#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৩
বিপ্রতীপ মায়াকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে আর আড় চোখে তাকাচ্ছে। কিছু বলবে বলবে করেও সে বলছে না। মায়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল
“আপনি এমন করে হাসছেন কেন? কী বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না? আর পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
বিপ্রতীপ আবার একটু হাসলো। মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল
“সিনিয়র মানুষ তার উপর পজিশনেও সিনিয়র। তাই ভয়ে বুক কাঁপছে। আর আমি ভয় পেলে এরকম করে হাসি৷ ছোটো বেলা থেকে বদঅভ্যেসটা বলতে পারেন।”
মায়া কপাল কুচকে উত্তর দিল
“কাজের বাইরে আমি একজন সাধারণ মানুষ। কী বলতে চাচ্ছেন বলে ফেলুন। নাহয় পথ থেকে সরে দাঁড়ান। বাসায় অনেক কাজ পড়ে আছে।”
বিপ্রতীপ কিছুটা হেসে বলল
“যতদূর জানি আপনার তো বাচ্চা নেই। তাহলে বাসায় যাওয়ার এত তাড়া কেন? বাসায় কী স্বামী আছে?”
মায়া বিরক্ত হয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল
“বাসায় স্বামীও নেই।”
বিপ্রতীপ এবার হেসে দিল। বেশ জোরে হেসেই বলল
“বাহ্ আমি কত চালাক! আপনি সিনগেল কি’না কত সহজে জেনে গেলাম। আমি একচুয়েলি আপনাকে অনেক পছন্দ করি। তবে কথা কম বলেন তো তাই বুঝতে পারিনি আপনি সিনগেল কি’না। যাইহোক আপনিও সিনগেল আমিও সিনগেল। হয়ে যাই মিনগেল। কী বলুন?”
মায়া কপালটায় আরও ভাঁজ তুলে বলল
“ঠাটিয়ে একটা চড় দিয়ে চাপায় যা দাঁত আছে ফেলে দিব। রাস্তায় এসে অসভ্যতা করছেন? সরেন এখান থেকে।”
বিপ্রতীপ ভয়ে ঢোক গিলল। পথটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল।।এরপর আমতা আমতা গলায় বলল
“সাবধানে যাবেন।”
মায়া বিপ্রতীপের এ আচরণ গুলো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছিল না। তার কাছে এসব বেশ ম্যাকি লাগে। এ বয়সে এত ন্যাকামি তার ভালো লাগে না। অথচ একটা সময় সেও ন্যাকামি করত। অভিমান করত। রাগ করত৷ কিছুদিন আগেও মিহানের কথায় সে গলে গিয়েছিল। ভেবেছিল মিহানের স্ত্রী সত্যিই পালিয়ে গিয়েছিল। এতে করে মিহানের সাথে একটু সখ্যতাও বেড়েছিল তার। সে সাথে নতুন করে বাঁচার একটা আশা। যদিও সেটা সে মনে মনেই রেখেছিল। মিহানকে প্রকাশ করেনি। তবুও আশার প্রদীপ তো তার বুকে জ্বলেছিল। কিন্তু সে আশাটাও মিহান নিরাশ করে দিল। একটা মানুষ এত মিথ্যা কী করে বলে সেটাই সে ভাবছে৷
মায়া বাসায় এসে গোসল করে চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে শুকাচ্ছে। ততক্ষণে রাত হয়ে গিয়েছে। স্কুল থেকে এসে খাটে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপতে গিয়েই অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল। এরপর গোসল করে মাথা ধুতে আরও সময় লাগল। ক্ষুধায় তার পেট জ্বলছে। তবুও উঠে রান্না করতে মন চাচ্ছে না তার। একা একা রান্না করে খেতে তার একদম ভালো লাগে না। তবে এই একাকীত্বই যেন তার সঙ্গী।
হঠাৎ করে কলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর থেকে কলটা এসেছে। কলটা ধরে হ্যালো বলতেই মিহান কথা বলতে লাগল
“মায়া আমার সাথে তুমি একটু কথা বললে সমস্যা কোথায়? আমরা চাইলেই তো আগের মতো সব ঠিক করে নিতে পারি। দেখো আমার স্ত্রী পালিয়ে গেছে৷ যা শাস্তি পাওয়ার আমি পেয়ে গিয়েছি। তুমি চাইলে আমরা বিয়েও করতে পারি। একটু তো আমার সাথে কথা বলো। আমার ভুলের জন্য আমি তো ক্ষমা চেয়েই নিয়েছি।”
মায়া মিহানের কণ্ঠ শুনেই কেটে দিল। কত সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা বলছে এটা ভেবেই তার বুক খাঁ খাঁ করছে। এত গুলো মিথ্যা এক নিঃশ্বাসে বলতে জিহ্বাটাও ভার হলো না তার। কীভাবে সে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে সেটাই ভাবছে। যেখানে তার প্রথম স্ত্রী বর্তমান এবং সে স্ত্রী এর সাথে সবকিছু ঠিক আছে। বিবাহিত ছেলেরা হয়তো মেয়ে পটায় বিবাহিত জীবনে সুখে নেই এ কথাগুলো বলেই। অথচ সে সংসারে কোনো ঝামেলা থাকে না, থাকে না কোনো জঞ্জাল।
মায়ার মন চাচ্ছে মিহানকে বলে দিতে যে, সে সত্যিটা জেনে গেছে। তবে অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেছে সে। কারণ মিহান কতদূর পর্যন্ত নাটক করতে পারে সেটাই সে দেখতে চায়। কলটা আবার বেজে উঠল। মায়া কলটা কেটে দিল। পর পর কয়েকবার কল বাজল। আর মায়া কলটা কেটে দিল৷ এরকম করে সপ্তম বার কলটা বাজলে মায়া কলটা ধরে বেশ রাগী গলায় বলতে লাগল
” সবকিছুর লিমিট থাকে। লিমিট ক্রস করলে সেটা ভালো হবে না। আর কল দিবে না। আরেকটা কল আসলে সত্যিই ভালো হবে না কিন্তু।”
কিন্তু মায়াকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে বিপ্রতীপ বলে উঠল
“মায়া ম্যাম আমি বিপ্রতীপ। আপনার বাসার সামনে এসে দেয়াল টপকাতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে গিয়েছি। ড্রেনের গন্ধে পেট ফুলে মরে যাওয়ার উপক্রম। একা উঠতে পারছি না। সত্যিই আমি লিমিট ক্রস করে ফেলেছি। আর সেটা হলো বেঁচে থাকার লিমিট।”
মায়া বিস্মিত হয়ে গেল বিপ্রতীপের কথা শুনে৷ সে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল
“আপনি দেয়াল টপকাতে গিয়েছেন কেন? আর আমার বাসার সামনেই বা এসেছেন কেন?”
বিপ্রতীপ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
“আরে ম্যাম সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম একা বাসায় থাকেন আপনার রান্না করতে কষ্ট হবে। তাই রাতের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম। কতগুলো কল দিলাম ধরছিলেন না। এরপর বাধ্য হয়ে দেয়াল টপকাতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে গেলাম। এতক্ষণ কল ধরলেন না, যখনই ধপাশ করে ড্রেনে পড়লাম তখন ঠিকই কল ধরলেন। যাইহোক প্লিজ উদ্ধার করুন আমাকে।”
মায়ার বিরক্ত বেড়ে গেল। সে বিরক্ত গলায় উত্তর দিল
“ড্রেনে পঁচে মরুন।”
বলেই কলটা কেটে দেয়। জানালা দিয়ে ড্রেনের দিকে তাকিয়ে দেখে বিপ্রতীপ ড্রেনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। ড্রেনের কাজ চলতেছিল তাই ড্রেনের ঢাকনা খোলা ছিল। এদিকে বিপ্রতীপকে দেখে মায়ার অনেকটা হাসিও পাচ্ছে। সে নিজেকে সামলে নিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে লক্ষ্য করল বিপ্রতীপ কী করে। খেয়াল করল সে উঠার চেষ্টাটা পর্যন্ত করছে না৷ বোকার মতো নাক চেপে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ার মনে হয় মানবিক দিক থেকে হলেও তাকে উদ্ধার করা উচিত। সেটা ভেবেই সে নীচে গেল। নীচে গিয়ে কেয়ার টেকারকে বিষয়টা যখনই বলতে যাবে তখনই তার বাসার সামনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে থামলো। তারা সরাসরি গেইটে ঢুকে কেয়ারটেকারকে বলল
“এখানে বিপ্রতীপ নামের একজন যুবক ড্রেনে পড়ে গিয়েছে আমরা তাকে উদ্ধার করতে এসেছি৷ তিনিই আমাদের উনার নম্বর থেকে কল দিয়ে ইনফরম করেছেন।”
ফায়ার সার্ভিসের কথা শুনে মায়া আরও বিরক্ত হলো। এতক্ষণে বিপ্রতীপ ফায়ার সার্ভিস ও কল দিয়ে ফেলল! বিপ্রতীপের এমন মাথামোটা আচরণে তার বিরক্তি আরও বাড়তে লাগল। এদিকে ফায়ার সার্ভিস ড্রেন থেকে বিপ্রতীপকে তুলে আনলো। বিপ্রতীপ মায়ার সামনে আসতেই মায়া দূরে গিয়ে বলল
“যান সাবধানে বাসায় গিয়ে গোসল করিয়েন৷ ইয়াক কী গন্ধ আসছে।”
মায়া যদিও কথাগুলো বিপ্রতীপকে রাগাতেই বলেছিল। তবে মায়ার পরিকল্পনায় বিপ্রতীপ পানি ঢেলে বলল
“আরে এসব গন্ধ তো কিছুই না। চলেন একটু আপনাকে আমি যেখানে পড়ে ছিলাম সেখানে রেখে আসি৷ তাহলে এ গন্ধকে গন্ধই মনে হবে না।”
মায়া রেগে গিয়ে বলল
“শাট আপ মিস্টার বিপ্রতীপ। আর না বলে এভাবে যার তার বাড়িতে আসবেন না।”
কথাগুলো বলে মায়া চলে আসলো। বাসায় এসেই সে খিল খিল করে হাসতে লাগল। এতক্ষণ অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিল সে। হাসি চেপে রেখে গম্ভীর হওয়াটা বেশ কঠিন। আজকে অনেকদিন পর মায়া হাসছে। মায়ার হাসির শব্দে যেন আজকের চাঁদও পূর্ণিমার পরিপূর্ণ আলো নিয়ে ফুটেছে৷
রাত তিনটে বাজে। মায়ার ফোনে আবারও কল আসলো। মায়া কল ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে গড় গড় করে কিছু কথা ভেসে আসলো। আর সেটা শুনেই মায়ার কপালটা কুঁচকে গেল। এ বিপদ ১০ নম্বর সতর্ক সংকেতও যেন অতিক্রম করে ফেলেছে৷
…চলবে।