মহুয়ার রাতদিন পর্ব-০৩

0
7

#মহুয়ার_রাতদিন. ৩✍️ #রেহানা_পুতুল
এদিকে ভয়ে মহুয়ার হৃৎপিণ্ডটা ছলকে ছলকে উঠছে। কোন অশুভ শক্তি যেন তার কলজেটা খাবলে খাবলে খাচ্ছে।
তারপর এক রাতে মহুয়া, তার বড় জা,ও শাশুড়ীর সাথে ভাত খেতে বসলো অন্যসব রাতের মতোই। রাহিমার ছয় বছরের ছেলে রাব্বিও বসেছে। সে বেশী ছোট চাচী মহুয়ার কাছেই থাকে। মহুয়াকে রাব্বি ছোটাম্মু বলেই ডাকে। মহুয়া রাব্বিকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। ছোট্ট শিশুরা ফুলের মতো। নিষ্পাপ! নিখুঁত! তাদের কে না ভালোবেসে থাকা যায় না। মহুয়া রাব্বিকে খাইয়ে দিলো আগে।

এই সময়ে রাহিমা ও তফুরার খাওয়া শেষ হয়ে গেলো। তারা উঠে গেলো। রাব্বি মহুয়াকে তাড়া দিয়ে বলল,

“তুমি খাইবা না ছোটাম্মু?”

“খাবো বাবা। তোমার খাওয়া শেষ হলেই।”

রাব্বির খাওয়া শেষ। সে উঠে চলে গেলো ঘুমানোর জন্য। মহুয়া দেখলো পানির জগ প্রায় খালি। পানি নেই। সে জগ নিয়ে উঠানে গেলো। নলকূপ চেপে জগ ভরে নিলো। ঘরে এসেই দেখে একটি বিড়াল তার ভাতের প্লেটে মুখ দিয়েছে। সে ভাতের প্লেটখানা ঘরের বাইরে নিয়ে একপাশে ঢেলে দিলো। মনে মনে বলল,

“হায়রে বিলাই,অভাগীর রিজিকে তুইও ভাগ বসালি। তুই খা আজ আমার ভাত।”

এই বলে বেজার মুখে মহুয়া ঘরে চলে এলো। টিনের বড় কৌটাটা নামিয়ে নিলো। ঘরে ভাজা কিছু শুকনো মুড়ি লবন পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে নিলো। শুয়ে গেলো তার রুমে গিয়ে।
কিছুক্ষন পর রাহিমার গলার শব্দে মহুয়া উঠে গেলো।

“কী হয়েছে ভাবি?”

“আরেহ আমাগো ঘরের দুয়ারের সামনে উঠানে বিলাই একটা মইরা পইড়া আছে।”

তফুরাও উঠে এলো। দেখলো। বলল,

“কথা না বাড়ায়া অন্যদিকে নিয়া ফালায়া দাও। কোনদিক থেইকা কী খাইয়া আইছে, কে জানে।”

মহুয়ার সারামুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো। ঠোঁট শুকিয়ে এলো। ভীরু ও উৎকন্ঠাজনিত গলায় বললো,

“ভাবি,ওরে ত আমার প্লেটের ভাত দিছি খেতে। আমি জগ ভরতে গেলাম বাইরে। তখন বিলাইটা আমার ভাতে মুখ দিছিলো।”

“কস কী? তোর ভাতের থালায় কী এমন আছিলো যে খাইয়াই বিলাইটা মইরা গ্যালো?”

তফুরা ঝাঁঝিয়ে উঠলো মাথা দুলিয়ে। মহুয়ার মুখপানে দৃষ্টি তাক করলো।

বললো,
“তুমি সত্যই ভাত খাওনাই? বিলাইরে দিলা?”

মহুয়া শ্লেষের হাসি দিলো ঠোঁট বাঁকিয়ে। কণ্ঠে উষ্মা ঢেলে বলল,

“নাহ। আমি খেলেতো এখন আমি মরতাম এবং আমার পেটের সন্তানও। আপনি বিষ দিয়েছেন আমার ভাতে?”

তফুরা পারেতো নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে ফেলে। বিষিয়ে আসা কণ্ঠে বললো,

“তুমি কী আমাগো মা পোলারে আলাদা করতে চাও? এই ধান্দা তোমার দিলে? আমার ত মনে হয় তুমিই নিজেই ভাতে কিছু মিলাইছো,আমারে দোষী সাব্যস্ত করনের লাইগা।”

“আপনি জানেন এবারও আমার মেয়ে সন্তান জন্ম নিবে। তাই আপনি এটা করতে পারেন।”

শীতল গলায় বলল মহুয়া।

তারপর অনেকক্ষণ পালটা তর্ক,উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো তফুরা ও মহুয়ার মাঝে। তফুরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে মহুয়ার গালে সপাটে চড় বসিয়ে দেয় ফকিরনির মাইয়া বলে।
রাহিমা চুপ করে আছে নিরব দর্শকের মতো। মাঝেমধ্যে হুঁ হাঁ করছে জা ও শাশুড়ীর পক্ষ নিয়ে। তফুরা বড় বউকে অধিক স্নেহ করে। কারণ সে প্রথম সন্তান পুত্র জন্ম দিয়েছে। তফুরা রাগান্বিত মনে নিজের রুমে চলে গেলো। এক খিলি পান বানিয়ে মুখে পুরে দিলো।

রাহিমা তার রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মা,আপনে ত মহুয়ারে আসলেই অত দেখতে পারেন না মাইয়া জন্ম দিলো বইলা। আবার এইবারও মাইয়া জন্ম দিবো সে। আপনেই মনে হয় তার ভাতের থালায় কিছু মিশাইছেন।”

তফুরা মরিচ চোখে চাইলো রাহিমার দিকে। গজগজ সুরে বললো,

“আমি এত খারাপ মানুষ? বিলাই অন্যদিক থেইকা কিছু খাইয়া আইছে। চইলা যাও আমার সামনে থেইকা।”

রাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। ঘুমন্ত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়। মহুয়ার আঁখিজোড়া টলমল। নিস্তেজ হয়ে আসছে তার সমস্ত অনুভূতি। আধো ঘুমে আধো জাগরণে বাকি রাত পার করে। ভোরে আজান হলে বিছানা ছাড়ে। অজু করে এসে নামাজ পড়ে। কোরান তেলওয়াত করে। উঠে গিয়ে তার সমস্তকিছু গুছিয়ে একটি বড় সাইডব্যাগে ভরে নেয়। বোরকা পরে নেয়। ভাতিজা রাব্বির কাছে যায়। কপালে, গালে মায়ের মতো আদর করে। দু-চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরছে তার। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রাহিমা চোখ মেলে। পিটপিট চোখে তাকায়।

মহুয়াকে দেখেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে।
“কিরে কই যাস?”

“ভাবি কোন ভুলত্রুটি হলে মাফ করে দিবেন। রাব্বিকে মারবেন না জ্বালালে। একজন মায়ের কাছে পৃথিবী একদিকে বাকিসব একদিকে। আমার গর্ভের মেয়েকে বাঁচানো আমার ফরজ দায়িত্ব। এখানে থাকলে আমাদের মা,মেয়ের দু’জনেরই প্রাণ সংশয়। আপনার দেবর ফোন দিলে বুঝিয়ে বলবেন। আমাদের বাড়ি চলে যাচ্ছি আমি। আমার ভাতে উনিই বিষ মিশিয়েছে। এজন্যই সীমাকে দিয়ে চেকাপ করিয়ে আনলো আমাকে। অথচ তার আগে উনি ভালই চলছিল। উনার পরিবর্তিত নিষ্ঠুর আচরণ ও কর্ম আমাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছে।”

রাহিমা স্তব্ধ চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কবে আইবি আবার?”

“জানিনা। আমার রিজিকে যদি এই ঘরের ভাত থাকে তাহলে অবশ্যই আসা হবে। নয়তো আর আসা হবে না।”

ছলছল কণ্ঠে বলল মহুয়া।

ভোরের নির্মল হাওয়া,ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু,বাড়ি,ঘর,ফসলি জমি সব পিছনে ফেলে মহুয়া উঠে গেলো বড় রাস্তায়। একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলো বাবার বাড়ি। তাকে দেখে এক পাহাড় বিস্ময় নিয়ে তাকালো তার মা। সে মা,বাবাকে সবিস্তারে সব জানালো। তাদের মাথায় হাত। নিজেরাই খেতে পায় না ঠিকমতে তিনবেলা। মেয়েকে কীভাবে খাওয়াবে। বাচ্চা প্রসবের সময় ও পরের খরব কীভাবে বহন করবে। মহুয়া তাদের আস্বস্ত করে বলল,

“তোমারা চিন্তা করো না। টিউশনি করবো। নয়তো কিছু একটা করবোই।”

“ক্যামনে করবি? পারবি? আইচ্ছা যাক,খোদায় এক ব্যবস্থা করবই।”

তার বাবা ক্ষোভের সাথে বললো,

“এই বেডিরে ত শাস্তি দেওন দরকার। তুই কস বুলবুলিরেও সেই পুকুরে ফালাইদিছে।”

“বাবা,আমি বেঁচে থাকলে সাজা উনি পাবেই। অন্যায়কারীকে আল্লাহ তার প্রাপ্য সাজা দিবেই। হয় আগে নয় পরে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

মহুয়া নিজের রুমে চলে যায়। কাপড়চোপড়গুলো ব্যাগ হতে বের করে নেই। গুছিয়ে রাখে পুরোনো কাঠের আলনাটিতে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় নির্জন বাগানের ধারে। একটি প্রকাণ্ড আম গাছের গুড়ির উপর বসে পড়ে দুই হাঁটু ভেঙ্গে। স্বামীর বাড়ির সব স্মৃতি মনে পড়তেই ঢুকরে কেঁদে উঠে মহুয়া। নীড় হারা ডাহুকীর ন্যায় কাটিয়ে দেয় একবেলা।

ছোট ভাই মিরন সামনে এসে মহুয়াকে তার ভাষায় বলে,
“বুবু,মা খাইতে ডাকে।”

মহুয়া উঠে যায় ঘরে। ভাত খেয়ে নেয়। তার মা বুঝতে পারে মহুয়া বেশ কেঁদেছে। কিন্তু কিছুই বলল না। নিত্য অভাব যেখানে লেগেই আছে,সেখানে মেয়েকে প্রবোধ দিবেই বা কী বলে। কারণ আশু পরিস্থিতিতে সে নিজেও বিরক্ত।

সেদিন বিকেলেই মহুয়া তার এক চাচীর ঘরে যায়। সেই চাচীকে প্রসঙ্গত বলে,

“চাচী আমার সবই ত শুনলেন,পারলে আমাকে দুজন স্টুডেন্ট যোগাড় করে দিবেন। ফাইভ,সিক্স,সেভেনের হলেই হবে। এইটের হলেও পারবো। আপনাকে বলার কারণ হলো ঝুমার সাথে এ বাড়ির ও বাড়ির ছেলেমেয়ে পড়ে। তাই আপনি বা ঝুমা খোঁজ করলেই আশাকরি পেয়ে যাবেন।”

শুনে সেই চাচী খেদ ঝেড়ে বললেন,

“আইচ্ছা দেখি কী করণ যায়। একটা জালিম হড়ি তোর কপালে জুটলো। আরে বুড়ি, মাইয়া হইবো তো কী হইছে? মাইয়া হলো ঘরের লক্ষী,প্রাণ! আমরাতো সাত বইন আমার বাপের ঘরে। কই আমার দাদিতো আমারে মাইয়া নিয়া খোঁচা দেয়নাই আমার মায়েরে।
তোর মা,বাপও,এক্কেবারে বিদেশি পোলা পাই বিয়া দিয়া দিলো অল্পবয়সেই। অভাব কইরাও যদি পড়তে পারতি,তাইলে ভালো ঘরে বিয়া হইতো। বড় একখান চাকরিও পাইতি। ঘরের অভাবও দূর হইতো। নিজের জীবনও গড়ায়া লওন যাইতো।”

“থাক চাচী, মা বাপকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব আমার নিয়তি। যাই চাচী।”

“হ যা। সাবধানে যাইস।”

সেই সন্ধ্যায় তফুরা, মহুয়ার বাবাকে ফোন দিয়ে বললো,

“কথা মন দিয়া হুনেন,আপনার মাইয়া কার অনুমতি নিয়া ঘর থেইকা বাইর হইলো? তার এত বড় হিম্মত! তার প্যাটের মাইয়া নিয়া সে থাউক বাপের বাড়ি। আমার ঘরে তার আর জায়গা নাই। আমি আমার বিদেশী পোলারে আবার বিয়া করামু। সেই ঘরে পোলায় পোলা জন্ম দিবো।
মুরুক্ষু মাইয়া বিয়া করামু। তবুও বড় ঘরে করামু। আপনার মতন নুন আনতে পান্তা ফুরায়,এমন ঘরের মাইয়া আনুম না। রূপ দিয়া,বিদ্যা দিয়া কী পানি খামু আমরা।”

কথাগুলো বলেই চট করে মোবাইল রেখে দিলো তফুরা।

মহুয়ার বাবা বিষাদগ্রস্ত মুখে স্ত্রীকে ডাকলেন। মেয়েকে ডাকলেন। তফুরার বলা কথাগুলো শুনালেন। মহুয়া থম মেরে আছে বাজ পড়া পাখির ন্যায়। মুখ দিয়ে কোন শব্দই উৎসারিত হচ্ছে না তার। তার মা চোখের পানি ছেড়ে দিলো ঝরঝর করে।

তখন মাকে সে শান্তনা দিয়ে বললো,
“আরেহ মা কান্দো কেন? আমানতো আমাকে অনেক ভালোবাসে। তার মা বললেই হলো নাকি? একটা সম্পর্ক কী এতই সস্তা, বললো আর শেষ হয়ে গেলো। আমি আমানকে সব বুঝিয়ে বলবো। আশাকরি সে বুঝবে।”

মা,বাবার সামনে থেকে মহুয়া উঠে যায়। নিজের রুমে গেলো। আমানকে ভিডিও ফোন দিলো। আমান রিসিভ না করে কেটে দিলো। মহুয়া অডিও কল দিলো। বাট নো রিসিভ। রাতে মহুয়া খেয়ে শুয়ে পড়লো। মোবাইলে টুং করে আওয়াজ হলো। আমানের পাঁচ মিনিটের ভয়েজ নোট এলো হোয়াটসঅ্যাপে। মহুয়ার হৃদয় নেচে উঠলো ময়ুরের পেখমের মতো।

দোচালা বেড়ার ঘর তাদের। রাতের নির্জনতায় কথা পাশের রুম হতে শোনা যাবে। তাই মহুয়া কানে হেডসেট লাগিয়ে নিলো। মন দিয়ে নিবিড়ভাবে আমানের কথাগুলো শুনলো। একবার নয়। বারবার শুনলো। বুঝতে কী তার অসুবিধা হচ্ছে নাকি? শেষমেষ আমানও? কোথায় যাবে এবার সে? তার রাত-দিন বুঝি এবাবেই কাটবে তিমির আঁধারের ন্যায়। নাকি অন্যরকম কিছু ঘটবে তার জীবনে?

ভাবতেই মহুয়ার সমস্ত শরীর মন অসাড় হয়ে আসে। সে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে অশীতিপর বৃদ্ধার ন্যায়।

চলবে…৩