মেঘের খামে পর্ব-৬৩

0
5

মেঘের খামে…
পর্ব ৬৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

পাঁচ বছর পর,

মহুয়া কিছু বুঝতে পাড়ছে না। বিয়ের আগেরদিন তারা এয়ারপোর্টে কী করছে? সবাই তার দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে আজবই লাগছে তার। মহুয়া জাহানের শার্ট টানল।

জাহান কথা বলছিল পাইলটের সাথে। মহুয়ার ডাকায় তাকাল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“আমরা এখানে কী করছি? আর সবাই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেন?”
“এয়ারলাইনসের হবু মালকিন তুমি তাকাবেই তো।”
মহুয়া আড়চোখে তাকায় জাহানের দিকে। রাগান্বিত হয়ে। জাহান হাসলো। বলল, “তোমার শ্বশুর মশাই তাদের হুমকি দিয়েছেন, তোমার একটুও কষ্ট হলে তাদের জন্য ঝামেলা হয়ে যাবে। উনি নিজের ছেলে মেয়ের জন্যও একথা বলে নি। তাই তারা দেখছেন কে এত গুরুত্বপূর্ণ এসেছেন।”
মহুয়া ভাব নিয়ে তার চুলগুলো পিছনে ঝটকায়, “তা তো আছেই। আমার মতো গুরুত্বপূর্ণ আর কে হবে?”
“চলুন ম্যাডাম আপনাকে এক অপরূপ দৃশ্য দেখাই, আসুন।”
“কোথায় যাচ্ছি?”
“তা জানতে পারবে। আগে চেঞ্জ করে আসো।”
“কেন?”
“এত প্রশ্ন করো কেন তুমি?”
“একশোবার করবো। তুমি আমাকে প্রশ্ন করার সাহস করো করো কীভাবে?”

জাহান তার ঝারি শুনে তাকে ধরে একপাশে নিয়ে আসে। বলে, “জান এখানে তো আমার ইজ্জতের ফালুদা করো না। তিনবছর হলো এখানে ফুল টাইম জয়েন করেছি। সবাই অনেক সম্মান করে। ভয়ও পায়। কাজের জায়গায় একটা ভাব রাখা লাগে না’কি?”
“আচ্ছা যাই হোক, কোথায় যাব চেঞ্জ করতে?”
মহুয়াকে এক মহিলার সাথে পাঠাল জাহান। মহুয়াকে তৈরী করার কথায় তাকে সাধারণ পোশাকই পরাল। তাকে নিয়ে এলো বাহিরে। হেলিকপ্টারে উঠলো তারা। মহুয়া তখনও জিজ্ঞেস করে, “বিয়ের আগে কি ভাগিয়ে অন্যকোথাও নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? একাজ তো পাঁচ ছয় বছর আগে করা উচিত ছিলো।”

হেলিকপ্টার আকাশে উড়ার সাথে সাথে মহুয়ার প্রশ্নের ঝুলি খুলল। তবে তার কোনো প্রশ্নের উওর এলো না। এতে সে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল বাহিরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের একসাথে বাঁধা হলো। কাঁধে, পেটে কতগুলো কালো বেল্ট লাগানো হলো সেইফটির জন্য। জাহানেরও তাই। তার কাঁধে ব্যাগের মতো কিছু। মহুয়া সবটা বুঝল ঠিকই। সে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমরা কী স্কাইডাইভিং করছি?”
জাহান তার পিছনে যেয়ে দাঁড়ানো। তার বুকের সাথে মহুয়ার পিঠ ঠেকানো। সে ঝুঁকে মহুয়ার কানে বলে, “উঁহু, তোমার স্বপ্ন পূরণ করছি।”
মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। কথার অর্থটা সে বুঝতে পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যে হেলিকপ্টারের দরজা খুলে দেওয়া হয়।

আকাশের মাঝে ভাসতে যাওয়ার এক মুহূর্ত আগের কথা, হেলিকপ্টারের কিনারায় দাঁড়িয়ে জাহান একহাতে দরজা ধরে রেখেছে, তার অন্যহাত মহুয়ার পেটের উপর। সে মহুয়াকে মৃদুস্বরে বলে, “মেঘে ভাসতে তৈরি তো জান? মেঘের কোলে পাখির মতো উড়ে বেড়িয়ে দেখো নাহয় আজ।”
সে হেলিকপ্টারে ধরা তার হাতটা ছেড়ে দেয়৷ সাথে সাথে মহুয়া চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠে। একনাগাড়ে নিচের দিকে দ্রুত পড়ে যাচ্ছিল তারা। মানসিকভাবে সে প্রস্তুত ছিলো না মোটেও।

জাহান ব্যাগে থাকা এক রশি টান দিতেই প্যারাস্যুট খুলে যায়।
মহুয়া অনুভব হয় সে নিচে পড়ে নি। হাওয়ায় ভাসছে। সে চোখ খুলে, দেখে এই বিশাল আসমানের সমুদ্রের সাদা মেঘের কোলে তারা ভেসে বেড়াচ্ছে। পাখির মতো। হাত বাড়ালেই কটনক্যান্ডির ন্যায় মেঘগুলো হাতে গুলিয়ে যাচ্ছে। ভেতর থেকে অদ্ভুত এক অনুভব হলো। স্বপ্নপূরণের অনুভূতি বুঝি এমনই সুখময় হয়?
তবুও নিচে তাকাতে ভয় হয় তার। এতবছরে ভয়ডর খুব কমই লেগেছে তার। কিন্তু হঠাৎ জমিন থেকে উঠে আসমানে ভাসতে একটু অদ্ভুত তো লাগে। তখনই তার অনুভব হলো জাহান আরও শক্ত করে তাকে ধরে রেখেছে। সে জানে যাই হয়ে যাক না কেন, জাহান তাকে একটু আঁচও আসতে দিবে না। সেইফটির জন্য অনেক প্রস্তুতি নিয়ে পাঠানো হয়েছে তাদেরকে। অথচ এই মানুষটা ছোঁয়াই তার সবচেয়ে বড় আশ্বাস।

সে নিচে তাকাল। এই সবুজ শ্যামলী দেশটাকে আকাশ থেকে খুব ছোট দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত এই সৌন্দর্য চোখে গেঁথে গেল তার। তার ইচ্ছে হলো প্রতিবছর এই দৃশ্য দেখবে। সে আবার আকাশের সমুদ্রে মেঘের খেলাগুলো দেখতে ব্যস্ত হলো। ছোট থেকে সে মোহ ও মৃণার সাথে এই আকাশের মেঘের খেলা দেখতো আজ সে মেঘকে ছুঁয়ে দেখছে। অথচ বুঝতে পারছে না। তাকে কী সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করছে? তার দেশের এই সৌন্দর্য, আকাশে স্নিগ্ধ মেঘের খেলা, না’কি তার প্রিয় মানুষটার সঙ্গ।

মহুয়া ও জাহান নেমেছিল নিচে। জাহানের কেবিনে বসেছিল তারা। মহুয়া আজকের স্কাইডাইভিং সম্পর্কে কথা বলছিল এবং জাহান তার কথা শুনছিল এবং কম্পিউটারে কাজ করছিল কিছু। মহুয়া বিরক্ত হয়ে বলে, “আমি তোমার সাথে কথা বলছি আর তুমি কী করছ? কম্পিউটার বন্ধ করে আমার কথা শুনো।”
মহুয়া নিজে তার কম্পিউটার বন্ধ করতে আসলে জাহান তার হাত ধরে নিজের কোলে বসায়। তার কোমরে তার শক্তপোক্ত হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, “রবিবার আমরা হানিমুনে যাচ্ছি। ওখানে কোনো কাজের কথা চাই না। ফোন থাকবে সুইচ অফফ। তাই কাজ সেরে রাখছি। তোমাকে আদর করার সময় ডিস্টার্বেন্স চাই না বেবি।”
মহুয়ার কান লাল হয়ে গেল। সে প্রথমে তার কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিলেও পরক্ষণে তার জংলী রূপে এসে পড়ে। হাত খামচে দেয় জাহানের। কিন্তু জাহান তাকে আরও কাছে টেনে নেয় নিজের। তার কাঁধে মুখ ডুবায়। আর তার ফোন বেজে উঠে। জাহান এতে বিরক্ত হয় যদিও। কিন্তু ছাড়তে তো হয় মহুয়াকে।

সোফায় ব্যাগ ছিলো মহুয়ার। সে দৌড়ে যেয়ে ফোন বের করে। দেখে মোহের কল। কল ধরে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে সে, “বেবস জানিস কি হয়েছে?”
“ভাইয়া তোকে স্কাইডাইভিং এ নিয়ে গেছে। আমি জানি৷ আমার সাথে কথা হয়েছে৷ কিন্তু তুই কি জানিস এওয়ার্ড ফাংশন শুরু হয়ে গেছে। জলদি টিভি অন কর, নাহলে যদি মৃণা এওয়ার্ড পায় আর তুই ভুলেও মিস করিস অকারণে জাহান ভাইয়ার ক্লাস লাগাবি।”
“বলিস কী শুরু হয়ে গেছে না’কি। জলদি ছাড়ছি।”
“দোয়া কর যেন মৃণাই এওয়ার্ড পায়। এই প্রথম এওয়ার্ড শো। গতবছর শেষের দিকে গান যেহেতু বের হয়েছে পাওয়ার তো কথা তাই না?”
“পাবে না আবার? সবজায়গায় আমাদের মৃণার গান চলে। জানিস একটা এয়ারহোস্টেসের সাথে দেখা হয়েছিল ওর স্পটেফাইতেও মৃণার গান চলছে। তুই চিন্তা করছিস কেন? আরও কতগুলো এওয়ার্ডও তো পেয়েছে ‘প্রেমের কথন’ গানের জন্য।”
“এটা তো দেশের সবচেয়ে বড় এওয়ার্ড। অনেকে পাঁচ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থেকেও পায় না।”
“আমাদের মৃণা পাবে দেখে নিস।”
“আচ্ছা তুই টিভি অন কর। আমিও দেখছি সমুদ্রের সাথে। তুই দেখেই বের হয়ে যাবি। দরকার হয়ে গাড়ি করে দেখতে দেখতে আয়। রাতে তোর হলুদ আছে। রিমেম্বার?”
“মনে আছে মা। চিন্তা করিস না।”
ফোন রাখার পর টিভি ছাড়লো মহুয়া।

এওয়ার্ড শো শুরু হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ নাচ গান হলো। টিভিতে সে একঝলক দেখতে পেল মৃণাকে। নীল রঙের এক গাউন পরা সে। গাউনে গাঢ় হাল্কা নীল রঙের কাজ। তারও পারফর্মেন্স হবে। গান গাইবার আগে তার রুমে আসে সে। রুমে এসে চুল ঠিক করছিল। তখনই নক পড়ে। তার ম্যানেজার জানায়, তন্ময় এসেছে।

তন্ময় একগুচ্ছ লাল গোলাপের বুক-এ নিয়ে ঢুকে রুমে। মৃণা তাকে দেয়ে উঠে দাঁড়ায়, “কোনো কাজ ছিলো?”
“কাজ না, কথা ছিলো। তোমার ফেভারিট লাল গোলাপ নিয়ে এসেছি।”
গোলাপের গুচ্ছটা এগিয়ে দেয় তন্ময়। মৃণা তা হাতে নেয় কিন্তু বলে, “লাল গোলাপ কখনোই আমার পছন্দ ছিলো না।”
“কিন্তু আগে দেওয়ার সময় তো তুমি অনেক খুশি হতে।”
“হতাম, তা ঠিক। তখন হয়তো তোমার খুশিটাই সর্বোপরি ছিলো তাই। কিন্তু এখন… ”
“এখন? এখন তুমি রেগে আছো তা ঠিক মৃণা। কিন্তু মনের এক সুপ্ত কোণায় আমার নামই লেখা। তুমি আমার উপর অভিমান করে আছো বুশরার জন্য তাই না?” তন্ময় মৃণার হাতটা ধরতে নিলে সে হাত পিছিয়ে নেয়। তন্ময় তাকায় তার হাতের দিকে। নিজের হাতটা পিছিয়ে নেয়, “অভিমান করে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলে। আর কয়বছর কাটাবে?”
“তোমার উপর আমার কোনো অভিমান নেই। উল্টো কৃতজ্ঞতা আছে।”

তন্ময়কে এই কথায় বেশিই অবাক দেখা যায়। সে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় মৃণার দিকে। মৃণা মৃদু হাসে, “তুমি না ছাড়লে জীবনের এই পাওয়াগুলো আর পেতাম না। এক মরিচীকার পিছনে দৌড়াতাম। এই মুহূর্তে আমার কাছে যা আছে এবং যে আছে সবকিছু আমি ভাগ্য করে পেয়েছি।”
“তোমার কী আমাকে একটুও মনে পড়ে না? তোমাকে ছাড়া তো আমার সব শূন্য মনে হয়। আমি তোমাকে আজও ভালোবাসি মৃণা।”
মৃণা মৃদু হাসে, “কারণ যে সত্যি তোমার সাথে থাকে তাকে তুমি অবহেলা করো। আমাকেও করেছিলে। আর তুমি আমাকে ভালোবাসো না, আমি কেবল তোমার একাকিত্বতা দূর করার খেলনা ছিলাম। কিন্তু আমি এমন কাওকে পেয়ে গেছি যার জন্য আমি কোনো খেলনা নই। যে আমাকে কষ্ট দিতে জানে না, উলটো আমার কারণে কষ্ট পেলেও আমার দিকে এভাবে তাকায় যেন তার পৃথিবী জুড়ে আমি এক নারীই আছি। তুমি আমাকে কখনো এক চিলতে পরিমাণ সুন্দর অনুভব করাও নি তন্ময়, কিন্তু তার দৃষ্টিতে আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী। এমন পুরুষকে ছেড়ে আমি তোমাকে কীভাবে আর ভালোবাসি বলো?”
তন্ময় প্রথমে স্তব্ধ রইল। তারপর অস্থির ভঙ্গিতে বলল, “তুমি কী ওই মুরাদের কথা বলছ?” সে মৃণার বাহু ধরে বলে, “সে তোমার সাথে নাটক করছে মৃণা। তোমার এমন খ্যাতি দেখে লোভে পরে গেছে সে।”
“কী বললে?” মৃণা রেগে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, “খবরদার আমার হাসবেন্ডের ব্যাপারে একটা খারাপ শব্দও আমি সহ্য করবো না। আমার হাসবেন্ড কেমন তা তোমার থেকে শুনতে হবে না আমার। আমার নাম, খ্যাতি, আমার বেঁচে থাকার কারণটাও একমাত্র উনি। যেদিন তুমি বুশরা আপুর সাথে ব্যস্ত ছিলে। আমার ফোন ধরারও সময় ছিলো না, সেদিন উনি কোটি টাকার প্রজেক্ট ছেড়ে আমার কাছে এসেছিলেন। যেখানে তুমি কখনো আমার স্বপ্নের কথা মনেও রাখো নি উনি আমাকে সে স্বপ্ন পূরণের জন্য এগিয়ে দিয়েছেন। আমি ভয় পেতাম তবুও আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। আমি কেবল গান গেয়েছি, কিন্তু আমি আজ যেই পর্যায়ে আছি সব কৃতিত্ব উনার। উনার নামে একটা কথাও আমি শুনবো না। ভেবেছিলাম পুরনো সব ভুলে তোমার সাথে নতুন সম্পর্ক শুরু করব। বন্ধুত্ব না হোক, কলিগ হয়ে থাকবো। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলাটাই বৃথা।”

মৃণা তার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে তন্ময় বলে, “হাসবেন্ড মানে? তুমি মিথ্যে বলছো তাই না? তুমি কবে বিয়ে করলে? তুমি বিয়ে করলে এতদিনে নিউজে এসে পরতো।”
“পাঁচ বছর আগে। উনি এই অনাথ মেয়েটাকে সম্মানের সাথে নিজের বাড়িতে উঠিয়েছে। কেউ যেন আমার নামে একটা ভুল কথাও না বলতে পারে একারণে। কিন্তু আমি নিজের উপরই এতটা লজ্জিত ছিলাম যে কখনো সে সম্পর্কের মান রাখিনি। উনিও বলেছিলেন, যতদিন উনাকে ভালো না বাসি ততদিন এই সম্পর্ক লুকানো থাকবে। আর অন্যকাওকে ভালোবাসলে সে মুহূর্তে মুক্ত করে দিবেন।”
তন্ময় তাকায় তার দিকে। বিষাদী নজরে, “আর তুমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছ?”
মৃণা একপলক তাকায় তার দিকে। তারপর বেরিয়ে যায়।

সে এসে দাঁড়ায় স্টেজে কতগুলো তারকাদের মাঝে। বিশাল এক রুম। তাদের পিছনে টিকিট কিনে বসার জায়গা আছে। এর পরে আরও মানুষ দাঁড়ানো। গিজগিজ অবস্থা। এতগুলো মানুষ দেখে মৃণার হৃদস্পন্দন বেড়ে উঠে ভয়ে। পিছনে থেকে তার নামের শব্দ গুঁজে উঠে। শত কন্ঠ শুনেও তার হৃদয় শান্ত হয় না। উল্টো আরও বেশি এলোমেলো হয়ে যায়। দুইবছর হলো সে গানের জগতে এসেছে। একবছর হলো তার এলবাম বের হয়েছে। এক এলবামেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে সে। ক্যামেরার সামনে হাজারোবার গেয়েছে সে কিন্তু এতগুলো মানুষের সামনে না।

সে হাজারো মানুষের মধ্যে তার চোখ খুঁজে একটি পুরুষের। যে তার এই অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে জানে। পেয়েও যায়। সে স্বভাবতই হাসিটা তার ঠোঁটের কোণে। যে হাসির কারণে তার চোখটা ছোট হয়ে আসে। আর সে চোখদুটো চুম্বকের ন্যায় আটকে আছে তার দিকে। সে চোখদুটো তার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। তার সুরেরা তার আশেপাশে যেন প্রজাপতির মতো ঘুরতে লাগলো। তার দৃষ্টি নড়ে না। সে মাইক ধরেই গুনগুন করে গান শুরু করে,

তোমার চোখে দেখি আকাশের আলো,
তোমার হাসিতে বাজে জীবনের ভালো।
কথা না বলেও তুমি বলো কত গান,
প্রেমের কথনে ভরে যায় প্রাণ।

প্রেমের কথন— স্বপ্নের বুনন,
হৃদয় ছুঁয়ে যায় প্রতিটি ক্ষণ।
তুমি আমি মিলে লিখি কাব্যগান,
প্রেমের কথনেই বেঁচে রয় প্রাণ…

গান শেষে মৃণা এসে বসে তারকাদের মাঝে। তবে বারবার ঘাড় করে পিছনে তাকায় মুরাদের দিকে। এমন সময় এনাউন্সমেন্ট করা হয় ‘song of the year’ এর জন্য। নমিনেশন দেখানোর পর এনাউন্সমেন্ট করা হয় মৃণার নাম। আশেপাশের সকলে তাকে শুভেচ্ছা জানায়। সে উঠে যায় স্টেজে। এওয়ার্ড নেয়, বক্তব্য দেওয়ার জন্য মাইকের সামনে আসে। তাকায় ক্যামেরার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি, সে বলে, “আমি কখনো ভাবি নি, এতগুলো মানুষের ভালোবাসা আমার কপালে আছে। আমি ভাবতাম এই পৃথিবীতে কেবল দুইটা মানুষ আমাকে ভালবাসতে পারে, আমার প্রাণের থেকেও প্রিয় দুই বান্ধবী। আমার মহুয়া আর মোহ। কিন্তু আপনারা আমাকে ভালোবেসেছেন। এত ভালোবাসার যোগ্য আমি রাখি, একথা একটা মানুষ আমাকে বলেছিল।” সে তাকায় ভিড়ে বসা মুরাদের দিকে। তার চোখজোড়া সিক্ত হয়ে যায়, “যে আমার থেকে বেশি আমাকে ভরসা করেছে, আমাকে ভালোবেসেছে।”

মুরাদ তালি দিচ্ছিল হাত তুলে। তার ঠোঁটের কোণে খুশির বাহার। কিন্তু সে মৃণা শেষ কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ মৃণা তার কথা তুলছে কেন? আজ সকালেরই কথা, সে মৃণাকে বলেছিল, “তুই চাইলে আমরা ডিভোর্স নিতে পারি। আমি তোকে জোর করে এই সম্পর্কে বেঁধেছিলাম। যা তোর জন্য উচিত হয়নি। তুই তখন নিজেকে রক্ষা করতে জানতি না, এখন নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা তোর আছে। তুই চাইলে এই সম্পর্ক আমি এখানেই শেষ করে দিব। আমাকে কেবল সারাজীবনের জন্য তোর জীবনের অংশ রাখতে হবে। টুকটাক দেখা করিস, তাতেই হবে।”
মৃণা তার দিকে তাকিয়ে রইলো কথাটা শুনে কিছুক্ষণ। তারপর ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে এলো।
সেই মুহূর্তে মুরাদের বুকের ভিতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। সে ভেবেছিল আজ আসবে না। কিন্তু তার মৃণার এতবড় উপলব্ধি সেখানে না থাকলে চলে?

মৃণা আবারও বলে, “মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিল আমার। তারপর থেকে ভালোবাসা পাই নি তেমন। ভেবেছিলাম আমার এই ভাগ্যে ভালোবাসা আর জুটবে না। তারপর আপনি আমার জীবনে এলেন মুরাদভাই। ভালোবাসার অর্থটাই বদলে দিলেন। সারাজীবনের জমানো ভালোবাসার অভাবটা আপনার দ্বারাই শোধ হয়ে গেল। আপনাকে পাওয়ার বিনিময়ে সব হারানোর আফসোসটা আমার আজ নেই। আপনি কেবল আমার স্বামী না, আমার শক্তি। যে আমাকে শক্ত করেছে। আপনাকে কখনো বলা হয় নি। কিন্তু আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি মুরাদভাই। আপনাকে টুকটাক দেখলে আমার আর হবে না। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত আপনাকে না দেখলে আমার মন ভরবে না। এই এওয়ার্ডটার আসল হকদার আপনি। কেবল আপনি। থ্যাঙ্কিউ।”
মৃণা স্টেজ থেকে নেমে নিজের নামের সিটে যেয়ে বসে না। তা পেরিয়ে যায় পিছনের দিকে। মুরাদের কাছে।

“মুরাদভাই আপনি শুনেছেন?” মৃণা অত্যন্ত আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকায় মুরাদের দিকে। তবে মুরাদের মুখখানা গম্ভীর। খানিকটা বিরক্তিকরও। সে শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করে, “তুই কী পাগল?”
প্রশ্নটা শুনে মুখ মলিন হয়ে গেল মৃণার।
সে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় মুরাদের দিকে।
“জামাইকে ভাই ডাকতে তোর বিন্দুমাত্র লজ্জা করে না ময়না?”
মৃণা হেসে ফেলে। মুরাদের হাতে এওয়ার্ড দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। সাথে সাথে চারদিকে তালির বর্ষণ হয়।

স্ক্রিনের ওপাশ থেকে লাফিয়ে উঠে মোহও। সে জোরে তালি দিয়ে তাকায় পাশে বসা সমুদ্রের দিকে। সে ল্যাপটপে কাজ করছিল। টিভির সামনে বসে। তা দেখে মোহ মুখ ফুলিয়ে নেয়। সে ল্যাপটপ সমুদ্রের কোল থেকে নিয়ে বলে, “কী করছেন আপনি? কত বড় মোমেন্ট মিস করে ফেললেন জানেন?”
সমুদ্র তাকাল তার দিকে। চোখের চশমাটা পাশে রেখে এক হাত দিয়ে মোহকে কাছে টেনে নিলো। বলল, “মৃণা যে মুরাদের কাছে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করলো তা স্পষ্ট শুনেছি মধু। একটা ই-মেইলের রিপ্লাই করছিলাম শুধু।”
মোহ ঠোঁট উল্টে তাকাল। কান্না কান্না ভাব। কিন্তু সমুদ্র কি করল বুঝল না। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে মধু? এমন করছ কেন?”
“জানি না। কি কিউট লাগছে মুরাদ ভাইয়া আর মৃণাকে। দেখেছেন?”
সমুদ্র হেসে তাকে বুকে ভরে নেয়, “তুমিও না ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”
হঠাৎ কেঁদে উঠে মোহ। শব্দ করে। বাচ্চাদের মতো।
সমুদ্র আবারও তার দিকে তাকায় চিন্তিত ভঙ্গিতে, “কী হলো? কাঁদছো কেন?”
“জানি না।”
“কাঁদছো কেন জানো না?”
“না। ফুসকা খাবো।”
“ফুসকা খাবে? এই সময়? যেয়ে তৈরি হও মহুয়ার হলুদে যেতে হবে তো।”
“না না আমি এখনই খাব।” মোহ তাকে ছেড়ে উঠে বসে। আবারও কান্না করে বলে, “আপনি আমাকে আর ভালোবাসেন না।”
সমুদ্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, “তুমি তো কখনো এমন জেদ করো না। তোমার হলো কী? আচ্ছা এক কাজ করো, তুমি তৈরি হয়ে নেও আমরা যাবার সময় সবার জন্য ফুচকা নিয়ে যাব। ওখানে সবাই মিলে একসাথে খাব।”
মোহের মুড মুহূর্তে বদলে যায়, “সত্যি?” তার চোখজোড়া চকচক করে উঠে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি এক্ষুণি তৈরি হয়ে আসি। ওখানে যেয়ে তো দেখতেও হবে। সব সাজানো হয়েছে না’কি?”
.
.
মোহ মহুয়ার বাড়িতে এসে দেখে মহুয়া আসলেও মৃণারা এখনো এসে পৌঁছায় নি। মোহ জিজ্ঞেস করে জানতে পারে মহুয়া তার রুমে। তার ফুফুকে দাওয়াত না দিলেও আঁখি ও শ্রাবণী এসেছে।

রুমে মহুয়া শ্রাবণীর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো। খেলছিল তাকে নিয়ে। আদর করছিলো। চুমু খাচ্ছিল। তার পাশে বসা ছিলো আঁখি। সে এখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে। বড় হয়েছে আগের থেকে অনেক।
মহুয়া আঁখিকে বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলে, “কি কিউট বাবুটা তাই না। আরে আমার কিউটু মিউটু।”
আঁখি তাকে দেখে বলে, “তোমার মতো কিউট হবে আপু। একদম খালামণির মতো।”

শ্রাবণী ফিটার বানাচ্ছিল। তার কথা শুনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে, “দেখতে একটুও ওর মতো হবে না। আসল খালা না’কি? তবে ভাগ্যটা যেন আমাদের মহুর মতো হোক। সাত কপাল নিয়ে এসেছে। কীভাবে এই সাধারণ মুখশ্রী নিয়েও সব ধনী ছেলেরা ওর জন্য ঝগড়া করে বুঝি না।”
কথার ধরণটা খোঁচা মারা হলেও মহুয়া তা বাদ দেয়। আজ অন্তত সে ঝগড়া করতে চায় না। কিন্তু আঁখি মহুয়াকে মন খারাপ করতে দিতে চায় না। তাই বলে, “আপু তোমার বিয়ে তো হচ্ছে। জলদি করে আমাকে খালামণি বানিয়ে দিও। বাবুটা একদম যেন তোমার মতো কিউট হয়।”
“বলছিস তোর দুলাভাই কিউট না?”
“কি বলো আপু। দুলাভাই তো একবারে নায়ক। তোমাদের টুইন হোক। একটা বাবু দেখতে হবে তোমার মতো, আরেকটা দুলাভাইয়ের মতো।”

শ্রাবণী তাদের দিকে তাকিয়ে বিছানার দিকে আসতে আসতে বলল, “টুইন কীভাবে হবে? এক্সিডেন্টে ওর যে জরায়ুতে ক্ষতি হয়েছে এরপর তো ওর মা হবার সম্ভাবনাই কম। একটা হবে না’কি দেখ।”
কথাটা শুনে মহুয়া চকিতে তাকাল তার দিকে। তার কপালে শঙ্কার দাগ, “আপু কী বললে তুমি? আমার এক্সিডেন্টে পা’য়ে সমস্যা হয়েছিল কেবল যা চার মাসে ঠিক হয়ে গেছে। বাচ্চা হবে না বলতে কী বুঝাচ্ছো তুমি?”

চলবে…