#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৯
বিপ্রতীপ দ্রূত মায়াকে ধরে উঠাল। কপাল থেকে রক্ত মায়ার মুখ বেয়ে পড়ে লাল হয়ে মুখটা লেপ্টে গেছে। বিপ্রতীপ বেশ ভয় পেয়ে বলল
“হায় আল্লাহ! আপনার অবস্থা তো খারাপ। এখনই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
কথাটা বলেই মায়াকে বিপ্রতীপ কোলে তুলে নিল। মায়া বিপ্রতীপের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মায়ার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কখন যে জ্ঞান হারাল সে নিজেই বুঝতে পারল না। যখন জ্ঞান ফিরল সে অবাক হয়ে গেল। সে একটা নতুন বাসায় শুয়ে আছে। সামনেই বিপ্রতীপ বসা। মাথাটা হালকা ব্যথা করছে তার। মায়া বিপ্রতীপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“আমি কোথায় এসেছি? এটা কার বাসা? আর আমাকে এখানে কেন আনা হলো?”
বিপ্রতীপ হেসে জবাব দিল
“আরে আরে ভয় নেই। আপনাকে কিডন্যাপ করিনি। আমি মাফিয়া না যে কিডন্যাপ করে বলব ভালোবাসা দিবি কি’না বল। এক্সিডেন্ট কেইসে পুলিশের ঝামেলা হত। তাই বাসায় এনে ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। আপনার চিন্তা নেই। আমি এ বাসায় একা থাকি না। আমার বউ ও থাকে। আমার বউ আপনার যত্নের ত্রুটি করবে না। এত লাবিং সুন্দরী বউ আমার.. আপনি দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবেন। ”
বিপ্রতীপের কথা শুনে মায়া চমকে গেল। তার শরীর কাঁপছে। বিপ্রতীপ বিবাহিত সেটা সে মানতেই পারছে না। বিবাহিত হলে তার জন্য বিপ্রতীপ এত পাগলামি কেন করেছে ভাবতেই তার চোখ ভিজে যাচ্ছে। শরীরটা ভার লাগছে তার। হাত পা যেন জ্বলছে তার। এতদিন পর সে কাউকে ভরসা করতে পেরেছিল। আজকে সে ভরসাটাও নষ্ট হয়ে গেল। চৌচির হয়ে গেল বিশ্বাসের দেয়াল। মায়া আমতা আমতা করে বলল
“আপনি বিবাহিত?”
মায়ার এ প্রশ্নের উত্তর আসলো একটা মেয়েলী কণ্ঠের মাধ্যমে। বৃদ্ধা নয়না মায়াকে হাসতে হাসতে বলল
“গোলা*মের পুতের কথায় কিছু মনে করিস না। গোলা*মের পুত আমার কথা কয়ছে। ছোটো থেকে বউ বলে ডেকে ডেকে অভ্যাস তো তাই। আমি ওর নানী হই। এ বউ ডাকটা ওর নানা শিখায়ছে। এরপর থেকেই বউ ডাকে। ওর মা ওর জন্মের সময় মারা যায়। ২ ভাই ১ বোনকে আমিই লালন পালন করে বড়ো করেছি। বাকি দুজনকে পালতে কষ্ট হয়নি তবে এ হারামজাদাকে পালতে আমার কষ্ট হয়েছে। এত দুষ্টু। ওর মায়ের মৃত্যুর পর ওর বাবা আর ওর মুখ দেখেনি। ওকেই ওর বাবা ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করত। তাই ওর সকল দায় পড়ে আমার উপর। অবশ্য ওর বাবার মৃত্যুর ১ মাস আগে সে তার ভুল বুঝেছিল। নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমাও চেয়েছিল। তবে সে আনন্দ দ্বীপের কপালে বেশিদিন জুটে নি। দ্বীপের নামটা দিয়েছিলাম আমি। আমার মনে হয়েছিল আমার মেয়ে চলে যাওয়ার পর ওকে কান্নার নদীতে সুখের দ্বীপ হিসেবে রেখে গেছে। আর পুরো নাম বিপ্রতীপ রাখার পেছনে কারণ হলো তার বাবা তাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছিল। তাদের মধ্যকার মায়া থাকলেও একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য তারা একই পথের পথিক হয়েও ছিল বিপরীত। তাই ওর নাম রাখা হয় বিপ্রতীপ।”
বৃদ্ধা নয়নার কথায় ব্যাগড়া দিয়ে বিপ্রতীপ বলে উঠল
“তোমার কী অভ্যাসটা ভালো হবে না? আসার পর থেকে তাকে কাহিনি বলা শুরু করছো। যাকে পাও তাকে ধরে এসব শুনাও। সে কী তোমার কাহিনি বুঝবে বউ? তুমি তো আগে পরিচিত হবে। এরপর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবে। তারপর নাহয় এগুলো বলো। তা ‘না করে ট্যাপের মতো বেজেই চলেছো। থামার নাম নেই।”
বৃদ্ধা নয়না রাগে গর্জে উঠে বললেন
“তোর কাছে আমার ব্যবহার শিখতে হব? তোর মাকে আমি পেটে ধরেছি। আমাকে বুঝাতে আসবি না কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়। যে কান্ড করেছিস তুই। তোকে তো জেলে নিতই সাথে এ নিষ্পাপ মেয়েকে জেলে নিত। তোর কুকর্মের দায়ে এ মেয়েটা ফাঁসত। তোর ভাই যদি বিষয়টা হ্যান্ডেল না করত আজকে তোর কপালে শনি ছিল। আজকে দুজন জেলে থাকতি। কী দরকার ছিল এসব করার? সারাদিন মাথায় কুবুদ্ধি ঘুরে তাই না? একটুও শান্ত থাকা যায় না তাই না?”
বৃদ্ধা নয়নার কথা মায়া কিছুই বুঝতে পারছে না। বিপ্রতীপ নিজেই যেখানে পুলিশের লোক তাহলে সেখানে কী করে তাকে জেলে দিবে কারণ ছাড়া সেটাই সে ভাবছে। মায়া বিভ্রত গলায় বলল
“নানী আপনার কথা তো আমি বুঝতে পারছি না। কী করেছে বিপ্রতীপ? ওকে কেন পুলিশ ধরবে? আর আমাকেই বা কেন ধরবে?”
বৃদ্ধা নয়না মায়াকে কিছু বলতেই যাবে সে সময় বিপ্রতীপ তার মুখ চেপে ধরে মায়াকে বলল
“আরে ঐটা কিছু না। বউ মজা করছে। একটু বেশি ভালোবাসে তো আমাকে, তাই আমাকে নিয়ে অধিক চিন্তায় আবোল তাবোল বকছে।”
মায়া বিপ্রতীপের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে বলল
“নানীর মুখ ছাড়েন। উনাকেই বলতে দিন। আমি শুনতে চাই কী হয়েছে। আপনি মুখ ছাড়েন।”
বিপ্রতীপ একটা ঢোক গিলে নয়নার মুখ ছাড়ল। নয়না বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
“আমাকে কী তুই মেরে ফেলতে চেয়েছিলি হারামজাদা।”
এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল
“ওকে যদি শায়েস্তা করতে পারো করো। কোনো কথা শুনে না। থানায় গিয়ে ভুলভাল বলে এসেছে। সব পুলিশদের বোকা বানিয়ে আসছে। ভুল ইনফরমেশন দিয়ে থানায় সব পুলিশদের নাচিয়েছে। সে বলেছে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সে। ডাহা মিথ্যা কথা ছিল। এসব মজা করতে করতেই বিপদে পড়বে সে। আজকে ওর ভাই বড়ো পদে আছে বলেই বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পেরেছে। নাহয় পারত না। ওকে শায়েস্তা করো পারলে। আমি যাই একটু। ইনহেলার নিতে হবে।”
নয়না চলে গেল। মায়া বিপ্রতীপের দিকে রাগী চোখে তাকাল। বিপ্রতীপ মায়ার দিকে তাকিয়ে জিহ্বায় কামড় দিল। এরপর কান ধরে মায়াকে বলল
“ঐ সময় এরকম না করলে সেক্সি শিলা আর বোরহানকে তো ফাঁদে ফেলতে পারতাম না। যাই করি না কেন ওদের তো শিক্ষা দিতে পেরেছি। তখন ঐ অভিনয় না করলে ওরা ওরকম শিক্ষা পেত না৷ আর বড়ো ভাইয়াকে বলে মিহান আর অফিসার বোরহানের বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে আমি যা করেছি পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে করেছি। এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনার গায়ে তো দূরে থাক আপনার আশে পাশে ১ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিপদের আচ লাগতে দিব না।
প্লিজ রাগ করবেন না। একটুই তো গোয়েন্দায় সেজেছি। এর বাইরে তো কিছু করিনি।আর মেয়েদের এ এক দোষ কোনো কিছুতেই মন ভালো হয় না। গোয়েন্দা সাজার পরও সে পরিচয়ে আপনার মন মানলো না। এখন আবার এ পরিচয়েও মন মানছে না। যত দোষ নন্দগোষ।”
বলেই মিহান জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। মায়ার রাগ ও হচ্ছে, অভিমানও হচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে। বিপ্রতীপ যেন অদ্ভুত একটা চরিত্র। মায়া নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে একটা গম্ভীর ভাব এনে বলল
“এরকম করবেন না আর।”
বিপ্রতীপ মাথা নেড়ে বলল
“জি আচ্ছা। যা আপনি বলবেন। এবার সব বাদ দিয়ে বলুন শরীর কেমন লাগছে আপনার? আগের থেকে বেটার? ডাক্তার বলল আপনার মধ্যে পুষ্টির অভাব। পুষ্টি যেন খাওয়ানো হয়। বাজার থেকে বেছে বেছে তাই পুষ্টি কিনে নিয়ে এসেছি। আর নিজের হাতেই রান্না করেছি। গরুর মাংস, ডিম ভুনা, চিংড়ি ভুনা, লাল শাক, আর ডাল। এগুলোতে যদিও এত পুষ্টি নেই। তবুও এগুলো খেতে ভালো লাগবে। অল্প পুষ্টি বেশি স্বাদ।”
মায়া কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করল
“তাহলে তো বলা উচিত ছিল স্বাদ কিনে এনেছি পুষ্টি না।”
বিপ্রতীপ হেসে জবাব দিল
“ঐ একই হলো। স্বাদ আর পুষ্টি। পেট ভরে খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আপনার বাসায় যেহেতু কেউ নেই। একাই থাকেন আপনি, চাইলে এখানে সপ্তাহখানেক থাকতে পারেন। এরপর একটু সুস্থ হয়ে যেতে পারেন। আমি তো স্কুল থেকে আপনার জন্য ছুটি নিয়েছি এক্সিডেন্টের কথা বলে। আপনাকে এক সপ্তাহ ছুটি দিয়েছে। আর আমিও কু্ত্তার টিকা দেওয়ার জন্য আবারও ছুটি নিয়েছি। কয়েকটা দিন এখানে থেকে আমার বউয়ের সাথে আড্ডা দিন। আমাদের সাথে আড্ডা দিন ভালো লাগবে।”
স্কুলের কথা বলতেই মায়া জিজ্ঞেস করে উঠল
“স্কুল থেকে ১৫৬ টা বাচ্চা নিঁখোজ হয়েছে এটা কী সত্য ছিল নাকি এটাও মনগড়া কাহিনি বলেছেন?”
বিপ্রতীপ হাসতে হাসতে বলল
“চরিত্রে ঢুকে গিয়েছিলাম। তাই কী থেকে কী বলেছি জানি না৷ যা মনে এসেছে বলেছি। আর বাকিরা তাই বিশ্বাস করেছে।”
বিপ্রতীপের এ কথা শুনার পর মায়া খিলখিল করে হাসতে লাগল। মায়ার হাসির সাথে সাথে বিপ্রতীপও হাসতে লাগল। তাদের হাসির মাঝে উপস্থিত হলো বিপ্রতীপের চাচাত ভাই মিশবা। মিশবার আগমনে পরিবেশটা পাল্টে গেল। বিপ্রতীপ হুট করেই চুপ হয়ে গেল।।তার অবশ্য একটা কারণও আছে…
চলবে।