#মৌয়ের_সংসার (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
কাজল মৌয়ের বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে তার অনুভূতি। মৌয়ের স্থানে দাঁড়িয়ে তার সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু এত সহজ সব সম্পর্কের ইতি টানা। বিষয়টি বলতে মৌ বলে,“সব সম্পর্কের ইতি টানা সহজ নয়। আমি তো ইতি টানছি না। ভালোবাসাটা থাকবে। মনের কোনে কোথাও না কোথাও থাকবে। তবে হ্যাঁ এটার পূর্ণতা হচ্ছে না। এজন্য অবশ্য আফসোস থাকবে। তবে আমি বিশ্বাস করি পরবর্তীতে যে জীবনে আসবে সে আমার সব আফসোস দূর করে দিবে।”
একটু থেমে মৌ আবার বলে,“যদিও আমি সম্পর্কের পূর্ণতার কথা ভেবেই জড়িয়েছিলাম। এখন কোন কারণে সেটা নাহলে সবটা তো মেনে নিতেই হবে।”
এটা বলে মৌ গভীর ভাবনায় পড়ে যায়। তার স্মৃতিতে নিজের মায়ের করুণ মুখটা ভেসে উঠে। সেটা মনে করে সে আপনমনে বলে,“মা সহ্য করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতো তখন সবাই বলতো, প্লীজ মানিয়ে নাও। তোমার শাশুড়ী বুড়ো মানুষ বাঁচবে কতদিন? একটু কথা শোনালে শুনে নাও। দিনশেষে আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দাদীর আগেই মা রা গেল। তারপর অবশ্য আমার বাবা তার মায়ের সেবা করার জন্য, আমার দেখাশোনা করার জন্য আবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু দাদী তার সঙ্গে খারাপটা করতে পারেনি৷ আমার বাবাও আমাকে মাকে যা দেয়নি সেইসব তাকে দিয়েছে। এখানে আমি তার দোষ দিবো না। আমার সৎ মায়ও একটা সংসারে সাবানা হতে হতে ক্লান্ত হয়ে জীবন পার করে, অবশেষে লাথি গুতা খেয়ে বিতারিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। সে বুঝে গেছেন, সাবানা হয়ে টিকে থাকা যায় না। টিকে থাকা গেলেও নিজেকে সুখী করা যায় না। তাই সে বাবার থেকে তার অধিকার বুঝে নিয়েছে। এখানে তার দোষ নেই। তবে আমি এখনো যখন বাড়ি যাই বাবা আর সৎ মায়ের ঘনিষ্ঠতা কেন জানি মেনে নিতে পারি না? তাই তো বহুদিন হয়ে গেল বাসায় যাই না। বাবা ডাকে কিন্তু আমার ইচ্ছা করে না।”
“থাক না এসব কথা। যেসব কথা বললে কষ্ট বাড়বে সেসব নাই বা বললা।”
কাজলের কথা শুনে মৌ উপহাসের হাসি দেয়। সে কিছুটা হেসেই বলে,“পৃথিবীর কোন কষ্ট মায়ের মৃ ত্যুর চেয়ে বেশি হয়? হয় না। আমি আমার সেই মাকে ম রতে দেখেছি। সেই কষ্টটা যখন সহ্য করে নিয়েছি তখন এসব কিছুই নয়। তাই তো এত বছরের ভালোবাসাও আমাকে কষ্ট দিতে পারছে না।”
এটা শুনে কাজল ভীষণ অসহয় চোখে তার দিকে তাকায়। তার বেশ অপরাধবোধ হয়। দু’জনে একই স্থানে চাকরি করার সুবাদে একই সঙ্গে থাকে। কাজলের বাসা অন্য শহরে। এখানে এসেই মৌয়ের সঙ্গে পরিচয়। বন্ধুত্ব। মৌয়ের তেমন কেউ না থাকায় সে সব কথাই কাজলের সঙ্গে শেয়ার করে। তবে কাজলের অপরাধবোধ হওয়ার কারণ ভিন্ন। মৌয়ের দুঃখের কথা শুনলে তার মনে পড়ে যায়, সে মৌয়ের সামনেই তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কতটা আনন্দের সঙ্গে কথা বলে। মজা করে। এসব তো মৌয়ের নেই। তাই সে কষ্ট পায় হয়তো। সেটা ভেবেই কাজলের খারাপ লাগছে।
কাজল এসে মৌয়ের পাশে বসে। তার কাধে হাত রাখে। মৌ কিছুটা কেঁপে উঠে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে কাজলকে জড়িয়ে ধরে। বুকের মধ্যে কান্না চেপে রেখে বলে,“আমার সৎ মা আসার পর আমার দাদী তার ভুলটা বুঝতে পারে। তার মনে হয় আমার মা ভীষণ ভালো ছিলো। অথচ আমার মা বেঁচে থাকাকালীন তার এসব মনে পড়েনি। একটু অনুশোচনা হয়নি। যাই হোক ম রার আগে তো বুঝেছে। তবে আজও আমার চোখে মায়ের সেইসব স্মৃতি মনে পড়ে। মা তলপেটে ব্যথা নিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করেছে। কাজ শেষে সামান্য একটু সময় শুয়ে থাকায় তাকে কত কথা শুনতে হয়েছে। আমার দাদী তো বলতো, ননীর পুতুল, অল্পে ভেঙে পড়ে। কি এমন অসুস্থতা? বাবাও বলতো এসব কোন অসুখ। অতঃপর আমার মা তার সব ব্যথা লুকাতে শুরু করলেন। অভিমানে অসুস্থতাকে আড়াল করলেন। ধীরে ধীরে মরনব্যধী বানিয়ে ফেললেন। এসব কথা মনে পড়লে পৃথিবীর সব দুঃখই দুঃখ মনে হয় না। আমার মা মৃ ত্যুর আগে নিরবে চোখের পানি ফেলতেন। তার সেই চোখের পানিতে কত কত কষ্ট লুকিয়ে যে রয়েছে সেটা আমি জানি। আমি বুঝি।”
এটা বলে মৌ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। উচ্চশব্দে কান্না করতে থাকে। কাজল তাকে সামলানোর চেষ্টা করে। সে খুব শান্ত গলায় বলে,“তুমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নাওনি মৌ। তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। ভুল তো আমরা করি। আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ না করে আমরা ভালোবাসার জন্য পাগল হয়ে যাই। অতঃপর ভালোবাসার মানুষ অবহেলা করে দূরে ঠেলে দিলে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারি। সেখানে দাঁড়িয়ে তোমার সিদ্ধান্ত যথার্থ। তোমার কোন ভুল নেই মৌ।”
মৌ ধীরে কান্নার শব্দ থামিয়ে দেয়। সে নিজের আবেগ আবারও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। তার কান্নার মাঝে যে শুধু মায়ের কষ্টটা নয়, সেই সঙ্গে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণাও রয়েছে সেটা কাজল বুঝতে পারে। তাই তো ঐ কথাটি বললো। মৌ এটা বুঝতে পেরে খুশি হয়। মানুষ যতই কঠিন হোক না কেন? এমন কিছু মূহুর্তে তার সত্যি অন্যকারো সান্ত্বনার প্রয়োজন পড়ে। কাজল মৌয়ের মাথাটা উপরে তুলে তার চোখের পানি মুছে দেয়। অতঃপর বলে,“তোমার মা জীবনে আর যাই করুক না কেন, তোমাকে তিনি সঠিক শিক্ষায় বড় করেছেন।”
মৌ জবাব দেয় না। সে শুধু তার মায়ের মুখটা কল্পনা করে। শেষ সময়ে তার মায়ের বলা কথাটি আজও তার কানে বাজে। সে বলেছিলো,“মা ম রা মেয়েদের জীবনটা খুব কঠিন হয়। আমি চাইনি তোকে কখনো ছাড়তে মা। কিন্তু ভাগ্যের উপর কারো হাত নাই। তবে হ্যাঁ আমার মতো ভুল করিস না। আমার জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন? দুঃখের কথা বলার জন্য অন্তত মায়ের কোলটা পেয়েছিলাম। তোর কিন্তু সেটা নেই। তোর মা তো তোর সঙ্গে থাকতে পারবে না।”
এটা শুনে মৌ তার মায়ের মুখে হাত দিতো। কান্না করে বলতো,“বারবার কেন একই কথা বলো। তুমি থাকবে না মানে? তুমি কোথায় যাবে? তুমি তো সারাজীবন আমার সঙ্গেই থাকবে।”
মৌয়ের আজও সেই কথাগুলো মনে পড়ে। তার মনে হয় তার কথাই সত্যি। তার মা তার সঙ্গে আছে। সে দূরে যায়নি৷ যদিও এটা নিছকই মৌয়ের অবচেতন মনের কল্পনা, ভ্রম। তবুও সে খুশি। থাকুক না জীবনে এমন কিছু ভ্রম। ক্ষতি নেই তো।
____
পলাশ বিয়ের জন্য পাত্রী নির্বাচন করে মৌকে ফোন দেয়। সে মৌকে উদ্দেশ্য করে বলে,“এখনও সময় আছে মৌ। আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি চাই না আমার জীবনে অন্য কেউ আসুক। তোমাকে শুধু চাকরিটা ছাড়তে হবে। আর তো কিছু না। তোমার মাসিক যত হাত খরচ সব আমি দিবো। তোমার সব শখ পূরণ করবো। প্লীজ রাজি হয়ে যাও।”
“যদি আমাকে এতটাই চাইতে তবে বিয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলে নির্লজ্জের মতো ফোন দিয়ে এসব বলতে পারতে না।”
মৌয়ের কঠিন গলার কথাটি শুনে পলাশ রেগে যায়। সে চিৎকার দিয়ে বলে,”মৌ?”
“ভুল বললাম।
তুমি যেমন ভাবছো আমি খুবই সামান্য বিষয়ে তোমাকে ছাড়ছি তেমন আমারও মনে হয় তুমিও খুবই সামান্য বিষয় নিয়ে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ে বিয়ে করছো। তুমি চাইলে এই বিষয়টা এডজাস্ট করতে পারতে।”
“আমি তো রাজিই। আমার বাবা, মা রাজি নয়।”
এটা শুনে মৌ হাসে। সে হাসি মুখেই বলে,“প্রেম করার সময় বাবা, মায়ের অনুমতি নেওয়ার কথা মনে ছিলো না। তখন অনুমতি নিলে এই সমস্যা হতো না। যাই হোক কোন অভিযোগ নেই। নতুন জীবনে সুখী হও৷”
“ভুল করছো মৌ।
আমাকে ফিরিয়ে না দিলে অন্তত তোমার একটা সংসার হতো। ফিরিয়ে দিয়ে তুমি তোমার স্বপ্নের সংসারটা হারাচ্ছো। কারণ এই সমাজে তোমার মতো যারা চাকরি করে স্বামীকে নিজের পায়ের তলায় রাখতে চায় সেই মেয়ের সংসার হয় না। তোমারও সংসার হবে না।”
এটা শুনে মৌ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,“মেয়েরা চাকরি করলেই যে স্বামীকে মূল্য দিবে না এই ভাবনাটা ভাবছো বলেই আজ আমাদের পথ আলাদা হচ্ছে। দেখো এই সমাজে সব নারী পুরুষ সমান নয়। সবাই ভালো নয়। খারাপ ছেলেও আছে মেয়েও আছে। তাই বলে খারাপটা ভেবে সবসময় সিদ্ধান্ত নিবো এমনটা করা উচিত নয়। যাই হোক তোমার কথা শুনে এবার মনে হচ্ছে আমি অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবার তুমি আমার কথায় রাজি হলেও আমি তোমায় বিয়ে করবো না পলাশ। কারণ আমাদের পথ এক হওয়ার নয়। আমি বলছি না তুমি খারাপ। আমি শুধু এটাই বলছি তুমি আমার যোগ্যতার নও। যেমন আমি তোমার যোগ্যতার নই।”
একটু থেমে মৌ আবার বলে,“আর কখনো যোগাযোগ করো না। সেই সঙ্গে আমার সংসার হলে অবশ্যই আমি তোমাকে জানিয়ে দিবো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। মৌয়ের সংসার হোক বা না হোক তোমারটা যেন হয়। তুমি সুখী সংসার সাজাও। এটাই চাই। ভালো থাকবে।”
এটা বলে মৌ ফোনটা কাটে। সে জানে সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে হয়তো তার পলাশকে ফিরিয়ে দেওয়াটা ভুল। তবে তার কাছে এটা ভুল নয়। পলাশ বিয়ের আগেই তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, তার মা নেই। সে একা মানুষ। বাবা যে আছে সে বিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করবে। এমন মেয়ে কে বা বিয়ে করবে? বিয়ের আগে এত কথা উঠলে পরে আরও উঠবে। তাই মৌয়ের কাছে এটা ভুল নয়। সে যা করেছে তা সঠিক। তাতে নাই বা হলো তার সংসার গড়া। তবে হ্যাঁ সংসার হলে সেটা অবশ্যই তেমন ছেলের সঙ্গে হবে। যার সঙ্গে কাটালে মৌ হাসিমুখে বলতে পারবে, এটা মৌয়ের সংসার।
’
’
চলবে,