাত এগিয়ে পা ছুঁতে নিলেই মহুয়া পা সরিয়ে নেয়।
“কী করছ তুমি?” মহুয়ার গম্ভীর কণ্ঠ শুনে সে তাকালো চোখ তুলে। মহুয়া চোখেমুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার মুখটা গম্ভীর।

যে শায়ান নিজের বাবাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে কাউকেই ভয় পায় না তার মহুয়ার এরকম গম্ভীর দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে উঠে। সে সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয়।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “নাটক করতে করতে কি পাগল হয়ে গেলে না’কি? মানুষ দেখানোর জন্য কেবল হাত ধরবে। এছাড়া অচেনা কেউ আমাকে ছুঁলে আমার অস্বস্তি লাগে।”
কথাটায় তার বুক কাঁপলো। কিছুক্ষণ আগে এসে দেখেছে জাহানের এতটা কাছে ছিল সে। সে দৃশ্যটা চোখের সামনে ভাসতেই তার বুকের ভিতর কেমন ব্যাথা করে। সেই মুহূর্তে কত কষ্টে সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল সেই জানে। অতিরিক্ত করে ফেললে মহুয়া তার আশেপাশেও ঘেঁষতো না কখনো।

শায়ান উঠে মহুয়ার পাশে বসে। তার থেকেও গম্ভীরমুখে বলে, “তোমাকে ছোঁয়ার শখ নাই আমার। আমার জন্য ব্যাথা পেয়েছ তাই দেখছি। পড়ে ভাবলাম শাঁকচুন্নিরা আবার ব্যাথা পায় না’কি!”
মহুয়া কথাটা শুনে তার বাহুতে কতগুলো ধুমধাম ঘুষি মারলো।
শায়ান এতে কিছু বলল না। শব্দ করে হাসলো। যাতে আরও রেগে যায় মহুয়া।

শায়ান নিজের হাসির শব্দ শুনে নিজেই থেমে গেল। তাকাল তার পাশে। মহুয়া পা’য়ে পা তুলে দেখছে। শায়ান তাকে দেখে হাসলো। মেয়েটাকে দেখেই আগে রাগ উঠতো তার। রাগে বুক জ্বলতো। অথচ সে খেয়ালই করে নি মেয়েটা আসার পর তার জীবনটা হাল্কা হয়ে গেছে। এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করে, সময় কাটিয়ে তার ভালোই লাগে। সে পরিবর্তন হচ্ছে। এখন আর তার আড্ডা দিতে ভালো লাগে না, নারীসঙ্গ উপভোগ করতে ইচ্ছে হয় না, মদের নেশা লাগে না। সব অভ্যাস ছিলো তার মনকে ভোলানোর জন্য। তার ভেতরের বিষাদ কাটানোর জন্য। অথচ সে কখনো খেয়ালই করলো না এই মেয়েটার সাথে তার মেজাজ খারাপ থাকলেও বুকের ভেতরের দুঃখগুলো আর অনুভব হয় না।

অথচ সে কখনো খেয়ালই করলো না এই মেয়েটার সাথে তার মেজাজ খারাপ থাকলেও বুকের ভেতরের দুঃখগুলো আর অনুভব হয় না।

শায়ান এক গভীর নিশ্বাস ফেলে। হঠাৎ মহুয়ার কন্ঠ কানে ভেসে উঠে, “তুমি অভিনয় অনেক ভালো করতে পাড়ো।”
“অভিনয়?”
“মানে একটু আগে একদম ঝাক্কাস অভিনয় করেছিলে। আমি তো ভেবেছি আসলেই তোমার রাগ উঠে গিয়েছিল। এক্টিং ট্রাই করা উচিত তোমার।”
বলে মহুয়া হাসে। কিন্তু শায়ান তো তাকে বলতে পাড়ে না। সত্যিই তার খুব রাগ উঠেছিলো। যা উলটো দাবিয়ে রেখেছে সে।
মহুয়া বাক্যটা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়।
“চলো যাই।”
“এত জলদি? একটু বসবে না।” নম্রসুরে আবদার করে শায়ান। তা-তে মহুয়া ভ্রু কুঁচকে তাকায়, “এখানে তো কেউ নেই। এখনো নাটক করছ কেন? ”
শায়ান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। উঠে দাঁড়ায়, “কিছু না। চলো। হাঁটতে পাড়বে?”
“না হাঁটতে পাড়লে কি তোমার পিঠে চড়ে যাবো?”
“তুমি চাইলে নিতে পাড়ি।”
একথা শুনে মহুয়া সরে দাঁড়ায়, ”ভাই প্লিজ এমন সুন্দর কথা তোমার মুখে মানায় না। তুমি নিশ্চয়ই শায়ান শিকদার না। এক মিনিট ওর কোন জমজ ভাই আছে। সেটা তুমি। ওই শয়তান শায়ানকে কিডন্যাপ করে তুমিও জায়গা নিয়েছো। গুড জব ম্যান।” মহুয়া তার পিঠে চাপড় মেরে সাব্বাশি দেয়।
শায়ান এবার বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে, “লাইক সিরিয়াসলি? এসব আসে কার মাথায়?”

মহুয়া হাসে। তারপর গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় শায়ানের দিকে, “জাহানের ব্যবহার আজব তাই না? এই’যে আমাকে কারো কাছে সহ্য করতে পাড়ে না আবার নিজের থেকে দূরে ঠেলে দেয়। কোনো ঘাপলা তো আছে, কি বলো?”
শায়ান থেমে যায়। তাকায় তার দিকে। তার চোখে একরকম বিস্ময়ের সাথে ভয়ও বিদ্যমান।
মহুয়াও থামে। ফিরে দেখে শায়ানের দিকে।
“আচ্ছা তোমার ফ্যামিলির সাথে জাহানের বাবার তো ভালো সম্পর্ক। আংকেলকে বললে কী আংকেল জাহানের বাবার সাথে আমার জন্য কথা বলবে? আংকেল তো রাজনীতি করে। অনেক পাওয়ারফুল। আংকেলের কাছে তো আমাকে হেল্প করা এক দুইয়ের ব্যাপার তাই না?”

শায়ান এক ঢোক গিললো। তার চোখে মুখে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস। বুকের ভেতরের হৃদপিণ্ডটা একটু বেশিই জোরে দৌড়াচ্ছে।
তার যখন ভয়ে অবস্থা বেহাল তখন মহুয়া একগাল হাসলো, “আমিও না আংকেল দেশের অবস্থা ছেড়ে কী আমাকে প্রেম করতে সাহায্য করবে! আর আংকেল তো জীবনেও করবে না৷ দাদী তো এখনও আমাকে তার নাতবৌ করার আশায় আছে।”
শায়ান গভীর এক নিশ্বাস ফেলে। শান্তির নিশ্বাস। মহুয়া আবারও হাঁটতে শুরু করলে সেও মহুয়ার পিছনে হাঁটতে শুরু করে। পার্কিং স্পটে এসে দেখে সেখানে জাহান আর রশ্মি কেউ নেই। মহুয়াকে স্কুটিতে উঠিয়ে দিয়ে শায়ান নিজেও বাইকে বসে। মহুয়ার মানা করা সত্ত্বেও তার পিছনে যায় বাসা পর্যন্ত। সে বাসার ভেতরে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ সামনের গলিতে বসে তাকিয়ে থাকে তার বারান্দার দিকে। কিছু একটা ভাবে।
.
.
রিকশার রাস্তায় কেবল ছয় সাত মিনিট লাগে। সামনেই একটা ক্লিনিক আছে। মোহ আর সমুদ্র বসে আছে রিকশায়। মোহ মুখ করা অন্যপাশে। সে সরে বসে আছে। সমুদ্রের স্পর্শও সে পেতে চায় না। কিন্তু অনুভব করতে পারছে, সমুদ্রের দৃষ্টি তার দিকে আটকে আছে। যেন গভীর দৃষ্টি দিকে সম্পূর্ণ ছুঁয়ে দেখছে তাকে। এজন্য একপলকও সেদিকে তাকায় না মোহ, ভুলেও। তার ভয় হয়, এই দৃষ্টিতে হারিয়ে যদি তার হৃদয়া জলের মতো গলে যায়? তাহলে নিজেকে উওর দিবে সে?

আচমকা অনুভব হলো , তার হাতে পুরুষালী ছোঁয়া। সে তাকাল নিজের হাতের দিকে। সমুদ্র তার হাত ধরল, হাতে হাত রেখে আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দিলো। ভেতরের সত্তা কেঁপে উঠে মোহের। সে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার ভেতরে যেন তুফান উঠেছে। সহ্য করতে পাড়লো না সে। হাত ছাড়াতে নিলে সমুদ্র আরও শক্ত করে তার হাত ধরলো। এবার সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল সমুদ্রের দিকে। কিন্তু তার সে চাহনি দেখে ভেতরের আত্না কেঁপে উঠে তার। তার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠে। তবুও নিজেকে সামলে বলে, “হাত ছাড়ুন।”
“তোমার এতটুকু অনুভূতি নিতে দেও অন্তত, তোমার অনুভূতি ছাড়া যে আমার ভেতরটা শূন্য লাগে। বুকে ভেতর হাহাকার করে।”
“কারণ কী? আমি তো আপনার ভালোবাসার মানুষ নই। এসব কথা তাকে যেয়ে বলুন। আপনার সমস্যা কী জানেন? দেবদাস হবার বড্ড শখ আপনার। তাইতো আমার মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য মেয়ের জন্যও দেবদাস হয়ে যাচ্ছেন। যাকে কখনো ভালোইবাসেন নি। কিন্তু আমার আপনার জন্য পারু বা চন্দ্রমুখী হবার শখ নেই।”

রিকশা থেমে গেছে। ছোট একটা ক্লিনিক এসে পড়েছে। মোহ ভারী স্বরে বলে, “হাত ছাড়ুন। ক্লিনিক এসে পড়েছে।”
মোহ নামার পর সমুদ্রও নামে। তারা ক্লিনিকে যায়। তার হাতের অবস্থা দেখে ভারী বিরক্ত হয় ডাক্তার, “আপনি না গতকালও ব্যান্ডেজ করতে আসলেন? একদিন পরও কাঁচ ঢুকে ছিলো হাতে। বলেছিলাম খেয়াল না রাখলে ইনফেকশন হতে পাড়ে। কী কান্ড ঘটালেন আপনি আবার?”
মোহ এবার চিন্তিত হয়। সে চিন্তিত সুরে বলে, “ডক্টর উনার কোনো ক্ষতি হবে না-তো?”
“আমি ব্যান্ডেজ খুলে দেখছি।”
“প্লিজ ডক্টর যেন উনার কিছু না হয়।” আকুতির সুরে বলল মোহ। সে দেখলো ডাক্তার হাতের ব্যান্ডেজ খোলার আগে একটি কাঁচের টুকরো বের করছে হাত থেকে। এখনো এমন কতগুলো কাঁচের টুকরো সে হাতে গাঁথা। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো খিঁচিয়ে। ডাক্তার হাসলো। তাকাল সমুদ্রের দিকে। তার কোনো হেলদোল নেই। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো তো সামনে বসা মেয়েটির দিকে। তার চোখে ভয় বা চিন্তার কোন ছাপ নেই। অথচ তো সামনে বসে মেয়েটি যেন ভয়ে কাতরাচ্ছে।

ডাক্তার হাসল। জিজ্ঞেস করে, “আপনার ওয়াইফ?”
একথায় সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে, “হ্যাঁ।”
“আপনারা একে অপরকে অনেক ভালোবাসেন তাই না? দেখে বুঝা যায়। তো শুনুন, আপনি সিগারেট খাওয়া কমান। এত সিগারেট খেয়েছেন যে আপনার থেকেই সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি। আপনার বয়স কম। আপনার বউয়ের বয়স আরও কম। সিগারেটের ক্ষতি জানেন না? আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার বউ বাচ্চার কী হবে বলেন?”
কথাটা শুনে চমকায় মোহ। আপনা-আপনি তার পেটে হাত চলে যায় নিজ অজান্তেই। একটাই তো স্বপ্ন ছিলো তার, জীবনে একমাত্র সে ভালোবাসবে তার স্বামীকে। তার স্বামীও তার ভালোবাসবে বাঁধনহারা হয়ে। দু’জনের ছোট সুখী। সংসার হবে। দু’টো বাচ্চা থাকবে। সারাদিন সে ঘরে বাচ্চাদের হাসির শব্দ গুঁজবে। চারজনে একত্রে প্রতিরাতে বসে গল্প করবে। তার চাওয়াটা কী খুব বেশি ছিলো?
নিশ্বাস আটকে এলো তার। এখানে আর থাকতে পাড়লো না। সে উঠে দাঁড়ায়, “আমি বাহিরে আছি।”
বলে সে বেরিয়ে যায়। সমুদ্রও যায় তার পিছনে। সেখে মোহ আরেকটি রিকশা ঠিক করছে।

সমুদ্র যেয়েই তার হাত ধরে নেয়, “তুমি বলেছিলে তুমি থাকবে।”
“প্লিজ আমার আর সহ্য হচ্ছে না সমুদ্র। আমার সাথে এমনটা না করলেও পাড়েন। আপনার সাথে থাকলে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। প্লিজ আপনি ব্যান্ডেজটা করিয়ে নেন। আর যদি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আপন ভেবে থাকেন তাহলে নিজের খেয়াল রেখেন। কারণ আপনাকে এমন অবস্থায় দেখলে আমার কষ্ট হয়। আপনি তা বুঝবেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসার ভুল করে ফেলেছিলাম, আপনি ভুলেও আমাকে ভালোবাসেন নি।”
মোহ তার হাত ছাড়িয়ে উঠে পড়ে রিক্সাতে।
সমুদ্র তার পিছনে যেতে পাড়ে না। তবুও তার মনে হয় তার এতক্ষণ ভার থাকা বুকটা আবারও শূন্য হয়ে গেছে।
.
.
শায়ান নিজের বাবার কোয়াটারে অপেক্ষা করে। তার বাবা কাজ করা অবস্থায় এখানেই থাকেন। আজ সে জীবনে প্রথম এসেছে এখানে। অপেক্ষা করছে চার ঘন্টা ধরে। তার বাবা আসছে না। তবুও সে নাছোড়বান্দা। দেখা করেই যাবে। যতক্ষণই অপেক্ষা করতে হয়।

তার বাবা আসে কিছুক্ষণ পড়েই। তাক দেখে অবাক হয়। সে ভারী গলায় বলে, “তুমি এখানে এখনো আছো? চারঘন্টা আগে না’কি এসেছিলে?”
“অপেক্ষা করছিলাম।” শায়ান দাঁড়িয়ে উওর দেয়।
তার বাবাকে প্রথমে অবাক দেখায়। তারপর চিন্তিত। তারপর রাগী সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী অঘটন ঘটিয়েছ?”
“কিছু না।”
তার বাবাকে আরও অবাক দেখায়। শায়ান এত শান্ত গলায় উওর দিচ্ছে? শায়ান সবার সাথে রাগী সুরে কথা বলে আর তার সাথে ভয়ে। তার এমন শান্ত কথার ধরণ তার হজম হচ্ছে না। সে জিজ্ঞেস করে, “কেন এসেছ?”
“কথা আছে।”
“আচ্ছা ভেতরে আসো। খাবার লাগাতে বলছি। খেতে খেতে কথা বলবো।”
শায়ান তাচ্ছিল্য হাসে। এই প্রথম তাকায় তার বাবার চোখে। চোখে চোখ রেখে বলে, “আপনার সাথে খেতে আসি নি বাবা। যা গত আঠারো বছরে হলো না তা এখন কেন হবে। অবশ্য আঠারো বছর আগে আমার সাথে বসে খেয়েছেন কি-না মনে নেই ঠিক। যাই হোক আপনার সাথে বিশেষ কথা আছে। আপনি তো খুব ব্যস্ত মানুষ সময় নষ্ট করবো না। সরাসরি বলি, আমি যোগ্য হতে চাই।”
শারাফ শিকদার বিস্ময়ের চরম সীমানায়, “কী?”
“আমি যোগ্য হতে চাই। আপনি ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক যে কাজ বলবেন আমি সব করতে রাজি। কেবল আমাকে এতটুকু যোগ্য বানাবেন যেন পাঁচবছর পর মহুয়ার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারা মানা না করতে পাড়ে। সারাজীবন বাবা হবার কোনো দায়িত্ব পালন করেন নি। অন্তত নিজের ছেলের জন্য এতটুকু তো করতে পাড়বেন।”
তার বাবা আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শায়ানের দিকে। যেন সে বিশ্বাসই করতে পাড়ছেন না এইটাই তার ছেলে।

“আর যদি না পাড়েন আমাকে জানাবেন আমি অন্য রাস্তা খুঁজে নিব। আসি।” শায়ান বলে চলে যেতে নিয়েও আবার ফেরত তাকায়। বলে, “জানেন আমি ছোট থেকে ভাবতাম, আমি ছেলে হিসেবে অনেক খারাপ তাই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আর আপনি আমার খবরও নেন না। আমার বাঁচা বা ম’রে যাওয়াতে আপনার কিছুই আসেযায় না। কিন্তু না আপনারা বাবা মা হিসেবে ব্যর্থ। আমি মানুষ হিসেবে খারাপ হতে পাড়ি কিন্তু একটা জিনিস আমি নিশ্চিত বলতে পাড়ি। আমি বেস্ট বাবা হয়ে দেখাব। যে ভালোবাসা আমি পাই নি তা আমার ছেলেমেয়েদের দিব। আপনার মতো অযোগ্য বাবা আমি কখনো হবো না।”
কথাগুলো বলে চলে গেল শায়ান। আর শারাফ শিকদার বাকরুদ্ধ হয়ে তার কথা শুনে গেলেন। তার উওর দেবার মতো কিছু ছিলো? বোধহয় না, আজও তার মনে আছে তার স্ত্রীর ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা। যে নারীকে সে তার প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল সে কি নিষ্ঠুরতার সাথে ছেড়ে গিয়েছিল তাকে। অন্য পুরুষের হাত ধরে। সে কিছুই করতে পাড়লেন না তখন। কিন্তু তার আঙুল ধরা সে ছোট ছেলেটাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। তাকে দেখলেই যে সে বিশ্বাসঘাতক নারীর কথা মনে পড়তো তার। যার বিশ্বাসঘাতকতা শাস্তি দিতে পাড়লেন না তিনি। তাইতো সে শাস্তি অবহেলা স্বরূপ দিয়ে গেলেন তারই অংশকে বছরের পর বছর।

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৪৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“তুই একা বাসায় যেতে পাড়বি শিউর?” মুরাদ ফোনে জিজ্ঞেস করল কথাটি। মৃণা নির্দ্বিধায় উওর দিলো, “পাড়বো। বাসা তো এখানের কাছেই। রিকশা নিয়ে চলে যাব দশ পনেরো মিনিট লাগবে।”
“এই মিটিং এর জন্য দেরি হয়ে গেল। তুই একটু নাহয় দাঁড়া, আমি আসছি।”
“আপনার উলটো পড়ে যাবে ভাইয়া। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সামলাতে পাড়বো।”
“আচ্ছা। যেয়েই আমাকে জানাবি।”
“ঠিকাছে।”

মৃণা সামনে এগোল। রাত বাজে তখন পৌণে দশটা। এই সময় রাস্তাটা একদম নীরব না থাকলেও রিকশা পেতে দেরি হলো। রিকশা পেয়ে সে উঠলো। আজ চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে চাঁদ তারা নেই। মৃণার ভেতরটা আজ অস্থির লাগছিল। যদিও সে বাসার কাছাকাছি এসে পড়েছিলো। তাই নিজের মনকে স্বস্তি দিলো।

হঠাৎ রিকশা থেমে যায়। সামনে দুইটা বাইক এসে দাঁড়ায়। দুই বাইকে চারটা ছেলে। হাতে তাদের মদের বোতল। তাদের দেখে চমকিত হয়ে যায় মৃণা। তার বুকের ভয়টা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে মুহূর্তের পর মুহূর্ত। সে রিকশাওয়ালা মামাকে বলে, “মামা অন্যদিক দিয়ে রিকশা নেন।”
সে চেষ্টা করে কিন্তু ছেলেগুলো বাইক থেকে নেমে রিকশার আশপাশ ঘেরা ধরে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায় মৃণার। ছেলে একটা মাতাল হয়ে হেলেদুলে পড়ে যাচ্ছে যেন। তবুও সে রিকশাতে উঁকি দেয়। মৃণা হুট উঠাতে চাইলে সে হাত দিয়ে হুট ধরে নামিয়ে বলে, “ভাই মাইয়া একটা। দেখতে আহামরি না।”
“মাইয়া তো। নামা।”
ছেলেটা মৃণার হাত ধরলে সে হাত ঝারিয়ে বলে, “দে…দেখুন ভাইয়া আপনারা আমাকে যেতে দিন।”
“ভাইয়া? ওই শালী কে তোর ভাই? আমারে তোর ভাই মনে হয়? যখন রাত কাটাবি তখন বুঝবি আমি কে!”
“ছিঃ! এসব কী বলছেন আপনি?”
“এই শুদ্ধ ভাষা মারাইস না। নিচে নাম।”
অন্য ছেলে তখন বিরক্ত গলায় বলে, “ওরে জিগাইতোস কোন দুঃখে? ধরে টেনে ছিঁচড়ে আইনা বাইকে উঠা। জলদি কর। কেউ আইসা পড়বো।”
মৃণা চিৎকার করলে ছেলেটা তার মুখ চেপে ধরে তাকে টান দেয়। হাঁটুর ভরে পড়ে মৃণা। কিন্তু ভয়ে তার কোনো ব্যাথা অনুভব হয় না। সে টানা হিঁচড়া করলে আরেকটা ছেলে এসে তার হাত ধরে, “এমন নাচতাছোস কে? তোর শরীরে কত জোর আসে তাও দেখুম দাঁড়া।”
আরেকজন ছেলে রিকশাওয়ালাকে বলে, “তোরে কি এখান থেকে যাইতে আমন্ত্রণ দিতে হইবো, না তুইও আমগো লগে যাইতে চাস?” বলে কুৎসিত হাসলো সে।

রিকশা নিয়ে দ্রুত গেল লোকটি। মৃণা কোঁকড়াচ্ছিল। শেষ আশাও তার চোখের সামনে থেকে এমনভাবে চলে যাওয়ায় অসহায় লাগছিল তার। ভয়ে তার আত্না কেঁপে উঠে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ম’রে গেলেও তার কোনো আফসোস থাকবে না। কিন্তু তার সম্মানের কিছু হতে দিবে না সে। সে নিজের বুকের সব সাহস জোগাড় করে মুখ ধরে থাকা ছেলেটির হাতে কামড় দিলো। ছেলেটা হাল্কা ছাড় দিতে মৃণা চিৎকার করে দৌড় দিতে চাইল তখনই এক ছেলে তার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফিক্কা মারলো। মাথায় ব্যাথা পেয়ে র’ক্ত ভেসে উঠেলো তার। তবুও সে চিৎকার করা থামালো না। আশপাশ থেকে শব্দ আশা শুরু হলে প্রথম ছেলেটা বলে, “ওকে জলদি বাইকে তুল শালা। মুখ চেপে ধর।”
তার ধরার আগে মৃণা হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েই দৌড় দিলো। ছেলেটার হাতে এলো কেবল তার ওড়না। সে আবারও ধরতে নিলে পিছন থেকে দেখলো মানুষ আসছে। একজন বলল, “মাইনষে আইতাসে। জলদি চল।”
“মাইয়াডা?”
“এমন মাইয়া প্রতিদিনই পামু। উঠ জলদি।”

ছেলেগুলোকে যেতে দেখে। মৃণা অবশেষে থামে। ব্যাথায় এক পা’ও নড়তে পাড়ে না আর। থপ করে রাস্তাতেই বসে পড়ে। কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থেকে। সজোরে কেঁদে দেয়। তার হাত পা কাঁপতে থাকে। কিছু মুহূর্ত পর তার সাথে কতকি হতে পাড়তো ভাবতেই বুকের ভেতরটা সজোরে কেঁপে উঠে। সজোরে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে সে। দেখে কতগুলো লোক আসছে। আবারও ভয়ে তার আত্না কেঁপে উঠে। সে ভয়ে সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আবার থপ করে বসে পড়ে। ব্যাথায় নড়তেও পাড়ছে না। তারপর আবারও দাঁড়াল। বহু কষ্টে চেষ্টা করল দৌড়াতে। কিন্তু তার জান প্রাণ যেন বের হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ দেখল লোকগুলোর মাঝে তাকে আনা রিকশাওয়ালাও আছে। সাথে আছে একটি মহিলা।

রিকশা নিয়ে সামনে এসে মাঝবয়েসী লোকটি বলে, “আম্মা তুমি ঠিক আসো তো?”
প্রশ্নটা শুনতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মৃণা। উওর দেবার অবস্থায় সে নেই।
লোকটি আবারও বলে, “আমি তো একা ওগোর লগে লড়তে পাড়তাম না এল্লাগা চা’য়ের দোকানে যাইয়া লোক নিয়া আইসি। তুমি উঠো আমি তোমারে বাসায় দিয়া আসি।”
মৃণা ভয়ে নড়তেও পাড়ে না। এক মহিলা এসে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মৃণাকে ঢেকে রিকশায় উঠায়। তারপর নিয়ে যায় তার বাসার সামনে। মৃণা তখনও নিস্তব্ধ হয়ে ছিলো। সে বহুকষ্টে রিকশাওয়ালাকে জানায়, “আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে আজ আমার সাথে…” বলে ঠোঁট কামড়ে ধরে কেঁদে দেয় মৃণা।
“আম্মা তোমার বয়সের আমার মাইয়া আছে। আমার মাইয়ার লগে কেউ এমন করলে আমি ছাইড়া যাইতাম কও?”
“ধন্যবাদ মামা।”
মহিলাটিও বলে, “আমি এই গলির সামনের চা’য়ের দোকানেই থাকি। কিছু লাগলে আমারে কইয়ো।”

তারা যাবার পর মৃণা বাসায় ঢুকে। লামিয়া দরজা খুলে তার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে চমকে উঠে। সে মৃণার কাঁধ ধরে আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “এ’কি অবস্থা তোমার আপু? কী হয়েছে তোমার? এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
মৃণা কিছু বলে না। বলতে পাড়ে না। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। সে কিছু মুহূর্ত লামিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে ফুপিয়ে।
.
.
সিনথিয়া এসেছে ফুপির সাথে বেড়াতে। শ্রাবণীর সাথে দেখা করবে বলে। কিন্তু তার দেখা করতে যাওয়ার মতিগতি দেখা গেল না। রাতে তৈরি হয়েছিল বের হবার জন্য। মুরাদকে দেখে আর গেল না। তার আশেপাশে ভনভন করতে লাগলো। এইত্তো মুরাদ তার ফুফার সাথে বসে টিভি দেখছিল আর গল্প করছিল কাজের ব্যাপারে। সিনথিয়া চা নিয়ে এসে একেবারে ঘেঁষে বসলো তার দিকে। মুরাদ তার দিকে চোখ রাঙালো ঠিকই, কিন্তু সে না দেখার মতো বেহায়ার মতো বসে রইলো। এরপর মুরাদ নিজেই উঠে যেয়ে বসলো তার ফুফার পাশে। তার ফুফার সাথে কথা বললেও তার ধ্যান সম্পূর্ণ নিজের ফোনে।

সে অপেক্ষা না করতে পেড়ে এক পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। কল দেয় মৃণাকে।

সে কখন থেকে মৃণাকে কল করে যাচ্ছে অথচ মেয়েটার ফোন বন্ধ আসছে। তার ভীষণ চিন্তা হলো। তার কাছে লামিয়ার নাম্বার ছিলো ইমারজেন্সির জন্য। সে কল করলো। প্রথমে লামিয়া কল না ধরলেও তৃতীয়বার ধরল। ধরতেই সে জিজ্ঞাসা করল, “লামিয়া বলছো?”
“জ্বি কে?”
“আমি মুরাদ। মৃণাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। তাই তোমাকে কল দিলাম। ও কী বাসায় পৌঁছে গেছে?”
লামিয়া তাকাল তার সামনের দিকে। মৃণা বিছানার একপাশে গুটি শুটির মেরে বসা। বহু কষ্ট মানে তাকে গোসল করতে পাঠিয়েছিল। ভেবেছিল আসলেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। তার হাত ছিঁলে গেছে। হাঁটুর কাছের ব্যাথা সে এখনো দেখেনি কিন্তু তার পায়জামা, কামিজে রক্ত লাগা, মাথায় চোট খেয়ে র’ক্ত লেগে আছে। এতকিছুর পরও সে যায় নি। খাবার নিয়ে বসেছিলো পনেরো মিনিট ধরে। খাবেও না। ভয় পেয়ে আছে ভীষণ।

লামিয়া ফোনে মুরাদকে বলল, “ভাইয়া… ” বলে চুপ তইলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার বলল, “বিরাট কিছু হয়ে গেছে।”
এতটুকু শুনেই আতঙ্কে মুরাদের গলা শুকিয়ে গেল। সে কাঁপানো সুরে বলে, “মৃণা ঠিক আছে তো?”
“না ভাইয়া।”
মুরাদ তখনই রওনা দেয় মৃণার বাসার উদ্দেশ্যে, ” কি হয়েছে তা বলো।”
সে বাহিরে যাবার সময় সিনথিয়া সামনে এসে দাঁড়ায়। আবদারের সুরে বলে, “মুরাদ ভাইয়া তুমি কি বাইরে যাচ্ছো? আমাকেও সাথে নিয়ে চলো। আমরা একসাথে আইসক্রিম খেয়ে আসব।” বলে তার বাহু ধরতে চাইল।
মুরাদের তখন মেজাজ ছিল চরম পর্যায়ে। এর মধ্যে সিনথিয়ার এমন গায়ে পড়া স্বভাব দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়, “আমার সাথে ফারদার এমন বেহায়ামি করলে এই ঘরে আসা বন্ধ করে দিবো। মনে রাখবি। বেয়াদব কোথাকার!”

মহুয়া তখনই নিচে নেমেছিল সিঁড়ি দিয়ে। সম্পূর্ণ ঘটনা চোখে না পড়লেও মুরাদ যে সিনথিয়াকে বকলো তা স্পষ্ট চোখে পড়লো। আর তা দেখে হাসতে হাসতে সে সিঁড়িতেই বসে পড়লো।

সিনথিয়া তো ফুলে ফুঁপে আগুন। মুরাদের বকা থেকে মহুয়ার এমন হাসিটা তার কাছে বেশি অপমানজনক লাগলো। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, একবার মুরাদের সাথে তার বিয়েটা হোক, তারপর সবার আগে সে মহুয়াকেই শিক্ষা দিবে।

মুরাদ মৃণার বাসার সামনে যেয়ে গাড়ি থামায়। কীভাবে সে ড্রাইভ করে এতটুকু এসেছে সে-ই জানে। তার বুক কাঁপছে রীতিমতো। শরীর কাঁপছে। মাথার ভেতর ভনভন করছে। মৃণা এমন পরিস্থিতিতে ছিলো ভাবতেই তার নিশ্বাস আটকে এলো।

মুরাদ ভেতরে যেয়ে কলিংবেল দিতেই দরজা খুলে লামিয়া। মুরাদকে দেখে শান্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে, “ভালো হয়েছে ভাইয়া এসেছেন। আপু তখন থেকে বসেই আছে। খাচ্ছেও না, ডাক্তারের কাছে যাবেও না। গোসল থেকে বের হয়ে কোন কথা বলছে না।”
মুরাদ ভেতরে ঢুকে দেখলো মৃণাকে। তার মাথার আঘাত, হাতের চামড়া ছিঁলে যাওয়াটা দেখেই তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। তার মনে হলো ওই ছেলেগুলোকে সামনে পেলে মে’রেই ফেলবে সে।

সে এই রাগ দাবিয়ে মৃণার সামনে যেয়ে বসলো। ডাকলো তাকে, “ময়না…”
মৃণা চোখ তুলে তাকায়। তাকে দেখেই মৃণার চোখ ভরে আসে। সে আহ্লাদিত ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টে তাকায় তার দিকে। স্তব্ধ থাকা মনটা বিচলিত হয়ে যায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে।

তার কান্না যেন ঝড়ের মত এলোমেলো করে দেয় মুরাদের হৃদয়। সে নিজেকে সামলাতে না পেড়ে মৃণার মাথার পিছনে হাত রেখে তাকে বুকে চেপে ধরে। জড়িয়ে নেয় তাকে। তার চোখেও পানি ভরে আসে। সে শক্ত করে মৃণাকে বুকে ধরে তার কপালে চুমু খায় একখানা। আর কাঁপানো সুরে বলে, “মাফ করে দে ময়না। আমার তোকে একা যেতে দেওয়াই উচিত হয় নি। আমার তাড়াতাড়ি আসা উচিত ছিলো। আমি থাকলে এমনটা হতো না। আমার জন্য তোর এত কষ্ট হয়েছে।”
কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। মৃণা তা বলতেই চাইলো কিন্তু কান্নার জন্য সে কথাও বলতে পাড়ল না। মুরাদের বুক পেয়ে তার কান্নার বেগ যেন আরও বাড়লো। এতই বাড়ল যে নিশ্বাসও আটকে এলো।
তার যখন কান্না কমে এলো তখন মুরাদ লামিয়াকে বলে, “আমি ওকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। ও আর এখানে থাকবে না। তুমি একা কীভাবে থাকবে? আমাদের সাথে চলো।”
“না না ভাইয়া নিতু আর মিতু আপু এসে পড়বে। আমি পড়ে আপুর সাথে দেখা করতে আসবো। আমার চিন্তা করা লাগবে না। এমন মানুষ আমার সাথে খারাপ করতে আসলে আমি তো চোখ উঠিয়ে ফেলতাম। এখানে আসার পর একবার দুইজন আমাকে ধরেছিল মরিচের গুঁড়া দিয়ে তাদের চোখ জ্বালিয়ে দিয়েছি। আপনি মৃণা আপুর খেয়াল রাখেন।”

মৃণা মুরাদের বুক থেকে মুখ তুলে তাকায়, “আমি কোথাও যাব না।”
মুরাদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। শাঁসিয়ে বলে, “তোর থেকে অনুমতি নিচ্ছি না। তোকে বলছি।”
তাকে কোলে তুলে নেয় মুরাদ। আর বলে, “তাদের আমি ধরে তোর কাছে আনবো। তোকে ছোঁয়া হাত থাকবে না। চিন্তা করিস না।”
মুরাদ তাকে কোলে তুলে নেয়। মৃণা সাথে সাথে আঁতকে উঠল, “মুরাদ ভাই আমি বাসায় যাব না। নামান আমাকে।”
কে শুনে কার কথা? মুরাদ তাকে নিয়ে বের হয়।
লামিয়াও সাহায্য করে তার।

গাড়িতে মৃণা কোনো কথা বলে না। বাড়ির সামনে এলে মুরাদ আবার মৃণাকে কোলে নিতে চাইলে অনেক অনুরোধে থামায়। তাই মুরাদ তার হাত ধরে নিয়ে আসে বাসায়।

সবাই রাতের খাবার খাচ্ছিল। ডাইনিং রুমে খাওয়া-দাওয়ার সময় মুরাদের সাথে মৃণাকে দেখে সবাই অবাক হয়। মহুয়া অবাক হয় সবচেয়ে বেশি। মৃণা তো বলে নি আজ আসবে। তখনই তার চোখ যেয়ে আটকায় তার মাথায়। কপালে আঘাতের চিহ্ন দেখে খাবার রেখেই উঠে দৌড়ে যায় সে। তার কপালে আঘাতের পাশে হাত ছুঁতে যেয়েও হাত সরিয়ে নেয়। চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “তোর কপালে কী হয়েছে? ব্যাথা পেয়েছিস কীভাবে?”

মুরাদ জানিয়ে দেয়, “মৃণা আজকের পর থেকে এখানেই থাকবে। তোর সাথে। ওকে রুমে নিয়ে যা। ধরে নিয়ে যাবি, পা’য়েও ব্যাথা পেয়েছে।”
“কিন্তু ব্যাথা পেয়েছে কীভাবে?”
মহুয়ার মা’ও আসেন তার কাছে। তার চুলে হাত বুলিয়ে চিন্তিত সুরে বলে, “ব্যাথা পেলি কীভাবে তুই? তোকে বলেছিলাম এখান থেকে যেতে না। একা থাকতে কষ্ট হবে। দেখলি তো। কী অবস্থা হয়েছে তোর? ও উঠতে পাড়বে দোতলায়?”
“গেস্ট রুমে তো ফুপিরা আছে।”

ফুপি বলল, “কী’রে মুরাদের মা তুই কী চাস আমরা রুম ছেড়ে যাই?”
“না না আপা কী বলেন? দুইটা রুম তো ও নাহয় সিনথিয়ার সাথে এক রুমে থাকতো। পা’য়ের ব্যাথা কমলে মহুয়ার রুমে চলে যাবে।”
সিনথিয়া মুখ বানাল তাকে দেখে, “আমি ওর সাথে রুম শেয়ার করবো না।”
তারপর মুখ বানিয়ে আবার খেতে শুরু করে।
মহুয়া রাগে তাকায় তার দিকে। রাগান্বিত স্বরে বলে, “ওকে তোমার সাথে রাখবোও না। ব্যাথা পেয়েছে যেহেতু দেখাশোনা করতে হবে। তোমার ভরসায় রাখবো না’কি? তুমি আমার রুমে যাও। আমি মৃণার সাথে গেস্ট রুমে থাকবো।” তারপর সে মৃণাকে ধরলো, “সাবধানে আয়।”
মুরাদ বলে, “আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি।” বলে বেরিয়ে গেল।
মহুয়া মৃণাকে নিয়ে যাবার সময় ফুপি মহুয়ার মা’কে বলে, “ঘরে জোয়ান ছেলে থাকতে বাহিরের মেয়েকে ঘরে থাকতে দিচ্ছিস কীভাবে তোরা?”
একথায় মৃণা থেমে যায়। পিছনে ফিরে তাকায় কথাটা শুনে। মহুয়ার কানেও কথাটা যায়। সে তো রাগে মুঠোবন্দি করে নেয়। ফিরে কিছু বলতে যাবে আর মৃণা থামায় তাকে। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় মানা করে কিছু না বলতে।

তার রুমে যাবার পর মহুয়ার মা জানায়, “মহুয়ার ছোট বেলার বান্ধবী আপা। অনেক ভালো মেয়ে।”
“ভালো মেয়ে হলে একা থাকে কেন? পরিবার নাই?”
“সৎ মা’য়ের সংসার তো অনেক অত্যাচার হতো তাই…”
“তাই নিজের ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়েছিস৷ ঘরে একটা ছেলে আছে। এসব মেয়েদের ভালো করে চিনি ভুলিয়ে ভালিয়ে ছেলেদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে নেয়।”
“আপা মৃণা এমন মেয়ে না। ওকে ছোট থেকে চিনি আমি।
“এখন তো কথা ভালো লাগবে না। আচ্ছা যাই হোক, মেয়েকে বেশিদিন ঘরে রাখবি না। আর মুরাদের বয়স হয়েছে। ওর জন্য একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দে।”
মহুয়ার বাবা বলেন, “মুরাদের সাথে এই নিয়ে কথা হয়েছে আপা। ও এখন বিয়ে করবে না।”
“তো বুড়ো হলে করবে না’কি? এমন সফল ছেলেদের প্রতিই তো মেয়েদের নজর বেশি থাকে। ভুল পথে যাওয়ার আগে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়ে দে। আমি এক দুইদিন পর কথাটা বলতাম। তবে যেহেতু কথা উঠেছেই তাহলে এখনই বলি। সিনথিয়ার সাথে মুরাদের বিয়ের কথা ভাবছিলাম। তোদের কী মতামত?”
.
.
মুরাদ ডাক্তার ও নার্স নিয়ে এসেছে মৃণাকে দেখাতে। অথচ মহুয়াকে দেখেই সে থতমত খেয়ে গেল। রাগে তার ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে। সে বুঝতে পেড়েছে মৃণা সব জানিয়েছে তাকে। মুরাদকে দেখেই মহুয়া উঠে দাঁড়ায়,
“ভাইয়া তুমি ওকে ডাক্তার দেখাও, আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
মহুয়া উওর দেয় না। সে উঠে চলে যায় সেখান থেকে। সোজা যায় দোতলায়। ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর কতক্ষণ পায়চারি করে, এরপর মাথায় হাত দিয়ে নিচে বসে পড়ে। তবুও তার মাথার আগুন নিভে না। রাগে রক্ত উঠে গেছে যেন মাথায়।

সে পকেট থেকে ফোন বের করে কল দেয় জাহানকে। জাহান প্রথমে তার কল ধরে না। পরে ধরা মাত্রই মহুয়া ঝারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কল দিচ্ছি চোখে দেখা যায় না? কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলে যে কল ধরতে পাড়ছো না?”
“অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আই থিংক আমাদের কথা বলাটা উচিত হবে না…”
“এই কচুর কাহিনী এখন শুরু করবে না। আমার বাসার সামনে আসো জলদি। তোমার বাসা থেকে এখানে আসতে লাগে পঁচিশ মিনিট। তুমি ত্রিশ মিনিটে এখানে এসে না পৌঁছালে কসম খেয়ে বলছি তোমার চেহেরা আমি জীবনে দেখবো না। তুমি আমার সামনে এসে মিনতি করলেও তোমার সাথে এক মুহূর্তের জন্য থাকবো না। ছুঁতে দেওয়া তো দূরের কথা নিজের চেহেরাও দেখাব না।”
এই কথা শুনে জাহান কিছু সময় চুপ রইলো। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোমার কিছু হয় নি তো? কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে?”
“তুমি আসো।”
“আগে বলো, নাহয় এ চিন্তা মাথা থেকে যাবে না। রাস্তায় আমি কি করে বসি…”
“আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি কিন্তু আমার মেজাজ ঠিক নেই।”
“আসছি।”

ত্রিশ মিনিটের কথা থাকলেও কাঁটায় কাঁটায় বাইশ মিনিটেই এসে পড়েছে জাহান। বাইক নিয়ে গলির সামনে দাঁড়িয়ে কল দেয় মহুয়াকে। মহুয়াকে সহি সালামত আসতে দেখে সে শান্তির নিশ্বাস ফেলে। মহুয়া তাকে আশ্বাস দেবার পরও এতক্ষণ চিন্তায় সে কিছু ভাবতেও পাড়ছিল না। কিন্তু সে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ এমন অস্থির হয়ে ডাকলে কেন?”
“তোমার হেল্প লাগবে।”
“কী হয়েছে বলবে?”
“মৃণা একটা গানের স্টুডিওতে জয়েন করেছে। ওখানে ভোকাল ট্রেনিং করতে গিয়েছিল। ওখান থেকে বাসায় যাওয়ার সময় চারটা ছেলে ওর সাথে…”
রাগে, কষ্টে চোখ বন্ধ করে নেয় মহুয়া। তার নিশ্বাস আটকে আসে। বহু কষ্টে বলে, “ওরা একটুর জন্য মৃণাকে কিছু করতে পাড়ে নি। মানুষ এসে পড়েছিল। কিন্তু যদি কিছু করে ফেলতো!” মহুয়ার কন্ঠে স্পষ্ট ভয় ভেসে উঠে। সে জাহানের দিকে তাকায় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে, “তুমি… তুমি জানো ওর মাথায়, হাতে, পা’য়ে কত ব্যাথা পেয়েছে। অথচ ওই ব্যাথা নিয়ে একটা কথাও বলল না। কিন্তু যখন ওই মুহূর্তের কথা বলতে শুরু করল। ও কাঁপছিল। ও…ও আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন কান্না করছিল আমার কাছে এতটা অসহায় লেগেছে। আমি ওই সময় ওর সাথে থাকলে এমন হতেই দিতাম না। ওই চারজনকে সেখানেই আধম’রা করে দিতাম। কিন্তু আমি ওর সাথে ছিলাম না। ওর একা… একা এতকিছু সহ্য করতে হয়েছে। যদি লোকগুলো না আসতো তাহলে কী হয়ে যেত জাহান!”
কথাগুলো বলতে বলতে মহুয়ার চোখে পানি চলে এলো। টুপ টুপ করে পড়তে লাগলো তার নরম গাল দিয়ে। সে কথা বলতে বলতে রাস্তাতেই মুখে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।

জাহান প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মহুয়া সহজে কাঁদে না, সে এতটুকু তো চিনেছে। তাকে হারানোর কথা শুনেও নিজেকে দুর্বল দেখায় নি। অথচ আজ এমন অসহায়ত্ব দেখাচ্ছে সে?

জাহান হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসলো। মহুয়ার মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে তার মুখের দিকে চাইলো। তার বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো। সে যেদিন প্রেমে পড়েছিল সেদিন এই চোখে পানি দেখেছিল সে, আর ভেবেছিল এই চোখে আর কখনো জল আসতে দিবে না। অথচ বরাবরই ব্যর্থ সে। এক ব্যর্থ প্রেমিক।

সে মহুয়ার দুই গালে হাত রেখে তার চোখে তাকায়, “আমি আছি তো। ওই চারজনকে পাতাল থেকে হলেও তোমার আর মৃণার সামনে দাঁড় করাবো। ওর মন তো নরম। ওর হয়ে তুমি শাস্তি দিও। তুমি শুধু আমাকে ডিটেইলস এনে দিও।”
মহুয়া কান্নার মাঝেই ঠোঁট উল্টে বলল, “তো তোমাকে কী এমনিতেই ডেকেছি না’কি? একাজের জন্যই তো ডেকেছি।”
কান্নার এমন চরম মুহূর্তেও যে কেবল মহুয়াই এই কথা বলতে পাড়ে। জাহান হেসে দেয় ফিক করে।
মহুয়া চাটি মারে তার হাতে, “এখানে আমি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলাচ্ছি আর তুমি হাসছো? ”
জাহান আবারও হেসে তার কান্নাভেজা গালে আলতো চুমু খেল। সাথে সাথে কেঁপে উঠে মহুয়ার অন্তর। হঠাৎ সে কান্না ভুলে তাকিয়ে থাকে জাহানের দিকে। এই মুহূর্তে জাহান এমন কিছু করবে সে কল্পনাও করে নি।

জাহান তার বাহু ধরে উঠে দাঁড় করায়। দুই গালে হাত রেখে যত্ন সহকারে তার চোখের পানি মুছে বলে, “তুমি যেয়ে মৃণার সাথে থাকো। ও নিশ্চয়ই অনেক ভয়ে আছে। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করবে না। কথার কৌশলে বের করবে কোথায় এসব ঘটনা ঘটেছে। আর ওখানে কে কে ছিলো? কোনো ক্লু বের করো।”
“আচ্ছা।”
“তুমি তো আবার কৌশলে কথা বের করাতে এক্সপার্ট।”
মহুয়া কপাল কুঁচকায়, “খোঁটা মারছো?”
“এখন যাও। আর চিন্তা করো না ওই কুত্তাদের শাস্তি আমি দিবোই। মৃণাকে বোন বলে ডেকেছি। ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতেই হবে।”
“তোমার কত্তো বড় সাহস তুমি ওদের কুত্তা ডেকেছ? কুকুররা কত ভালো হয় জানো? ওরা জানোয়ার থেকেও অধম।”
জাহান ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে, “তোমার সাথে কথা বলাও মুশকিল। এখন যাও, আমরা আগামীকাল দেখা করবো। কিন্তু আমাদের দেখা করা কথা শায়ানকে জানাবে না।”
“কারণ কী?”
“এইত্তো গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ। আপাতত মৃণার ব্যাপারটা চিন্তা করো। গোয়েন্দা দপ্তরে ব্রেক দেও।”
.
.
মুরাদ ডাক্তারকে দেখিয়ে তাকে বাহির পর্যন্ত দিয়ে আসতে গেল। মৃণাকে ব্যান্ডেজ করানো হয়েছে। এর মধ্যে নিজের নাইটস্যুট নিতে এলো সিনথিয়া। মৃণাকে দেখে মুখ বানালো প্রথমে। তারপর নিজের ব্যাগ খুলে কাপড় বের করল লাগলো। তার চোখে মুখে চরম বিরক্তি।

সিনথিয়ার মা’ও এলো মেয়ের পিছনে। প্রথমে রুমটা যাচাই করল। কাওকে না দেখে মৃণাকে বলল, “তুমি ব্যাথা পাইছো? ডাক্তার আসলো কেন?”
“হ্যাঁ আন্টি। এখন ঠিক আছে।” স্বভাবতই নমনীয় ভাষায় উওর দিলো মৃণার।
“ঠিক তো থাকবেই এত দামী ডাক্তার নিয়ে আসছে মুরাদ। তো শুনলাম তুমি না’কি একা থাকো। মেয়ে মানুষ হয়ে একা থাকো কেমনে?”
মৃণা পড়লো এবার দ্বিধায়। সে মাথা নামিয়ে মিনমিনে সুরে, “পরিবারের সাথে ঝামেলা চলছে।”
“মা মরা মেয়ের এত হেডম থাকতে নাই। খাওন দিবে খাওন খাইয়া পড়ে থাকবা। তাও তো নিজের বাপের বাড়ি। অন্যের বাড়িতে এসে থাকতেও তো মানুষের লজ্জা লাগে।”
“আ…আমি আসতে চাই নি। মুরাদ ভাই…মুরাদ ভাইয়া…”
“হইছে এত ঢঙ করা লাগবো না৷ তোমগো মতো মেয়েরে ভালো মতো চিনি। ভালো মানুষ পাইয়া ঘাড়ে চইড়া বসো।
টাকা ওয়ালা ছেলে দেখলে তো মাথা ঠিক থাকে না। মহু তোমার বান্ধবী। ও জানে নাই কিন্তু মুরাদ জানছে তুমি ব্যাথা পাইছো। লেদি পাইছো আমাকে? দুনিয়াদারি সব দেখি আর বুঝি।”

সিনথিয়া তার মা’কে এসে থামাল, “আম্মা চুপ করো তো। দেখো ওরে, মুরাদ ভাইয়া চোখ তুলেও তাকাবে না এমন মেয়েকে।”
“তুই তো ভোলাভালা সিনথু। এজন্য বুঝোস না। এমন মাইয়ারা যে কত চতুর হয়। বশ কইরা নেয় একদম পোলাগোরে।” তারপর মৃণার দিক তাকিয়ে হুমকির সুরে বললেন, “দেখো মাইয়া মুরাদ থেকে দূরে থাকবা। ওর সাথে আমার মেয়ের বিয়ের কথা চলে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি থেকে রফাদফা হবা। তোমগো মতো মেয়ের চরিত্রের ঠিক নাই। এখানে সবাইকে ভালা পাইয়া ঘাড়ে উঠে বসছো। লজ্জা শরম থাকলে তাড়াতাড়ি চলে যাবে।”
মৃণা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো সহ্য করলো। তার চোখ নামানো। সে চোখ দিয়ে জল পড়ছে টুপ টুপ করে। লজ্জায় সে চোখ উঠাতে পাড়ে না। এমন অপমানের পর আর এখানে সে থাকবে না। কিছুতেই না।

মুরাদ রুমে ঢোকার সময় দেখে তার ফুপি ও সিনথিয়াকে দেখে প্রশ্ন করে, “আপনারা এই রুমে কী করছিলেন?”
তারা এক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে যায়। মুখে ভয় স্পষ্ট। কিন্তু সিনথিয়া শেষ মুহূর্তে সামলে নেয়। তার হাতের কাপড় দেখিয়ে বলে, “জামা আনতে গিয়েছিলাম ভাইয়া।”
“ওহ.. আছা।”
মুরাদ রুমে ঢুকতে গেলে বাঁধা দেয় ফুপি, “বাবা ওই রুমে তো কেউ নেই। একা মেয়ে বসা। লোক যদি শুনে তোমার নামে খারাপ কথা রটবে বাবা।”
মুরাদ সরু চোখে তাকায় তাদের দিকে। তারপর গম্ভীরমুখে বলে, “যারা এমন মানুষ ভর্তি ঘরে একটা রুমে গেলেও এমন কথা রটায় তাদের মস্তিষ্কে মগজের জায়গায় গোবর ভরা।”

মুরাদ কাওকে পাত্তা না দিয়ে রুমে ঢুকে। মৃণাকে বলে, “আমি খাবার আনতে বলেছি তোর জন্য। এরপর ব্যাথার ঔষধ খেয়ে…”
সে কথা বলতে বলতে মৃণার সামনে আসে। দেখে সে মাথা নিচু করে চোখ মুছে নিচ্ছে। সে কাঁদছিল? মুরাদ সাথে সাথেই তার পাশে বসে। তার হাত ধরে বলে, “তোর কী বেশি ব্যাথা করছে? ডাক্তারকে আবার ডাকবো?”

মৃণা তার হাত সরিয়ে নেয়, “মুরাদ ভাই আমাকে কী আগামীকাল বাসায় দিয়ে আসবেন?”
মুরাদ কপাল।কুঁচকায়, “বাসায়? এটাই তোর বাসা। ওখানে আমি আর তোকে যেতেই দিবো না। সারাদিন তোর চিন্তায় ম’রবো।”
“এটা আমার বাসা না মুরাদ ভাই। এটা আপনাদের বাসা। এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। উলটো খারাপ দেখায়।”
“কেউ তোকে কিছু বলেছে?”
“না। কেউ কিছু বলে নি। কিন্তু ভবিষ্যতে মানুষ বলবে। আমি এবাসায় থাকলে ক’দিন পর আপনাদের নিয়ে কথা বলবে পাড়া-মহল্লার লোকেরা। আমায় নিয়ে কথা বলবে। এক সময় আমার উপর প্রশ্ন তুলবে। ঘরে বাহিরের এক অবিবাহিত মেয়ে থাকাটা সত্যিই দৃষ্টিকটু দেখায়।”
মুরাদ বিরক্ত হয়ে বলে, “তুই হঠাৎ এসব…” তখনই তার মনে পড়ে বাহিরে সে তার ফুপি ও সিনথিয়াকে দেখেছিল। ভাবনাটা তার মস্তিষ্কে আসতেই রাগে মাথায় র’ক্ত উঠে যায়। সে মৃণাকে কিছু না নলেই রুম থেকে বেরিয়ে তার ফুপিকে ডাকতে থাকে। মৃণা ঝামেলার আঁচ করতে পেড়ে নিজেও উঠে যায়।

মুরাদের চেঁচামেচি শুনে ঘরে সবাই আসে ডাইনিং রুমে। মুরাদের বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে চেঁচামেচি করছিস কেন? নিজের বড়দের কেউ এভাবে ডাকে?”
“উনাকে জিজ্ঞেস করো উনি কি করেছে?”
“কী করেছি আমি?” ফুপি অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে।
“জানেন না আপনি?”

মৃণা বহু কষ্টে আসে সেখানে। সে পরিস্থিতি বিগড়ে যাবার আগেই মুরাদকে বলে, “মুরাদভাই প্লিজ চলেন এখান থেকে? কী করছেন আপনি?”
“তুই একা এখানে এসেছিস কোন দুঃখ? পা’য়ে ব্যাথা পেয়েছিস না তুই?”
মুরাদ তার হাত ধরে বসাতে নিলে ফুপি ক্ষেপে যায়, “এই… এই মেয়ে তোকে তোকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে তাই না?”
“ও কিছু বলে নি। উলটো বাসা ছেড়ে যেতে চেয়েছে। আপনারা তখন বের হবার সময় আমাকে দেখে যে ভয় পেয়েছেন আমি তা দেখেই আন্দাজ করে নিয়েছি। আমি এত বুদ্ধিহীন হলে আজ এ পর্যায়ে আসতে পাড়তাম না। আপনিই কিছু একটা বলেছেন ওকে।”
“বলেছি। বেশ করেছি। যা সত্যি তাই বলেছি। তোরা বুঝতে পাড়ছিস না। এমন মেয়েদের কাজই বড়লোক ছেলে ফাঁসিয়ে বিয়ে করা। এসব ভেবেই মহুর সাথে বন্ধুত্ব করেছে বুঝেছিস? এখন তোকে ফাঁসিয়ে তোর ঘাড়ে ঝুলতে চায়। বাবা তোরা অনেক সহজ সরল তাই এসব বুঝিস না।”

মহুয়া তখন বাসায় ঢুকছিল শেষ কথাটা শুনে সে দরজা থেকেই বলল, “এক মিনিট, আপনি কী চিনেন ওকে যে এসব বলছেন? ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব ক্লাস থ্রী থেকে। যখন আমাদের কিছু ছিলো না তখন থেকে মৃণা আর মোহ আমার সাথে আছে। আর আপনারা কী করেছিলেন? আপনাদের বাসায় যেয়ে বাবা একটু সাহায্য চেয়েছিল অথচ আপনারা কতশত অপমান করেছেন।”
মহুয়ার মা বলে, “মহু চুপ কর।”
“চুপই তো করে আছি এত বছর। তোমাদের জন্য। তোমাদের তো চোখে পড়ে না। তোমাদের সামনে এতকিছু বলে, করে তোমাদের চোখে তো কিছুই পড়ে না। সারাজীবন এমন চোখ বন্ধ করে থাকো। অপমান ভুলে গেছো সব? যখন আমাদের টাকা ছিলো না তখন কত কথা শুনিয়েছে ভুলে গেছো? আত্নীয়তা শুধু তোমরাই করো। ক’দিন আগে শ্রাবণী আপুর বিয়েতেও আমাকে বলেছে আমি না’কি তার থেকে জ্বলছি তাই বিয়ে ভাঙতে চাইছি তখনও চুপ ছিলে। আবার তাদের আত্নীয়তা রক্ষার্থে আমার বিয়ে দিতে চাইলে। আজ মৃণাকে বলছে তাও তোমরা চুপ। ও’কে না তুমি মেয়ে বলেছিলে মা? তারপরও কীভাবে চুপ থাকো? এরা কে আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করার? সারাজীবন চোখ মুখ বন্ধ করে শুনেই যাও। আজ মৃণাকে বলেছে আগামীকাল তোমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলবে তখনও চুপ থেকো। কিন্তু আমি চুপ থাকবো না। আমার ভাই আমাকে চুপ থাকা শেখায় নি।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে বড় বড় শ্বাস ফেললো মহুয়া। মৃণা তাকে থামাতে উঠতে চাইলে মুরাদ তাকেই থামিয়ে দেয়। উল্টো বসিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে চুপ থাকতে।

সিনথিয়া রাগান্বিত স্বরে বলে, “তুই ছোটো, ছোট হয়ে থাকে। এতটুকু মুখে এত কথা ফুটে কীভাবে?”
“কারণ এটা আমার বাসা। এই বাসায় কে থাকবে না থাকবে এটা বলার অধিকার আমার আছে। তোমাদের না।”
তখন ফুপিও বলে, “এটা আমারও ভাইয়ের বাসা। এখানে আমারও সমান অধিকার …”
“সরি ফুপি। এই বাড়ি আমার ভাই দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছে। এখানে তোমার কোনো অধিকার নেই। আর অধিকার সম্পর্ক দিয়ে না, খারাপ সময়ে মানুষের পাশে থেকে আসে। যা তোমরা করো নি। তোমাদের কারো এই বাড়িতে আর আমাদের জীবনে কোনো অধিকার নেই।”
“তুই…তোর এত সাহস! তোর থেকে বেশিই আছে। তুই তো বিয়ে করে অন্যের বাড়িতে চলে যাবি। আমার মেয়ে এখানে থাকবে। ”
“কী?” মহুয়ার সাথে মুরাদও অবাক হয়।
“সিনথিয়ার সাথে মুরাদের বিয়ে ঠিক করেছি আমরা।”

“আমার বিয়ে অথচ আমি জানি না?” মুরাদ তাচ্ছিল্য সুরে বলে, “আমি একবারও বলেছি আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো?”
“তোমার মা বাপে তো কথা দিয়েছে।”
মুরাদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় তার বাবা মা’য়ের দিকে। সাথে সাথে তার মা জানায়, “আপা আমরা বলেছি মুরাদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে আপনাকে জানাবো। কথা দেই নি।”

“আর কথা দিলেও লাভ হতো না। আমি সিনথিয়ার মতো গা’য়ে পড়া মেয়েকে কখনো বিয়েই করতাম না। আর আমার বোনকে এত বড় কথা বলার পর আপনারা আমাদের বাসায় আসেন কোন মুখে। একথা আমি আগে জানলে আপনাদের সাথে কোনো সম্পর্কই রাখতাম না।” আরও মুরাদ জানিয়ে দেয়, “এছাড়া আপনাদের ভুল ধারণা দূর করতে জানিয়ে দেই। মৃণা আমার পিছনে পড়ে রয় নি। আমি ওকে চারবছর ধরে ভালোবাসি আর ও আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।”
“কী?” সিনথিয়া চমকে যায়, “আপনি এই মেয়েকে পছন্দ করেন? আপনার রুচি এত খারাপ মুরাদ ভাই? এর থেকে তো আমি হাজার গুণে সুন্দর।”
কথা শেষ না হতেই মহুয়া তার গালে এক কষিয়ে চড় মারে। সাথে সাথে রাগে গর্জে উঠে সিনথিয়া, “তোর এত বড় সাহস। তুই আমাকে থাপ্পড় মেরেছিস? তোর থেকে এক বছরের বড় আমি।”
ফুপিও বড় গলায় বলে, “বড় বোনকে থাপ্পড় মারিস। এত বেয়াদব হয়েছিস?”
একথা শুনতেই মহুয়া আরেক গালে থাপ্পড় মারে সিনথিয়ার। সিনথিয়া উল্টো থাপ্পড় মারতে গেলে মহুয়া তার হাত ধরে মুচড়ে দেয়। তারপর ঠেলে সরিয়ে দেয়।
ফুপি আবারও বলে, “এই ছোটলোকি মেয়ের জন্য তুই তোর বোনের উপর হাত তুলেছিস?”
এই কথা শুনে আরও জোরে থাপ্পড় মা’রে সিনথিয়াকে মহুয়া।
সিনথিয়া হতভম্ব। সে গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “আমি আবার কী করলাম?”
“ছিঃ ফুপি আপনার মেয়েকে দেখেন। আপনার জন্য একটা থাপ্পড়ও খেতে পাড়ে না।”

ফুপি রাগে গড়গড় করে বলে, “সিনথিয়া ব্যাগ গোছা। এই বাড়িতে এক মুহূর্তও থাকবো না।”
“আলহামদুলিল্লাহ।” মহুয়া শান্তির নিশ্বাস ফেললো।
ফুপি তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। তার ভাইকে ধরে বলে, “তোর মেয়েকে দেখেছিস? এত বড় বেয়াদব বড় করেছিস তুই? আমি চলে যাচ্ছি আর সে কি খুশি হচ্ছে।”
মহুয়ার বাবা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন, “আপনার যাওয়া উচিত আপা। দেরি হলে বাস পাবেন না, নাহলে ড্রাইভারকে কল দিব? গাড়ি করে যাবেন?”
“কী? কী বললি তুই? তুই আমাকে তোর বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলছিস?”
মহুয়ার মা তখন বলে, “আপনি ঘরে এত অশান্তি ধরালেন। এক মা মরা মেয়ে এত বিধস্ত অবস্থায় এলো তার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে লজ্জা করলো না আপা? আপনাকে তো বলেছিলাম ওর পরিবারে ঝামেলা আছে। তাই তাদের সাথে থাকে না। এরপরও… আমার দুই মেয়ের নামে খারাপ বললেন আর আমরা আপনাকে ঘরে রেখে আদর যত্ন করবো?”
“দুই মেয়ে? শুনো নি মুরাদ কী বলেছে? আমি যা বললাম তা ঠিক হলো কী? মেয়ে তো দেখি আগেই তোর ছেলেকে হাত করে নিয়েছে।”
ফুপির কথা শুনে শান্ত গলাতেই উওর দিলো মহুয়ার মা, “আমাদের এতে কোনো সমস্যা নেই। মৃণাকে আমার আগে থেকেই পছন্দ। ও আমার কাছে আমার মেয়ের মতোই। মহুয়া আমাকে যত সময় না দিয়েছে এর থেকে বেশি মৃণা দিয়েছে। ও এই ঘরে বউ হয়ে আসলে আমার থেকে বেশি আর কেউ খুশি হবে না।”

মৃণা হতবাক হয়ে যায় এই কথা শুনে। তার সবসময় একটাই ভয় ছিলো। মুরাদ তাকে পছন্দ করে এ কথা শুনে মহুয়ার পরিবার তাকে ভুল না বুঝে। নিজের পরিবার কখনো ছিলোই না। মহুয়ার পরিবার তার নিজের পরিবার থেকেও আপন করে রেখেছে। এই মানুষগুলোকে কখনো হারাতে চায় নি সে। কিন্তু তারা এত সহজে রাজি হয়ে গেল? তারা কী বুঝতে পাড়ছেনা সে মুরাদের কত অযোগ্য?

ফুপি ক্ষেপে যায় আরও বেশি, “বেশ তো। রাখ এক আবিয়াত্তা মেয়েকে ঘরে। যখন দুনিয়া তোদের আর এই মাইয়ার উপর থু থু করবো তখন বুঝবি। দেখি তারপর তোর মেয়েকে কোন ঘরে দেয়। আমাকে নাহলে চুপ করালি সব মানুষের মুখ কেমনে বন্ধ করবি? এই মেয়ে তো কত চালাকির সাথে তোদের হাত করেছে ওটা সবাই বুঝবে। তখন ওর চরিত্র নিয়ে কথা বললে কীভাবে আটকাবি?”
“চুপ।” মুরাদ হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “একদম চুপ। আমি আমার ময়নার চারিত্রিক সার্টিফিকেট আপনাদের থেকে নিব না। ও এই বাড়িতেই থাকবে। এই বাড়িতে আমার যত অধিকার আছে, মহুয়ার যত অধিকার আছে। ওরও অধিকার আছে।”
“আচ্ছা আর কীভাবে এলো এই অধিকার? কে ও?”
“আমার হবু বউ। আমার অর্ধাঙ্গিনী। আর যদি তাও আমাদের সম্পর্কের সার্টিফিকেট লাগে তাহলে মা কাজি ডাক দেও, আজই আমাদের বিয়ে হবে।”

চলবে…