তুই আমার আসক্তি পর্ব-১৫

0
4

(রুমান্টিক এলার্ট,অতিরিক্ত রুমান্টিক গল্প পছন্দ না তারা দূরে থাকুন)

#তুই_আমার_আসক্তি
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_তাসনিম_তালুকদার_বুশরা

কপি করা বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ ❌

আফজাল খানের শরীর রাগে কাঁপছে। চোয়াল শক্ত করে দাঁত চেপে তিনি গর্জে উঠলেন,তোর সাহস দেখে আমি অবাক নেহার! তুই কিভাবে এই বিয়ে করতে পারিস? স্নেহা তো তোর বোনের মতো..! আর তুই ওকে বিয়ে করেছিস?

ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা আরও ঘন হয়ে উঠলো। সবার চোখ নেহারের দিকে, যেনো একসাথে হাজারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।

নেহার: এবার এক চুলও পিছালো না। তার দৃষ্টি সোজা, গলা দৃঢ় না, বাবা। আমি স্নেহাকে কোনোদিনও আমার বোনের চোখে দেখি নি। আমি সবসময় ওকে আমার বউয়ের চোখে দেখেছি। আর শুধু বিয়েই করিনি আমাদের মধ্যে অনেক কিছুই হয়েছে।

এই অকপট স্বীকারোক্তি শুনে চারপাশে যেনো ঝড় বয়ে গেলো। মৌসুমী খান চমকে উঠলেন, তারপর দু’হাত কপালে চাপড়ে ধরে গলায় কাঁপন নিয়ে বললেন,লজ্জা করে না তোর? বড়দের সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলতে পারিস?এভাবে কিভাবে বলছিস..? লজ্জা করে না..?

তারপর চোখ লালচে করে যোগ করলেন—তোর যদি সত্যিই স্নেহা ভালো লাগতো, আমাদের বলতে পারতিস। আমরা তোদের বিয়ে দিয়ে দিতাম সম্মানের সাথে। কিন্তু তুই এভাবে লুকিয়ে সব করবি এর মানে কী, নেহার?

ঘরের ভেতর বাতাস ভারি হয়ে এলো। স্নেহা নিচু মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বেয়ে নীরব অশ্রু গড়াচ্ছে। মনে হলো, প্রতিটি বাক্য যেনো তার হৃদয়ে ছুরির মতো বিঁধছে।

আর নেহার তার চোখে এখনও অনুশোচনার ছায়া নেই। বরং বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেনো নিজের অপরাধকেই সে গর্বের সাথে ঘোষণা করেছে।

নেহার এবার কাঁপা গলায় নয়, দৃঢ় সুরেই বললো, আমি কি করতাম ফুপাই তো? স্নেহাকে এখন বিয়ে দেবে না বলে জেদ ধরে বসেছিলো। তাই আমি নিজে থেকেই ওকে বিয়ে করেছি। আর এই ব্যাপারে সাকিব তো সব জানে। কিরে সাকিব? তুই-ই বল কিছু।

সবার চোখ একসাথে সাকিবের দিকে ঘুরে গেলো। হঠাৎ যেনো সে সবার সামনে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে। সাকিবের বুক ধকধক করছে মনে মনে বিড়বিড় করলো, আরে নিজেদের ঝামেলা নিজেরা মেটাও না, আমাকে কেনো টেনে আনছো, ভাই?

তহিদা রহমান চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাসের সুরে বললেন—সাকিব! তুই এসব জানতি?

সাকিব গলা শুকিয়ে আমতা আমতা করতে করতে বললো,আসলে…!তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আহমদ রহমান বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন আসলে কী? জানতি না জানতি সোজা কথা বল!সাকিব ঠোঁট কামড়ে নিচু স্বরে বললো,জানতাম।

এই এক কথাই যেনো ঘরে বজ্রপাতের মতো নেমে এলো। আহমদ রহমান আর সহ্য করতে পারলেন না। চেয়ার থেকে ঝাঁপিয়ে উঠে সাকিবের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁত চেপে বললেন,দিবো কানের নিচে, বজ্জাত ছেলে! নিজের বোনকে এভাবে লুকিয়ে বিয়ে দেয় কেউ?

সাকিব পিছিয়ে গেলো কিছুটা, দুই হাত তুলে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বললো,আমার দোষটা কী?

ভাইয়া তো বললো,আমি যদি এই বিয়েতে সাক্ষী না দিই, তবে আমাকে মেরে গুম করে ফেলবে। তাই তো রাজি হয়েছি।

সাকিবের এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্নেহা ও অন্যান্য সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নেহারের দিকে। কিন্তু নেহারের চোখে, হুলস্থুলে বা হাসিতে কিছুই অস্বাভাবিক লাগছে না। যেন, এখানে কিছুই ঘটেনি।

আফজাল খান মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে হালকা করে বললেন, না, এই ছেলে নিয়ে আমি কি করব? আমি মানি না। এই বিয়ে স্নেহার মা-এর জন্যও ঠিক নয়। আমি চাই, স্নেহাকে এমন একজন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবো, যে সত্যিই তার যোগ্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদের ডিভোর্স করিয়ে দিই।

এমন সময় হঠাৎ স্নেহার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। সে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে, অজ্ঞান হয়ে, আর চারপাশে চুপচাপ শোকের ছায়া নেমে আসে।

~~

হসপিটালে…!

সবাই করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। চাপা উত্তেজনা আর চিন্তার মিশ্রণে বাতাস ভারী হয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিরবতার পর, ডাক্তার বেরিয়ে আসেন। তাঁর পায়ের ধ্বনি করিডোরে প্রতিধ্বনিত হয়।

নেহার এগিয়ে এসে তীব্র উদ্বেগে প্রশ্ন করল, ডাক্তার, কী হয়েছে? ও হঠাৎ এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলো? কিভাবে?

ডাক্তার একটু ধীরভাবে নেহারের দিকে তাকালেন, তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, তেমন কিছু না। তিনি মা হতে চলেছেন। এই সময়ে এত বেশি মানসিক চাপ ও উদ্বেগ ওর জন্য ভালো নয়। মাথা ঘুরে যাওয়াই স্বাভাবিক।

সবাই স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মৃদু বিস্ময়ের সঙ্গে কেউ বলতে পারল না। নেহারের চোখ বড় হয়ে গেলো। কেবল ধীরে ধীরে বলে উঠল, মানে…প্র্যাগনেন্ট?

ডাক্তার হালকা হেসে বললেন, হ্যাঁ। এ সময় আপনারা ওর খেয়াল রাখবেন। চেষ্টা করবেন যাতে আর কখনও এমন কিছু না ঘটে। এখন ওর সবচেয়ে বেশি দরকার শান্তি আর যত্ন।

এরপর ডাক্তার চলে যান, আর করিডোরে এক অব্যক্ত বিস্ময় আর নীরবতা ভর করে। সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি চকিত, আনন্দমিশ্রিত অবাককামনা মাথায় ভাসতে থাকে।

নেহারের মনে অজানা আশঙ্কা আর মায়ার অনুভূতি একসাথে জেগে ওঠে। সে বুঝতে পারল, এখান থেকে আর আগের মতো কিছুই থাকবে না সবকিছুই বদলে গেছে।

নেহার কারো থেকে কিছু না শুনেই সরাসরি স্নেহার কেবিনের দিকে এগোয়। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, স্নেহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। তার চোখ লাল, কাঁদার চিহ্ন এখনও মুখে স্পষ্ট।

নেহার নিঃশব্দে কেবিনে ঢুকে পাশে বসে যায়। ধীরে ধীরে স্নেহার দুই হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে, কোমলভাবে বলল, কি হয়েছে, জান? এভাবে কেন কান্না করছিস? আমাদের ভালোবাসার প্রতীক আসছে আর তুই কান্না করছিস? এটা ঠিক নয়।

স্নেহার কাঁপা কণ্ঠে বলল, সবাই কেমন যেন বকাবকি করছে আমাদের বিয়ের কথা শুনে আর বাচ্চার কথা শুনে নিশ্চয় সবাই আরও রাগ করবে।

নেহার মৃদু হাসি দিয়ে তার চোখের গভীরে চোখ রেখে বলল, সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, এই মুহূর্তে শুধু তুমি শান্ত থাকবে। এসব ভাবনা, বকাবকি সব ভুলে যা। যদি তুই কাঁদিস, আমার মেয়ের কষ্ট হবে। তাই, আমি চাই তুই একদম কাঁদবি না।

স্নেহা ধীরে ধীরে কান্না থামাল। কাঁপা কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কিভাবে জানলেন আমাদের মেয়ে হবে নাকি ছেলে?

নেহার চোখে কোমল হাসি ফুটে উঠল। সে ধীরে ধীরে বলল, আমি জানি আমাদের মেয়েই হবে।

তারপর, নেহার স্নেহাকে আস্তে করে বসিয়ে কপালে গভীর চুম্বন দিল। স্নেহা চোখ বন্ধ করে সে চুম্বনের উষ্ণতায় মুড়ে যায়, যেন সময় থেমে গেছে।

নেহার তখন ধীরে ধীরে কপাল ঠেকিয়ে বলল, ধন্যবাদ, জান আমাকে এতো সুন্দর অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। আর জীবনের বেস্ট মুহূর্ত দেখানোর জন্য।

কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই নেহার স্নেহাকে আরও জড়িয়ে ধরে। স্নেহা আর কিছু বলে না। নিঃশব্দে, সে নেহারের বুকে মাথা রেখে থাকে, যেন এই মুহূর্তে সব কষ্ট, সব ভয় এবং সব চিন্তা বিলীন হয়ে গেছে।

নেহার চোখে একটি অদ্ভুত উষ্ণতা ভেসে ওঠে। সে স্নেহার চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে বলে, জান, আমি প্রতিজ্ঞা করছি এই ছোট্ট প্রাণের জন্য সব করব। যত কঠিন পরিস্থিতি আসুক, যত চ্যালেঞ্জই হোক আমি তোদের কখনও ছাড়ব না। তুই আর আমাদের মেয়ে সবসময় নিরাপদ রাখবো।

স্নেহা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, চোখে নতুন আশা আর বিশ্বাসের জল ঝলমল করছে।

নেহার হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে বলে, আমরা একসাথে আমাদের ছোট্ট পরিবারের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করব। প্রথম হাসি, প্রথম ধাপ, প্রথম শব্দ সবটাই আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। আর তুই জানিস তুই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের মেয়ের জন্যও তুই হবে সেই শক্তির প্রতীক।

স্নেহা নরম হাসি দিয়ে নেহারের বুকের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরে। মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব ভয়, সব দুশ্চিন্তা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

নেহার হাত ধীরে ধীরে স্নেহার গায়ের চারপাশে লেগে থাকে, যেন এই বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে। সে ফিসফিস করে বলে, আমাদের জীবন এখন শুধু আনন্দ, ভালোবাসা আর নতুন জীবনের জন্য। আমরা একসাথে সবকে মোকাবিলা করব। ঠিক আছে?

স্নেহা আবার মাথা নাড়ে। এই ছোট্ট সঙ্কেতেই নেহার মনে হয়, সব কথাই বলা হয়ে গেছে ভালোবাসা, অঙ্গীকার, এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।

নেহারের নিঃশ্বাস আর হৃদস্পন্দন সব মিলিয়ে যেন নতুন জীবনের মতো শান্তি এনে দিয়েছে। সেখানে শুধু তাদের দুইজন, তাদের ভালোবাসা এবং আগামীর ছোট্ট প্রিয়তম, এক অসম্ভব উষ্ণ মুহূর্তের সাক্ষী।

চলবে…..