মেঘের খামে…
শেষ পর্ব
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কথাটা শুনে মহুয়া চকিতে তাকাল তার দিকে। তার কপালে শঙ্কার দাগ, “আপু কী বললে তুমি? আমার এক্সিডেন্টে পা’য়ে সমস্যা হয়েছিল কেবল যা চার মাসে ঠিক হয়ে গেছে। বাচ্চা হবে না বলতে কী বুঝাচ্ছো তুমি?”
মোহ তাদের রুমে এসেছিল সবেমাত্র। কথাটা দরজাতে শুনতেই সে থেমে গেল। সে প্রথমে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। এক ঢোক গিলল। তারপর তার ভীষণ রাগ উঠে শ্রাবণীর উপর। সে দ্রুত রুমের ভেতর ঢুকে বলে, “শ্রাবণী আপু আপনি এসব কী বলছেন? আপনাকে এমন অপয়া কথা বলার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।”
“যা সত্যি তাই বলছি। মামীর থেকে তো তাই শুনলাম। কেন তোমরা কী জানো না?”
“আপনি বের হন এখান থেকে। এখনই।”
শ্রাবণী কপাল কুঁচকায়, “তুমি কে আমাকে বের করার? এটা আমার মামার বাড়ি। এখানে কেউ তোমার কিছু হয় না কিন্তু আমার আত্নীয় হয়।”
মহুয়া এতক্ষণ চুপ ছিলো। এই কথা শুনে সে শান্ত কিন্তু শীতল দৃষ্টিতে তাকাল শ্রাবণীর দিকে। বাচ্চাকে আঁখির কোলে দিয়ে নামল বিছানা থেকে। শ্রাবণীকে জানাল, “তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক হতে পাড়ে কিন্তু মোহের সাথে আত্নার সম্পর্কে আছে। আমার বিয়ে উপলক্ষে এসেছ না? আমি তোমাকে আমার বিয়েতে চাই না। গেইট আউট।”
“তুই….”
মহুয়া তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, “আঁখি উনাকে নিয়ে যা এখান থেকে।”
“জ্বি আপু।”
আঁখি শ্রাবণীকে এক প্রকার জোর করে সেখান থেকে নিয়ে যায়। তাদের যাবার পর মহুয়া তাকায় মোহের দিকে। সে কপাল কুঁচকায়, “তুই হঠাৎ রেগে যাওয়ার মানুষ না। শ্রাবণী আপু যা বলেছে তা কী সত্যি?”
মোহ একমুহূর্তের জন্য চমকানো দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়, ” হতে যাবে কেন? এমন কিছু হলে তো তুই জানতিই। এখন এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে তৈরি হয়ে নে। এখনো তুই তৈরি হওয়া শুরু করিস নি কেন?”
“তুই চোখ লুকাচ্ছিস। তুই মিথ্যা বলছিস।”
মোহ তাকায় তার দিকে, “কী আজেবাজে কথা! তুই যেয়ে জামা পালটে আয় তো। আমি সাজিয়ে দিচ্ছি।”
মোহ তার আলমিরা থেকে জামা নিতে গেলে মহুয়া তার হাত ধরে বলে, “মোহ তুই মিথ্যা বলতে পারিস না। চোখ সরিয়ে নিস। সত্যি বল, শ্রাবণী আপু কী সত্যি বলেছে?”
মোহ তার প্রশ্নের জবাবে চোখ নামিয়ে নেয়। উওরটা পেয়ে যায় সে।
তার বুকের ভেতরটা বিষাদে ভরে যায়। তার চোখ ফেটে বেরিয়ে এলো রাজ্যের বিস্ময়। যেন তার সাথে বড় এক বেইমানী হয়েছে। হয়েছেই তো। তার জীবনের এতবড় কথা, সবাই জানতো। কেবল সে ছাড়া? তার চোখে পানি এসে পড়ে, “পাঁচ বছর। পাঁচটা বছর কেটে গেল শুধু তোরা কেউ আমাকে এই কথাটা বলার প্রয়োজন বোধ করলি না?”
“মহু…আই ক্যান এক্সপ্লেইন। আমার কথাটা শুন।”
“আমাকে একা থাকতে দে। যা এখান থেকে।”
“মহু তুই বুঝার চেষ্টা কর…”
মহুয়া তার কোন কথা শুনেনা। তার হাত ধরে তাকে বের করে দেয় রুম থেকে। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। তবে মোহ দরজার বারি দিতে থাকে একের পর এক। সে বলে, “মহু এখানে কারো কিছু করার ছিলো না। সবটাও তো আল্লাহর ইচ্ছা।”
মহুয়া দরজায় হেলান দিলো। তার বুকে এতটা ব্যাথা হচ্ছে কেন? হঠাৎ তার মনে হচ্ছে এক শূন্যতা এসে ভর করেছে তাকে। তার বুকের ভেতরে অনেক বড় এক পাথর এসে জমেছে। সে ভেজা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “জাহান জানে?”
মোহ দরজা থাপড়ানো বন্ধ করে । আড়ষ্টভাবে বলে, “জানে। শুরু থেকেই জানে।”
আচমকা চিৎকার করে উঠে মহুয়া, “তাহলে কেন বিয়ে করছে ও? ওর তো একটাই স্বপ্ন ছিলো। একটা সুখী পরিবারের।”
“আর ভাইয়া তোর সাথে সে সুখী পরিবার চায় মহু।”
“চুপ কর। একা থাকতে দে আমাকে। আমি কারো চেহেরা দেখতে চাই না।”
“আজ তোর হলুদ। নিচে মেহমানরা আসছে।”
“তাদের চলে যেতে বল। কোনো বিয়ে হবে না।”
“পাগলামি করিস না। দরজা খোল বলছি।” মোহ আবারও দরজায় ধাক্কায়।
মহুয়া বসে পড়ে নিচে। সে নিজেই বুঝতে পারছে না, টুপ টুপ করে তার চোখ দিয়ে এত জল গড়িয়ে পরছে কেন? তার বুক এতটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কেন? তার সহ্য হলো না। সে কখনো মা হবার কথা ভাবে নি। এই ব্যাপার নিয়ে এতটা উৎসুক হয় নি। অথচ আজ যখন সে জানতে পাড়ছে সে মা হবে না তখন মনে হলো কিছু হারিয়ে গেছে। যা ছিলো না কখনো, তা আবার হারায় কীভাবে? কিন্তু সহ্য হলো না তার। সে আর্তনাদ করে উঠলো।
.
.
জিনি আজ এসেছে প্যারিস থেকে। আজকাল সে প্যারিসে ফ্যাশন ডিজাইনিং পরছে। আজই ফ্লাইট পেয়েছিল সে। আসতে বড্ড দেরি করে ফেলল। বাড়িতে হলুদের জমজমাট অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। হয়তো তৈরি হওয়ার সময়ও পাবে না সে।
“এক্সকিউজ মি, আপনি কাওকে খুঁজছেন?” পরিচিত এক কন্ঠে জিনির বুকের ভেতরটা থড়বড় করে কেঁপে উঠে। অবশ্যই পাঁচ বছর পরও সে এই কন্ঠটা স্পষ্ট শুনতে পায়। তার প্রথম ভালোবাসা বলে কথা। সে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায় তিসানকে। কাঁচা হলদে রঙের পাঞ্জাবি পরা। হাতা বটানো। আগের মতো গড়নে পাতলা নেই সে। সুঠাম দেহের পুরুষ এখন। তাকে দেখেই শরীরে শিরশির অনুভূতি হলো। এই পাঁচ বছরে দু’টো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল সে। কিছুমাসের জন্য। তাদের স্পর্শও জিনির হৃদপিণ্ডটা কাঁপাতে পারে নি অথচ এই লোকটার একপলক দর্শনই তাকে কাবু করে নিলো। কিশোরকালের ভালোবাসার ছাপটা কী এতোই গভীর হয়?
“আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে? ভেতরে আসুন। জাহানের হলুদের আয়োজনে এসেছেন?” তিসানের প্রশ্ন শুনে জিনি হাসল তাচ্ছিল্যভাবে। নিজের চোখে পরা সানগ্লাসটা খুলল। হাসলো মৃদুভাবে, “এ কয়বছরে ভুলে গেলেন তিসান ভাইয়া।”
তিসান থমকে গেল। জিনিকে চিনতে পেরে নয়, তার চোখদুটোয় চোখ পরে। আগেও তো জিনিকে কত দেখেছিল। ছোট থেকে দেখে এসেছে অথচ আজ তার ভেতরটায় কেমন লাগলো। জিনিকে আজ অন্যরকম লাগছে, সেদিনের দেখা বাচ্চা মেয়েটা আর সে নয়। জিন্সের উপর ব্লাক টপ পরেছে। এর উপর পরেছে শ্যানেলের আকাশী রঙের জ্যাকেট। চুলগুলো ঘন, কার্ল করা। নিসন্দেহে অতি সুন্দরী যুবতী হয়েছে। তাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস আটকে গেল তিসানের।
জিনি জিজ্ঞেস করে, “এখনো কি চিনতে পারেন নি?”
তিসান তার মুগ্ধময় রূপ থেকে চোখ সরাল। খানিকটা গভীর কন্ঠে বলল, “চিনেছি, তা ঠিক। কিন্তু এই রাতে বেলা কেউ সানগ্লাস পরে, অক্টোবর মাসে জ্যাকেট পরে থাকে তা জানা ছিলো না। নমুনা লাগছে তাই তাকিয়ে ছিলাম।” বলে হাসল তিসান।
এমন অপমানে জিনি আরও নিভলো। সে কাঠকাঠ গলায় বলল, “এসেছি তো প্যারিস থেকে বাংলাদেশে। এখানে জ্যাকেট খুলে ঘুরলে ছেলেরা কেমন ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে তাকিয়ে থাকবে তা আমার জানা আছে। এই’যে এখনই তাকিয়ে আছে দেখেন।”
তিসান আশেপাশে তাকাতেই জিনি যেতে চাইল। তিসান আবারও ডাকল তাকে, “কথা বলবি না আমার সাথে?” সামনে এসে দাঁড়াল ঠিক।
জিনির তখনও অস্থির লাগছিল। কিন্তু সে মৃণার বিয়েরদিনের তার অপমানটা ভুলে নি। তার সম্মান তার ভালোবাসার চেয়ে বড়। সে হেসে উওর দিলো, “বাবা আর ভাইয়ার সাথে দেখা করবো ভাইয়া। এরপর আমার বয়ফ্রেন্ডকে কল দিয়ে জানাব আমি এসে পৌঁছে গেছি।”
সম্পূর্ণ মিথ্যা বলল জিনি। আপাতত তার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। প্যারিস যাবার প্রথম বছরে দুইজনকে ডেট করেছিল সে। তিসানকেই ভোলার জন্য। পারে নি। তাই বয়ফ্রেন্ডের ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ধ্যান দিলো।
“বয়ফ্রেন্ড?” খানিকটা অবাক দেখাল তিসানকে।
“কেন থাকতে পারে না? হয়েছে কি তিসান ভাই, আমি গা’য়ে পরা স্বভাব বাদ দেয়ার পর ছেলেরা এখন আমার গা’য়ে পরতে আসে। তাই বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে রেখেছি। ছেলেদের দূরে রাখতে সাহায্য হয়। তাকে ছাড়া অন্য ছেলের সাথে কথা বলতেও বিরক্ত লাগে ভীষণ। আপনার সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগছে তা বলছি না কিন্তু এখন যেতে হবে।”
জিনি তার পাশ কেটে চলে যায়। দেখে জাহান তার রুম থেকে আসছে। সরষে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরা। হাতা কণুই পর্যন্ত গুটাতে গুটাতে আসছে। জিনি দৌড়ে যেয়ে জাহানকে জড়িয়ে ধরলো। জাহান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “গতমাসেই তো তোর সাথে দেখা করে আসলাম। এমন ব্যবহার করছিস যেন কতবছর পর দেখা হলো।”
“তোমার বিয়ের খুশিতে ধরলাম। তোমাকে হলুদ মেখে যাব ভাবির সাথে দেখা করতে। ভাবিকে কতবছর দেখি না। ভিডিও কলে দেখেছি, সামনে তো না। তো ভাইয়া কেমন লাগছে নিজের বিয়েতে?”
“পাঁচ বছরের তপস্যার পর যেমন লাগে।”
জিনি হাসে। তার বাহু ধরে তাকে স্টেজের দিকে নিয়ে যেতে বলে, “মুরাদ ভাইয়াকে পটিয়ে বিয়ে করতে পারতে কিন্তু।”
“ভাইয়ার ইচ্ছাটা তো অপূর্ণ থেকে যেত। তার ইচ্ছা ছিলো তার বোন নিজের যোগ্যতায় চাকরি করবে।”
“তা ঠিক। এজন্যই তো ভাবি চাকরি পেতেই বিয়ের জন্য রাজি হলো। তবে ভাবিকে চাইলেই তো মুরাদ ভাইয়ার কোম্পানিতে জায়গা দিতে পারতো। অথবা আমাদের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে?”
“এতে মুরাদ ভাইয়ার ইচ্ছাকে অপমান করা হতো না? ভাইয়া কিছু ভেবেই ওকে নিজের কোম্পানিতে নেয় নি। তাহলে আমরা কীভাবে নেই? হয়তো ওকে দায়িত্ব বুঝানোর জন্য।”
“মেক সেন্স। তবে একটা জিনিস ছিলো।”
“কি?”
জিনি জাহানকে বসিয়ে তার পাশের থালা থেকে একহাত ভর্তি হলুদ নিয়ে মাখিয়ে দুষ্টুমি করে বলে, “শুভ হলুদ ভাইয়া।”
“জিনির বাচ্চা কী করলি তুই? এখনো বাবাও আসে নি। সব মেহমানও না। হলুদ লাগিয়ে দিলি কোন দু:খে?”
“তোমার এই হলুদ নিয়ে এখন আমি ভাগবো ভাবির কাছে। তোমার লাগানো হলুদই লাগাবো। ভালোবাসা বাড়বে।”
“এত ভালোবাসা পৃথিবী সইতে পাড়বে তো?”
হঠাৎ বেজে উঠলো জাহানের ফোন। পকেট থেকে বের করে দেখে মোহের ফোন। সে কল ধরে বলে, “মোহ বলো, সব ঠিক তো। আচ্ছা শুনো, তোমার বান্ধবীর একটু ছবি পাঠাবে? আম্মু বলল আগামীকালের আগে দেখা যাবে না মহুয়াকে, নাহলে আমিই এসে পরতাম।”
“বোধহয় আপনার আসতেই হবে ভাইয়া।” আতঙ্ক তার কন্ঠে।
ভয় পেয়ে গেল জাহান, “কী হয়েছে মোহ? সব ঠিক?”
“ভাইয়া… মহুয়া জেনে গেছে এক্সিডেন্টের কারণে যে ওর মা হবার সম্ভাবনা কমে গেছে। রুমে নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে। আমরা ডেকেছি দেড় ঘন্টা ধরে। খুলছে না। মুরাদ ভাইয়ার কথাতেও খুলছে না। সিরিয়াস বিষয়।”
জাহান সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে, “কী? কীভাবে জানলো?”
“তা পড়ে বলছি। আপনি আসুন।”
“এখনই আসছি।”
জাহান জিনিকে বলে, “মহুয়ার বাসায় যেতে হবে।”
“অল ওকে ভাইয়া?”
জাহান উত্তর দেয় না। সময় নেই। সে দৌড়ে যেতে নিলে তিসান থামায় তাকে, “তুই নিজের হলুদ ছেড়ে কোথায় যাচ্ছিস।”
“মহুয়ার বাসায়।”
“মেহমান এসেছে। হলুদের অনুষ্ঠান চলছে তোর।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।” সে তিসানকে সরিয়ে চলে গেল। তার পিছনে গেল জিনিও।
মহুয়ার বাসায় যেয়ে তার রুমের সামনে যেয়ে দেখে সবাই তার রুমের বাহিরে দাঁড়ানো।
“মহুয়া বের হয় নি এখনো?” জাহানের প্রশ্নে সবাই তাকায় তার দিকে। মহুয়ার মা কান্না করছিলেন। সে বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা। আমি শ্রাবণীকে কথায় কথায়…”
“আম্মু এসব কথা এখন বাদ দিন। মহুয়ার একসময় জানারই ছিলো সব। সত্যি তো আর লুকানো থাকে না।”
মুরাদ ভারী ক্লান্ত গলায় বলল, “আমরা তো অনেক চেষ্টা করলাম। তুমিই এখন দেখো।”
জাহান দেখল সবার দৃষ্টি এই মুহূর্তে তার দিকে গেঁথে আছে। মুরাদ তো দরজার সামনে থেকে নিজের জায়গাও ছেড়ে দিল। তবে জাহান এগিয়ে এলো না। উলটো দৌড়ে গেল ছাদের দিকে। মৃণা জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনি ছাদে কেন যাচ্ছেন?”
“টপকে তোমার বান্ধবীর রুমে যাব।”
মুরাদ প্রথমে কথাটা শুনে স্বাভাবিক থাকলেও পরক্ষণেই ব্যাপারটা তার মাথায় ক্লিক করে। সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “টপকে যাবে মানে? আগে কী তুমি ছাদ থেকে মহুয়ার রুমে গিয়েছ?”
জাহান দাঁড়িয়ে যায় সিঁড়িতে। পিছনে ফিরে মুরাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “কী যে বলেন ভাইয়া? আমি এমনটা করতে পারি?”
মুরাদ কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে। জাহান ভীত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “যখন ওর এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ওর চিন্তা হতো তাই আসতাম। কসম ভাইয়া এরপর আসি নি।”
মুরাদ রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে, “এই পোলাপানগুলোকে নিয়ে কী করব? তোমরা তো দুইটাই পাগল, সংসার করবে কীভাবে?”
জাহান ভারী ইনোসেন্ট মুখ নিয়ে তাকাল তার দিকে।
মুরাদ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আচ্ছা যাও।”
জাহান অনুমতি পেয়ে আবারো দৌড়ে উঠে। ছাদের এককোণায় মহুয়ার ব্যালকনি। সেখানে যেয়ে পাইপ ধরে লাফ দেয়।
মহুয়া বিছানার এককোণে গুটিশুটি মেরে বসেছিল। কেন যেন তার চোখের জল বন্ধ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। তার ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে।
হঠাৎ বারান্দা থেকে শব্দ শুনে সে তাকায় জাহানকে দেখেই দৌড়ে যায় দরজা বন্ধ করতে। কিন্তু জাহান রুমে ঢুকে পড়েছে।
তা দেখে মহুয়া আরও বিরক্ত হয়। রেগেমেগে ফুলে রুমে ঢুকে। জাহান তার হাত ধরে নেয়, “কী হয়েছে আমার জানটার? এমন ফুলে আছে কেন?”
মহুয়া তো পিছনে ফিরে চোখ দিয়ে অগ্নি ঝরায় তাকে দেখে। হামলা করে বরাবর। একের পর এক ঘুষি মেরে তাকে বলে, “তুমি সব জানতে…সব জানতে তুমি। তারপর আমার কাছ থেকে লুকিয়েছ। কত বড় সাহস তোমার! এত বড় কথা কীভাবে লুকাতে পারো তুমি? তুমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছ। অথচ আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো কিনা আমি জানিনা। কেন বিয়েটা করছো?”
জাহান মহুয়ার হাত ধরে নেয়। এতক্ষণ সে শান্তভাবে ছিলো। ভেবেছিল শান্ত কথাতেই মহুয়াকে সামলে নিবে। অথচ তার শেষ কথায় মেজাজ খারাপ হয়ে যায় জাহানের। অন্যহাত দিয়ে তাকে টেনে কাছে আনে। তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে আলতো করে তাকে কাছে টেনে নেয়, “কেন বিয়ে করছি মানে? তুমি জানো না আমি তোমাকে কেন বিয়ে করছি?”
মহুয়া মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকায়।
তবে জাহান তার গাল চিপে তার মুখ করে নিজের দিকে, “তুমি জানো না আমি কেন তোমাকে বিয়ে করছি? তোমার জন্য আমি নিজের জান দিতে দ্বিধাবোধ করবো না সেখানে এই সামান্য কারণে তোমাকে আমি বিয়ের চিন্তা বাদ দিবো?”
“সামান্য কারণ? তোমার একমাত্র স্বপ্ন এটা। একটা বড় সুখী পরিবারের।”
“আর আমার সেই সুখ তুমি। একমাত্র তুমি। আমি অন্য কারো সাথে সংসার করার কল্পনাও কখনো করিনি। আসেই না। আমার শুধু তোমাকে চাই সংসার করার জন্য। সারাজীবনের জন্য। আমার সে পরিবারে তুমি না থাকলে আমার কোনো পরিবারই লাগবে না। বিয়ে তো কেবল মানুষ বাচ্চার জন্য করে না। তুমি চাইলে আমরা বাচ্চা এডোপ্ট করবো। এই পৃথিবীতে কত বাচ্চা আছে যাদের মা বাবা নেই। আর তুমি না চাইলে আমরা দুইজন একসাথে কাটিয়ে দিব। ব্যাস এতটুকুইতো। পরিবার ছোট হোক বা বড়, আমার তোমাকে চাই সে পরিবারে। তুমি এতটা ব্যাকডেটেড ছিলে না কখনো জান। আজ কী হলো? মাথার তাঁর সব একসাথে ব্লাস্ট হলো না’কি?”
কথায় মহুয়া প্রথমে মুখ ফুলিয়ে তাকায় তার দিকে। তারপর একে একে কতগুলো চাটি মারে তার হাতে। জাহান হেসে তার গালে হাত রাখে। সে ভেজা চোখে চোখ ডুবিয়ে এক ঢোক গিলে বলে, “তোমার চোখের পানি আমার ভারী অপছন্দ, কিন্তু জানো তোমায় কাঁদলে কতটা সুন্দর লাগে। তোমার চোখগুলো কতটা গভীর দেখায়। ইচ্ছা করে ডুবে যাই।”
“যাও ডুবে।”
“বলছো কিন্তু…”
“কী?”
“ডুবে যেতে…”
মহুয়া জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। জাহান মুহূর্তও ব্যয় না করে তার গাল ছুঁইয়ে দেয় মহুয়ার গালে। ছুঁতেই শিউরে ওঠে মহুয়া। জাহান মাদকাসক্ত কন্ঠে জানায়, “শুভ হলুদ জান। আমার নামের তোমার প্রথম হলুদ আমিই ছোঁয়ালাম।”
সে সরে দেখতে পায় মহুয়ার লজ্জামাখা চোখদুটো। সে নামিয়ে নিয়েছে। এই তেজি মেয়ের জেদটাও তাকে আকর্ষণ করে খুব বেশি। কিন্তু যখন সে লজ্জা পায় তখন জাহানের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যায় প্রচুর। সে আর কিছু ভাবে না, মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে নেয় মুহূর্তে।
কিছু মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় মহুয়া। হঠাৎ জাহান এমন কিছু করবে ভাবে নি সে। তার শরীরে এক শিহরণ হলো। যা তাকে বশ করে নিলো মুহূর্তে। সে জাহানের কলার ধরে আরও কাছে টানলো। জাহান তার হাত ডুবাল মহুয়ার চুলের ভেতর। তাকে মিশিয়ে নিলো নিজের মাঝে। আরেক হাত দিয়ে তার চুলগুলো একপাশে করে মুখ ডুবাল তার গলায়।
মহুয়া নড়ে উঠলো। সাথে সাথে বিদ্যুৎ এর গতিতে সরে গেল সে, “কী করছো?”
জাহান মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ফেলে, “জান চলো এখনই বিয়েটা সেরে ফেলি। পাঁচ বছর নিজেকে সামলেছি আজ পারছি না।”
“মুরাদ ভাইয়া জানলে আছাড় মারবে তোমাকে।”
দরজার ওপাশ থেকে আবারও মুরাদের কন্ঠ শোনা যায়, “সব ঠিক আছে? মহু দরজা খুল বলছি।”
জাহান ভীত গলায় বলে, “শুনে ফেলেছে না’কি? এই আমি তোমাকে কিছু করিনি বুঝেছ?”
মহুয়া হাসে, “এত ভয় পাও কেন ভাইয়াকে।”
“সে তুমি বুঝবে না। তোমার ভাইকে দেখলেও আমার হাত পা ঠান্ডা হয় আসে।”
এমন সময় বাহির থেকে ঢোলের শব্দ শোনা যায়।
“বাসায় ঢোলওয়ালাদের আসার কথা ছিলো না’কি?” জাহান প্রশ্ন করে।
“বাসার ভেতর থেকে না, বাহির থেকে শব্দ আসছে।”
মহুয়া দৌড়ে বাহিরে যেয়ে দেখে তিসান ও জয় সহ জাহানের বন্ধুরাও এসেছে। ঢোলওয়ালাদের সাথে। তাদের দেখে মহুয়ার ঠোঁটে হাসি এঁকে উঠে, “তুমি ডেকেছো তাদের?”
জাহান নিজেও তাদের দেখে অবাক হয়। সে তো তাদের ডাকে নি। তাহলে তারা এখানে কীভাবে? উত্তরটা পেয়ে গেল সে খানিকের মধ্যেই। দেখল তার বাবাও এসেছে। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরা। চোখে চশমা। তাকে দেখেই জাহান বিব্রতবোধ করে। লজ্জায় মুখে হাত দিয়ে নেয়। কিন্তু মহুয়া তো সেই খুশি। সে বারান্দা থেকেই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “শশুড়আব্বা এই নায়ক সেজে ঢোল নিয়ে এসেছেন যে?”
“তোমার শশুড় আব্বার সাথে বিয়েতে নাচার কথা ছিলো ভুলে গেছ?”
মহুয়ার মনে পড়ে। মুহূর্তে সে তার দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। তিসান গান ছাড়ে,
“রূপ হে তেরা সোনা সোনা
সোনি তেরি পায়েল….”
মহুয়া চিৎকার করে জানান দেয়, “আমাকে ছাড়া শুরু করবন না বলে দিচ্ছি।”
এক দৌড় দেয় সে। দেখে দরজার বাহিরে পরিবারের সবাই দাঁড়ানো। সবার মুখে চিন্তার ভাব। কিন্তু সে তা পাত্তা না দিয়ে দুইহাতে মৃণা ও মোহকে ধরে দেয় দৌড়।
মোহ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বলে, “আস্তে মহু…”
“আরে আমার শশুড় আব্বা দাঁড়ানো। আমাকে ছাড়া নাচ সেরে ফেলবে। কীসের আসতে?”
জাহান বের হয়ে লজ্জিত সুরে বলল, “সরি আম্মু আব্বু আর ভাইয়া। আপনাদের মেয়ের সাথে থাকার সাইডিফেক্টে আমার বাবারও কয়টা মাথার তার ছিঁড়ে গেছে।”
তারা প্রথমে বুঝে না। নিচে নেমে দেখে তাদের আত্নীয়রা দরজায় দাঁড়ানো।
Say “shava shava” —গানে নাচছে ধুমিয়ে মহুয়া তার শশুড়, জাহানের বন্ধুবান্ধবদের সাথে। সাথে মৃণা ও মোহও আছে কিন্তু তারা হাতে তালি দিচ্ছে কেবল। মহুয়া সবাইকে টেনে নিয়ে যেতে এলো, কিন্তু তার সাথে এসে তাল মিলিয়ে নাচলো শুধু সমুদ্র। মহুয়া মৃণা আর মোহকেও টানলো। কিন্তু কেউ আসবে না। জোরে গানের মাঝে শব্দ শোনা যাবে না বলে মহুয়া উঁচু স্বরেই মোহকে বলল, “মৃণুর কথা তো বুঝলাম তুই এমন হয়ে গেলি কবে? ওর বিয়ের সময় বলেছিলি আমার বিয়েতে আরও বেশি নাচবি।”
মোহ চুপ করে গেল। সে মুখ শুনে কিছু বলতে চেয়ে আবারও চুপ করে গেল। এবার মহুয়ার খটকা লাগল। সে হাত ধরল মোহের। জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে তো? অল ওকে? দুলুভাই কিছু বলেছে? একবার বল। এবার শিক্ষা দিব আসলেই।”
“আরে এমন কিছু না।”
“তাহলে বল।”
মোহ সংকোচবোধ করল। মৃণাও তাকাল তার দিকে। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে।
“আমি তোদেরকেই আগে বলতাম তাই কাওকেই জানাই নি। আজকের ঘটনার পর বুঝতে পাড়ছিলাম না জানাবো না’কি! আজ সকালে রিপোর্ট এসেছে।”
“কীসের? সব ঠিক আছে তো?” মৃণা চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করল।
মোহ রঙে গেল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো, “তোরা তো খালামণি হবি।”
কথাটা শুনেই মৃণা ও মহুয়া তাকালো একে অপরের দিকে। মৃণা সাথে সাথে মোহকে জড়িয়ে ধরে, “কনগ্রেটস দোস্ত। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই মা হবি।”
মহুয়া খুশিতে চিৎকার করে লাফিয়ে জড়িয়ে ধরল মোহকে। তারপর তাকে ছেড়ে দৌড়ে গেল সমুদ্রের কাছে।
সমুদ্র তো মহুয়াকে টেনে আনলো জাহানের কাছে। একসাথে নাচার জন্য। মহুয়া তাকে সংবাদটা দিতে চাচ্ছিল চট-জলদি। তবে সমুদ্র শুনছেই না। সে যেন বেঁকে বসে আছে মহুয়া আর জাহানের নাচ দেখবে। মহুয়া বারবার বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এবার বিরক্ত হয়ে জোরেই বলে উঠে, “আরে আপনি আমার কথা শুনছেন না কেন দুলুভাই? না শুনলে আপনি যে বাবা হবেন এই নিউজটা মিস করবেন না?”
মুহূর্তে সব গান বাজনা থেমে গেল। জয়ও গান বন্ধ করে দিলো। সমুদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
“কী বললে?”
সকলে শুনতে আগ্রহী। কারণ কথাটা স্পষ্ট শোনা যায় নি শব্দ করা গানে।
“বলেছি আমি খালামণি হচ্ছি খুব শীঘ্রই।”
জাহান খুশিতে জড়িয়ে ধরে সমুদ্রকে। কিন্তু সমুদ্র তখনও স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো মহুয়ার দিকে, “তুমি সত্যি বলছো?”
মহুয়া মাথা নাড়ায় দ্রুত। তবুও সমুদ্র এই খুশির সংবাদটা নিজের হৃদয়ে গ্রহণ করার পূর্বে তাকাল মোহের দিকে।
মোহ লজ্জামাখা চোখজোড়া দিয়ে সম্মতি জানাল। সমুদ্রের চোখে পানি এসে পড়ে। সাথে সাথে সমুদ্র দৌড়ে যায় তার কাছে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মোহ পিছিয়ে যায়। সমুদ্র বুঝতে পাড়ে সে এত মানুষের সামনে সংকোচ বোধ করছে। তাই জড়িয়ে ধরে না। তবে তার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে, “তোমাকে পাওয়াটাকে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ভেবেছিলাম। অথচ এই কয়েকটা শব্দ আমার সে মুহূর্ত থেকেও সুন্দর হয়ে উঠলো। থ্যাঙ্কিউ মধু।” সে আলতো করে চুমু খায় তার হাতে।
সকলে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে শুভেচ্ছা জানাল। অথচ সমুদ্র অপেক্ষায় ছিলো কখনো সে মোহকে তার বুকে ভরে নিবে শক্ত করে। সারাক্ষণ তার চোখ ছিলো সে মেয়েটার উপরই স্থির।
রাত হয়েছিল। মহুয়ার বাবা বলল, “দেখলি তো, কীভাবে কান্না করে নিজের হলুদের রাতটা শেষ করলি?”
“রাত এখন শেষ হয়েছ না’কি?”
মহুয়া একহাত হলুদ নিয়ে লাগাল তার বাবা, শশুড়আব্বা, মৃণা ও মোহকে। একে একে সবাই একে অপরকে হলুদ লাগাতে শুরু করল। গান, বাজনা ও একগুচ্ছ মজার সাথে কাটলো সে রাতটি। রাত তখন বারোটা। মুরাদ ও সমুদ্র দুইজনই অপেক্ষা করছিল।তাদের বউয়ের জন্য। একজন বাবা হবার সুসংবাদ পেয়েছে, আরেকজন এক দশক পর তার প্রেমের সফলতা। কিন্তু তাদের ব্যাকুল অপেক্ষায় পানি ঢেলে মহুয়া তাদের নিয়ে গেল নিজের রুমে। তার কথা, “আগামীকাল তার বিয়ে। তাই তার বান্ধবীদের দখল করার সম্পূর্ণ অধিকার তার আছে। তার অধিকার তাদের থেকে অনেক বছর আগের।”
আর কি? তার সাথে কে ঝগড়া বেঁধে নিজের মাথা নষ্ট করতে যাবে? হারবেই শেষ পর্যন্ত। তাই নিজ নিজ হৃদয় মেরে এই দীর্ঘ রাতটি কাটতে লাগলো।
তবে মধ্যরাতে ফোন বাজলো। কাঁচা ঘুম থেকে চোখ খুলে মৃণা দেখল তার ফোন বাজে। মুরাদের কল। সে কল ধরতেই মুরাদ হুকুম দেয়, “এখনই সিঁড়ির পাশের ব্যালকনিতে আয়। তোর বান্ধবী যেন না জাগে। বুঝেছিস?”
এতটুকু বলেই টুস করে কল কেটে দিলো। মৃণা থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। কী হলো এটা? সে ভালো করে দেখে স্বপ্ন দেখছে না। তাই সে তার পাশে ঘুমে আছন্ন থাকা মোহ আর মহুয়ার দিকে তাকিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে আসে। তবে ব্যালকনিতে যেয়ে দেখতে পায় না মুরাদকে।
আশেপাশে তাকায়। মুরাদকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। তবে সে সময় এক উষ্ণতার আভাস পায় সে। কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে তার বুকের ভেতরে কম্পন জেগে উঠে,
“মুরাদভাই আপনি?”
মুরাদ মৃণার উপর শালটা জড়িয়ে দিয়ে তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, “আমি ছাড়া এভাবে তোকে ছোঁয়ার সাহস আছে কারো? আর মুরাদভাই! ভাই ডাকা বন্ধ করবি প্লিজ? এরপর আমাদের বাচ্চারা আমাকে মামা ডাকা শুরু করবে।”
হাসলো মৃণা।
মুরাদ তার কৃষ্ণকালো কেশে হাত বুলিয়ে বলল, “তুই কী চাস আমার সাথে সংসার করতে?”
মৃণা পিছনে ঘুরে, তার বাহুডোরে আবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই।
“সন্দেহ আছে কী আপনার? আজকে সারা পৃথিবীর সামনে আপনার প্রতি ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করলাম। তবুও?”
মুরাদ তার কপালে কপাল ঠেকায়, “আজ আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর দিন জানিস? আমার এতবছরের ভালোবাসার তপস্যা আজ শেষ হলো। আমার মিষ্টির কাল বিয়ে। যাকে আমি বোন থেকে বেশি নিজের মেয়ের মতো বড় করেছি। আর মোহ, যাকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি আমার চোখের সামনে, আমার আরেক বোন সে মা হবে। এত সুখ কী এই পৃথিবীর সইবে।”
মৃণা কিছু বলল না। তার বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে।
মুরাদ বলল, “তোর থেকে তো আমি কখনো কিছু চাই নি। একটা জিনিস চাই?”
মৃণা তার বুকে পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে নিলো, “হুম।”
“আমাকে একটা ছোট রাজকন্যা দিবি? আজ যখন সমুদ্র ভাই বাবা হবার খবর শুনলো তার সুখ দেখেছিস? তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল। আমার ভীষণ লোভ লাগলো জানিস?”
“আপনার সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করা আমার ভাগ্য হবে। আর সে সন্তান কন্যা হলে তার ভাগ্য হবে আপনার মতো বাবা পাওয়া। আপনি যেভাবে মহুয়াকে বড় করেছেন, আমাকে এই কয়বছরে যেভাবে যত্ন করেও শক্ত করেছেন, আপনার কন্যা সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী হবে এমন বাবা পেয়ে।”
“বলছিস আমার বাচ্চার মা হবি?”
মুখ দিয়ে কিছু বলে না মৃণা। লজ্জায় মুখ দাবিয়ে নেয় মুরাদের বুকে।
মুরাদ শান্তি নিঃশ্বাস ফেলে তাকায় আকাশের দিকে। কৃষ্ণকালো আকাশে আজ তারার ছিনিমিনি খেলা। সে বিশাল বড় চন্দ্রিমা তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই চুপটি করে।
.
.
পরদিন সন্ধ্যায় সকলে উপস্থিত হয় সেন্টারে। চারদিকে উৎসবের আমেজ। বিয়ে পরানোর সময় এসেছে। ফুলের চাদরের দুইপাশে বসে আছে মহুয়া আর জাহান। তবে অদ্ভুত ব্যাপার। দুইজনের মধ্যে কারোই মুখে কোনো আশঙ্কা নেই। নার্ভাসনেসের বিন্দুমাত্র তাদের মধ্যে নেই। এই সময় বর বধূরা কত চিন্তিত থাকে, হোক তা লাভ ম্যারেজ। অথচ দুইজন নির্বিকারে হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে।
কাজি মহুয়ার কাছে থেকে এলো জাহানের কাছে। বিয়ে পরানোর উদ্দেশ্যে। তবে কাজি কিছু বলার আগেই জাহান তাকে ফুসফুসিয়ে বলে, “কাজি সাহেব একটা কথা ছিলো। আপনি চুরি করে দেনমোহরের পাশে আমার নামটাও লিখে দেন।”
একথা শুনে কাজি তাজ্জব বনে গেল, “কেন?”
“যেন বউ আমাকে কখনো ছাড়তেই না পারে।”
কাজি হা করে তাকিয়ে রইলো জাহানের দিকে। যেন এমন আজব কথাবার্তা সে আর শুনে নি কখনো।
“কাজিসাহেব কী হলো? বিয়ে পড়াচ্ছেন না কেন?” মুরাদের কথা শুনে জাহান সোজা হয়ে বসলো। কোনো কথা বলল না। নড়লোও না। কেবল যখন কাজিন কবুল বলতে বলল সে ফটাফট কবুল বলে সই করল। যে মুহূর্তে কাজি জানাল তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে সে মুহূর্তেই জাহান উঠে দৌড়ে গেল ফুলের চাদরের ওপাড়ে। সকাল।থেকে তার জানকে বউবেশের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে তার মন। সরিয়ে দেখতেই তার হৃদপিণ্ড এলোপাথাড়ি দৌড়াতে লাগলো। কমলা রঙের যে জামদানী শাড়িটি সে একমাস ধরে খুঁজে এনেছে তা পরেছে মহুয়া। কমলা রঙের জামদানীর সাথে স্বর্ণের গহনা। মাথায়ও সোনালী রঙের জামদানী ওড়না। হাতভরা মেহেদী। তাকে দেখেই জাহান সবার সামনে বুকে হাত রেখে বসে পরল তার সামনে হাঁটু গেড়ে।
“আজকে আমাকে মা’রার প্লান করে এসেছ না’কি?”
মহুয়া গালে হাত রেখে তাকাল তার দিকে, “ছোট একটা হার্ট অ্যাটাকও তো করলে না।”
“তিন চারটা হয়ে গেছে বোধহয়।”
তিসানকে ভারী বিরক্ত শুনাল, “তোরা বন্ধ করবি? তোরা হার্ট অ্যাটাক না করলে তোদের এই প্রেমের লুতুপুতু কথা শুনে আমরা ঠিকই হার্ট অ্যাটাক করল।”
তার কথায় সবাই হেসে দিলো। মহুয়াও। কিন্তু হাসলো না জাহান। সে তাকিয়ে রইলো মহুয়ার দিকে। মুগ্ধ নয়নে। সে মৃদুস্বরে বলে, “জানো সূর্যোস্তের সৌন্দর্যও আজ তোমার সৌন্দর্যের সামনে ফিঁকে।”
বিয়ে শেষে জাহানের বাড়িতে এসেছে সবাই। মহুয়াকে বাসরঘরে নিয়ে গেছে জিনি। জাহান সেখানে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকলেও তাদের এয়ারলাইনসের শেয়ারহোল্ডাররা আসায় কথা বলতে হয়েছে তার। ছাড় পেয়েছে রাত এগারোটায়। তারপর ঢুকতে নিলে গেইট ধরল জিনি, জয় আর তাসিনসহ তার বন্ধুরা। টাকা ছাড়া ঢুকতেই দিবে না। সে তাতেও রাজি। টাকা শোধ করে ভেতরে ঢুকলো। ঢুকতেই ঝটকা খেল এক বড়সড়। রুমে মহুয়ার সাথে আছে শায়ান আর মোহ। মহুয়ার কোলে একটা বিড়াল। তার ক্রিমপাফ।
তাকে দেখে মহুয়া তার কোলের ক্রিমপাফকে দেখিয়ে বলে, “দেখো শায়ান নিয়ে এসেছে। আমি ওকে বলেছিলাম আমার বিয়ে পর্যন্ত ক্রিমপাফকে নিজের কাছে রাখতে। তাই বিয়ে হতেই নিয়ে আসছে।”
শায়ান এগিয়ে আসে। জাহানের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “গিফটটা তোমার ভালো লাগে বন্ধু।”
জাহান তেরছা দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “ইচ্ছা করে আজ রাতে এনেছিস না? সারারাত এখন একে নিয়েই পড়ে থাকবে।”
“বুঝলি তোর আর আমার অনেককিছু মিলে। এই যে এই চিন্তাটা অন্যকারো মাথায় আসে নি। তুই কত জলদি বুঝে নিলি।”
জাহান রেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল। এর আগেই শায়ান মহুয়াকে বলে, “আমি মার্সম্যালো আর কুকিকে নিয়ে আসবো ওর সাথে খেলা করার জন্য। একা একা তো থাকতে পারবে না।”
জাহান বিরক্তি নিয়ে বলে, “তোকে কি তাহলে এখন থেকে রেগুলার সহ্য করতে হবে?”
“এই ভালো বুঝলি। ওরা তো আবার আমাকে ছাড়া আসবে না। তোকে মোটেও ডিস্টার্ব করবো না। ওরা ক্রিমপাফের সাথে খেলবে আর আমি মহুয়ার সাথে গল্প করলাম। ব্যাস হয়ে গেল। ঠিক বলেছি না মহুয়া?”
মহুয়া ক্রিমপাফকে আদর করতে করতে বলল, “ওদের আনলেই হবে।”
শায়ান শয়তানি হাসি দিয়ে বের হতে নিলে জাহান বলল, “তোর সময় আসবে না? দেখিস কি করি।”
শায়ান পাত্তা দিলো না। শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল। মোহ বের হওয়ার সময় জাহানকে বলল, “সরি ভাইয়া। ওর ক্রিমপাফকে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। দিবে না।”
জাহান আহত দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে।
মহুয়ার কাছে যেয়ে বসে তার বিছানার পাশে। তার হাত ধরতেই ছোঁ মেরে হাত সরিয়ে নেয় মহুয়া, “কী চাই? দেখছো না আমি ব্যস্ত?”
অসহায়ের মতো তাকায় জাহান, “আজ আমাদের বাসররাত জান।”
“তো? মনে আছে পাঁচবছর আগে আমাকে এনগেজমেন্ট এর নিউজ শুনিয়ে কষ্ট দিয়েছিলে…”
“সে কথা এখন তুলছো কেন?”
“আহারে আমার ভোলাভালা হনুমান, তার প্রতিশোধই নিবো। আমি কষ্ট পেয়েছি। এখন থেকে তুমি কষ্ট পাও।”
“মানে কী?”
মহুয়া উওর দেয় না। ক্রিমপাফের সাথে খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়।
জাহান ক্রিমপাফকে মহুয়ার কোল থেকে নিয়ে বিছানায় রাখে। তার দিকে তাকায় আদুরে দৃষ্টিতে, “জান একটু আদর করবে না আমাকে?”
মহুয়া উঠে দাঁড়ায়, “একটুও না। আমি এসব গয়নাগাটি খুলে আসি।”
জাহান তাকে থামায়। তার বধূমাখা মুখ দেখে তার মন ভরে নি এখনো। সে মহুয়ার কোমর জড়িয়ে কাছে টানলো তাকে। তার গালে হাত রেখে আলতো করে চুমু খেল তার অধরে। মাদকাময় কন্ঠে বলল, “তোমাকে বউ দেখা শেষ হয় নি যে জান। সেদিন যখন প্রথম এই কমলা শাড়িতে দেখেছিলাম সে দৃশ্যটা আজও চোখে ভাসছে। আমার বুকের ভেতরের কোমল।হৃদয়টা বেহাল অবস্থা তুমি টের পাও নি।”
জাহান মহুয়ার হাত ধরে তার বুকে রাখে। বলে, “এখন এই অবস্থা দেখো। তখনের কথা চিন্তা করো।”
মহুয়া কাঁপছিল আজ জাহানের ছোঁয়ায়। তার চোখ আজ মিলছে না জাহানের চোখে। তবুও শক্ত গলায় শুধায়, “এত প্রেমের কথা বলে লাভ নেই জনাব। আজ কোনো আদর হবে না।”
জাহান আরেকটু কাছে টানে তাকে। তার চিবুকে হাত রেখে মুখ তুলে। চোখে চোখ রেখে বলে, “আদর না করতে দিলে এই চোখের তৃষ্ণা মেটাতে দেও। তোমাদের সারাজনম বউবেশে দেখার তৃষ্ণা আজ এক রাতে দেখে মিটিয়ে নেই। জানো জান, তোমাকে এক টুকরো সূর্যাস্তের মতো লাগছে। স্নিগ্ধ, মুগ্ধ, মনোহর। যার জন্য চাইলে মুহূর্ত না ভেবে প্রাণ দিয়ে দেওয়া যায়।”
.
.
সমুদ্রসহ মোহ বাসায় আসে রাতে। শাড়ি পালটে গয়না খুলে রাখে। তবে আশেপাশে কোথাও সমুদ্রকে পায় না। তাকে না পেয়ে পড়ার টেবিলে বসে। আজকাল।সে নিবন্ধন আর বিসিএসের জন্য পড়ছে। যেটাতে হয়ে যায়। কিন্তু এর আগে নেয় তার ডায়েরিটা। একটি গল্প লিখছে সে। ‘মোহের সমুদ্র’ নামক। তার ও সমুদ্রের গল্পটা। শখ করেই লেখাটা শুরু করেছিল। কিন্তু আজকাল লিখতে ভালোই লাগে। পড়ার আগে বা পড়ে লেখা শুরু করে। সময় কেটে যায় অনেক কিন্তু তার লেখা শেষ হয় না। ভালোই লাগে তার। প্রথমে এলোমেলো ভাবে লিখেছিল সে এই গল্পটাই। কিন্তু একসময় তার লেখালিখি এত ভালো লাগে যে টুকটাক গল্প উপন্যাস লেখা শুরু করেছে। সংবাদপত্র আর অনলাইনে দুই জায়গাতে লিখে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাই এই বছর মোহের সমুদ্র নামক উপন্যাসটি বের করবে।
রুমে সমুদ্রের আসার আভাস পেল সে। সে তাকাল আড়চোখে।
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“মা’য়ের কাছে।” সে হাঁটু গেড়ে বসলো মোহের সামনে। মোহের পা নিজের হাঁটু রেখে তার পরনের নুপুরটা খুলে তার আনা নুপুর পরিয়ে দিচ্ছিল।
মোহ গালে হাত রেখে দেখল তাকে, “আবারও নুপুর আনলেন? নুপুরের কারখানা দিবেন না’কি?”
সমুদ্র তখনই কথা শেষ করল না। দুই’পায়ে নুপুর পরিয়ে একটি বাক্স দিলো মোহের হাতে।
“এটা কী?”
“খুলে দেখো।”
মোহ খুলে দেখলে বাক্সের ভিতরে ছোট্ট একজোড়া রূপার নুপুর আর একটা হাতের ব্রেসলেট। সে তাকাল সমুদ্রের দিকে জ্বলজ্বল চোখে, “কী কিউট এগুলো!”
“আমি দুইবছর আগে এনে রেখেছিলাম। মেয়ে হলে ওর জন্য নুপুর আর ছেলে হলে ব্রেসলেট।”
“আপনার কী চাই? আমার তো ছেলেই চাই। আপনার থেকে বেশি আমাকে ভালোবাসবে। মেয়ে হলে তো নিজের বাবার দলে চলে যাবে।”
সমুদ্র হাসে। তারপর ফট করে কোলে তুলে নেয় তাকে। যায় বারান্দায়। সেখানে দোলনা লাগিয়েছে নতুন। মোহের খুব পছন্দ। সেখানে মোহকে নিজের খুব কাছে বসিয়ে বলে, “তুমি আমাকে যে খুশিটা দিয়েছ এর জন্য তোমার উপর খুবই কৃতজ্ঞ আমি মধু। ছেলে হোক বা মেয়ে, আল্লাহর রহমত। তুমি আর আমাদের বাচ্চা সুস্থ থাকলেই হবে।”
“আইস্ক্রিম খাবো।”
“একদম না। ঠান্ডা লেগে যাবে। তোমারও বাবুরও।”
মোহ মুখ লটকালো, “এখন থেকেই বাবুর চিন্তা? বাবু আসলে তো আমাকে ভুলেই যাবেন।”
সমুদ্র তার ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দেয় হাল্কা। বলে, “এই পৃথিবীতে তোমার থেকে বেশি আমি কাওকে ভালোবাসতে পারবো না।”
মোহ তার বুকে মাথা রাখে, “দেখেন বাবু আসলে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবেন। তাদের মধ্যে আমাদের প্রাণ হবে। আমাদের ভালোবাসাই তো তারা।”
রাত কাটছিল। ছন ছন শব্দ হচ্ছে নুপুরের। তারাসহ চন্দ্রিমা বিদায় নিয়ে সূর্যিমামার আগমন ঘটল পৃথিবীর বুকে। অন্ধকার কাটিয়ে পৃথিবীটা আলোকিত করে গেল।
সমাপ্তি…..
_____________________________________________
পরিশিষ্টঃ
মৃণা একবার জিজ্ঞেস করেছিল। পনেরো বছর পর কী তাহলে বন্ধুত্ব এমনই থাকবে?
থাকল না, আরও গভীর হলো। চারদিকের ব্যস্ত জীবনেও একে অপরের জন্য সময় খুঁজল। ক্যারিয়ার, সংসার, বাচ্চা সবকিছুর মাঝেও তাদের বন্ধুত্ব কমেনি। উলটো গভীর হয়েছে। এমনকি তাদের পরিবারগুলোও এক হয়েছে। প্রতি শুক্রবার তারা কাটায় একসাথে। বাচ্চারা একসাথে খেলে সারাদিন। জাহান, মুরাদ ও সমুদ্র কতশত গল্প জুড়ে।
মহুয়া পাঁচ বছর অন্যকোম্পানিতে চাকরি করে মুরাদের কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। নিজের যোগ্যতা দেখিয়েছে। ভাইবোন দুইজনই মার্কেটিং এক্সপার্ট। মহুয়া আসার পর আরও নাম হয়েছে তাদের কোম্পানির। কেবল দেশে না বিদেশেও। মৃণা দেশের নামকরা গায়িকা। এই কয়বছরে শতখানিক এওয়ার্ড পেয়েছে সে। আর মোহ, সে কলেজের প্রফেসর। সাথে লেখিকাও। তার উপন্যাস বের হয়েছে ছয়টি। সবগুলো জনপ্রিয়তা পেল। তার ও সমুদ্রের এক ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে নয় বছরের, মেয়ের বয়স পাঁচ। নাম সাগর ও সেতু। মৃণা ও মুরাদের মেয়ে কেবল একটা, নাম মেধা। এবছরে পড়ল সাতে। আর মহুয়া জাহান সত্যিই বাচ্চা দত্তক নিয়েছিল। দুইটা মেয়ে একটা ছেলে। ছেলে বড়, নাম রেখেছে ইভান। ইভানের পর মহুয়ার কোলজুড়ে আল্লাহ পাঠিয়েছিল আরেক ছেলে, জোভানকে। তারপর আবার তারা দুই মেয়ে দত্তক নিয়েছে। মালিহা ও জান্নাত। আরেকটা সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছে।
সব বাচ্চারা গল্প করতে, খেলতে ঘুমিয়ে গেছে একই কক্ষে। মৃণা তাদের সবাইকে দেখে মিষ্টি হাসলো। একে অপরের গা চড়ে ঘুমুচ্ছে। কেউ কাওকে লাথি মারছে ঘুমের মাঝে। লাইট অফফ করে দরজা বন্ধ করল। দোতলা দিয়ে দেখল মুরাদ, জাহান ও সমুদ্র ড্রইংরুমে খেলা দেখছে একসাথে। তারপর সে উপরে গেল, ছাদে। দেখল তার প্রাণজোড়াকে। মোহ আর মহুয়া চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে ছাদে। আসমানের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখছে। গল্প করছে। তাকে দেখে মোহ সরে মাঝে জায়গা দিলো, “জলদি আয়।”
মৃণা যেয়ে শুয়ে পড়লো তাদের মাঝে, “কী করছিলি?”
“আমরা তো মেঘ দেখে গেস করিছি কোনটা কি! তুই কোথায় ছিলি?”
“বাচ্চাদের চকোলেট মিল্ক দিয়ে গিয়েছিলাম। দেখি সব ঘুমে। একে অপরের উপর চড়ে শুয়ে আছে। লাথি মারছে।”
শেষ কথায় হেসে উঠে মহুয়া, “এই লাথি মারা ব্যক্তি জোভান ছাড়া কেউ হবে না। সবাইকে সারাক্ষণ বিরক্ত করতে থাকে। বড়দের নাকে দম করে দুষ্টুমিতে আর ছোটদের অর্ডার দেয় শুধু।”
মোহ হাসে, “তোর সব গুণ এসেছে।”
মহুয়া উঠে বসে তাকে চিমটি করে বলে, “কী বললি তুই শালী?”
মোহ হাত ঢলে বলে, “কে বলবে তুই চার বাচ্চার মা। নিজে এমন বাচ্চামো করিস।”
মহুয়া তাকে ভেঙিয়ে শুয়ে পড়ে আবার।
মৃণা তাদের দেখে হাসে। আবারও জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা বল তো আগামী পঁচিশ বছরে কী আমাদের বন্ধুত্ব এমনই থাকবে?”
মহুয়া বলে, “বলতো মোহ থাকবে না’কি?”
“অবশ্যই থাকবে।”
“থাকলে শালী বইয়ে লিখিস নি কেন?”
মহুয়ার তার পাশ থেকে একটা মোটা বই মোহের পেটে নিয়ে রাখে। আর বলে, “আমাকে যেভাবে ঝগড়াটু বানিয়েছিস আমি মোটেও এত ঝগড়া করি না।”
মোহ ঠোঁট টিপে হাসে, “একদমই করিস না।”
এবছর মোহের বই এসেছে, ‘মেঘের খামে’।
তাদের তিন বান্ধবী নিয়েই এই বই লেখা। তাদের ছোট বেলা থেকে শুরু করে তাদের বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে —-তাদের গল্প।
মৃণা মহুয়াকে ফেরত টেনে শোয়াল। বলল, “ঝগড়া করিস না।”
মোহ জিজ্ঞেস করে, “আমাদের মহু আমার বইও পড়ে। এটা তো লেটস্ট নিউজ।”
“এটা দেখে পড়লাম কেবল। আমাদের গল্প দেখে। আচ্ছা দেখ ওই মেঘটাকে খরগোশের মাথার মতো দেখা যায় না?”
“মোটেও না, মাথামোটা। দুইটা কলম একসাথে এমন দেখা যায়।”
“তোর চোখ খারাপ।”
“তোর মাথা খারাপ।”
মৃণা থামাল দুইজনকে, “তোরা থামবি? ওই মেঘটাকে দেখ লাভ সেপের দেখাচ্ছে। যেন মেঘের খামে আমাদের জন্য ভালোবাসা পাঠাচ্ছে।”
লেখককথন~ আরেকটি যাত্রা আপনাদের সাথে শেষ করলাম। ভালোবাসা দিলেন। অনেক ধন্যবাদ। হয়তো আবারও আরেক যাত্রার সাথী হবো, ইনশাআল্লাহ। এই যাত্রাটা কেমন লেগেছে জানাবেন….