মিষ্টির তনুদা পর্ব-১৫

0
2

#মিষ্টির_তনুদা
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৫

মিষ্টি কান্না ভেজা চোখ তুলে তনুর ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকাল। মিষ্টির হাত দিয়ে এতবেশি রক্ত ঝরছে। এতক্ষণ মনে মনে ভয় পেলেও তনুকে দেখে সব ভয় উধাও হয়ে গেল। মনে প্রচুর জেদ চাপল। এই মানুষটা মিষ্টিকে চরম ভাবে ঠকিয়েছে। কথাগুলো ভাবলেই মিষ্টির পাগল পাগল লাগে। সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিতে ইচ্ছে করে। এমনকি নিজেকেও শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।
তনু সম্মতি ফিরে পেতেই মিষ্টির হাতটা ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলল। মিষ্টি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তনুকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। চিৎকার করে বলল,
“ছাড়ুন আমাকে! আমি আজ আপনার চোখের সামনে নিজেকে শেষ করে দেব। কী ভেবেছেন কী? আমাকে ঠকিয়ে আপনি জিতে যাবেন? না..আমি আপনাকে এত সহজে জিততে দেব না। কিছুতেই না।”
তনু ভেজা কণ্ঠে বলল,
“মিষ্টি ডাক্তারের কাছে চল? তোর হাতের অবস্থা ভালো না।”
মিষ্টি জেদি কণ্ঠে বলল,
“যাব না। আপনি চলে যান তো.. আমার চোখের সামনে থেকে। আপনাকে অসহ্য লাগছে।”
তনু মিষ্টির একটা কথাও শুনল না। মিষ্টিকে জোর করে পাজকোলা করে ফার্মিসিতে নিয়ে গেল।
ডাক্তারের কথামতো তুলোতে ভায়োডিন ভিজিয়ে তনু মিষ্টির হাতের রক্ত ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দিল। মিষ্টির মা পাশে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছে। মেয়ের এতটা অবনতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
ভাগ্যিস মিষ্টির হাতের রগ কাটেনি। রক্ত পরা বন্ধ হয়েছে। ডাক্তার ব্যান্ডিস করে দিল। তারপর কিছু ব্যাথার ঔষধ কিনে মিষ্টিকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। খবর পেয়ে তনুর সবগুলো কাজিন মিষ্টিকে দেখতে এলো। কতবার কতভাবে জিজ্ঞেস করল,
“হাত কেটেছিস কেন মিষ্টি?”
মিষ্টি যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে৷ একটা টু শব্দও করল না। তনুও মিষ্টির পাশে চুপটি করে বসে আছে। মিষ্টির মা অন্নপূর্ণা রানী মিষ্টির মাথায় তেল ঠেসে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর নীরবতা ভেঙে তনু বলল,
“কাকিমা মিষ্টিকে কিছু খেতে দেন। গতকাল রাত থেকে ও না খেয়ে আছে।”
তিনি তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ভাতের থালা নিয়ে এসে নিজের হাতে ভাত মেখে মেয়েকে খাইয়ে দিলেন। মিষ্টি বিনাবাক্যব্যয়ে মায়ের হাতে ভাত খেয়ে নিল।
তনু মিষ্টির মুখের সামনে ঔষধ তুলে ধরতেই মিষ্টি মুখ সরিয়ে নিল। তনু একপ্রকার জোর করেই মিষ্টিকে ঔষধ খাইয়ে দিল।
মিষ্টি বলল,
“মা আমি এখন ঘুমাব।”
মিষ্টির কথাশুনে সবাই একে একে উঠে চলে গেল। শুধু তনু মিষ্টির পাশেই বসে রইল। কিছু সময় কেটে যাবার পর, তনু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চল আমি তোকে তোর ঘরে নিয়ে যাচ্ছি?”
“কোনো দরকার নেই। আপনি চলে যান।”
অন্নপূর্ণা মৃদু ধমকে স্বরে বলল,
“এ আবার কেমন কথা, মিষ্টি?”
তনু মিষ্টির কথা গায়ে মাখল না। মিষ্টিকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। তনু ঘরের ভেতর থেকে দরজা চাপিয়ে দিতেই মিষ্টি চাপা কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলল,
“যতই ভালোমানুষির নাটক করেন না কেন! সত্যিটা কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে না। আর না আপনি সত্যি সত্যি খারাপ থেকে ভালো হয়ে যাবেন। আপনি যতই রিকুয়েষ্ট করেন। আমি কিছুতেই আপনার সাথে আর সংসার করব না।”
“সামান্য একটা কারণে আমাদের সংসারটা তুই ভেঙে দিবি মিষ্টি?”
রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে মিষ্টির শরীর জ্বলে গেল। একহাত দিয়ে তনুর শার্টের কলার চেপে ধরে, চোখে চোখ রেখে জেদি কণ্ঠে বলল,
“কোনটাকে সামান্য কারণ বলছেন আপনি? লজ্জা লাগছে না আপনার? এতকিছুর পরও কত সহজেই বলছেন। সামান্য একটা কারণ। এই একই কাজ আমিও যদি করতাম মেনে নিতে পারতেন আপনি? জীবনেও মেনে নিতেন না। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পুরো এলাকা রটিয়ে দিতেন।”
“মেনে নিলাম আমি খারাপ। তবে আমার খারাপ হওয়ার পেছনের গল্পটা শুনবি না মিষ্টি?”
“না।”
তনু বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আচ্ছা না শুনলি। তবে আমি যে তোকে ছাড়তে পারব না মিষ্টি।”
“আকাম-কুকাম করার সময় মনে ছিল না?”
“বার বার এক কথা কেন বলিস? এগুলো আমাদের বিয়ের আগের ঘটনা। আমি কিন্তু অস্বীকার করতে পারতাম। যেহেতু তোর কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। আমি একবারও অস্বীকার করিনি। আরেহ্.. স্বয়ং ভগবান এতবার ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেন। আর তুই মানুষ হয়েও আমাকে ক্ষমা করতে পারছিস না?
মিষ্টি বলল,
“আমিও ক্ষমা করব। তবে এই একই কাজ আমি করব৷ তারপর..
মিষ্টি আরকিছু বলতে পারল না। বাকি কথা মুখেই রয়ে গেল। তনু আচমকা মিষ্টির টুঁটি শক্ত হাতে চেপে ধরল। অতিরিক্ত রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। চাপা কণ্ঠে বলল,
“কথাটা আমার বল?”
মিষ্টি তনুর কাছ থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিল। কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলল,
“আমার কথা শুনেই আপনার শরীর জ্বলছে। অথচ আপনি কতশত রাত নারী শরীরে মজে ছিলেন। কথাগুলো হঠাৎ জানার পর আমার কেমন লেগেছে, একবারও ভেবে দেখেছেন? আমার বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এই কষ্ট আমি কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারছি না। কারণ আপনার সম্মান জড়িয়ে আছে। আবার সহ্য করতেও পারছি না।”
তনু মিষ্টিকে বুকে টেনে নিল। মিষ্টির পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে মলিণ কণ্ঠে বলল,
“তোর সব দুঃখ-কষ্ট আমি ভুলিয়ে দেব মিষ্টি।”
“কীভাবে ভুলাবেন? চোখ বুঁজলেই কতগুলো উন্মুক্ত নারী শরীর আমার চোখের পাতায় ভেসে উঠে। আপনি সেই নারী শরীরগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন। আমি সহ্য করতে পারছি নাতো।”
“তুই এসব নিয়ে আর ভাবিস না মিষ্টি।”
“আমি ভাবতে চাই না। অটোমেটিক ভাবনা গুলো মনে এসে যায়। চোখে ভাসে। আপনি ছাড়ুন তো আমাকে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না।”
তনু আর একটু গভীর ভাবে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরল। গাঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“আমি তোর ভালোলাগার ঔষধ হতে চাই মিষ্টি।”
মিষ্টির খুব ক্লান্ত লাগছে। বলল,
“একই সাথে একটা মানুষকে ভালোবাসা ও ঘৃণা করা অনেক কঠিন ব্যাপার। অনেক কঠিন মানে অনেক কঠিন। আপনি একটা মানুষকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। আবার তাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। সেই নিকৃষ্ট অনুভূতিটা কেমন লাগবে আপনার?”
তনু চমকে উঠল। বুকের ভেতর ক্ষয়ে গেল। মিষ্টি কী তবে তনুকে ঘৃণা করে? এই মেয়েটাকে তো কখনো ভালোবাসেনি তনু। বলতে গেলে একপ্রকার মায়ের জোড়াজুড়িতে ওদের বিয়েটা হয়েছে। আর পাঁচটা কাঁপলের মতো ওদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছে। মিষ্টি তনুকে ঘৃণা করে কথাটা শোনার পর থেকে এত কেন কষ্ট হচ্ছে? বুকের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। তবে কী তনুও মিষ্টিকে বেখেয়ালে ভালোবেসে ফেলেছে? এত তাড়াতাড়ি ভালোবাসা হয় বুঝি? কী জানি! তনু মিষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসল। বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। তারপর তাতে আয়েশ করে একটা সুখটান দিল। বলল,
“ইন্টার ১ম বর্ষে পড়াকালীন আমার জীবনে প্রথম প্রেম এলো। মেয়েটাকে ভেঙেচুরে ভালোবেসেছি। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ওর সব আবদার পূরণ করতাম। ও যখন যা বলতো তাই শুনতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, দামি দামি গিফট কিনে দেওয়া। আরও কতকিছু। তিনবছর চুটিয়ে প্রেম করলাম। মা অবশ্য জানতো। এডমিশন টেস্ট নিয়ে আমি তখন মহাব্যস্ত। ওকে আগের মতো সময় দিতে পারছিলাম না। ও ভাবতো আমি ওকে ভুলে যাচ্ছি। নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছি। মিথ্যা সন্দেহ করে যতটুকু সময় ফোনে কথা বলতাম। সারাক্ষণ ঝগড়া করতো। তবুও কেন যেন আমি ওকে ছাড়তে পারিনি। তখন বয়স কম, আবেগ ছিল বেশি। একদিন খবর এলো ওর বিয়ে হয়ে গেছে। প্রবাসী জামাই। ওকেও নাকি খুব শীঘ্রই নিয়ে যাবে।
তিনবছর প্রেম করার পর তার মনে হয়েছে। সমবয়সী প্রেমে নাকি কোনো ভবিষ্যত নেই। সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে সব জায়গা এমনকি ওর জীবন থেকেও ব্লক করে দিল।
আমার নষ্ট জীবনের সূচনা সেখান থেকেই শুরু হলো। ওকে আমি কিছুতেই ভুলে থাকতে পারছিলাম না। বন্ধুদের প্রচারণায় ওই সব খারাপ জায়গা যেতাম। নেশা করতাম। যেন ওকে আমি ভুলে থাকতে পারি। কাউকে আর দ্বিতীয়বার ভালোবাসার সাহস পাইনি। তবে টাইমপাস করেছি প্রচুর। তুই ভালো মেয়ে। তোকে আমার একটুও বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। মাকে অনেকবার বারণ করেছি। মা শুনেনি। মায়ের মাথায় হাত রেখে দিব্যি কাটিয়েছে। তোকেই বিয়ে করতে হবে। আমার ধারণা আমার অবনতির কথা কোনো ভাবে মা জেনে গিয়েছিল। আর বাঙালি মানুষের প্রধান অস্ত্র ছেলে-মেয়ে বিপথে গেলে বিয়ে দেওয়া। তাদের ধারণা বিয়ে হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মা যখন জানতে পারল। তুই আমাকে পছন্দ করিস। মা এই সুযোগটা লুফে নিল। তার বিপথগামী ছেলেকে ঘরকুনো করতে রাতারাতি তোকে আমার বউ বানিয়ে দিল। ভাবল, ঘরে বউ এলে যদি আমার মতি ফিরে। মায়ের ধারণা সত্যি হয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। তবে তোকে বিয়ে করার পর আমি আর কখনো ওইসব খারাপ জায়গায় যাইনি।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই বড় করে দম ছাড়ল তনু। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে একটুখানি হয়ে গেছে। মিষ্টি কেঁদে দিল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“জেঠী এতবড় প্রতারণা আমার সাথে করতে পারল?”

(চলবে)