মায়াতীর সংসার পর্ব-০২

0
3

#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২

এরপর যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হাসপাতালে ছিলাম। মিহান পাশেই বসা ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল

“তুমি ঠিক আছো?”

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তীব্র ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও বেশ শক্ত গলায় উত্তর দিলাম

“হুম ঠিক আছি। সাহায্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”

মিহান কিছুটা বিস্ময়ে বলল

“আপনি করে কেন বলছো?”

আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম

“কাছের কাউকে ছাড়া আমি তুমি বলি না।”

মিহান আমতা আমতা করে উত্তর দিল

“আগের সব ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। প্লিজ মনে রাগ পুষে রেখো না। আমি আমার অপরাধের শাস্তিও পেয়ে গিয়েছি। আমার স্ত্রী আমাকে কেবল বিয়ে করেছিল তার পরিবারের চাপে। অনেক কষ্টে দুটো বছর সংসার টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। দু বছরের মধ্যে আমাদের একটা কন্যা সন্তানও হয়। সবাই বলেছিল বাচ্চা নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই বেশ জোর পূর্বকেই বাচ্চা নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী আর সংসার করে নি। সে তার পছন্দের ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। সন্তানের ভরণ পোষণের দায়িত্ব বাবা হিসেবে আমিই পেয়েছি। আমি মেয়ের পরিবার প্রতিষ্ঠিত দেখে বিয়ে করেছিলাম। তবে বুঝতে পারলাম নাম, ডাক, টাকা, এসব কিছু ভালোবাসা আর সুখ দিতে পারে না। আমার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আমি একাই সংসার করছি আমার মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের বয়স পাঁচ বছর হলো। স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছিলাম। বাসার কাছেই এ স্কুলটা। তোমার খোঁজ নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। তবে বাজেভাবে তোমাকে ঠকিয়েছিলাম। তাই সাহস হয়নি। যদি সম্ভব হয় ক্ষমা করে দিও।”

আমি কিছুই বললাম না। চুপ করে রইলাম। আমার এ নীরবতা আমাকে বেশ পুড়াচ্ছে। তবুও আমি নিজেকে নীরব রাখার চেষ্টা করছি। নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা পর্যায়ে শুধু বললাম

“আমি ক্ষমা করার তো কেউ না। যদি মনে হয় অন্যায় করেছেন তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। আপনার মেয়ের জন্য শুভকামনা রইল। স্কুলটা ভালো আছে চাইলে ভর্তি করাতে পারেন। সাবধানে থাকবেন৷ আমার শরীরটা ভালো লাগছে আমি বাসায় যাব। হাসপাতালে সকল বিল আমি এখনই পরিশোধ করে দিচ্ছি।”

মিহান আমার কথা শুনে নম্র গলায় বলল

“মায়া আমি বিল পরিশোধ করে দিয়েছি। তোমার বিল পরিশোধ করতে হবে না।”

আমি মিহানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম

“আমার সকল কিছুর দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ধন্যবাদ।”

বিলের টাকা মিহানকে দিয়ে আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসায় এসে গোসল করে খাটে হেলান দিয়ে বসলাম। খুব দম বন্ধ লাগছে। কান্না পাচ্ছে। খুব বাজে ভাবে ঠকে গিয়েও মানুষটাকে আমি ভুলতে পারিনি। যদিও তার জন্য আমার জীবন থেমে থাকে নি। তবুও কেন জানি না এ মানুষটাকে আমার জীবনের সে অধ্যায় থেকে মুছে ফেলতে পারি না। চঞ্চল একটা মেয়ে হুট করে শান্ত হয়ে যায় কতটা চাপা কষ্টে সেটা কেবল সেই জানে। পুরনো স্মৃতি যতই মনে পড়ছে ততই যেন শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আরও তাজা হচ্ছে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়া খাটে হেলান দিল। মনে মনে এতক্ষণ সে এসব আওরাচ্ছিল আর ভাবছিল জীবনের এমন সময় এ মানুষটার সাথে দেখা না হলেই বোধ হয় ভালো হত। আবার ভাবছে সেও ঠকানোর ফল পেয়েছে। তার স্ত্রী ও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাকে দেওয়া প্রতিটা কষ্টের বিনিময় সে ও পেয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন সকাল ৯ টায় তার ঘুম ভাঙলো। দ্রূত ঘুম থেকে উঠে কোনোরকম ফ্রেশ হয়ে স্কুলের দিকে ছুট লাগাল। নাস্তাও খেল না। কারণ নাস্তা খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। সকাল ১০ টায় বাচ্চাদের ক্লাস। তাকে গিয়ে ক্লাস ধরতে হবে।

অনেকটা তাড়াহুড়ো করে সে ক্লাসের ঠিক ১০ মিনিট আগে স্কুলে পৌঁছাল। স্কুলে পৌঁছাতেই মিহানের সাথে তার আবার দেখা। এবার সে একদম বিচলিত হলো না। গতকালকের মতো তার হার্টবিটও বাড়ল না। মিহান মায়ার দিকে এগিয়ে আসলো। তার পাশে ছোটো মিষ্টি একটা বাচ্চা। বাচ্চাটাকে দেখেই সে বুঝতে পারল এটা মিহানের বাচ্চা। মিহান স্কুল মাঠেই মায়ার কাছে এসে বলল

“মায়া আমার মেয়ে তিয়াশা।”

তিয়াশা নামটা শুনেই মায়ার বুকটা কেঁপে উঠল। যখন তারা প্রেম করত তখন তারা সন্তানের নামও ঠিক করে ফেলেছিল। মেয়ে হলে রাখবে তিয়াশা আর ছেলে হলে রাখবে তিয়ান। আর আজকে মিহানের মেয়ের নাম তিয়াশা শুনে মায়ার বুকের হার্টবিট আবারও বাড়তে লাগল। নিজেকে আবারও সামলে মিহানের দিকে তাকালাম। মিহান বলতে লাগল

“আমার মেয়েটাকে একটু খেয়াল রাখবে প্লিজ। মা থেকেও নেই ওর। ও জানে ওর মা বিদেশে থাকে। এতিম বাচ্চা বলা যায়। আমার রাগের প্রভাব ওর উপর দিও না। ও অনেক ভীতু স্বভাবের। আজকে ওর প্রথম ক্লাস। আর তুমিই ওদের ক্লাস টিচার। এ স্কুলে তোমার অনেক সুনাম। তাই বলব আমার বাচ্চাটাকে নিজের মেয়ের মতো খেয়াল রেখো।”

মায়া শক্ত গলায় উত্তর দিল

“দেখুন আমাকে তুমি বলা বন্ধ করুন। আমাকে আমার স্টুডেন্টদের কোনো গার্ডিয়ান তুমি বলে সম্বোধন করে না। আর বাকি রইল তিয়াশার বিষয়। তিয়াশাকে আমি ততটুকুই খেয়াল রাখব যতটুকু আমি অন্য বাচ্চাদের রাখি। আমি এতটাও নির্দয় না যে অহেতুক কোনো বাচ্চার উপর রাগ দেখাবো। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি তিয়াশাকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি আসতে পারেন।”

মায়ার কথা শুনে মিহান চলে গেল। মায়া তিয়াশার হাতটা ধরতেই তিয়াশা হেসে তাকে জিজ্ঞেস করল

“তুমি কী আমার মিস?”

মায়া তিয়াশাকে হেসে উত্তর দিল

“হ্যা। তোমার নাম কী?”

তিয়াশা হেসে উত্তর দিল

“তিয়াশা। তবে বাবা তো আমার নাম তোমাকে বলেছিল। তুমি ভুলে গেলে? শর্ট মেমরি লস আছে তোমার? গাজনী সিনেমার আমির খানের মতো?”

মায়া তিয়াশার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হেসে বলল

“তুমি সিনেমাও দেখো?”

তিয়াশা হাসতে হাসতে বলল

“হ্যাঁ দেখি তো। আমি তো সারাক্ষণ বাসায় একা একা থাকি। তাই সিনেমা দেখি। গান করি৷ একা একা নাচ করি। আবার কখনও কখনও মায়ের সাথে গল্প করি।”

মায়া কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল

“তোমার মাকে কোথায় পাও? তোমার মা তো বিদেশ থাকে তাই না?”

তিয়াশা হেসে বলল

“সিকরেট সেটা৷ পরে বলব। মা, আমি আর বাবা একটা গেম খেলছি তো তাই বলা যাবে না মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলি। গেমটা শেষ হলেই বলে দিব। প্রমিস।”

মায়া তিয়াশার কথার মানে তখন বুঝতে না পারলেও কিছুদিন পর ঠিকই বুঝতে পারে। কারণ মিহান এবারও তার সাথে বড়ো একটা গেইম খেলতে চেয়েছিল। আর সে গেইমে মায়া পা দিয়েও ফেলেছিল। তবে সময়ের আগে সবটা তার সামনে চলে আসে। আর সেদিনের পর থেকে মিহানের প্রতি কেবল মায়ার বুক ভরে ঘৃনা জন্মাতে শুরু করল।

মিহান বলেছিল তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে। তবে প্রকৃত পক্ষে তার স্ত্রী দেশের বাইরে গিয়েছে এম আর সি পি করতে। তার স্ত্রী একজন ডক্টর। আর সে সুবাধে বাচ্চা দেশে থাকায় মিহানের কাছে আছে। আর মিহান চেয়েছিল মায়ার কাছে এসব মিথ্যা বলে সিমপ্যাথি নিবে। এরপর মায়ার সাথে ভালো আচরণ করে আবারও মায়ার কাছে ফিরবে। মায়াকে দুর্বল করবে৷ এরপর বড়ো একটা ধাক্কা দিবে।

কিন্তু তিয়াশার সাথে কথা বলতে বলতে মায়ার কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এদিকে মিহান তিয়াশাকেও শিখিয়ে দিত মায়াকে কী বলতে হবে। কী করতে হবে। তবে তিয়াশা খুব ছোটো হওয়ায় সবকিছু পারফেক্টলি করতে পারত না। আর সেজন্যই মূলত সব সত্যটা এত দ্রূত মায়ার সামনে চলে আসে। তবে সে যে সত্যটা জেনেছে এটা সে মিহান কে জানতে দেয়নি। রোজকার মতোই মিহান তিয়াশাকে নিয়ে আসে। মায়ার সাথে তার দেখা হয়। আর সে মায়ার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজে। এরপর পাত্তা না পেয়ে আবার চলে যায়। এমন করেই প্রতিটা দিন মায়ার কাটছে।

এ সময়টাও মায়ার ভীষণ খারাপ কাটছে। না চাইতেও মিহানের সাথে তার দেখা হচ্ছে। না চাইতেও সব জেনেও তাকে চুপ থাকতে হচ্ছে। না চাইেতেও মুখোশধারী মানুষটাকে একটা বাচ্চার জন্য সহ্য করতে হচ্ছে।

অফিসের কোণে চুপ হয়ে বসে আছে মায়া। মায়ার নীরবতা দেখে মায়ার নতুন কলিগ বিপ্রতীপ মায়ার পাশে বসলো। সে মায়াকে হালকা গলায় বলল

“আচ্ছা আপানার কী সারাক্ষণ পেঁচার মতো মুখ করে রাখতে ভালো লাগে? এই যে সারাদিন আপনি মুড অফ করে রাখেন আপনার ক্লান্ত লাগে না? মনে হয় না ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে একটু হাসি। আমি এ স্কুলে জয়েন করেছি এক মাস হয়ে গেল। আপনাকে কখনও হাসতে দেখলাম না। কারও সাথে কথা বলেন না। সবসময় চুপচাপ বসে থাকেন। এভাবে একা থাকতে ভালো লাগে?”

মায়া বিপ্রতীপের দিকে তাকাল। অল্প বয়সী ছেলে। মায়ার ৩-৪ বছরের ছোটো হবে। মায়া বিপ্রতীপের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রেগে বলল

“বয়সেও এবং পজিশনেও আমি আপনার সিনিয়র। সংযত হয়ে কথা বলুন। স্কুলের পরিবেশটা নষ্ট করবেন না। ব্যক্তিগত কিছু জিজ্ঞেস করার হলে স্কুলের বাইরে করবেন। স্কুলে নয়। এটা প্রফেশনের জায়গা। এখানে প্রফেশনের বাইরে কথা না বললে কিছু যায় আসবে না। প্রফেশনের জন্য যতটুকু কথা বলা দরকার ততটুকু আমি বলি৷ এবার গিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিন।”

বিপ্রতীপ একদম চুপসে গেল। মুখটাকে বাঁকা করে সে তার ডেস্কে চলে গেল।

স্কুল ছুটি হলো বিকেল ৫ টায়। মায়া স্কুল থেকে বের হয়ে একটু পথ হাঁটলো। সামনে এগুতেই সে খেয়াল করল বিপ্রতীপ দাঁড়িয়ে আছে। মায়াকে দেখেই বিপ্রতীপ এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছে যে মায়ার বোধগম্য হচ্ছে না বিপ্রতীপ এমন কেন করছে।

…..