মিষ্টির তনুদা পর্ব-১৩

0
3

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৩

তনুর ভার্সিটি জীবনের খুব কাছের বন্ধু রবিদের বাড়ি গাজীপুর। রবির পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজ বিয়ের দ্বিতীয় দিন। এতক্ষণে হয়তো বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়িতেও চলে এসেছে রবি। খুব ধুমধাম করে বিয়ে করছে। ওদের পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছে রবি। তনু মিষ্টিকে নিয়ে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছে। রবিদের বাড়ি যেতে রাস্তার পাশেই দেখল, বিশাল পদ্মবিল। তনু কী মনে করে, রাস্তার একপাশে বাইক থামিয়ে মিষ্টিকে বলল,
“আস্তে করে নাম মিষ্টি।”
মিষ্টি শাড়ির কুঁচি কায়দা করে ধরে নেমে দাঁড়াল। ওরা যখন পদ্মবিলের দিকে হেঁটে গেল। তখন দুপুরের কড়া রোদ সরে গিয়ে, প্রকৃতিতে শীতল ছায়া পড়েছে, গাছের ফাঁকফোকর গলে লাল রঙা সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিম আকাশে এলিয়ে পড়েছে। বর্ষার টইটম্বুর জলে কলমির ডাটার ভাঁজে ভাঁজে অজস্র পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। মিষ্টি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। এত সুন্দর, মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সহজে চোখ ফেরানো যায় না। ওরা দুজন নৌকায় উঠল। নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে চারপাশ মুখরিত। মিষ্টি হাত বাড়িয়ে একেক পর এক পদ্মফুল ছিঁড়ে নিচ্ছে। ঠোঁটের কোণে একটুখানি মিষ্টি হাসি ফুটে রইল। তনু কী মনে করে একটা পদ্মফুল মিষ্টির কানের পিঠে গুঁজে দিল। মিষ্টি আবেশে দুচোখ বুঁজে ফেলল। তনু পকেট থেকে ফোন করে ফটাফট
মিষ্টির কতগুলো সুন্দর ছবি তুলে ফেলল। মিষ্টি আহ্লাদ করে বলল,
“একটু ভিডিও করে দেন?”
তনু কতগুলো পদ্মফুল নৌকার কার্ণিশে রেখে দিল। মিষ্টিকে ইশারায় বলল,
“নৌকার কার্ণিশে শাড়ির আঁচল মেলে দিয়ে, চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়।”
মিষ্টি তাই করল। মিষ্টির শাড়ির আঁচলেও কতগুলো পদ্মফুল রেখে দিল তনু। তারপর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বিভিন্ন স্টাইলে ভিডিও করে দিল। একপর্যায়ে মিষ্টিকে কাছে টেনে নিল তনু। মিষ্টির পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, কাঁধে হাত রেখে দুজনের বেশ কিছু কাঁপল ছবি তুলে নিল।
রবিদের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা লেগে গেল। তনু সবার শেষে এসেছে। বাকি বন্ধুরা আগেরদিনই চলে এসেছে। রবি তনুকে দেখে এগিয়ে এলো। বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এত দেরি হলো কেন আসতে?”
তনু স্মিত হেসে রবির পিঠ চাপকে বলল,
“তোকে তো দেখতে হেব্বি লাগছে।”
রবি মিষ্টিকে দেখিয়ে ইশারায় ফিসফিস করে বলল,
“মেয়েটা কে?'”
“মিষ্টি।”
“তোর বউ?”
“হ্যাঁ।”
রবি কিছু বলার আগেই বাকি বন্ধুরা হৈ হৈ করে চলে এলো। তনুকে হাইফাইভ করে, মিষ্টিকে দেখিয়ে অরিন্দ্র বলল,
“এটা কে মামু? নিশ্চয়ই তোমার নতুন গার্লফ্রেন্ড? তা এবার প্রেম কতদিন টিকবে?”
তনু চোখ পাকালো। অরিন্দ্র পাত্তা দিল না। মিষ্টিকে বলল,
“হেই সুন্দরী? কী অবস্থা?”
মিষ্টির মনটা খারাপ হয়ে গেল। তনু কিন্তু বাকি বন্ধুদেরও মিষ্টিকে তনুর বউ বলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতো। আগেও তনুর সত্যি সত্যি প্রেমিকা ছিল নাকি? সেই প্রেম কতটা গভীর হয়েছিল? প্রেমিকা তনুকে ছেড়েই বা গেল কেন? মিষ্টির ভালো লাগছে না। মনটা খুব অশান্ত। এখানে না এলেই বরং ভালো হতো।
প্রান্ত তনুর গা টিপে ফিসফিস করে বলল,
“তা নতুন প্রেমিকা কতটা ভালো সার্ভিস দিচ্ছে বন্ধু? আগেরটা তো খুব ভালো পারফরম্যান্স করতো..
রবি চোখ রাঙাল। প্রান্ত আস্তে কথা বলার চেষ্টা করলেও কথাটা বেশ জোরেই শোনা গেল। প্রান্তকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
” চুপ কর।”
মিষ্টির খুব কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক ছুটে বাড়ি চলে যেতে। মানুষটা এমন কেন? আগেও অন্যকারো সাথে শুয়েছে নাকি? জানতে হবে মিষ্টিকে। কিন্তু কার কাছ থেকে জানবে ও?
মিষ্টি স্বাভাবিক থাকার প্রাণপনে চেষ্টা করছে। মনটা শরৎতের মেঘলা আকাশের মতই নিকেশ কালো আঁধারে ঢাকা। বুকের ভেতর কী যেন একটু একটু করে ভাঙছে।
রবির বউকে যে ঘরে বসানাো হয়েছে। মিষ্টিকে সেই ঘরে বসতে দেওয়া হলো।

তনুরা সবগুলো বন্ধু-বান্ধব মিলে ছাদে বসে ধুমপান করছে। শুধু প্রান্তকেই কোথাও দেখা গেল না। তনু একমনে সিগারেট ফুঁকছিল।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তনু সবাইকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মিষ্টি আমার বউ।”
রবি বাদে সবাই চমকে উঠল। মিষ্টিকে দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই। যে মেয়েটা বিবাহিত। তনু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ের আগে কোনো ছেলেই শুদ্ধ পুরুষ থাকে না। থাকলেও সংখ্যাটা খুবই কম। কম-বেশি সবারই একটু না একটু চরিত্রে দোষ থাকে। আমারও ছিল। একটু না অনেকটাই। তবে বিশ্বাস কর। মিষ্টিকে বিয়ে করার পর আমি আর কখনো কোনো মেয়ের সংস্পর্শে যাইনি। তোরা কেউ মিষ্টিকে এমন কিছু বলবি না। যা-তে আমার নতুন সংসার শুরু করার আগেই ভেঙে যায়। অশান্তি হয়। মিষ্টির সাথে আমার বিয়ের সময়ও আমার বিয়েতে একটুও মত ছিল না। তবে এখন ওকে আর আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না। আমাদের বিয়েটা আমি মন থেকেই মেনে নিয়েছি। আমি মিষ্টিকে নিয়ে খুব হ্যাপি আছি। ওর বয়স, বোধবুদ্ধি কম হলেও মনটা খুব সরল। মনে কোনো ঘোর-প্যাঁচ নেই। এমন ভালো মনের বউ নিয়ে হাজার বছর সুখে-শান্তিতে সংসার করা যায়।”
রবি তনুর কাঁধে হাত রাখল। বলল,
“তুই হ্যাপি থাকলে আমরাও হ্যাপি। চিন্তা করিস না। মিষ্টি বউদি তোর অতীত নিয়ে কিছুই জানতে পারবে না।”
তনু বলল,
“মিষ্টি খুব সেনসেটিভ মনের মেয়ে। ও আমার বিষাক্ত অতীত জানলে সহ্য করতে পারবে না। ওকে নিয়ে আমার আজকাল খুব ভয় হয়।”

প্রান্ত অনেকক্ষণ যাবৎ মিষ্টির আশেপাশেই ঘুরঘুর করছিল। একদেখায় প্রচণ্ড ভালো লেগে গেছে মিষ্টিকে। তাছাড়া তনু বাজি ধরে প্রান্তর গার্লফ্রেন্ডকে কঠিন প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। সবকিছুই মজার ছলে করেছিল তনু। তনুর ধারণা মেয়েটা নাকি সুবিধার ছিল না। প্রান্তর বিশ্বাস হয় না। প্রান্ত আজও মনে মনে তনুকেই দোষে। তনুর জন্যই প্রান্তর সিরিয়াস প্রেমটা ভেঙ্গে গেছে। প্রান্তও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তনুর প্রেমিকাকেও প্রান্ত তনু স্টাইলে পটিয়ে বিছানায় নেবে। তারপর তনুকে রসিয়ে রসিয়ে বলবে,
“তোর প্রেমিকারও সুবিধার না।”
অনেকগুলো দিন পর সৃষ্টিকর্তা প্রান্তর মুখ তুলে চেয়েছে। প্রান্তও সুযোগ বুঝে মিষ্টির কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“তনুর ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলার ছিল।”
মিষ্টি বিস্ময় চেপে আস্তে করে উঠে গেল। দুজনে রবির ঘরের পেছনের বড় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। মিষ্টি নিচু কণ্ঠে বলল,
“কী বলবেন?”
প্রান্ত খুব সাবধানে ফিসফিস করে বলল,
“তনুর সাথে কতদিন রিলেশনে আছেন আপনি? ওর অতীত জানেন?”
“না।”
“সেকি! খোঁজ খবর না নিয়েই রিলেশনে গেছেন? অবশ্য আপনার বয়স কম। তনুর মতো প্লেবয়ের আপনাকে পটাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। যাইহোক তনু কিন্তু পাক্কাা মেয়েবাজ। কোনো মেয়ে ওর সাথে একবার বিছানা মজালে দ্বিতীয়বার সেই মেয়েকে ছুঁয়েও দেখে না তনু। তাছাড়া ও আগে ওইসব খারাপ জায়গাও যেত নাকি। আর একটা কথা, ও কিন্তু পাক্কা অভিনেতা। এত নিখুঁত অভিনয় করে, ওর যে চরিত্রে দোষ আছে। ওর মা-বাবাই জানে না। জানবে কীভাবে! ছেলে তো প্রচুর চালাক। এলাকায় কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। আপনাকে দেখে আমার খুব ভালো মনে হলো। আপনাকে ঠকতে দেখে আমার একটুও ভালো লাগতো না। তাই আপনাকে কথাগুলো বললাম। আমার কথা বিশ্বাস নাহলে তনুকে কথার মারপ্যাঁচে চেপে ধরবেন। দেখবেন সব স্বীকার করে নেবে। আর হ্যাঁ, আমি যে কথাগুলো বলেছি। এই কথা ভুলেও তনুকে বলবেন না। এখন আসি কেমন?”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই প্রান্ত গটগট করে চলে গেল।
এত শক্ত শক্ত কথা মিষ্টির কোমল মস্তিষ্ক হজম করতে পারল না। মাথা ঘুরে উঠল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে আসছে। চোখের জলে কাজল লেপ্টে গেছে। তনুর ওই ঠোঁট, ওই হাত, ওই বুক মিষ্টির আগে অন্যকোনো মেয়ে গভীর ভাবে ছুঁয়েছে। এই অতিসহজ কথাটাই মানতে পারল না মিষ্টি। শুধু কী তাই? তনুর পুরুষসত্ত্বা একাধিক নারীর সংস্পর্শে পরিপূর্ণ হয়েছে। উফ, এত কষ্ট কোথায় রাখবে মিষ্টি? তনু খারাপ মেয়েদের কাছেও টাকার বিনিময়ে থাকতে যেত। ছিঃ…আরকিছু ভাবতে পারে না মিষ্টি। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। মিষ্টির তো কখনো কোনো খারাপ অতীত ছিল না। তাহলে কেন ওই খারাপ মানুষটাই মিষ্টির হৃদয় জুড়ে বিচরণ করল? মিষ্টির নিঃশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? মানুষটা তো এমন ছিল না? পুরো এলাকায় ওনার নামে কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। ছাত্র ভালো হওয়ার জন্য ছোটোবেলা থেকেই তার খুব নামডাক। তবে কী ঢাকা গিয়ে বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পরেই নষ্ট হয়ে গেল মানুষটা?
“এখানে একা একা কী করছিস মিষ্টি?”
কারেন্ট নেই। এইদিকটা বেশ অন্ধকার। মাত্র কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর মিষ্টি আছড়ে পড়ল তনুর বুকে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলল। তনু মিষ্টিকে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে গেল। মিষ্টির পিঠে হাত রাখতেই মিষ্টি জ্বলে উঠল। তনুকে ধাক্কা দিয়ে খানিকটা দূরে সরিয়ে দিল। শীতল কণ্ঠে বলল,
“আমি এখুনি বাড়ি যাব।”
“আজ না…”
“বললাম তো আমি এখুনি বাড়ি যাব।”
“চুপপ..সবাই শুনতে পেলে কী ভাববে? তুই এমন করছিস কেন?”
” আমি বাড়ি যাব।”
“অযথা জেদ করিস না মিষ্টি?”
“আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে দেব?”
তনু চমকে উঠল। সবকিছু তো ঠিকই ছিল। হঠাৎ কী এমন হলো? মিষ্টি এমন পাগলামি করছে কেন? ও-কি তনুর ব্যাপারে কিছু শুনে ফেলেছে? ভয়ের এক শীতল স্রোত তনুর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। গা কাঁপছে খুব। তনু মিষ্টিকে ছুঁতে গেল। মিষ্টি ছিটকে দূরে সরে গেল। আগে জানলে এখানে মিষ্টিকে নিয়ে জীবনেও আসতো না তনু। মরে গেলেও না। ইশ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। তনু মিষ্টির মুখটা চেপে ধরে একটা ঘরে নিয়ে গেল। ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতেই মিষ্টি আচমকা তনুর শার্টের কলার শক্তহাতে চেপে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আপনি এত খারাপ কেন? কেন আমাকে ঠকালেন? আমি কী এমন ক্ষতি করেছিলাম আপনার?”
তনু অসহায় বোধ করল। বিড়বিড় করে বলল,
“তুই আমাকে ভুল ভাবছিস মিষ্টি।”
“আমি তো মানতেই পারছি না। এই.. এই হাত দিয়ে আপনি আমার আগে অন্যকাউকে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছেন। রাতভর ভালোবেসেছেন। এমনকি টাকার বিনিময়েও খারাপ মেয়েদের সাথে ছিঃ…
” তোকে এসব কথা কে বলেছে?”
“কেন সে-কি কিছু মিথ্যে বলেছে?”
তনু মিষ্টির গালদুটো আঁজলায় তুলে ধরল। মিষ্টির ভেজা চোখে ঠোঁট ছুঁয়াতেই মিষ্টি মরিয়া হয়ে সরে যেতে চাইল। তনু যেতে দিল না। একহাত দিয়ে মিষ্টির কোমর শক্ত করে চেপে ধরল। মিষ্টির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“আমি মানছি আমি বিয়ের আগে যা করেছি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দে মিষ্টি। তুই শুধু দেখবি, আমি এখন কীভাবে চলাফেরা করি। এখন আমার কোনো খারাপ রেকর্ড আছে নাকি।”
“আমি মানতে পারছি না। এভাবে আমাকে না ঠকালেও পারতেন। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন? আপনার স্পর্শে আমার গা গুলাচ্ছে।”
তনুর বুকের ভেতর ভেঙে এলো। তবে মিষ্টিকে ভুলেও ছাড়ল না। আরও শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখল।

(চলবে)