মেঘের খামে পর্ব-৫৭+৫৮

0
4

মেঘের খামে…
পর্ব ৫৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয় মোহকে হাস্পাতালের দিকে। তাকে এডমিট করা হয়। ডাক্তার তাকে দেখে বলে,
“আপনারা এতজন এলেন কেন? এখানে এতজন থাকা মানা। উনার অভিভাবক কে?”
সমুদ্র এগিয়ে আসে, “আমি ওর স্বামী।”
“নিজের স্ত্রীর খেয়াল রাখন না ঠিক মতো? ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। হয়তো ডিপ্রেশনেও। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না?”
সমুদ্র উওর দিতে পারে না। সে তো এতদিন মোহের সাথেই ছিলো না।
ডাক্তার উওর না পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে, “পেসেন্টকে স্যালাইন লাগাতে হবে। নার্স লাগিয়ে দিবে। আপনারা বাড়তি লোকেরা এখানে থাকবেন না।”

ডাক্তার যাবার পর নার্সও স্যালাইন লাগিয়ে বের হয় রুম থেকে। মহুয়া মোহের পাশে বসে। তার অন্যহাত ধরে। চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। ভেজা গলায় বলে, “সব আমার দোষ। মৃণার বিয়ের চক্করে আমি খেয়ালই করিনি যে মোহ ঠিকভাবে খাচ্ছে না। এর উপর মিতা আপুর মিসক্যারেজের পর মোহ দৌড়াদৌড়িতে ছিলো। আমার ওর খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।”
সমুদ্র এই কথা শুনে অবাক হয়, “মিতার মিসক্যারেজ হয়েছে?”
মহুয়া এবার চোখ তুলে তাকায়, “আপনাকে মোহ বলে নি?”

“বলবে কীভাবে সে তো নিজের প্রথম প্রেমকে নিয়েই ব্যস্ত।” তিসান হঠাৎ কথাটা বলে উঠে।
মহুয়া বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে, “এসব কোন ধরনের কথা বলছো তুমি? তাও এই পরিস্থিতিতে?”
“ভুল বলেছি? আমি মৃণার কাছ থেকে শুনেছি। উনার আর উনার প্রাক্তনের কাহিনি। বিয়ের পরও উনি মোহকে মেনে নেয় নি রাইট?”
“সেটা বহু আগের খবর। এখন দু’জনে অনেক খুশি আছে।”
“তুমি কীভাবে জানো মহুয়া? তুমি জানো না। এই লোক মোহকে মোটেও খুশি রাখে নি।”
“খবরদার তিসান। আমার দুলুভাইয়ের সাথে বেয়াদবি করবে না।”
“আমি বেয়াদবি করছি? তুমি জানো উনি কী করেছে?”
তিসান যেয়ে দাঁড়ায় সমুদ্রের সামনে। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলুন, আপনি কী করেছেন? মোহের এমন অবস্থা যে তাকে হাস্পাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এর কারণটা বলুন।”
সমুদ্র চোখ নামিয়ে নেয়। মহুয়া তার দিকে তাকালেও সে একবারও মহুয়ার সাথে চোখ মেলায় না।

তিসান আবারও বলে, “আপনি ওকে খুশি না রাখতে পারলে ওর সাথে আছেন কেন? আমাকে দিয়ে দিন। আমি ওঁকে খুশি রাখবো।”
এবার সমুদ্র তাকায় তার দিকে। কপাল কুঁচকে, “তোমাকে দিয়ে দিব? এর মানে কী?”
“এর মানে আপনি ওকে তালাক দিন, আমি ওঁকে বিয়ে করবো। আপনার সাথে বিয়ে করে ওর অবস্থা দেখেছেন? ওর যে মুখ দেখে আগে চোখ ফেরানো দায় ছিলো, সে মুখশ্রীর অবস্থা দেখেছেন? আপনি ওকে ছেড়ে দিন। আমি ওর সব খুশির খেয়াল রাখবো। ওকে ভালোবাসবো, ওর জন্য স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করবো যা আপনি কখনো পারেন নি।”

কথা শেষ হতেই সমুদ্র তার শার্টের কলার ধরে নেয়। তার চোখদুটো যেন অগ্নিবান। যেকোনো মুহূর্তে ভস্ম করে দিবে তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে।
“তোর সাহস কী করে হলো আমার বউয়ের কথা মাথায়ও আনার। ও কেবল আমার স্ত্রী, আর আমারই থাকবে।”
“নামের স্ত্রী হলেই হয় না। খেয়ালও রাখতে হয়। আপনার থেকে বেশি আমি ওকে সুখে রাখতে পারবো। আপনি ওকে না ছাড়লে, না ছাড়লেন। আমি ওকে কনভেন্স করে বিয়ে করবো।”
সমুদ্র তার কলার ছেড়ে একটা ঘুষি মারে তার মুখে। যার কারণে সে পিছিয়ে যায় একটু।

এতক্ষণ শান্তই ছিলো তিসান। হাত তোলার কথা ভাবে নি। কিন্তু সমুদ্রের আঘাতে তারও মাথায় র’ক্ত উঠে যায়। সে-ও এগিয়ে যায় সমুদ্রকে ফেরত আঘাত করতে। এমনকি তার সাথের ভাই ব্রাদাররাও ক্ষেপে যায়।

তিসান তাকে এগিয়ে মারতে যাবার আগেই মহুয়া তাকে ধরে নেয়। চেঁচিয়ে উঠে তার উপর, “ব্রোফ্রেন্ড এটা হাস্পাতাল। আমার বান্ধবী অসুস্থ। তুমি এসব কী কাহিনি করছো?”
“আমি কাহিনি করছি? ও আমাকে মারলো তোমার চোখে পড়ে নি?”
“অন্যের বউয়ের নামে এসব কথা বললে পরিণাম তো এমন হবেই। ঠিক আছে বিয়ের আগে তুমি মোহকে পছন্দ করতে। কিন্তু এখন এসব বেশি হয়ে যাচ্ছে। ও বিবাহিত। সুখে সংসার করছে।”
“মোটেও ও সুখে সংসার করছে না। মৃণার বিয়ের আগের থেকে ওরা আলাদা হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করো।”
“কী আলতু ফালতু কথা!”
“জিজ্ঞেস করো…জিজ্ঞেস করো উনাকে কেন তারা আলাদা থাকছে।”
“ফালতু কথা বলবা না। কিছু হলে মোহ আমাকে বলতো। মোহ আর দুলুভাইয়ের মধ্যে সব ঠিক আছে।”
“আমার কথা বিশ্বাস না হলে উনাকে জিজ্ঞেস করো। উনি আর মোহ আলাদা থাকছে কি-না? উনি মোহকে ভালোবাসে না’কি? উনি মোহের উপর হাত তুলেছে না’কি? জিজ্ঞেস করো উনাকে।”

শেষ প্রশ্ন শুনে মহুয়া থমকে গেল। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের দিকে। নিজ অজান্তেই প্রশ্ন করে বসে, “আপনি মোহের উপর হাত তুলেছেন?”
তার কন্ঠে চরম অবিশ্বাস।

সমুদ্রের চোখ লুকানো দেখেই সে উওর পেয়ে যায়।
“আপনি কীভাবে পাড়লেন? আমি ছোট থেকে আজ পর্যন্ত ওকে দেখে এসেছি। কোনো ছেলেকে ওকে বিরক্ত করতে দেই নি। ওকে আর মৃণাকে রক্ষা করে এসেছি। আর আপনার এত্তো বড় সাহস ওর উপর আপনি হাত তুলেছেন। আমার বান্ধবীর উপর? ও আপনার স্ত্রী। জানেন আমরা বুঝ হবার পর যখন কথা বলতাম। ও সবসময়ই বলতো ও কেবল একজনকেই ভালোবাসবে, ওর স্বামীকে। আর ও আপনাকে ভালোও বেসেছিল। আপনার মন অন্যকোথাও আছে তা জানা সত্ত্বেও। ও যখন বিয়ের পর আমাকে বলেছিল যে আপনি অন্যকাওকে ভালোবাসেন। সত্যি বলতে আমার ভেতরে অনেক রাগ উঠেছিল কিন্তু তবুও আপনার পক্ষ হয়ে বলি। আমার তো মনে হয়েছিল, আপনি ভালো মানুষ। এই এক খুঁতের কারণে আমি আমার বান্ধবীকে তার সংসার ভাঙতে উৎসাহ দিবো না। একসময় অতীত ভুলে ওকে ভালোবেসে ফেলবেন। ওর মতো মেয়েকে ভালো না বেসে মানুষ থাকতে পাড়বে? তাও তার স্বামী। আপনাকে আমি আমার মুরাদ ভাইয়ার পরে ভাইয়ের জায়গা দিয়েছিলাম। আপনার ঠিক বেঠিক সব কথায় আমি আপনার পক্ষ নিয়েছি। আপনার মতো মানুষ কীভাবে আমার ভাই হতে পাড়ে? আমার ভুল হয়েছিল। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। মোহকে তখন যদি আপনাকে ছেড়ে দিতে বলতাম, ও যদি আপনাকে ছেড়ে দিতো তাহলে আজ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতো না এখানে।”
“মহুয়া আমার কথা শুনো…” সমুদ্র শান্ত গলায় তাকে কিছু বলতে নেয়। এর পূর্বেই মহুয়া রেগে দাঁত পিষে বলে, “বের হন। আমার মোহের আশেপাশেও আসবেন না আপনি।”
“মহুয়া কী বলছো এসব?”
“ঠিক বলছি। মোহও এটাই বলেছিল তাই না? ও নিশ্চিত আমার জাহানকে নিয়ে চিন্তা ও মৃণার বিয়ের জন্য আমাদের কিছু বলে নি। আপনার সাথে থেকে আমার জন্য। আমি বলেছি বলে। যেন আমি ওর চিন্তা না করি। ওর কত কষ্ট হয়েছে সে মুহূর্তে!” মহুয়ার বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো আপনা-আপনি। সে আবার তাকাল সমুদ্রের দিকে। রাগে, কষ্টে তার চোখে পানি এসে পড়ে, “আপনি তো ওকে ভালোবাসলেন না। কিন্তু এতটুকুও কি চিনলেন না ওকে, মোহ যাকে ভালোবাসে অপরিসীম ভালোবাসতে জানে, কিন্তু যে একবার ওকে আঘাত করে তার কাছে ফিরে যায় না। আপনি ওকে অনেকবার আঘাত করেছেন। কয়েকটি আমি জানি, আর কতগুলো হয়তো জানি না। তবুও নিজের মনের দোয়ার আপনার জন্য বন্ধ করে নি। এবার আপনি কত বড় আঘাত দিয়েছেন চিন্তা করুন যে ও আপনার থেকে দূরে যেতে চায়। প্লিজ যান এখান থেকে। মোহকে চোখ খুলে আপনাকে দেখতে চাইবে না। আর আমিও আপনাকে এই মুহূর্তে সহ্য করতে পাড়ছি না আর। আপনার সাথে কোনো বেয়াদবি করতে না চাওয়ায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছি কঠিনভাবে। একসময় আপনাকে ভাই ভেবেছিলাম। হয়তো তাই। প্লিজ বের হন এখান থেকে।”

মহুয়া ফিরে আবার মোহের কাছে যেতে নেয়। তখনই সমুদ্র বলে, “আমি ওকে ভালোবাসি।”
মহুয়া থেমে যায়। সে ফিরে তাকায় সমুদ্রের দিকে।
সমুদ্র আবারও বলে, “ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। মধুকে ছাড়া বাঁচাটাও আমার কাছে দায় মনে হচ্ছে।”
“আপনার বুঝতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। এখান থেকে যান।”
“মহুয়া তুমি আমার বোনের হও। আমার কথা একটু শুনো…”
“ওর জীবনের সিদ্ধান্ত ও নিবে। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে আপনার চেহেরা দেখতে পারছি না কোনো মতেই। প্লিজ বের হয়ে যান, নাহলে আমি এমন কিছু বলে ফেলবো বা করে ফেলবো যা আপনার আমার কারো ভালো লাগবে না।”
সমুদ্র অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় মহুয়ার দিকে। যদিও সে জানতো এই দিন আসবেই তবুও তার সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে গেছে ভীষণ।
.
.
মোহকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছিল ইনজেকশনের মাধ্যমে। তাই তার ঘুম থেকে উঠতে রাত হয়। উঠে সে চোখ খুলে দেখতে পায় রুমে মৃণা, মুরাদ, মহুয়া, তার বাবা মা সবাই আছে। এমনকি তিসানও আছে। কেবল তার চোখের তৃষ্ণা মেটানো লোকটি নেই। সে এই অবস্থায়ও মোহকে ছেড়ে গিয়েছে? ভাবতেই বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো তার।

মোহের মা তার চোখ খুলতে দেখেই প্রশ্নের ভান্ডার খুলে বসলো, “তোর ঠিক লাগছে তো? কষ্ট হচ্ছে না-তো? মাথা ঘুরাচ্ছে? তোর…”
“আম্মু আমি ঠিক আছি।” মোহ খানিকটা কষ্টেই কথাগুলো গলা দিয়ে বের করল।
“আমি মিতার চিন্তায় তোর খেয়ালই রাখলাম না। আমার কারণে তুই আজ এই অবস্থা।”
“মা এমন করো না। সব ঠিক আছে। আমি ঠিক আছি।”
মহুয়া তার পাশেই বসেছিলো। এই কথা শুনে সে মা’রল মোহকে, “হাস্পাতালের বেইডে শুয়ে না’কি ভালো আছে। একটু ভালো হ। তোকে সাইজ করবো।”
মৃণা তখন আতঙ্কিত কন্ঠে বলে, “এই মা’রিস না। ব্যাথা পাবে।”
“কচু পাবে। ম্যাডাম খাবে না, কিছু না। কেন ভাই? যে দোষ করসে তাকে মা’রবি। তুই নিজেকে কষ্ট করবি না’কি?”
মুরাদ বলে, “মিষ্টি তুই থামবি? ও মাত্র উঠেছে। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি।”
“হ্যাঁ ডাক্তার ডেকে এনে তুমি মৃণাকে নিয়ে বিদায় হও। এখানে এমনিতেও রাতে একজন ছাড়া থাকতে পারবে না।”
মৃণা প্রতিবাদ করে, “আমি কোথাও যাব না।”
মোহের মা’ও বলে, “তুমি বাসায় যা-ও মা সকাল থেকে আছো। আমি আছি।”
“আন্টি আপনি আর আংকেল বাসায় যাবেন। মিতা আপুরও যেহেতু অবস্থা ভালো না তাকে একা না ছাড়াই ভালো। আমি আর মৃণা তো আছি। আর মৃণা তোকে আমি এমনি পাঠাচ্ছি। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে নাস্তা নিয়ে আসবি।”
“কিন্তু ঔষধ আনার জন্য তো কাওকে লাগবে।”
মুরাদ বলে, “সমুদ্র ভাইয়া তো বাহিরে আছে। ভাইয়া এনে দিবে।”
“সমুদ্র?” মোহের এতক্ষণে যেন আটকে আসা নিশ্বাস ছাড়ে, “উনি এসেছে?”
“সমুদ্র ভাই তো সকাল থেকেই এখানে।” মুরাদ জানায়।
সাথে সাথে মোহের ঠোঁটের কোণে নিজ অজান্তেই হাসি এঁকে উঠে। তবে সে হাসির সাথে সে মহুয়ার তাকানো খেয়াল করে। এই দৃষ্টি সে চিনে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সে চোখে কতগুলো প্রশ্ন জমানো। যা দেখে মোহের বুকের ভেতর জয় জমে গেল। তাহলে কী মহুয়া কিছু জেনেছে?

সবাই গেল রাতে। সবাই যাবার পরও সে তাকে রইল দরজার দিকে। সমুদ্রের আসার আশায়। কিন্তু সমুদ্রের দেখা অএল না। সে উলটো মহুয়ার প্রশ্নের সম্মুখীন হলো, “সে আসবে না। আমি মানা করেছি। তুই কেন আমাদের কিছু বলিস নি মোহ? এত বড় এক সত্যি লুকাতে পারলি?”

মোহ তার দিকে তাকায়। মহুয়া সঠিক কি জানে, সে বুঝতে পাড়ল না। কিন্তু তার ভয় হলো।
“কী ব্যাপারে?” মোহ প্রশ্ন করে ভীত সুরে।
“ঢঙ করবি না। তুই জানিস আমি কি ব্যাপারে কথা বলছি। সমুদ্র ভাইয়া তোকে মে’রেছে, এত বড় কথা তুই আমার থেকে লুকাতে পারলি? এর উপর তার সাথে সুখে সংসারের নাটক করছিস নিজেকে কষ্ট দিয়ে। কেন? আমি আর মৃণা চিন্তা করবো এজন্য? এজন্য তুই আমাদের সামনে নাটক করে নিজের শরীরের এই অবস্থা করেছিস?”
“না! থাপ্পড় মা’রে নি। হাত উঠিয়েছিল। থেমে গিয়েছে আগেই। কিন্তু তবুও আমি সে দৃশ্য ভুলতে পারছি না।” মিনমিনে সুরে বলল মোহ।
“ভোলা উচিতও না। কথাটা শুনে আমার গা জ্বলে গেছে। ঠিক আছে মা’রে নি কিন্তু এই কথা তার মাথায় এলো কীভাবে?”
মোহ চুপ রইলো।
মহুয়া আবার জিজ্ঞেস করে, “কী ভেবেছিস? কী করবি?”
“জানি না। উনাকে ছাড়া আমার বাঁচতে কষ্ট হয়, উনার সাথে থাকতেও কষ্ট হয়। এমন পরিস্থিতিতে পড়লাম আমি। আমার মাথা কাজ করছে না।”
“মাথা কাজ করবে কেমনে? মাথা কাজ করার জন্য পেটেও তো কিছু যেতে হবে তাই না? এই আমাকে দেখ, জাহানের বাচ্চার জন্য। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। খাওয়া বন্ধ করার জায়গায় উলটা ডাবল করে দিছি। পুরশু ওই শালার বিয়া আর আমি সকালে তিনটা পরোটা খাইয়া আইসি। কেউ বিশ্বাস করবো?”
“বিয়ে না এনগেজমেন্ট।”
“এনগেজমেন্ট না বিয়ে।”
মোহ এই কথা শুনে উঠে বসতে নেয়। কিন্তু তার শরীর ব্যাথা হয়ে আছে সারাদিন শুয়ে থাকায়। তাই মহুয়া তাকে বালিশে হেলান দেইয়ে ধরে বসাল।
“বিয়ে মানে কি? জাহান ভাইয়ার এনগেজমেন্ট। এনগেজমেন্টের পরও তো সম্পর্ক ভাঙা যাবে তাই না?”
“ঐদিন শায়ান আমাকে প্রপোজ করেছিল। তখন বলল, এই শুক্রবারে এনগেজমেন্ট না, তাদের কাবিন হবে। এ কথা জাহান জানেনা।”

মোহ কিছু মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার কথা শুনে। মুখ খুলে কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। আতঙ্ক স্পষ্ট তার মুখে।

তার চেহারা এরকম ভঙ্গিমা দেখে মহুয়া তাকে সান্ত্বনাবাণী দেয়, “আরে আমি সব সামলে নিব। চিন্তা করিস না। লাগলে ওর বাসার সামনে যেয়ে শোলের ভীরু যে ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে নাটক করেছিল। আমিও করব।”
বলে মহুয়া হাসে।
কিন্তু তার হাসির পিছনের কষ্ট স্পষ্ট দেখতে পায় মোহ। তার তুলে তার চোখের আঙুল বুলায় আলতো করে, “তুইও কতরাত ঘুমাস নি তাই না? খুব চিন্তায় আছিস?”
“তুই বলেছিলি না মহুয়া চিন্তা করে না চিন্তা দেয়। কেবল একটা সলিড প্লান লাগবে। এর জন্য জানা লাগবে জাহান কেন হ্যাঁ বলেছে এই সম্পর্কে। জাহানের বাচ্চা থাকলে ওর পেট থেকে কথা বের করতাম। কিন্তু ওকে কই গুম করেছে আল্লাহ মাবুদ জানে। আর শায়ানের সাথে বন্ধুত্বের নাটক করে বের করতে চেয়েছিলাম কিন্তু… ”
“আমি জানি।”
মহুয়া থেমে যায় মোহের কথা শুনে। অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “কী?”
“আমি জানি। ওদিন জাহান ভাইয়া আমাকে সব জানিয়েছিল চা’য়ের দোকানে বসে। যেন তোর খেয়াল রাখতে পারি। এই শায়ান সব নষ্টের গোড়া। এই শায়ান নামক ছেলে আর রশ্মির ভাই রাজ তোর ক্ষতি করার হুমকি দিয়েছে ভাইয়াকে।”
“আমার ক্ষতি?”
“হ্যাঁ, প্রথমে জাহান ভাইয়ার বাবা জিনি ও তার মা’য়ের বলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করার চেষ্টা করেছিল। লাভ হয় নি তারপর শায়ান ও রশ্মির ভাই তোর নামে হুমকি দিয়েছিল। দুইজনে না’কি অনেক পাওয়ারফুল। ভাইয়া ভেবেছিল এনগেজমেন্ট করে পাঁচ বছর সময় নিবে। যখন সে ব্যবসায়ের দায়িত্ব আর ক্ষমতা ভাইয়ার হাতে আসবে তখন সে তোকে সব জানাবে। এনগেজমেন্ট ভেঙেও তোকে রক্ষা করতে পারবে। তুই আমাকে এই বিয়ের কথা আগে বললে আমি তোকে সব আগেই জানিয়ে দিতাম।”
মহুয়ার মুখমণ্ডল শান্ত থাকে কত সেকেন্ড। তারপর ভারী হয়। অবশেষে তার ফর্সা মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়, “আমি দুই মিনিটে আসছি।”
“কই যাচ্ছিস?”
“একটা কল করবো। তুই রেস্ট কর। আমি বের হলেই একজন আসবে। বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সকাল থেকে। কিন্তু তাকে দেখেই আমার মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে তাই আমি থাকতে আসতে পারবে না।”
বলে মহুয়া বাহিরে গেল। আর মুহূর্তের মধ্যে হাজির হলো সমুদ্রও।

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৫৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“হ্যালো, মহুয়া? তুমি আমাকে কল দিয়েছ বিশ্বাস হচ্ছে না।” ফোনের ওপাশ থেকে শায়ানের কন্ঠ শোনা গেল।
“আগামীকাল আমার সাথে দেখা করবে।” মহুয়া সরাসরি বলল।
“তুমি আমাকে কল করে দেখা করার কথা বলছো? আমি ভাবিনি যে তোমার রাগ এত জলদি চলে যাবে।”
রাগে মহুয়া দাঁত পিষলো। সে কেবল জানাল, “আগামীকাল দেখা করো। কথা আছে।”
“জানো মহুয়া, আমি বাবার ব্যবসায় জয়েন করেছি।”
“আমায় বলছ কেন?’
“তোমার জন্য করেছি। তোমার যোগ্য হবার জন্য। তোমার ভাই তো এমন কর্মঠ কারো কাছেই তোমাকে দিবে।”
এই কথায় চুপ রইলো মহুয়া। তার রাগ গিললো বহু কষ্টে। হাস্পাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে সে ফোনে চেঁচামেচি করতে পারে না।
“বলছ সময় হবে না?”
শায়ান তড়িঘড়ি করে উওর দিলো, “এমনটা বলছি না। এমনি জানালাম। তোমার জন্য সব সময় সময় আছে। আধাঘন্টা আগে জানালেই হবে, যেখানে বলবে ওখানে পৌঁছে যাব।”
মহুয়া আর কিছু বলে না। কল কেটে দেয়।
.
.
সমুদ্রকে দেখার জন্য যার মন এতক্ষণ ছটফট করছিল সে তার দিকে তাকাচ্ছেও না।

সমুদ্র এসে পাশে বসলো মোহের। সাথেই মোহ মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। মুখশ্রী কঠিন করে রাখল। সমুদ্র তার গালে হাত রেখে মুখ নিজের দিকে করে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, ” তোমাকে বলেছিলাম যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দাও। নিজেকে শাস্তি কেন দিতে গেলে তুমি? তোমার এতটা সাহস হলো কীভাবে? নিজের কি অবস্থা করেছ তুমি। একবার দেখেছ? এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?”
“আপনি যে কষ্ট আমাকে দিয়েছেন তার থেকে কমই দিচ্ছি। আর আপনি এখানে কেন? আপনার জবার কাছে যান। এই সাপ্তাহ তো তার কাছেই ছিলেন। জলদি যেতে হবে আপনার। আমার জন্য আপনার বেশিই সময় নষ্ট হয়ে গেছে।”
মোহ সমুদ্রকে এক হাত দিয়ে ঠেলা দিতে লাগলো। সমুদ্র শক্ত হয়ে সেখানে বসে থাকে। একসময় মোহের হাত ধরে তাকায় তার দিকে। সরাসরি চোখে, “আমি ওখানে ওদের শাস্তি দিতে গিয়েছিলাম মধু।”
হঠাৎ এমন কথায় মোহ থেমে যায়। অবাক হয়ে থাকায় তার দিকে, “ওদের কাদের? কারিমের?”
“কারিম আর জবার।”
কারিমের নাম শুনে মোহ বিন্দুমাত্র অবাক না হলেও জবার নামে শুনে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পাড়ে না সে।

সমুদ্র বলে, “কারিম এখন কারাগারে আছে। এসবের জন্যই এতদিন দৌড়াদৌড়িতে ছিলাম। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই তোমার সাথে যোগাযোগ হয় নি। ওর বিরুদ্ধে সামনে কেইস খুলবে। ট্যাক্স ফ্রড ও পণ্যে ক্ষতিকর পদার্থ মেলানোর দোষে। আর আমি ওকে ওর শাস্তি দেওয়াবোই। আমার মধুকে ছোঁয়ার শাস্তি এত ছোট হতে পাড়ে না। ওঁর যৌবন কাটবে কারাগারের পিছনে। আমি তা নিশ্চিত করবো।”
মোহের কানে অর্ধেক কথা যেন গেলোই না, “আপনি জবার কথা কি বললেন?”
“ওর মা বাবা এবং শশুড়বাড়ি সবাইকে ওর বিয়ের আসল কারণ জানিয়েছি। সবাই ভীষণ ক্ষেপা। কারিমের যাবার পর ওর কোনো ঠিকানা নেই।”
“আর কেন করলেন আপনি এমনটা?”
সমুদ্র বিভ্রান্ত হয়, “ও তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে মধু।”
“ও আপনার প্রথম ভালোবাসা না? যার জন্য আপনি সব ছেড়ে দিয়েছেন। তার জন্য সবার সাথে লড়াই করেছেন। আমার জন্য তাকে এত বড় শাস্তি দিলেন? কেন?” তার কন্ঠে অবিশ্বাস।
সমুদ্র মোহের গালে হাত রাখে, “তুমি আমার স্ত্রী। তোমার চরিত্রে প্রশ্ন তুললে আমি তাকে ছাড়বো না’কি?”
মোহ হাসবে না কাঁদবে বুঝে না। যে মেয়ের জন্য নিজের সারা জীবন শেষ করে দিয়েছে লোকটা, তার জীবন নষ্ট করল তাকে একবার অপমান করার জন্য?

“কেন?” প্রশ্নটা শুনে অবাক হলো সমুদ্র। মানে সে বুঝলো না। পালটা প্রশ্ন করল, “কেন মানে?”
“মানে আপনি আমার জন্য আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে এমন কেন করলেন?”
“তুমি আমার কাছে ওর থেকে হাজারোগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
“তাহলে সেদিন ওর জন্য আমার সাথে এমন করেছিলেন কেন?”
“সেদিন ওর জন্য করিনি। সেদিন যখন শুনলাম তুমি ওকে থাপ্পড় মেরেছ তখন মনে হলো আমি এতমাস ধরে যাকে চিনি, যার সাথে সারাক্ষণ থাকি,যাকে আপন মনে করেছি সে এমন করেছে সে আমার ভাবনার মতো না। তখন তোমাকে অচেনা লাগছিলো। মনে হলো আমার পিছনে তুমি ওকে থাপ্পড় মারতে পারলে আগের কথাগুলো যদি সত্যি হয়? এক ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল। মনে হচ্ছিল আমার মধুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি ঈর্ষার জন্য। যাকে আমার মন ভীষণ আপন মনে করে আমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি সে নয়। এছাড়া শরীর ক্লান্ত ছিলো ভীষণ, মেজাজ ছিলো চিটচিটে, আর তখন রাগে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। সবসময়ই দেয়। তুমি জানো। এসব দিয়ে নিজের অপরাধ লুকাচ্ছি না আমি। আমি নিজের করা কান্ডে লজ্জিত। ওদের আমি শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু আমায় শাস্তি দেওয়ার অধিকার কেবল তোমার আছে। তুমি যা শাস্তি দেওয়ার দেও, আমি মাথা পেতে নিবো। কেবল আমাকে ছাড়ার কথা বলো না।”
মোহ তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তার মুখখানা এই মুহূর্তে অনুভূতিশূন্য। তার মনে কি চলছে তা মুখে পড়তে পারছে না।
মোহ শুধায়, “নামের সম্পর্কে আজীবন থাকতে পারবেন?”
“পারবো।
” আমি আপনার সাথে থাকবো না।”
“আচ্ছা।”
“আমায় ছুঁতে পারবেন না।”
“ঠিকাছে।”
“স্বামীর অধিকার খাটাতে পারবেন না।”
“রাজি। তুমি যা বলবে আমি সবকিছুতে রাজি। কেবল তুমি আমার থাকবে। আমার স্ত্রী। অন্যকারো হতে পারবে না।”
তাচ্ছিল্য হাসে মোহ, “সে তো আমি চেয়েও পারবো না। বুঝলেন, আপনাকে এই কয়দিনে মন থেকে ঘৃণা করতে চেয়েছি। নিজের ভালোবাসা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছি। পারিনি। বোধহয় এই জনমে আপনাকে ছাড়া অন্যকাওকে ভালোবাসা হবে না। আমার অন্যকাওকে ভালোবাসার ক্ষমতাও নেই। জানেন আমি না অন্যকারো সাথে সম্পর্কে যেয়ে আপনাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম কত কষ্ট লাগে। কিন্তু কি করব? আপনাকে ছাড়া অন্যকোনো পুরুষের সামান্য ছোঁয়া আমার কাছে বিষের মতো লাগে।”
“আমি জানি।”
“জানেন? সবসময় জানতেন?”
“একসময় পর বুঝে গিয়েছিলাম।”
“এজন্য আমাকে কষ্ট দিতেন তাই না?”
“উঁহু বুঝার পর তোমার যেসব জিনিসে কষ্ট পাও তার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেছি। তবুও নিজ অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিতাম। আমাকে কী এই একবার মাফ করা যায় না?”
মোহ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নেয়, “এখন যেতে পারেন।”
“চলে যাবো?”
“হ্যাঁ।”
“শেষ প্রশ্নটা করবে না?”
“কোন প্রশ্ন।”
“তোমাকে ভালোবাসি কি-না? এমন সময় এলেই এই প্রশ্ন করো। তাহলে আজ করো নি কেন?”

মোহ তাকাল না সমুদ্রের দিকে। তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এলো। ধুকপুক করে উঠলো। তবু বলল, “হয়তো উওর জানা আছে। কিন্তু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই না। একবার শুনলে আমি সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে যাবো। তাই না শোনাই ভালো।”

দরজা খোলার শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র। তাকায় দরজার কাছে দাঁড়ানো মহুয়ার দিকেও। তার চোখেও চরম বিতৃষ্ণা। তবুও সে বলে, “ডাক্তার বলেছে আগামীকাল সকালেই স্যালাইন শেষ হলে বাসায় যেতে পারবে।”
মহুয়া তার কথা শুনেও উওর দেয় না। সমুদ্র ছোট এক নিশ্বাস ফেলে বাহিরের দিকে যায়। একবার থেমে মহুয়াকে বলে, “আমি বাহিরেই আছি। মধু বা তোমার কিছু লাগলে জানিও।”
মহুয়া উওর দেয় না। সোজা যায় মোহের কাছে। সমুদ্র বের হবার পর মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “কী বলল?”
“কারিম আর জবাকে শাস্তি দিয়েছে।”
“মানে ওই’যে তার এক্স গার্লফ্রেন্ড শাঁকচুন্নিটা আর ওই হারামিটা যে তোর সাথে জবরদস্তি করতে চেয়েছে?”
“হুঁ।”
“ভালো শাস্তি দিয়েছে? না আমার কিছু করতে হবে?”
“না, আর কিছু করার নেই।”
“আর উনার কী খবর?”
“উনার?”
“বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে যে।”
মোহ হাসল, “সারাক্ষণ দুলুভাই করা মুখ আজ নামও নিচ্ছে না।”
“আমার খুব রাগ উঠছে উনার উপর। রাগ থেকে বেশি কষ্ট লাগছে। দেখ মৃণার ক্ষেত্রে তন্ময় আমার কোনোকালেই পছন্দ ছিলো না। তাই ওর সম্পর্ক ভাঙ্গায় আমি উল্টো খুশি হয়েছি। কিন্তু উনাকে আমার প্রথম দেখায় তোর জন্য পছন্দ হয়। উনাকে একদম আমার মতো লেগেছে। কোনো মানুষ আমাদের কীর্তিকলাপ দেখলে মুরাদ ভাইয়াকে না, উনাকে আমার ভাই মনে করবে।”
“এভাবে তো আগে ভাবি নি। পয়েন্ট তো আছে।”
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকায় মোহের দিকে, “তো এখন কী করবি?”
“জানি না। মস্তিষ্ক বলে তার থেকে দূরে থাকতে, নাহলে আবার কষ্ট পাবো। কিন্তু মন তো বেহায়ার মতো তার কাছে যেতে চায়। তুই বল।”
“আমাকে এমন সিচুয়েশনে আগে আনার চিন্তাভাবনা করবি না ভুলেও। দেখি ওদিকে চাপ।”
মহুয়া মোহকে ঠেলে তার পাশে শুয়ে পড়লো, “সে আজ স্বীকার করেছে তোকে ভালোবেসে ফেলেছে।”
মোহের নিশ্বাস আটকে গেল কথাটা শুনে। যদিও সে কথাটা জানে। তার মন জানে। কিন্তু শুনতে কত মধুর লাগলো। তার মনে হলো এর থেকে মধুর কথা আর কখনো সে শুনে নি।

“কী করা উচিত আমার?” মোহ প্রশ্ন করে।
“তোর জীবন, তোর ইচ্ছা। তবে হ্যাঁ মাফ করার চিন্তাভাবনা করলে এত সহজে করবি না। কতদিন ঘুরাবি। জাহানের বাচ্চাকে তো আমি সারাজীবনের জন্য বিবাহদণ্ড দিবো। তুই কতদিন ঘুরাতেই পারিস।”
“ইন-ডিরেক্টভাবে বলছিস মাফ করে দিতে?”
“তুই তাকে ছাড়া থাকতে পারবি না আমিও জানি। হুদাই আমার সঙ্গে নাটক করবি না।”
“আচ্ছা সব বুঝলাম কিন্তু সত্য জানার পর জাহান ভাইয়াকে শাস্তি দিবি কীসের?”
“দুই সাপ্তাহ আমাকে যে চিন্তা দিয়েছে তার শাস্তি বিশ বছরের কম তো হবে না।”
মোহ কোণি দিয়ে মারে তাকে, “তুই বহুত খারাপ।”
“তোর বেস্টফ্রেন্ড যে।”
মোহ হেসে দিলো।

এতক্ষণে দরজা খুলে এলো মৃণা আর মুরাদও।
“তোমরা এখানে?” মহুয়া জিজ্ঞেস করে। প্রশ্ন শেষ হবার আগেই মৃণা দৌড়ে এসে তাদের জড়িয়ে ধরে।
মুরাদ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে,”তোদের বান্ধবী কান্না করে আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এখানে আসার জন্য। তার চিন্তার শেষ নেই। তোরাই সামলা ওঁকে। আমি বাহিরে সমুদ্র ভাইয়ের সাথে বসছি।”
মোহ মৃণাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কাঁদছিস কেন?”
“তোর কী অনেক ব্যাথা করছে দোস্ত? খারাপ লাগছে?”
“আরে আমি এখন ঠিক আছি। এভাবে কাঁদে না-কি কেউ পাগল।”
মোহ মৃণাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয় তাকে। কিন্তু মহুয়া উল্টো রেগেমেগে বলে, “শালী ভাবির ঘরের ভাবি বাসা থেকে এসেছিস। কিছু খাবার তো আনবি। আমার পেটে যে গন্ডাররা শিং মা’রতেছে তার এখন কি করবো?”
মোহ আর মৃণা তার দিকে তাকায় প্রথমে। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।
.
.
পরদিন মোহকে বাসায় দিয়ে এসে প্রথমে মহুয়া যায় শায়ানের সাথে দেখা করতে। সে জানতো না সন্ধ্যায় ভার্সিটি খোলা থাকে। কিন্তু শায়ান তাকে এখানেই আসতে বলল।

সম্পূর্ণ নীরব ভার্সিটির মাঠে কেবল শব্দ আসছে বাস্কেটবল কোর্ট থেকে। স্পিকারে গান ছেড়ে বাস্কেটবল খেলছিল শায়ান। মহুয়া এসে তার স্পিকার বন্ধ করে দিলো। আর শায়ানও কারো উপস্থিতি টের পেল। পিছনে ফিরে মহুয়াকে দেখতেই তার ঠোঁটে হাসি এঁকে উঠলো। সে দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। নিশ্বাস দ্রুত, ঘেমে একাকার। তবুও একগাল হেসে বলল, “অনেকদিন পর দেখলাম তোমায়। ভেবেছিলাম কয়েকদিন আমার চেহেরাই দেখতে চাইবে না।”
“দেখতে এলাম। মানুষকে কষ্ট দিয়ে তুমি কত সুখে থাকতে পারো। কত বড় মিথ্যুক তুমি!”
কথাটা শুনেই শায়ানের হাসি মলিন হয়ে গেল। সে অবাক সুরে জিজ্ঞেস করল, “আমি তোমার সাথে কি মিথ্যা কথা বললাম?”
“তুমি বলেছিলে আমাকে ভালোবাসো রাইট? ”
“একথা তোমার মিথ্যা মনে হয়?” খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল সে।
“প্রথম যখন বলেছিলে তখন সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করলেও ভেবেছিলাম হতেই পারে পছন্দ করেছ। কিন্তু ভুল ছিলো, তুমি কেবল আমার সাথে খেলা খেলছিলে। পছন্দ করা মানুষকে মা’রার হুমকি কে দেয়?”
কথাটা শুনে শায়ান চুপ হয়ে গেল।

মহুয়া তাচ্ছিল্য হাসে, “তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না আমি জাহানের প্রেমে কেন পড়েছি? নিজেই দেখো, তুমি আমার ক্ষতির হুমকি দিচ্ছো আর ও আমাকে বাঁচাতে নিজের সুখও ত্যাগ করতে রাজি। তুমি বলো, আমার কাকে ভালোবাসা উচিত?”

আচমকা শায়ান তার হাত ধরে নেয়, “বিলিভ মি মহুয়া, রাজ ভাই যখন কথাটা বলছিল আমি সেখানে ছিলাম না। এরপর যখন আমাকে জানিয়েছিল তখন আমারও মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওটা কেবল হুমকি ছিলো। আমি থাকতে তোমাকে কেউ ছুঁতেও পারবে না।” সে হাত ছেড়ে বাহু ধরে নেয় মহুয়ার। অসহায় মুখ নিয়ে আকুতির সুরে বলে, “আমি কেবল তোমায় পেতে চেয়েছি। আর কিছু চাই নি তো। তুমি কেন আমার হতে পারবে না মহুয়া? আমি তোমার জন্য নিজেকে বদলে নিয়েছি। তোমাকে যেভাবে সুখে রাখার জন্য সব করছি। তুমি কেবল জাহানের বদলে আমায় ভালোবাসতে পারবে না? আমি জানি আমার অতীত ভুল, কিন্তু আমার অতীত ভুল ছিলো বলেই আমি এমন হয়েছি । ছোটবেলায় নিজের মা’কে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে দেখেছিলাম। যখন যুদ্ধ শব্দটাও জানতাম না তখন যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়েছে। আপন মানুষরাই সম্পত্তির আমার প্রাণ নিতে চেয়েছিল। মা যাবার পরে বাবা কখনো ফিরেও তাকায়নি। আপন মানুষ বলতে শুধু দুই চার জন ছিল আমার জীবনে। তোমাকে কখনো আপন করার ইচ্ছা ছিল না, সত্যি বলছি। তুমি শেষ মানুষ ছিল যাকে আমি ভালবাসতে চেয়েছিলাম। হয়তো এই কারণে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কেন, কীভাবে, কোথায় ভালোবেসেছি জানি না। অনেকবার অস্বীকার করেছি এই অনুভূতি। আমি আর পারছি না মহুয়া। জীবনে আমি অনেককিছু পাইনি। সারাজীবন অন্যকিছু না পেলেও আফসোস থাকবে না। আমার শুধু তোমাকে চাই। তোমার হাসি আমাকে এতটা প্রশান্তি দেয় যা আমি কখনো অনুভব করিনি। তোমার হাসি আমার কাছে আকাশঝরা বৃষ্টির পানির মতো। যা গা ছুঁলেই শরীর জুড়ে শান্তি বয়ে যায়। তুমি আমার সে শান্তি। প্লিজ আমাকে একবার ভালোবাসার চেষ্টা করে দেখো, প্লিজ।”
একটানা কথাগুলো বলে খুব আশার দৃষ্টি নিয়ে সে তাকালো মহুয়ার দিকে। উওরটা যেন হ্যাঁ তে আসে।

মহুয়াও তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। নিশব্দে।তারপর অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল, “তাহলে আমার হাসির প্রেমে পড়েছিলে? এখন কী আমার ঠোঁটে সে হাসি দেখতে পাও? আমি মুহূর্তে মুহূর্তে ম’রছি শায়ান। আমার কষ্ট আমি দেখাই না কিন্তু আমারও কষ্ট হয়। এর কারণ তুমি। আমি তোমাকে বলেছিলাম, নিজের ভালোবাসার যুদ্ধ করতে হয় আগে। যুদ্ধ না করে ত্যাগ করতে নেই। কিন্তু সেখানে হিসেবটা ভিন্ন ছিলো না? সেখানে রশ্মির ভালোবাসা ছিলো একপক্ষিক। আমি আর জাহান তো একে অপরকে ভালোবাসি। আর সে যুদ্ধটা হুমকি দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হয়। এমন কাজ করে আবার বলছো আমাকে ভালোবাসো? ভালোবাসলে কখনো আমার ক্ষতির চিন্তা মাথায় আনতে না। আগামীকাল আমি জাহানকে পাই বা হারাই, তোমার মতো জঘন্য মানুষের চেহেরাও আমি এ জনমে আর দেখতে চাই না।”
“মহুয়া!”
মহুয়া তার বুকে হাত রেখে জোরে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে দু’তিন কদম পিছিয়ে যায় শায়ান। মহুয়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সে অগ্নিবর্ষী ধারণ করলেও তার আগুন জ্বলা চোখেও জল ভেসে উঠে। সে উঁচু স্বরে জানিয়ে দেয়, “তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে হারালে কখনো, এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ক্ষমা করবো না। তোমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা, তোমার চেহেরাও দেখবো না। আই হেইট ইউ শায়ান শিকদার। আই হেইট ইউ।”
মহুয়া তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে সেখান থেকে চলে যায়। আর শায়ান তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এক দৃষ্টিতে। তার কানে কেবল এক কথা বাজতে থাকে, “তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে হারালে কখনো, এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ক্ষমা করবো না। তোমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা,চেহেরাও দেখবো না। আই হেইট ইউ শায়ান শিকদার। আই হেইট ইউ।”

তার বুকের ভেতর ব্যাথা হলো। তার হৃদপিণ্ড রক্তক্ষরণ হলো কী? এমন লাগছে কেন?

শায়ানের দৃষ্টি তখনও আটকানো মহুয়ার দিকে। সূর্যের আলো এসে পড়ছে তার উপর। কী অপূর্ব দেখাচ্ছে। যেন সূর্যের এক টুকরো সোনালী আলো তার অলংকার হয়ে গেছে।
.
.
মহুয়া ভার্সিটি থেকে সোজা এলো মোহের বাসায়৷ মহুয়া ও মৃণা এখানেই থাকবে। খাওয়াদাওয়া শেষে মৃণা ঘুমিয়ে পড়ল। মোহ ঘুমাল না কারণ ঘুমের ঔষধে সে গতকাল সারাদিনই ঘুমিয়েছে। আর মহুয়া বসে আছে। বারে বারে ফোন দেখছে নিজের। আর ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। আর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

মোহ জিজ্ঞেস করে, “এমন করছিস কেন? কী হয়েছে?”
“রাত সাড়ে বারোটা বাজে।”
“তো?”
“তো? যে আমার জামাই হবার কথা ছিলো তার বিয়ে হবে সন্ধ্যায়।”
“চিন্তা না করে কিছু কর।”
“সব করেছি। জিনি জাগছে সারারাত, জাহান এলেই বিয়ের কথা বলে দিবে। তিসানরা ওদের বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। সিকিউরিটি অনেক টাইট। তিসানকে পর্যন্ত ইনভাইট করে নাই জাহানের বাপ। আমার শশুড় আব্বা কত খাটাইস দেখেছিস? কিন্তু যে গুটি দিয়ে আমি খেলায় এগোব। সে গুটিই কল দিচ্ছে না।”
“হোয়াট? কী বলছিস?”
“পরে বলবো। আপাতত চিন্তায় আছি খুব।”
প্রায় বিশ মিনিট বাদেই কল এলো মহুয়ার ফোনে। সাথে সাথে সে উৎসুক হয়ে কলটা ধরল। এ তো খুবই বিরক্তিকর স্বরে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে কল দিয়েছো কেন? কী চাই?”
ওপাশ থেকে ভেসে এলো কিছু মুহূর্তে মৌনতা। তারপরে ভারী কন্ঠ এসে কানে বাজলো, “আগামীকাল আমি তোমাকে পার্টিতে নিয়ে যাব। কিন্তু ব্যাস এতটুকুই। এখানে তুমি কিভাবে কি করবে তুমি জানো। কিন্তু এর পরিবর্তে তুমি আমাকে আর তোমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য দোষারোপ করতে পারবে না।”
সাথে সাথে মহুয়া উৎসুক হয়ে চেঁচিয়ে উঠে, “ডিল…ডিল…ডিল.. এরপর নিজের কথা থেকে ফিরতে পারবে না।”
“আমার মনেই হচ্ছিল সন্ধ্যার কাহিনীটা একারণেই করেছ। মনে রেখো আমি নিয়ে গেলেও কোনো হেল্প করবো না। আমার এতও মহান সাজার শখ নেই।”
“মহুয়ার কারো হেল্প লাগবেও না। একবার ওইখানে ঢুকতে পারলেই শশুড়আব্বার মাথা ঘুরিয়ে দিবো।”
শায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “সন্ধ্যা সাতটায় রেডি হয়ে থেকো। তোমাকে তোমার বাসার সামনে থেকে পিক করে নিবো। তোমার জন্য কেবল এত বড় রিক্স নিচ্ছি। কথাটা যেন মনে থাকে।”

চলবে…