#মৌয়ের_সংসার (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“আমাদের বাড়ির বউরা চাকরি করে না। চাকরিটা ছেড়ে দাও মৌ।”
পলাশের মুখে কথাটি শুনে মৌ ম্লান হাসে। অতঃপর ঠান্ডা স্বরে বলে,“স্যরি পলাশ। আমার পক্ষে চাকরি ছাড়া সম্ভব নয়। সম্পর্কের শুরুতে আমি তোমাকে বলে দিয়েছিলাম, আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করবো। বিয়ের পরও চাকরি করবো। তুমি তখন সবটা মেনেই আমার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলে।”
মৌয়ের কথা শুনে পলাশ নরম গলায় বলে,“দেখো মৌ। আমার তোমার চাকরি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বাবা, মা রাজি হবে না।”
“আচ্ছা।”
কথাটি বলে মৌ উঠে দাঁড়ায়। এটা দেখে পলাশ বিরক্ত হয়ে বলে,“আচ্ছা মানে?”
“তুমি তোমার পছন্দের মেয়ে খুঁজে নাও। আমার তোমার প্রতি কোন অভিযোগ নেই। হ্যাঁ মনের টানে আমরা একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছি। তাই বলে যে একে-অপরে স্বামী, স্ত্রী হিসাবে যোগ্য হবো তা নয়। সেজন্য তোমার অধিকার রয়েছে তোমার যোগ্য মেয়েকে খুঁজে নেওয়ার। তুমি সেটাই করো। আমার কোন অভিযোগ নেই। হ্যাঁ আফসোস রয়েছে, তোমার সঙ্গে এতটা বছর থেকে সময় নষ্ট করলাম।”
মৌয়ের মুখ থেকে এই কথা শুনে পলাশ রেগে যায়। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“তারমানে তুমি আমাকে ছাড়তে পারবে কিন্তু চাকরি নয়?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
পলাশের এই কথা শুনে মৌ যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় বলে,“বাসি। তবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করতে হবে এই শর্তে রাজি নই। সবার সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। আমারটা তেমন হয়েই নাহয় থাকবে।”
মৌয়ের স্বাভাবিক গলায় বলা কথাগুলো পলাশ নিতে পারে না। সে হতভম্ব হয়ে যায়। সে উত্তেজিত হয়ে বলে,“মৌ প্লীজ এমন করো না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।”
“আমিও চাই না। তবে হ্যাঁ আমাকে পেতে হলে তোমাকে আমার এই সত্তাটাকে মেনে নিতে হবে। তোমার জন্য আমি কোনকিছু ত্যাগ করতে পারবো না।”
“যারা চাকরি করে না সেসব মেয়েরা বুঝি ভালো নেই?”
এটা শুনে মৌ ম্লান হেসে বলে,“আছে। দেখো পলাশ সবার চাহিদা একরকম নয়। এই জগতে আমি যেটাকে খুব নগন্য ভাবি সেই জিনিসটা অন্যকারো কাছে খুবই মূল্যবান। যেসব মেয়েরা চাকরি করে না তারা যে ভালো নেই তা নয়। অবশ্যই ভালো আছে। সবাই তো খারাপ থাকবে না। আবার যারা চাকরি করে তাদের মাঝে যে কেউ খারাপ নেই তেমনটা নয়।”
একটু থেমে মৌ আবার বলে,“প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে স্বামী, সংসার খুব মূল্যবান। কেউ কেউ একটু সংসারের জন্য নিজের সমস্তটা ত্যাগ করে দেয়। তোমার হয়তো তেমন ঘরোয়া মেয়ে প্রয়োজন। তবে আমি তেমন নই। আমি ত্যাগ করতে পারবো না। তারমানে এটা নয় যে তুমি ভালো ঘরোয়া মেয়ে পাবে না। তোমাকে আমাকেই বিয়ে করতে হবে। এমনটা নয়। তুমি খোঁজো দেখবে খুব ভালো মেয়ে পাবে। ঘরোয়া, সাংসারিক।”
”মৌ?”
পলাশ চিৎকার দিয়ে উঠে। অতঃপর বলে,“খুব বেশি বুঝছো তুমি মৌ। সামান্য কারণে আমাদের তিন বছরের সম্পর্ক নষ্ট করে দিচ্ছো। এটা ঠিক করছো না মৌ। তুমি এভাবে আমাকে ঠকাতে পারো না।”
“স্যরি পলাশ।
তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কাউকে ঠকাচ্ছি না। বিয়ের ক্ষেত্রে তুমি যেমন তোমার এবং তোমার পরিবারের চাহিদা বলছো সেভাবেই আমিও আমার চাহিদা বলেছি। আর যদি বলো ঠকানোর কথা। তবে সেটা তুমি করছো। তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো। আমাদের সম্পর্কের শুরুতেই আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমি চাকরি করতে চাই। স্বাবলম্বী হতে চাই। তুমি সবটা মেনে নিয়েছিলে। কিন্তু আজ উল্টো কথা বলছো। এখানে কে কাকে ঠকাচ্ছে?”
মৌয়ের মুখে এই কথা শুনে পলাশ থেমে যায়। তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না। কারণ মৌ ভুল নয়। সে সব সত্যি কথা বলছে। মৌ এবার শান্ত গলায় বলে,“সব বাদ পলাশ। তুমি বাড়ি গিয়ে ভাবো। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করো। তোমার পক্ষে যদি একান্তই চাকরিজীবি মেয়ে বিয়ে করা সম্ভব না হয় তবে নিজের পছন্দ অনুযায়ী মেয়ে খুঁজে নাও। আর যদি সম্ভব হয় তবে অবশ্যই বিয়ের পর আমি চাকরি করবো এই শর্তটা মেনেই আমার সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে।”
”বয়স তো কম হলো না।
এই সময়ে এসে এত সামান্য কারণে আমাকে ছেড়ে দিয়ে তুমি আমার মতো কাউকে পাবে জীবনে? তোমার সংসারটা হবে বলে তোমার মনে হয়?”
পলাশের মুখে এই কথা শুনে মৌ ভেঙে পড়ে না। সে বিচলিত না হয়ে খুব শান্ত গলায় বলে,“স্যরি আমার তোমার মতো কাউকে প্রয়োজন নেই। আমার জীবনে যদি তোমার মতো কেউ আসেই তবে আমি তোমাকে না করছি কেন? আমার জীবনে তাকে প্রয়োজন যে আমার বিষয়টা বুঝে মেনে নিবে। আর হ্যাঁ সংসার হবে কি হবে না জানি না। তবে হলে অবশ্যই আমি সংসার জীবনে তাকেই জীবনসঙ্গী বানাবো যে আমার শর্তটা মেনে আমাকে ঘরে তুলবে। যতদিন এমন ছেলে না পাই ততদিন অব্দি তাকে খুঁজতে থাকবো। ভাগ্যে সংসার থাকলে পেয়ে যাবো না থাকলে পাবো না। এখানে তো আমার হাত নেই। আমি শুধু চেষ্টা করতে পারি।”
“তুমি বিষয়টা খুব জটিল করে ভাবছো মৌ।”
এটা শুনে মৌ মুচকি হাসি দেয়। সে মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“তুমি একটু বেশি সহজ করে ভাবছো।”
এটা বলে মৌ চলে যায়। পলাশ তাকে থামায় না। সে বুঝতে পারছে মৌ তার সিদ্ধান্ত থেকে এক বিন্দু সরবে না। পলাশের পরিবারও এমন মেয়ে মেনে নিবে না। তার উপর মা নেই। বাবা অন্য একজনকে বিয়ে করে আলাদা থাকছে। পলাশ মনেমনে বলে,“তুমি আমাকে ছেড়ে বড় ভুল করেছো মৌ। তোমার মতো মেয়েকে কোন পরিবারই মেনে নিবে না। সেখানে একটা কথা মানলেই আমি আমার পরিবারকে রাজি করাতে পারতাম। তুমি এমনটা করে ঠিক করলে না।”
____
“তুমি এই সামান্য কারণে তিন বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিলে?”
কাজলের কথা শুনে মৌ স্বাভাবিক গলায় বলে,“আমি কিছু শেষ করিনি। আমি শুধু আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। যেই সিদ্ধান্ত পলাশের পছন্দ হয়নি। তাই সে অন্যত্র পাত্রী দেখতে যাচ্ছে।”
“তুমি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতে, তুমি কেন চাকরি ছাড়তে চাও না। তাছাড়া এই যুগে অনেকেই তো চাকরি করছে। এখন এই…।”
কাজলকে থামিয়ে দিয়ে মৌ বলে,“আমার বাবা এবং সৎ মা আলাদা বাসায় থাকছে। আমি আলাদা জায়গায় তোমার সঙ্গে থাকছি। বলতে গেলে আমি অনাথের মতো রয়েছি। এটা জেনেও তার পরিবার রাজি হয়েছে, পলাশের জন্য এটাই গর্বের। সেখানে আমি চাকরিটা ছাড়তে পারবো না কেন? আমার এত ক্রটি তারা মেনে নিয়েছে। আর এখানেই সে আমার অযোগ্য।যেগুলো তারা আমার ক্রটি হিসাবে দেখছে সেগুলো কিন্তু আমার ক্রটি নয়। যারা শুরুতেই এত ক্রটি দেখছে তারা সারাজীবন ক্রটিই খুঁজে পাবে।”
একটু থেমে মৌ আবার বলে,“আমি আমার মায়ের মতো মহান নই। যে সারাজীবন শ্বশুড়বাড়িতে বাংলা সিনেমার সাবানার চরিত্রে অভিনয় করবো। এটা আমার দ্বারা হবে না। তখন দেখা যাবে তাদের আমার ছোট থেকে ছোট কাজে ভুল ধরা থেকে সংসারে অশান্তি সব মিলিয়ে আমি বিরক্ত হয়ে সম্পর্কের ইতি টানলাম। সেই সময়ে যদি আমার চাকরি না থাকে তাহলে আমি কোথায় যাবো? তখন তো যাওয়ার জায়গা খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়েই সাবানা হতে হবে। স্যরি আমি সেটা পারবো না। আমি এত ভালো নই। আমার মায়ের ভালো রূপটা দেখার পর থেকে আমার ভালো হওয়ার ইচ্ছাটা ম রে গেছে। কারণ দিনশেষে আমার মাকে মানিয়া আর মেনে নেওয়া নিয়েই জীবনটা দিতে হয়েছে। ম রার আগে অব্দি নিজের এক চিমটি শখ পূরণ করতে পারেনি।”
এটা বলতে মৌয়ের মুখটা মলিন হয়ে যায়। তার চোখেমুখে ফুটে উঠে বিষন্নতা। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে তার মায়ের করুণ মুখ। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“গৃহিনীরা সংসারের বহু কাজ করে। তবুও দিনশেষে তাদের শুনতে হয় তোমরা তো চাকরি করো না, তোমরা কিভাবে বুঝবে কত কাজ করতে হয়? অর্থাৎ তাদের কাজগুলো কাজ হিসাবেই মূল্যায়ন হয় না৷ হ্যাঁ মানছি অনেকে গৃহিনী হয়ে ভালো আছে। চাকরি না করেও সুখে আছে। তাদের স্বামীরা তাদের সেই সুখটা দিয়েছে। কিন্তু আমি তাদের দেখে বড় হইনি। আমি আমার মাকে দেখে বড় হয়েছি। যে সারাজীবন শুধু ত্যাগই করেছে। যার বিনিময়ে কেউ ভুলেও কখনো জানতে চায়নি, তুমি সুখী আছো? বছরে একটা ঈদে দুইটা শাড়ী, প্রতিদিন তিনবেলা খাবার দিলেই তো হয়। তাহলেই তো তারা সুখী। আমি আমার সেই মাকে দেখে বড় হয়েছি। তাই আমার কাছে সংসারটা এমনই। সেজন্য চাকরি ছেড়ে আমি বিয়ে করবো না। সে যতই ভালোবাসার হোক না কেন।”
’
’
চলবে,