মিষ্টির তনুদা পর্ব-১+২

0
2

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০১

“আমি কিন্তু মিষ্টিকে বিয়ে করব না মা।”
“বিয়ে করবি না তো প্রেম-নিবেদন করতে গিয়েছিলি কেন?”
তনু অধৈর্য হয়ে বলল,
“তুমি কেন বুঝতে চাইছ না, বলোতো মা? ওটা জাস্ট প্র্যাঙ্ক ছিল।
-‘আমরা সেকেলে মানুষ। এসব পাংক-ফাংক বুঝি না বাপু। তাছাড়া মিষ্টি আমাদের ঘরের মেয়ে। তারউপর অল্প বয়স। চেহারা সুন্দর। ওর সাথে বিয়ে হলে তুই সুখেই থাকবি।
-‘মা…
– আমি এই বিষয়ে মিষ্টির বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে রেখেছি। এখন শুধু নমঃ নমঃ করে তোদের বিয়েটা সেরে রাখব। মিষ্টির পড়াশোনা শেষ হলে, আর তোর ভালো একটা চাকরি হয়ে গেলে, মিষ্টিকে অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলে আনব।
-‘মা শোনো? তোমাদের বোকা, মাথামোটা ভাস্তিকে আমি কিছুতেই বিয়ে করব না।
-‘তা বললে তো হবে না বাবা৷ তোর আর মিষ্টির ভেতরে কিছু একটা চলছে। এই কথা সবাই জানাজানি হয়ে গেছে। তাছাড়া মিষ্টির বাবা যে রাগী মানুষ। এত সহজেই যে তোর মতো বেকার ছেলেকে মেয়েজামাই হিসাবে মেনে নিয়েছে। এটা তোর সাত কপালের ভাগ্য।
-‘মা আমি আজ বেকার আছি। আগামীকাল কিন্তু বেকার থাকব না। বুয়েট থেকে পাশ দিয়ে বের হলেই কত ভালো চাকরি পাব। তুমি জানো? তখন কত মেয়ের বাবা আমার বাড়ির সামনে লাইন লাগাবে। তোমার কোনো ধারণা আছে?
-‘চাকরি পাবি। এখনো পাসনি তো। এত অহংকার করা ভালো না তনু। ভগবান এতে অখুশি হোন। মিষ্টি খুব ভদ্র, শান্তশিষ্ট মেয়ে।
-‘ভদ্র না ছাই। ও মেয়ে দিনে হাজারবার ক্রাশ খায়। সে খবর রাখো তোমরা? বর্তমানে কার উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে, কে জানে!
-‘তোর উপরেই তো শুনেছি।
তনু চমকে উঠল। মিষ্টির মনের কথা মা কীভাবে জানল? নিশ্চয়ই মিষ্টিই রসিয়ে রসিয়ে মাকে বলেছে। ইশ, মেয়েটা এত বেহায়া কেন? এই মেয়েকে তনু বিয়ে করবে না। জীবনেও না। মরে গেলেও না।

তনুদের বাড়ির সামনের বাড়ি মিষ্টিদের। দুই বাড়ির মাঝখানে একটা পিচ ঢালা সরু রাস্তা। রাস্তার এপার মিষ্টিদের তিনতলা বাড়ি। আর রাস্তার ওপার তনুদের পাঁচতলা বাড়ি। দুই বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি না। এবাড়ির ব্যালকনিতে, জানালায় কিংবা ছাদে দাঁড়ালে ও-বাড়ির মানুষ দেখা যায়৷ একটু উচু স্বরে কথা বললে গল্প করা যায়। ওরা সম্পর্কে প্রতিবেশী। প্রতিবেশী হলেও দুই বাড়ির সাথে সম্পর্ক খুব ভালো।
তনুর ভাষ্যমতে এই এলাকার সবচেয়ে বিরক্তিকর, বোকা, আহ্লাদী মেয়েটার নাম হলো ‘মিষ্টি’। মিষ্টি এবার এইচএসসি দেবে। অথচ বুদ্ধি এখনো হাঁটুর নিচে। বুদ্ধি হাঁটুর নিচে বলছি কেন! দুটো কারণ বলি, তাই বুঝবেন। ওদের এলাকার সবচেয়ে স্মার্ট, সুদর্শন, টলিউড নায়কের মতো সুন্দর দেখতে তনুদাকে তনুদার কাজিনরা জোর করে ডেয়ার দিয়েছিল। যে বোকা মিষ্টিকে সবার সামনে প্রপোজ করতে হবে।
তনু প্রথমে রাজি না হলেও সবার জোড়াজুড়িতে মিষ্টিকে প্রপোজ করতে রাজি হলো৷ এক বৃষ্টিস্নাত গোধূলি সন্ধ্যায় মিষ্টিকে তনুদার কাজিন সেতু ডেকে ছাদে নিয়ে গেল। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাতে একগুচ্ছ কদমফুল নিয়ে, হাঁটু গেঁড়ে ফিল্মি স্টাইলে বসে তনু মিষ্টিকে প্রপোজ করল। মিষ্টি অতিরিক্ত লজ্জায় লাল, নীল হচ্ছিল। আর এত সুন্দর রোমান্টিক দৃশ্য দেখে সবাই খুব মজা নিচ্ছিল। ঘটনা এখানেই থেমে যেতে পারতো। কিন্তু থামল না। বোকা মিষ্টি এই কথা তার মাকে বলে দিল। সাথে তনুদার দেওয়া ফুলগুলোও ঘটা করে দেখাল। সেই কথা এককানে, দুইকানে দুই বাড়িতেই ছড়িয়ে গেল। এই কথা যখন তনুর কানে গেল। তখন সে রেগে আগুন। মিষ্টিকে আবারও ডেকে পাঠাল ছাদে। মিষ্টি খুশি মনে ছাদে উঠে এলো। তনু মিষ্টিকে দেখে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘তুই কী পাগল মিষ্টি?
মিষ্টি ঘাবড়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘এভাবে বলছেন কেন? কী করেছি আমি?
-‘আমি তোকে প্রপোজ করেছি। এই কথাটা তোর মাকে বলেছিস কেন?
মিষ্টি লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। মিনমিন করে বলল,
-‘আচ্ছা আর বলব না।
-‘আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। তোর কী যোগ্যতা আছে আমার বউ হওয়ার?
কষ্টে মিষ্টির চোখে জল এসে গেল। তনুদা এতবড় কথাটা মিষ্টিকে বলতে পারল? বুঝ হওয়ার পর থেকে এই মানুষটাকে মন দিয়ে বসে আছে মিষ্টি। সে খবর কী এই ঘাড়ত্যাড়া মানুষটা রাখে? রাখে না বোধহয়। মিষ্টি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘কোনো যোগ্যতা যখন নেই। তাহলে প্রপোজ করেছিলেন কেন?
-‘মারব ঠাটিয়ে এক থাপ্পড়। এই তোর বয়স কত? দুদিন পর এইচএসসি দিবি। কোথায় মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। তা-না। ওনি নাকি আমাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছে। যতসব নাটক। শোন মিষ্টি আমি কিন্তু তোকে বিয়ে করব না। যে ভাবেই হোক। তুই বিয়েটা আটকা। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।
মিষ্টি দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘অসম্ভব। আমি পারব না।
তনু চোখ রাঙিয়ে কড়া কণ্ঠে বলল,
-‘পারতে তোকে হবেই মিষ্টি।

চলবে

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০২

তনুদের বাড়ি ও মিষ্টিদের বাড়ি রাস্তার এপার-ওপার। তনুরা বনেদি পরিবার৷ তনুর বাবা-কাকা জেঠুরা চার ভাই। কোনো বোন নেই। নিচতলায় বিশাল মার্কেট ভাড়া দেওয়া। মাসের শুরুতে ভাড়ার টাকা চারভাগে ভাগ হয়। আর দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত পুরোটাই ফ্ল্যাট বাসা। তনুর বড় জ্যাঠা ইন্ডিয়া থাকে। দোতলা পুরোটাই ভাড়া দেওয়া। তনুর বাবা মেজো। তিনতলার পুরোটা জুড়ে তনুরা থাকে। চারতলায় সেজো কাকার পরিবার থাকে। পাঁচলতায় ছোটোকাকার পরিবার।
তনুরা দুই ভাই-বোন। সেজো কাকার চার মেয়ে। বড় মেয়ে সেতু তনুর দুই বছরের ছোট। আর তিন বোনের নাম রিতু, নিপু, মিতু। ছোটকাকার তিন ছেলে এক মেয়ে। অনিক মানিক রতন। আর বোনের নাম রত্না।
তনু বুয়েট থেকে এবছর ইন্জিনিয়ারিং পাশ দিয়ে বের হবে। আর তনুর ছোটবোন তনুশ্রী ক্লাস নাইনে পড়ে।

অন্যদিকে এটা মিষ্টির বাবার মামারবাড়ির এলাকা। মিষ্টির দাদু সারাজীবনের সঞ্জয় দিয়ে জমি কিনে দুইতলা পর্যন্ত কম্পিলিট করতে পেরেছিলেন। ওনি মারা যাওয়ার পর তিনতলা কম্পিলিট করেছে মিষ্টির বাবা। একতলায় শপিংমল। দুইতলায় ব্যাংক ভাড়া দেওয়া। ও তিন-তলার পুরোটা জুড়ে মিষ্টিরা থাকে।
মিষ্টির বাবার কোনো ভাই নেই। শুধু একটা বোন আছে। বোনের বিয়ে হয়েছে ফরিদপুর।
মিষ্টিরা তিন ভাই-বোন। বড়বোন ঋতুর বিয়ে হয়ে গেছে। মেজো মিষ্টি। ছোটভাই তমাল।

তনু পড়াশোনার জন্য বাড়িতে থাকে না। ঢাকা থাকে। তবে ছুটিছাটা পেলেই বাড়িতে চলে আসে। আবার প্রায়ই বৃহস্পতিবার রাতে আসে। শুক্রবার সারাদিন থেকে শনিবার ভোরে চলে যায়। মিষ্টির রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে তনুদার রুমটা সরাসরি দেখা যায়। খুব বেশি দূরত্ব না হওয়ায় একটু জোরে কথা বললেও শোনা যায়। তনুদা বাড়িতে আসলেই সারাদিন ফোন নিয়ে পরে থাকে। গায়ে হাতাকাটা গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখে। ইয়ারফোন দিয়ে সারাক্ষণ গান শুনে কীভাবে কে জানে! মিষ্টির তো ওই যন্ত্রটা পাঁচ মিনিট কানে গুঁজলেই কান ব্যাথা হয়ে যায়। মাথা ধরে যায়।

তনু মিষ্টির সাথে ওই ব্যাপারে কতক্ষণ রাগা-রাগি করে এই বাড়িতে আর একমুহূর্তে দাঁড়াল না। চলে গেল। মিষ্টিও কতক্ষণ ছাদে বসে হাপুস নয়নে কাঁদল। তারপর চোখের জল মুছে একপা-দুপায়ে ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে, তনুদার দেওয়া বাসি কদম ফুলগুলো বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল। ছোটবেলা থেকে মিষ্টির একটু বুদ্ধি কম দেখে, সবাই মিষ্টির সাথে মজা করে। মিষ্টিও সরল মনে সবার উপহাসের পাত্র হয়। এমন না যে মিষ্টি বুঝে না। মিষ্টি সবই বুঝে। তারপরও কেন যে পরিবর্তন হতে পারে না৷ মিষ্টি ও তনুদার ঘরটা পাশাপাশি। মাঝখানে রাস্তার পাঁচ হাত দূরত্ব। ছোটোবেলা থেকে প্রায় সময়ই তনুদাকে দেখে অভ্যস্ত মিষ্টি৷ দেখা-দেখি থেকে কখন যে তনুদার উপর ভয়াবহ ক্রাশ আর দিনদিন ভালোলাগা বেড়ে গেছে। বুঝতেই পারেনি বোকা মেয়েটা। তনুদা যখন নিজে থেকে মিষ্টিকে প্রপোজ করল। মিষ্টি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। অস্থির মন। ব্যাকুল হৃদয়। নিজের পেটের কথা শত চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারল না। খুশিমনে বলে দিল মাকে। সেই বলাই বুঝি মিষ্টির জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল? এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কথা তোলার কী দরকার ছিল? হঠাৎ করে বিয়ের কথা শুনলে মানুষটা তো রেগে যাবেই। আগে প্রেম হোক, ভালোবাসা হোক। তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাবা যেত। এত অপমানের পরও বোকা মিষ্টি তনুদার কোনো দোষই খুঁজে পেল না। মিষ্টির মাকেই দোষী মনে হলো।
এদিকে দুই বাড়িতে তনু-মিষ্টি বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কাছের আত্মীয়-স্বজনকে নেমন্তন্ন দেওয়া হয়ে গেছে। বিয়ের কেনা-কাটার লিষ্ট করা হচ্ছে।

দুদিন তনু আর মিষ্টির সাথে দেখা করল না। কথা বলল না। মিষ্টি ফোন দিলেও রিসিভ করে না। এমনকি ঘরের, জানালার ভারি পর্দাও সবসময় টেনে রাখে। যেন সময়ে-অসময়ে মিষ্টিকে দেখা না লাগে। এই ঢঙি মেয়েটা তনুর বউ হবে। এই তিক্ত সত্যিটাই কেন জানি মানতে পারছে না তনু। মাকে কত বোঝানো হলো। মা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে বেশ ভয় পায় তনু৷ বাবাকে যে সরাসরি বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলবে। তাও সাহস পাচ্ছে না৷ মাকে বলে কোনো লাভ নেই। মিষ্টির মায়ের সাথে তনুর মায়ের খুব খাতির। সম্পর্কে প্রতিবেশি হলেও দুজন এমন ভাবে চলাফেরা করে। কেউ হঠাৎ দেখলে বলবে দুজন বোধহয় আপন বোন।

একসপ্তাহ পর ছোট পরিসরে হলুদের অনুষ্ঠান হবে। তারপর.. তারপর.. এই বোকা, মাথামোটা, আহ্লাদী মেয়েটার সাথে তনুর সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে। আর কিছু ভাবতে পারে না তনু। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।
তনুর কেমন পাগল পাগল লাগে। কী মনে করে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু রবিকে ফোন দেয়। সংক্ষেপে সব ঘটনা খুলে বলে। সবশুনে রবি বুদ্ধি দেয়।
“সবাই যখন এত করে বলছে, বিয়েটা করে নে তনু। বোকা মেয়ে গুলো বউ হিসাবে লক্ষ্মীমন্ত হয়। এদের তুই যে ভাবে ইচ্ছে সেভাবে কন্ট্রোল করতে পারবি। তাছাড়া বয়স তো কম হচ্ছে না। ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে তোরই লাভ।
-‘অসম্ভব এই মেয়ের সাথে আমি সারাজীবন সংসার করতে পারব না।
-‘সারাজীবন সংসার করতে তোকে কে বলেছে? আপাতত বিয়েটা কর। পরে হাজারটা কারণ দেখিয়ে বিয়ে ভেঙে দিবি। ব্যস..
-‘না..না..এ হয় না। আমার জন্য দুই বাড়ির ভেতরে
দ্বন্দ্ব লাগুক। বহুবছরের সুসম্পর্ক নষ্ট হোক আমি তা চাই না।
-‘সম্পর্ক যেন খারাপ নাহয় তোকে সেইভাবেই কাজটা করতে হবে।
-‘বলছিস?
-‘ইয়েস মামু। এত প্যারা নাও কেন? বিয়ে করো। শুধু বিয়ের কথাটা তোর ভার্সিটির সবার কাছে গোপন রাখবি। বন্ধু-বান্ধব কাউকে বলারও দরকার নেই।
-‘ওকে।
তনু ফোনের লাইন কেটে দিল। এখন অনেকটা হালকা লাগছে। জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। দেখল, মিষ্টি টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে কী যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। সামনে একটা বই খুলে রাখা। অবাধ্য চুলগুলো মনের সুখে উড়ছে। কখনো মিষ্টির দিকে অন্য নজরে তাকানো হয়নি। জীবনে এই প্রথমবার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হলো তনুর৷ এই মেয়েটা তনুর বউ হবে? এই মেয়েটাকে নিয়ে একসাথে ঘুমাতে হবে? এমনকি…
তনু ফোনটা আবারও হাতে তুলে নিল। আনমনে ফোন দিল মিষ্টিকে। মিষ্টি ফোন রিসিভ করতেই তনু কী বলবে ভেবে পেল না। বলল,
-‘এতবার ফোন দিয়েছিস কেন?
মিষ্টি বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল,
-‘এখন বিয়ে করার দরকার নেই। আমাদের বিয়ের দিন আপনি ঢাকা চলে যাবেন তনুদা।
-‘কেন বিয়ে করবি না আমাকে? এত তাড়াতাড়ি বিয়ের শখ মিটে গেল?
মিষ্টি সরল মনে বলল,
-‘করব। আগে আপনি পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে জয়েন্ট করেন। আমি এইচএসসি দেব। তারপর..
-‘জাতে মাতাল তালে ঠিক। আমি বেকার দেখে তুই আমাকে বিয়ে করবি না। অথচ আমি চাকরি পেলেই আমার গলায় ঝুলে পড়বি বলছিস! ছি..তুই এত লোভী মিষ্টি?
মিষ্টি যদি চালাক হতো। তাহলে বলতো, কেন আমার বাবার কী কম আছে? যে আপনার চাকরি দেখে বিয়ে বসতে হবে আমাকে। কিন্তু মিষ্টি তো বোকা। বলল,
-‘এমা না..না..আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন তনুদা।
-‘আমি ঠিকই বুঝেছি। তুই বোকা হওয়ার নাটক করিস। আসলে তুই বোকা না। মহা চালাক। শোন মিষ্টি? তুই কী একবার আমার ঘরে আসতে পারবি? আমার তোকে কিছু বলার আছে।
মিষ্টি ঘড়ি দেখল। রাত এগারোটা বাজে। এতরাতে তনুদার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে না। বলল,
-‘আগামীকাল আসব।
তনু জেদি কণ্ঠে বলল,
-‘আগামীকাল না। তুই এখুনি আসবি। এখুনি মানে এখুনি…
মিষ্টি শুকনো ঢোক গিলল। এতরাতে মরে গেলেও তনুদাদের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। মিষ্টি অস্থির হয়ে বলল,
-‘কী বলবেন? ফোনেই বলেন না?
-‘খুব তো সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস। তুই আমাকে ভালোবাসিস। এখন ভালোবাসার পরীক্ষা দে? চলে আয়। গেইট খোলা আছে। আমি মেইন দরজা খুলে রাখব। রাখি।
মিষ্টিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তনু ফোনটা কেটে দিল।

এত রাতে মিষ্টি তনুদার ঘরে যাওয়ার সাহস পেল না। তাছাড়া একই বাড়িতে হলেও নাহয় যাওয়া যেত। এভাবে রাস্তা পার হয়ে, মার্কেটের ভেতর দিয়ে এতরাতে মিষ্টির পক্ষে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব না৷ মা যেতে দেবে না। ভেতরে ভেতরে খুব ছটফট করছে মিষ্টি। মনটা খুব অশান্ত। ভয়ে ভয়ে নিজে থেকে তনুদাকে ফোন দিল। বুকটা দুরুদুরু করছে। তনুদা ফোন রিসিভ করল না। আবারও কাঁপা হাতে ফোন দিল মিষ্টি। এবার ফোন রিসিভ করেই মৃদু ধমকের সুরে তনু বলল,
-‘বার বার ফোন দিচ্ছিস কেন?
-‘না..মানে!
-‘কী মানে..মানে করছিস? তোকে না আমার ঘরে আসতে বললাম?
-‘আমি কুকুর দেখে ভয় পাই।
-‘কে কুকুর, আমি?
-‘ছিঃ..ছিঃ..আমি রাস্তার কুকুরের কথা বলছি।
-‘আচ্ছা তোকে আমার ঘরে আসতে হবে না। ফোন রাখ।
মিষ্টির মনটা খারাপ হয়ে গেল। বলল,
-‘আপনি এত রেগে রেগে কথা বলছেন কেন?
-‘তো কীভাবে কথা বলব?
-‘একটু ভালো ভাবেও তো কথা বলা যায়।
মিষ্টির কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমান৷ তনু কড়া কণ্ঠে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। শুধু বলল,
-‘একবার ব্যালকনিতে আয় মিষ্টি।
মিষ্টি হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করে নিল। গায়ে ওড়নাটা পেঁচিয়ে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে ব্যালকনিতে চলে এলো। তনু জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে তনুদাকে দেখে লজ্জায় গুটিয়ে গেল মিষ্টি। গা শিরশির করে উঠল। ইশ, মানুষটার গায়ে কোনো পোশাক নেই। শুধু হাফপ্যান্ট পরে আছে। গলায় হেডফোন ঝুলছে। দেখতে কী যে বিশ্রী লাগছে।
-‘মিষ্টি?
মিষ্টি ফোনটা শক্ত করে কানের সাথে চেপে ধরল। আস্তে করে বলল,
-‘হুঁ…
-‘কী হুঁ হুঁ করছিস, তাকা আমার দিকে?
মিষ্টি শুকনো ঢোক চিপল৷ চোখ তুলে তাকাল। তনুদার লাজ-লজ্জার বালাই নেই। এভাবে কারো সামনে আসে কেউ? একটু ভদ্রস্ত হয়েও তো আসা যায়। মিষ্টি সরল মনে বলল,
-‘আপনাকে দেখতে বিশ্রী লাগছে।
-‘কেন আমি কী ল্যাংটা হয়ে আছি? যে আমাকে বিশ্রী লাগবে?
-ছিহ…
-‘ওরে..আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা। বিয়ের পরে এর চেয়েও ভয়ংকর রূপে তুই আমাকে দেখার জন্য প্রস্তুত থাক।
ভয়ে মিষ্টির পেটের ভেতর কী যেন গুড়গুড় করে উঠল। এই মানুষটা এত ঠোঁটকাটা কেন? একটু রয়ে-সয়ে কথা বললে কী এমন ক্ষতি হয়?
এই প্রথম মিষ্টি সাহস করে বলল,
-‘তনুদা আপনি কী জানেন? আপনি অত্যন্ত অসভ্য একটা মানুষ।
-‘মারব ঠাঁটিয়ে এক থাপ্পড়। এ্যাঁই.. তুই আমাকে অসভ্য বলছিস কেন? আমি কী তোকে কখনো জোর করে চেপে ধরেছি? না চুমু খেয়েছি?
মিষ্টির চোখে জল এসে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘ছিহ…

চলবে