#মৌয়ের_সংসার (৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“আমারও আপনাকে ভালো লাগল। আমরা বোধহয় কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।”
মৌয়ের কথাটি শুনে পিয়াস খুশি হয়ে যায়। সে খুশি মনে মৌয়ের দিকে তাকায়। মৌ শান্ত গলায় বলে,“তবে হ্যাঁ, অনেকে বিয়ের আগে অনেক কথাই বলে বা দেয়। কিন্তু বিয়ের পর রাখতে পারে না। আমি চাইবো আপনার কথাগুলো মিথ্যা না হোক।”
“বিয়ের পর একজন পুরুষ মানুষের কাধে অনেক দায়িত্বের ভার থাকে। সেজন্য হয়তো সবদিক সামলানো সম্ভব হয় না।”
পিয়াস কথাটি বলে আরও কিছু বলতে নিলে মৌ বলে উঠে,“জানি। আমি আমার বাবাকে দেখেছি। কিন্তু হ্যাঁ সে দুইদিক সামলাতে পারেনি। তাই আমার মায়ের দিকটা বাদ দিয়ে দিয়েছে। আমি সেটা চাই না। আমি চাই আমার জীবনে যে আসবে সে অন্তত চেষ্টা করুক দুইদিক সমানভাবে সামলানোর। এতটুকু আশা নিশ্চয় জীবনসঙ্গীর থেকে করতে পারি?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়।”
এটা বলে পিয়াস মাথা নাড়ায়। মৌ নিজ থেকে বলে,“আমার একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্ক কয়েক মাস পূর্বে শেষ হয়ে গিয়েছে।”
“এসব বলার প্রয়োজন নেই। সবার জীবনেই অতীত থাকে। অতীত নিয়ে পড়ে না থাকাই ভালো।”
এটা শুনে মৌ মাথা নাড়িয়ে বলে,“তবুও সবটা বলে নেওয়া ভালো। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে যাতে সমস্যা না হয়।”
“আপনি তাকে এখনো ভালোবাসেন?”
পিয়াসের এই প্রশ্ন শুনে মৌ থেমে যায়। তার মনে পড়ে যায় পলাশের কথা। শান্ত গলায় বলে,“হয়তো। কিন্তু হ্যাঁ বিয়ে খুব পবিত্র বন্ধন। যুগ যুগ ধরে পারিবারিকভাবে বিয়ে করে মানুষ গভীর প্রেমে পড়েছে। একে-অপরকে ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে ধরেছে। এখানে হয়তো ভালোবাসাটা বিয়ে পড়ানোর পর অটোমেটিক জন্ম নেয়। তাই আমার মনে হয় এই বিয়ের পর আমার মনের ঐ ভালোবাসাও চলে যাবে। তাছাড়া বিয়ের পর আমার স্বামী যাতে না ঠকে সেটা আমি শতভাগ নিশ্চিত করবো। এতটুকু আশ্বাস আমি দিতে পারি।”
“আপনার কথাগুলো খুব সুন্দর মৌ।
আমি জানি না, আমি আপনার সব চাওয়া পূরণ করতে পারবো কি-না। তবে চেষ্টা করবো।”
এটা শুনে মৌ পিয়াসের দিকে শান্ত চোখে তাকায়। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলে,“সব চাওয়া পূরণ করতে হবে না। এই জগতে কারো সব চাওয়া পূরণ করা যায় না। তবে হ্যাঁ চেষ্টাটাই করবেন প্লীজ।”
একটু থেমে আবার বলে,“মেয়ে মানুষকে খুশি করা খুব সহজ। আপনার নূন্যতম চেষ্টা দেখলেই সব না পাওয়ার যন্ত্রণা মুছে যাবে। জীবনে আক্ষেপ থাকবে না। একজন স্ত্রী তার স্বামীর থেকে বোধহয় আর বেশি কিছু চায় না। অনেকে হয়তো চায় তারা ব্যতিক্রম।”
“হুম চেষ্টা করবো। তবে একপাক্ষিক চেষ্টায় কিন্তু কোনকিছু হয় না।”
“জানি। একজন সারাজীবন চেষ্টা করে যাবে আর অন্যজন সেটায় মজা নিবে এমনভাবে হয় না আসলে। দুজনার প্রতি দুজনার একইরকম গুরুত্ব থাকা জরুরি।”
পিয়াস মাথা নাড়ায়। মৌ যে খুব বুদ্ধিমতী সেটা সে বেশ ভালো বুঝতে পারে। মৌ ধীরে ধীরে জীবনের সব কথাই বলে। যে কথাগুলো বিয়ের আগে বলে নেওয়া উচিত। পিয়াসও তার কিছু কথা বলে। অবশেষে মৌ বলে,“আমার মা নেই। এটা আমার দূর্বলতা নয়। আমি চাইবো, আপনি এটাকে কখনো দূর্বলতা না ভাবুন। একই সংসারে অনেকগুলো বছর পার করলে একটু তর্ক, বিতর্ক হবেই। দোষ, ভুল সবার থাকতে পারে। আমরা কেউ ভুলের উর্ধ্বে নই। তবে সেই তর্কে কখনো এমন কোন শব্দ না আসুক যে তোর তো মা নাই তুই কিভাবে আদব কায়দা শিখবি? বা অন্য কিছু। অর্থাৎ এমন কোন বাক্য চাই না যেটা দ্বারা বোঝাবে আমার মা নেই এটা আমার দূর্বলতা। মাকে জড়িয়ে বলা কথায় আমার হৃদয়ে সহজে আঘাত করা যাবে সেটা ভেবে কথা বলা যাবে না।”
একটু থেমে আবার বলে,“রাগ হতেই পারে। তবে সেই রাগের একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকা জরুরি। এটা আমার শর্ত নয়। আমার অনুরোধ। আমার জীবনসঙ্গী আমাকে এমন কোন কথা বলবে না, এটাই আমি আশা রাখি।”
পিয়াস মাথা নাড়ায়। অতঃপর তারা দুজনে কথা শেষ করে। পিয়াসের পরিবার মৌকে আংটি পড়িয়ে চলে যায়। এবার দুই পক্ষ বসে বিয়ের দিন ঠিক করবো। পিয়াসের পরিবার চলে যেতে মৌয়ের কাছে তার বাবা আসে। শান্ত গলায় বলে,“এখন থেকে বিয়ে অব্দি এখানে থাকা যায় না? এখান থেকে অফিসে যাও। যদি কোন সমস্যা না হয় তোমার।”
এটা শুনে মৌ শান্ত গলায় বলে,“আচ্ছা ভেবে দেখবো।”
”এটা বাবা হিসাবে অনুরোধ।
আশা করি এতটুকু অনুরোধ রাখা যায়।”
বাবার এই কথা শুনে মৌ ম্লান হাসে। তার বাবা শান্ত গলায় বলে,“আমার উপর খুব অভিমান, তাই না?”
“না।”
এটা বলে মৌ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারা বাবা মলিন গলায় বলে,“আমি তোমার মাকে ভালোবাসতাম না এমন নয়। তাকে খুব ভালোবাসতাম। তবে হ্যাঁ আমি আমার ভালোবাসাটা সেভাবে কখনো মানুষের সামনে প্রকাশ করতে পারিনি।”
“জানি। আপনার মতো যারা মাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে তাদের চোখে বউয়ের প্রতি ভালোবাসাটা প্রকাশ পায় না। মা এবং বউকে যেখানে একত্রে সামলানো উচিত ছিলো বা খুশি করা উচিত ছিলো। সেখানে ঝামেলা যাতে কম হয় তাই মাকে খুশি করে বউকে কষ্ট দেওয়াটা আপনারা যথার্থ মনে করেন। বউ এবং মায়ের দ্বন্দে দোষটা যারই থাক, বউকে চুপ করানো বা গায়ে হাত তুলে থামিয়ে দেওয়াটা সহজ। কারণ ওটা বউ। সে কখনো ছেড়ে যাবে না। কিংবা রাতে একান্তে বুঝিয়ে নেওয়া যাবে। মাকে তো সেটা করা যাবে না। মা জন্ম দিয়েছে। তার চোখে পানি দেখলে সহ্য হবে না।”
বাবা অবাক চোখে মৌয়ের দিকে তাকায়। মৌ শান্ত গলায় আবার বলে,“মায়ের চোখে পানি দেখতে না চাওয়া ভুল নয়। সন্তান হিসাবে এই চাওয়া যথার্থ। কিন্তু বউকে কাঁদিয়ে মায়ের মুখে হাসি ফোটানোটা অন্যায়। তাও যদি মেনেও নেই যা করেছেন বাধ্য হয়ে। কিন্তু হ্যাঁ আমার মনে হয় একান্তে যেভাবে আমার মাকে বুঝিয়েছেন, মা বুড়ো মানুষ ভুল করে মাফ করে দাও। সেভাবে কখনো মাকে বোঝাননি, মা ও ছোট মানুষ। সব ভুল ধরতে নেই। আলাদা করে মাকে চাইলে বোঝাতেই পারতেন। হ্যাঁ একটু হয়তো বউয়ের গোলাম কথাটা শুনতে হতো। এই সামান্য কথাটা শুনলে খুব খারাপ বেশি খারাপ হতো না।”
এটা বলে মৌ শান্ত চোখে তার বাবার দিকে তাকায়। বাবা মলিন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মৌয়ের কথা মিথ্যা নয়। এসব এখন মৌয়ের বাবা ঠিক বুঝে। তবে সময়ের সময় বুঝতে পারেনি। তার স্মৃতিতে আজও ভেসে উঠে। তার প্রিয়তমা স্ত্রী যখন পেটের ব্যথায় রাতে ছটফট করেছে। ঘুমাতে পারছিলো না। সেই সময়ে কাতরাতে কাতরাতে বলছিলো,“একটু গরম পানি করে নিয়ে আসবে। একটু গরম পানির ছ্যাক দিলে ভালো লাগতো।”
তখন তিনি এক বাক্যে বলেছিলেন,”গরম পানি করবো আমি? ছাড়ো তো। আমাকে এই কাজ করতে দেখলে মা কী ভাববে? ভাববে আমি তোমার চাকর। খুব লজ্জাজনক।”
একটু থেমে আবার বললেন,“পেট ধরে বসে থাকো। ব্যথা কমে যাবে।”
এটা বলে দ্বায় সারতেন। অথচ সেদিন তিনি চাইলেই পারতেন স্ত্রীর সেবা করতে। এসব দেখে মেয়েটা বড় হয়েছে বলেই আজ একরোখা। তবে তাতে তার দুঃখ নেই। সমাজ একরোখা বললেও এই জগতে তার মতো স্বামী যার কপালে জুটে তাকে একরোখাই হতে হয়। নয়তো স্বামীর থেকে নিজের অধিকার বুঝে পাওয়া যায় না। এসব ভেবে মৌয়ের বাবা মৌয়ের মাথায় আলতো করে হাত দিয়ে বলে,“তুই সুখী হ এটাই আমার চাওয়া। আমি হয়তো খুব খারাপ মানুষ। তবে তোর খারাপ চাই না। তুই তো সন্তানটা আমারই।”
মৌ মাথা নাড়ায়। কোন জবাব দেয় না। তার বাবা আবারও বলে,“তোর হয়তো খারাপ লাগে তোর নতুন মায়ের সঙ্গে আমার আহ্লাদীপনা দেখে। আসলে পুরুষ মানুষ থাকতে মূল্য দিতে জানে না। তোর মাকে মূল্য দিতে পারিনি বলেই তো তাকে দিচ্ছি। ভুল বুঝতে পেরে তাকে সুখী রাখার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ অবশ্য আফসোস হয়। খুব আফসোস হয়। তোর মা থাকতে তাকে এই সুখ দিতে পারিনি।যেটা তার প্রাপ্য ছিলো সেটা অন্য কাউকে দিচ্ছি।”
“কারো প্রাপ্যই কাউকে দিচ্ছেন না। নতুন মায়ের এটা প্রাপ্য। সে যেটা পাচ্ছে সেটা তার পাওয়ার অধিকার আছে। হ্যাঁ অন্য কারোরও এই অধিকার ছিলো কিন্তু সেটা দেননি। তারমানে এটা নয় যে অন্য কেউ অর্থাৎ আমার মায়ের সেই অধিকার নতুন মাকে দিচ্ছেন। বরং আপনি তাকে সেটাই দিচ্ছেন যেটা সে স্ত্রী হিসাবে আপনার থেকে পায়।”
মৌয়ের এই কথা শুনে বাবা ম্লান হাসে। মেয়েটা বড্ড বুঝদার। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মৌয়ের এই কথাটা শুনে তার সৎ মায়ও খুশি হয়। মৌ মেয়েটা তাকে কখনো নতুন মা বা কিছু বলে সম্মোধন করেনি। তাকে কখনো মেনেই নিতে পারেনি। সেখানে আজ কথার ছলে হলেও নতুন মা বলেছে। সেই সঙ্গে সে হিংসা করছে না তাকে। তার সৎ মা তার বাবার থেকে যে ভালোবাসা পায় সেটা পাওয়ার যোগ্য সে। এটা যে সে মানে এটা শুনেই তার ভালো লাগে। এতদিন ভাবতো মৌ বুঝি তার এই সুখ সহ্য করতে পারে না। হিংসা করে। তার ধারণা ভুল বুঝতে পেরে মেয়েটার উপর তার থাকা কিঞ্চিৎ রাগটা বিলীন হয়ে যায়।
’
’
চলবে,