মেঘের খামে পর্ব-৫৫+৫৬

0
4

মেঘের খামে…
পর্ব ৫৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

টাকা পয়সা পরিশোধ করে অনেক ঝোপঝাড় পাড় করে মুরাদ প্রবেশ করল তার বাসরঘরে। সারা কক্ষ ফুলের ঘ্রাণে ম ম করছে। মৃদু আলো জ্বালানো। তার সামনে বিছানাতে বসে আছে মৃণা। লেহেঙ্গা পরা। লম্বা এক ঘোমটা দেওয়া। তাকে দেখেছে মুরাদ বহুবার। প্রতিবারই তার হৃদস্পন্দন থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য। বুকের ভেতর আনন্দের ঝড় উঠে। তার স্বপ্নপরী, তার ময়না তার সামনে বসা। তার বউ হয়ে। ভাবতেই তার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। খুশিতে তার হৃদপিণ্ডে যেন বাজি ফুঁটছে। ব্যবসায়ে সবচেয়ে বড় ডিল করতে যেয়েও সে এত নার্ভাস হয় নি। অথচ যাকে এতবছর ধরে চিনে তার কাছে যেতেই তার বুকের ভেতর এমন তুফান বইছে?
বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়িয়েছে এজন্য? এই সম্পর্ক কী এতটাই শক্তিশালী?

সে দেখল মৃণা নিজ থেকেই উঠে এসে ঝুঁকে সালাম করতে নেয়। এর পূর্বেই ধরে নেয় তাকে মুরাদ, “কী করছিস?”
“শুনেছিলাম বিয়ের পর না’কি স্বামীকে সালাম করে?”
মুরাদ হাসে, “ব্যাপারটা শিউর জানি না। কিন্তু তোর করতে হবে না।”
মুরাদ তার পকেট থেকে একটা বক্স বের করে। ছোট লাল রঙের বক্স। সেটা খুলে একটি আংটি বের করে দেখায় মৃণাকে। আংটির মধ্যে ছোট একটা ফুল ডিজাইন করা।
“ভালো লেগেছে?” মুরাদ প্রশ্ন করে। উওরে মাথা নাড়ায় মৃণা। আবার প্রশ্ন করে, “আপনি তো বিয়ের সময় একটা পরালেন।” সে নিজের আঙুলের ডায়মন্ডের আংটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে।
মুরাদ জানায় তাকে, “এটা আমার প্রথম কামাই দিয়ে কিনেছিলাম তোর জন্য। ভেবেছিলাম কখনো তোকে নিজের করতে পারলে দিব। তুই সারাজীবন আমার থাকবি কি-না জানি না। বাধ্য কখনোই না। কিন্তু এটা তোর আমানত।”
মুরাদ তার হাতে রিংটি গুঁজে দেয়, পরায় না আর। মৃণা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এতবছর আগে থেকে মুরাদ তার জন্য এই আংটিটা কিনে রেখেছে? তাকে বিয়ে করে পরাবে বলে?
তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো তাহলে এইটা নিজ হাতে পরিয়ে দিলো না কেন? আবার করল না।

মুখ তুলে দেখল মুরাদ তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার দৃষ্টিতে কেমন মোহিত! দেখেই মৃণার ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো। সে চোখ নামিয়ে নিলো। সাথেই স্পর্শ পেল সে তার গালে মুরাদের হাতের। মুহূর্তের মধ্যে স্পর্শ পেল তার কপালে মুরাদের ঠোঁটের। সাথে সাথে চোখ চেপে বন্ধ করে নিলো। তার বুকের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। তার ওড়না মুঠোবন্দি করে দাঁড়িয়ে রইল নিস্তব্ধ হয়ে।
হঠাৎ তার কানের কাছে মৃদুস্বরে শব্দ এলো, “তুই কী জানিস ময়না? তোর চোখে আজীবনের জন্য আমার হারাতে ইচ্ছে হয়?”
মৃণার নিশ্বাস আটকে আসে। সে বহু কষ্টে বলে, “মুরাদ ভাই এমন করেন না প্লিজ।”

মুরাদ সাথে সাথে সরে দাঁড়ায়। চোখমুখ কুঁচকে তাকায় তার দিকে, “মুরাদভাই? সিরিয়াসলি ময়না? ভাই? বাসররাতে জামাইকে কে ভাই ডাকে?”
মৃণা চোখ খুলে সাথে সাথে। একটু লজ্জা পেল বটে। তার কৃষ্ণ রঙিমা গাল দুটোয় লাল আভা ছড়াল।
মুরাদ তা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো সাথে সাথে। সে খানিকটা কেশে বলল, “এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে প্রি কী বলিস? তো বিছানাতেই দু’জনে ঘুমাব না টিভি সিরিয়ালের মতো সোফাতে ঘুমাতে হবে। যদিও রুমে সোফা নেই তুই চাইলে আনবো।”
“লাগবে না।”
মুরাদ আড়চোখে তাকায় তার দিকে, “শিউর তুই? আমি নিজের গ্যারান্টি নিতে পাড়ছি না। তোকে বুকে নেওয়ার জন্য এখনই আমার মন ছটফট করছে।”
মুরাদের কথা শুনে লজ্জায় মিইয়ে গেল মৃণা। সে বলল, “আমিও জামা পরিবর্তন করে নেই।”

সে যেতে নিলে মুরাদ তার হাত ধরে নেয়। বলে, “এত অপ্রস্তুত হবার কিছু নেই। শুধু একটু বুকেই ভরতে চাই। তোর পারমিশন ছাড়া নিজের লিমেট ক্রস করবো না। আর যদি কখনো না মানিস তাহলে… তোর যেখানে খুশি যেতে পারিস। কিন্তু আপাতত আমাকে এতটুকু অধিকার কি দিতে পাড়বি?”
মৃণা তাকায় তার দিকে, “আমার উপর আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। ”
মুরাদ হাসে। মাথা নাড়ায়।
“নেই। কারণ তুই আমাকে ভালোবাসিস না। যেদিন তুই এই সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে মেনে নিবি সেদিন তোর উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে। আমি চেঞ্জ করে বারান্দায় যাচ্ছি। তারপর তুই ফ্রেশ হয়ে নিস। একসাথে এশার নামাজ আদায় করে ঘুমাব।”
মৃণা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

এশার নামাজ আদায় করে মৃণা বসলো বিছানায়। কেমন অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি। বুকের ভেতরটা ধরপর করছে। কেমন অপ্রস্তুত হয়ে আছে সে। এই প্রস্তুতির কারণ বুঝতে পারল না।

চোখজোড়া নামানো। মেঝের দিকে আটকে আছে। অথচ তার চোখ তুলে তাকাতে মন চাইল, কোথায় মুরাদ? বাতি বন্ধ হলো। সাথে তার বুকের ধড়ফড় করা বাড়ল। সে অনুভব করলো মুরাদ এসে বসেছে বিছানার অপরপাশে। সে কী বলবে? কী করবে?

“ঘুমিয়ে পড়। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত এদিনের অনুষ্ঠানে।” মুরাদের কথায় সে সাথে সাথে শুয়ে পরলো। তবুও বুকের ভেতর অস্বস্তি বাড়লো। বিছানার একদম কোণা করে শুয়েছে। একবার ফিরে দেখল অপরপ্রান্তে শুয়ে থাকা মুরাদের দিকে। দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলল। চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। কোনো মতেই। সময় কাটল। কিন্তু তার চোখের ঘুমের ছিঁটেফোঁটাও নেই।

আচমকা তার পেটে হাত ছুঁলো কেউ। নিশ্চয়ই মুরাদ। তার হাত রেখে নিজের দিকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃণার।
মুরাদ অন্য হাতটার হাত নিচ দিয়ে এনে শক্ত করে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। তার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে রাখে। মুরাদের উষ্ণ নিশ্বাস তার কাঁধে এসে লাগছে।
সে মৃদুস্বরে বলল, “ঘুমিয়ে পড়।”
সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো মৃণা। মুরাদের ঠোঁটজোড়া হাল্কা করে তার কাঁধ ছুঁয়ে দিয়েছে। তার আলিঙ্গনে মনে হলো সে ভস্ম হয়ে যাবে এই মুহূর্তেই। অথচ আজব ব্যাথা, তার শান্তি লাগছে। যে শান্তি তার কোনো কালেই লাগে নি। এমন সুখ আর যন্ত্রণার অনুভূতি একত্রে কী স্বাভাবিক?

চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল মৃণা। সে গভীর ঘুমে আছন্ন। এমন শান্তির ঘুম তার শেষ কবে হয়েছে তার মনেও নেই।
.
.
মহুয়ার বাহিরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা ছিলো। কিন্তু সে কী বাঁধা মানার মানুষ? সে উল্টো সকাল সকাল তার ঘুমের বিসর্জন দিয়ে বের হলো জাহানের বাসার উদ্দেশ্য। অবশ্যই অচেনা তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাই জিনিকে কল দিলো সে।

জিনিকে কল দেওয়ার একটু পরই কল ধরল। সে বাহিরে জানতে পেরে ঘুম থেকে উঠেই দৌড় দিলো। দরজা থেকে রিসিভ করল তাকে। ভেতরে ঢুকে সে দেখে জাব্বির চাচাকে। যে তাকে দেখে মোটেও খুশি হলো না। উল্টো চিন্তায় পরে গেল। জিনি মহুয়াকে নিয়ে তার রুমে যেতে চায়। কিন্তু মহুয়া থামায় তাকে, “তোমার ভাই কোথায়?”
“ভাইয়া? ভাইয়া তো বিয়েতেই ছিলো। তোমাদের বাসায় নেই?”
“না।”
“তাহলে তাসিন ভাইয়াকে একটা কল দেও উনার সাথে বোধহয়।”
“কথা হয়েছে। তোমার ভাইয়া কারো সাথেই নেই।”
” ঘরেও তো ভাইয়া নেই।”
তারপরও সে জাব্বির চাচাকে প্রশ্ন করে, “ভাইয়া কী বাসা চাচা?”
না-বোধক উওর এলো। মহুয়া আরও চিন্তায় পড়ে যায়।
জিনি অবাক সুরে জাব্বির চাচাকে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া বাসায় না থাকলে কোথায় গেল?”

“সেটা কী তোমার জানার দরকার আছে?” কন্ঠ শুনে চমকে উঠে মহুয়া। সাথে সাথে পিছনে তাকায়। জাহানের মতো ভারী কন্ঠ শুনে একমুহূর্তের জন্য ভেবেছিল সে। কিন্তু পিছনে ফিরে দেখে কোর্ট টাই পরা এক মধ্যবয়সী লোক। দেখতে অনেকটা জাহানের মতোই। তবে খানিকটা বয়স্ক, রঙ গাঢ় শ্যামলা। তবে চুলগুলো জাহানের মতো কোঁকড়ালো না, সিল্কি সোজা।

মহুয়া জিনির বাহুতে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করে, “এটা তোমার আব্বু?”
“হ্যাঁ, আমার বাবা।”
“তোমার বাবা তো তোমার ভাই থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম। আন্টির চয়েজ তো সেই।”
“ভাবি তোমার শশুড় আব্বা হবে।”
“ওইটাই তো। কতজনের জামাই তো হ্যান্ডসাম হয়। এটা নিয়ে কী শো-অফফ করা যায় না’কি? কিন্তু শশুড়আব্বা কয়জনের হ্যান্ডসাম হয়। আমি তো বিয়েতে আমার শশুড়আব্বার সাথেই নাচ দিবো।”

“আমি এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছি।” জাহানের বাবা তার পকেটে হাত রেখে বলে। সে সোফায় বসে মহুয়ার দিকে সামনের সোফার দিকে ইশারা করে বলে, “তোমার সাথে একটু কথা আছে। বসো।”
“আমার সাথে?” মহুয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তোমার নামই মহুয়া রাইট?”
“আপনি কীভাবে জানেন?” মহুয়া কৌতুহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে। সে যেয়ে বসে জাহানের বাবার সামনে।
জাহানের বাবা প্রশ্ন করে, “তুমি কে, কি করো, তোমার ফ্যামিলি কি করে সবই আমি জানি।”
“জানতেই পারেন।”
সে কপাল কুঁচকায়, “আমি কীভাবে জানি জিজ্ঞেস করবে না?”
“ইভান এয়ারলাইন্সের মালিক একজনের খোঁজ বের করতে পারবে না। এটা ভাবাও তো বোকামি। আপনি আপনার ছেলেকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে দিচ্ছেন। অফকোর্স আপনি তার ভালোবাসার মানুষের খোঁজ বের করবেন। এটা আশ্চর্যের কিছু না।”

জাহানের বাবা হাসে বাঁকা করে, “চালাক আছো। আমার ছেলে এমনি এমনি তোমার জন্য পাগল হয় নি। তুমি কী ওর সম্পত্তি দেখে বিয়ে করতে চাইছ? দাম বলো, তোমার যত লাগে আমি দিব। কিন্তু এরপর ওর আশেপাশেও আসবে না।”
“আংকেল আপনি সিনেমা বোধহয় অনেক দেখেন। গরীব মেয়ে বড়লোক ছেলের প্রেমে পড়বে, তার বাবা তাকে টাকা অফার করবে আর ঝামেলা বাঁধাবে। আপনি খোঁজ নিয়ে নিশ্চয়ই দেখেছে আমাদের ফ্যামিলির অবস্থা এতোটাও খারাপ না। আর খারাপ হলেও আমার ভালোবাসা কোনো কেনার জিনিস না। আপনার ছেলে আমার আগেপিছে ছয়মাস ঘুরে আমায় প্রেমে পাগল করেছে, এ শাস্তিস্বরূপ আমি তাকে সারাজীবনের জন্য প্রেম দন্ডে দণ্ডিত করেছি। সারাজীবন শাস্তি কাটানোর আগে আমাকে ছাড়তে পারবে না।”
“ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।” এবার খানিকটা ক্ষেপেই গেলেন জাহানের বাবা।
“যা ও নিজেই জানে না তাইতো? আপনি তো ওকে কেবল এনগেজমেন্টের কথা বলেছিলেন তাই না?”
“দেখো, এটা আমার ওয়াইফের শেষ ইচ্ছা ছিলো। আমি আমার ওয়াইফকে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। তাই জাহান আর রশ্মির বিয়ে হবেই।”
“নিজের ছেলের ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে তাকে ছলনা করে বিয়ে করাবেন। এটা আপনার ওয়াইফের শেষ ইচ্ছা ছিলো?”

জিনি অবাক হয় তার কথা শিনে, “বিয়ে মানে? বাবা তুমি তো বলেছিলে জাহান ভাইয়ার এনগেজমেন্ট। তুমি ভাইয়ার সাথে মিথ্যা কথা বলেছ? ভাইয়া কোথায়?”
“ও সঠিক জায়গায় আছে। তোর এতো জানার প্রয়োজন নেই।” তিনি আবার তাকায় মহুয়ার দিকে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, “দেখো, আমি তোমার কোনো ক্ষতি চাই না। আমি কেবল চাই তুমি আমার ছেলের সাথে আর দেখা না করো। ওর কাবিন হতে যাচ্ছে। তোমার কী ওর সাথে দেখা করা মানায়?”
“তো আপনার এভাবে নিজের ছেলেকে মিথ্যা বলে বিয়ে করানোটা মানায়? নিজের ছেলের ভালোবাসা চোখে পড়ে না আপনার? আপনার জেদ কী আপনার ছেলের সুখের থেকেও বেশি বড়?”

এমন সরাসরি প্রশ্নে ভড়কে যায় জাহানের বাবা। তার সামনে বসা মেয়েটার মুখে প্রকাশ্য বিবাদ দেখে এক মুহূর্তের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলে। যেখানে তার রেগে যাবার কথা, সেখানে সে বাকরুদ্ধ।

হঠাৎ তার মনে পড়ে সাতাশ বছর আগের সে দিনটি। তার সামনে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী ঠিক সুরেই নিজের বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, “তোমার মেয়ের সুখের থেকেও কী তোমার জেদ বড় আব্বা?”
সেই মুহূর্তে সে আরেকবার প্রেমে পড়েছিলো সে স্পষ্টবাদী, প্রতিবাদী মেয়েটির। যে তাদের ভালোবাসার জন্য লড়াই করেছিল। ঠিক তার ছায়াটি আজ দেখতে পারছে তার সামনে থাকা এই পিচ্চি মেয়েটির দিকে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনটা গলে যাচ্ছিলো কিন্তু তার স্ত্রীর দৃশ্য পরক্ষণেই চোখের সামনে ভেসে উঠে। আর তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। জাব্বিরকে বলেন, “ওকে গাড়িতে উঠিয়ে দেও। যেন সহি-সালামত যেয়ে বাসায় উঠে। আর এই বাড়িতে যেন ঢুকতে না পারে।”
মহুয়া তখন উঠে দাঁড়ায়। তাচ্ছিল্য সুরে বলে, “আপনার গাড়ির কোনো দরকার নেই। আমি যেভাবে এসেছি, সেভাবে যেতেও পারবো। আপনার প্রশংসা করেছিলাম। বলেছিলাম আপনি হ্যান্ডসাম, কচুর হ্যান্ডসাম। মোটেও আপনি হ্যান্ডসাম না। আর শুনে রাখেন শশুড়আব্বা, আপনি যতই তিড়িংবিড়িং করেন না কেন, আপনার ছেলের একমাত্র বউ আমিই হবো। লিখে রাখেন।”
মহুয়া ভেংচি কেটে সেখান থেকে প্রস্থান করল।

জিনি তার বাবাকে প্রশ্ন করে, “বাবা তোমার মনে হয় মা এসব চাইবে? যে তোমার ছেলে তার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলুক।”
“তুই ছোট মানুষ। এসব নিয়ে তোর কথা বলা লাগবে না।”
জিনি গভীর নিশ্বাস ফেলে, “বাবা আমি বিদেশে যেতে চাই পড়াশোনার জন্য। যত দ্রুত সম্ভব।”
তার বাবা ভ্রু কুঁচকালেন, “কলেজের মাঝে? আর আগে কখনো তো এই কথা বলো নি। তাহলে এখন কেন?”
“আমার ভয় লাগছে।”
“ভয়? কার থেকে?”
“তোমার থেকে। যদি তুমি জাহান ভাইয়ার মতো আমাকেও জোর করে এমন মানুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেও যাকে আমি ভালোই বাসি না। তোমরা এত যুদ্ধ করে তোমাদের ভালোবাসা পেলে যে এখনো সবার মুখে তোমার আর মা’য়ের প্রেমকাব্যের চর্চা আছে। তোমাদের ছোট থেকে দেখে আমি আর ভাইয়াও কত স্বপ্ন দেখেছিলাম, তোমাদের মতো আমাদেরও কখনো প্রেমের গল্প হবে। আমার নাহয় ভাগ্য ভালোবাসা এখনো এলো না। ভাইয়ার তো এসেছিল। ডুবে ভালোবেসেছিল। অথচ তুমি নিজ হাতে তার স্বপ্ন এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিলে? ভাইয়ার ভেতরে কি অবস্থা হচ্ছে তুমি বুঝো না? তুমিও তো এই পথ দিয়ে হেঁটে এসেছিল। নিজের ছেলেকে একই কষ্ট দেওয়া কী সুখের লাগছে তোমার?”
“জিনি! বয়স অনুযায়ী মুখ খুলতে হয়। আমাদের ভালোবাসা আর জাহানের ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমিই বলেছিলে আমরা যুদ্ধ করেছি। জাহানের ভালোবাসা এতটা গভীর হলে সে-ও যুদ্ধ করতে পাড়তো। এত সহজে মেনে নিতো না। এখন রুমে যাও। তোমার সাথেও আমার পরে কথা হবে। আর আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তুমি নিজের রুমেই থাকবে।”
“মা জীবিত নেই বলে তাই না? মা থাকলে কখনো ভাইয়াকে কষ্ট পেত দিতো না। মা তোমার উপর চরম নিরাশ হতো জানো তো বাবা?”
.
.
মুরাদ ঘুম থেকে উঠে দেরিতে। চোখ খুলতেই এক অপরূপ সুন্দর দৃশ্য তার চোখে আটকায়। আয়নার সামনে মৃণা দাঁড়িয়ে আছে। সদ্য স্নান করে বেরিয়েছে সে। নীল রঙের শাড়ি পরা। তার হাঁটু অব্দি চুল একপাশ করে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে।

সে উঠে দাঁড়ায় যেয়ে পিছনে মৃণার। তাকে ছোঁয় না। কেবল তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে, মুগ্ধ নয়নে।
“অপরাজিতা ফুল দেখেছিস কখনো?”
মুরাদের এমন প্রশ্নে মৃণা তাকায় আয়নার দিকে। হঠাৎ তাকে নিজের এতটা কাছে দেখতে পেয়ে থমকে যায়। তাৎক্ষণিক পিছনে ফিরে পিছিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলে আটকে পরে।

মুরাদ হেসে ঝুঁকে হাত রাখে ড্রেসিং টেবিলে। মৃণার দু’পাশে। মৃণা চোখ নামিয়ে নেয় সাথে সাথে।
“উওর দিলি না? তুই জানিস তোকে সম্পূর্ণ অপরাজিতা ফুলের মতো দেখাচ্ছে। নীলাভ, স্নিগ্ধ, সুন্দর।”
মৃণা চোখ উঠিয়ে তাকায় তার দিকে। তার নিশ্বাস আটকে যায় সেখানেই।
আচমকা মুরাদের হাত চলে যায় মৃণার পিছনে। এক টানে তাকে কাছে টেনে আনে। তার ভেজা চুলগুলো আলতো কানের পিছনে গুঁজে মুগ্ধস্বরে বলে, “জানিস এই সকালটার স্বপ্ন প্রতিরাতে দেখেছি। এত সুন্দর স্বপ্নও পূরণ হবে, তা কল্পনা করিনি।”
মৃণা চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। সে চোখে চোখ মিলতেই হারিয়ে যায় সে মুরাদের পরম আদুরে ছোঁয়ার।

তখনই দরজায় নক পড়ে। মোহের কন্ঠ ভেসে আসে,
“মুরাদ ভাইয়া, মৃণা, আন্টি ডাকছে।”
মৃণার হঁশ ফিরে। সে আমতা-আমতা করে বলে, “মো…মোহ ডাকছে।”
মুরাদ পিছিয়ে যেতেই সে দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলল। মোহের ঠোঁটের কোণে তো দুষ্টুমি হাসি, “তুই তো ভোরেই উঠে যাস। আজ উঠতে এতো দেরি হলো যে? রাতে অনেক ভালো ঘুম হয়েছে না’কি?”

মৃণা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মোহ আবার তাকায় মুরাদের দিকে, “মুরাদ ভাই একটা গড়বড় হয়ে গেছে।”
“কী হয়েছে?” মুরাদ আসলে চিন্তায় পড়লো।
“আপনার সাথে তো এখন আমার নতুন সম্পর্ক তৈরি হলো। শালী দুলাভাই এর। তো দুলাভাই ডাকবো, না ভাইয়াই ডাকবো বলেন।”
“তোর বান্ধবীই তো এখনো ভাই ডাকে। এর থেকে বড় গড়বড় আর কী হতে পারে?”
মোহ চমকে উঠে, “তুই বাসররাতেও ভাই ডেকেছিস? ভাই তুই ঠিক আছিস?”
মৃণা লজ্জায় আধখানা। সে মোহের হাত ধরে বলে, “আন্টি না ডেকেছে। জলদি চল।”
মৃণা মোহকে নিয়ে যেতে নিলে মুরাদ ডাক দেয়, “মোহ শুন…”
“জি ভাইয়া?
” তোর বান্ধবী কোথায়? এসব পরিস্থিতিতে মজা নেওয়ার জন্য তো ও সবার আগে থাকে।”
মোহ ভয় পেয়ে যায়। আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠে দেখে মহুয়া উধাও। কল দিয়ে জানল সে গেছে জাহানের বাড়ি। তাকে খুঁজতে। বলেছে সামলে নিতে ঘরে। তাই সে বলল, “ঘুমুচ্ছে ভাইয়া।”
“এত বেলাতেও ঘুমায়। কুম্ভকর্ণও ওর কাছে হার মানবে বোধহয়।”
মোহ জোরপূর্বক হাসলো। তারপর মৃণাকে নিয়ে দ্রুত গেল নিচে।

নিচে যাবার পর মৃণা দেখে অনেক মেহমান এসেছে। পাড়া প্রতিবেশী। মৃণা তাদের সালাম দিলো। তারপর রান্নাঘরে গেল মহুয়ার মা’য়ের কাছে। মা তো তাকে দেখে আদর করে চুমু খেল দুই গালে। তারপর বাহিরে নিয়ে এলো। সবাই মিলে নাস্তা করে। গল্প গুজব করতে লাগলো।

কিন্তু মৃণা খেয়াল করে সবাই তাকে কেমন করে যেন দেখছে যেন ভীষণ অসন্তুষ্ট। একজন তো মুখে বলেই ফেলল, “যাই বলেন ভাবি বিয়েটা অনেক সুন্দর হলেও আমাদের মুরাদের জন্য কিন্তু আরও মেয়ে বাছাই করে বিয়ে দিতে পাড়তেন।”
আরেকজনও কথা শুনে তাল মেলায়, “ঠিক কথা। মানে ভালো মেয়ে দরকার বুঝলাম কিন্তু বাহ্যিক সৌন্দর্যও তো দেখতে হয়।”

মোহের রাগ উঠে গেল তাদের কথা শুনে। সে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই কন্ঠ পেল পিছন থেকে, “আর আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে আমার বউয়ের সৌন্দর্য নিয়ে গবেষণা করার?”
মৃণা মুরাদকে দেখে। তার ছলছলে দৃষ্টিতে তাকায় মুরাদের দিকে। মুরাদ তার চোখে তাকায় একপলক। তার শান্ত মুখখানা ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। সে আন্টিদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার কাছে আমার বউয়ের সৌন্দর্যের সাথে তুলনা এই পৃথিবীর কোনো নারী কেন, কোনো হুরপরীও করতে পারবে না। আপনাদের কারো এত যোগ্যতা নেই যে আপনারা আমার বউয়ের খুঁত ধরবেন। আমার বউয়ের কেবল একটাই খুঁত আছে। সে নিজের জন্য লড়াই করতে জানে না। আপনাদের মতো মানুষ উল্টাপালটা বলবে আর সে কাঁদবে, মুখের উপর জবাব দিতে জানে না। কাওকে বাজিমাত দেওয়ার সাহস নেই। এটাই ওর একমাত্র খুঁত।”

মুরাদ মৃণার হাত ধরে বলে, “তোর কী এখানে থেকে কথা শুনতে ভালো লাগছে? দাঁড়িয়ে আছিস কোন দুঃখে?”

মুরাদ মৃণাকে হাত ধরে নিয়ে যায়। আর তা দেখে মোহ মৃদু হাসে। তার হঠাৎ মনে পড়ে সমুদ্রের ফুপিদের বাসার দৃশ্যটা। তার বুকটা কেঁপে উঠে। সমুদ্রের শূন্যতা তার ভেতরে হাহাকার করে তুলে। বাহিরে যতটা হাসিখুশি থাকুক সে। ভেতরটা কেমন খালি হয়ে গেছে তার। সারাক্ষণ মনে হয় তার বুকের ভেতরটা কেউ মুচড়িয়ে ধরে রেখেছে। সে বুঝে না, তার কি প্রেম পাওয়ার ভাগ্য নেই?

মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠে তার। তার বাবা কল দিয়েছে। সে কল ধরল। তার বাবা বলল ফোনের ওপাশ থেকে কিছু একটা। যা শুনে মোহকে আতঙ্কিত দেখা গেল। সে ভড়কে গেল সাথে সাথে, “তুমি কী বলছো এসব বাবা? কীভাবে হলো এসব? আসছি…আমি এক্ষুনি আসছি।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৫৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মোহ সোজা যায় বাসায়। তার মা আর বাবা মিতার রুমেই ছিলো। সাথে ছিলো আহিন ভাইয়াও। সে একটু আগেই তার বাবার কল পেল। মিতার হঠাৎ পেটে অনেক ব্যাথা উঠে। তাকে গতরাতে হাস্পাতালে নিয়ে গিয়েছিল। রাতেই জানতে পারে তার গর্ভের বাচ্চাটা আর নেই।

মোহ রুমে ঢুকে দেখে আহিন বসে আছে মিতার সামনে। তার এক হাত ধরে আছে। মিতা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। মোহ ইতস্ততবোধ করলো। তবুও ডাক দিলো, “আপু…”
তার ডাকে মুখ তুলে তাকায় মিতা। তার ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে। চোখ লালবর্ণের। মুখ ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। তাকে দেখে সে নীরব কান্না শব্দে রূপান্তরিত হলো, “দেখলি মোহ, তোর সাথে খারাপ করার শাস্তি আমি পেয়ে গেছি। আমার জন্য তোর জন্য নষ্ট হয়ে গেছে তাই আল্লাহ আমার কাছ থেকে আমার সন্তান নিয়ে গেল। সব আমার অপরাধের শাস্তি।”
“এসব কি বলছো আপু তুমি?”
আহিন উঠে দাঁড়ায়। জায়গা খালি করে দেয় মোহের জন্য। মোহ সে জায়গায় বসে। সাথে সাথে মিতার হাত ধরে নেয় খপ করে, “মাফ করে দে আমায় মোহ। তোকে কষ্ট দিয়েও আমি প্রায়শ্চিত্ত করি নি তাই হয়তো আল্লাহ আমার খুশি নিয়ে গেছে। তুই মাফ করলে যদি আল্লাহ আমার শান্তি ফিরিয়ে দেয়।”
সে মোহকে জড়িয়ে নেয় শক্ত করে। আরও জোরে শব্দ করে কাঁদতে থাকে।

মোহ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এমন সময় কি বলা উচিত, করা উচিত তা সে জানে না। সে আলতো করে হাত রাখে মিতার কাঁধে। মৃদুস্বরে তার কানে বলে, “আমার মুখ দিয়ে সবসময় তোমাদের সবার জন্য দোয়াই বের হয়েছে।”
“কিন্তু আত্নার বদদোয়া লেগে গেছে। আমি তোকে এতটাই কষ্ট দিয়েছি। মাফ করে দিস আমায়।”
মোহ আর কিছু বলে না। কি বলবে সে জানে না। সে-ও শক্ত করে তার বোনকে জড়িয়ে ধরল।

মোহ খাবার রান্না করছিল। ঘরে এইসময় এক শোকাবহ অবস্থা। তার মা, বাবা, মিতা, আহিন সকলেই প্রবলভাবে আহত অনুভব করছে। তাই মোহই সকলের জন্য খাবারের প্রস্তুতি নিলো। রান্না শেষে সকলকে খাবার দিলো। মিতাকে সে নিজে খাইয়ে দিলো। তারপর রান্নাঘরে এলো খাবার খেতে। খিদে লেগেছিল তার। আজকাল ভালো করে খায় না। খেতে ইচ্ছা হয় না তার। আজ অনেকদিন পর তার খিদে লেগেছিল। ভাত প্লেটে বেড়ে মনে পড়ল সমুদ্রের কথা। সমুদ্র এসে কথা বললে মিতা কান্না বন্ধ করতে পারে। তার সাথে অনেক হাসে সবাই। তাই সে আজ কল দিলো৷ কল ধরল না কেউ। কয়েকবার দেওয়ার পরও। তাই সে কল দিলো সমুদ্রের মা’য়ের ফোনে। সেখান থেকে জানলো সমুদ্র ক’দিন বাসায় আসে নি। এতদিন মহুয়ার বাসায় থাকলেও সমুদ্র গতকাল রাতেই বের হয়েছিল। সে এখনো বাসায় যায় নি? তার বিরক্তি লাগলো, রাগ উঠলো। সমুদ্র কোথায় গিয়েছে তাহলে? জবার কাছে যায় নি তো? ভেবেই রাগে, দুঃখে, কষ্টে সে প্লেটে বেড়ে রাখা ভাত আবার পাতিলে ঢেলে রাখল।
.
.
মহুয়া বসে আছে ডা.নাহিদের সামনে। তার লাঞ্চ টাইম আবারও হাইজ্যাক করেছে মহুয়া। ডা. নাহিদ তার খাবারের দিকে তাকিয়ে আফসোসের নিশ্বাস ফেললেন। তারপর তাকালেন মহুয়ার দিকে,
“কি যেন বলতে, বলো।”
“জাহানের বিয়ের খবর আপনি পান নি? আপনার প্রিয় বন্ধু যেহেতু দেওয়ার তো কথা।”
একথায় ডা. নাহিদ আমতা-আমতা করলেন, “রশ্মির সাথে জাহানের বিয়ের কথা শুনে আমিও অবাক হয়েছিলাম।”
“আপনি অবাক হয়েছেন আর আমার মাথায় আকাশ পড়েছে। এখন আংকেল আপনি বলেন, আমি আর জাহান একে অপরকে ভালোবাসি। আপনার বন্ধুর কী আমার প্রেমে ডিপজল হওয়ার দরকার আছে?”
“ডিপজল?”
“মানে ভিলেন আরকি।”
“তাহলে তুমি কি চাও আমি কি ডিপজল মানে আহিদের সাথে যেয়ে ঝগড়া করবো? জান্নাতের কথা এলে ওর সিদ্ধান্ত কেউ ফেরাতে পারবে না। তোমার তো রাগ হওয়া উচিত জাহানের উপর। বাপের বেটা হলে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেত। এভাবে বিয়েতে রাজিই হতো না।”
“সে তো জানেই না যে তার বিয়ে।”
“কী?”
“জ্বি। আপনার বন্ধু এনগেজমেন্ট জানিয়ে পাড় করছে। শুক্রবার স্যারপ্রাইজ দিবে আরকি জাহানকে। এই স্যারপ্রাইজের পরিবর্তে আপনার বন্ধুর মাথায় বোম্ব ফাটাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পাড়বো না, আমার এত হ্যান্ডসাম শশুড়আব্বা। বোম্ব ফাটালে যদি টাকলা হয়ে যায়, শো-অফফ কীভাবে করব?”
তার কথা শুনে ভ্রু কপালে উঠে যায় ডা.নাহিদের। সে বলে, “ভারী চিন্তার বিষয় বটে।”
“আই নো রাইট।” মহুয়া বড় নিশ্বাস ছেড়ে চেয়ারেই পা তুলে বসে। টেবিলে হাত রেখে গম্ভীরমুখে তাকায় নাহিদের দিকে। জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী আমার কোনো সাহায্য করতে পারবেন না?”
“আহিদ একবার সিদ্ধান্ত নিলে কারো কথা শুনে না।”
“আমাকে কী পার্টিতে ঢুকাতে পারবেন?”
“আমাকে মে’রে ফেলবে।”
“আপনার ভাগ্নার প্রেমের জন্য একটু ম’রতে পারবেন না? কেমন চাচা আপনি?”
“তুমি সবেমাত্র ওর সাথে ঝগড়া করে এলে আর তোমাকে ও পার্টিতে ঢুকাবে?”
“আপনি তো দেখি কোনো কাজের না। আচ্ছা তাহলে এসব বাদ দিন। আমাকে ডাইরেক্ট বলুন তো জাহানের মা বাবার প্রেমকাহিনী।”
ডা.নাহিদ ভ্রু উঁচায়, “এখানে তোমার প্রেম কাহিনী লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে আর তুমি আহিদ ও জান্নাতের প্রেম কাহিনী জানতে চাইছো।”
“তাইতো এলাম আপনার কাছে। অন্য কোন কাজে তো আসলেন না। প্রেমকাহিনী তো অন্তত শুনাতে পাড়েন।”
ডা. নাহিদ হার মেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলতে শুরু করে,
“সালটা ১৯৯২। আহিদের বাবা ছিলো না। মারা গেছেন ছোট থাকতেই। ওর মা বহুকষ্টে পেলে বড় করেছিলেন। কিন্তু পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিলো। আমরা বন্ধু ছিলাম ছোট থেকেই। ওর মা ও আমার মা দূর সম্পর্কের আত্নীয় ছিলো। আমাদের বাসায় আশ্রিতা হিসেবে থাকতো আর কাজে সাহায্য করতেন তিনি। অনেক ভালো মানুষ ছিলেন মামী। আহিদ বৃত্তি পেয়ে আমাদের কলেজে ভর্তি হয়। পড়াশোনা ছাড়া তার পৃথিবীতে অন্যকিছুতে ধ্যান ছিলো না। ছোট থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও করতো নিজের মা’য়ের সাহায্য করার জন্য। দেখতে বেশি সুন্দর হলেও মেয়েদের কোনোকালে পাত্তা দিতো না। অনেক মেয়েরা তার পিছনে পাগল ছিলো। এরমধ্যে ছিলো জান্নাত, জাহানের মা’ও। তবে সে সরাসরি অন্য মেয়েদের মতো পিছনে ঘুরে নি। বেশ ভাব নিয়ে থাকতো। থাকারই কথা, কলেজে সবচেয়ে ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলো। তবে বাহিরের মানুষদের সাথে ভাব থাকলেও বন্ধুদের জন্য তার প্রাণ হাজির। আমাদের বন্ধুত্ব হয় তিন্নির মাধ্যমে। আমার তখনের প্রেমিকা, এখনের বউ। আর জান্নাতের সবচেয়ে ভালো বান্ধবী। তিন্নি, জান্নাত ও ফারজানা অর্থাৎ রশ্মির মা তখনকার অনেক ভালো বান্ধবী ছিলো। আমি আর তিন্নি কলেজের পর প্রথম দেখা করতে যেতাম লুকিয়ে। তিন্নি তার সাথে নিয়ে এলো জান্নাতকে আর আমি আহিদকে। সে প্রথম তাদের পরিচয় হয়। সেদিন বুঝি জান্নাত মোটেও ভাবওয়ালা মেয়ে না। একটু রাগী তবে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ তার। আমরা তিনজন প্রচুর গল্প করছিলাম কিন্তু আহিদ তার বইয়ে ডুবে ছিলো। জান্নাত বারবার তাকাচ্ছিল তার দিকে। আমি কেবল দুষ্টুমি করে প্রশ্ন করেছিলাম, সে কি আহিদকে পছন্দ করে না’কি?
তার সরাসরি স্বীকারোক্তি।
এমন সরাসরি উওরে আমরা দুইজনই ভরকে গেলাম।
অন্যকোনো মেয়ে হলে এতটা অবাক হতাম না। কিন্তু যেখানে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী আর ধনী মেয়ে এমন মুখের উপর কোনো উওর দিবে তাও না চিন্তা করে তাই অবাকই হলাম।
তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
জান্নাত উওর দিলো সোজা আহিদের দিকে তাকিয়ে, ‘কারণ ও অন্য মেয়েদের পাত্তা দেয় না।’
একারণ শুনে আরও অবাক হলাম ভীষণ। জিন্দেগীতেও এমন উওর শুনে নি কেউ।
আহিদ সেদিন উঠে চলে গিয়েছিল।
তাদের তখনও কথা হয় নি ভালোভাবে। দিনকাল চলতে থাকে। আমার আর তিন্নির জন্য ওদের দেখা হলেও ওরা কখনো কথা বলতো না। এভাবে আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিলাম। সামনে এইচএসসি। এর মধ্যে আহিদের মা অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রচুর। সে আর কলেজে আসে না কয়দিন। সে তো ধরেই নেয় এইচএসসি দিবে না। মা’য়ের সাথেই থাকবে তার। আমরা অনেক বুঝাই। তার এত মেধা, এত পরিশ্রম যেন নষ্ট না করে। কিন্তু সে কারো কথা শুনে না।
কলেজে না আসায় জান্নাত তার কথা জিজ্ঞেস করে। তারপর জানতে পারে কি হয়েছে। তখন তো তোমাদের মতো ফোন ছিলো না আমাদের। একদিন রাতে ল্যান্ডলাইনে কল দেয়। আহিদের সাথে কথা বলতে চায়। সেদিন তাদের প্রথম কথা হয়। কি কথা হয়েছে আমি আজও জানি না। কিন্তু পরদিনই আহিদ কলেজে যাবার জন্য তৈরি হয়। যাওয়ার আগে তার মা’য়ের হাত ধরে চুমু খেয়ে যায়। আবারও আগের মতো পরিশ্রম করতে শুরু করে। তখনও তারা ভালো করে কথা বলতো না, কিন্তু আমি দেখতাম আহিদ জান্নাতের দিকে ক্লাসের মাঝে তাকিয়ে থাকতো আনমনে। জান্নাতও তার দিকে তাকাতো, আবার লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতো। চোখে চোখে কথা হতো তাদের কি যেন! বুঝতাম না। তারপর এসএসসি শেষ হতেই আহিদের মা মারা গেলেন। তার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আপন বলতে এক মা-ই তো ছিলো। তখন জান্নাত ওকে সামলায়। প্রতিদিন আসে ওর সাথে দেখা করতে। অনেক বকা দেয়। কথা না শুনলেই বকতো। ওর সাথে থেকে আহিদ নিজে শোক কাটিয়ে উঠতে পারে, নাহয় ওরও বোধহয় বাঁচার ইচ্ছা ছিলো না।

এভাবেই আমরা ভার্সিটিতে উঠি। আমি মেডিক্যাল ভার্সিটিতে গেলেও তিন্নি, জান্নাত আর আহিদ একই ভার্সিটিতে চান্স পায়। দু’বছর পর তাদের সম্পর্কের নাম হয় ভালোবাসার। তারপর দুইজনের প্রেম চলে কয়েকমাস। দুইজনই ছিলো বিপরীতধর্মী। আহিদ শান্ত ও গম্ভীর। চুপচাপ থাকতো সব পরিস্থিতিতে। আর ওদিকে জান্নাত স্পষ্টবাদী ও চঞ্চল। আর প্রতিবাদী ছিলো ভীষণ। যা মনে আসবে তাই বলতো। লোক, মানুষ, জায়গা কিছু দেখবে না। এভাবেই ভার্সিটির শেষ সময়ে জান্নাতের বাবা তার জীবন ছেলে দেখতে শুরু করলে সে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় সে ভালোবাসে একজনকে। তাকেই বিয়ে করবে। তার বাবা বুঝানো থেকে শুরু করে হুমকি পর্যন্ত দেয়। চারদিন ধরে ওকে রুমে বন্দী করে রাখে। কিন্তু জান্নাতের মতো জেদি মেয়েও ছিলো না কম। সে-ও খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তার বাবা মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে আহিদের সাথে দেখা করতে রাজি হয়। কিন্তু ওর কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না। তাই জান্নাতের বাবা তীব্র নারাজ হয়। সে কোনো মতেই বিয়ে দিবে না আহিদের সাথে। সে ঢাকার সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে একজন। অনাথ কাওকে নিজের মেয়ে কীভাবে দেয়? কিন্তু জান্নাতও হার মানে নি। তার বাবা যখন জোর করে অন্যকোথাও বিয়ে দিবে সে পালিয়ে এসেছিল আহিদের কাছে। আহিদ প্রথমে তাকে বুঝিয়ে পাঠাতে চাইলেও, সে-ও জানতো জান্নাত ছাড়া সে বাঁচবে না। তার তো এই একটি মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। তার সম্পূর্ণ জগৎ সংসার একটি মেয়েতেই সীমাবদ্ধ।

তারপর ওরা কাজি অফিসে বিয়ে করে নেয়। আহিদ তার জমানো টাকা দিয়ে একরুমের ঘর ভাড়া নেয়৷ দালানের রাজকন্যা কুঁড়েঘরে এসেও উফফও করে নি। অবশ্য আহিদ তাকে সে ছোট ঘরটাতেও রাণীর মতোই রেখেছিল। জান্নাতের সুখ তার কাছে নিজের প্রয়োজন থেকেও আগে ছিলো। নিজে না খেলেও জান্নাতকে কমতি হতো দিতো না কখনো। ভার্সিটি শেষে রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো হওয়ায় আহিদ বড় কোম্পানিতে চাকরিও পায়৷ আরেকটু বড় বাসায় উঠে। সাথে খুশির খবরও এসেছিল তাদের সংসারে। জান্নাত প্রেগন্যান্ট ছিলো। আহিদের কেবল একটাই স্বপ্ন ছিলো, একটা সুখী পরিবারের। তার নিজের পরিবারের। যা হতে যাচ্ছিল। কিন্তু কিসমতের তা মান্য ছিলো না। তাদের ছেলে হবার কথা ছিলো। তারা নামও ভেবে রেখেছিল, ইভান। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পরপরই মারা যায়। অনেক খারাপ অবস্থা হয়ে যায় দু’জনের। এর মধ্যে জান্নাতের বাবা আসে তাকে নিয়ে যেতে। সে বলে, আহিদ তার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারে নি বলেই এমনটা হয়েছে। মেয়ে তার কাছে থাকলে কখনো এমনটা হতো না। আরও অনেক অপমান করে। এরপর থেকে আহিদ প্রতিজ্ঞা করে তাদের থেকে বেশি অর্থ কামিয়ে দেখাবে। জান্নাতকে রাণীই বানিয়ে রাখবে। তার পরিশ্রম দ্বিগুণ করে। কাজের পাশেপাশি নিজে পরিকল্পনা ব্যবসায়ের, ইনভেস্টর খুঁজে। যা সহজে হয় না। তারপর জাহান আসে এই পৃথিবীতে জান্নাতের কোল জুড়ে। এদিকে আহিদেরও ব্যবসা শুরু হয়। সে অনেক ঋণ নিয়ে যা শুরু করে। সে ব্যবসা থেকে ভালো অর্থ এলেও আহিদের শান্তি হচ্ছিল না। সে সবচেয়ে বড় ব্যবসা করতে চাইছিল। তারপর এয়ারলাইনসের পরিকল্পনা মাথায় আসে। কয়েকজনকে তার পরিকল্পনা শুনায়। সময় কাটে। জিনি আসে এই পৃথিবীতে। আহিদের ব্যবসাও উন্নিতি হয়। এয়ারলাইনসের কাজ শুরু হয়। জনাব শিকদার তার ব্যবসায়ে ইনভেস্ট করতে রাজি হয়। জান্নাতকে দিয়েই সে তার এয়ারলাইনসের উদঘাটন করায়। আর নাম রাখে তার প্রথম ছেলেকে দিয়ে। ইভান এয়ারলাইনস। সবকিছু পার্ফেক্ট যাচ্ছিল। কিন্তু একটা এক্সিডেন্ট সব ওলট-পালট করে দিলো। জান্নাত আহিদকে ছেড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। তার একমাত্র স্বপ্ন পূরণ হয়েও উজাড় হয়ে গেল। জান্নাতের সাথে আহিদের সুখও চলে গেল। সে শুধু বেঁচে রইল তার দুই সন্তানের জন্য। নিজেকে কাজে ডুবিয়ে দিলো। যদি জান্নাতের স্মৃতি একটু কম মনে পড়ে।”

নাহিদ সবটা বলে তাকাল মহুয়ার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললে। পানি পান করল একগ্লান। একটানা সবটা বলে ক্লান্ত সে। পানির গ্লান পুণরায় টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করে, “শুনলে তো সবটা। এখন কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?”
“আছে।”
“করো।”
“আমার শাশুড়ী’মা অর্থাৎ জাহানের মা চারদিন না খেয়ে কীভাবে ছিলো? আমি তো একবেলা না খেলে আমার পেটে হাতিরা কাবাডি খেলে।”
এহেন প্রশ্ন শুনে ডা. নাহিদ আশ্চর্য নিয়ে তাকিয়ে রইলো মহুয়ার দিকে। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে এমন প্রশ্নে। কিন্তু হেসে দেয় পরক্ষণেই। বলে, “জান্নাত বেঁচে থাকলে তোমাকে তার অনেক পছন্দ হতো।”
“অফকোর্স হতো। আমি কী অপছন্দ করার মতো না’কি? কেবল আমার শশুড়আব্বা আমার কদর বুঝলো না।” তারপর সে উঠে দাঁড়ায়। নিজের ব্যাগ নিয়ে বলে, “বুঝলাম ডাক্তার আংকেল। আমার শশুড় আব্বাকে লাইনে আনার কিছু ভেবে নিবো আপনার বলার গল্প থেকে শুক্রবার দেখা হচ্ছে। এখন যাই।”
“তোমাকে না আসতে মানা করেছে?”
“মানা করলেই আমি মানবো না’কি?”
.
.
বুধবার সকালে, ঘুম থেকে উঠে মৃণা দেখতে পায় না মুরাদকে। সে গোসল করে এসে দেখে মুরাদ একব্যাগ চকোলেট নিয়ে এসে রেখেছে বিছানার উপর।
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এতগুলো চকোলেট কেন?”
“বিয়ের পর প্রথম ভার্সিটি আর স্টুডিওতে যাবি। মিষ্টি মুখ করাবি না?”
মৃণা একথায় চুপ থাকে কতক্ষণ। চোখ মেলায় না মুরাদের সাথে। তারপর বলে, “আচ্ছা আমরা আপাতত বিয়ের ব্যাপারটা কাওকে না জানালে ভালো হয় না?”
কথাটা শোনা মাত্রই মুরাদের হাসিমুখটা মলিন হয়ে যায়। সে আড়চোখে তাকায় মৃণার দিকে। বলে,
“তোর যেমন ইচ্ছা। কিন্তু একজনকে জানাতেই হবে।”
কৌতুহলবশত প্রশ্ন করে মৃণা, “কাকে?”
“তোর এক্স-কে। এই পুরো ব্যাগ চকোলেট তার হাতে দিয়ে বলবি তোর জামাইয়ের পক্ষ থেকে তার জন্য ছ্যাঁকার গিফট।” বলে মুরাদ পুরো ব্যাগ চকোলেট মৃণার হাতে তুলে দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল ওয়াশরুমে। শাওয়ার নিতে।

আর মৃণা সেখানে ভ্যাবলার মতো তাকিয়েই রইলো।একবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকাল আবার চকোলেটের ব্যাগের দিকে।
.
.
আজ অনেকদিন পর মোহ বের হয়েছে ভার্সিটির জন্য। এতদিন সে মহুয়ার বাসা ও নিজের বাসায় দৌড়াদৌড়ি করেছে। একদিকে মহুয়ার সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তার পূরণ করতে হবে, অন্যদিকে তার পরিবারের অবস্থারও খেয়াল রাখতে হবে।

আজও সে ভার্সিটিতে আসতো না। মহুয়া আসছে বলে তার যেতে হচ্ছে। তবে মন মেজাজ ভালো না তার। চারদিন পর সমুদ্র তাকে বারে বারে কল করছে। যখন কল দিয়েছিল ধরে নি। এখন সে-ও ধরবে না। কথা তো দূর, তাকে দেখার জন্যও বিতৃষ্ণা জাগছে তার মনে।

ভার্সিটির সামনের পার্কিং-এ দেখে মহুয়া কথা বলছে জাহানের বন্ধুদের সাথে। হয়তো তার খোঁজ নিচ্ছে। কারণ এখনো খোঁজ পায় নি সে জাহানের। সে গেল সেখানে। মহুয়াকে ডাকার পূর্বেই তিসান জোর গলায় প্রশ্ন করল, “তোমার এই অবস্থা কেন মোহ? তুমি তো দেখি চিন্তায় দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছো।”
মোহ ভড়কে যায়। সে মহুয়াকে এখনই এসব জানাতে চায় না। সে আরও বেশি চিন্তা করবে। তবে এসব মহুয়া আগে থেকেই খেয়াল করছে। মোহ আজকাল খেতে চায় না। রাতে ঘুমায় না ঠিক মতো। তার মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পরেছে গাঢ়, তার আকর্ষণীয় মুখখানা মলিন হয়ে গেছে, শুকিয়ে যাচ্ছে সে। একটু বেশিই।

অন্যদিন হলে মহুয়া তিসানকে বকা দিতো। কিন্তু আজ সে সায় দেয়, “একদম ঠিক বলেছ ব্রোফ্রেন্ড। কত বকেছি ওকে, কথাই শুনে না। মৃণাকে আগে মেডাম জ্ঞান দিতো। এখন সে নিজেই কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছে।”
বলে কথাটা হাসিতে উড়িয়ে দিতে যেয়ে মহুয়ার কিছু একটা ধরে নিজের কথার মাঝেই। সে এবার চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “তোর আর সমুদ্র ভাইয়ার মধ্যে সব ঠিক আছে তো?”

মোহ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে কি এখন মিথ্যা বলবে? সে সহজে তো মিথ্যা বলে না। অন্যদিন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বললেও আজ তো মহুয়া সরাসরি এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে নেয়।

সে মুখ খুলবে কিছু বলার জন্য এর আগেই মহুয়া বলে, “আমিও না কি বলছি। ভাইয়া একটু আগেই তোকে না পেয়ে আমাকে কল দিয়েছিল। তোর দেখা না পেয়ে ভার্সিটিতে আসছে। চিন্তা কর, কত লাভিং আমার দুলুভাই। এই দেখ, বলতে বলতে এসেও পরেছে। ”
সে হাত নাড়িয়ে মোহের পিছনে তাকায়।
মোহ পিছনে ফিরে দেখে সমুদ্রকে। বাইক থেকে নামছে। তাকে দেখে কষ্টের সাথে সাথে একরাশ বিরক্তি তাকে এসে গ্রাস করে। সমুদ্র এদিকে আসার আগেই মোহ বলে, “আমি একটু কথা বলে আসছি উনার সাথে।”
মহুয়ার উত্তরের অপেক্ষা না হলেই সে রাস্তার ওপাড়ে গেলে। সমুদ্র তাকে দেখেই এগিয়ে আসে। তার গালে হাত রেখে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন মধু? তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?”

মোহ জানে মহুয়া তাকে দেখছে, তাই কোনো ঝামেলা করল না। সে শান্ত গলায় অথচ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের দিকে, “হাত সরান, আমাকে ছোঁয়ার আগে উওর দিন এতদিন কোথায় ছিলেন। একচুয়ালি কেবল এই প্রশ্নের উওর দিন, জবার কাছে গিয়েছিলেন?”
“আমি…”
“আমি কোনো এক্সপ্লেনেশন শুনতে চাই না। হ্যাঁ বা না বলুন।”
“আমার কথা তো শুনো…”
“আমি হ্যাঁ অথবা না-তে উওর শুনতে চেয়েছি।”
“হ্যাঁ কিন্তু… ”
“আর কোনো কথার প্রয়োজন নেই। আমি যা শোনার, যা বুঝার, সব শুনেছি ও বুঝেছি। এখন আর কিছু নেই শোনার বা বুঝার। আপনার চেহেরাও আমি দেখতে চাই না। আপনি যদি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আপন ভেবে থাকেন, তাহলে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আর এখানে কোনো সিন ক্রিয়েট করবেন না। মহুয়াকে আমি এখনই কিছু জানাতে চাচ্ছি না আমাদের ডিভোর্স নিয়ে।”
শেষ শব্দটা শুনে চোখ বড় হয়ে যায় সমুদ্রের, “ডিভোর্স? মধু তুমি কি বলছো নিজে বুঝতে পাড়ছো তো?”

উওর দেয় না মোহ। ফিরে আবারও মহুয়ার দিকে এগোয়। ওপারে যাবার জন্য। দুই’পা এগোতেই হঠাৎ থেমে যায়। তার মাথা ঘুরান দিয়ে উঠে। চোখের সামনে সব ভাবসা হয়ে যায়। তার মনে হয় তার চারপাশ ঘুরছে। সে ভাবসা চোখে দেখে মহুয়াসহ জাহানের সব বন্ধুরা দৌড়ে আসছে।

পিছন থেকে সমুদ্রের কন্ঠও পায় সে। কি বলে শুনতে পায় না ভালো করে। বোধহয় তাকে ডেকেছে। সে মধুর ডাক, মধু…

তার শরীর মুহূর্তে অনেক হাল্কা লাগলো। সে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে এক উষ্ণ ছোঁয়া তাকে আলিঙ্গন করে নেয়। চোখের সামনে দেখতে পায় তার প্রিয় দৃশ্য, সমুদ্রের মুখখানা।
তারপর?
তারপর সব অন্ধকার হয়ে যায়।

চলবে…