মিষ্টির তনুদা পর্ব-০৩

0
2

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৩

তনুদা চট করে ফোনের লাইন কেটে দিল। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে। মাথা দপদপ করছে। এই ন্যাকা-ষষ্ঠী মেয়েটাকে বিয়ে করা কিছুতেই সম্ভব না।
তনু তখনই ঘরে চলে গেছে। মিষ্টি ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে রইল। এই মানুষটা মিষ্টির কল্পনায় সুন্দর ছিল। কী সুন্দর মিষ্টির সাথে খুনসুটি করতো। দুজনের বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে যখন তনুদার সাথে দেখা হতো, কথা হতো। তখন কী সুন্দর মিষ্টির সাথে হেসে হেসে কথা বলতো মানুষটা। ভালো ব্যবহার করতো। অথচ বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল। আচ্ছা, তনুদা এত পাল্টে গেল কেন? মিষ্টি তো এই তনুদাকে ভালোবাসেনি। সারারাত ভেবেও কোনো কুল-কিনারা পেল না মিষ্টি।

সকাল থেকেই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসতে শুরু করেছে। ডেকোরেশনের লোকেরা ছাদটা ফুলটুল দিয়ে সাজাচ্ছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই রাতে মিষ্টির ঠিকমতো ঘুম হয় না। আজ রাতেও একফোঁটা ঘুম হয়নি। মাথাটা ভার হয়ে আছে। মন-মেজাজ ও ভালো না। সেতুদিদি এসে মিষ্টিকে একচোখ টিপে বলল,
-‘কিরে বিয়ের কনে, মন-টন এত ভার কেন? শুনলাম, তনুদার সাথে নাকি তোর কিছু একটা চলছে?
মিষ্টি উত্তর দিল না। সেতুদিদি একা একাই কতক্ষণ কথা বলে চলে গেল।

সারাটাদিন একপ্রকার ছটফট করেই কাটল মিষ্টির। বিকালে তনুদার সব কাজিনরা মিষ্টিদের বাড়িতে এসে মিষ্টিকে মেহেদী পরিয়ে দিল। অনিক একফাঁকে তনুদাকেও টেনে ধরে নিয়ে এসেছে। তনুদা পায়ের উপরে পা তুলে মিষ্টির সামনে বসে বসে একমনে ফোন টিপছে। মিষ্টি না চাইতেও আঁড়চোখে বার বার তনুদাকে দেখছে। তনুদার কোনো হেলদোল নেই। মিষ্টি নামের মেয়েটাকে সে যেন দেখতেই পাচ্ছে না। সন্ধ্যার দিকে ছোট পরিসরে মিষ্টিদের বাড়ির ছাদে
হলুদ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে। মিষ্টিকে কাঁচা ফুলের গহনা ও হলুদ রঙের সবুজ পাড়ের শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল সেতুদিদি। তনুদা সবুজ কালারের পাঞ্জাবি পরেছে।

দুই বাড়ির হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান একসাথে মিষ্টিদের বাড়ির ছাদেই হচ্ছে। তনুদা এসে স্টেজে বসল। তনুর কাজিনরা মিষ্টিকেও তনুর পাশে বসিয়ে দিল। বড়রা ওদের দুজনকে হলুদ ছুঁইয়ে, মন ভরে আশীর্বাদ করে ফল মিষ্টি খাইয়ে দিল।
তারপর শুরু হলো কাজিনদের নাচ, গানের উৎসব আড্ডা। সারাটা সময় মিষ্টি পুতুলের মতো তনুদার পাশে চুপটি করে বসে রইল। তনুদার মুখটা খুব হাসি হাসি। দেখে মনে হচ্ছে, সে খুব এনজয় করছে। কখনোবা নিজেও গানের তালে তালে বসে বসেই হাত তুলে নাচছে। মিষ্টির মনে শান্তি নেই। মানুষটা তো মিষ্টিকে বিয়ে করতে চায় না। হয়তো তনুদার মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছে। কেন যে মিষ্টির আবেগ বেশি।
-‘এত কী ভাবছিস মিষ্টি?
তনুদা ফিসফিস করে নিচু কণ্ঠে বলল। মিষ্টি চমকে উঠল। চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তনুদার দিকে তাকাল। মানুষটা মিষ্টির দিকে তাকিয়েই ছিল। চট করেই চার চোখের মিলন হয়ে গেল। তনুদা একচোখ টিপে, কেমন করে যেন হাসল। ফিসফিস করে বলল,
-‘তোকে একদম পেত্নীর মতো লাগছে রে মিষ্টি। এত মেকাপ নিয়েছিস কেন? তোকে দেখে তো শ্যাওড়া গাছের পেত্নী গুলোও ভয় পেয়ে পালাবে।
মিষ্টির মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে গেল। গালদুটো লাল টকটক করছে। চোখের কোণও ভিজে উঠল। চোখের জলটুকু লুকাতে অন্যদিকে তাকাল মিষ্টি। তনুদা মিষ্টির বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
-‘এত অস্থির ভাবে সেজেছিস কেন মিষ্টি? তোর দিকে তাকালেই আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। নেশা ধরে যাচ্ছে।
মুখে বলল,
-‘কিরে পেত্নী? মুখ লুকাচ্ছিস কেন? আমি কিন্তু মিথ্যা মিথ্যা প্রশংসা করতে পারি না। যা সত্যি তাই বলেছি।
মিষ্টি আর একটাও কথা বলল না। যে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তনু বলল,
-‘চল ছাদের ওই দিকটাই যাই?
মিষ্টির উত্তরের অপেক্ষা না করেই মিষ্টির একহাত ধরে ছাদের কার্ণিশে নিয়ে গেল তনু। মিষ্টির বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা করছে। তনুদা পকেট থেকে ফোন বের করে মিষ্টিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-‘আর বলো না জান। এক পেত্নী আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে। ঘাড় থেকে যতদ্রুত নামাতে পারব! তত তাড়াতাড়িই তোমার কাছে চলে আসব। আচ্ছা এখন রাখি। লাভ ইউ..
তনুদা বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। তাতে আয়েশ করে সুখটান দিয়ে মিষ্টির মুখের উপরে ধোঁয়া ছাড়ল। কাশতে কাশতে মিষ্টির অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। সিগারেটের তীব্র গন্ধে মাথা ধরে গেল। তনুদা হেসে ফেলল। বলল,
-‘এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গেছিস মিষ্টি? তাহলে সারাজীবন কী করবি? ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবন বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হয়। ভালোবাসা দূর থেকেই সুন্দর। যত কাছে আসবি তত তিক্ততা বাড়বে, দিনশেষে ভালোবাসাও ফুরিয়ে যাবে।
-‘আমি আপনাকে বিয়ে করব না তনুদা।
-‘তা বললে তো হবে না। এখন তোর জন্য আমি বেইজ্জতি হতে পারব না। আমি তো তোকে সুযোগ দিয়েছিলাম। বার বার রিকুয়েষ্ট করেছি। তোর তরফ থেকে বিয়েটা ভেঙে দে। তুই তখন আমার একটা কথাও শুনিসনি। এখন আমি তোর কথা শুনবো কেন?
-‘আপনি কাকে ভালোবাসেন?
-‘তোকে বলব কেন?
মিষ্টি চলে যেতে নিল। তনুদা পিছু ডেকে বলল,
-‘আজ রাতে অন্তত ঘুমাস। এত বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।
মিষ্টি মনে মনে বলল,
-‘করুক। আমি মরে যাই ! তাতে আপনার কী? মুখে বলল,
-‘ঘুমাব।
-‘এত টেনশন করিস না। বিয়েই তো শুধু করব। সংসার তো আর করব না।
মিষ্টি চমকে উঠল। সংসার করবে না মানে কী? সংসার যদি নাই করে তাহলে বিয়ে করবে কেন?
তনুদা হেসে দিল। হাসলে মানুষটাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। এমনিতেই দাড়িগুলো স্টাইল করে ছেটে রাখার জন্য সব সময়ই সুন্দর লাগে তনুদাকে। ফর্সা গায়ে সবুজ পাঞ্জাবি পরেছে দেখে সৌন্দর্যটা শতগুণ বেড়ে গেছে।
মিষ্টি ওর বড়দিদিকে কানে কানে কিছু বলতেই নাচ-গান বন্ধ করে সবাই যে যার মতো চলে গেল। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসল। মিষ্টি তো কিছু খেতেই পারল না। তবে তনুদা গপাগপ খেল। নিজের হলুদের অনুষ্ঠানের খাবার যে এত মজা করে খাওয়া যায় তনুদাকে না দেখলে কেউ বুঝবেই না।
ওরা সবাই চলে যেতেই মিষ্টি পোশাক পাল্টে শুতে চলে গেল। এত কোলাহলে একপ্রকার মাথা ব্যথা করছে মিষ্টির। মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

তনুদা,
আপনি আমাকে ভালোবাসেন না জানার পর আপনাকে আমার কেন জানি, আর বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো না। আমার পাগলামি বা বোকামির জন্য আমি স্যরি। বিয়ের পর যদি সংসারই না করেন। শুধু শুধু বিয়ে করার কোনো দরকার নেই। আপনি আমাকে রিকুয়েষ্ট করেছিলেন। যে করেই হোক আমি যেন বিয়েটা আটকাই। আমি ব্যর্থ। আপনার মনোভাব বুঝার পর অনেক চেষ্টা করেও বিয়েটা আটকাতে পারলাম না৷ তাই আমি দুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম। বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলেই আমি ফিরে আসব। সম্ভব হলে আপনিও ঢাকা চলে যান। বিয়ের দিন বর-বউ দুজনই পালাইছে। এটা ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার হবে কিন্তু।
ইতি,
মিষ্টি।

চিরকুটটা পরে তনু রেগে আগুন হয়ে গেল। ওই পুঁচকে মেয়েটার এতবড় সাহস। ও কীভাবে বিয়ের দিন পালিয়ে যায়? এই সহজ ব্যাপারটা তনু কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। আত্মসম্মানে লেগেছে খুব।
তনুরও জেদ চেপে গেল। চিরকুটটা হাত দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে, দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
-‘বিয়ে তো আমি তোকেই করব মিষ্টি এবং আজই।

চলবে