#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৫
বিপ্রতীপ দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে স্যালাইন দেওয়া অন্যহাতে স্যালাইন ধরে আছে। তার পিছু পিছু নার্স ডাক্তার দৌড়ে এসেছে। কাহিনি যা’তা হয়ে গেল। সবাই বিপ্রতীপের দিলে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। মায়া নিজেও কথা বলতে পারছে না কান্ড দেখে। মিহান গালে চড় খেয়ে চুপসে গেছে৷ সে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছা তার রইল না৷ সে সরাসরি চলে নিতে গেল। মিহানকে চলে যেতে দেখে বিপ্রতীপ পেছন ডেকে বলল
“ব্রো চড়টা কী বেশি জোরে লেগেছে? আপনি বেশ ভাগ্যবান মায়া ম্যামের হাতে চড় খেতে পেরেছেন। আমার তো সেই ভাগ্যও হয়নি। সমস্যা নাই ব্রো একদিন গরুর চাপ খেতে খেতে আপনার সাথে আড্ডা দিব।”
এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল
“ম্যাম কখনও ঐ ভদ্রলোককে চড় দিতে মন চায়লে আমাকে বলবেন। আমি নিয়ে আসব উনাকে। তখন মন মতো হাতে সরিষা তেল দিয়ে চড় দিয়েন।”
বিপ্রতীপের কথা শুনে মিহান দ্রূত সেখান থেকে চলে গেল। রাগে তার শরীর কাঁপছে, কপাল ঘামছে। মায়া এদিকে বিপ্রতীপের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
“আপনি কী পাগল? না জেনে বুঝে একজনের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করতে পারেন না।”
বিপ্রতীপ মোলায়েম গলায় জবাব দিল
“আপনি ভীষণ বিচক্ষণ। আপনি যেহেতু চড় দিয়েছেন সেহেতু আপনি ঠিকই করেছেন। আপনার ভুল হওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ।”
মায়া কপালটা ভাজ করে বলল
“সবকিছুই বুঝলাম। আপনি এখানে স্যালাইন নিয়ে কেন এসেছেন? ডাক্তারগণ এবার আপনাকে পাগল ভেবে পাগলাগারদের পাঠাবে। এত এত ডাক্তার নার্সদের হেনস্থা করেছেন। এখন হয়তো হাসপাতাল থেকেই আপনাকে বের করে দিবে।”
বিপ্রতীপ খিলখিল করে হেসে জবাব দিল
“আমার বাবার হাসপাতাল এটা। চাইলেও বের করতে পারবে না।”
মায়া ক্লান্ত হয়ে উত্তর দিল
“সবই বুঝলাম। তবে আপনি এখানে কেন এসেছেন? তার উপর হাতে স্যালাইন নিয়ে? এরকম অদ্ভুত কান্ড ঘটানোর মানে কী?”
বিপ্রতীপ হাসতে হাসতে উত্তর দিল
“আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না। তাই ধন্যবাদ জানানোর জন্য দ্রূত আসতে গিয়ে স্যালাইন নিয়েই চলে আসলাম। যদি স্যালাইন খুলে আসতাম তাহলে তো আপনি চলেই যেতেন। ধন্যবাদ তো দেওয়া হত না৷ আর রোগী আসলে তো মানুষ ফল নিয়ে আসে। ভাবলাম রাগ করে ফলগুলো দিতে ভুলে গেছেন কি’না। তাই এসেছিলাম ফল নিয়ে ধন্যবাদ দিতে।”
মায়া বিপ্রতীপের কথা শুনে আর কথা বাড়ালো না। তার মাথা ঝিম ঝিম করছে। সে নিজেকে সংযত করে সেখান থেকে বাসায় আসলো। বাসায় এসে তার কেবল বিপ্রতীপের পাগলামি গুলোই চোখে ভাসছে। এগুলো ভেবেই সে ভীষণ হাসছে। হাসতে ভুলে গিয়েছিল সে। এখন তো তবুও একটু হাসতে পারছে এটাই অনেক।
আগে মিহানকে দেখলে বা তার কথা চিন্তা করলে যেমন অনুভূত হত। এখন আর তেমন হয় না। মনে হচ্ছে মিহানের আবদ্ধ করা জায়গাটা থেকে সে বের হতে পেরেছে। এখন মিহানকে চিন্তা করলে তার ঘৃণায় বুক ভারী হয়ে যায়।
পরদিন স্কুলে ঢুকলো মায়া। স্কুলে ঢুকেই সে খেয়াল করলো বিপ্রতীপ সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। মায়া বুঝতে পারল না সে এত দ্রূত হাসপাতাল থেকে আসলো কী করে। আর ছুটি নিয়েছিল এক সপ্তাহের। সেখানে ১ দিন পার হতেই চলে এসেছে কেন? আর কিসের মিষ্টি বিলাচ্ছে সেটাও তার বোধগম্য হচ্ছে না। মায়া স্কুলে প্রবেশ করতেই বিপ্রতীপ একটা মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল
“ম্যাম আপনার মিষ্টি।”
মায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
“কিসের মিষ্টি?”
বিপ্রতীপ রসিকতা করে উত্তর দিল
“কুকুর কামড় দিয়েছে তো। তাই কুকুরের বাচ্চার বাবার হতে চলেছি। সেই খুশিতে এ মিষ্টি। নেন তাড়াতাড়ি খান।”
বিপ্রতীপের কথা শুনে বাকিরা সবাই হেসে দিল। মায়ার কলিগ রুবাইয়া হাসতে হাসতে বলল
“খুব ভাগ্য করে আপনার মতো কলিগ পেয়েছি।।এত হাসাতে পারেন আপনি। সবসময় মজা করেন। একটুও সিরিয়াস না আপনি। আপনার সাথে থাকলে হাসতে হাসতে মারা যাব। পেট ব্যথা হয়ে গেল আমার।”
মায়া এসব শুনে কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে মিষ্টিটা খেয়ে সেও রসিকতা করে জিজ্ঞেস করল
“ডেলিভারি কবে?”
মায়ার এমন প্রশ্নে সবাই হা হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।।কারণ বরাবরেই মায়া বেশ সিরয়াস একটা মানুষ। কথা বলে খুব কম। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলেছে এমন দেখা মেলেনি। এমনও হয়েছে স্বল্প প্রয়োজনেও সে চুপ থেকেছে। রসিকতা মজার বাইরে একটা মেয়ে সে। সেই মেয়ে আজকে রসিকতা করে কথা বলছে কারও যেন হজম হচ্ছে না। মায়া সবার এক্সপ্রেশন দেখে সবাইকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল
“সবসময় তো আর মজা করা হয় না। আপনারা বেশ মজা করছেন তাই আমিও একটু শরীক হলাম। আপনাদের খুশির জন্য এতটুকু করা। যাইহোক কাজ আছে কাজ করতে যাচ্ছি।”
মায়া কাজ করার জন্য ডেস্কের দিকে এগুতেই সবাই পেছন থেকে বলে উঠল
“হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থ ডে টু মায়া।”
মায়া চমকে পেছনে তাকাল। বিপ্রতীপ মাথা চুলকাতে চুলকাতে মায়ার দিকে একটা কেক বাড়িয়ে দিয়ে বলল
“সবাইকে আপনার জন্মদিন উপলক্ষে মিষ্টি খাইয়েছি। আমার তরফ থেকে ছোটো একটা সারপ্রাইজ। আপনার জন্মদিন শুভ হোক। এবার আপনার জীবনে কাউকে দেখতে চাই। আমি চাই পরের জন্মদিনটা আপনি আপনার প্রিয় কারও সাথে কাটান। আপনাকে গম্ভীর একদম মানায় না। আমি সবসময় চাই আপনি হাসিখুশি থাকুন। আপনাকে পেঁচামুখী দেখতে ভীষণ বাজে লাগে। হাসলে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগে। এই যে আমরা সবাই কলিগ। কত মজা করি। কত আড্ডা দেই। আপনি কখনও এসবে আসেন না। এক ঘরে হয়ে থাকেন। সবাই মনে করে আপনি অহংকারি। কিন্তু আমি আপনাকে ভেতর থেকে চিনেছি। আপনি বড্ড নরম মনের মানুষ। কোনোভাবে যেন আপনার জীবনের দুর্বলতা সবার সামনে প্রকাশ না পায় সে জন্য আপনি চুপ থাকেন। কারণ আপনি কথা বললে আপনার কথার সাথে আপনার ভেতরের দুর্বলতাও বের হয়ে আসবে। আমি জানি আপনিও একটা সময় উচ্ছ্বল ছিলেন। তবে হয়তো সময়ের পরিক্রমায় আপনি সব মাটি চাপা দিয়ে রেখেছেন। আমরা সবাই চাই আপনি আবার আপনার আসল রুপে ফিরে আসুন। আপনি যেভাবে আছেন সেটা আপনি নন। বরং আপনার মুখোশ। এ গম্ভীরতা আপনাকে সত্যিই মানায় না। আপনার ৩১ তম জন্মদিনে আপনার সকল আনন্দ ফিরে আসুক। হ্যাপি বার্থ ডে টু মায়া ম্যাম।”
মায়ার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বিপ্রতীপ যেন মায়ার মনের কথায় বলছে। এখনের মায়া যেন মুখোশ পড়া আলাদা মায়া। বাবার মৃত্যুর পর সে একদম হাসতে ভুলে গিয়েছে। মিহানের সাথে বিচ্ছেদের পর তার জীবনের সকল রঙ যেন ফিকে হয়ে গিয়েছে। অথচ একটা সময় এ জন্মদিন নিয়ে তার কত প্ল্যান ছিল। বাসায় তার বন্ধুদের দাওয়াত দিত সে। তার বাবা সবার জন্য খেজুরে পায়েশ রান্না করত। তার জন্য সিন্ড্রেলিনা কেক আনত। একটা রাজকন্যা সেজে বসে থাকত সে। মিহানও তার জন্মদিনে একটা পুতুল গিফট করেছিল। ছোটো একটা রুপার পুতুল। সে পুতুলটা এখনও আছে তার। জন্মদিনে হৈ হুল্লুর করে পার করত সে। আর আজকে সে নিজের জন্মদিনটায় ভুলতে বসেছে। পুরনো অতীতে আবারও ডুবে গেল সে। তার ঘোর কাটল বিপ্রতীপের ডাকে। মায়া নিজেকে সামলে নিল। হালকা গলায় বিপ্রতীপকে বলল
“আপনাকে ধন্যবাদ। আমি নিজেই আমার জন্মদিন ভুলে গিয়েছিলাম। সবাইকে অনেক থ্যাঙ্কিও আমাকে স্পেশাল ফিল করানোর জন্য।”
এরপর মায়া কেক কাটলো। সারাদিনটা তার বেশ ভালোই কাটল। স্কুল ছুটির পর সে বাসায় যাচ্ছে। বিপ্রতীপ তার পেছন থেকে এসে বরাবর দাঁড়াল।।তারপর তার সাথে হাঁটতে লাগল।।মায়া এবার আর বিরক্ত হলো না। নম্র গলায় জিজ্ঞেস করল
“কিছু বলবেন?”
বিপ্রতীপ কিছু বলতে যাবে এর মধ্যেই মিহান সামনে এসে দাঁড়াল।
চলবে।