(রুমান্টিক এলার্ট,অতিরিক্ত রুমান্টিক গল্প পছন্দ না তারা দূরে থাকুন)
#তুই_আমার_আসক্তি
#পর্ব_১১
#লেখিকা_তাসনিম_তালুকদার_বুশরা
কপি করা বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ ❌
ক্লাস রুমে আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এসেছে। স্নেহা এবং সুহা একসঙ্গে বসলেও, বাতাসের নীরবতা যেন এক ধরণের ভারী ভাব নিয়ে এসেছে। স্নেহার চোখে চিন্তার রেখা, আর সুহার চোখ ভিজে গেছে, বারবার হাতের ভেতর মুখ ঢেকে রাখছে।
স্নেহা: বারবার উদ্বেগ ধীরে ধীরে নরম কণ্ঠে বললো কিরে সুহা, কি হয়েছে? বলবি তো? এভাবে কেনো কান্না করেছিস? আমাকে তো বল।
স্নেহার বারবার প্রশ্নের দিকে সুহা কেবল মাথা নাড়লো। তবে তার ভয়, লজ্জা আর অস্বস্তি বোঝা যাচ্ছিল। বারবার একই কথা বলছিলো,
আমার কিছু হয়নি। আমি কান্না করিনি।
স্নেহা: প্রথমে শান্ত, তারপর ধীরে ধীরে রেগে গিয়ে বললো—এই লাস্ট বার, সুহা। এরপর যদি মিথ্যা কথা বলিস, তাহলে তোর সাথে আমার আর কোনো কথা নেই।
সুহা কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে রইলো। হঠাৎই চোখে জল ধরে না রাখতে পেরে সে অসহায় হয়ে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো—
সুহা: এবার অসহায় হয়ে স্নেহা কে কালকে সব কথা খুলে বললো, কিভাবে ইমরান ওকে রিজেক্ট করেছে সব।
সব কথা শোনার পর স্নেহার ভ্রু কুঁচকে গেল। চোখে বিস্ময় আর বিরক্তি মিলেমিশে উঠলো। সে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
স্নেহা: ইমরান ভাই তোকে কেন রিজেক্ট করলো? আমি বুঝলাম না। তুই তো দেখতেও সুন্দর, আর উনি তো তোকে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতো।
সুহা: চোখ নামিয়ে নিলো, ঠোঁট কামড়ে ভাঙা গলায় বললো,হয়তো আমাকে ভালো লাগে না। বাদ দে, এসব নিয়ে আর ভাবিস না।
কিন্তু স্নেহার রাগ চেপে রাখা গেলো না। চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। সে গর্জে উঠলো—
স্নেহা: বাদ দিবো মানে? তোকে এত কথা শুনালো, আর তুই চুপ করে সহ্য করবি? না, আজকে উনার খবর আছে।
কথা শেষ করেই স্নেহা দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সুহা ভয় পেয়ে গেলো। কেঁপে ওঠা গলায় বললো,
হায় আল্লাহ এ আবার কি করতে যাচ্ছে?
সে তাড়াহুড়ো করে নিজের খাতা-কলম গুছিয়ে নিলো এবং ছুটে বেরিয়ে গেল স্নেহার পিছনে। করিডোরে ভিড় ঠেলে, দ্রুত পা ফেলে স্নেহার কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করছিলো। তার বুক ধুকপুক করছে, মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন স্নেহা এখন কি করবে?
মাঠের অশ্বত্থ গাছের নিচে প্রতিদিনের মতো আড্ডা দিচ্ছিলো নেহার, ইমরান আর আশিক। হালকা বাতাসে হাসি-ঠাট্টা চলছিল, কিন্তু হঠাৎই তাদের দিকে এগিয়ে এলো স্নেহা।
স্নেহার মুখটা লাল টকটকে। হাঁটার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিলো, ওর ভেতরে অগ্নিগিরির মতো রাগ জমে আছে। নেহার এক নজর স্নেহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সে খুব ভালো করেই জানে স্নেহা রেগে গেলে মুখ লাল হয়ে যায়। তাই আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
নেহার: কিরে, কি হয়েছে? এভাবে সাপের মতো ফুঁসছিস কেনো?
কিন্তু স্নেহা কোনো উত্তর দিলো না। একেবারে ইমরানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। দাঁত চেপে, যেনো অনেক কষ্টের রাগ গিলে ফেলে বললো,
স্নেহা: ভাইয়া, আপনি আমার বান্ধবীকে এভাবে রিজেক্ট করলেন কেনো গতকাল? ও কি দেখতে সুন্দর না? নাকি আপনার আগে থেকেই কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে? কোনটা আসল কারণ?
মুহূর্তেই বাতাসে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। নেহার আর আশিক দু’জনেই থম মেরে গেলো। ইমরান প্রথমে ভড়কে গেলো, তারপর ধীরে ধীরে গম্ভীর হলো। স্নেহার কণ্ঠে যে কষ্ট আর অভিমান মিশে আছে, তা উপেক্ষা করার মতো নয়।
নেহার আর আশিক একসাথে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,কাকে রিজেক্ট করেছিস ইমরান.?
তাদের বিস্মিত মুখের মাঝেই হঠাৎ করেই সুহা সেখানে এসে দাঁড়ালো। স্নেহার উত্তেজিত অবস্থাটা বুঝতে পেরে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে স্নেহার হাত ধরে টানতে লাগলো।
চল স্নেহা, প্লিজ..!
কিন্তু স্নেহা দৃঢ়ভাবে নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো, চোখে আগুন নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো।
ইমরান: গম্ভীর কণ্ঠে বললো,দেখেন, স্নেহা ভাবি আমি কালকে আপনার বান্ধবীকে সব বলেছি। আমি ওকে কোনোদিন সেই চোখে দেখিনি। তাহলে কিভাবে সম্ভব? মিথ্যে আশা দেওয়ার চেয়ে সত্যি বলাটাই ঠিক।
কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্নেহার চোখে রাগ ঝলসে উঠলো। দাঁত চেপে বললো,
স্নেহা: একটা মেয়ে আপনার জন্য কেঁদে কেঁদে মরে যাবে, আর আপনি এভাবে ফিরিয়ে দিবেন? এটা কি ঠিক হলো?
নেহার: এবার বিরক্ত হয়ে ধমকানোর ভঙ্গিতে বললো,আচ্ছা স্নেহা, তুই যা। আমি দেখছি ব্যাপারটা।
কিন্তু স্নেহা একটুও নড়লো না। হাত কোমরে রেখে সোজা দাঁড়িয়ে বললো,
স্নেহা: না যাবো না। ভাইয়াকে একটা কারণ দেখাতে হবে—কেনো উনি আমার বান্ধবীকে রিজেক্ট করলেন।
আশিক: এবার শান্ত করার ভঙ্গিতে বললো,ভাবি, আপনি যান। আমরা আছি তো, দেখি কি করা যায়।
কিন্তু স্নেহা যেন কিছুতেই থামতে চাইলো না। ঠিক তখনই সুহা আবার তার হাত ধরে টানলো, চোখে জল নিয়ে বললো,
সুহা: চল প্লিজ, স্নেহা। এতে কোনো ভালো হবে না। উল্টো আমারই অপমান বোধ হবে।
কিন্তু স্নেহা যেন শুনছেই না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইমরানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
স্নেহা: কি ভাইয়া? বলুন কেনো রিজেক্ট করেছেন?
নেহার: এবার গলা উঁচিয়ে ধমক দিলো,
তুই কি যাবি না, স্নেহা?
স্নেহা: ঠোঁট কামড়ে হঠাৎ কাঁপা গলায় বললো,
হ্যাঁ, শুধু পারেন আমাকে ধমকাতে আজাইরা লোক।
এ কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে সে হঠাৎ করেই গাছতলা থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে পেছনে কাঁদতে কাঁদতে সুহাও দৌড়ে গেল তার সাথে।
চারপাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নেহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লো।এই মেয়েটা সবকিছুতেই এত তাড়াহুড়ো করে…একটুও সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা করে না।
আশিক চুপচাপ নেহার দিকে তাকিয়ে রইলো, আর ইমরান গভীর দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো নিজের অবস্থান নিয়ে।
~~
দুপুর গড়িয়ে দুইটা বাজে।
আজ থেকে নেহার অফিসে যাবে না— সামনে পরীক্ষার জন্য পুরো এক মাস শুধু পড়াশোনায় মন দিতে হবে। সে কারণেই বাবাকে বলেছিল, এক মাসের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই ইমরান আর সুহার ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভেবেই পাচ্ছে না এমন কিছু কিভাবে হলো। তার চেয়ে বড় কথা, এসব নিয়ে স্নেহাও তার ওপর রাগ করে আছে।
ধীরে ধীরে স্নেহার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো নেহার।অন্ধকার-আলো মেশানো ঘরে দেখলো, স্নেহা গভীর ঘুমে মগ্ন। গায়ে মোটা কম্ফোর্টার জড়ানো, মুখের কোণে শিশুসুলভ ক্লান্তি। নেহার এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলো, যেন সমস্ত অভিমান আর রাগের মাঝেও এই মেয়েটির প্রতি মমতা তার বুকের ভেতর গলে যাচ্ছে।
চুপচাপ দরজা টেনে বন্ধ করে দিলো।
তারপর আস্তে করে বিছানায় উঠে স্নেহার কম্ফোর্টারের ভেতরে ঢুকে পড়লো। কাছে গিয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো স্নেহাকে— বুকের ভেতর জড়ো করা সব অপরাধবোধ আর ভালোবাসা দিয়ে।
স্নেহা হঠাৎই অচেনা স্পর্শে আঁতকে উঠলো। অর্ধেক ঘুমের ঘোরেই তড়িঘড়ি করে চোখ খুললো। পরক্ষণেই বুঝলো নেহার তাকে জড়িয়ে আছে।
স্নেহা হঠাৎ নেহারের বুকের ভেতর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। চোখে ক্ষোভ, মুখে অভিমান
স্নেহা: ছাড়ুন আমাকে..! অসভ্য লোক! লজ্জা করে না? মানুষের সামনে ধমক দেন, আবার এখন এসে প্রেম দেখাতে আসছেন?!
নেহার: একটুও বিচলিত হলো না। ঠোঁটে হালকা দুষ্ট হাসি খেললো।আমি তো আগেও তোর সাথে অনেক কিছু করেছি, স্নেহা। এমন কিছু নেই যা আমরা একসাথে করিনি। তাহলে
স্নেহার: চোখ লাল হয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো অসভ্য! বেহায়া লোক! চুপ করুন!
নেহার: এবার গম্ভীর হলো। স্নেহার কাঁধ শক্ত করে ধরে নিচু স্বরে বললো আচ্ছা, ঠিক আছে। চুপ করবো। কিন্তু আমার কিছু কথা আছে। তুইকে মনোযোগ দিয়ে শুনতেই হবে।
স্নেহা: তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকালো।শুনবো না! কেন শুনবো আপনার কথা..? সরেন আমার কাছ থেকে!
রুম খানা হঠাৎ আরো নিস্তব্ধ। জানালা দিয়ে ভেসে আসা আলোয় স্নেহার চোখে ভয়, রাগ আর অসহায়তার মিশ্র ছায়া। নেহারের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, যেন অনেকদিনের দমিয়ে রাখা আগুন আজ আর আটকে রাখা যাচ্ছে না।
এক মুহূর্তে নেহার স্নেহার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিলো। স্নেহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণ তাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিলো।
সে ছটফট করতে লাগলো, মুক্ত হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করলো। কিন্তু নেহার যেন অন্ধকার কোনো শক্তিতে আচ্ছন্ন তার হাতগুলো তার মাথার ওপরে টেনে ধরে রাখলো নেহার, আর অপর হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো স্নেহার কোমর।
নেহারের ঠোঁট একবার থামলো না। তার প্রতিটি স্পর্শ ছিলো জেদি, দাবিদার—যেন স্নেহাকে সে নিজের ভেতরে মিশিয়ে নিতে চাইছে। প্রথমে স্নেহার প্রতিরোধ প্রবল ছিলো, কিন্তু ক্রমে তার শরীর অবশ হতে শুরু করলো। হৃদস্পন্দন দ্রুত, নিঃশ্বাস ভারী তবুও সে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কেন করছে সে, নিজেই বুঝতে পারছিলো না। ভয়? নাকি লুকোনো এক টান?
নেহারও যেন তার নীরবতায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলো। চুম্বন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো, যেন প্রতিটি মুহূর্তে স্নেহাকে আরও গভীরে টেনে নিতে চাইছে। তার শক্ত বাহুতে স্নেহা একেবারে বন্দি—কোনো উপায় নেই, কোনো পালানোর রাস্তা নেই।
স্নেহার মনে হচ্ছিলো, সে যেন এক অদ্ভুত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে—যেখানে রাগ, ভয়, আকর্ষণ আর অসহায়তা মিলেমিশে গেছে। তার ভেতরের এক অংশ চিৎকার করছে পালাতে, আরেক অংশ নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করছে।
নেহারের চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি যেন সে ঘোষণা দিচ্ছে, তুই আমার।
সেই মুহূর্তটা আর সাধারণ ভালোবাসা ছিলো না এটা ছিলো ঝড়ের মতো, অন্ধকারের মতো, এমন এক ভালোবাসা যেখানে আবেগ আর ভয়ের সীমারেখা মুছে গেছে।
চলবে…..