মৌয়ের সংসার পর্ব-০৫

0
2

#মৌয়ের_সংসার (৫)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

কেটে গেল বেশ কিছু সময়। মৌ তার বাবার কথা রাখেনি৷ এতদিন সে কাজলের সঙ্গেই ছিলো। তবে বিয়ের বাকি সাতদিনের মতো, সেই সময়ে সে কাজলকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি আসে। বিদায়ের সময় অবশ্য কাজল খুব মন খারাপ করছিলো। মৌ তার মন ভালো করার জন্য বলে,“মন খারাপ করো না। আমার কথা যখনই মনে পড়বে তখনই ফোন করো।”

“এবার তো তোমার বিয়ে হয়ে যাবে।
চাকরি, সংসার সব সামলে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তোমার হবে?”
কাজলের এই প্রশ্নে মৌ ম্লান হাসে। হাসিমুখেই বলে,“চেষ্টা করলে সব সম্ভব। তুমি আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। তোমার সঙ্গে যতটা সময় আমি কাটিয়েছি, এটা আমার জন্য খুব ভালো সময়। আমি এই সময়ের কথা অবশ্যই মনে রাখবো। সেই সঙ্গে চেষ্টা করবো সবসময় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার। তাছাড়া সমস্যা কোথায়, আমরা তো একসঙ্গে একই অফিসে কাজ করি। আমাদের দেখা হয়েই যাবে।”

কাজল মাথা নাড়ায়। সে উপদেশের ভাষায় বলে,“আমি জানি তোমার চিন্তা ধারা সুন্দর। তবুও বলছি, বিয়ে হয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাবে। সেখানে কিছুটা নিজেকে মানিয়ে নিও। মেয়ে মানুষের শ্বশুড়বাড়িতে গেলে একটু ভাঙতেই হয়। এটাই নিয়ম। এটাই সংসার ধর্ম।”

“হ্যাঁ। আমি ভাঙবো না বা মানিয়ে নিবো না এমন চিন্তা করি না। অবশ্যই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু হ্যাঁ মানিয়ে নেওয়া আর সারাজীবন নিজের প্রতি অন্যায় সহ্য করা এক নয়। আমি ততক্ষণ অব্দি মানাবো যতক্ষণ অব্দি ওপর পাশের মানুষটি আমাকে তুচ্ছ মনে না করে।”
এটা বলে মৌ মুচকি হাসি দেয়। কাজলও হাসি দেয়। সে মৌকে জড়িয়ে ধরে।মৌ শান্ত গলায় বলে,“আমার বিয়েতে অবশ্যই দু’দিন আগে আসবে। আমি তোমার অপেক্ষা করবো কাজল।”

“আমি অবশ্যই যাবো।
যাই হোক খুশি থেকো। আমি তোমার জন্য সবসময় দোয়া করি। তুমি খুব ভালো থাকবে আশা করি।”
কাজলের কথায় মৌ মাথা নাড়ায়। তার সঙ্গে পিয়াসের এই ক’দিনে ভালোই আলাপ হয়েছে। পিয়াসের কথাবার্তা তাকে মোটেও খারাপ মানুষ মনে হয় না মৌয়ের। সেই ভরসায় মৌ বলে,“অবশ্যই ভালো থাকবো। আশা করি জীবনে ভুল মানুষকে বেছে নেইনি।”
কাজল মাথা নাড়ায়। মৌ তাকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে আসে।

____

মৌ বাড়ি আসায় তার বাবা ভীষন খুশি হয়। সে মৌয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। তবে মৌ তেমন গুরুত্ব দেয় না৷ মৌয়ের চোখে তার বাবা স্পষ্ট তার জন্য রাগ, ঘৃণা দেখতে পায়। নিজের মেয়ের চোখে রাগ, ঘৃণা দেখলেই তার মনে পড়ে যায় তার স্ত্রীকে সে কত কষ্ট দিয়েছে।আজ সে অনুশোচনার আগুনে পুড়লেও সঠিক সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকতে পারেনি। এজন্য বলে সময় থাকতে মূল্য দিতে হয়। তবুও সবকিছু ভুলে মৌয়ের বাবা মেয়ের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। যতটা সময় আছে, মেয়েকে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ মৌয়ের সৎ মায়ও তার সঙ্গে বেশ ভালো আচরণ করে।

দেখতে দেখতে বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসে। পিয়াস এবং মৌ দু’জনেই এই বিয়েতে খুশি। এতদিনের পরিচয়ে তাদের মনের কোনে খুব সুন্দর এক অনুভূতির জন্ম হয়েছে। তাই বিয়ে যত দ্রুত এগিয়ে আসছে ততই তাদের ভেতরে ভালো লাগা কাজ করছে।

বিয়ের আগের দিন রাতে মৌয়ের বাবা তার কাছে এসে তার পাশে বসে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,“কাল থেকে তোমার নতুন জীবন শুরু। আশা করি তোমার এই জীবনটা খুব সুখের হবে। তবে হ্যাঁ যদি কখনো মনে হয় তুমি ওখানে তোমার মায়ের মতোই যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছো তবে ওখানের মাটি কামড়ে পড়ে থেকো না। তুমি তৎক্ষনাৎ আমার কাছে চলে এসো। মনে রেখো তোমার বাবা তোমার পাশে আছে।”

“এতটা গভীরে না গিয়ে আপনি এই দোয়া করুন আমি যাতে ওখানে ভালো থাকি। আমার সংসারটা সারাজীবন সুখে শান্তিতে এগিয়ে যাক। আমার স্বামী যেন আপনার মতো না হয়।”
মৌয়ের এই কথাটা তার বাবার জন্য শোনা কষ্টকর হলেও সে মানিয়ে নেয়। সে মেয়ের জন্য সেই দোয়াই করে। পৃথিবীর সব বাবাই চায় তার মেয়ে সুখী থাকুক। তার জীবনটা সুখে শান্তিতে ভরে উঠুক। সেদিন বেশ রাত অব্দি বাবা, মেয়ে গল্প করে৷ মৌ যদিও কম কথা বলছিলো। তবে তার বাবার কথা শুনছিলো। সে বাবাকে আজ আর কষ্ট দিলো না। তাই মন দিয়ে তার গল্প শুনতে থাকে। তার বাবা তার জন্মের সময় ভীষণ খুশি হয়েছিলো। প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি অন্যরকম। মৌয়ের বাবা সেই গল্প করতে গিয়ে তার স্মৃতিতে মৌয়ের ছোটবেলা ভেসে উঠে। সে আবেগে কান্না করে দেয়। মৌ তার বাবার ভালোবাসা দেখে অবাক হয় না। সে জানে তার বাবা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। তার ভালোবাসা মিথ্যা নয়। সেও তার বাবাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। তবে মেয়ে তো। মেয়েদের একটা খুব কমন রোগ হলো, তার মা যার জন্য কষ্ট পায় সে তাদের দেখতে পারে না। মনের কোথাও তার জন্য তার হৃদয়ে একটু হলেও চাপা রাগ জন্ম নেয়। তার বাবা যতই ভাবুক সে তাকে ঘৃণা করে। কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। সে তার বাবাকে ঘৃণা করে না। তবে মনের কোনে চাপা রাগ জন্মে রয়েছে। এসব ভেবে মৌ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

___
দেখতে দেখতে মৌয়ের বিয়ে হয়ে যায় পিয়াসের সঙ্গে। না তাদের বিয়েতে আর কোন বাঁধা পড়েনি। খুব সুন্দরভাবে বিবাহর কাজ সম্পন্ন হয়। বিয়ে শেষে সবাইকে বিদায় জানিয়ে মৌ শ্বশুরবাড়িতে পা রাখে। এখানে তাকে খুব সুন্দরভাবে বরণ করে নেওয়া হয়। অতঃপর সেই কাঙ্ক্ষিত রাতটি আসে। যে রাত নিয়ে কম বেশি সব ছেলে, মেয়েই স্বপ্ন দেখে। খুব রঙীন স্বপ্ন। বাসর ঘরে বসে মৌ তার স্বপ্নের কথাই ভাবছিলো। তার ইচ্ছা, তার একটা সংসার হবে। যেই সংসারে তার সব ভুলক্রটি নিয়ে পিয়াস তাকে ভালোবাসবে। সেও পিয়াসকে একইরকম ভালোবাসবে। একে-অপরের হাত ধরে দু’জনে পূর্ণতা পাবে। মৌ ঘরে বসে এসব কথা ভাবছিলো। সেই সময়ে দরজা খুলে পিয়াস ঘরে আসে। সে দরজা বন্ধ করে মৌয়ের কাছে আসতে মৌ কেঁপে উঠে। পরক্ষণে সে নিজেকে সামলে নেয়। সে পিয়াসের দিকে তাকায়। বাসর ঘরে পিয়াসের প্রথম কথা ছিলো,“আজকের এই বিশেষ দিনে তোমার আমার কাছে কিছু চাওয়ার আছে?”

“আছে।”
মৌ শান্ত গলায় জবাব দেয়। পিয়াস তার চাওয়ার কথা জানতে চায়। মৌ সুন্দরভাবে বলে,“একজোড়া বিশ্বস্ত হাত। যেই হাতগুলো আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে ধরতে পারবো। যেই হাতে হাত রেখে আমার কখনো মনে হবে না আমি ভুল করেছি। আপনার কাছে আমার এটাই চাওয়া। এই পৃথিবীতে কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। আমার মতো মেয়েদের ভুল হয়তো বেশি থাকে। একরোখা, জেদী যে। আপনি তো আমার সম্পর্কে জেনেই আমাকে বিয়ে করেছেন। তাই আমি চাইবো আপনি আমার ভুল শুধরে দিবেন। তবে ভুল না শুধরে তার শা স্তি ঘোষণা করবেন না প্লীজ। আমি এটাই চাই।”

একটু থেমে আবার বলে,“সংসার জীবনে প্রতিটি মেয়েই চায় সারাজীবন কাটাতে। কেউ সংসার ভেঙে চলে যেতে চায় না। আমিও চাই না। তাই আমি চাই আপনি আমার ভুল ধরিয়ে না দিয়ে সম্পর্কের ইতি টানবেন না প্লীজ। সুযোগ সবারই পাওয়া উচিত। আর হ্যাঁ আমি আপনার স্ত্রী। আশা করি স্ত্রী শব্দের অর্থ আপনি জানেন। আমি চাইবো আমার স্বামী আমাকে স্ত্রী হওয়ার সেই সম্মানটা দিক যেটা আমার প্রাপ্য।”

পিয়াস মুগ্ধ চোখে মৌয়ের দিকে তাকায়। মৌয়ের কথাগুলো সবসময় তার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। সে তৎক্ষনাৎ কথা দেয়,“আমি অবশ্যই তোমার সম্মান রাখবো মৌ। তুমি আমার স্ত্রী, তোমাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া আমার দায়িত্ব। আমি আমার সব দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করবো। আমারও একই কথা। আমার ভুল হতে পারে। তুমিও আমার ভুলটা শুধরে দিও।”

মৌ মাথা নাড়ায়। পিয়াস তার ডান হাতটি ধরে। মৌ কিছুটা লজ্জা পায়। পিয়াস মিষ্টি করে বলে,“আমি তোমার কাছে কিছু চাইতে পারি?”

“হ্যাঁ।”
মৌ সম্মতি দিলে পিয়াস খুশিমনে বলে,“আপনি ডাকলে পরপর মনে হয়। তুমি করে ডাকো।”

“আচ্ছা।
এবার বলো আজ সারাদিন কেমন কাটলো?”
মৌ এক কথায় তুমিতে চলে আসায় পিয়াস অবাক হয়। সে কিছুটা মজা করে বলে,“কোথায় ভাবলাম তুমি লজ্জা পেয়ে বলবে, না আমার তুমি বলতে লজ্জা করে। সেটা না করে এক কথায় বলে দিলে?”

“হ্যাঁ। কারণ তুমি আমাকে এভাবে দেখেই বিয়ে করেছো। এবার আমি আমার সত্তা থেকে বেরিয়ে গেলে তোমার সাময়িক পছন্দ হলেও পরবর্তীতে বিরক্ত লাগবে। এটা আমার ধারনা।”

“এত বুঝদার কিভাবে হলে?”
পিয়াসের এই প্রশ্নে মৌ ম্লান হাসে। অতঃপর দু’জনে তাদের নিজেদের কিছু গল্প করে। গল্পের মাঝে কাছাকাছি আসে। এসবের মাঝে হঠাৎ মৌ বলে উঠে,“কথাটা মনে রেখো প্লীজ পিয়াস৷ আমাকে অসম্মান করতে মন চাইলে ঘরের মধ্যে করো যাতে তুমি পরে ভুল বুঝে ক্ষমা চাইতে আসলে আমি ক্ষমা করতে পারি। অসম্মানটা লোকের সামনে করে আড়ালে ক্ষমা করতে এসো না। সংসার বাঁচাতে আমি মুখে ক্ষমা করলেও মন থেকে কিন্তু পারবো না। আমি তোমাকে আমার জীবনের সব গল্প বলেছি। আমি আমার মায়ের মতো হতে চাই না পিয়াস। সেই সঙ্গে সংসারটাও ছাড়তে চাই না। করতে চাই। মন দিয়ে। নিজের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে চাই। তোমার পরিবার যেটা এখন আমার পরিবার। এই পরিবারের প্রতি আমার যা দায়িত্ব আমি সব পালন করবো। সবার সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করবো, যেখানে দ্বন্দ নয় ভালোবাসা থাকে।তবে একপাক্ষিক কিন্তু সারাজীবন করা যায় না। এটা মনে রেখো।”

মৌ এই পর্যায়ে পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। তার চোখে পানি দেখে পিয়াস তার কপালে চুমু দেয়। তাকে সামলানোর চেষ্টা করে। পিয়াস বুঝতে পারে এই মেয়েটা নিজেকে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, সে তত শক্ত নয়। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই, সংসার সব এইটা সেও মানে। তবে মায়ের জীবনে যা দেখেছে তেমন জীবন কাটাতে চায় না সে। এই ভয়েই সে এখন কাঁদছে। সেরকম পরিস্থিতি হলে তাকে তার মায়ের মতোই হতে হবে নয়তো সংসার ত্যাগ করতে হবে। দু’টোর একটাও চায় না। পিয়াস তার অনুভূতি বুঝতে পারে। মৌ কান্নারত কন্ঠে বলে,“একজন পুরুষ মানুষ চাইলে তার স্ত্রীকে রাজরানীও বানাতে পারে আবার চাকরানীও। সবটা তোমার হাতে।”

“আমি তোমাকে রাজরানী বানাবো মৌ।
আমি তোমাকে রাজরানী বানাবো।”
এটা শুনে মৌ কান্নামাখা মুখে হাসি দেয়। তার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হয়। স্বামীর সামান্য কথায় যে নারী হৃদয় এত খুশি হয় সেই স্বামী যদি তাকে সত্যি রাজরানীর মতো রাখে তখন তার খুশি দেখে কে? সেই নারী তো কখনো কাঁদে না৷ একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে এতটুকু তো চাইতে পারে, যে তার স্বামী তার কান্নার নয় তার মুখের হাসির কারণ হবে। এটা কী স্বামীর দায়িত্ব নয়?


চলবে,