তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব-০১

0
2

#তুমি_অজান্তেই_বেঁধেছ_হৃদয়
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

রায়ান ভাইয়ের দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে অনু অঝোরে কাঁদছে। কষ্টে নয়; আনন্দে। সে তার আঠারো বছরের জীবনে কখনোই শাড়ি পরেনি। কখনো ইচ্ছেও হয়নি। শাড়ি তার কাছে ঝামেলা লাগতো। অথচ রায়ান ভাইয়ের দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়াতেই কী রকম ইমোশোনাল হয়ে গেল সে! জন্মদিনে শাড়িটা উপহার হিসেবে পেয়েছিল অনু। অনুষ্ঠান শেষ করে সব গিফ্ট সাইডে রেখে আগে রায়ান ভাইয়ের দেওয়া প্যাকেটটি খুলেছিল। কালো রঙের জর্জেট শাড়িটি দেখে খুশিতে ঝলমল করে ওঠেছিল শাড়ি পছন্দ না করা অনু! কারণ এটা রায়ান ভাইয়ের দেওয়া গিফ্ট বলে কথা! শাড়িটা নিয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। জামার ওপরেই আঁচলটা বুকে জড়িয়ে দেখল তাকে কেমন লাগছে। কী অদ্ভুত একটা অনুভূতি, আনন্দ! চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি। আনন্দে সে হাসতে হাসতে কাঁদছিল। কিন্তু আফসোস,সেই শাড়িটা পরে কখনোই রায়ান ভাইয়ের সামনে যাওয়া হয়নি!

“কীগো অনু শুনছ, তোমার রায়ান আইতাছে ঢাকা থেইকা?”

অনু ভড়কে গেল। অতীত থেকে ছিটকে ফিরে শাড়িটা আলমারির ভেতর তুলে রাখল। শাড়িটা দেখে কখন যে অতীতের ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল টের-ই পায়নি! পিছু ফিরে বলল,

“আহা! রায়ান নয়; রায়ান ভাইয়া। কতবার বলেছি বলো তো?”

“আহা ম’র’ণ! সেই তো রায়ানের ফটো বইয়ের ভাঁজে লুকাইয়া রাখো। চুপিচুপি চুম্মাও খাও। তহন লজ্জা করে না? আবার ভাই ডাকা হইতাছে এহন!”

এই পর্যায়ে অনু দৌঁড়ে এলো। মুখ চেপে ধরল লিলি খালার। লিলি খালা এই বাড়িতে কাজ করেন অনেক বছর ধরে। তাই পরিবারের বাকি সবার মতো সেও একজন সদস্য। বলা চলে, বাকিদের থেকে তার দাপট-ই বেশি। সবাই তাকে মানেও এবং ভালোওবাসে।

অনু লজ্জিত বদনে মুখখানা নামিয়ে বলল,

“তুমি এত ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেন লিলি খালা? বাড়ির মানুষজন শুনলে কী হবে ভাবতে পারছ?”

লিলি খালা অনুর কোমল হাতখানা মুখ থেকে সরিয়ে দিলেন। ভেংচি কেটে বললেন,

“আর কী হইব? তোমার রায়ানের লগে তোমার বিয়া হইয়্যা যাইব।”

“আবার বলছ আমার রায়ান!”

“তাইলে কী বলব? তোমার রায়ান ভাইয়া?”

“হ্যাঁ, তা-ই বলবে।”

“আইচ্ছা! এতই যহন ভাই ভাই করো তাইলে আবার ফটোতে চুম্মা খাও ক্যান শুনি?”

অনু বিরক্ত হয়ে গেল। কোমরে দুহাত গুঁজে বলল,

“উফ! বড্ড জ্বালাও তুমি। যাও তো এখন।”

লিলি খালা জবাব দেওয়ার পূর্বেই উঠান থেকে সবার হইচই এর আওয়াজ ভেসে আসছে। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে ‘রায়ান” নামটি। তার মানে সে চলে এসেছে! অনুর বুকে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। লিলি খালা কি কোনোভাবে সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে? শুনতে পেলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। একদিন রুম ঝাড়ু দিতে এসে অনুর বইয়ে রায়ানের ছবি দেখেছে, অন্যদিন দেখেছে সেই ছবিতে চুমু খেতে। এরপর থেকে আঠার মতোন লেগে আছে অনুর পেছনে। সময় নেই, অসময় নেই শুধু রায়ানের গুনগান। তবে সে ভালো মানুষ। বাড়ির কাউকেই কিছু বলে দেয়নি। এজন্যই অনু তাকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছে।

লিলি খালা বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে উঠানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। এবার অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“নিচে চলো। তোমার রায়ান আইছে।”

পরক্ষণেই আবার জিহ্বায় কা’ম’ড় দিয়ে বললেন,

“ওপস! শরি (সরি) তোমার রায়ান ভাইয়া আইছে।”

লিলি খালা চলে যাওয়ার পরও অনু নিটোল পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। এত অপেক্ষা করেছে এতদিন! অথচ এখন মানুষটার সামনে যাওয়ারই সাহস হচ্ছে না। তার সকল জারিজুরি, দাপট, চঞ্চলতা, সাহস যেন এই মানুষটার সামনে গেলেই কর্পূরের মতো উবে যায়। এমন যে কেন হয়! সে রুমে এসে চুপ করে বসে রইল।

উঠান থেকে মা, চাচিদের কণ্ঠ ভেসে আসছে। সবাই ডাকছে অনুর নাম ধরে। অনু কী করবে বুঝতে পারছে না। বাড়ির সব মানুষ এখন রায়ান ভাইয়ার সামনে উপস্থিত। একমাত্র সে-ই ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। বিষয়টা দৃষ্টিকটু। তার নিজেরও তো ভাবতে কেমন লাগছে। সে বুক ভরে শ্বাস নিল। সাহস সঞ্চয় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার নিজেকে দেখে নিল। কালো রঙের একটা জর্জেট থ্রি-পিস পরেছে। একদম নতুন এই জামাটা। বানানোর পর একবারও পরা হয়নি। রায়ানের কালো রঙ পছন্দ বলে এটাই আজ পরে ফেলেছে। কপালে কালো রঙের ছোট্ট একটা টিপও পরেছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। আর কোনো সাজগোজ নেই মুখে। এতেই তাকে কী দারুণ লাগছে! এখন রায়ান ভাইয়ার চোখে ভালো লাগলেই হলো। আয়নায় তাকিয়ে লজ্জিত হাসি দিয়ে নিচে নেমে গেল। পা দুটো যেন এখনো কাঁপছে। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। সেজো চাচি অনুকে দেখে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন। হাসিমুখে বললেন,

“এতক্ষণে আসার সময় হলো তোর?”

অনু জবাব দিল না। মুচকি হাসল। রায়ানের দিকে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। মাটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছেন রায়ান ভাই?”

রায়ান এক পলক তাকাল অনুর দিকে। অনুও তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হওয়াতে অনু নিজেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সমুদ্রের অতল গহ্বরের মতো রায়ান ভাইয়ার চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলানোর সাহস নেই অনুর। রায়ান স্বভাবতই গম্ভীর, কম কথা বলে। সে রাশভারী কণ্ঠে উত্তরে বলল,

“ভালো।”

এরপর যা বলল তার জন্য মোটেও অনু প্রস্তুত ছিল না। রায়ান বলল,

“এই গরমের মধ্যে জর্জেট জামা পরেছিস কেন? তোর সুতি জামা নেই?”

অনু আহত দৃষ্টিতে তাকাল রায়ানের দিকে। মনটাই ভেঙে গিয়েছে তার। যার জন্য এই জামা পরল সে কিনা বলছে এই কথা! অনু চুপ থাকা অবস্থাতেই রায়ান আবার বলল,

“আর এত সেজেগুজে বসে আছিস কেন বাড়িতে? পড়াশোনা নেই?”

অনুর রাগে-দুঃখে ইচ্ছে করছিল রায়ানের পিণ্ডি চটকাতে। নেহাৎ ভালোবাসে বলে কিছু বলতে পারে না। রায়ানের জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে ঠিক ধুয়ে দিত। শুধু এই ছেলেটার বেলাতেই সে কেমন জানি হয়ে যায়!

রাগ, দুঃখ সব সাইডে রেখে অনু মিথ্যা কথা বলল,

“আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন আজ। তাই সেজেছি। একটু পর বের হবো।”

রায়ান আর কথা বাড়াল না অনুর সাথে। সে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। দাদি বললেন,

“যা দাদুভাই গোসল কইরা আয়। সবাই এক লগে খাইতে বমু।”

রায়ান আদুরেস্বরে বলল,

“আচ্ছা দাদিজান।”

এক এক করে সবাই চলে গেল যার যার কাজে। উঠান এখন পুরোপুরি ফাঁকা। অনু একা দাঁড়িয়ে আছে। সেও চলে যাবে তখন চোখ পড়ল চেয়ারের ওপর পড়ে থাকা কালো সানগ্লাসটার ওপর। রায়ান ভাইয়ার একটা স্বভাব আছে ছোটোবেলা থেকেই। আর সেটা হলো সানগ্লাস পরা। রোদ থাকুক আর বৃষ্টি থাকুক সে সবসময়ই সানগ্লাস পরে থাকে। পারলে রাতেও পরে থাকে এমন একটা অবস্থা। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কিনা। কেউ নেই দেখে সানগ্লাসটা তুলে চোখে পরল। একটু ভাবসাব নিয়ে উঠানে হাঁটাহাঁটি করছিল তখন দোতালার বারান্দা থেকে রায়ান ভাইয়ের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,

“সানগ্লাস পরে তোর ফ্যাশন শো শেষ হলে, ভালো মেয়ের মতো আমার সানগ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে যাবি।”

অনু থতমত খেয়ে সানগ্লাস খুলে বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলল,

“হ্যাঁ, হ্যাঁ…এক্ষুনী, এক্ষুনী দিয়ে যাচ্ছি।”

রায়ান চলে গেল নিজের রুমে। অনু বুকে হাত দিয়ে ফাঁকা চেয়ারটিতে বসে পড়ল। এখনো ভয়ে বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে! এভাবে কেউ ধমকায়? একটুও রসকষ নেই মুখে। জন্মের পর কি কেউ আদৌ তার মুখে মধু দিয়েছিল? মনে তো হয় না! আজগুবি চিন্তা করতে করতেই হাতের মুঠোয় থাকা সানগ্লাসটির দিকে নজর পড়ল। সে কি নিজে যাবে এটা ফেরত দিতে? নাকি অন্য কাউকে পাঠাবে? নিজেই বরং যাওয়া যাক। এই সুযোগে আরেকটা বার দেখা হয়ে যাবে, আবার কথাও হয়ে যাবে।

অনু সিঁড়িতে দপাদপ পা ফেলে দুই তলায় গেল। তাদের বাড়িটা পুরনো আমলে অর্থাৎ তার দাদার সময়ে তৈরি করা। অনুর বাবা-চাচারা পাঁচ ভাই এবং দুই বোন। রায়ান ভাইয়ার বাবা সবার বড়ো। এরপর অনুর বাবা। তারপর ওর এক ফুপু এবং সেজো চাচা, নয়া চাচা এবং ছোটো চাচ্চু, সবার শেষে ছোটো ফুপু। অনুদের যৌথ পরিবার। দুই ফুপুর বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি সবাই এখনো একসাথে এই বাড়িতে থাকে। সবাই এক নামে চেনে এই বাড়ি ‘চৌধুরী ভিলা’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব চাচাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে। সবার আলাদা আলাদা বাড়িও আছে। কিন্তু দাদা-দাদি এখনো জীবিত আছেন বলে সবাই একসাথেই থাকে। এত বড়ো পরিবার এখনো একসাথে মিলেমিশে থাকে এটাও একটা বিরাট বিস্ময়ের ব্যাপার! গ্রামের সবাই এজন্য চৌধুরী বাড়ির লোকজনদের শ্রদ্ধার নজরে দেখেন, সম্মান করেন।

অনুদের বাড়িটা গোলাকৃতি। ওপরে, নিচে চারপাশে রুম আর মাঝখানে পাকা উঠান। দুই তলার ওপরে সুন্দর করে বানানো মাঝারি ধরনের একটা ছাদও আছে। অবসর সময়ে অনু ও ওর বাকি সব কাজিনরা মিলে ছাদে আড্ডা দেয়, গল্প করে। ওপরের সবগুলো রুম শুধু ওদের কাজিনদের জন্য বরাদ্দ। সবগুলো রুমের একটাই কমন বারান্দা। ওপরের দুটো রুম দুই ফুপুদের। এখন তালাবন্ধ অবস্থায় আছে। যখন ফুপুরা আসে তখন দরজা খুলে দেওয়া হয়। বাড়তি দুটো রুম রাখা হয়েছে মেহমানদের জন্য। নিচে পাঁচটা রুম অনুর বাবা এবং বাকি চার চাচার। আর একটাতে দাদা-দাদি থাকেন। পাশের ছোট্ট রুমটায় থাকেন লিলি খালা। একপাশে বড়ো একটা রান্নাঘর। মা, চাচিদের বেশিরভাগ সময় এই রান্নাঘরেই কাটে। রান্নাঘরের সামনে বিশাল বড়ো বারান্দাটিতে বেশ বড়ো একটা খাওয়ার টেবিল; যেখানে ওরা সবাই একসাথে বসে খায়। দিনে এটা সম্ভব না হলেও রাতের খাবার সবাই একসাথে মিলে খাবে। এটা দাদার আদেশ বা ইচ্ছে যেকোনো একটা বলা যায়। বাবা, চাচারা সবাই বাড়িটি ভেঙে আবার নতুন করে বানাতে চেয়েছিলেন। দাদি রাজি হয়নি। এই বাড়ির সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাই যদি বাড়ি ভাঙতেই হয় তাহলে যেন তার মৃ’ত্যু’র পর ভাঙা হয়। অনুর বাবা, চাচারা মা বলতে অ’ন্ধ। মায়ের কথাই শেষ কথা। তাই তারা আর দ্বিতীয়বার বাড়ি ভাঙার কথা মুখেও আনেননি কেউ। কিন্তু কিছুটা মেরামত করে নতুনত্ব এনেছেন। যেমন প্রতিটা রুমে এটাচ ওয়াশরুম বানানো, রঙ করা এসব খুঁটিনাটি বিষয়গুলোতে নতুনত্ব এনেছেন শুধু।

অনু রায়ানের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। হাত-পা কাঁপছে। ছোটো থেকেই এই লোকটাকে সে যমের মতো ভয় পায়। দরজায় নক করতে গিয়ে বুঝতে পারল ভেতর থেকে লক করা। ছোটো ছোটো শব্দে দরজায় কড়া নেড়ে অনু মিহি কণ্ঠে ডাকল,

“রায়ান ভাই? রায়ান ভাই?”

অনেকক্ষণ পর রুম থেকে গম্ভীর কণ্ঠটি ভেসে এলো,

“কে?”

“আমি। অনু।”

এবার দরজাটি খুলে গেল অনুর মুখের ওপর। সামনে তাকিয়ে মুখ হা হয়ে গেছে অনুর। রায়ান ভাই মাত্রই গোসল করে বেরিয়েছে। কালো ট্রাউজারের সাথে সাদা রঙের একটা টি-শার্ট পরেছে। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল,

“কী?”

অনু তখনো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রায়ান ভাই এবার ধমকে উঠল,

“কী হলো? কথা বলিস না কেন?”

অনু এবার ভড়কে গিয়ে বলল,

“আপ… আপনার সানগ্লাস!”

রায়ান হাত বাড়িয়ে সানগ্লাসটি নিয়ে বলল,

“তোর কি তোতলানো স্বভাব আছে?”

এবার ভ্রু কুঁচকাল অনু। এই লোকটা নিজেকে কী ভাবে আর অনুকেই বা কী ভাবে? অনু বোকা, বলদ? মোটেও না। অনুর রাগ, তেজ সম্পর্কে রায়ান ভাইয়ের কোনো আইডিয়াই নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এক মাত্র তার সামনে আসলেই অনুর ক্যারেক্টার বদলে যায়। বাঘিনী থেকে মিউমিউ করা বিড়াল হয়ে যায়। অনেকবার চেষ্টা করেছে, রায়ান ভাইয়ের সামনে কোনো হ্যাবলামো করবে না। কিন্তু কোনোবারই সফল হতে পারেনি। কেন পারেনি বা পারে না সেটাও একটা রহস্য।

রায়ান ভাই ফের নিজেই বলল,

“তোর তো অনেক সমস্যা অন্দি! কখনো তুতলিয়ে কথা বলিস, কখনো ধ্যানে চলে যাস। মেজ চাচ্চু কি জানে এসব?”

অনু গাল ফুলিয়ে বলল,

“আমার কোনো সমস্যা নেই, রায়ান ভাই। আমি একদম ঠিক আছি। আর আমার নাম অন্দি নয়।”

রায়ান ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে তাকাল। নাম জানে না এমনভাবে জিজ্ঞেস করল,

“তাহলে তোর নাম কী?”

“অনিন্দিতা চৌধুরী অনু।”

“এত কঠিন নাম যে কেন রেখেছে! তোর আকিকার সময় আমি থাকলে এই নাম কখনো রাখতে দিতাম না।”

অনু মনে মনে বলল,

“তা বেশ তো! এত কঠিন নামে আপনার ডাকতে হবে কেন? অনু বলে ডাকলেই হয়!”

তবে মুখে সে কিছুই বলতে পারল না। রায়ান নিজেই বলল,

“ঠিক আছে অন্দি, তুই এখন যা।”

অনু বলতে চাইল,

“অন্দি নামটা শুনতে খুব বাজে লাগে, রায়ান ভাই। আপনি বরং অনু বলেই ডাকুন।”

কিন্তু এবারও সে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল। নিজের রুমে আসতে আসতে রায়ানের দরজা লাগানোর শব্দটা শুনতে পেল। আল্লাহ্ যে তাকে কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছেন! এতটা কঠোর, কঠিনও হয় কোনো মানুষ? খাটের ওপর চুপ করে বসতেই লিলি খালা এলেন রুমে। অনুকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী হইছে?”

অনু ঠোঁট উলটে বলল,

“কই কিছু না তো!”

এরপর লিলি খালার দিকে চোখ তুলে তাকাল। দেখতে পেল লিলি খালা কফি নিয়ে এসেছেন। অনু কফির মগটা নিয়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে লিলি খালা হা-হুতাশ শুরু করে দিলেন,

“হায়, হায় করলা কী! এডা তোমার রায়ান ভাইয়ের কফি!”

অনু নিজেও আঁতকে উঠে বলল,

“তাহলে তুমি আমার রুমে নিয়ে এসেছ কেন?”

“তোমারে দিয়া কফি পাডাইতাম তাই।”

“আমাকে দিয়ে কেন?”

“এমনিই। যাও কফিডা দিয়া আহো। আমি তোমার ফুপুগো রুমডা গিয়া পরিষ্কার করি।”

অনু খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,

“ফুপুরা আসবে আজ?”

“হ। তোমার রায়ান ভাই আইছে বইলা কথা! অহন যাও কফি দিয়া আহো। ঠান্ডা হইয়্যা যাইব।”

“কিন্তু আমি তো কফিতে চুমুক দিয়েছি। এঁটো কফি নিয়ে যাব?”

“সমস্যা নাই। মহব্বত বাড়ব।”

ভ্রু কুঁচকাল অনু। লিলি খালা বিশেষ পাত্তা দিলেন না। তিনি চলে গেলেন ফুপুদের রুমগুলো পরিষ্কার করার জন্য। অনেক দোনোমনা করে অনু কফি নিয়ে রায়ান ভাইয়ের রুমের সামনে গেল। দরজায় লাগানো নেইমপ্লেটের দিকে দৃষ্টি বুলাল একবার। ‘তাহমিদ চৌধুরী রায়ান’। অনু বিড়বিড় করে বলল,

“আমার রায়ান ভাই!”

ঠিক তখনই দরজাটি খুলে গেল। মুখের হাসি উবে গেল অনুর। মুখ শুকিয়ে আমসি! রায়ান ভাই গম্ভীরকণ্ঠে বলল,

“দরজার সামনে কী?”

অনু ফের তোতলানো কণ্ঠে বলল,

“ক…ক… কফি! আপনার কফি।”

কফির মগটা রায়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়েই অনু দৌঁড়ে নিচে নেমে গেল। আর কিছুই বলার সুযোগ দিল না রায়ানকে। রায়ান বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অনুর যাওয়ার পথে। কী অদ্ভুত আচরণ! রুমে এসে কফির মগে চুমুক দিতে যাবে, তখন দেখতে পেল মগে লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। রায়ান চিৎকার করে ডাকল,

“অন্দি!”

চলবে?