মিষ্টির তনুদা পর্ব-০৬

0
3

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৬

মিষ্টির খুব রাগ হলো। ইদানীং কারণে-অকারণে তনু মিষ্টিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। মিষ্টির সহ্য হয় না। জেদি কণ্ঠে বলল,
-‘আপনাকে ফ্লোরে ঘুমাতে হবে না। আপনি চলে যান।
“এতরাতে তোর ঘ্যানঘ্যান শুনতে ভালো লাগছে না। চুপ করে থাক।
মিষ্টি ভয়ংকর রেগে গেল। উচু স্বরে বলল,
” চুপ করব না। কী করবেন আপনি?
তনু ভ্রু কুঁচকে মিষ্টির দিকে তাকাল। বলল,
-‘দেখতে চাস.. কী করব আমি?
মিষ্টি তনুর সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসল। চোখে চোখ রেখে বলল,
-‘দেখি..?
তনু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-‘সরে যা মিষ্টি। আমি ঘুমাব।
-‘ঘুমাতে হলে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমাবেন। আমার ঘরে থাকতে পারবেন না আপনি।
-‘কোথায় লেখা আছে এটা তোর ঘর?
-‘এটা আমার ঘর…
-‘আস্তে মাঝরাতে এত চিল্লাস কেন? লোকে তো অন্যকিছু ভাববে।
-‘ভাবুক। আই ডোন্ট কেয়ার।
-‘ইদানীং মুখে খুব বুলি ফুটেছে তোর। তুই আগেই ভালো ছিলি মিষ্টি। দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস।
মিষ্টির চোখে জল এসে গেল। এখন তো মিষ্টিকে ভালো লাগবেই না। মিষ্টি দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকাল। এই গণ্ডারটার সামনে কিছুতেই কাঁদবে না মিষ্টি। কিছুতেই না।
মিষ্টির চোখের জল এত সস্তা না। তনু মিষ্টির মন ভালো করার জন্য বলল,
-‘মুভি দেখবি মিষ্টি?
-‘না।
-‘তুই না আগে মুভি দেখতে খুব পছন্দ করতি?
মিষ্টি দায়সারা ভাবে বলল,
-‘এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না।
তনু মিষ্টির একহাত টেনে ধরে জোর করে নিজের পাশে বসিয়ে দিল। তনুও মিষ্টির গা ঘেষে বসল। তনুর পুরুষালি উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে মিষ্টি কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শব্দ হচ্ছে। মনটা খুব অশান্ত। তনু ফোনটা হাতে নিল। কতক্ষণ ফোন ঘাটা-ঘাটি করে, ইচ্ছে করে একটা রোমান্টিক হিন্দি মুভি ছেড়ে দিল।
মিষ্টির দৃষ্টি ফোন ছাপিয়ে তনুর ফর্সা হাতে স্থির। মুভি দেখায় কোনো মনযোগ নেই। এই নিশুতি রাতে একাকী ঘরে তনুর সাথে থাকতে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। পাছে না তনু মিষ্টির অনুভূতি বুঝে ফেলে, নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপনে চেষ্টা করছে মিষ্টি। তনু বোধহয় মিষ্টির ছটফটানি বুঝতে পারল। ইচ্ছে করে ঘরের লাইটটা বন্ধ করে দিল। ফোনের আবছায়া আলোতে মিষ্টিকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
মিষ্টির অবাধ্য খোলা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে বরংবার তনুর চোখ-মুখ আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মিষ্টি রেশম চুলগুলো থেকে সুন্দর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে৷ অন্যরকম ভালোলাগা, আবেশে বুঁদ হয়ে রইল তনু।

প্রায় পয়ত্রিশ মিনিট পরে মুভিতে শুরু হলো; অতিরিক্ত রোমান্টিক দৃশ্য। নায়ক ঝগড়ার এক পর্যায়ে জোর করে নায়িকার ঠোঁট জোড়া নিজের উত্তপ্ত ঠোঁট জোড়া দিয়ে চেপে ধরল। হঠাৎ কী হলো নায়িকার তিন সেকেন্ড সময় লাগল বুঝতে। নায়িকা ছটফট করে উঠল। নায়ক নায়িকাকে ছাড়ার বদলে আরও একটু গভীর ভাবে নিজের সাথে চেপে ধরল।
এই দৃশ্য দেখে মিষ্টির শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত বেড়ে গেল। অতিরিক্ত লজ্জায় চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল মিষ্টি। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই মানুষটা এত বেহায়া কেন? মিষ্টিকে সাথে নিয়ে এই মুভিটা দেখতে একটুও কী লজ্জা করল না? ছিহ…
তনুর শরীরের রক্ত কণিকা টগবগ করে ফুটছে। ফোনটা অফ করে দিয়ে, মোহাচ্ছন্ন হয়ে মিষ্টিকে কাছে টেনে নিল তনু। তনুর আকস্মিক স্পর্শে মিষ্টি যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। বিবশ অনুভূতি একটু একটু করে ওর মন-মস্তিষ্ক গ্রাস করে নিচ্ছে। তনু মিষ্টির কানের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে গাঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
-‘একটু আগে মুভিতে যে দৃশ্য দেখলি। এই একই কাজ আমিও যদি তোর সাথে করি। তুই কী খুব রাগ করবি মিষ্টি?
মিষ্টির পেটের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরল। অতিরিক্ত লজ্জায় ফর্সা মুখটা রক্তবর্ণ ধারণ করল। বুকের ভেতর ঘূর্ণিঝড়ের এলোমেলো, অশান্ত বাতাস বইছে।
তনু আচমকা মিষ্টিকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল। মিষ্টির মনে হচ্ছে, ও বোধহয় সত্যি সত্যিই এবার দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। এত কেন গা গুঁলাচ্ছে? মিষ্টি রীতিমতো ভয় পেল। তনুদার ভাব-ভঙ্গী অস্বাভাবিক ঠেকছে। অতিরিক্ত ভয় পেয়ে দুইহাতে মুখ ঢেকে, ঝরঝর করে কেঁদে দিল মিষ্টি।
মিষ্টির কান্নার শব্দে তনু ঘোর কেটে গেল। এবার নিজের উপরই ভীষণ রাগ লাগছে তনুর। মিষ্টির কান্নাও সহ্য হচ্ছে না। মিষ্টিকে আচমকা ধাক্কা দিতেই মিষ্টি ভড়কে গেল। তনু মিষ্টির হাতদুটো শক্ত হাতে চেপে ধরল। মিষ্টির চোখে চোখ রেখে, চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘তুই এত ন্যাকামো করছিস কেন মিষ্টি? ভাব করছিস যেন তুই কিছুই বুঝিস না। কচি খুকি। আমাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিলি। অথচ বিয়ের পর বরকে আদর-সোহাগ করতে হয়। এগুলো জানিস না? এ্যাঁই..এখনো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস কেন? কান্না বন্ধ কর। নাহলে মারব ঠাটিয়ে এক থাপ্পড়। অসহ্য। এই আমি চলে যাচ্ছি। আর জীবনেও তোর কাছে আসব না। তুই আমাকে ডেকে ডেকে মরে গেলেও না। তুই থাক তোর ভাব নিয়ে। আর তোর ননীর শরীর আলমারিতে তুলে তালা দিয়ে রাখ। বেয়াদব কোথাকার। ঢঙ দেখলে গা জ্বলে যায়।
কথাগুলো একদমে বলেই তনু মিষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ল। মিষ্টি বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমাদের বিয়ে এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।
কথাটা এতই আস্তে করে বলল মিষ্টি। তনু শুনতেই পেল না।
তনু যাওয়ার আগে আঙুল তুলে মিষ্টিকে শাসিয়ে বলল,
-‘খবরদার আমার ঘরের দিকে ভুলেও তাকাবি না তুই। যদি আর একবার তোকে বেহায়ার মতো তাকাতে দেখি। তোর চোখদুটো আমি গেলে নেব।

রাতদুপুরে তনু মিষ্টির সাথে রাগ কর চলে গেল। মিষ্টি ভয়ে, লজ্জায় মানুষটাকে বাঁধা দেওয়ারও সাহস পেল না। সারারাত কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটো ফুলিয়ে ফেলল মিষ্টি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গেল।
সবার ডাকা-ডাকিতে মিষ্টির ঘুম ভাঙল। ঘুম ভেঙে ওর পাশে তনুকে ঘুমাতে দেখে রীতিমতো চমকে উঠল মিষ্টি। কখন ওর পাশে এসে ঘুমিয়েছে মানুষটা?

তনু-মিষ্টির বাসি বিয়ে ভালোভাবেই সম্পূর্ণ হলো।

পরেরদিন সমস্ত নিয়ন মেনে ঘরোয়া পরিবেশে মিষ্টির বৌভাতের অনুষ্ঠান হলো। সেই অনুষ্ঠানে ঘটা করে মিষ্টির ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব নিল তনু।

তাছাড়া দুই পরিবারের আগে থেকেই কথাবার্তা। এখন শুধু বিয়েটা হলো। তনুর চাকরি হয়ে গেলে তখন বড় করে রিসিপশনের অনুষ্ঠান করবে। আপাতত মিষ্টি চাইলে মিষ্টিদের বাড়িতেও থাকতে পারবে। যেহেতু তনু বাড়িতে থাকে না।

বৌভাতের দিন বিকালবেলা মিষ্টিকে কিছু না বলে ঢাকা চলে গেল তনু। তনু যে চলে গেছে মিষ্টি জানলো রাত দশটার পরে। আগামীকাল থেকে নাকি তনুর পরীক্ষা শুরু হবে। আবার কবে আসবে কেউ সঠিক বলতে পারল না।
মিষ্টির বুকের ভেতর ভেঙে এলো। কেউ না জানুক! মিষ্টি তো জানে। মিষ্টির সাথে রাগ করেই মানুষটা চলে গেছে। নাহলে আজকের মতো বিশেষ একটা রাতে কেউ বউ ফেলে চলে যায়? যতই পরীক্ষা থাকুক। যাওয়ার আগে একবার মিষ্টিকে বলেও গেল না। কী নিষ্ঠুর.. কী নিষ্ঠুর..মানুষটা।
মিষ্টি রাতে ভাত খেতে পারল না। তনুর ঘরটা ফুল-টুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মিষ্টি ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর তনুকে ফোন দিল। লাগাতার ফোন দিতেই থাকল। পর পর একুশবার ফোন দেওয়ার পর তনু ফোন রিসিভ করল। মৃদু ধমকের সুরে বলল,
-‘বার বার ফোন দিচ্ছিস কেন মিষ্টি?
মিষ্টি কান্না গিলে ফেলে কোমল কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি আমাকে না বলে ঢাকা চলে গেছেন কেন?
-‘সেই কৈফিয়ত আমি তোকে দেব নাকি? তুই আমার কে?
মিষ্টি মনে মনে হাজারবার বলল,
-‘আমি আপনার বউ..আমি আপনার বউ..আমি আপনার বউ…..
মুখে বলল,
-‘আপনি জানেন না?
তনু কণ্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
-‘না জানি না। ফোন রাখ তুই।
-‘আপনি আবার কবে আসবেন?
-‘জীবনেও আসব না। তোর ভাব দেখার সময় নেই আমার। আমি আমার সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আজ ডেটে যাব। তারপর আমার গার্লফ্রেন্ডের লিপস্টিক আঁকা সুন্দর ঠোঁটে গভীর চুমু খাব। তুই কী সেই দৃশ্য দেখতে চাস মিষ্টি?
-‘ছিঃ..
-‘ফোন রাখ মিষ্টি। তোর সাথে কথা বলতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না।
-‘তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?
-‘সেই কৈফিয়ত তো আমি তোকে দেব না। আমার ইচ্ছেতে আমি বিয়ে করেছি। এখন তোর যদি ইচ্ছে হয়। তুই বিয়েটা ভেঙে দিতে পারিস। এখন রাখি। খবরদার ভুলেও ফোন দিবি না আমাকে। তোর সাথে কথা বললেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
মিষ্টি মনে মনে বলল,
-‘আমার সাথেই আপনাকে সারাজীবন কথা বলতে হবে। একশোবার ফোন দেব আমি আপনাকে। হাজারবার ফোন দেব। কী করবেন আপনি?
তবে মুখে কিছুই বলার সাহস পেল না।

(চলবে)