(রুমান্টিক এলার্ট,অতিরিক্ত রুমান্টিক গল্প পছন্দ না তারা দূরে থাকুন)
#তুই_আমার_আসক্তি
#পর্ব_৯
#লেখিকা_তাসনিম_তালুকদার_বুশরা
কপি করা বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ ❌
রিমি: মুখ বাঁকিয়ে ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল,তোমাকে তা বলতে হবে না। আমি আমার বেবির ব্যাপার নিজেই বুঝে নেবো। আর তুমি তো নেহারের কাজিন—তাই আমাদের ব্যাপারে ঢুকতে এসো না। এটাই আমার একদম পছন্দ না।
কথাটা শেষ হতেই স্নেহার চোখ লাল হয়ে উঠল রাগে। ভ্রু টানটান, মুখ গম্ভীর। সে চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়াল। গলায় ফুঁসে ওঠা কণ্ঠে সে গর্জে উঠল,
স্নেহা: এই মেয়ে! তোদের মধ্যে কখনো ঢুকলাম? আর একটা বাজে কথা বললে মাথা ফাটিয়ে দিবো এই চেয়ার দিয়ে!
তার কথায় ক্যান্টিনের চারপাশ মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যে টেবিলের চারপাশে অল্প আগেও হাসিঠাট্টা চলছিলো, সেখানে এখন কেবল নিস্তব্ধতার ভার।
নেহার দ্রুত হাত বাড়িয়ে স্নেহাকে চেপে ধরলো, যেন শান্ত করতে চায়। চোখে অনুনয়ের ভঙ্গি, কণ্ঠে নরম সুরে বলল,
নেহার: স্নেহা, এরকম করিস না বোইন। হুদাই সিনক্রিকেট করে কি লাভ? তুই তো জানিস সব কিছু।
কিন্তু স্নেহা যেন আরও জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে, কণ্ঠে দমিত আগুন নিয়ে বলল,
স্নেহা: শালা! এখন আমি তোর বোন হলাম? আসিস আবার রাতে হয়ে বিড়াল দুধ-ভাত খেতে আসিস তারপর তোকে লঙ্কা ভাত যদি না খাওয়াই, আমার নাম স্নেহা নয়!
রিমি: ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,নেহার বেবি, রাতে কি তোমার দুধ-ভাতে খেতে মন চাই..?তাহলে আমায় বলতে পারতে আমি না হয় ড্যাডিকে বলে বিশ কেজি দুধ পাঠিয়ে দিতাম তোমাদের বাসায়। আর তো আন্টিও আছে, তাহলে এই মেয়ের হাতের দুধ-ভাত খেতে এত টান কেন?
রিমির মুখ থেকে এমন আবাল মার্কা কথাগুলো বেরুতেই, সবাই এক মুহূর্তের জন্য থমথমে নীরবতা নেমে এল। তারপরেই ইমরান, আশিক আর সুহার মুখে হাসির ঝিলিক। যেন কেউ আচমকা কোনো কৌতুক শোনালো।
কিন্তু স্নেহার মনে হল মাথায় হাত দিয়ে নিজের কপালেই বাড়ি মারে। হাসবে নাকি কাঁদবে—তা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। ভেতরে ভেতরে যেন জ্বলন্ত আগুনে তেল ঢেলে দিল রিমি।
নেহার: কণ্ঠে বিরক্তির ঝাঁজ ফুটে উঠল,রিমি, তুমি এখান থেকে চলে যাও। তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না।
রিমি: তখন ঠোঁট ফাঁক করে ন্যাকামো ভরা স্বরে বলল,আরে বেবি, তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে…?
বলতে বলতেই হঠাৎ এগিয়ে এসে নেহার হাতটা ধরে ফেলল সে।
এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারল না স্নেহা। মুহূর্তেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। চোখ-মুখ লালচে হয়ে উঠেছে রাগে। রিমির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় তার চুলের মুঠি চেপে ধরল।
স্নেহার চোখে তখন আগুন জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে, রাগে ফুঁসে উঠল সে।
স্নেহা: হারামি! ন্যাকামো করার জায়গা পাস না। আজকে তোর একদিন না, যেন আমার জামাইয়ের চব্বিশ দিন!
কথাটা শেষ হতে না হতেই, এক ঝটকায় স্নেহার হাত উঠে রিমির গালে সপাটে চড় বসলো। শব্দটা ক্যান্টিনের ভেতর এমনভাবে প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, যেন সবাই মুহূর্তের জন্য শ্বাস আটকে রাখল।
রিমি হতভম্ব। চোখ কপালে উঠে গেছে। চারপাশে থাকা ইমরান, আশিক, সুহা—সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। কেউ হাসবে নাকি ভয়ে চুপ করে থাকবে, বুঝে উঠতে পারছিল না।
নেহা আর বসে থাকতে পারল না। চেয়ার সরিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে স্নেহার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।তারপর স্নেহা রিমির থেকে ছাড়িয়ে বললো,
নেহা: কি করছিস তুই স্নেহা? পাগল হয়ে গেছিস নাকি!
কিন্তু তখন আর সময় নেই। মুহূর্তেই খবরের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ঘটনাটা। ক্যান্টিনে ভিড় জমে গেল। কারো হাতে ফোন, কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে কি হচ্ছে, কি হচ্ছে?
স্নেহা নেহার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তার চোখে শুধু একটাই দৃশ্য রিমি।
স্নেহা: আমাকে ছাড়েন নেহার ভাই! আমাকে এই মেয়েটাকে আজকে ছাড়তে বলো না। আমি ছাড়ব না ওকে।
নেহার মরিয়া হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরল। যেন নিজের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবে। তারপর হঠাৎ এক ঝটকায় স্নেহাকে কোলে তুলে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তার চোখে আতঙ্ক এখন যদি ঝামেলা বাড়ে, তবে অপমানের শেষ থাকবে না।
ঠিক তখনই রিমি চেঁচিয়ে উঠল, মুখটা লালচে হয়ে গেছে রাগে আর লজ্জায়।
রিমি: এই মেয়ের তর সাহস কি করে হয়? আমার চুল ধরারা, আমার গালে থাপ্পড় দেয়ার! তোকে আমি দেখে নেবো।
স্নেহার রাগ তখন আর সীমিত ছিল না। চোখে অগ্নি, গলায় কণ্ঠ কেঁপে ওঠা, মনে ভেতর থেকে এমন উত্তেজনা, যা আর কোনো নিয়ন্ত্রণে নেই। হঠাৎ করেই সে নিজের পায়ের জুতো খানা ছুঁরে মারলো রিমির দিকে। ক্যান্টিনের ভিড়ে সবাই অবাক কেউ চুপ, কেউ হেসে ফেলল, কেউ চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে।
জুতো খানা সরাসরি রিমির মুখে লেগে গেল। ঠোঁট ফেটে গেল, চামড়ার উপর আঘাতের শব্দ ক্যান্টিনে প্রতিধ্বনি তুলল। কেউ চিৎকার, কেউ হাসতে হাসতে কাঁপছে।
নেহার আর এই পরিস্থিতি সহ্য করতে পারল না। স্নেহাকে কোলে তুলে নিয়েই বড় বড় পদক্ষেপে তারা ক্যান্টিনের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। নেহার চোখে আতঙ্ক, স্নেহার চোখে অটল প্রতিজ্ঞা ভিড়ের মধ্যে যেমন ছিলেন সবাই, তারা তেমনই অপ্রতিরোধ্যভাবে এগোতে লাগল।
রিমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাঁড়িয়ে বলল, কণ্ঠে অশান্তি আর প্রতিশোধের মিলিত ছাপ,
রিমি: ছাড়বো না! আমি তোকে ছাড়বো না! তোর জীবন আমি শেষ করে দেবো, শয়তান মেয়ে! তুই আমার নেহারের কোলে উঠিস আর আমাকে মারিস, অপমান করিস? তোকে এমনভাবে রাখব না—বাঁচতে পারবি না, মরতে পারবি না।
তার কথার সঙ্গে হেসে উঠল এক অদ্ভুত, বাকা হাসি, যা ক্যান্টিনে আতঙ্ক আর উত্তেজনার পরিবেশ আরও বাড়িয়ে দিল। কেউ চুপ, কেউ মুখ লুকিয়ে আছে, কেউ ফোন বের করে দৃশ্য ধারণ করতে শুরু করেছে।
নেহার বাইরে ঠান্ডা হাওয়ায় স্নেহাকে কোলে আঁকড়ে ধরেছে। স্নেহার কণ্ঠে কাঁপন আছে, চোখে দৃঢ় অঙ্গীকার—সে জানে, এই মুহূর্তের পর কেউ তার প্রিয় মানুষকে ক্ষতি করতে পারবে না।
ক্যান্টিনের ছোট্ট কোণটি এখন এক যুদ্ধক্ষেত্র রাগ, প্রতিশোধ, সাহস আর আবেগের মিশ্রণ। বাইরের বাতাসে তাদের পদক্ষেপের ধ্বনি মিশে যায়, আর ভেতরে ক্যান্টিনের উত্তেজনা যেন ধীরে ধীরে নীরবতার আচ্ছাদনে ঢেকে যাচ্ছে।
~~
নেহার গাড়ির সামনে পৌঁছালো স্নেহা কে নামিয়ে দেয়।তারপর ধীরে ধীরে গাড়ির দরজা খুলল। চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে এক ধরনের অসহায়তা।
নেহার: প্লিজ, আর সিনক্রিয়েট করিস না। আমার এসব ভালো লাগে না। আমি টায়ার্ড, এখন আর এসব ভালো লাগছে না।
স্নেহা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে, চোখে অগ্নি ঝরছে, গলায় কণ্ঠ কেঁপে উঠেছে,
স্নেহা: আপনার তো খুব মজা লাগে তাই না? এসব শুনতে একটাই হয় না—একশোটা লাগে আপনার একটা হয় না।
নেহা চোখ বন্ধ করে এক গভীর নিশ্বাস নিল, রাগ আর ক্লান্তি কাবু করার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে, স্নেহার দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। কণ্ঠে শান্তি, কিন্তু ভেতরের অনুভূতিগুলো স্পষ্ট,
নেহার: দেখ, জান। অনেক হয়েছে এসব। আর ভালো লাগছে না। আমি তকে ভালোবাসি—বিয়ে করেছি, আর কি চাই? আমি যদি তকে ভালো না বাসতাম, তাহলে কি বিয়ে করতাম?
স্নেহার চোখে আগুন জ্বলে উঠেছে, কণ্ঠে ঠান্ডা তীব্রতা। সে নেহার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
স্নেহা: সব আড়ালে করেছেন। আর আমি এখন পুরোনো হয়ে গেছি। হয়তো আর ভালো লাগে না। কে বলতে পারে? হয়তো আপনার পড়াশোনা শেষ হলে আমাকে আর ভালো লাগবে না। যা পাওয়ার, তা তো আমার থেকে পেয়েই গেছেন।
স্নেহার কথার আঘাত নেহারের মাথার ভেতর জড়িয়ে ধরে। রাগ, বিস্ময়, আর অদ্ভুত এক ব্যথা একসাথে মাথায় চেপে বসে। প্রথমে সে হেসে ফেলে, তবে হাসিটা ভেতরে ভাঙা কাচের মতো ফুঁটে যাচ্ছে।
নেহার: সিরিয়াসলি..? তর এরকম মনে হয় আমার ভালোবাসা নিয়ে তোর এই কনফিউস? ভালোবাসা কখনো পুরোনো হয় বুঝি..? তাহলে তো আমিও বলতে পারি তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি, কারণ আমিও তো পুরোনো হয়ে যাবো, তাই না?
স্নেহার চোখ বড় হয়ে গেছে, হৃদয়টা যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেছে। নেহারের চোখে মিশে আছে বিরক্তি, রাগ আর গভীর ভালোবাসার মিলিত ছাপ।
হঠাৎ নেহার তার কাছে এগিয়ে আসে। স্নেহাকে গাড়ির পাশে টেনে নিয়ে দাঁড় করায়। স্নেহার কাঁধ চেপে ধরে বলে,
নেহার: মিসেস নেহার খান। আমি নেহার খান। কখনোই আপনাকে ছাড়বো না। যতদিন আমার নিঃশ্বাস আছে, ততদিন আমি আপনার হয়ে থাকবো। কারণ, আপনার মাঝে আমি আমার পৃথিবীর সব সুখ খুঁজে পাই।
স্নেহার চোখে অচেনা উত্তেজনা, হৃদয় দ্রুত ধক ধক করছে। নেহারের চোখে মিশে আছে এমন এক অদম্য প্রেম, যা কথা ছাড়াও বুঝে নিতে পারে।
নেহার: আর বিয়ের ব্যাপারটা আমি জানাচ্ছি না। কারণ, পরীক্ষার আগে আমি কোনো ঝামেলা চাই না। তবে এটা মানে নয় যে আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনি আমার হৃদয় জায়গা করে নিচ্ছেন। যদি আপনাকে ভুলতে হয়, তবে আমার হৃদয়টা কেটে ফেলতেই হবে।
স্নেহার বুক ধুকপুক করছে। কণ্ঠ খোলার আগে চোখে জল জমে আসে, আর হৃদয় যেন নেহারের কথার সাথে মিলেমিশে ভরিয়ে যাচ্ছে।
নেহার হঠাৎ একটু থেমে যায়। তারপর আরও কাছ থেকে স্নেহাকে আঁকড়ে ধরে, চুপচাপ বললো, আচ্ছা এটা কি আদৌ সম্ভব, মিসেস খান? কলিজা কেটে ফেলা…!?
নেহারের গভীর কথাগুলো স্নেহার রাগকে গলে ভেঙে দিলো। যেন আগুনের মধ্যে জমে থাকা বরফ এক মুহূর্তেই গলে গিয়ে পানি হয়ে গেল। স্নেহার চোখে অদ্ভুত কোমলতা, আর হৃদয় যেন হালকা এক প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, সে মৃদু কণ্ঠে বললো,আমি বাড়ি যাবো।
নেহার হয়তো হেসে ফেললো। স্নেহার এমন নার্ভাস, লজ্জিত অবস্থায় দেখার আনন্দ যেন তার মুখে হালকা হাসি ফোটালো। তিনি ধীরে ধীরে স্নেহার থেকে দূরে সরে এলেন, চোখে এক উষ্ণ হাসি আমি ফোন করে দিচ্ছি। কেউ এসে তোকে বাড়ি নিয়ে যাবে।”
স্নেহা কোনোকিছুতে কম্প্রমাইজ করল না। সরাসরি বললো,না, আমি আপনার সাথে যাবো।
নেহার কোনো প্রতিবাদ করল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে, সে নিজেই স্নেহাকে গাড়িতে বসাল এবং নিজেও তার পাশে বসলো। গাড়ি চলে গেলো শান্ত শহরের রাস্তার দিকে, বাইরে সূর্যের গাঢ় রুদ। কিন্তু ভেতরে এক নিঃশব্দ শান্তি।
দুই জনের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। গাড়ির সঙ্গমে শুধুই নীরবতা, হালকা হাওয়া, আর দুটি হৃদয়ের নিঃশ্বাসের লয়। স্নেহা জানতো, এই নীরবতা ভীষণ স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে—যেমন কথা না হলেও তারা একে অপরকে বুঝছে।
বাড়ির কাছে পৌঁছে, নেহার সতর্কভাবে স্নেহাকে নামালো। চোখে একদম কোমলতা, মনটিতে একটি নিঃশ্বাসের ভারমুক্তি।
তারপর নেহার অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
স্নেহা হালকা শ্বাস ফেলল। মন যেন এখনও নেহারের কথার প্রভাবের মধ্যেই ভেসে আছে। আর সেই শান্ত নীরবতা, যা ভোর থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, স্নেহার হৃদয়কে অদ্ভুতভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।
চলবে…..