#মহুয়ার_রাতদিন. ৪ ✍️ #রেহানা_পুতুল
ভাবতেই মহুয়ার সমস্ত শরীর মন অসাড় হয়ে আসে। সে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে অশীতিপর বৃদ্ধার ন্যায়। চুরমার হয়ে যাওয়া মনকে প্রবোধ দিতে পারে না। শেষবারের মতো আবারো শুনলো আমানের কথাগুলো।
“মায়ের থেকে, ভাবির থেকে সব শুনেছি। বাইরে আরামে থাকি না। কষ্টে থাকি। খাটি। রোজগার করি। সেই টাকা বাড়িতে পাঠাই। কেন? পরিবারের সবাই যেন শান্তিতে থাকে। সেজন্য। কিন্তু শান্তি নাই। আমাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে তোমরা দুর্বল। তাই মা তোমাকে মাঝেমধ্যে এটা ওটা নিয়ে কটাক্ষ করে। অবজ্ঞা করে কথা বলে। এসব আমি মানছি। কিন্তু এর প্রতিশোধ হিসেবে ত তুমি আমার মায়ের নামে এত বড় অপবাদ দিতে পার না। গ্রামে পুকুরে পড়ে গিয়ে,আগুনে পড়ে গিয়ে প্রায়ই বাচ্চা মারা যায়। এটা সবাই জানে। এটা সত্য। কিন্তু তুমি বললা মা বুলবুলিকে ফেলে দিয়েছে পুকুরে। আবার গতরাতে বিড়াল মারা গেলো। এখন কাকতালীয়ভাবে তোমার ভাত এবং বিড়ালের মৃত্যু একই সময়ে হয়েছে বলে তুমি মাকে বিষ দিয়েছে বললা। তুমি চলে আসছো ভালো করেছে। আপাতত আর যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করার দরকার নেই। বাচ্চা হলে তার খরচ আমি দিবো। তোমার চোখে আমার মা সবসময়ের জন্যই এখন খারাপ। আবার মার চোখেও তুমি খারাপ। দুই খারাপ এক ঘরে বাস করা সম্ভব নয়। কী করবো বলো, মাকেতো লাইফ থেকে বাদ দিতে পারব না। নিজের খেয়াল রেখো।”
মহুয়া বালিশে মাথা হেলিয়ে শুয়ে আছে। কান থেকে হেডসেট আলগা করে নিলো। নিরবে অশ্রু ঝরতে লাগলো আঁখিজোড়ার কোণ বেয়ে। ক্লান্ত পথিকের ন্যায় মহুয়া তন্দ্রাঘোরে ডুবে গেলো। সকালে উঠে বিষয়টা জানালো না সে পরিবারকে। তারাও বুঝতে পারল না। মহুয়ার মেঘমুখ দেখে তারা ধরে নিলো বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্যই এমন মুখ গোমড়া হয়ে আছে মেয়ে। থাকাটাই স্বাভাবিক।
দুপুরে মহুয়াকে ডেকে পাঠালো সেই চাচী। মহুয়া গেলে তিনি জানালেন,
“শোন সকালে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর বাড়িতে গেলাম। দুইজন ছাত্রী ঠিক কইরা আইলাম তোর লাইগা। মিজানের ভাতিজি। নিজামের জমজ মাইয়া দুইটা আছে না,ইরা ও মিরা নাম। ফাইভে পড়ে এবার। তারা পড়বে তোর কাছে।”
” মিজান ভাইয়ের ভাতিজিরা এতবড় হয়ে গেলো? মাশাল্লাহ!”
“আরে তার বড় ভাই নিজাইমনা প্রেম কইরা অল্পবয়সে বিয়া করল না? এরবাদেই ত জমজ দুইটা মাইয়া হইলো। মিজানের মা ভাবি, নাতনিগোরে ছেলে মাষ্টারের কাছে পড়াইব না। মাইয়া টিচার খুঁজতাছে। বাও মতন পাইতাছে না।”
“মিজান ভাই কোথায় এখন? কী করে? নিজাম ভাই?”
“দুই ভাই চাটগাঁইয়াতে ব্যবসা করে। ফলের আড়ত নাকি। ভাবি কইলো। হুন,ভাবি কইলো তোরে হেগো বাড়ি গিয়া বিকালে পড়াইতে। আমি তোর সমস্যা খুইলা কইলাম। পরে রাজী হইলো তোগো ঘরে আইসা পড়তে। ইরা, মিরা আইজ থেইকাই পড়তে আইবো তোর কাছে। বেতন নিয়া সমস্যা হইবো না। ”
“আলহামদুলিল্লাহ চাচী। আপনি আমার সাত জনমের উপকার করলেন।”
মহুয়া ঘরে এসে বিষয়টা জানালো। তার মা,বাবা স্রস্টার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। ইরা,ও মিরা বিকেলে এসে মহুয়ার কাছে পড়ে চলে গেলো। তারা দুই বোন টিচার হিসেবে মহুয়াকে বেশ পছন্দ করলো। মহুয়ার মা তাদেরকে গাছের পেয়ারা পেড়ে দিলো খেতে।
আমান মহুয়ার সাথে নিজ থেকে সেভাবে যোগাযোগ করে না। যতটুকু করে দায়সারাভাবে। কিন্তু মহুয়া দমে নেই। সে রাতদিন আমানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। সে আমানকে হারাতে চায় না। সে চায় আমান তাকে বিশ্বাস করুক। তাকেই নিয়েই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বেঁচে থাকুক। কিন্তু আমান সেভাবে যোগাযোগ করে না মহুয়ার সাথে। আমানের নিরবতায়,দুরত্বে, মহুয়ার অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে যায় চৈত্রের মাঠের ন্যায়।
এভাবে কেটে যাচ্ছে মহুয়ার রাত-দিন। নয়মাস পূর্ণ হলে মহুয়ার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান। মহুয়ার খুশির অন্ত নেই। সাতদিন পরে সে মেয়ের নাম রাখে বুলবুলি। আমানদের বাড়িতে সে খবর দেয়নি। দেওয়ার মতো পথ আমানের মা রাখেনি। বরং বন্ধুর করে রেখে পুরো পথ। মহুয়া আমানকে ভয়েজ নোট দিয়ে বুলবুলির কথা জানিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে ছবি দিয়েছে। মেয়ে হয়েছে শুনে আমানের মাঝে কোন বাড়িতি উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। তবে কিছু টাকা পাঠালো নামমাত্র। এতে মা,মেয়ের একজনেরও প্রয়োজন মিটানো গেল না।
মহুয়া বুঝতে পারলো,তফুরা বিভিন্ন যুক্তি খণ্ডন করে করে ছেলের কান ভারি করে তুলেছে মেয়ে সন্তানের বিপরীতে। আর আমানও মায়ের কথাকে প্রাধান্য দিলো।
মহুয়া বেদনার স্বাস ছাড়ে। মাথা উঁচিয়ে আকাশপানে চায়। মহুয়ার মেয়ের যখন বয়স পাঁচ মাস। তখন তার বাবা ডায়রিয়া হয়ে মারা যায়। মহুয়া ও তার মায়ের মাথায় যেন হঠাৎ বজ্রপাত হলো। এতদিন তার বাবা মিলে গিয়ে কম বেশি কাজ করেছে। মাসে একটা আয়ের পথ ছিলো। এখন তাও বন্ধ হয়ে গেলো।
তার পরেরদিন ভোরে মহুয়ার বিধবার মা তাকে বললো,
“মারে শোন,তিনদিন বা পাঁচদিনের দিন তোর বাপের নামে একটু মিলাদ দিমু। কোরান খতম হইবো। সারাজীবন আমগোর লাইগা খাইটা গেলো হে,আর এখন আমরা তার লাইগা দুই চারজন মিসকিন যদি আল্লারওয়াস্তে না খাওইয়াতে পারি,আল্লাহ বেজার হই যাইবো। আমি মাটির ব্যাংকটা ভাইঙ্গা পালামু।”
মহুয়া মরা বিকেলের মত অবসন্ন গলায় মাকে বলে,
“ঠিক বলছ মা। আমার কাছেও টিউশনির কিছু টাকা আছে। আমরা মা,মেয়ে মিলে আব্বার জন্য খাওয়াবো।”
“মিরনরে পাঠিয়ে তার মহাজন চাচাকেও দাওয়াত করতে হবে মা।”
“তাতো অবশ্যই। ধর,মিরন এখনো তার মিলে আছে। তোর বাপে অনেকবছর তার মিলে শ্রম দিছে। তার টাকায় আমাগো প্যাটে দানা পানি পড়ছে।”
“তাইলে আমি গিয়ে বলল উনাকে।”
“হ মা, তুই অহনই বোরকা পিন্দা যা। উনি এখন মিলে আছে। দাওয়াত দিয়া আয়।”
ঠিক তখনই উঠান হতে মা,মেয়ের কানে রাশভারী পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। মিলের মহাজন সাবের উদ্দিন।
“কইরে মিরন,আছত ঘরে?”
মহুয়ার মা সাদা কাপড়ের আঁচলখানা দিয়ে মাথা ঢেকে নেয়। দরজার আড়ালে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। মহুয়া মাথায় ওড়না দিয়ে সামনের রুমে যায়। চেয়ার দেখিয়ে বিনীত গলায় অনুরোধ করে বলে,
“চাচা আসসালামু আলাইকুম। বসেন। মিরন বাইরে বসে আছে। আব্বার জন্য শুধু কান্না করে।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি মিরনের বড় বইন না?”
“জ্বী চাচা।”
“মাশাল্লাহ। সেই কবে তোমারে দেখছি। তোমার আব্বার লগে আমার মিলে গিয়া বইসা থাকতা। তখনো অনেক সুন্দর ছিলা তুমি। এহনো কম না। যাইহোক, তোমাগো খোঁজখবর নিতে আইলাম। নয়তো অন্যায় হইয়া যায়।”
” মা এতক্ষণ আপনার কথাই বলছিলো। আমি যেতাম এখন আপনার কাছে। দাওয়াত দেওয়ার জন্য। আব্বার জন্য ক’জন মিসকিন খাওয়াবো আমাদের সামর্থনুযায়ী। যদিও আমরা নিজেরাই মিস্কিন।”
সাবের ভদ্রতাসুলভ হাসি ছড়িয়ে দেয়। বলে,
“ওহ! আইচ্ছা। শুইনা ভালো লাগলো। এই নাও কিছু টেকা পয়সা রাখো। তুমি বাপের বড় সন্তান। তোমার ভাই না থাকার মতই। এখন তোমার,মা,ভাইর দায়িত্ব তোমার কাঁধে কিন্তু। এইটা রাত-দিন মগজে রাইখতে হইবো।”
মহুয়া সাবেরের করুণা নিতে অপারগতা প্রকাশ করছে। সাবের বুঝতে পারলো। কৌশলে বলল,
“আরেহ মেয়ে এভাবে ভাবো ক্যান? যাও পরে পোষাইয়া দিও মিরনরে দিয়া মিলের মইধ্যে। মিলাদ পাঁচদিনের দিন পড়াইয়ো। তাইলে আমি আসতে পারুম।”
সাবের এক খিলি পান মুখে পুরে চলে যায় হক মাওলা বলে। মহুয়া ও তার মা সাবেরের দানের উপর খুশী হয়।
তারপর পাঁচদিনের দিন মিলাদের অনুষ্ঠান হয়। বিকেলে সবাই চলে যায়।
সাবের মহুয়াকে ডেকে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ। পাক ভালো হইছে। আমি রাইতে মিল বন্ধ কইরা যাওনের সময় আবার আসুম। দরকার আছে। তোমাগে কামেই আইতে হইবো আমার।”
“জ্বি। অবশ্যই আসবেন চাচা।”
সেদিনই মহুয়া লোক মারফতে চুপিচুপি খবর পাঠালো বড় জায়ের কাছে। মিলাদে তিনি আসতে না পারলেও যেন রাব্বিকে অন্তত পাঠিয়ে দেয়। রাব্বির জন্য রাত-দিন তার মন পোড়ে। কিন্তু রাব্বির আসা হয় না। যার মাধ্যমে রাব্বির আসার কথা ছিলো, পাশের বাড়ির সেই ভাবি মহুয়াকে বলল,
“শোন, তোর জামাই সামনের মাসে আইবো শুনলাম।
তোর খুশী হওনের কাম নাই। তারে তার মা আনাইতাছে। বিয়া করাইবো। পোলায় পোলা পয়দা করবো নাকি। পাত্রী ঠিক হইছে। হুনছি তোরেও ছাড়বো না। দেখলি শখ কত,গাছেরটাও খাইবো। তলারটাও খাইবো। ”
মহুয়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তার সমস্ত পৃথিবী এক লহমায় দুলে উঠলো ভূমিকম্পের ন্যায়। পাশে থাকা বরই গাছের ডাল ধরে ফেললো শক্ত করে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বুকের পাঁজরগুলো যেন আমান নিজহাতে হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিচ্ছে।
চলবে…৪