#মধ্য_রাতের_চাঁদ |অন্তিম শেষাংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
সেদিন সন্ধ্যায় বাবা-চাচ্চু আর ছোটভাইয়ের সাথে বসে বলে নিভান— নীবিড়ের নামে একটা এতিমখানা করবে। ওর এই সিদ্ধান্তে দ্বিরুক্তি না করে সবাই সহমত পোষণ করে। মাহবুব সাহেব ছেলের এমন মহৎ উদ্যোগে মুগ্ধ হোন। উনি নিজ থেকেই যতটুকু পারেন ততটুকু দিয়ে পাশে দাঁড়াতে চান। ইচ্ছের অংশটা রেখে নীরবের সম্মতিক্রমে নীরবেরটাসহ তার কাছে গচ্ছিত সবটুকু অর্থ নিভানের হাতে তুলে দেন। এতবড় একটা কাজে কম তো আর খরচাপাতি হবে না। সিংহভাগই নিভান বহন করে। নীরব ছোটো চাচ্চুও সাপোর্ট করেন। এবং এ-ও বলে— তারাও প্রতিমাসে যতটুকু পারে দিয়ে পাশে থাকবে।
খুব বড় পরিসরে না হলেও ছোট পরিসরে একটা সুন্দর এতিমখানা গড়ে তোলা হয়। কিছু এতিম শিশুর থাকা-খাওয়া, দেখাশোনাসহ দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা যেন ভালো মানুষ হয়ে বড় হতে পারে। নিভান সবকিছু আন্তরিকতার সাথে দেখাশোনা করছে।
.
.
কোল থেকে নামালেই দুই ভাই হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাসা দাপিয়ে বেড়ায়। তবে নীড় একটু বেশি চঞ্চল। নিভ্র বরং শান্ত স্বভাবের। দেখতে দুজন একেবারে হুবহু না হলেও জমজ বলেই বোঝা যায়। নীড় যেন নীরবের কার্বন কপি, ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। আর নিভ্রটা লালচে ফর্সা, মায়াভরা মুখ, গোলগাল গড়ন। প্রত্যাশার দিকটা একটু বেশি পেয়েছে নিভ্র। প্রত্যাশার ভাষ্যমতে— নীড় এত লাফঝাঁপ করে, এক দন্ড স্থির থাকে না। তাই খাওয়ালেও শরীরে লাগছে না, সেইজন্য শুকনো। নিভ্রটা লক্ষ্মী, স্থির থাকে বলেই একটু গোলুমুলু।
প্রত্যাশার দ্বিতীয় বর্ষের টেস্ট পরীক্ষা কাল থেকে শুরু। সময়টা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বিছানায় বসে বই নিয়ে পড়ছিলো প্রত্যাশা। নীড়ের সামনে খেলনার স্তুপ। কিন্তু সেদিকে তার একটুও মন নেই। বারবার হামাগুড়ি দিয়ে প্রত্যাশার কাছে আসে, বই টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। কখনো বইয়ের পাতা টানছে, কখনো মায়ের হাত ধরে টানাটানি। একসময় বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বলল প্রত্যাশা,
-” নীড়!”
একটু জোরে বলায় নীড় আহ্লাদে ঠোঁট ফোলাল। প্রত্যাশা বইটা ওর সামনে ধরে বলল,
-” পড়বে তুমি? নাও আমার পড়া তুমি পড়ে দাও। উফ! তুমি একেবারে দুষ্টু ছেলে। একটুও স্থির থাকতে পারো না।”
নীড় দুই হাত বাড়িয়ে বইটা খাবলে ধরতে চাইল। প্রত্যাশা এক টান মেরে বইটা সরিয়ে নিতেই নীড় শব্দ করে কেঁদে উঠল। ছেলেকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল প্রত্যাশা,
-” খেলনার পাহাড় করে দিয়েছি, তবু তোমার চোখ পড়েছে এই বইটাতেই। আর না দিলেই গলা ফাটিয়ে কান্না করা।”
নীড়ের কান্নার শব্দ বাড়ল। প্রত্যাশা তড়িৎ ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে রাখল। পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
-” ও ও ও কাঁদে না। মাম্মা আর বকবে না সোনা। চুপ করো এখন।”
কান্নার বেগ থামিয়ে নীড় নিজের ভাষায় কিছু একটা বলতে বলতে চেঁচিয়ে উঠল,
-” দা দা দা, গ্যা।”
দুজনের মুখেই আধো আধো বুলি ফুটতে শুরু করেছে। দাদা, আব্বা, মা, বাবা কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট আওড়ায়।
নীরবের উপরে রাগ হচ্ছে প্রত্যাশার। এখনো আসছে না জন্য। নিভ্র আবার বাইরে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। তাকে কোলে নিয়ে বাইরে ঘোরো কোনো শব্দ নেই। সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে বাইরে নিভান নিয়ে যায় তাকে।
নীড়কে সামলে পড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শেষমেশ হাল ছেড়ে প্রত্যাশা বলল,
-” চলো, তোমাকে দাদুর কাছে দিয়ে আসি।”
.
নীহারিকা বিছানায় শুয়ে ছিলেন। মাথাটা হালকা যন্ত্রণা করছে। প্রত্যাশা ছেলেকে কোলে নিয়ে তার ঘরে ঢুকতেই বলল,
-” মা আছেন?”
-” হুঁ, আসো।”
-” বাবা এখনো আসেনি?”
-” না, সে তো এশার নামাজ পড়ে আসে। খুব কমই এই সময় আসে। শরীর খারাপ থাকলে তবেই তাকে এই সময় রুমে পাওয়া যায়।”
প্রত্যাশা বলল,
-” আপু ইচ্ছেকে পড়াচ্ছে। ছোটো মা আনিশাকে। সবাই ব্যস্ত। কাল আমার পরীক্ষা, আর এদিকে আপনার ছোটো ছেলে এখনো ফিরল না। একটুও পড়া হচ্ছে না এই বাচ্চাদের নিয়ে। বই সামনে ধরলেই হামলে পড়ছে। নিভ্রকে তাও জিজু নিয়েছে।”
নীহারিকা উঠে বসে বললেন,
-” ছোট দাদুভাইকে আমার কাছে দিয়ে যাও।”
বিছানায় নামিয়ে দিতেই নীড় কলকলিয়ে হেসে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে গেল ওপাশে। প্রত্যাশা কোমরে একটা হাত রেখে বলল,
-” এরসাথে একা পারবেন আপনি? এতো আপনাকে খাটিয়ে মা*রবে। বাবা থাকলে তবুও।”
নীহারিকা হেসে বললেন,
-” অতটাও বুড়ি হইনি যে তোমার ছেলের সাথে পারব না।”
বলেই নীড়কে কোলে তুলে নিলেন। ছোট্ট মুখে চুমু খেয়ে আদর করে বললেন,
-” আমার দাদুভাই লক্ষী হয়ে থাকবে। তুমি নিশ্চিন্তে পড় গিয়ে। দাদুভাইয়ের সাথে আমি খেলব। ছোটো দাদু ভাই চলো তোমাকে গল্প শোনাই।”
নীড় দুইটা আঙুল মুখে দিয়ে শব্দ করল,
-” ব্রু..ভু।”
প্রত্যাশা হেসে বেরিয়ে গেল। নীড় সারা বিছানা ছুটাছুটি করছে। নীরব-নীবিড় সেইম দেখতে ছিলো। তাই নীড়কে দেখলেই নীবিড়ের মুখটা ভাসে। নীহারিকার দু’চোখ ছলছল করে উঠল। এদের দুজনকে দেখলেই তার জমজ ছেলেদের পুরনো স্মৃতি উঁকি দেয়। তখন মায়ের মনটা হুহু করে কেঁদে ওঠে।
.
রাত নয়টা তিন বাজে। নীরব মাত্র ফিরল। ফিরেই ছেলেদের কথা জিজ্ঞেস করে। যদিও জানে কোথায় থাকতে পারে। প্রত্যাশা এক চোট ঝারি মে*রে বলে। তারপর বইটা রেখে ছেলেদের আনতে যায়। শাশুড়ির রুমে গিয়ে শুনল —– নীলাশা নিয়েছে।
নীলাশার রুমের দোরগোড়ায় দাঁড়াতেই নীড়ের খিলখিল হাসির শব্দ আসল।
-” এদের ঘুমানো লাগবে না। এখনো জেগেই আছে।”
ভেতরে এগিয়ে যেতে যেতে বলল প্রত্যাশা। রুমের মাঝে থাকা মখমলের কার্পেটের উপর খেলনা গাড়ি এটাসেটা ছড়ানো। নীলাশা নীড়ের সাথে খেলছে। নীলাশা মুখের সামনে কুশন ধরে আড়াল করছে, আবার মুখটা বের করতেই নীড় খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। প্রত্যাশার কথা শুনে নীলাশা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” নিভ্র ঘুমিয়ে পরেছে।”
বিছানায় চোখ পড়তেই দেখল প্রত্যাশা— নিভানের বুকের উপর লেপ্টে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে নিভ্র। ছোট্ট হাতে নিভানের গলা জড়িয়ে রেখেছে। প্রত্যাশা বলল,
-” ঘুমিয়ে পড়েছে, ওকে খাওয়ানো হয়েছে আপু?”
-” ফিডার বানিয়ে খাইয়েছি। তার আগে ডিম সেদ্ধ খাইয়েছিলাম। নীড় ডিমের হাফ খেয়েছে।”
নীলাশা উঠে দাঁড়িয়ে নীড়কে প্রত্যাশার কোলে দিয়ে বলল,
-” ছোটো বাবাটা যাও ঘুমিয়ে পড়।”
তারপর প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” নিভ্রকে আমি দিয়ে আসছি। দেখ কান্ড নিভ্রকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিভানটাও ওর সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে।”
প্রত্যাশা হেসে বলল,
-” জিজুকে কী বলব! এদেরকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আমি নিজেই ঘুমিয়ে পড়ি, অথচ মাঝেমাঝে দেখি এরা জেগেই আছে।’
নীলাশা ঘুমন্ত নিভ্রকে তুলতে যাবে তখন প্রত্যাশা বলল,
-” থাক আপু। ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমাদের কাছেই রাখো।”
নীলাশা আর কিছু বলল না। প্রত্যাশা নীড়কে কোলে নিয়ে রুমে গেল। বাচ্চাদের সাত মাস বয়সে প্রত্যাশা অসুস্থ হয়। সে কী জ্বর। এক সপ্তাহ বিছানায় ছিলো। সেইসময় বাসার সবাই তো আছেই নীলাশার অবদানও কম নয়। সারাদিন সবাই রাখলেও, প্রত্যাশা অসুস্থ রাতে দু’টো বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবে? নীরব ছেলে মানুষ, মেয়েদের মতো করে বাচ্চাদের দেখভাল করতে পারে নাকি। সেইসময় প্রত্যাশা নিজেই নিভ্রকে নীলাশার কাছে রাতে দিতো। নীড়টা আবার ছোট থেকেই ফিডার খেতে চায় না। জোর করে মুখে দিলেও জিভ দিয়ে ঠেলে বের করে দিতো। নিভান-নীলাশা দুজনেই বাচ্চা দুটোকে অনেক আদর করে। নিভান বেশি বাইরে নিয়ে যায় জন্য প্রত্যাশার কোলে থাকলেও নিভানকে দেখলে তার কোলে যেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিভ্র।
___________
জেলের স্যাঁতসেঁতে চার দেয়ালের ভেতর নিস্তব্ধ অন্ধকারে দুইহাতে হাঁটু জড়িয়ে বসে প্রীতি। মুখ লুকিয়েছে হাঁটুর ভাঁজে। চারপাশে শুধু নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গতা। চোখের কোণ বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল। দু’মাস খানেক আগে মায়ের ফাঁ*সি হয়েছে। প্রীতির মনে হয়, তাকেও ফাঁ*সিতে ঝুলিয়ে দিলে ভালো হতো। অন্তত এই জীবন্ত মৃ*ত্যুর যন্ত্রণা তাকে ছুঁতে পারত না। সে যে বেঁচে থেকেও ম*রে আছে।
অহংকার, জিদ, দম্ভ সব এখন ভস্মে পরিণত। বেপরোয়া রাগ-জিদ, আকাশচুম্বী অহম যে জীবনটাকে তুচ্ছ করে ফেলেছিল। আজ সেই জীবনই তার কাছে বি’ষে’র মতো তেতো ঠেকছে। সারাক্ষণ অদৃশ্য হতে চিৎকার করে বলে; কারো নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে পায়ে মাড়িয়ে বেঈমানি করার ফল। তার পবিত্র ভালবাসার মূল্য না দিয়ে ঠকিয়ে নিজেই নিজের অভিশাপ ডেকে এনেছিস তুই। এসব তুই ডিজার্ভ করিস।
আফসোস, আফসোস আর শুধুই আফসোস, সাথে এক সমুদ্র অপরাধবোধ প্রীতিকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সব শেষ করে এখন মনে হচ্ছে, জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নেয়া যেতো। জীবনের এই ক্ষতিপূরণ করা আর যে সম্ভব নয়। মেয়েটার কথা ক্ষণেক্ষণেই মনে পরে। বাচ্চা মেয়েটার ওই আদুরে মুখটা চোখের তারায় ভাসে। বুকের সাথে চেপে ধরতে বুকটা হাহাকার করে। তবুও মনকে বুঝ দেয়। শুধু একটাই প্রার্থনা; মেয়েটা ভালো থাকুক। তার পাপের ছায়া ওর উপর আর না পড়ুক। নীবিড়! এই একটা মানুষের নাম মনে উঠলেই নিজেই নিজেকে ধিক্কার ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করে— বড্ড অন্যায় করা হয়েছে তার সাথে। ইশশ্! যদি স্ট্যান্ড ইন হিসেবে নিয়েও আরেকটু মানিয়ে নেয়া যেতো। মন থেকে তার ভালোবাসাটুকু গ্রহণ করা যেতো, তাহলে জীবনের কাহিনীটা আজ অন্যরকম হতো। একটা সুন্দর জীবন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে গোটা জিন্দেগি পার করা যেতো। এই চার দেয়ালের ভেতর সময় গলে যাবে ধীরে ধীরে। মুক্তি ঠিকই একদিন আসবে। কিন্তু পাপের ভারে প্রতিটা নিশ্বাস দগ্ধ হবে। প্রতিটা মুহূর্তে শূন্যতার প্রতিধ্বনি বাজবে মনে। অপরাধে, অনুশোচনায় ফুঁপিয়ে উঠল প্রীতি। ঠোঁট দুটো কাঁপল, অস্ফুটে আওড়ালো,
-” বাকিটা জীবন এই আফসোসেই কাটবে, ইচ্ছে করেই সব হারিয়েছি। সব খুইয়ে আজ নিজেই নিজের কাছে পরাজিত। জীবনের গল্পে শুধুই শুণ্যতার অনুরণন। আমি যে শুণ্যতায় পরিপূর্ণ।”
___________
সকালের নরম মিঠে রোদ জানালার শুভ্র রঙা পর্দা গলিয়ে রুমে প্রবেশ করছে। সোনালী রোদের রেখা সার্থকের চোখের উপর পড়তেই ঘুমে বিঘ্ন ঘটে। ঘুমঘুম চোখেই একটা কুশন টেনে মুখের এক পাশে দিয়ে বালিশে মাথাটা গুঁজল সে।
অদ্রিকা রুমের মাঝ বরাবর চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পরনে শুভ্র রঙের লেডিস টিশার্ট আর ছাই রঙের ঢিলেঢালা প্লাজো। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। বাতাসে শর্ট হেয়ারগুলো মুখের উপর উড়ছে। অদ্রিকা একবার নিজের কাঁপা হাতে তাকায়, আবার চোখ চলে যায় সার্থকের দিকে। তারপর আবার হাতের তালুতে থাকা ছোট্ট বস্তুটায় চায়। মুহুর্তেই দুচোখ ছলছল করে উঠল আনন্দে। বুকের ভিতর হাজারটা ব্যাখ্যাতীত আবেগ একসাথে ধেয়ে আসছে ওর। ভেতর থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল,
-” আলহামদুলিল্লাহ।”
তন্মধ্যে সার্থকের গলা শুনে মেয়েটা হকচকাল। রুমে পড়ার স্যান্ডেলে পা গলাতে গলাতে চোখে খানিক কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” অদ্রি, কী এমন মনোযোগ দিয়ে দেখছো? হাতের মধ্যে কী ওটা?”
অদ্রিকা তড়িঘড়ি করে হাতটা পেছনে নিয়ে ফেলে। আমতা আমতা করে বলে,
-” ক-কই, কিছু না তো।”
সার্থক ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে আসতে আসতে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
-” কিছু না, তো হাতটা পেছনে লুকালে কেনো? স্ট্রেইঞ্জ!”
অদ্রিকা ঠোঁটজোড়া জিভের ডগায় ভিজিয়ে নিয়ে কিছু বলবে, তার আগেই সার্থক বলল,
-” বাচ্চাদের মতো বিহেভিয়ার করছো কেনো? আচ্ছা, জোর করব না। না চাইলে বলবে না।”
মুখে আলতো হাসি টেনে সার্থক পা বাড়ায়। ঠিক তক্ষুনি অদ্রিকা মৃদু গলায় ডাকল,
-” সার্থ?”
-” হুঁ।”
সার্থক ঘুরে সামনাসামনি দাঁড়াল। অদ্রিকা হাতটা সার্থকের সামনে মেলে ধরল। আর ধরতেই সার্থকের চাহনি থমকালো। পরপর ক-বার চোখের পলক নাড়াল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুপল চেয়ে রইল। অদ্রিকার হাতের তালুতে প্রেগন্যান্সি কিট। কিটটায় দু’টো রঙিন দাগ জ্বলজ্বল করছে। সার্থকের হৃদস্পন্দন এক মূহুর্তের জন্য থেমে গেল। বিস্ময়ে চোখদুটো বড়বড় করে কেমন কম্পিত গলায় বলে উঠল,
-” আ-আমি বাবা হচ্ছি?”
অদ্রিকা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে লাজুক হাসি ফুটল। সার্থক এক ঝটকায় অদ্রিকার কোমর টেনে কাছে আনল। ঠোঁটের কোণে অপার্থিব তৃপ্তির হাসি টেনে বলল,
-” থ্যাংকিউ অদ্রি, থ্যাংকস আ লট। বাট এত বড় আনন্দের খবর লুকাচ্ছিলে কেনো?”
সার্থকের টিশার্টের কলার দুহাতে ঠিক করার মতো করল অদ্রিকা। মিষ্টি হেসে বলল,
-” ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। একটু প্রিপারেশন নিয়ে। ধূর! তার আগেই।”
-” আমি এমনিতেই সারপ্রাইজড অদ্রি।”
অদ্রিকা মুখ তুলে তাকাল। গলায় প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলল,
-” সত্যি তুমি খুশি?”
-” আমার নিজের অস্তিত্ব আসতে যাচ্ছে আমি খুশি হবো না।”
দুচোখে অদ্ভুত আলো নিয়ে অদ্রিকার চোখের দিকে তাকাল সার্থক। হিম শীতল কণ্ঠস্বরে বলে গেল,
-” তুমি কল্পনাও করতে পারবে না অদ্রি, এই অনুভূতিটা কতটা অসাধারণ! আমি বাবা হতে যাচ্ছি! আই কান্ট বিলিভ ইট। একটা নতুন জীবন আসতে যাচ্ছে। আমার ব্লাড, আমার জান, আমার সব হবে ছোট্ট প্রাণটা।”
অদ্রিকার টিশার্টের ভেতর হাত গলিয়ে নরম তুলতুলে উদরে আলতো স্পর্শ করল সার্থক। লহমায় অদ্রিকার সমস্ত কায়া শিরশিরানি দিয়ে উঠে কোমল ছোঁয়ায় । চোখ খিচ মে*রে বুঁজে নিল অদ্রিকা। সার্থক ফের বলল একদম নরম কোমল গলায়,
-” তুমি পৃথিবীর সবথেকে দামী জিনিস। আমার ছোট্ট হার্টবিট। জাস্ট ওয়াচ মি; আমি তোমার জন্য বেস্ট ভার্সন অফ মাইসেল্ফ হবো। প্রমিজ, আমি একজন বেস্ট বাবা হবো। শুধু আর শুধুই তোমার জন্য আমার দুনিয়া নতুন করে সাজাতে ইচ্ছে করছে।”
অদ্রিকার চোখের কোণে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা আনন্দাশ্রু। বলল,
-” আমি জানি সার্থ তুমি খুব ভালো একজন বাবা হবে। তুমি একজন ভালো বন্ধু ছিলে আমার। তারপর একজন ভালো জীবনসঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করেছো। এখানেও তুমি সফল। তোমাকে নিয়ে আমার এতটুকু অভিযোগ নেই। তুমি সেই সুযোগই দাওনি।”
অদ্রিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সার্থক। অদ্রিকার মাথাটা ওর বুকের উপর। সার্থক কৃতজ্ঞ গলায় বলল,
-” আমার পৃথিবীটা রঙিন করে তোলার জন্য ধন্যবাদ অদ্রি। তুমি আমার সহধর্মিণী। আমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছো তুমি। আমার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে তোমার অবস্থান। সবশেষে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার সবটুকু উজাড় করে তোমাকে ভালোবাসতে চাই। যতটা ভালোবাসি এর চেয়েও বেশি ভালোবাসতে চাই।”
মেয়েদের জন্য পরম শান্তির স্থান হলো স্বামীর বুক। সেই শান্তির স্থানে মাথাটা রেখে আবেশে চোখবুঁজে নেয় অদ্রিকা। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে,
-” ভালোবাসি, ভালোবাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি তোমাকে।”
-” জানি তো।”
বলেই অদ্রিকার মুখটা তুলে দু’হাতে আঁজলা করে ধরল সার্থক। মৃদু হেসে বলল ফের,
-” আমি তুমি থেকে আমরা হচ্ছি। ফিলিংসটা অদ্ভুত সুন্দর! আমি স্পিচলেস।”
অদ্রিকা হেসে বলল,
-” আমাদের টুনাটুনির সংসারে সদস্যসংখ্যা বাড়তে চলেছে।”
সার্থক হেসে ফেলল। পরপর অদ্রিকার মুখটা আঁজলা করে ধরেই কপালে গাঢ় করে চুমু খেল।
অদ্রিকা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
-” যাও তো এখন ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। আমাকে বেরোতে হবে।”
-” এখন থেকে রুগি দেখা কমিয়ে দাও। একদম রেস্টে থাকবে।”
-” আরে এক্ষুনি দরকার নেই। আ’ম ফাইন। নো প্রব্লেম, ক্লিয়ার?”
-” তোমার অসতর্কতায় আমার বাচ্চার প্রব্লেম হলে আমি কিন্তু টলারেট করব না। বুঝেছো?”
অদ্রিকা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। বলল,
-” ওকে ওকে ডাক্তার সাহেব। অবশ্যই খেয়াল থাকবে।”
থেমে বলল,
-” প্রীতির সাথে আজ দেখা করতে যাবে?”
সার্থকের মুখটা মলিন হয়ে এল। বলল,
-” হ্যাঁ।”
-” আমি খাবার রান্না করে রাখব। নিয়ে যাবে কিন্তু।”
সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অদ্রিকা ম্লান গলায় আশ্বাস দিয়ে বলল,
-” মন খারাপ করো না, জেলে তো ন’মাসে মাস হিসেব করা হয়। সেই হিসেবে আর কিছুদিন গেলেই দু’বছর হবে। তারপর দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কে*টে যাবে। প্রীতিকে আমাদের সাথে থাকবে। ইচ্ছেকেও মাঝেমাঝে এনে দেখা করানোর ব্যবস্থা করিয়ে দিবো।”
__________
নীরব নাস্তা সেরে অফিসের জন্য প্রস্তুত। কোলে নিভ্রকে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে বাইরে যেতে যেতে প্রত্যাশাকে ডেকে বলল,
-” প্রত্যাশা আমি বাইরে আছি। ইচ্ছেকে নিয়ে এসো।”
বাসার সামনে থাকা ফুলের বাগান ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নীরব। কোলে থাকা নিভ্র ছোট্ট হাতে বাবার ইউনিফর্মে লাগানো ব্যাজটা ধরাধরি করে টানাটানি করছে। খুটতে খুটতে একসময় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আধো স্বরে বলল,
-” প্যা প্যা।”
নীরব তার তুলতুলে গালে নাক ছুঁইয়ে মুগ্ধ গলায় বলল,
-” হ্যাঁ পাপা।”
ব্যাজটা যেন বাবার কাছ থেকে আদায় করার এক নরম দাবী। নীরব বুঝেই হেসে ফেলল। এর মধ্যে প্রত্যাশা আসে। ওর কোলে নীড়। বলল,
-” ইচ্ছেকে আপু রেডি করে দিচ্ছে। একটু অপেক্ষা করুন, ও আসছে।”
সকাল থেকেই প্রত্যাশার চোখেমুখে কিছু বলার উসখুস ভাব। তবে বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে ও। নীড় বাবার কোলে যাবার জন্য হাত পা ছুঁড়ে ডেকে ওঠে,
-” পা পা পা।”
নীরব ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে এক হাতে নিভ্র আর অন্য হাতে নীড়কে সামলে নিল। দুহাতে দুটো ছোট প্রাণ। একজন ব্যাজ খুলে নিতে চায়, আরেকজন নীরবের মাথা থেকে ক্যাপটা খুলেই নিল হঠাৎই। প্রত্যাশা হেসে বলল,
-” একজনকে দিন, আপনার হাত লেগে যাচ্ছে তো।”
নিভ্রকে কোলে নেয় প্রত্যাশা। নীরব এবার ক্যাপটা নীড়ের মাথায় পরিয়ে দিয়ে দুজনের দিকেই তাকিয়ে বলল,
-” মাই চ্যাম্পস, তোমরা একদিন আমার থেকেও অনেক বড় হবে। যেদিন আমাকে হারিয়ে দেবে, সেদিনই হবে আমার আসল জয়।”
নীড়ের মাথায় ক্যাপ দেখে নিভ্র খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল, বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে চ্যাচালো,
-” এ দে দে দে।”
নীরব এবার নিভ্রের মাথায় ক্যাপটা পরিয়ে দিল। ফোকলা হাসিতে ঝলমল করে উঠল তার মুখ। দুজনেরই ওপর-নিচে চারটি করে দাঁত উঠেছে। ইঁদুরের মতো ছোট্ট ছোট্ট ধারালো দাঁত। নীড় তো রাগলে মাঝে মাঝে কামড়েও দেয়।
নীড় আঙুল মুখে দিয়ে চুষছে। নিভ্র বিজ্ঞের মতোন গোলগাল চোখ করে ক্যাপটা দুই হাতে ধরে নেড়েচেড়ে দেখছে।
প্রত্যাশা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,
-” নীরব, আজ কয় তারিখ?
-” ২০ এপ্রিল। বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় ৬ই বৈশাখ।”
প্রত্যাশার মুখ খানিকটা মলিন হয়ে গেল। সে তো জানেই আজ ক তারিখ। আশা নিয়ে একটু ইঙ্গিত দিয়ে বলল,
-” হুম। আচ্ছা এই তারিখে আপনার জীবনে কিছু স্পেশাল ঘটেনি? মানে বিশেষ কিছু আসেনি জীবনে?
নীরব মুখে একটুও ভাবান্তর আনল না। নির্লিপ্ত ভঙিতে বলল,
-” বৈশাখ মাসে যেমন কালবৈশাখী আসে, ঠিক তেমনি সতেরো বসন্তের এক ঝড়-তুফান, বজ্রপাত এসেছিল আমার জীবনে। এর চেয়ে স্পেশাল কিছু মনে পড়ছে না।”
প্রত্যাশার মেজাজ মুহূর্তেই ধোঁয়া তুলল। ফুঁসে উঠল,
-” বাহ্! আমি আপনার জীবনের ঝড়-তুফান! মানে আমি শুধু ঝামেলাই এনেছি আপনার জীবনে? তাই বলতে চাইছেন তো? চমৎকার! আর এই যে নিভ্র-নীড় দুটো রাজপুত্তুর। এত কষ্ট করে ওদের জন্ম দিলাম, তবুও আপনার জীবনের ঝড়-তুফান হয়েই রইলাম। ভালো কিছু আমার দ্বারা পাননি।”
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে দুষ্টু হাসি আড়াল করতে চেষ্টা করল নীরব। একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
-” নিভ্র-নীড় তো আমার পরিশ্রমের ফল।”
-” কী এমন পরিশ্রম করেছেন শুনি?”
নীরব দুষ্টু ভঙিতে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-” শুনবে? রুমে চলো।”
প্রত্যাশা লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল। মনেমনে অসভ্য বলে গালিও দিলো। তবে অভিমানী স্বরে বলল,
-” গতবারে তো ম্যারেজ ডে- র কথা আগে থেকেই বলতেন। এবারে ভুলে গিয়েছিলেন নাকি?”
-” উঁহু। ভুলা সম্ভব নাকি। বিকেলে ফিরে তোমাকে সারপ্রাইজড করতাম।”
বাগান থেকে একটা লাল গাঁদা ছিঁড়ল নীরব। প্রত্যাশার চুলের খোঁপায় গুঁজে দিল। বলল,
-” আজ শাড়ি পড়বে, সাজবে, আমি দুচোখ ভরে শুধু তোমাকেই দেখব।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল। আর হাসতেই গজ দাঁতটা উঁকি দিল। নীরব বিনিময় স্মিত হাসল। আলতো গলায় বলল,
-” ফুলে ভরে ওঠে বাগান, আর তোমার ঠোঁটের এক চিলতে হাসিতে ভরে যায় আমার হৃদয়। ফুল নিঃসন্দেহে সুন্দর। তবে আমার কাছে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি মনোহর তোমার ওই গজ দাঁতের মিষ্টি হাসি! চিরদিনের জন্য যার মায়ায় আমি বাঁধা পড়েছি।”
এরমধ্যে ইচ্ছে এসে ঝমঝমিয়ে বলল,
-” পাপা, মামণি আমি রেডি।”
নীরব সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” ভেরি গুড।”
নীরব বাইকে বসে। ইচ্ছে উঠে বসে দুই হাতে নীরবের পেট জড়িয়ে ধরল। এদিকে নিভ্র বাইকের সামনের হাতল শক্ত করে চেপে ধরে আছে। সে কান্না করছিলো তাই নীরব বলে– এক রাউন্ড ঘুরিয়ে আনি।
আস্তে গেয়ার দিয়ে বাসার সামনের রাস্তাটা থেকে ঘুরিয়ে ফিরে আসে নীরব। নিভ্রের চোখেমুখে সে কী খুশি! সে আরো ঘুরবে। প্রত্যাশা বলল,
-” দিন ওকে, ইচ্ছের স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে করলে নিভ্রের অভ্যাস হয়ে যাবে। তখন আপনার অফিস যাওয়ার সময় জ্বালাবে।”
নীরব ছেলের গালে চুমু খেয়ে প্রত্যাশার আরেক কোলে তুলে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে নীড়ের গাল ছুঁয়ে আদর দিয়ে বলল,
-” আসি বাবা। গুড বয় হয়ে থাকবে তোমরা।”
ইচ্ছে হাত নাড়িয়ে বলে,
-” বাই, মামণি। বাই ভাইয়ারা।”
এদিকে বাইক গেট পেরিয়ে যেতেই নিভ্র ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল।
-” প্যা প্যা।”
বলেই ভলিউম বাড়িয়ে দিল। প্রত্যাশা বলল,
-” প্যা প্যা নয়, পাপা। কাঁদে না, তোমার পাপা আসবে তখন আবার ঘুরো।”
দুই হাতে দু’জনকে নিয়ে ভেতরে যেতে থাকে প্রত্যাশা। নিভ্র কিচ্ছুতেই ভেতরে যাবে না। বাইরের দিকে ঠেলছে আর কাঁদছে। দু’হাতে দু’জনকে সামলাতে প্রত্যাশা হিমশিম খাচ্ছে। কান্নার শব্দ শুনে সবাই এগিয়ে আসল। শর্মিলা বললেন,
-” বড় দাদুভাই কান্না করছে কেনো, কী হয়েছে?”
নীলাশা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
-” নিভ্র কাঁদছে কেনো?”
প্রত্যাশা হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে নেয়। নীলাশা এগিয়ে ক্রন্দনরত নিভ্রকে কোলে নিল। এটাসেটা বলেও থামানো গেল না। তারপর নীলাশা বাইরে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করে পাখি দেখাতেই নিভ্রের কান্না থেমে যায়।
.
.
ঘড়িতে রাত নয়টা পঁয়তাল্লিশ। পুরো ড্রয়িংরুমটা আলোয় ঝলমল করছে। চারপাশে ফেয়ারি লাইটের ঝিকিমিকি, ছাদের নিচে ঝুলছে ছোট ছোট কাগজের ব্যানার। তাতে বড় অক্ষরে লেখা,
“Happy 2nd Anniversary Nirob & Prottasha”
মাঝখানে গোল করে সাজানো বেলুনের মাঝে রাখা ছোট্ট কেক টেবিল। কেকের চারপাশে গোলাপের পাঁপড়ি ছড়িয়ে রাখা। আরেক পাশে ঘাসের রঙের কার্পেট। তার উপর ছোট ছোট কুশন।
আজকের জন্য নীরবের গিফট করা নতুন পোশাক প্রত্যাশাসহ দুই ছেলের পরনে। নিভ্র-নীড় দুজনের পরনেই একই ড্রেস। লাল আর সাদার মিশেলে চায়না টিশার্ট, সঙ্গে অ্যাশ কালারের ডেনিম হাফ প্যান্ট।
প্রত্যাশার পরনে গাঢ় লাল-খয়েরি রঙের শাড়ি, তাতে হালকা পাথরের কাজ। চুল খোলা, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে ম্লান লিপস্টিক। বাড়তি কিছু নয়, কিন্তু তাতেই যেন চাঁদের গায়ে হাত বুলানো যায় এমন এক মোহ। অপার্থিব সৌন্দর্যে আবৃত লাগছে ওকে।
নীরব সাদা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে, হাতে ঘড়ি তারপর পারফিউমের স্প্রে করে নিল। চোখ ঘুরিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। প্রত্যাশা ছেলেদের রেডি করিয়ে দিয়ে সেটা দেখে বলল,
-” কী দেখছেন এতো?”
-” তোমাকে?”
-” নতুন নাকি? রোজই তো দেখেন।”
-” লাল শাড়িতে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। চোখ সরানো যাচ্ছে না। একদম নতুন বউ বউ মনে হচ্ছে।”
প্রত্যাশা ঠোঁট চেপে হাসল। নীরব বলল,
-” আজ আমাদের দু’বছরের পথচলা পূর্ণ হলো।”
-” হুঁ।”
-” দু’টো রাজপুত্র পেয়েছি।”
.
আবির বেলুন গুলো সাজাচ্ছিল। আনিশা রেডি হচ্ছে রুমে। ইচ্ছে বেলুন নিয়ে উড়াচ্ছিল। নীলাশা এসে বলল,
-” ইচ্ছে, দুধটা খেয়ে নাও।”
নীলাশার হাত থেকে ইচ্ছে দুধটা নিল। নীলাশা বলল,
-” বসে খেতে হয় সোনা।”
পাশে থাকা কুশনে বসল ইচ্ছে। ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করে নীলাশার হাতে ধরিয়ে দিল। নীলাশা শাড়ির আঁচল টেনে ইচ্ছের ভেজা ঠোঁটজোড়া মুছে দিল। ইচ্ছে হাসি মুখে বলল,
-” থ্যাংকিউ বড় মাম্মা।”
নীলাশা বিনিময় আলতো হাসল। হঠাৎ বলল,
-” একটা কথা বলব, তুমি শুনবে?”
ইচ্ছে ঘাড় কাত করে বলল,
-” হ্যাঁ, শুনব তো।”
-” বড় মাম্মা না ডেকে তুমি আমাকে শুধুই মা ডাকবে, হ্যাঁ?”
-” মা?”
নীলাশা কেমন করুণ চোখে তাকাল। ইচ্ছে চট করে নীলাশার গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” ওকে মা।”
নীলাশার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। ইচ্ছে বলল,
-” আমার পাপা তো দিদুনকে মা ডাকে। দাদুভাইকে বাবা। উমম! আমি তোমাকে মা বললে, বড় পাপাকে তো বাবা বলতে হবে।”
নীলাশা বলল,
-” বাবা বলবে।”
-” ওকে। আচ্ছা মা আমার মাম্মাটা আর আসলোই না।”
আকস্মিক মুখটা ম্লান করে বলে উঠে ইচ্ছে। মুখটা দেখে নীলাশার বড্ড মায়া হলো। নীলাশা বাচ্চা মেয়েটাকে বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” আসবে সোনা, তোমার মাম্মা আসবে।”
ইচ্ছে মুখ তুলে নীলাশার দিকে তাকাল। টুপ করে গালে চুমু খেয়ে বলল,
-” তুমি খুব ভালো মা। আমাকে কত্ত আদর করো। মামণিও এত্ত এত্ত আদর করে।”
নীলাশা ইচ্ছের কপালে চুমু খেল। তারপর উঠে গ্লাসটা রেখে ফিরছিল। কানের দুলে চুল আঁটকে গেছে টের পেতেই নীলাশা চুল ছাড়াতে থাকে। এমন সময় চেনা স্পর্শ অনুভব করে হাতে, কাঁধে উষ্ণ নিঃশ্বাস। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নিভান বলল,
-” আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।”
নিভান যত্ন করে কানের দুলে জড়িয়ে থাকা চুলগুলো ছাড়িয়ে দিতে দিতে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,
-” নীলাশা, নীল শাড়িতে তোমাকে দেখে মনে হয় নীলাম্বরীর মূর্ত হয়ে নামা কোনো দেবী। শান্ত, কোমল, অথচ মায়ায় গাঢ়। চোখ ফেরানো যায় না তোমার কাছ থেকে। নীল শাড়িতে তোমাকে অভাবনীয় সুন্দর লাগে!”
নীলাশার মুখে রক্তিম আভা পড়ল। হাসি ফুটল অধরে। কিছু হাসি, কিছু চোখের পানি, কিছু পাওয়া আর কিছু অপূর্ণতা নিয়েই আমাদের জীবন। নিভানের মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে নীলাশা ধন্য। একটা অপূর্ণতা, ঘুচানো যাবে না। তবে নিখাদ ভালোবাসা, যেকোন অবস্থাতেই পাশে থাকা এমন জীবনসঙ্গীই বা কজন পায়। এখন আর আগের মতো খারাপ লাগে না নীলাশার। একটা আক্ষেপ রয়েই যাবে। তবুও ইচ্ছে, ছোট্ট নিভ্র-নীড়ের মা হয়ে থাকতে চায় ও। ওদেরকে বুকে নিয়ে শুণ্য বুকের হাহাকার মেটাতে চায়।
নীরবের কোলে নিভ্র, প্রত্যাশার কোলে নীড়। এদিকে নিভান-নীলাশা সামনের দিকে দাঁড়িয়ে। শর্মিলার সাথে আনিশা দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে নীরব-প্রত্যাশার সামনে। আবির ফোন নিয়ে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। নীরব ছুরিটা তুলতে তুলতে বলল,
-” চলো কেক কাটি।”
-” হুম।”
প্রত্যাশা আলতো হাতে নীরবের ধরা হাতের উপর হাতটা রাখল। কেক কেটে নীরব একহাতে এক টুকরো তুলতে নেয়। ছোট দাদানের ইতস্তত দূর করতে আবির বলল,
-” ছোট দাদান ছোটো ভাবীর মুখের সামনে ধরো। ছবি তুলে রাখি, স্মৃতি থাকবে।”
ভয়ে ভয়ে বলল আবির। ভেবেছিল নীরব ধ’ম’ক দিবে, কিন্তু না নীরব আজ সেরকম কিছুই করল না। বরং হাতটা বাড়িয়ে প্রত্যাশার মুখের সামনে ধরল। প্রত্যাশা হা করে মুখে নিবে ঠিক তক্ষুনি নীড় থাবা মারল। সমস্ত কেক, ক্রিম হাতে মেখে নিলো। সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। নীড় মাখানো হাতটা প্রত্যাশার গালের সাথে ধরল। প্রত্যাশার গালে কেকে তেল চিটচিটে হয়ে গেল। প্রত্যাশা বলল,
-” নীরব দেখেছেন নীড়ের কাজ! আমি কী আর এমনি এমনিই বলি, আপনার ছোট ছেলের খাইখাই স্বভাব আছে।”
নীলাশা মজা করে বলল,
-” নীরব ছেলেদের না দিয়ে বউকে দিতে গিয়েছো, এইজন্য বোধহয় নীড় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।”
নীরব মৃদু হেসে বলল,
-” ঠিক বলেছেন ভাবী।”
নীরব দুই আঙুলে কেক নিয়ে প্রথমে নিভ্রের মুখে, তারপর নীড়ের মুখে দিল। ওরা দুজন জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটেচেটে খেতে থাকল। আর মুখটা কিঞ্চিৎ বিকৃত করল। নীরব ইচ্ছেকেও কেক খাইয়ে দিল। নীরব চারপাশে তাকিয়ে মুচকি হাসল। নিভ্র-নীড়ের মুখে কেক লেগে আছে, প্রত্যাশার গালে ক্রীমের ছোঁয়া, ইচ্ছের চোখে উচ্ছ্বাস। নীরব মুগ্ধ কণ্ঠস্বরে বলল,
-” আকাশে আজ পূর্ণিমা। চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে নিজের মত করে। কিন্তু আমাদের আসল পূর্ণিমা তো এই ঘরে। এই মুখগুলোয়, এই হাসিগুলোয়। আকাশের পূর্ণিমার চাঁদটা বাইরে আলো ছড়াতে ব্যস্ত। আর ভেতরে আমাদের তিনটা চাঁদের আলোয় পুরো বাড়ি আলোকিত। এদের হাসি, আনন্দ, কোলাহলে এভাবেই সময়টা থমকে যাক। এটাই তো এক টুকরো স্বর্গীয় সুখ।”
❝ সমাপ্ত ❞