মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
7

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

প্রত্যাশার বিড়বিড় করা দেখে নীরব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” কিছু বলছিলে?”

প্রত্যাশা অপ্রতিভ্য ভঙিতে মাথা নেড়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

-” ক-কই? না তো। কী বলব?”

প্রত্যাশা ক’পা এগিয়ে ডান হাতটা নীরবের সামনে সটান বাড়িয়ে একটা আইসক্রিম এগিয়ে বলল,

-” নিন।”

নীরব মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক বোঝায়। মুখে বলল,

-” তুমি খাও। দুটোই তোমার জন্য।”

প্রত্যাশা সামনের টুলে বসল। আইসক্রিমে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। আকস্মিক ভারী স্বরে বলে উঠল,

-” আপনি যতোই সবাইকে বলেন অফিশিয়াল কাজে কুয়াকাটায় গিয়েছিলেন। আমি জানি এটা মিথ্যে। আপনার ওখানে যাওয়ার কারন আমি। আমার বারবার মনে হচ্ছে আপনার এই অ্যাক্সিডেন্টের জন্য পরোক্ষভাবে আমিই দায়ী। যদি না আমি ট্যুরে যেতাম, না ওরকম কিছু ঘটতো, আর না তো আপনাকে ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হতো। আজ আপনাকে এভাবে সাফার করতেও হতো না।”

-” দূর্ঘটনা তো কখনো বলে কয়ে আসে না। আমি কুয়াকাটায় গেছি বলেই এমনটা হয়েছে; এই ভাবনাটা ঠিক নয়। আমি এখানে থাকলেও, অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনোদিন এমন কিছু ঘটতেও তো পারত। এর থেকে বেশি কিছুও হয়তো হতে পারতো। সো, এটা নিয়ে নিজেকে দায়ী ভাবা বো’কা’মি‌।”

আইসক্রিম গলে হাত গড়িয়ে পড়তে নিচ্ছিল। নীরব সেদিকে তাকিয়ে বলল,

-” আইসক্রিম গলে যাচ্ছে।”

প্রত্যাশার মনে হলো, নীরব হয়তো কথা বলতে আগ্রহী নয়। তাই তো আইসক্রিমের কথা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশার রাগ হলো, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করল না। ওর যে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে— নীরব কী এখনো ও ছবিগুলোকে বিশ্বাস করে আছে? আমাকেই অবিশ্বাস করে? ওই ব্যাপারে কিছুই তো এরমধ্যে আর বলেনি। দুনিয়ার সব অভিযোগ রাগ-ক্ষোভ একদিনে ঝেড়ে তারপর থেকে যেনো হজ্বে বসেছে। মৌনতা পালন করছে। এতটা নির্লিপ্ত আছে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

সেদিন রাতের কথা ফের মনে উঠতেই প্রত্যাশার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। শুণ্যে তাকিয়ে মনেমনে আওড়ায়—- আবার সেদিনের উনার করা অপমান ভুলি কী করে! কম তো আর বলেনি। বিশেষ করে দু’টো কথা ম*রে গেলেও ভুলব না। নেহায়েৎ অসুস্থ মানুষ তাই আগ বাড়িয়েই কথা বলতে হচ্ছে। আবার উনি তো সবার সামনে সাধু পুরুষ। যাইহোক না কেনো অন্যকে জানাবে না, বুঝতে দেবে না কিছু। সেদিন রাতে কত কী ঘটল! অথচ বাড়ির একটি মানুষকেও বুঝতে দিলো না। কী সুন্দর করে সকালেই কজ দেখিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল!

মনটা ভার হয়ে এলো প্রত্যাশার। আনমনেই তাচ্ছিল্য হেসে ভাবল— উনি নিজেই তো বলেছিলো, এরপর থেকে তোমার-আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা হয়তো হবে না।

কথাটা মনে উঠতেই চোখ জিভে উঠল প্রত্যাশার। নিজেকে মনে হলো ছ্যাঁচড়া। নীরব চাইছে না, সে শুধু শুধুই বেহায়ার মতো এখানে আছে। আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির দিনের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। এসব কিছু তো আর ভালোবাসা থেকে উনি করছেন না। উনি নিজেই বলেছেন, যতদিন সম্পর্কটা থাকবে, ততদিন দায়িত্ব থাকবে।

এসব কিছু ভাবনা-চিন্তা প্রত্যাশার মন-মস্তিষ্কে বিরুপ প্রভাব ফেলল। ঝট করে ফোনটা বের করে আব্বুর নম্বরে ডায়াল করল‌। রিসিভ হতেই বলল,

-” আব্বু তুমি কোথায়?”

-” কেনো রে মা? কোনো সমস্যা?”

-” নাহ, কোনো সমস্যা নেই। আব্বু তুমি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে? আমাকে নিতে? সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে তো তাই বলছি। নইলে আমি একাই যেতে পারতাম।”

-” আমি বাজারে আছি। কিন্তু প্রত্যাশা যাওয়ার সময় বললে রাতে থাকবে তুমি।”

প্রত্যাশা নীরবের দিকে তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল,

-” আসলে সামনে পরীক্ষা এখানে থাকলে পড়াশোনা হবে না। তাই উনি নিজেই যেতে বলেছে।”

মিথ্যে বলতে প্রত্যাশার গলা মৃদু কাঁপল। শফিক সাহেব বললেন,

-” আচ্ছা, আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।”

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই শফিক সাহেব আসেন। জামাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে বেড়িয়ে যান। প্রত্যাশা বাবার পিছুপিছু যেতে গিয়ে কেবিনের দরজাটা একহাতে টেনে আবার ফিরে তাকাল। বেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল মিহি স্বরে,

-” আসছি।”

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘুরে পা চালাল প্রত্যাশা। পরমূহুর্তেই পিছুন থেকে আসা একটা শব্দেই পা দু’টো থেমে গেল।

-” শোনো?”

নীরব দরজা বরাবর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই ফের আদেশ স্বরুপ বলল,

-” এদিকে তাকাও। কথা আছে।”

প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন ঘুরে দাঁড়াল। বলল,

-” জ্বী বলুন।”

-” মাথা থেকে পুরনো সব ঝামেলা ডিলিট করে দাও। নাউ ইটস্ টাইম টু ফোকাস, জাস্ট ফোকাস অন ইয়োর স্টাডি। সামনে তোমার এক্সাম, ওটাই প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। আমার বউ হয়ে শুধু ফেল ঠেকানোই যেন তোমার আল্টিমেট গোল না হয়। দ্যাট উড বি কাইন্ডা এমব্যারাসিং ফর মি।”

সারাবছর না পড়ে লম্ফঝম্প করে বেড়ানো প্রত্যাশা শেষের কথাশুনে মনেমনেই মুখ বাঁকাল। নীরব মৃদু হাসল, সে হাসি অবশ্য প্রত্যাশার দৃষ্টিগোচর হলো না। নীরব আরো বলল,

-” রেজাল্টের দিন যেনো আমাকে লজ্জায় পড়তে না হয়। বি কেয়ারফুল, ওকে?”

প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ বিড়বিড় করল,

-” আহা! এখন উনাকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে হলে তো আলাদিনের চেরাগ ঘষে জ্বিন ডাকতে হবে! বলব– হে জ্বিন বাবু, আমার হাজবেন্ডের মান-ইজ্জতের প্রশ্ন। প্লাস পাইয়ে দিও, নইলে উনি আত্মসম্মানহানিতে ভেঙে পড়বেন। যত্তসব!”

তবে ভদ্রতা দেখিয়ে মুখে বলল প্রত্যাশা,

-” ঠিক আছে।”

বলেই আর টু শব্দটি না করে প্রত্যাশা প্রস্থান করে।

পাওয়ার থাকলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়, সুযোগও বেশি মেলে। কিন্তু নীরব কখনোই নিজের পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি, করবেও না। এই বিশ্বাস ওর নিজের ওপর আছে। তবে কোনো সমস্যা সমাধানে, ন্যায়- অন্যায় জাস্টিফাইয়ের জন্য পেশার থেকে পাওয়া ক্ষমতা ব্যবহার করাই যায়। ছবি থেকে হোটেলের নাম দেখে ছিলো, সরাসরি গন্তব্য ***হোটেলে। নিজের অফিসিয়াল আইডি কার্ড দেখিয়ে রিসিপশনে যোগাযোগ করে ম্যানেজারের সঙ্গে। প্রথমে ওরা রাজি হচ্ছিল না সিসিটিভি ফুটেজ দিতে, কিন্তু নীরব যখন বলে; প্রয়োজনে উপরের কর্তৃপক্ষের পারমিশন আনবে, তখনই ম্যানেজার নমনীয় হয়।

নীরব সোজা চলে যায় সেই তারিখে, দুপুরের পর থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে। এক পর্যায়ে দেখা যায়, প্রীতি নিজের রুমে ঢোকে, একটু পরেই ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর কাটতে কাটতে দেখা যায়; দু’জন মেয়ে প্রত্যাশার হাত ধরে রেখেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, প্রত্যাশা স্বাভাবিক নেই। নীরব মনোযোগ দিয়ে ফুটেজ দেখতে থাকে। প্রত্যাশা প্রীতির গাল টিপে দেয়, খিলখিলিয়ে হাসে, হাত ছড়িয়ে নাচতে নেয়। এসব দেখে নীরবের পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রত্যাশা ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলো নিশ্চয়। তাছাড়া ও যতই ইমম্যাচিউর হোক, এরকম বিহেভ করবে না। আই থিংক ওকে নে”শা যুক্ত কিছু খাওয়ানো হয়েছিল।

এরমধ্যে সার্থকের উপস্থিতি। প্রীতির ব্যাগ হাতড়ে কিছু খোঁজা, কিছুপল পর সার্থকের রুমে প্রত্যাশার ঢোকা। নীরব প্রথমেই জেনে নিয়েছিল, সার্থক, প্রীতিরা কত নম্বর রুমে ছিলো। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না। সার্থকের সাথে প্রত্যাশার রুমে থাকার সময় দশ মিনিটের মতো হবে হয়তো। কারন দশ মিনিট খানেক পরেই সার্থক কে একলা বের হতে দেখা যায়। তারপর করিডোরে অদ্রিকার সাথে সার্থকের কথা। কিছুক্ষণ পর ট্রে করে শরবত জাতীয় কিছু নেওয়া।

নীরব অনেক সময় ধরে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। সব মিলিয়ে সমীকরণ একটাই দাঁড়ায় প্রত্যাশা হুঁশে ছিলো না। আর শিওর ছবিগুলো ওই দশ মিনিটের ভেতর তোলা। এখন প্রশ্ন, প্রত্যাশাকে কীভাবে ড্রাঙ্ক করা হয়েছিল? ছবিগুলো কে তুলেছে?

আরেকটা বিষয় যেটা প্লাস পয়েন্ট হিসেবে নজরে আসে। প্রীতির সাথে হোটেলের একজন স্টাফ বয়ের কথা। প্রীতি ব্যাগ থেকে টাকা দিচ্ছে। যেটা প্রীতির দিকে সন্দেহের তীর নিয়ে যাচ্ছে। তবে সমস্ত কিছুর পিছুনে নীরব ওদের দুই ভাই-বোনের হাত আছে বলে মনে করে। হোটেল কর্তৃপক্ষের থেকে সেই স্টাফের নাম ঠিকানা আর কন্টাক্ট নম্বর যোগাড় করে নীরব। শোনা যায়, ছেলেটি হোটেলের চাকরি সম্প্রতি ছেড়ে দিয়েছে। মালয়েশিয়া যাবে বলে। সেইদিনই উক্ত নম্বরে কল করে নীরব। কিন্তু কপাল খারাপ থাকায় ফোন বন্ধ বলে।

প্রীতির পেট থেকে যেভাবেই হোক কথা বের করা। আর নয়তো সেই বয়টির সাথে কন্টাক্ট করা। তারপর সব সত্যি সামনে নিয়ে প্রত্যাশার কাছে স্যরি বলবে। আর প্রীতি আর ওর ভাইয়ের একটা বিহিত তো করতেই হবে। নীরবের অনুশোচনা হচ্ছে, সে রাতে মেজাজ খারাপ না করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা উচিত ছিলো। প্রত্যাশাকে অতকিছু বলা কোনো মতেই উচিত হয়নি। যদিও ওর ভুল কম নয়। ওর বো’কামির জন্যই এতকিছু। তবুও রাগের মাথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলা কয়েকটা কথার জন্য নীরব নিজেই অনুতপ্ত।

_________

প্রত্যাশাকে নিয়ে রাত আটটার দিকে শফিক সাহেব বাসায় ফিরলেন। অধরা তো মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হলেন। সাথে স্বামীকেও কথা শুনাতে বাদ রাখলেন না।

-” প্রত্যাশার যেনো বোধবুদ্ধি নেই, ও বলল আর তুমি ওকে নিয়ে চলে এলে। তুমি ওকে বোঝাতে পারলে না ওখানে ওর থাকাটা জরুরী। ওর শ্বশুর বাড়ির লোক বলবে না, কেমন বউ। বর হাসপাতালে ও বাড়িতে আরাম করে থাকে। কোনো দায়দায়িত্ব নেই।”

শফিক সাহেব মিনমিনে গলায় বললেন,

-” আরে তুমি আমাকে কথা শুনাচ্ছ কেনো? আ’জ’ব! প্রত্যাশা নিজে বলল নীরবই যেতে বলেছে। ওর সামনে এক্সাম। সেখানে আমার কী করার আছে বলো?”

প্রত্যাশা দুই হাত এক করে মাথাটা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। অধরা রাগ ঝাড়তে লাগলেন,

-” প্রত্যাশা তোর কোনোকালে আক্কেল, কান্ডজ্ঞান হবে না? জামাই বলল আর তুই সাথে সাথে এক লাফে চলে এলি। কেনো, তোর কোনো দায়িত্ব নেই?”

-” কী আশ্চর্য! আম্মু তুমি শুধু শুধু আমাকে কেনো বকছো?”

-” তুই বিকেলে গিয়ে সন্ধ্যায়ই কোন সাহসে চলে এলি? বল তোর সমস্যাটা কী?”

-” আমার ওখানে থেকে কাজটাই বা কী? কোনো কাজ নেই শুধু শুধু বসে থাকা। তাই…”

প্রত্যাশার কথা শেষ করতে না দিয়ে অধরা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” ইচ্ছে করে চওড়িয়ে দাঁত ফেলে দিতে। ওখানে ওর কাজ কী? ওকে বলে দিতে হবে যেনো সব। তুই একেবারেও ছোট না প্রত্যাশা। ডাক্তার নীরবকে আপাতত ক’দিন মুভমেন্ট করতে নিষেধ করেছে। এখন যদি ছেলের বউ থাকতেও তোর শাশুড়ি ছেলের দেখভাল করে, ব্যাপারটা ভালো দেখায়? তুইই বল ভালো দেখায়? প্রতিবেশীরা এসে প্রশ্ন তুলবে ছেলের বউ আসেনি। বউমা থাকতেও মা’কেই সেবা করতে হচ্ছে।”

প্রত্যাশা মনে মনে ভাবল— ধূর! আম্মুকে কীভাবে বোঝাই! উনি যেহেতু ওনার আশেপাশে আমাকে চাইছেন না। ঠিক করে কথাও বলেনি। আর সে রাতের কথাই বা ভুলি কী করে!

অধরা গলার স্বর এবারে একটু নরম করে বললেন,

-” কালকে সকালে নীরবকে রিলিজ করবে। আমারো তো একবার দেখতে যাওয়া লাগে। সেদিনের পর আর যাওয়া হয়নি। কাল আমি ও বাড়ি দেখতে যাচ্ছি। তুইও আমার সাথে যাবি। আমি কিন্তু তোকে রেখে আসবো, তাই সেইভাবে ব্যাগ গুছিয়ে নিস।”

-” রেখে আসবে মানে? সামনের বৃহস্পতিবার থেকে আমার এক্সাম। আর মাত্র ছ’দিন পরেই।”

-” পরীক্ষা বই সাথে নিবি। তোর শাশুড়ির সাথে আমার ফোনে একটু আগেই কথা হয়েছে। তোর গিয়েই চলে আসায় উনার কথায় বুঝলাম অসন্তুষ্ট সে। যদিও মুখে সরাসরি বলেনি। উনি নিজেই বলেছেন, প্রত্যাশা তো বই-টই নিয়েও আসতে পারতো। একদিক দিয়ে ওর-ও সুবিধাই হতো; পড়ায় কোনো সমস্যা হলে, নীরবের থেকেই বুঝে নিতে পারতো।”

মা আর শাশুড়ির সিদ্ধান্তের মাঝে পরে প্রত্যাশা আর দ্বিরুক্তি শব্দ উচ্চারণ করার সাহস পেলো না। নিঃশব্দে মেনে নিল।

_________

পরেরদিন…..

অধরার সাথে বিকেলে শ্বশুর বাড়ি এসেছে প্রত্যাশা। অধরা অবশ্য সন্ধ্যার পরেই চলে গিয়েছে। সবাই অনেক থাকতে বলেছিল। বাড়ি ফাঁকা এটাওটা অজুহাত দিয়ে থাকলেন না। যাওয়ার আগে প্রত্যাশাকে হাজারটা আদেশ-নিষেধসহ অনেককিছুই বলে যান। এ-ও বলেন— এমনভাবে চলতে, যেনো কোনো কথার সৃষ্টি না হয়।

রাতে ডিনার শেষে রুমে যাচ্ছিল প্রত্যাশা। নীহারিকা বললেন,

-” ওয়াটার বোতলের পানি ফেলে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, নীরবের কী কী ওষুধ আছে এখন সেগুলো মিলিয়ে দেখে দিও।”

-” আচ্ছা, ঠিক আছে।”

নীরব হাঁটাচলাচল করছে না এমন নয়। প্রয়োজনীয় সব নিজেই করছে, কিছুটা খুঁড়িয়ে। তবে ডাক্তার যেহেতু পায়ে প্রেশার দিতে নিষেধ করেছে তাই বেশি সময় তার বিছানাতেই কাটছে। রাতের খাবার রুমেই দেয়া হয়েছিল।

রুমে ঢুকতেই বিছানায় নজর গেল প্রত্যাশার। কালো টিশার্ট, ধূসর ট্রাউজার পরনে। কপালে সাদা ব্যান্ডেজ। যেটা আজকে আসার আগে ড্রেসিং করে নতুন করে করা হয়েছে। বেডের হেডে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছে নীরব। প্রত্যাশা কোনো কিছু না বলে বোতলের পানি চেঞ্জ করে আনে। পরপর প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষুধ বের করে বেডটেবিলে নামাতে নামাতে বলল,

-” আপনার মেডিসিন। এগুলো রাতে আছে।”

নীরব একটা অফিশিয়াল মেইল দেখছিলো। ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই বলে,

-” রাখো।”

প্রত্যাশার মনে হলো নীরব তাকে ইগনোর করছে। জোড়ালো শ্বাস ফেলে দরজাটা লক করে বিছানার ওপাশে বসল। কয়েক মূহুর্ত পরপরই কিছু ভেবে অভিমানী কণ্ঠে বলল,

-” শুনুন, আপনি কথা বলা অফ করে দিয়েছিলেন, যোগাযোগ রাখা বন্ধ করেছিলেন। সম্পর্কটা রাখতে চান না, সেটাও জানি। সব ঠিক আছে।”

একটু থামল। দুই হাতের তালু ঘষে ফের বলল,

-” আমাকে এখানে আসতে দেখে, আপনি আবার ভাববেন না আমি অবলা নারীর মতো আপনার হাতে পায়ে ধরে, হাউমাউ করে কেঁদেকেটে বারবার রিকোয়েস্ট করব সম্পর্কটা রাখতে। আর সেটা করতেই এখানে এসেছি। এরকম ভাবলে ভুল।”

নীরব ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। প্রত্যাশার ঠোঁট দুটো এক নাগাড়ে চলতে লাগল,

-” তাহলে আপনি এখন প্রশ্ন করতেই পারেন আমি এখানে কী করতে এসেছি? আপনার সাথে একটা সম্পর্ক না থাকলেও আরেকটা সম্পর্ক কিন্তু থেকে যাবে। নিভান ভাইয়া বউকে খুব ভালোবাসে। আপনার আমার সম্পর্ক থাকা না থাকায় ওদের সম্পর্কের এতটুকু ভাটা পড়বে না। আর ওদের সম্পর্ক থাকা মানেই আপনার আমার বেয়াই-বেয়াইনের সম্পর্কটা থেকে যায়। কখনো সামনাসামনি পড়া, জাস্ট হাই-হ্যালো এতটুকুই। যাকে আত্মীয়তার হক বলে আরকি। ধরুন, আমি সেই আত্মীয়তার জের ধরেই অসুস্থ আপনাকে দেখতে এসেছি। নেহায়েৎ আম্মু বারবার বলেছে তাই বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে।”

নীরব শীতল চাহনিতে চেয়ে আছে তুরন্ত ছুটে চলা ঠোঁটজোড়ার দিকে। মৃদু হেসে ফোনটা বিছানায় নামাল। ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে ফাজলামির সুরে বলল,

-” হ্যাঁ আপনি তা দেখতে আসতে পারেনই। একটা প্রশ্ন, আজকালকার বেয়াইন বেয়াইয়ের বেডে একসাথে শুতেও আসে নাকি? বেয়াইনদের এই হক সম্পর্কে আমি অবগত নই।”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

প্রত্যাশা বিছানা থেকে একটা বালিশ হাতে তুলে পা বাড়াতেই নীরবের কপালে ভাঁজ পড়ল। নীরব তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,

-” প্রত্যাশা বালিশ রাখো। আমি জাস্ট মজা করে কথাটা বলেছি।”

-” জানি।”

-” তাহলে বালিশ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

-” আমি কাউচে ঘুমাব।”

নীরবের কপালের ভাঁজ মিলিয়ে এল। বলল আদেশ স্বরুপ,

-” বেশি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বেডে শুয়ে পড়ো।”

প্রত্যাশার বুকের ভিতরটা ভার হয়ে উঠল। কেন জানি মনে হলো, ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। আম্মু জোর করে গুঁজে দিয়ে গেল। হুঁশিয়ারি করে গিয়েছেন– কোনো কথার যেনো সৃষ্টি না হয়। প্রত্যাশার ভালো লাগলো না কথা বাড়াতে। নিঃশব্দে বিছানার এক কোণায় পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল।

নীরব মেডিসিন খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে এসে সবুজ রঙের ডিমবাতি জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ ঘরে সেই আলোয় প্রত্যাশাকে দেখে তার বুক কেমন করে উঠল। মেয়েটা একদম গুটিসুটি মে*রে শুয়ে আছে, যেন নিজেকে সরিয়ে রেখেছে পুরো পৃথিবী থেকে। চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না।

হঠাৎ করেই প্রত্যাশার পেটের ওপর হাত রাখে নীরব। প্রত্যাশা চমকে না উঠে, দাঁতে দাঁত চেপে পরে রইল। বুঝাতে চাইল গভীর তন্দ্রায় ডুবে আছে সে। দু সেকেন্ড খানেকের মাঝেই নীরব একটানে বউকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাছে টেনে নিল। প্রত্যাশা এবারে চোখদুটো কষে এঁটে রেখেই এক ঝটকায় নীরবের হাতটা পেটের উপর থেকে নামিয়ে দিল। নীরব জোড়ালো শ্বাস ফেলল। প্রত্যাশার হাতের উপর আলগোছে ডান হাতটা রেখে, কণ্ঠে এক সমুদ্দুর অপরাধবোধ মিশিয়ে বলল,

-” স্যরি! আ’ম রিয়েলি স্যরি।”

প্রত্যাশা দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,

-” স্যরি? হোয়াট ফর স্যরি?”

নীরব চুপ হয়ে গেল। কিছু একটা যেন গলার কাছে আটকাল। প্রত্যাশার চোখে তাকাতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল,

-” দ্যাট নাইট, আই বিহেভড রিয়েলি ব্যাডলি উইথ ইউ। রাগের মাথায় যা করেছি, তা একদমই ঠিক হয়নি। আই শুডন’ট হ্যাভ ডান দ্যাট। আই অ্যাম ট্রুলি স্যরি, প্রত্যাশা।”

চোখে টলটলে জল নিয়ে প্রত্যাশা নিরুত্তর রইল।প্রত্যাশার নিশ্চুপ , নিঃশব্দ চোখের জল নীরবের অপরাধবোধ বাড়াল ক’গুণ। নীরব অসহায় চাহনিতে প্রত্যাশার অশ্রুসিক্ত চোখে চোখ রাখল। বলল ব্যাকুল স্বরে,

-” প্লীজ প্রত্যাশা?”

প্রত্যাশার ছোট্ট হৃদয় ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। ব্যথাতুর মন নিয়ে ভারি গলায় বলল,

-” জানি না কে বা কারা, কীভাবে ওই ছবিগুলো তুলেছে? উদ্দেশ্যই বা কী? তবে এতটুকু জানতাম আমি নির্দোষ। আমি সজ্ঞানে ভুলেও ওমন কিছু করতে পারি না। আর সত্য প্রকাশ হবে, দেরিতে হলেও এতটুকু বিশ্বাস আমার ছিলো, আছে। তবে মাঝখানে ঘটে যাওয়া কিছু মূহুর্ত মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। ম*রে গেলেও কিছু কথা ভুলতে পারব না। হয়তো চাইলেও সম্ভব নয়। শরীরের ক্ষত ওষুধে যায়, থেকে যাওয়া শুকনো দাগ অয়েন্টমেন্টেও দূর করা যায়। তবে কথার আঘাতে হৃদয়ে তৈরি হওয়া ক্ষ’তের দাগ আদৌও মুছা সম্ভব?”

-” আমার ভুলে, নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে তোমাকে যে আঘাত করে ফেলেছি, সেটা স্যরি বলাতে উঠে আসবে না। কথাগুলো যদি ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হতো, তবে আমি সেটাই করতাম। ভুল মানুষ মাত্রই হয়। কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। লাইফের বড় ভুল ছিলো জাস্টিফাই না করেই সেদিন রাগে কন্ট্রোললেস হয়ে তোমার সাথে রুঢ় আচরণ করেছি। বিলিভ মি, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার পর আমার মধ্যে অপরাধবোধ জাগে।”

আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে প্রত্যাশার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে নীরব। বলল শান্ত, শীতল কণ্ঠে,

-” প্রত্যাশা, তোমার মনে কথার আঘাতে যে ক্ষত আমার দ্বারা তৈরি হয়েছে। সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমার। শুধুই আমার। তোমার মনের ক্ষ’ত মোছার অয়েনটমেন্ট আমি হবো। দাগ গুলো না উঠুক, ব্যথাটা যেন কমে সেই চেষ্টাই করব।”

বলতে বলতে প্রত্যাশার হাওয়াই মিঠাইয়ের মতন নরম মসৃণ গালে হাত রাখল নীরব। গালে আলতোভাবে হাত রেখে আকুল আবেদন ভরা কণ্ঠে বলল,

-” প্লীজ, পারডন মি। ভুলে যাও সবটা।”

-” সম্ভব?”

একরাশ হতাশা নিয়ে বলল নীরব,

-” জানি ভুলা অসম্ভব। তবুও এ__”

নীরবের কথায় দাড়ি টেনে দেয় প্রত্যাশা। গাল থেকে আস্তে করে নীরবের হাতটা নামিয়ে দিল। নিচু স্বরে বলল,

-” নীরব আপনি যে যায়গায় ছিলেন, আমি নিজেও সেই জায়গাটা ফেস করে এসেছি। আমিও আপনাকে অবিশ্বাস করে অনেক কিছুই বলেছি। নীরব আপনি আমার থেকে বড়, অনেক বেশি অভিজ্ঞ, হাইয়ার এডুকেটেড। নিঃসন্দেহে আপনার জানাশোনা, অভিজ্ঞতা আমার থেকে অনেক বেশি। একই ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনাকে আমার সাথে কম্পিয়ার করলে পার্থক্য কী? আমাদের দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কী রইল?”

নীরব বাকরুদ্ধ। উত্তর দিতে পারল না। প্রত্যাশা মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

-” ও হ্যাঁ পার্থক্য অবশ্য আছে। একটা বিশাল পার্থক্য আছে। আমি আপনাকে আপনার পরিবারের সবার সামনেই অপমান করেছিলাম। আর আপনি আমাকে কারো সামনে ছোট করেননি। আপনি চারদেয়ালের মাঝে আমাকে অপমান করে যাচ্ছে না তাই বলেছেন। সেদিনের পর থেকে মনেহয় সবাই ঠিকই বলে, আপনি বাবার কথা রাখতেই আমাকে বিয়ে করেছেন।”

প্রত্যাশার গলা ধরে এল। নীরব চোখ তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,

-” সবাই মানে? কে কে, কী বলেছে তোমাকে? আমাকে বলো কে বলেছে তোমাকে এসব?”

প্রত্যাশা প্রীতির নাম নিলো না। স্রেফ বলল,

-” কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়। আপনি নিজেই তো বলেছিলেন, ‘সব জেনেশুনে দয়া দেখানোই আমার ভুল হয়েছে’ তারমানে দাঁড়ায় আপনি আমাকে দয়া করেছেন। বিয়েটা করে দয়া করেছেন?”

নীরবের শব্দগুলো জড়িয়ে এল,

-” আ-আমি বলছি তো তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না। ওই দৃশ্যগুলো দেখে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। রাগের মাথায় কী বলেছি নিজেও জানি না।”

-” নীরব আপনাকে আমার ফ্যামেলি বলেছিল দয়া করতে? এমন না যে আমার আব্বু কন্যা দায়গ্রস্থ ছিলো। আমাকে ওই মূহুর্তে পাত্রস্থ করতেই হবে। আপনি যদি আপনার ফ্যামেলির চাপে পড়ে বিয়ে করেন; সেই দায় তো আমার না, না আমার ফ্যামেলির।”

-” প্রত্যাশা তোমার মনেহয় আমাকে দিয়ে জোর করে কিছু করানো যাবে? বিয়ের মতো জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি চাপে পড়ে করব?”

একটু থেমে,

-” হ্যাঁ, সত্যি বললে বলব; বাবা তোমার-আমার বিয়ের কথা বললে আমি প্রথমে না করি। সেটা তোমার আমার এইজ গ্যাপের জন্যে। তারউপর তুমি অনেক ছোটো।এছাড়া তোমাকে বিয়ে করতে আমার দ্বিতীয় কোনো আপত্তি ছিলো না।”

প্রত্যাশা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। কেনো জানি ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ছোট থেকেই সে কারো উপর রাগ করে থাকতে পারে না। নীলার সাথে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঝগড়া হতো, এখনো হয়। এমন না যে সে নীলার সাথে সবসময় মুখে মধু নিয়ে কথা বলে। সেও ত্যাড়া করে বলে। তবুও রাগ আগে প্রত্যাশাই ভাঙাতো। কিছু কিনলে দৌড়ে গিয়ে আপুকে দিতো। আপু তবুও ঝারি মা’রত। আম্মু তো বারবার বলতো—- প্রত্যাশা তোর লজ্জা নেই। তুই এত কিছুর পরেও কেনো ওর সাথে কথা বলতে যাস?

নীরবের করা অপমানও প্রত্যাশা ধরে রাখেনি। নীরবের এক্সিডেন্টের জন্য ওর নিজেকেই দায়ী মনে হয়েছে। ছুটে গিয়েছে, সবটা মনের এককোণে ঠেসে সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। তবুও…এত কিছুর পরেও যখন কিছু কথা মনে ওঠে, তখন হৃদয়টা দুমড়েমুচড়ে যায়। চোখের কোল ঘেঁষে নোনতা পানি গড়িয়ে পড়ল। প্রত্যাশার দিকে আরেকটু ঝুঁকল নীরব। পরপর হাতের আঙুল দিয়ে চোখের পানি ফেলে দিল। প্রত্যাশার মুখটা আঁজলা করে ধরে নরম, কোমল গলায় বলল,

-” আই নো, সেদিন আমি খুব বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। রাফ বিহেভ করেছি। বাট স্টিল, আই’ম আস্কিং; ক্যান ইউ ফরগিভ মি?”

প্রত্যাশা ফুঁপিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু বলল,

-” আমি ঘুমাব। ঘুম পাচ্ছে।”

তারপর নিঃশব্দে উল্টোদিক ঘুরে শুলো। বালিশে মুখ গুঁজে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিল। নীরব বড় একটা হতাশ শ্বাস ফেলে কপালের উপর ডান হাতটা আড়াআড়ি করে রাখল। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ নিজের মেজাজের উপর বর্তাল। সেদিন যদি একটু ভাবতো, নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারত? উফ্! এক সমুদ্দুর আফসোস নিয়ে চোখের পাতায় ঘুম নামল না নীরবের। অস্বস্তি, অপরাধবোধে হাঁসফাঁস করল ভেতরটা।

___________

ঘড়িতে সাতটা পঞ্চাশ বাজে। নীরবকে এড়িয়ে যেতেই মূলত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কিচেনে আসছে প্রত্যাশা। শাশুড়ি অবশ্য ওকে পড়ার কথা বলে রুমে যেতে বলে। প্রত্যাশা না গিয়ে কিচেনে টুকটাক সাহায্য করে।

নীহারিকাকে টেবিলে খাবার সাজাতে হাতে হাতে সাহায্য করছিল প্রত্যাশা। নীহারিকা একটা ট্রে-তে খাবার সাজিয়ে বলল,

-” প্রত্যাশা?”

-” হুঁ..”

-” নীরবের খাবার। যাও রুমে দিয়ে এসে তুমি খেয়ে নাও।”

প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক প্রত্যুত্তর দিয়ে রুমে যায়। নীরব বেডের হেডেবোর্ডে হেলান দিয়ে এক পায়ের সাথে আরেক পা জড়িয়ে রেখেছে। হাতে তার আজকের পত্রিকা। খানিক আগে রুম থেকে মা’কে ডেকে পত্রিকা চেয়েছিল। ভেবেছিল মা রান্নায় ব্যস্ত থাকবে প্রত্যাশাকে দিয়ে পাঠাবে। কিন্তু তার সে ভাবনায় জল ঢেলে প্রত্যাশা পরিকে দিয়ে পাঠায়। নীরব পরিকে জিজ্ঞেস করে— তোর ছোট ভাবীমণি কোথায়? কী করে সে?

পরি উত্তর দেয়— ছোটো ভাবিমণি কাজ করতাছে। বড় খালাম্মা তারে কইল। সে আবার আমারে দিয়া ব্যাগার খাটাল। আমারে পাঠাইল।

নীরব একবার প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে ফের পত্রিকায় চোখ ফেরাল। প্রত্যাশা খাবার নামাতে নামাতে বলল,

-” আপনার নাস্তা।”

আর বাড়তি শব্দ উচ্চারণ না করে প্রত্যাশা পা চালায়। নীরব দারাজ গলায় বলল,

-” ওয়েট?”

প্রত্যাশা মুখের দিকে তাকাল না। দৃষ্টি ফ্লোরে রেখেই বলল,

-” হুঁ, বলুন।”

-” কাছে এসো?”

প্রত্যাশা ভড়কাল। তবে উপরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল, বুঝতে দিলো না। শুধু বলল,

-” মানে? আমার কাজ আছে।”

নীরব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

-” কাজ করতেই ডাকছি। আদর করতে নয়।”

প্রত্যাশা মনেমনে দু’টো গালি দিলো। নীরব ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” যেহেতু সবাই জানে তুমি আমার সেবা করার জন্য এখানে আছো। পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ রেখে স্বামী সেবা করতে আসছো। তাই একটু ভালো করেই না হয় স্বামী সেবা করো। শুধু লোক দেখানো নয়।”

এই লোক চাইছে টা কী? অদ্ভুত! মনে মনে এসব ভেবে মাথা ঝাড়ল প্রত্যাশা। মুখে বলল,

-” কী করতে হবে, বলুন?”

-” খাইয়ে দিতে হবে।”

প্রত্যাশার চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। বিস্ফোরিত চাউনিতে চেয়ে বলল,

-” কীহ! পারব না।”

নীরব পত্রিকা ভাঁজ করে একপাশে নামাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-” পারবে না মানে? আমার মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যথা, ডক্টর মুভমেন্ট করতে নিষেধ করেছেন। তারপরও তুমি এটুকু সেবা করতে চাইছো না। নির্দয়ের মতো সরাসরি ‘পারব না’ বলে ফেললে।”

প্রত্যাশা ঝটপট প্রত্যুত্তরে বলল,

-” পায়ে ব্যথা, মুভমেন্ট করাতে বারণ। হাতে তো আর কোনো সমস্যা নেই। হাত নাড়াতে বারণ নেই। আর দিব্যি তো কাল রাতেও নিজ হাতেই খেলেন।”

নীরব নড়েচড়ে বসল। মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” সমস্যা ছিলো না, এখন হচ্ছে।”

বিরক্তিতে প্রত্যাশার কপাল কুঁচকে গেল। স্রেফ বলে দিল,

-” সবকিছু থাকল। খেয়ে নিবেন।”

এই বলে প্রত্যাশা প্রস্থান করতে নিবে, ঠিক তখুনি নীরব বলল,

-” ওকে ফাইন। খাবার গুলো যেভাবে আছে, থাকুক সেভাবেই।”

প্রত্যাশা যেনো এবার ফ্যাসাদে পড়ল। খাবার ওমন থাকলে শাশুড়ি এসে দেখে আবার তাকেই না দোষারোপ করে বসে। অসভ্য লোকটা কীভাবে ঠাণ্ডা মাথায় স্বৈরাচারীতা করছে! ভেতরে ভেতরে গজগজ করতে করতে প্রত্যাশা বেডের একপাশে বসল। বলল,

-” বাহ্, এখন থেকেই স্বৈরাচারী স্বভাব দেখাতে শুরু করলেন। এটাই বাদ ছিলো।”

নীরব মুচকি হাসলো। বলল,

-” উঁহু, ভুল বললে। স্বৈরাচারীতা নয়, বউয়ের থেকে সেবা নিচ্ছি।”

প্রত্যাশা পরোটা ছিঁড়ে কালা ভুনায় ডুবাতে ডুবাতে শুকনো ঢোক গিলে ভাবল— এখনো যাকে মাঝে মাঝেই আম্মু খাইয়ে দেয়। সে কী না হাতির মতো একজনকে খাইয়ে দিবে। কী আশ্চর্য!

মুখটা পাংশুটে করে নীরবের মুখের সামনে খাবার ধরল। নীরব ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,

-” টেস্ট করে দ্যাখো। দ্যাখো ঝাল নুন পরিমাণমতো আছে কী না! আমি বেশি ঝাল খেতে পারি না।”

প্রত্যাশা অতীষ্ঠ চাহনিতে চেয়ে বলল,

-” আপনার মা রান্না করেছে। তাই সব ঠিকই থাকার কথা।”

-” তবুও টেস্ট করে দেখে দাও।”

কী জ্বা’লা! প্রত্যাশার রাগ হলো। এই লোক বাচ্চাদের থেকেও বেশি জ্বালাতন করছে। প্রত্যাশা মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” সব পরিমাণ মতোই আছে।”

তারপর নীরবের মুখের সামনে খাবার ধরতেই নীরব বড় করে হা করে খাবার মুখে নিল। গলাধঃকরণ করে প্রত্যাশার হাত থেকে খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিতে নিতে বলল,

-” দাও, আমি নিজেই খাচ্ছি। পিচ্চি বউকে আর কষ্ট দিতে চাইছি না।”

প্রত্যাশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ত্রস্ত প্লেট দিয়ে উঠে গেল।

__________

ব্রেকফাস্ট টেবিলে মুখোমুখি বসে প্রীতি আর সার্থক। এমন দেখা খুব বেশি হয় না। বিশেষ করে সেদিনের ঘটনার পর দু’জনের কারোর সাথেই আর কথা হয়নি। কেউ কারো দিকে তাকায় না পর্যন্ত।

প্রীতি নিঃশব্দে ব্রেডে জেল মাখিয়ে মুখে দিল। খানিক পর নিজ থেকেই আচমকা বলে উঠল,

-” স্যরি ভাইয়া।”

সার্থকের হাতে ফ্রুটস জুসের গ্লাস। ঠোঁটে গ্লাস তুলতে তুলতে একবার চোখ মেলল প্রীতির দিকে। তবে কিছু বলল না। প্রীতি একটু চুপ থেকে ফের বলল,

-” অদ্রিকা আপু তোকে পছন্দ করে ভাইয়া।”

সার্থক এবারও নিঃশব্দ, নিরুত্তাপ। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। প্রীতি হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-” সৃষ্টিকর্তা যে কেনো সেইসব মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়, যারা ভাগ্যে নেই। অথচ তাদেরকেই ভালো লেগে যায়। উফ্! সেই পছন্দটাও কাঁটার মতো বুকে বিঁধে থাকে, সারা জীবন।”

-” ভালো লাগলে যে পেতেই হবে, এমন তো কোনো শর্ত নেই। কখনও কখনও ভালোবাসা মানে; দূর থেকে তার সুখে নিজেকে সুখী ভাবা। ভাগ্যকে মেনে নেওয়াটাও ভালোবাসারই এক রকম পরিণতি।”

কথাটা বলেই টিস্যু দিয়ে হাত মুখ মুছে উঠে দাঁড়াল সার্থক। এরমধ্যে মনা ইচ্ছের পিছুপিছু ঘ্যানঘ্যান করতে করতে নামল। অভিযোগ দিলো প্রীতির কাছে,

-” ম‌্যাডাম, ইচ্ছে কিচ্ছুতেই খাবার খাচ্ছে না।”

প্রীতি ধ’ম’কিয়ে উঠল,

-” ইচ্ছেএএএ…. দ্রুত খাবার খেয়ে নাও। স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে।”

ইচ্ছে ঘাড় ফুলিয়ে বলল,

-” আমি খাবো না, স্কুলেও যাব না। আমি দাদু বাসায় যাব। তোমরা বলছো নিয়ে যাবে, কই যাচ্ছো না কেনো? আমি এক্ষুনি যাবো।”

সার্থক উবু হয়ে ইচ্ছের ফোলা ফোলা গালে হাত রাখল। আদুরে গলায় বলল,

-” ইচ্ছে সোনা তুমি খেয়ে নাও। আমি তোমার জন্য আজ খেলনা আনব। অনেক…টেডি আনব, রিমোট কন্ট্রোল কার… তারপর __”

ইচ্ছে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

-” আমার চাই না গাড়ি, চাই না টেডি। আমি দাদু বাসায় যাবো। আমি খাবো না, খাব না, স্কুল যাব না।”

প্রীতি রেগে কিছু বলবে। সার্থক থামিয়ে দিল। বলল হাসিমুখে,

-” ওকে লিটল প্রিন্সেস। তোমাকে আমি দাদু বাসায় নিয়ে যাবো। তুমি এবারে খেয়ে নাও তো ফাস্ট।”

-” সত্যিই?”

-” হুম, সত্যি।”

-” এক্ষুনি?”

-” না এখন কী করে….এখন না তোমার স্কুল আছে। আমারো তো হসপিটাল আছে।”

ইচ্ছের মুখ আবার ভার হয়ে এলো। সার্থক শব্দ করে ইচ্ছের গালে চুমু খেয়ে বলল,

-” আচ্ছা বিকেলে নিয়ে যাবো। খুশি?”

খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে বলল ইচ্ছে,

-” থ্যাংকিউ মামা।”

___________

দুপুরের পর ভাত ঘুম দিচ্ছে সবাই। যে যার রুমে। কেবল প্রত্যাশা ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছে। কিছুটা অভিমান মনের কোণে পুষে মূলত নীরবকে এড়িয়ে চলতেই এখানে সে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চারটের ঘর ছুঁয়েছে। এরমধ্যে নীলা এসে সামনের সোফায় বসল। প্রত্যাশা দুই হাতে বই সামনে মেলে আছে। নীলা ত্যাড়া সুরে বলল,

-” প্রত্যাশা, তুই পড়ছিস? নাকি আয়না ধরার মতো বই সামনে ধরে আছিস। কারন তুই যে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড়তি, পাশের বাড়ির লোকজনেরও কানের তালা ফেটে যেতো। তোর পড়ার ধরুন তো এমন ছিলো; গাছের পাতা সবুজ, গাছের পাতা সবুজ।”

প্রত্যাশা জবাব দিলো না। ইচ্ছে করল না।‌ মিনিট খানেক পর নীলা আবার চিরাচরিত স্বভাবে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,

-” তোর তো একদিক দিয়ে ভালোই হলো রে প্রত্যাশা। সারাবছর না পড়ে উড়নচণ্ডী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিস। এমনিতেই রেজাল্ট খারাপ আসতো। এখন তো ছুঁতো দিতে পারবি, বরের সেবা করতে গিয়ে ঠিকমতো পড়তে না পাড়ার জন্য রেজাল্ট খারাপ আসছে। কী কপাল তোর প্রত্যাশা, একদম টাইমিংটা দ্যাখ!”

প্রত্যাশা বইটা নিচের দিকে হালকা নামাতেই ওর চোখদুটো দেখা গেল। নীলার দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে বলল,

-” আফসোস হচ্ছে তোমার?”

নীলা নির্বোধের মতন শুধাল,

-” আফসোস, কীসের আফসোস হবে?”

-” এইযে আমার রেজাল্ট খারাপ হলেও একটা ছুতো দিতে পারব। আম্মু বকবে না, বাকিরাও কিছু বলবে না। তুমি তো আর এই সুবর্ণ সুযোগ পাওনি। তাই ভাবলাম তোমার আফসোস হচ্ছে বুঝি!”

-” আমি কী তোর মতো গা’ধী মার্কা ছাত্রী ছিলাম নাকি? আ’জ’ব আমি ওমন__”

কথা কেড়ে নিয়ে প্রত্যাশা বলল,

-” মাঝে মাঝে তুমি এমন কথা বলো না, গাধারাও লজ্জায় পড়ে যায়।”

এরমধ্যে নীহারিকাকে আসতে দেখে দু’জনেই থেমে গেল। প্রত্যাশা একটু আতংকে ছিলো। রুম ছেড়ে এখানে পড়তে দেখে শাশুড়ি আবার কিছু সন্দেহ না করে। তবে নীহারিকা কোনো কিছু না বলে কিচেনে যায় বিকেলের নাস্তা বানাতে। শর্মিলাও খানিক পরেই কিচেনে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর ডোরবেলটা বাজতে লাগলো। প্রত্যাশা কলম ঠোঁটের সাথে ধরে পড়া মনে করছিল। হঠাৎ নীহারিকার গলা এল,

-” প্রত্যাশা, দ্যাখো তো কে এল।”

প্রত্যাশা পেনটা বইয়ের ভাঁজে রেখে এগিয়ে গেল। কাঁধের একপাশে থাকা ওড়নাটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নেয়। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়। ইচ্ছে সামনে, পিছনে সার্থক দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশা সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। প্রত্যাশার সামনাসামনি হয়ে সার্থক নিজেও অপ্রস্তুত হয়। প্রত্যাশা সৌজন্যমূলকও কিছুই না বলে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। শর্মিলা এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল,

-” প্রত্যাশা কে এসেছে?”

প্রত্যাশা ত্রস্ত ঘুরে দাঁড়াল। বলল,

-” ইচ্ছে।”

শর্মিলা ওদেরকে দেখেই অমায়িক হাসল। প্রত্যাশা তুরন্ত পা ফেলে চলে যায়। ইচ্ছে একগাল হেসে ‘ছোট দিদুন’ বলে কোমড় জড়িয়ে ধরে। শর্মিলা আদর করে। সার্থক সালাম দিয়ে বলল,

-” আন্টি ইচ্ছে থাকুক, রাতে আমি হসপিটাল থেকে ফেরার পথে ওকে নিয়ে যাবো। ও খুব জিদ করছিলো।”

শর্মিলা বলল,

-” ও মা সেকি তুমি ভেতরে আসবে না। তাই হয় নাকি। ভেতরে আসো। বসো, তারপর যেয়ো।”

এরমধ্যে ইচ্ছের গলার আওয়াজ পেয়ে নীহারিকা এগিয়ে আসেন। প্রত্যাশা বইগুলো তুলছিলো রুমে যাবে বলে। শাশুড়ির কথায় হাত থেমে যায়,

-” প্রত্যাশা একটু কিচেনে যাও তো। আমি আসছি।”

প্রত্যাশা হাঁফ ছেড়ে কিচেনে গেল। নীহারিকাকে দেখে নম্রস্বরে সালাম দেয় সার্থক। নীহারিকা সালাম নিয়ে বলল,

-” ভেতরে এসো।”

ছেলেটাকে উনার বেশ ভদ্রই মনেহয়। আর এভাবে গেলে খারাপ দেখায়, তাই সৌজন্যমূলক বলেন নীহারিকা।

শর্মিলা রুমে কোন একটা কাজে। নীলা তো ইহজনমের অলস। কাজের সময় তাকে পাওয়া যায় না। নীহারিকা নাস্তা রেডি করতে করতে প্রত্যাশাকে বলল,

-” ইচ্ছের মামা আছে ড্রয়িংরুমে। নাস্তাটা দিয়ে আসো।”

প্রত্যাশা কণ্ঠে অবাকতা নিয়ে বলে উঠল,

-” আমি!”

নীহারিকা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

-” আলিশা বলে গেল শুনলে না, তোমার শ্বশুর ডাকছে। দেখি কী দরকার পড়ল তার আবার। তুমি বাকিটা রেডি করে দিয়ে এসো। আর পরীটাও হয়েছে দুনিয়ার ফাঁকিবাজ। আল্লাহর ত্রিশটা দিন ওর যেনো কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে। এ বেলা নয়, ও বেলা ওর ছুটি লাগবেই।”

নীরবের ফোনটা বেজে উঠল। অধরার নম্বর দেখে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে অধরা বলল,

-” প্রত্যাশাকে সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি। রিং হয়ে বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। সকালে একবার কথা হয়েছে আর সারাদিন হয়নি।”

প্রত্যাশার ফোনটা টেবিলের উপর দেখে নীরব বলল,

-” ফোনটা বোধহয় সাইলেন্ট আছে, আপনি একটু লাইনেই থাকুন। আমি ওর কাছে দিচ্ছি।”

প্রত্যাশা কী করবে ঠাওর করতে পারছে না। শাশুড়ির কথা না শুনলে বেয়াদব ভাববে। আবার নীরব ওনাকে পছন্দ করে না। যার জন্য এত কিছু ঘটল। ওর প্রচন্ড অসহায় লাগল। ওর মনে হলো মেয়েদের কপালই পোড়া, এর মন রক্ষা করতে গেলে ওর মন রক্ষা হয় না। মাঝখান দিয়ে নীরিহ, নিরুপায় মানুষটিকেই দোষী হতে হয়। প্রত্যাশা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নাস্তার ট্রে নিয়ে এগোল।

ইচ্ছে আনিশার সাথে সোফায় বসে মোবাইলে কার্টুন দেখছে আর গল্প করছে। টেবিলের উপর থাকা বই-খাতা ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। বাতাসে খাতার পাতা উল্টে গোটাগোটা অক্ষরের লেখাগুলো সামনে এলো। সার্থক সেদিকেই চেয়ে ছিল। এমন সময় পায়ের শব্দে সামনে তাকায়। প্রত্যাশা নিঃশব্দে হাতের ট্রে টি-টেবিলে নামাল। সার্থক চোখ তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকাল। ছটফটে চঞ্চল প্রত্যাশার এত নিশ্চুপ, শান্ত স্বভাব দেখে তার কপালে কুঞ্জন পড়ল।

নীরব রুম থেকে বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ পা জোড়া থমকে গেল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ওর। গম্ভীর গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা?”

প্রত্যাশার পিলে চমকে উঠল। প্রত্যাশা ঝট করে মাথা তুলে তাকায়। যদিও ও এখান থেকে এক্ষুনি প্রস্থান করতো। নীরবকে দেখে ভ’য় জেঁকে ধরল, অজানা আশংকায় অস্থির হলো। নীরব হিম শীতল গলায় বলল,

-” রুমে আসো।”

প্রত্যাশা দুরুদুরু বুক নিয়ে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই নীরব এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। প্রত্যাশার আঙুলের খাঁজে আঙুল মিশিয়ে কোমল স্বরে বলল,

-” কখন থেকে ডাকছি তোমায়? চলো দরকার আছে।”

সবকিছু যেনো প্রত্যাশার মাথার উপর দিয়ে গেল। বুঝতে কয়েক সেকেন্ড বিলম্ব হলো। মনে মনে গালি দিলো প্রত্যাশা। এএসপি সাহেব ফাজিল কম না। উনি নিশ্চয় তার শত্রুকে দেখিয়ে দিল, এতকিছুর পরেও তাদের সম্পর্ক ঠিক কেমন আছে!

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

রুমের দরজার চৌকাঠ পেরোতেই নীরবের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এল। হাত সরিয়ে মেরুদণ্ড টানটান করে প্রত্যাশার দিকে গম্ভীর মুখে তাকাল। মুহূর্তেই প্রত্যাশার ভেতর একটা অজানা ভ’য় গেঁথে বসল— ওখানে নরম স্বরে কথা বললেও, এখন নিশ্চয় বকাঝকা করবে? সার্থকের সামনে কেনো গিয়েছি?

প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে উদয় হতেই ভয়ের ছায়া পড়ে প্রত্যাশার মুখেচোখে। নীরব নিঃশব্দে সেই ভীতু মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রত্যাশা জিভের ডগায় ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে জড়ানো স্বরে বলে উঠল,

-” আ-আসলে মা বললেন নাস্তা দিতে। না দিলে তখন আবার___”

প্রত্যাশার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নীরব বলল,

-” ইটস্ ওকে। ডোন্ট প্যানিক।”

শব্দগুলো প্রত্যাশার ভেতর থেকে দুশ্চিন্তার জালটা একটু একটু করে খুলে দিল। আপনাআপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোল। নীরব শান্ত গলায় বলল,

-” একটা সম্পর্ক ন*ষ্ট হতে তৃতীয় ব্যক্তির অনেক ভূমিকা থাকে। আবার সম্পর্ক ভাঙতে বাইরের মানুষ যেমন দোষী, তার চেয়েও বড় দোষ থাকে আমাদের। যখন আমরা তাদের সেই সুযোগটা দিয়ে ফেলি।”

একটু থেমে,

-” আশাকরি আমরা এমন কিছু করব না, যাতে কেউ আমাদের মাঝখানে ঢুকতে পারে। আর একটা সম্পর্কে বিশ্বাস খুব জরুরী। বিশ্বাসটুকুই হয় সম্পর্কের মূল শক্তি। একজন মানুষ পারফেক্ট হয় না, আমিও নই। তবে পূর্বের থেকে শিক্ষা তো নিতেই পারি।”

বাবা-মায়ের রুমের সামনে দিয়ে ড্রয়িংরুমে যেতে পথেই মায়ের কথা কানে আসে নীরবের। মা বাবাকে রাগি স্বরে বলছিলেন— ঘি রঙের পাঞ্জাবিটা তো আয়রন করে সোফাতেই রেখেছি। তুমি একটু চোখ দিয়ে দেখবে না। দেখা নেই শুধু পারে ডাকাডাকি। ওদিকে ইচ্ছেকে নিয়ে ওর মামা এসেছে। প্রত্যাশাকে নাস্তা দিতে বলে এসেছি। সে আবার কী করছে আল্লাহ জানে! তার কাজের উপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। কথাবার্তাই ঠিকঠাক শেখেনি___”

প্রত্যাশা নিশ্চুপ। নীরব প্রসঙ্গ ঘোরাতে বাম হাতে ধরা ফোনটা বাড়িয়ে দিল।

-” তোমার আম্মু ফোন করেছিলেন। কল ব্যাক করো।”

-” আমার ফোন দিয়ে করলেই তো হয়।”

এই বলে প্রত্যাশা এগিয়ে যেতে চাইলে নীরব ঠেকিয়ে দিল। কণ্ঠে আদেশ নামিয়ে বলল,

-” আমি কল দিয়ে দিয়েছি, রিং হচ্ছে। এই নাও।”

প্রত্যাশা দ্বিরুক্তি করার সুযোগ না পেয়ে ফোন নেয়। ভালো-মন্দ দুই-চারটা খোঁজখবরের পরপরই প্রত্যাশা ঠোঁট বাঁকিয়ে আহ্লাদী সুরে বলল,

-” আম্মু বাসায় যাবো।”

অধরা স্বভাবমতো বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, নরম গলায় কিছু উপদেশ দিয়ে কল কা’টেন। প্রত্যাশা ফোনটা বিছানায় রেখে পা ঝুলিয়ে বসে পরল। কয়েক মুহূর্ত পর নীরব ব্যালকনি থেকে রুমে আসতে আসতে বলল,

-” শাশুড়ি মায়ের কাছে দিলে তো আমাকে ভিলেন বানিয়ে।”

প্রত্যাশা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-” মানে? কীভাবে?”

-” তোমার আম্মু নিশ্চয়ই ভীষণ দুশ্চিন্তা করছেন। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই বাসায় যাওয়ার কথা বলেছো। শাশুড়ি মা ভাববে; ‘জামাই বুঝি ঠিকঠাক নয়। তাই মেয়ে থাকতে চায় না। একদিনেই চলে যাওয়ার বায়না ধরেছে।’ জামাই হিসেবে রেজাল্ট তো একদম ফেল।”

কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে প্রত্যাশা। পা দুটো দুলিয়ে আড়ালে ভেংচি কা’টল।

.
.

প্রত্যাশা যে এখানে আছে সার্থকের অজানা ছিলো। নীরবের এক্সিডেন্টের খবরও তার জানা ছিলো না। প্রীতির সাথে কথা বন্ধ হওয়ার পর থেকে বাড়িতে সে রাতটুকু ছাড়া থাকেই না বলা চলে। সার্থক বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নম্র গলায় বলল,

-” আন্টি আমি এখন উঠছি। ইচ্ছেকে নিতে রাতে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিবো।”

নীহারিকা আকস্মিক বলে উঠলেন,

-” আজই? মাত্র আসলো।”

নীহারিকার কথার অর্থ বুঝতেই সার্থক জড়তা নিয়ে বলল,

-” আ-আসলে আন্টি ওর স্কুল আছে।”

পাশ থেকে শর্মিলাও ইচ্ছের থাকার কথা বলল। বড়দের কথা ফেলতে না পেরে সার্থক বলল,

-” আচ্ছা, ঠিক আছে। আগামীকাল আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। প্লীজ এবারে না করবেন না।”

ওদিকে প্রীতিকে নিয়ে ভ’য়। আসতে দিতে রাজী হচ্ছিল না। মেয়েকে কাজের লোকের কাছে রেখে দিবে, তবুও এদের ছায়াও যেনো মাড়াতে দিবে না। এমন ভাবসাব ওর।

___________

বেডের মাঝখানে ইচ্ছে বিভোরে ঘুমাচ্ছে। একপাশে নীরব অপরপাশে প্রত্যাশা। ইচ্ছে নীহারিকার কাছে শুবে, সেখানে প্রত্যাশা ইচ্ছে করে ইচ্ছেকে নিয়ে এসেছে। গল্প শোনাবে এটাসেটা বলে। নীরবের মনে হচ্ছে ইচ্ছেকে মাঝে দিয়ে একটা দেয়াল দিয়ে রেখেছে প্রত্যাশা। আচমকা হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার হাতের কব্জি ধরে নীরব। প্রত্যাশা তখনও নির্বিকার। নীরব ফিসফিসিয়ে বলল, যাতে ইচ্ছের ঘুম না ভাঙে,

-” প্রত্যাশা এপাশে আসো।”

-” পারব না।”

নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস নামিয়ে বলল,

-” মনে হচ্ছে তুমি সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স মেন্টালিটিতে চলে গেছ।”

-” মন্দ নয়, মাঝেসাঝে এমন দূরত্ব দরকার হয়।”

-” মাঝখানে ইচ্ছে আরেকপাশে তুমি, এপাশের আমি যেন দেয়ালের ওধারে বন্দী কয়েদি।”

প্রত্যাশা ঠোঁট টিপে হাসল। মৃদু আলোয় সে হাসি নীরবের দৃষ্টিগোচর না হলেও নীরব ঠিকই টের পেলো। বলল ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে,

-” প্রত্যাশা দ্য কুইন অব কিউট রিভেঞ্জ।”

-” কী আশ্চর্য! ঘুমানো বাদ দিয়ে এত কথা কেনো বলছেন? ঘুমান তো।”

তন্মধ্যে ইচ্ছে নড়াচড়া করতে লাগল। নীরব প্রত্যুত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল।

__________

দু’দিন পর…

সন্ধ্যার পর সবাই ড্রয়িংরুমে বসে নাস্তা করছে। নীলা ফোন চাপছে মাঝেমাঝে মুখে পপকর্ন তুলছে। নিভান এসে পাশে বসতে বসতে বলল,

-” নীলাশা ঝালমুড়ি বানাও তো। অনেকদিন হলো ঝালমুড়ি খাই না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, এমন সন্ধ্যায় ঝালমুড়ি হলে মন্দ হয় না।”

নীলা একরাশ আলসেমি আর বিরক্তি মিশিয়ে বলল,

-” উফ্! আজকের মতো যা আছে, সেগুলোই খাও তো। এখন ঝালমুড়ি করলে সবাই ওটাই খাবে। তখন এতগুলো নাস্তা ওয়েস্ট হবে। কী আছে শুধু শুধু খাবার বাসি করার!”

আজন্মের আলসে আপু। পারবে না তা সরাসরি না বলে একটা অজুহাত দেখিয়ে দিল। প্রত্যাশা বিড়বিড় করে বলে সন্তর্পণে উঠে কিচেনে গেল। ছু•রি দিয়ে পেঁয়াজ কুচি করছিল। চায়ে চিনি কম হয়েছে জন্য আবির কিচেনে আসে চিনি নিতে। প্রত্যাশাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল,

-” নতুন ভাবি চিনির কৌটা কই?”

-” ওই যে।”

চামচে চিনি তুলতে তুলতে হঠাৎ মাথা উঁচু করে বলল আবির,

-” ব্যাড লাক আমার‌।”

প্রত্যাশা চমকে তাকাল,

-” ওমা! হঠাৎ ব্যাড লাক কেনো?”

আবির ভান করা আক্ষেপ নিয়ে মুখ টিপে হাসল,

-” ভাবির তো আর কোনো ছোট বোন নেই সেইজন্য। ধূর, ভাবির আরেকটা ছোট বোন থাকলে আমাকে আর এদিক-সেদিক গার্লফ্রেন্ড খুঁজে হয়রান হতে হয় না। ধরে নিতাম ছোটজন আমার জন্যেই বরাদ্দ। কী জমত বলো তো? তিন ভাই, তিন বোন , এক বাসা। জমজমাট ফ্যামিলি হতো না?”

প্রত্যাশা বিনিময় ঠোঁট টিপে হাসল। আবির চিনি মেশাতে মেশাতে ফাজলামির সুরে বলল,

-” ভাবির আপন বোন না থাক, তাতে কী! খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুপাতো যে কোনো এক কাজিন বোনকে দেখিয়ে দিলেও চলবে। কাজিন আছে না? একটা রেফার করো। দেবরকে তো একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে, না?”

-” তোমার বউ পাওয়ার দায় আমার ঘাড়ে কেনো পড়ল বলো তো?”

-” ভাবির কাজ তো শুধু নাস্তা বানিয়ে খাওয়ানো না। দেবরের প্রেমজীবনকেও তো একটু সাজিয়ে দেওয়া উচিত। কী বলো উচিত না?”

-” অফকোর্স উচিত, কেনো নয়? আমি তোমাকে একটা টাস্ক দিচ্ছি। তুমি যদি সেটা করতে পারো, তাহলে… তাহলে আমি আমার কোনো এক কাজিন-টাজিনের সাথে তোমার প্রেমের বন্দোবস্ত করে দিবো।”

-” কী করতে হবে ফাস্ট বলে ফেলো?”

-” এইযে পেঁয়াজ কুচি দেখছো না, এখান থেকে এক টুকরো পেঁয়াজ কপালের উপর পাঁচ মিনিট ধরে রাখবে। চোখ বন্ধ করা যাবে না। তবে পলক ফেলতে পারবে। এভাবে যদি ফাইভ মিনিটস রাখতে পারো, তাহলে আমি আমার কোনো এক সুন্দরী কাজিনকে রেফার করবো, প্রমিস।”

-” প্রাঙ্ক করছো?”

-” উঁহু! আ’ম সিরিয়াস। এখনই ভ’য় পেলে নাকি?”

-” এ আবার এমন কী, এক্ষুনি করে দেখাচ্ছি। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী।”

আবির মশা তাড়ানোর ভঙিতে গোল চাক করা একটুকরো পেঁয়াজ কপালের উপর রাখল। ভাব নিয়ে বলল,

-” নাও, কাউন্ট করো।”

প্রত্যাশা মুচকি হেসে কাঁচামরিচ কুচি করতে লাগলো। মিনিট খানেক হওয়ার আগেই আবিরের চোখ থেকে টপটপ অশ্রু ঝরতে লাগল। চোখে এত ঝাঁঝ লাগছে যা সহ্য করা সত্যিই কঠিন। ঝাঁঝের চোটে পানির নহর ছুটল চোখদুটোয়। চোখ বারবার বুঁজে আসতে চাইছে। একপর্যায়ে চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে গেল। মিনিট তিনেক হওয়ার আগেই আবির অতীষ্ঠ হয়ে এক ঝটকায় পেঁয়াজ ছুঁড়ে ফেলল। নাক টেনে বলল,

-” ও আম্মু গো, আমি শেষ।”

প্রত্যাশা হাসি আটকিয়ে দ্রুত বলল,

-” চোখেমুখে পানির ছিটা দাও।”

আবির কষে চোখ এঁটে রেখেছে। প্রত্যাশা নিজে আবিরের হাত ধরে বেসিনের সামনে নিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিল। আবির চোখে পানি নিতে লাগল। প্রত্যাশা দুইহাত বুকে ভাঁজ করে বলল,

-” সামান্য পেঁয়াজের ঝাঁঝ সইতে পারো না মিস্টার দেবর মশাই। আর বলো কী না ভাবির কাজিন নাই? দেবরের প্রেমের বয়স হয়নি, পেঁয়াজই দিলো তার প্রমাণ।”

আবিরের চোখদুটো লাল হয়ে গিয়েছে। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ ডলে বলল,

-” তুমি খুব মা’রাত্মক। জীবনে ছ্যাঁকা খেয়েও তো মনেহয় এতটা চোখের জল পড়বে না, আজ যতটা জল গড়ালো।”

চানাচুর বেশি করে দিয়ে সরিষার তেল দিয়ে ঝালমুড়ি মাখিয়ে ড্রয়িংরুমে যায় প্রত্যাশা। টি-টেবিলে নামিয়ে বলল,

-” মুড়ি খাও সবাই। খেতে ইচ্ছে হলো, তাই সবার জন্যেই বানালাম।”

নিভান হাতে তুলে মুখে চালান করে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” উফ্! তোমার সাথে দেখছি আমার ইচ্ছেটা মিলে গেল। ধন্যবাদ শালিকা__”

মুখ ফস্কে পুরনো ডাকটা বেরিয়ে গিয়েছে। নীহারিকা সামনেই ছিলেন, অদ্ভুত চাউনিতে নিভানের দিকে তাকাতেই তার হুঁশ ফিরল। এইরে সম্পর্ক যে একটি পলকে পাল্টে গেছে, সে হুঁশ রাখতে হবে না। ছোট ভাইয়ের বউকে তো আর এভাবে শালিকা বলা যায় না। কেমন লাগে। নিভান অপ্রতিভ্য ভঙিতে সংশোধন করতে তড়িঘড়ি বলল,

-” ধন্যবাদ প্রত্যাশা।”

প্রত্যাশা মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে বসল। কয়েক মূহুর্ত পর প্রত্যাশা ডায়নিংয়ে যায় পানি খেতে। প্রত্যাশার চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে পিছনে আটকানো ছিলো। পিঠের উপর খোঁচা খোঁচা বিঁধছে। গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়লেও এক ফোঁটা গরম কমেনি। ঘাড়ের উপর চুল ছড়িয়ে থাকায় গরম লাগছিল। প্রত্যাশা ক্লিপটা দুই ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে চুলগুলো মুড়াতে থাকে। অদূরে কারো একজনের দৃষ্টি থমকে গিয়েছে, কারো নজর যে এদিকেই আটকে আছে, চোখের পলক যে নামছে না। সে খেয়াল প্রত্যাশার আছে? উঁহু! নেই। নেই বলেই প্রত্যাশা এক ধ্যানে নিজের কাজ করতে ব্যস্ত। প্রত্যাশা চুল পেঁচিয়ে মাথার উপর উঁচু করে ধরে পরপর ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নেয়। অতঃপর মুখের সাইডে থাকা কাটা একগাছি চুল কানের পিঠে গুঁজে নেয়, ঠিক তক্ষুনি নীরবের সাথে চোখাচোখি হয়।

বুকের ভেতর একটা মাতাল করা হাওয়া বইয়ে গেল নীরবের। দৃশ্যটা তাকে সম্মোহিত করে। নীরবের চাউনি নিষ্পলক, প্রত্যাশা চোখ সরিয়ে নিল। নীরব চুলে ব্যাক ব্রাশ করে একহাত পকেটে গুঁজে পা চালালো। পিছুন থেকে নীহারিকা ডেকে উঠলেন,

-” নীরব, কোথায় যাচ্ছিস?”

-” কাজ আছে একটু।”

-” এখনো ভালো করে সুস্থ হলি না আর কাজ আছে বলছিস। কাজ সারাজীবনই থাকবে। পায়ের উপর স্ট্রেচ ফেলানো ঠিক হবে না। এক্ষুনি বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। আরো দু’টো দিন যাক।”

নীরবের কপালে বিরক্তির ছাঁট পড়ল। বলল অধৈর্য স্বরে,

-” মা, ঠিক আছি তো। এখন কোনো প্রবলেম নেই। আর কাল থেকে অফিসেও যাচ্ছি। টেনশন করো না, কিছুই হবে না। আ’ম ওকে।”

-” কিছু বললে তো শুনবি না। মা শুধুই প্যানপ্যান করে ভাববি। ছোট নোস যে আটকিয়ে রাখব। যা খুশি কর গে। আমি কিছু জানি না।”

নীরব বুঝিয়ে দু একটা কথা বলে যেতে নেয়। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ জোরেশোরে বলে উঠল,

-” আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। তোমরা খেয়ে নিও। অপেক্ষা করার দরকার নেই শুয়ে পড়ো। আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে।”

‘তোমরা’ বললেও প্রত্যাশা ঢের অনুমান করল, তাকে উদ্দেশ্য করে বলতেই জোরেজোরে বলা। নীহারিকা বললেন,

-” ছাতাটা নিয়ে যা বাবা।”

______________

প্রত্যাশার তীব্র মন খারাপ হচ্ছে। বইটা হাতে ধরে মুখভার করে আছে। আম্মু-আব্বুর উপর খুব অভিমান, অভিযোগ জমেছে— কালকের দিনের কথা আম্মু-আব্বু কী করে ভুলে গেলো? একবার ফোন করেও তো কিছুই বলল না। বিয়ে দিয়ে মেয়েকে একদম পর করে দিয়েছে।

ঘড়িতে এগারোটার ঘর পার। নীরব ফেরেনি এখনো। ভাবল– একবার কল করে খোঁজ নিবে কী না? পরক্ষনেই স্থির করল, আরেকটু দেখি।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফেরে নীরব। মেইন দরজা লক করে পা বাড়াতেই শর্মিলার গলা এল,

-” ভাবি এতক্ষণ তোর জন্য অপেক্ষা করে মাত্র রুমে গেল। নীরব খাবার বেড়ে দিবো?”

নীরব মুখে হাসি টেনে বলল,

-” না ছোট মা, ডিনার করতে একটু দেরি হবে।”

শর্মিলা জগ থেকে বোতলে পানি ঢেলে ক্যাপ আটকিয়ে নিলেন,

-” অপেক্ষা করব? তুই তো কখনো বেড়ে খাস না। ভাবিকে ডাকার দরকার নেই, আমি বরং এখানেই আছি।”

নীরব একটা বক্স শর্মিলার হাতে ধরিয়ে বলল,

-” এটা রেখে দিও। এটা সবার জন্যে। আর ছোট মা সমস্যা নেই, অপেক্ষা করতে হবে না। প্রত্যাশা খাবার রেডি করে দিবে।”

.
.

রুমে গিয়ে হাতের ব্যাগটা সোফায় নামিয়ে বিছানায় তাকাতেই এলোমেলো প্রত্যাশার দিকে নজর গেল। বইটা বালিশের উপর পরে আছে, ও নিশ্চিতে ঘুমে ডুবে। নীরব ফ্রেশ হয়ে এসে প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে দুই আঙুলে প্রত্যাশার কপালের উপর থাকা ছোটছোট চুল ঠেলে দেয়। প্রত্যাশা একটু নড়ে উঠল। টিশার্ট সরে পেট বেড়িয়ে আছে। নীরবের চোখ নিষিদ্ধ জায়গায় বিচরণ করল। শুকনো ঢোক গিলে সে প্রত্যাশার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

প্রত্যাশা আহ্লাদী ভঙিতে একটু নড়ল। তারপর মুখের উপর থাকা নীরবের হাতটা টেনে গলার সাথে ধরল। নীরবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। নিজেকে সামলে ফের ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

ঘুম জড়ানো গলায় চোখবুঁজেই বলল প্রত্যাশা,

-” ঘ-ঘুমাব।”

.
.

নীরব খাবার খাচ্ছে প্রত্যাশা সামনের চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। ওর যা রাগ হচ্ছে, এই লোক রাত বারোটায় ফিরে এখন ঘুম থেকে জাগিয়ে খাবার বেড়ে নিল। কেনো আজ একটু বেড়ে খেলে কী এমন হতো?

প্রত্যাশার ঘুম ছুটছেই না। নীরব একবার ঘড়ির দিকে তাকাল ফের প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” রুমে সোফার উপর দ্যাখো একটা প্যাকেট আছে। সেখানে একটা ড্রেস আছে, যাও ফাইভ মিনিটসের মধ্যে পরে নাও।”

-” কীহ? এতরাতে আমি ড্রেস পাল্টাব, কেনো?”

-” উত্তর পরে, আগে যা বলছি সেটাই করো।”

-” পারব না, এখন আমি ঘুমাবো। ঘুমে চোখে দেখছি না।”

নীরব হতাশ শ্বাস ফেলে উঠে হাত ধুয়ে টাওয়েল দিয়ে মুছে নিল। প্রত্যাশা খাবার কোনো রকমে ঢেকে রুমে গিয়ে বিছানায় উঠতে নিবে, তার আগেই নীরব ওর হাত ধরে টেনে নিল। রাগি স্বরে বলল,

-” ড্রেস পড়তে বললাম, শুনলে না?”

-” কী আশ্চর্য! মাথা-টাথা গেছে আপনার? এতরাতে__”

ঘড়িতে বারোটা দশ বাজে। নীরব বিরক্ত শ্বাস ফেলে বলল,

-” ব্যালকনিতে আসো, দরকার আছে। এবারে দ্বিতীয় কথা যেনো বলতে না হয়।”

দরজা ঠেলে ব্যালকনিতে পা রাখে নীরব। প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে পিছুপিছু গেল। ব‌্যালকনিতে পা রাখতেই প্রত্যাশার চোখ ছানাবড়া। নীরব একেএকে ক্যান্ডেলগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। টেবিলের উপরে ছোট্ট গোল একটি চকোলেট কেক, উপরিভাগ চকোলেট গ্লেজে চকচক করছে। কেকের মাঝে লালচে ক্যান্ডি হার্ট বসানো। কেকের উপর ইংরেজি ফন্টে গোলাপি আইসিংয়ে লেখা,

“Happy Birthday My Misses”

চারপাশের ক্যান্ডেলের আলোয় কেকটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রত্যাশা আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল,

-” নীরব আপনি কী করে জানলেন?”

-” সিক্রেট।”

নীরব একটা বেলুন দুই হাতে ধরল, যেখানে লেখা—‘Sorry’ নীরবের পা•গ•লামী দেখে প্রত্যাশা হেসে ফেলল। নীরব তাড়া দিল কেক কা’টতে। প্রত্যাশা কেক কে’টে নীরবের মুখের সামনে ধরল। হাতটা ধরে ঘুরিয়ে প্রত্যাশার মুখেই কেকের টুকরো ধরল নীরব। ইশারায় হা করতে বলে। প্রত্যাশা হা করে মুখে নিতে নেয়, সেই সময় নীরব আরেকপাশ থেকে ছোট্ট করে বাইট দেয়। দু’জনের নাকে নাক ছুঁইয়ে যায়।

নীরব টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে প্রত্যাশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। প্রত্যাশা অবাক হয়, প্রত্যাশার অবাক আরেক দফা বাড়ে; যখন নীরব প্রত্যাশার পায়ের দিকে হাত বাড়ায়। প্রত্যাশা এক ঝটকায় দু’পা পিছাল। চেঁচিয়ে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ! পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো? জান মাফ-সাফ করে দিয়েছি। তাও এভাবে, প্লীজ না।”

মূহুর্তেই নীরবের মেজাজ চটল। একে নিয়ে চলা মোটেই সহজ নয়। ক্ষণে ক্ষণে এ জ্বালিয়েই মা’র’বে। কবে যে এর বোধবুদ্ধি হবে। নীরবের মুখের অভিব্যক্তি দেখে প্রত্যাশা ভীতু স্বরে বলল,

-” ভুলভাল বললে স্যরি।”

-” আল্লাহর ওয়াস্তে মুখটা একটু বন্ধ রাখবে, তাতেই চলবে।”

প্রত্যাশা বাধ্য মেয়ের মতন মাথা নাড়াল। প্রত্যাশার পা-টা হাঁটুর উপর তুলে নিয়ে নীরব জিন্সের পকেট থেকে পায়েল বের করে পড়িয়ে দিল। আলতো ছোঁয়ায় প্রত্যাশার শরীরে ভূমিকম্প বয়ে যায়। নীরব উঠে দাঁড়াল। ঠোঁটে হাসি টেনে হিম শীতল গলায় বলল,

-” আঠারো বসন্তের শুভেচ্ছা, মাই মিসেস। তোমার চোখের হাসিতে আমার দিন শুরু হোক, আর তোমার ঠোঁটের অভিমানে রাত থেমে যাক। আমার সবটুকু সুখ, সবটুকু প্রার্থনা, আজ থেকে কেবল তোমার হোক। তোমার জীবনজুড়ে যত রং থাকবে, তা আমার ভালোবাসা থেকে আসুক। শুভ জন্মদিন, আমার হৃদয়ের বোকারানি।”

প্রত্যাশার চোখেমুখে স্ফূর্ত হাসি ফুটল। বলল চঞ্চল কণ্ঠে,

-” শুকরিয়া… শুকরিয়া আমার এএসপি সাহেব।”

‘আমার এএসপি সাহেব’ কথাটা নীরবের কানে বাজতে থাকল। এক ঝটকায় প্রত্যাশাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে নীরব। প্রত্যাশা বুকে মুখ গুঁজল। কিছু সময় দু’জনের মাঝে নীরবতা চলল। প্রত্যাশা নীরবতার সুতো ছিঁড়ে আফসোসের সুরে বলল,

-” জানেন, আম্মু বলে আমি পূর্ণিমার রাতে জন্মে ছিলাম। আজ পূর্ণিমা না, অমাবস্যাও না। তবে আকাশে মেঘ থাকায় চাঁদ ঢেকে আছে। চাঁদ থাকলে বেশি ভালো হতো। মাঝরাতে চাঁদের আলোয় কেক কাটার জমাই আলাদা হতো।”

নীরব সোজা হয়ে দুইহাত পকেটে গুঁজে দাঁড়াল,

-” আকাশের চাঁদ মেঘে ঢেকেছে তাতে কী? জমিনের চাঁদ তো পাশেই আছে।”

কথাটা বুঝতে প্রত্যাশার কয়েক সেকেন্ড লাগে। আর বুঝতেই লজ্জা পেল। প্রত্যাশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীরব আচমকা প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

-” ইউ আর মাই মিডনাইট মুন।”

প্রত্যাশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। প্রত্যাশার লজ্জা দূর করতে নীরব ঘুমানোর কথা বলে তাড়া দিল।

____________

ভোরের নরম আলো গাছের পাতার ফাঁক গলে ব্যালকনিতে আসছে। চারিপাশে পাখিদের কিচিরমিচির। আলস্য ভঙিতে ঘুম ভেঙে ব্রাশ হাতে ব্যালকনিতে আসে প্রত্যাশা। মুখে ব্রাশ নিয়ে ব্যালকনির দোরগোড়ায় পা রাখতেই নীরবকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল,

-” গুড মর্নিং।”

-” গুড মর্নিং।”

প্রত্যাশা এগিয়ে পাশে দাঁড়াতেই নীরব কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যাশা সেই নজর পড়ে নিল। আর নিলো বলেই বলল তড়িঘড়ি করে,

-” কী দেখছেন ওভাবে? শুনুন ভুল একবারই হয়, বারবার নয়। একবার ভুল করে আপনার ব্রাশ নিয়েছিলাম বলে যে আবারো অমন করব। সেটা ভাবলে সে গুড়ে বালি। কথায় আছে না ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। এখন আমি সিরিয়াস। ভুলটুল করে আপনাকে অযথা কথা শোনানোর সুযোগ দিচ্ছি না।”

ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে সটান দাড়িয়ে নীরব। একটু আগেই উঠেছে সে। নীরব ভেতরে ভেতরে মুচকি হাসল। তবে বলল নির্লিপ্ত ভঙিতে,

-” ভেরি গুড।”

হঠাৎ প্রত্যাশার নজর গেল ব্যালকনির ভেন্টিলেটরে। তুরন্ত গালের ফেনা গ্রিল দিয়ে থুথু করে ফেলল। একহাত উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল,

-” ভেন্টিলেটরের মধ্যে খড়কুটো! পাখির বাসা দেখছি। ডিম-টিম আছে বুঝি? পাখির বাচ্চা আছে?”

-” তুমিও যেখানে আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে। তাই উত্তর আমারো অজানা।”

মাথা উঁচিয়ে ওদিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” একবার চেক করে দেখি?”

-” দ্যাখো।”

প্রত্যাশা ত্রস্ত রুমে এসে কুলি করে, মুখে পানির ছিটা দিয়ে টুল নিয়ে ব্যালকনিতে ছুটল। টুলের উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে নীরবকে জিজ্ঞেস করল,

-” টুল আনতে গিয়ে দেখলাম রাতের ওষুধটা ওখানেই আছে। খাননি তো। আমি না রেখে বারবার বললাম খেয়ে নিবেন। আপনি তো বললেন পরে খাবেন। সে পরে আর আসেনি।”

-” ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

-” ওহ্।”

বলে আবার কিছু মনে হতেই ব্যগ্র কণ্ঠে বলল প্রত্যাশা,

-” আচ্ছা এখন নাস্তা করে খেয়ে নিয়েন। ওষুধ তো আর বুঝবে না কোনটা রাত আর দিন! আজ রাতে একটু দেরি করে খাবেন। তাহলেই চলবে।”

টুলের উপর দাঁড়িয়ে হাত দু’টো উঁচু করে গ্রিল ধরে মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করে পাখির ডিম আছে কী না! প্রত্যাশার টিশার্ট উঠে যায়, মসৃন পেট বেরোয়। নীরবের দৃষ্টি মুহূর্তেই নিষিদ্ধ জায়গায় পরে। প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,

-” কতদিন আগে থেকে এখানে বাসা?”

নীরব না শোনার মতো করে বলল,

-” হুঁ।”

প্রত্যাশা বিরক্ত মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে,

-” শুনেননি? কী ভাবছেন যে__”

নীরবের দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টিতে ঘোর লেগে আছে। প্রত্যাশার হুঁশ হলো। দ্রুত হাত নামিয়ে টিশার্ট টেনেটুনে নামাতে ব্যস্ত হয়। রাগ দেখিয়ে বলল,

-” নীরব এভাবে এদিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?

নীরব মুচকি হেসে মাথা চুলকিয়ে বলল,

-” কই কিছুই তো দেখিনি। কেনো তুমি কী কিছু দেখাতে চাও?”

প্রত্যাশা টেনে বলল,

-” নী…র..ব।”

নীরব হেসে দোলনায় বসল। ফোন বের করে স্ক্রল করতে থাকে। প্রত্যাশা সেটা দেখে আবার পাখির বাসার দিকে মনোনিবেশ করল। অল্পের জন্য ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না, ওইযে খড়কুটোর ভেতর মনে হচ্ছে সাদা সাদা ছোট্ট ডিম আছে, যা প্রত্যাশার কৌতুহল দ্বিগুন করল। ও দেখার জন্য ছাদের কার্নিশে দুইহাত রাখল। মাথা উঁচিয়ে চেষ্টা করল, হঠাৎ কী মনে করে নীরবের দিকে তাকাল। না নীরব এদিকে তাকিয়ে নেই, উনি ফোনে ডুবে আছে। তারপর প্রত্যাশার নিউরনে অদ্ভুত চিন্তার উদয় হলো। আর হলো জন্যই ঝটিকায় নেমে নীরবের সামনে আসে। একহাত কোমড়ে রেখে অন্যহাতে নীরবের ফোনটা কেড়ে নিলো। তারপর যেটা ভেবেছিল সেটা ভুল দেখে একটু লজ্জা পেল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন নীরব মুচকি হেসে বলল,

-” তুমি ভেবেছিলে আমি ক্যামেরা অন করেছি, তোমার মসৃন পেট, পিঠের দৃশ্য ফোনের মেমোরিতে রাখছি?”

প্রত্যাশা সবেগে মাথা নাড়ল। না বোধক বুঝাল। নীরব অফার করল,

-” দেখতে পাচ্ছো না তো, আমি হেল্প করবো?”

-” হেল্প করবেন? কীভাবে?”

উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল প্রত্যাশা। নীরব বলল নির্বিকার ভাবে,

-” কোলে তুলে ধরে।”

প্রত্যাশার উচ্ছ্বাস দপ করে নিভে গেলো। না করে ভাব দেখিয়ে বলে— লাগবে না, সে একাই পারবে। টুলের উপর আঙুলে ভর দিয়ে সর্বোচ্চ উঁচু হয়ে চেষ্টা করতেই সফল হয় প্রত্যাশা। তবে আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই টুল নড়ছিলো। আচমকা ব‌্যালেন্স হারিয়ে ধপাস করে পড়ল মেঝেতে। কোমড়ে হাত দিয়ে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। নীরবের ভাবাবেগ হয় না, ও তখনও নির্লিপ্ত বসে। প্রত্যাশা মুখটা কাঁদো কাঁদো করে হাত বাড়িয়ে বলল,

-” বসে হা করে কী দেখছেন? আমার খুব লেগেছে, তুলুন আমায়।”

নীরব হাতটা বাড়াল। প্রত্যাশা হাতটা আরেকটু বাড়িয়ে নীরবের হাত ধরবে, সেইসময় নীরব হাত টান মে*রে সরিয়ে নেয়। প্রত্যাশা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। পরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীরব প্রত্যাশাকে কোলে তুলে নেয়। প্রত্যাশা হইহই করে উঠল,

-” সে কী, নামান। আপনার পায়ের ব্যথা।”

নীরব রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,

-” সেইজন্য তো বারবার সিডিউস করে মাথা খারাপ করে দেওয়ার পরেও ছাড় পাচ্ছো।

-” মোটেই সিডিউস করিনি।”

-” তাই?

-” হুঁ।”

প্রত্যাশাকে আলগোছে বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রত্যাশা উঠে বসতে গেলে নীরব আঁটকে দেয়। প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকল। নীরবের চোখের ভাষা অন্যরকম ঠেকছে। প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলল। মুখ খুলে কিছু বলবে,

-” নী__”

নীরব তর্জনী রাখল প্রত্যাশার ঠোঁটে। বলল আস্তে করে,

-” চুপ।”

প্রত্যাশার দিকে আরেকটু ঝুঁকল। খুব কাছাকাছি। প্রত্যাশার হার্টবিট লাগামহীন ছুটছে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। নীরব সম্মোহিত চাউনিতে চেয়ে প্রত্যাশার কপালে চুমু খেলো। প্রত্যাশা চোখ বুজে নিলো। নীরবের হাত প্রত্যাশার নরম তুলতুলে পেট স্পর্শ করে। প্রত্যাশা কেঁপে ওঠে পেটের উপর টিশার্ট টেনে দেওয়ার চেষ্টা করল। নীরব ফিসফিসিয়ে বলল,

-” টিশার্টটা তো একা একাই তোমার গায়ে থাকতে চাইছে না। অকারনে স্থানচ্যুত হচ্ছে, এত ঝামেলার চেয়ে আমি বরং একে একেবারেই তোমার গা থেকে সরিয়ে দিই। দিই?”

প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বলতে চাইল— উঁহু। জোরেজোরে শ্বাস ফেলে চোখদুটো বুজেই বলল,

-” নীরব আপনি খুব লজ্জা দেন।”

-” তোমাকে লজ্জা দেওয়া আমার অধিকার। হ্যাজবেন্ডের লাইসেন্সে তোমাকে লজ্জা দেওয়া–নেওয়ার ছাড়পত্র আমার আগেই মঞ্জুর।”

প্রত্যাশা চোখ খিচে বুঁজে নিল। দম আটকে আসছে। কম্পিত স্বরে বলল,

-” নীরব স-সরুন।”

নীরব স্মিত হাসল। মুখটা প্রত্যাশার খুব কাছাকাছি এনে ওর ঠোঁটের কিনারায় দৃষ্টি রেখে বলল খুব আস্তে,

-” দু’দিন পরেই তোমার পরীক্ষা। এখন তোমাকে একটুও দুর্বল করতে চাই না। সত্যি বলছি, তোমার কাঁপা কাঁপা আদুরে ঠোঁটজোড়া; এতটা টানছে যে নিজেকে কন্ট্রোল করাটা কঠিন। তবুও, আজ শুধু; জাস্ট ওয়ান ডিপ কিস। ওনলি ওয়ান আই প্রমিস।”

কোনো কিছু ঠাওর করার আগেই নিঃশ্বাস আটকে এল প্রত্যাশার।

# চলবে