মহুয়ার রাতদিন পর্ব-০২

0
15

#মহুয়ার_রাতদিন. ২ ✍️ #রেহানা_পুতুল
মহুয়া তার মেয়ের স্বাভাবিক মৃ* ত্যু মেনে নিতে পারে না। তার সন্দেহের তীর চলে যায় অন্য কারো দিকে। সে তার মেয়েকে কোলে জড়িয়ে ধরে উঠানে হাত পা আছাড়িপিছাড়ি করে বিলাপ করে যাচ্ছে। মহুয়ার বাবা,মা এবং প্রতিবন্ধী ছোট ভাইটাও এলো। তারাও কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলছে। এই ভিতরে আমানের কাছেও খবর চলে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ ভিডিয়ো ফোন দিলো তার বড় ভাবির মোবাইলে। সে কান্না করছে আর মহুয়াকে বকছে অভিযোগ করে। কেন মহুয়া মেয়ের দিকে ভালো করে লক্ষ্য রাখল না। মহুয়া আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল।

সে ভিডিওতে স্বামীকে শুনিয়ে চিৎকার করে বললো,
“আমার মেয়েকে আম্মা ইচ্ছে করে পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমি কিছুই বলিনি এতদিন। চাইনি তুমি মাকে ভুল বুঝো। অসন্তুষ্ট হও মায়ের উপরে। বুলবুলি পেটে থাকতেই উনি বলছে, আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হলে মা,মেয়ে দু’জনকেই আগুনে পুড়িয়ে মারবে। কারণ মেয়ে হলে নাকি লস। ও পেটে থাকতে আমি ঠিকমতে খেতে পারিনি। দেয়নি একটু বাড়তি খাবারও। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছি। বুলবুলি জন্মের পরেও আমি ভালো কিছু খেতে পারিনি। এজন্য বুলবুলি তেমন বুকের দুধ পেত না। রোগার মত বড় হচ্ছিলো আমার বুলবুলি। বুলবুলি তোতলা কেন হয়েছে? ওই যে আমাকে দিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়াইছে। তাই। আজ আমিতো উনার সাথে ধানের কাজে ব্যস্ত। বুলবুলিকে শেষ দেখলাম উঠানে। উনি দেখলো,একদিকে মেয়ে। আরেকদিকে তোতলানো। ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। বড় হলে একে বিয়ে দিতে খরচ বেশি হবে। এর বেঁচে থেকে কাজ নাই। উনি ছেলের সামনে এক রূপ দেখায় বউকে নিয়ে। আড়ালে তার বিপরীত রূপ দেখায় বউয়ের সাথে। সাপের খোলসের মতো রূপ পাল্টাতে পারে উনি।

আমান কিছু বলতে পারে না। আহাম্মকের ন্যায় মহুয়ার দিকে চেয়ে থাকে। কাকে বলবে? তার মা এমন করতে পারে তা তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
তফুরা ঝাঁঝালো অথচ করুণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো আল্লাগো! বলে। খোদার আরশ কাঁইপা উঠবো এক মায়ের নামে হুদা বদনাম দিলে। এই বলে তিনি মহুয়ার মুখোমুখি বসা বড় বউয়ের হাত থেকে ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন। জীবন দিয়ে ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন।

“বাবা,তুই মার কথা একিন কর। বউর এখন পাগলের দশা। কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাইছে। তরতাজা মাইয়া মইরা যাওনে কলিজায় কামড় মারছে তার। তাই উলটাপালটা কতা কইতাছে। নামাজ পইড়া আমার নাতনির লাইগা দোয়া করিস। অয় ছিলো একটা পবিত্র ফুল। আল্লায় যেন তারে জান্নাতের ফুল বানায়া রাখে। ”

আমান ফোন রেখে দেয়। মায়ের কথা শুনতেও তার ভালো লাগছে না। তার কাছে সবকিছু অসহ্য লাগে। আদরের মেয়েটাকে একটু ছুঁয়েও দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ কেন তাকে দিল না। সেদিন আর কাজে যায় না আমান। সারাদিন বিষন্ন মনে একা রুমে শুয়ে বসে ছিলো।
বুলবুলির দাফন সম্পন্ন হলো। আমানদের ঘরের পরিবেশ বিষন্ন। তার বাবা নেই। বড় ভাই চাকরি করে অন্য জেলায়। মহুয়াকে সন্ধ্যায় তার বাবা,মা নিয়ে যেতে চাইলো। বাধ সাধলো তফুরা।
রোষপূর্ণ গলায় মহুয়ার বাবা,মাকে তিনি বললেন,

” ইনসাফটা হইলো? আপনাগো না হয় ফসল নাই,জমি নাই,ধান নাই,কাম নাই। কিন্তুক আমাগো ত গৃহস্থগিরি আছে। উঠান ভরা ধান। কামের মাঝে বউ ক্যামনে যাইবো? কাজ কাম করলে মনদিলও ভালা থাকবো। শোক কম লাগবো। মন পুড়লে গোরস্থানে গিয়া মাইয়ার গোর দেইখা আসতে পারবো। আপনাগো লগে যাওনের কাম নাই। ধান গোলায় উইঠা গ্যালে পরে যাইবো নি। এহন গ্যালে আমার দুয়ার বন্ধ হইয়া যাইবো হের লাইগা।”

মহুয়ার বাবা,মা দমে যায়। মহুয়ার দু’চোখ জুড়ে প্রবল বর্ষন। যেন বান নেমেছে তার চোখজোড়ায়। মহুয়ার মা একপাশে নিয়ে মেয়েকে বোঝায় দরদমাখা সুরে,

“মারে,থাক পইড়া এইখানে। আমাদের চাইতে ত এরা ভালো অবস্থানে আছে। জামাই বিদাশ থাহে। তিনবেলা পেটভরে চাইরটা ভাত খাইতে পারতাছস। বাবার বাড়ি ত হেইয়াও জুটব না কিসমতে। গরীব বাপের মাইয়া তুই। আর তোর বাপ বেমারের লাইগা মিলে রোজ যাইতে পারে না। তার বদলে তোর প্রতিবন্ধী ভাই যায়। ওইতো আর তোর বাপের কাম করতে পারে না। ওই হেগো মিল ঝাড়ু দেয়। মাইনষের ধান চাইল বস্তায় ভইরা দেয়। চা,বিড়ি,পান,সুপারি, নাস্তাপানি আইনা দেয়। এমন ফুট ফরমায়েশ খাটে। বিনিময়ে মাস হইলে তারা কিছু দেয়। এতে হেগো বাপ বেটার হাত খরচ চলে। আমিতো আগের মতই হাঁসমুরগি পালি,ছাগল পালি,সবজি চাষ করি। এগুলা বেইচা সংসার চালাই।”

মহুয়ার সারামুখ রক্তিম হয়ে উঠে তীব্র অভিমানে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,

“আমিতো বিয়ে বসতে চাইনাই আম্মা। পড়ালেখায় ভালো ছিলাম। ইচ্ছা ছিলো পড়াশোনা করে বাবার ডাল হবো ছেলের মতো। চাকরি নয়তো ব্যবসা করবো। যেহেতু মিরন শারীরিকভাবে অস্বাভাবিক। তাই ওর হিসেব ত বাদ। নাহ,বিদেশি ছেলে পেয়ে তোমরা দুজন উতলা হয়ে গেলা বিয়ে দেওয়ার জন্য। ইন্টারের খরচ টিউশনি করে আমিই বহন করতে পারতাম। কলেজেও ভর্তি হতে পারলাম মা। জামাইর বাড়িতে হাঁড়ি ঠেলতাছি আর চোখের পানি ফেলতাছি। কত শখ আছিলো কলেজে পড়বো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহুয়া।

“এখন এইসব বইলা আর কী লাভ মা। সবই মালিকের ইশারা মাত্র। বুইঝা শুইনা চলিস ননদ,হড়ির লগে। রয়ে সয়ে থাহিস। আমরা অহন যাইগা। কয়দিন পর যাইস বাড়ি।”

মহুয়ার মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে বলল তার মা। পরে তারা তিনজন চলে যায়।
অল্প কয়দিনের মাথায় ঘরের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলো। মহুয়ার মনের অবস্থা বেগতিক। যেদিকে তাকায় সে বুলবুলিকে দেখতে পায়। প্রলাপের মতো বকতে থাকে নিজে নিজে। আপন মনে বুলবুলির সাথে কথা বলে। গল্প শোনায় বুলবুলিকে। রূপকথার গল্প। রাজকন্যার গল্প। অচিনপুরের গল্প। তার কল্পনার বুলবুলি পিটপিট চোখে মায়ের মুখপানে চায়। মহুয়ার এমন বিষয়গুলো আমান শুনতে পায় বড় ভাবির কাছে। নিজেও ভিডিও কলে দেখে। আমান ঠিক করে বাড়ি আসবে। মহুয়া তার সান্নিধ্য পেলে হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তারপর সত্যি সত্যি আমান বাড়ি আসে তিন মাসের ছুটি নিয়ে। মহুয়ার আর বাবার বাড়ি যাওয়া হয় না। ছেলের কাছে তফুরা কোন অভিযোগ করে না মহুয়ার দেওয়া সেই অপবাদ নিয়ে।

বরং আমান যখন মাকে বলে,
“আম্মা, মহুয়ার কথায় রাগ পুষে রাখবেন না মনে। তখন তার স্থানে আমি হইলেও অমন কিছু বলতাম।”

তখন তফুরা তাকে প্রবোধ বাক্য শোনায়।

” নারে বাপ। আমি এই নিয়া তোরে বা হ্যারে কিছু কইছি? কইনাই। আর কমুও না। তহনকার কথা তহনই শ্যাষ। তারপর বউ আর ভুলেও অমন কতা কয়নাই। আচম্বিতে শোক পাওনে তার বেরেন ছুইটা গ্যাছে।”

মহুয়া সারাদিন ঘরের সব কাজগুলো করে। রাতে বিছানায় গেলে আমানের সান্নিধ্য পায়। আমান মহুয়ার পিঠে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মধু মধু স্বরে বলে,

“বুলবুলির শোক ভুলতে হইলে আরেকটা বুলবুলি তোমার কোলে আসা জরুরী। সত্যি বলতে এরজন্যই ছুটি নিয়ে এলাম।”

মহুয়া পুলক অনুভব করে স্বামীর কথায়। লাজ লাজ চোখে স্বামীর চোখে চোখ রাখে। রোজ রাতে আমান ও মহুয়া একাধিকবার দৈহিক সম্পর্কে মিলিত হয়। তিনমাস ফুরিয়ে আমানের চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। এমন এক দুপুরে মহুয়ার গা গুলিয়ে এলো। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ঘরের পিছনে গিয়ে সে হড়বড় করে বমি করে দিলো। ঘরে এসে বয়াম খুলে আমের আঁচার মুখে পুরে দিলো।

সেদিন বিকেলেই আমান মহুয়াকে গাইনি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলো। পরিক্ষা করে নিশ্চিত হলো মহুয়া মা হতে চলেছে। আমান খুশী হলো। মহুয়ার চোখেমুয় দীপ্তি ছড়িয়ে পড়লো। বাড়িতে এসে সবাইকে জানালো আমান। তফুরা খুশী হলো অন্যদের মতো। রাতে আমান মহুয়ার কপাল,গাল,ঘাড় চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো। সারা পেটে আদর করলো। পরেরদিন মহুয়াকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলো। মহুয়া আবার মা হতে যাচ্ছে। এই খুশীর খবরে তার বাবা,মা,ভাই খুশী হলো।

আমান চলে যায় আবার বিদেশে। যাওয়ার আগের রাতে মহুয়াকে বুঝিয়ে বলে,যেন তার মায়ের সাথে আগের মতই ভালো করে চলে মহুয়া। রাগের মাথায় যেন বাড়াবাড়ি রকমের কিছু না বলে। মহুয়া আমানের বুকে মাথা রাখে। মাথায় চুলের মাঝে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলে,

একদিকে আপনি নেই। আরেকদিকে আপনার মায়ের অনাদর,অবহেলা,তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলা রাত-দিন। সব মিলিয়ে আমার রাত-দিন কেমন যায়, সেতো কেবল আমিই জানি আর আমার অন্তর্যামী জানে।

তফুরা মহুয়াকে একটু বাড়তি খাবার খেতে দেয় মাঝে মাঝে। অতিরিক্ত খাটুনির কাজ করায় না। কোন বকাঝকাও করে না। কাজের ভুল ধরে না। কারণ তফুরার বিশ্বাস প্রথম যখন মেয়ে হলো,এবার নিশ্চয়ই ছেলে বাবু জন্ম নিবে।

কেটে যায় ছয়মাস। তারপর তফুরার আদেশে ননদ সীমা মহুয়াকে নিয়ে একটি সরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যায় আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে। রিপোর্ট হাতে পেলো। সবাই জানলো এবারও মহুয়া কন্যাসন্তান জন্ম দিবে। তফুরার মাথায় যেন সাত আসমান ভেঙ্গে পড়লো। প্রথম নাতি ছেলে চাই তার। মেয়ে নই।

তফুরা মুখ বিকৃত করে। হিংস্র পশুর ন্যায় বলে উঠে গোপনে,
“আগেরটারে জিন্দা মারছি। এইটারে প্যাটের ভিতর রাইখাই মারতে হইবো। মরা বাচ্চাতো কত কারণে হইতেই পারে। সাপও মরবো লাঠিও ভাঙ্গবো না।”

এদিকে ভয়ে মহুয়ার হৃৎপিণ্ডটা ছলকে ছলকে উঠছে। কোন অশুভ শক্তি যেন তার কলজেটা খাবলে খাবলে খাচ্ছে।
তারপর এক রাতে….

চলবে…২