তুই আমার আসক্তি পর্ব-১০

0
4

(রুমান্টিক এলার্ট,অতিরিক্ত রুমান্টিক গল্প পছন্দ না তারা দূরে থাকুন)

#তুই_আমার_আসক্তি
#পর্ব_১০
#লেখিকা_তাসনিম_তালুকদার_বুশরা

কপি করা বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ ❌

দুপুরের রোদটা যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতার আচ্ছাদনে ঢেকে গেছে। ইউনিভার্সিটির পেছনের সেই নির্জন জায়গাটায় কেবল বাতাসের হালকা সোঁ সোঁ শব্দ আর শুকনো পাতার মচমচে আওয়াজ। চারপাশে নেই কোনো ভিড়, নেই কোনো হাসি-ঠাট্টা—শুধু দুইটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি।

সুহার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধকধক করছে। গলা শুকিয়ে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে, অথচ মুখ খুলতে পারছে না। তার চোখে ভয় আর দ্বিধার ছায়া, যেন কোনো অজানা ঝড়ের আগে আকাশের ঘন মেঘ।

ইমরান মেয়েটির এমন অবস্থা দেখে অবাক। হালকা হাসি আর নরম গলায় বললো,

ইমরান: সুহা, তুমি নার্ভাস কেনো হচ্ছো? আমরা তো আগে থেকেই একে অপরকে চিনি। দয়া করে ভয় পেয়ো না। নিশ্চিন্তে যা বলবে বলো।

সুহা গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলো। সে চোখের কোণ থেকে ইমরানের দিকে তাকালো, তারপর ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করে ইমরানের চোখে চোখ রাখলো। হঠাৎ কেমন যেন চারপাশের সব শব্দ মিলিয়ে গেলো, কেবল তার হৃদয়ের শব্দটাই যেন শোনা যাচ্ছে।

তার কণ্ঠ কাঁপছিল, তবুও সে স্পষ্ট বললো,

সুহা: ইমরান ভাইয়া.. আমি… আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি কি আপনার পায়ের নিচে আমাকে একটুখানি ঠাঁই দেবেন? বিশ্বাস করুন, আমি কখনো আপনাকে আমার প্রতি অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না। সবসময় আপনার কথা শুনে থাকবো, আপনার পাশে থাকবো…!”

সুহার কণ্ঠের কাঁপা কাঁপা স্বীকারোক্তি যেন নিস্তব্ধ দুপুরটাকে ভেঙে দিলো। কিন্তু ইমরানের চোখে ছিলো বিস্ময় আর অনিশ্চয়তা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে গম্ভীর স্বরে বললো,

ইমরান: সুহা, তুমি এখনো ছোট। এসব কেবলই আবেগ, যা সময়ের সাথে আস্তে আস্তে কেটে যাবে। আমি… আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না। কখনোই পারবো না। আমি তোমাকে সেই চোখে কোনোদিন দেখিনি।

কথাগুলো যেন বাজের মতো আঘাত করলো সুহার ভেতরে। এক মুহূর্তে তার হৃদয়টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো। বুকের ভেতর কেমন শূন্য হয়ে উঠলো। চোখের কোণে টলমল করছে অশ্রু, কিন্তু সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে।

কাঁপা ঠোঁটে ধরা পড়লো তার প্রশ্ন

সুহা: কেনো… কেনো আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, ইমরান ভাইয়া? আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায় না? আমি কি দেখতে এতটাই খারাপ…?

সুহার কণ্ঠ যেন ছিঁড়ে আসা বেদনার সুর, প্রতিটি শব্দ ভিজে আছে অশ্রুতে।

ইমরান এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে কোনো ঘৃণা নেই, কোনো অবজ্ঞাও নেই—শুধু একরাশ সহমর্মিতা। হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

ইমরান: না সুহা, তুমি দেখতে খারাপ নও। বরং তুমি অনেক সুন্দর। খুব ভালোও। কিন্তু জীবনে তুমি আরও ভালো কাউকে পাবে। কেউ তোমাকে তোমার মতো করেই ভালোবাসবে। তাই এসব পাগলামি করার কোনো মানে হয় না।

সুহা শুনছিলো, কিন্তু মনে হচ্ছিলো শব্দগুলো যেন তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। কেবল বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। দুপুরের নির্জনতা এবার আরও ভারী হয়ে উঠলো, যেন পুরো আকাশটাই তার অশ্রুর ভারে নুয়ে পড়েছে।

সুহা আর নিজের ভেতরের ঝড়কে ধরে রাখতে পারলো না। কণ্ঠে কান্নার ঢেউ, চোখে অশ্রুর কুয়াশা। সে দু’হাত কাঁপা কাঁপা করে এগিয়ে দিয়ে বললো,

সুহা: আমার ভালো কাউকে নয়, আপনাকেই চাই, ইমরান ভাইয়া। দয়া করে আমাকে নিরাশ করবেন না.. আমি আপনার ছাড়া বাঁচবো না… ”

তার কণ্ঠ যেন ভেঙে পড়লো বাতাসে, নিস্তব্ধ দুপুরটায় অদৃশ্য সুরের মতো কাঁপছিলো।

ইমরান একবার গভীরভাবে তাকালো সুহার দিকে। তার চোখে বিস্ময়, করুণা আর কঠিন এক অদৃশ্য দূরত্ব। নীচু স্বরে বললো,

ইমরান: সুহা, তুমি বাসায় যাও। রেস্ট নাও। এসব ভুলে যাও। আমি… আমি কখনোই তোমাকে সেই চোখে দেখিনি।

বলে সে হঠাৎ পেছন ঘুরে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। ধীরে ধীরে দূরত্বটা বাড়তে লাগলো। তার পায়ের আওয়াজও মিলিয়ে গেলো শুকনো পাতার মচমচে শব্দের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চলে গেলো, যেন দুপুরের সোনালি আলোয় গিলে নিলো তাকে।

পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো সুহা।চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে, বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চলে যাওয়া সেই মানুষটার দিকে, যে তার স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতার মাঝে হারিয়ে গেলো।

চারপাশের বাতাস নিস্তব্ধ, কেবল সুহার কান্নার শব্দটাই যেন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে—একাকী, অসহায়, আর প্রতিধ্বনির মতো ভারী।

~~

রাত প্রায় নয়টা বাজে। তিন দিনের ব্যস্ততা শেষে আফজাল খান বাড়িতে ফিরেছে। সেজন্য ডাইনিং টেবিলে একসাথে বসেছে সবাই। টেবিলে গরম ভাতের ধোঁয়া উঠছে, প্লেটে সাজানো কাবাব, তরকারি, সালাদ—ড্রাইনিং রুম জোরে উঠেছে খাবারের ঘ্রাণে। পরিবারে আজ একধরনের প্রশান্তি, যেন সবাই চুপচাপ খাবারের স্বাদ নিতে ব্যস্ত।

কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর হঠাৎ আফজাল খান চামচ নামিয়ে রেখে গম্ভীর গলায় বললো,
নেহার, তোকে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো।

চামচ হাতে থেমে গেল নেহার। ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকালো।কি কথা, বাবা? বলো।

আফজাল খান একটু সময় নিলেন। দৃষ্টিটা টেবিলের উপর বুলিয়ে নিয়ে যেন ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিলেন। তারপর ধীর গলায় বললেন,

আফজাল খান: আমাদের বিজনেস পার্টনার জসিম সৈয়দকে তো চেনিস। ওর মেয়ে রিমি সৈয়দ—শুনলাম, সে নাকি তোকে বেশ পছন্দ করে। আর যেহেতু তোরা দু’জন একই ইউনিভার্সিটিতে পড়িস, তাই নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। আমার জানার ইচ্ছে তোর কাছে মেয়েটা কেমন লাগে?

নেহার: হঠাৎ কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,কেন বাবা? ওই মেয়েটার কথা হঠাৎ তুলছো কেন? ও দিয়ে কি করবে তুমি?

আফজাল খান: গলা পরিষ্কার করে, শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে উত্তর দিলেন,দেখ নেহা, রিমি মেয়েটাকে আমি তোর সাথে বিয়ে দিতে চাই। তোর পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে, বিজনেসের কাজকর্মও তো ভালো বোঝিস এখন। এর পরের ধাপটা হলো সংসার। সময় মতো বিয়ে করলে তোর জীবনও গুছিয়ে যাবে।

বাবার মুখে এই কথা শুনে নেহার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। যেন গলায় আটকে গেল খাবার। চামচ হাতে থেমে রইলো সে। ভাত আর গলা দিয়ে নামতে চাইলো না। টেবিলে এক মুহূর্তের জন্য ভারী নীরবতা নেমে এলো।

নেহার: ধীরে ধীরে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
বাবা, আমি এখনো বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। আমার আগে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হোক, তারপর এসব নিয়ে কথা বলা যাবে। প্লিজ, এর আগে এসব নিয়ে আর কিছু বলো না।

কথাটা শেষ করেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো নেহা। গম্ভীর মুখে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে উঠে গেল।

স্নেহা: যে এতক্ষণ নীরবে বসে সব শুনছিলো, তারও বুকটা ভার হয়ে এলো। খাবারের স্বাদ হঠাৎ ফিকে হয়ে গেল। আর কিছুর দিকে মন বসলো না। তাড়াহুড়ো করে একটা অজুহাত বানিয়ে সেও নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

টেবিলে কিছুক্ষণের জন্য শুধু নিস্তব্ধতা। তারপর মৌসুমী খান: ভ্রু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,ছেলেটার তো সামনে পরীক্ষা। এখন বিয়ের প্রসঙ্গ না তুললেই পারতে।

আফজাল খান: দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,আমি তো শুধু বললাম। এখনই তো বিয়ে করতে হবে বলিনি।

মৌসুমী খান: তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললেন,কথা বলাই যথেষ্ট। ছেলেটা তো চাপেই পড়ে যাবে। আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক, তারপর এসব।

বলে তিনি-ও ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে গেলেন। ডাইনিং টেবিল জুড়ে পড়ে রইলো অখাওয়া খাবারের গন্ধ আর এক অজানা অস্বস্তি।

~~

স্নেহা রুমে প্রবেশ করার পর বেলকনিতে চলে গেল। সেখানে চুপচাপ দোলনায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রাতের হালকা হাওয়া চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মনটাতে কোনো শান্তি নেই। সে ভেতরে ভেতরে ভাবছিল— মামা-মামী কি আমাকে কখনো মেনে নিবে? নাকি মানবে না?

হঠাৎই টের পেল, নেহার তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা অবাক, চোখের কোণ দিয়ে তাকালো নেহার দিকে। স্নেহার মুখে অদ্ভুত এক অসহায় ভাব, যেন সমস্ত দুঃখ ও ভয় একসাথে ওর চোখে ফুটে উঠেছে।

নেহার বুকটা ধক করে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্নেহার পাশে বসল। আর এক মুহূর্তে স্নেহাকে নিজের কাছে টেনে নিল, যেন সব দুঃখ আর দ্বন্দ্ব এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।

নেহার মৃদু: স্নেহার কানের কাছে গিয়ে বললো—মন খারাপ করিস কেনো? আমি তো ছিলাম, আছি আর থাকবো। শুধু পরীক্ষা শেষ হোক, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। বুঝলি, একদম মন খারাপ করবি না।

স্নেহা নীরবভাবে নেহার বুকে মাথা রেখে বসে রইলো। রাতের নীরবতা, হাওয়ার নরম স্পর্শ, আর নেহার কোমল শব্দ সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন থেমে গেছে। মনে হলো, এ পৃথিবীর সমস্ত অস্থিরতা কিছুক্ষণের জন্য অন্তরে স্থির হয়ে গেছে।

নেহার: হাত ধীরে ধীরে স্নেহার হাতে রেখে বললো,চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি পাশে আছি। সব সময়।

স্নেহা: কাঁপতে কাঁপতে, কম কন্ঠে বললো,যদি এরকম হয় যে মামা-মামী আমাকে মেনে নিলে না তখন আমি কি করবো? নেহার ভাই, তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো? আমি কিভাবে বাঁচবো? বলো, নেহার ভাই।

স্নেহার কণ্ঠের ভঙ্গি, ভয় আর অস্থিরতা—সব মিলিয়ে নেহার মন অচেনা এক অনুভূতিতে ভরে উঠলো। সে নীরবতার মধ্যেই স্নেহার দিকে আরো ঝুঁকল। স্নেহার কাঁপতে কাঁপতে থাকা শরীরটা নিজের বুকের সঙ্গে মেলাতে মেলাতে আরও শক্ত করে তার হাতের শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, যেনো স্নেহার সমস্ত ভয়, সমস্ত দ্বন্দ্ব, নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে চায়।

ধীরে ধীরে নেহার কন্ঠে শোনালো, শান্ত কিন্তু দৃঢ়

নেহার: আমি আছি না? আমি আছি। কেউ তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। একদম বাজে চিন্তা করবি না, স্নেহা।

স্নেহা কিছু বললো না। কেবল নিজের হাতগুলো নেহার শার্টের কাপড়ে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো, যেনো যেনো এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব কষ্ট থেমে যায়।

নেহার আরও শক্ত করে স্নেহাকে জড়ালো। তার কপালে ধীরে ধীরে চুমু দিলো, যেমন সমস্ত ভয়, সমস্ত অনিশ্চয়তা একেবারেই মুছে যায়। স্নেহা নরমে ভরে গেল, চোখ বন্ধ করে নেহার নিঃশ্বাস আর স্পর্শ অনুভব করছিলো।

বেলকনির হালকা হাওয়া তাদের চারপাশে ঘুরে যাচ্ছিল। রাতের নীরবতা, দোলনায় দুলতে থাকা বাতাসের সুর, আর দুই হৃদয়ের মিলনের নিঃশব্দ স্পন্দন—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেনো থেমে গেছে।

চলবে…..